“ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে…”
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
১।
মনেপড়ে “মেঘে ঢাকা তারা” ? মনেপড়ে উদ্বাস্তু হয়ে এপারে আসা সেই
বৃদ্ধ মাস্টারমশাই’র হাহাকার, তাঁর ছোটো ছেলে মন্টুর কারখানায়
চাকরি পাওয়ার ‘সুসংবাদে’? -
“ফেক্টিরিতে কাজ পেইয়েসে? লেবার? মইধ্যবিত্ত জীবনযাত্রার মান
কুন্ চড়ায় গিয়া ঠেকে দ্যাখ্…” … মাঝখানে
বড়মেয়ে বলেছিল “তা’তে কি হয়েছে? আজকাল ত’ এইসব চাকরিতেই উন্নতি বেশী...” এর উত্তরে
ঐ শেষ অংশটুকু “ মইধ্যবিত্ত জীবনযাত্রার মান কুন্ চড়ায়
গিয়া ঠেকে দ্যাখ্…” – এই উচ্চারনে কারো মর্মে
যদি প্রশ্ন জাগে, যে, তবে কি ঋত্বিক ঘটকও “লেবার” দেরকে দেখতেন সেই সহজাত মধ্যবিত্ত
দৃষ্টিভঙ্গিতে যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ তিনি নিজে...কিংবা তাঁর এই ছবি “মেঘে ঢাকা
তারা”ও অন্তিমে যাদের খারিজ করেদেয়? উচ্চারনটি ঋত্বিকের চবিতে হলেও বক্তা যে
মাস্টারমশাই তিনি মধ্যবিত্ত। আমাদের চিরচেনা ছাপোষা মধ্যবিত্ত। সুতরাং চ্ছিন্নমূল
হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মর্মে পুনরায় শিকড় প্রোথিত করবার সাধ থাকা স্বাভাবিক – ঠিক যেমন
ছিল ঋত্বিকের “সুবর্ণরেখা”র কেন্দ্র চরিত্রটির। সে’ও ছিল এক চ্ছিন্নমূল মধ্যবিত্ত।
সে’ও কাজ নিয়েছিল কারখানায়। অর্থাৎ সে’ও মন্টুর সমগোত্র। তার পরিণতিও অবশেষে যে
মন্টুরি পরিণতি সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরেকটু তলিয়ে দেখি ঐ মাষ্টারমাশাই’র অবচেতন
এবং “লেবার” শব্দটিকে।
মাষ্টার মশাই’র ঐ বাক্যে উচ্চারিত “লেবার” শব্দ আমাকে
মনেপড়ায় কৈশোরে, প্রথম যৌবনে শিক্ষাকরা একটি সংজ্ঞাঃ ‘যাদের শৃংখল ছাড়া হারাবার
কিছুনেই”... না, তারা “লেবার” নয়। – তারা ‘সর্বহারা’। আর ঐ সংজ্ঞা মতে সভ্যতার
আদিযুগ থেকে যারা “লেবার” তারা সকলেই সর্বহারা। শিল্প ও বিজ্ঞানে মিশরের পিরামিড
যতোই আকর্ষনীয় হোক্ সেইসব পিরামিড নির্মাণের নিমিত্ত যারা এনে জমা করেছিল সেই
অতিকায় প্রস্তর তারাও ছিল “লেবার”। তাদেরো ধরে আনা হয়েছিল নানাস্থান থেকে। চাবুকের
সামনে কাজ করতে হয়েছিল তাদেরো। আমাদের ভারতীয় বিশাল বিশাল মন্দির, মশজিদ, প্রাসাদ,
দুর্গও ঐসব “লেবার”দের শ্রমের উপরেই দণ্ডায়মান। কালে দাস ব্যবসা – যা সামন্ত
প্রভুদের দ্বারা চালিত হলেও সে’ও “লেবার” ধরে এনে কাজে লাগানোরই ব্যবসা। শিল্প
বিপ্লব ঐ ব্যবসার চরিত্রটা কিছুটা পালটে দিল। ক্রীতদাস’রা “প্রভু”র জমি চাষ বা
প্রভুর এলাকার রাস্তা বানানোর পরিবর্তে শ্রমিক হলো “প্রভুদের” কারখানার। তার আবাস
হলো কারখানার নিকটবর্তী বস্তি বা প্রভুর দেওয়া মনুষ্যবসবাসঅযোগ্য ‘কোয়ার্টার’। না
রইল তাদের শিকড়, না রইল তাদের সংস্কৃতি, না রইল তাদের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা।
সেই হিসেবে “লেবার”রাই প্রকৃত “সর্বহারা”। কৃষকরা নয়। হ্যাঁ,
চাষীরা সর্বহারা নয় কেননা তাদের “বন্ধন” ছাড়াও হারানোর কিছু ছিল, একদা। ছিল জমি।
ছিল গেরস্তি – তা যেমনই হোক্। কিন্তু শিল্পবিপ্লব ও তজ্জনিত “প্রগতি”র আগ্রাসনে
ক্রমে সেই সম্পন্ন চাষী প্রথমে হলো ভাগচাষী, অতঃপর ভূমিহীন কৃষক।
হাতুড়ির সঙ্গে যোগ হলো কাস্তের। এই অমানুষিক ব্যবস্থার
পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন পরলো শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের। –তথাপি, কস্মিনকালে একটি ভিটে
থাকার স্মৃতিতে অদ্যাপি মানুষ মশগুল। কাছাড়ের প্রত্যন্ত করিমগঞ্জের শন বিলের
বাসিন্দাদের মধ্যে যারা নিজেদের ‘দাস’ সম্প্রদায় বলেথাকে তারা নিজেদের, অদ্যাপি
হিন্দু মৎস্যজীবি ‘কৈবর্ত’ বা মুসলমান মৎস্যজীবি ‘মাইমাল’ দের থেকে নিজেদের একটু
উঁচু স্থান দিয়ে থাকে কেননা মৎস্য শিকারে বেড়িয়েপরা ‘মালো’দেরো বাসস্থান অনেক
সময়েই পাল্টেযায় মাছের যোগানের কমবেশীর নিরিখে। তাদেরো জমি জিরেত থাকেনা। তাই
তারাও একরকমের “লেবার”। এক রকমের যাযাবর। এক্রকমের সর্বহারা। - অথচ বর্তমান সময়ে
শনবিলের মূল জীবিকা, অদ্যাবধি, ‘মাছমারা’। তথাপি যেহেতু ‘দাস’ সম্প্রদায় মূলতঃ ছিল
চাষী তাই তারা নিজেদেরকে আলাদা ভাবতে চেষ্টা করে ঐ ‘কিছুনেই’দের থেকে।
সুতরাং “মেঘে ঢাকা তারা”র ঐ বৃদ্ধ মাষ্টারমশাই মূলতঃ শংকিত
হন ‘লেবার’ শব্দের অন্তর্গত ঐ অনিশ্চয়তা থেকে।
সভ্যতার আদিযুদ থেকে যারা “লেবার” তাদের সঙ্গে, ‘সভ্যতা’র “অগ্রগতি”
এনে যোগ করালো আরেকদল “লেবার”এর যারা গ্রামেগঞ্জে একদা ছিল কৃষক বা ছোটো ব্যাপারী।
যন্ত্রের জয়গানে যারা ঐ জমিটুকু বা ঐ ছোট্ট দোকানটুকু হারিয়ে এরা হাজির হলো শহরে,
নগরে, কারখানায়। এলো বাঁচবার আশা নিয়ে। যেমন এসেছিল “পথের পাঁচালী”র হরিহর রায়।
কিন্তু অবশেষে তার স্ত্রী’কে হতে হয়েছিল বড়লোকের বাড়ির দাসী। – অর্থাৎ নাগরিক
হওয়ার ঐ মুহুর্তেই তাদের আর হারাবার কিছু রইলনা সেই “বন্ধন” ছাড়া। - এরা “বল্লালী
বালাই”। বকলমে “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের” শিকার। আর প্রকারান্তরে ‘চিরস্থায়ী
বন্দ্যোবস্ত’, সে’ও শিল্পবিপ্লবেরি অবৈধ সন্ততি। প্রকৃত প্রস্তাবে সব রকমের
“প্রগতি” ই অবৈধ সন্ততি শিল্পবিপ্লবের। ক্রমে, শিল্পায়নের।
এই অমানুষিক শিল্পায়ন যা করে তা মূলতঃ মানুষের ও প্রকৃতির
পারস্পারিক সম্পর্কের ভারসাম্যের বিপক্ষে গিয়ে আমদানি করে যান্ত্রিকতার। অতি
উৎপাদনের। যে উৎপাদনের বন্টন কদাপি সুষম তো দূরস্থান, স্বাভাবিক হয়না। হতে পারেনা।
এই শিল্পায়ম মূলতঃ সৃষ্টি করে সেই শিকলের যা’তে শুধু কিছু মানুষ নয় যা’তে আজ বাধাপড়ে
আছে সমগ্র মানবসমাজ। এই শিকলে নিজের সন্ততিকে
বন্দী হতে দেখে হাহাকার করে ওঠেন বৃদ্ধ। মেয়ে আশ্বাস দেয় ?” ...
আজকাল ত’ এইসব চাকরিতেই উন্নতি বেশী” -
তাতে আরো আতঙ্কিত হন বৃদ্ধ।
তাঁর আতঙ্ক যে নেহাৎই অমূলক নয় তা প্রমাণিত হয়েপরে অচিরেই
যখন সেই “লেবার” ছেলের হাতকাটা যায় যান্ত্রিক গোলযোগে। মন্টু হাসপাতাল থেকে ফিরে
এলে তাকে দেখে নির্বাক হয়েযান সেই বেশী কথাবলা বৃদ্ধ। নির্বাক হয়ে যান কেননা তিনি
দেখতে পান আরো দূরের এক চক্রবাল যেখানে এমনি সংখ্যাতীত মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়ে এমনি
“লেবার” হওয়ার উদগ্র বাসনায় নিজের শিকড় ছেড়ে, ইচ্ছা, আদর্শ, মূল্যবোধ সব ছেড়ে এসে
ভিড় জমাচ্ছে দিল্লী, বোম্বে, বেঙ্গালোরের মতো শহরে। অবলীলায় আপনাকে তুলে দিচ্ছে ঐ
শিকলের বন্ধনে । তারা জানতেও পারছেনা তাদের হাত, পা শুধু নয় মগজ অবধি গিলে খেয়ে
নিয়েছে ঐ শিকল, ঐ বন্ধন, ঐ সভ্যতা, ঐ প্রগতি। ঠিক যেমন “সুবর্ণরেখা”র সেই
উদ্বাস্তু প্রোটাগোনিষ্ট যে আবার শিকড় পাওয়ার লোভে কারখানায় কাজ নেয়। পদোন্নতি হয়
তার। ঠিক। কিন্তু যে মুহুর্তে তার নিজিস্ব যে মূল্যবোধ তাকে তার মালিকের মনেহয়
অসহনীয় তৎক্ষণাত নড়ে ওঠে তার পায়ের তলার মাটি। অন্তিমে তার যে পরিণতি তা মন্টুর
চেয়েও ভয়ঙ্কর।
২।
শৃংখল ছাড়া হারানোর কিছু ছিলোনা আরেকদল মানুষেরো। তারা
পঞ্চপান্ডব। রাজত্বের পরিবর্তে পাঁচটি গ্রাম ভিক্ষা করেও নিস্ফল হওয়ার পর তাদেরো
আর হারানোর কিছু ছিলোনা কেবল “শৃংখল” ছাড়া – যে “শৃংখল”এ কৌরবপক্ষ তাদেরকে শুধু
রাজ্যত্যাগী, বনবাসী বা ফেরারই করেনি, তাদের জীবনকেও ঘিরে দিয়েছে মৃত্যুর চক্রান্ত
দিয়ে...
যে মুহুর্তে তারা টেরপেলো ঐ “শৃংখল”এর ভয়াবহতা সেই মুহুর্তে
যুদ্ধ ছাড়া আর তাদের কাছে রইলনা কোনো গত্যন্তর। ... কেন রইল না? যদি তারা চলে যেতো
বহু বহু দূরে, অন্য কোনো দেশে, বাহুবলে জয় করে নিয়ে আরো কিছু রাজ্য তারা রাজা হয়ে
বসতো অন্যত্র? – কৃষ্ণসহ যে রাজন্যবর্গ তাদেরকে সহায়তা করেছে তারাও নিশ্চয় সহায়তা
করত তেমন ক্ষেত্রেও ... কিন্তু তারা শিকড় উপড়ে চলেযেতে চায়নি। তারা প্রবাসী হতে
চায়নি। তাই অন্যত্র সম্রাট হওয়ার পরিবর্তে তারা, অন্তিমে, নিজবৃক্ষতলে, এক একটি
গ্রাম নিয়েই শান্ত, আনন্দিত থাকতে চেয়েছিল। ঠিক যে কারনে হোমারের ইউলিসিস্
যুদ্ধশেষে অধীর হয়ে উঠেছিল ইথাকা’য় ফিরে আসতে। দেবতাদের প্রবল সব চক্রান্তে
বারংবার বিধ্বস্ত হয়েও সে থামায়নি তার যাত্রা। জাহাজের মুখ ফিরিয়ে নেয়নি অন্যদিকে।
বনবাসপর্বে বকরূপী ধর্মের “জগতে সুখী কে” প্রশ্নের উত্তরে
যুধিষ্ঠির যখন বলেছিলঃ “দিবসস্য অষ্টমে ভাগে শাকং পচতি যো নরঃ ... অঋণী চ অপ্রবাসী
চ বারিচর মোদতে...” – তখনি আমরা জেনেছিলাম যে অন্তমে যুধিষ্ঠির অপ্রবাসী থাকবেনা।
পাঁচটি গ্রাম ভিক্ষা করে নিয়ে দিনের ষষ্ঠ কিংবা অষ্টম ভাগে , অঋনী-অপ্রবাসী
যুধিষ্ঠির শাকান্ন ভক্ষনেও সুখী থাকতে প্রস্তুত ছিল কেননা তার সুখের সংজ্ঞাটিই ছিল
ঐ। - অর্থাৎ ‘শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু নেই” –জীবনের থেকে সে চেয়েছিল একটি
মধ্যবিত্ত, থিতু জীবন। কিন্তু তা’ও দিতে যখন আপত্তি করলো কৌরবেরা তখন যুদ্ধ ভিন্ন
আর গত্যন্তর রইলনা যুধিষ্ঠিরের।
যাদের “শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই” তারা একদিন যুদ্ধে
নামবে। নামতে বাধ্য হবে। কিন্তু তার আগে তাকে অনুভব করতে হবে যে যদিও তার ফ্ল্যাট্
আছে, গাড়ি আছে, খেতাব আছে, ডিগ্রী আছে তথাপি সে এক ক্রীতদাস। মন্টুর মতো তারো হাত
কেটেগেছে, মগজ নিষ্ক্রিয়। কিন্তু মগজ নিষ্ক্রিয় থাকলে ঐ বন্দীত্বের বোধটি সে
টেরপাবে কিভাবে? – ইংলন্ডের শ্রমিকশ্রেনীও পায়নি। তাই মার্কস্-এঞ্জেল্সের
ভবিষ্যৎবানী সত্ত্বেও ইংলন্ডে ঘটেনি শ্রমিক-কৃষক অভ্যুত্থান। অন্ততঃ সেদিন।
আবার ইতিহাসে রয়েছে অন্য নজিরও। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমল
থেকে ইতিহাসে অনেক “ভাগ্যান্বেষী আর্য যুবা”র উল্লেখ আছে। তারা নানা সময়ে, নানা
যুদ্ধে নানান রাজার হয়ে লড়েছে, অনেকে যোগ দিয়েছে আলেকজেন্ডারের পক্ষে। তবে এদের সঙ্গে
আমাদের অমিলটি এই, যে, এদের এই “ভাগ্যান্বেষন” ঠিক আমাদের “বেটার অপর্চুনিটি”র
অন্বেষন নয়। মূলতঃ, সুভাষ বসু যাকে বলেছে ‘স্পিরিট্ অব্ এড্ভেঞ্চার’ – এ তা’ই।
আবার এমনও ঘটেছে যে
একটি প্রতিষ্ঠিত জনগোষ্ঠী চলেযেতে চেয়েছে অন্যত্র।
বেঁচেথাকার আশায়। ‘অপ্রবাসী’ নাহোক অঋনী থেকে দিনান্তে শাকভাত খাওয়ার আশায়। তেমনি
এক মহাযাত্রা ‘বাইবেল’এর এক্সোডাস। ঐ মহাযাত্রার মহানায়ক মোসেস্। কিন্তু সেই
মহাযাত্রা কেবলমাত্র ‘ভালো খাওয়াপরা’র তাগিদে নয়। জীবনকে একটি বৃহত্তর চক্রবালে
নিয়ে আসার প্রয়োজনে। ঐ প্রয়োজন যাত্রীদের সকলেই যে টের পেয়েছিল তেমন ভাববার কোনো
হেতু নেই। ঐ যাত্রার নানা পর্য্যায়ে, নানা সময়ে মোসেসের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছে
যাত্রীজনতা, তাকে আক্রমন করেছে। কিন্তু মাহাযাত্রী মোসেস্ জানতো এই যাত্রা এক
মহাযাত্রা। এই যাত্রার অন্তিমে এই আকাট মানুষগুলির মর্মেও দেখাদেবে জ্যোতি। -
হ্যাঁ, অবশেষে ঘটেওছিল তা’ই। স্বয়ং ঈশ্বর এসে দেখা দিয়েছিল মোসেস্কে।
হ্যাঁ, এ সকলি রূপকার্থে। যুধিষ্ঠির থেকে ইউলিসিস্ হয়ে
মোসেস্ এরা রক্তমাংসের কেউনয় আবার এই চরিত্রগুলির মর্মে যে ঐতিহাসিকতা নেই এমনো
নয়। ইতিহাসের নির্য্যাসে এরা রচিত। তাই এদের উদাহরন এসেপড়ে। এসেপড়বে। বারংবার। এসেপড়বে
এইকথাগুলিই সত্য বলে প্রমাণ করেযেতে, যে, অন্তিমে যা বৃহত্তর প্রানীসমাজের জন্য শুভকর
নয় তার বিপক্ষে এসে দাঁড়াবেই কোনো শক্তি। সেই শক্তি ‘সর্বহারা শ্রেনীর
একনায়কতন্ত্র’ই হোক্ আর মোসেসে’র এক্সোডাস্’ই হোক্। তবে আমি, ব্যক্তিগতভাবে, ‘সর্বহারা
শ্রেনীর একনায়কতন্ত্র’তে বিশ্বাস করিনা কেননা তা’ও অন্তিমে বলে সেই শিল্পায়নপ্রসূত
প্রগতির কথা’ই। এল্ভিন্ টফ্লারের ‘থার্ড ওয়েভ’এ বিপ্লোবোত্তর রাশিয়ার নগরজীবন
আর ধনতান্ত্রিক দেশের নগর জীবনের যে আপেক্ষিক আলোচনা আছে তা’তে এ বিষয়টি আরো
স্পষ্ট ও সুন্দর ভাবে বর্ণিত।
এখানে এসে মনে আসছে দুইজন মানুষের কথা। প্রথমজনের নাম রবি
কান্নন। পেশায় ডাক্তার। দেশে বিদেশে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাত। মূলতঃ
দক্ষিন ভারতীয়। কিন্তু চেন্নাই’এর রমরমা ক্যারিয়ার ছেড়ে গত ১৫ বৎসর যাবৎ তিনি
রয়েছেন আসামের প্রত্যন্ত শহর শিলচরে। ক্যান্সার হাসপাতালে। কেন? তাঁর জীবনের যে
লক্ষ্য তা কেবলমাত্র টিঁকেথাকার যে ক্ষুদ্র লক্ষ্যে, মূলতঃ অর্থসভ্যতার শিক্ষায়,
আমরা অসহায়-ধাবিত, তার প্রতিপক্ষে। ঐ প্রত্যন্ত শহরে একটি সফল দাতব্য হাসপাতাল গড়ে
তুলতে তিনি প্রবাসী। পক্ষান্তরে ডাক্তার
লক্ষণ (কুমার কান্তি) দাস, আরেক বিশ্বখ্যাত সার্জন, “চাল-কলা-বাঁধা’র বিদ্যে” কে
বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে পরেয়াছেন শিলচরের নিকটবর্তী একটি গ্রামে। ‘সুন্দরীমোহন সেবা
ভবন” নামের যে হাসপাতালটি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল ১৯৯১ সাল থেকে তারই দায়িত্ব
নিয়ে আঞ্চলিক জনগনের সেবায় তিনি অদ্যাপি নিয়োজিত। অন্তিমে যা বৃহত্তর প্রানীসমাজের
জন্য শুভকর নয় তার বিপক্ষে দাঁড়ানোর এমন উদাহরন অদ্যাপি বিরল নয়।
৩।
কিন্তু আমরা না’ত মৌর্য যুগের ভাগ্যান্বেষী, না’ত রবি
কান্নন। আমরা সেই “মেঘে ঢাকা তারা”র মন্টু।
আমরা ‘মন্টু’ জন্মসূত্রে। আমরা ‘মন্টু’ ঐতিহাসিক নিয়মে। যে
ইতিহাসের মধ্যে আমাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা – তার আকাশ বাতাস আমাদের জন্মের বহু পূর্বেই
হয়ে গিয়েছে পণ্য সভ্যতার, যন্ত্র সভ্যতার, অর্থ সভ্যতার মেঘে ঢাকা। অতএব জন্ম থেকেই
আমরা অক্ষম মেঘের গহনের তারাটিকে চিনে নিতে। ক্রমে অক্ষম এটুকুকেও অনুভব করতে যে আমরা
‘প্রবাসী’। সেই প্রবাসের মূল্য কোনো বড় আদর্শ নয়, বৃহত্তর লক্ষ্য নয়। আমাদের এই
প্রবাসের নিয়তি আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স্, আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ি, আমাদের বেতন,
আমাদের দামী সেল্ফোন... ইত্যাদি। এই সমস্তের নেশায় এই বনিক সভ্যতা আমাদের এমনি
বুঁদ করে রেখেছে, যে, আমরা এ’ও টের পাচ্ছিনা যে ‘মন্টু’র হাতের মতো আমাদের মাথাটিও
যে জন্ম থেকেই কেটেগেছে। বিকিয়ে গেছে। এখানে বিজ্ঞানী দেবল দেব’এর একটু অভিজ্ঞতা
মনেহয় অপ্রাসঙ্গিক হবেনাঃ ‘প্রলয়সাক্ষী (দেবল দেব’এর একটি কবিতা)র প্রেক্ষাপট আমার
কয়েক বছর আগের একটা অভিজ্ঞতা। কলকাতার কিছু আঁতেল ও পণ্ডিতদের একটা সেমিনারে আমি
জগৎজোড়া আবহাওয়ার পরিবর্তনের স্পষ্ট কারণ ও ভয়ানক ফলাফলের প্রেক্ষিতে অবিলম্বে
নিজেদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনবার কথা বলেছিলাম ; উন্নয়নের তাগিদে বড় বড় কারখানা বসানো, রোজগারের
তাগিদে প্লাস্টিক থেকে পিসিবি - যে কোনও পরিবেশধ্বংসী জিনিস
তৈরির কোম্পানিতে চাকরির উমেদারি করা, পয়সা হলেই গাড়ি কেনা,
বাড়িতে এ-সি মেশিন বসানো, --- এগুলো এখনি বন্ধ করে ভবিষ্যপ্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখানো উচিৎ,
এইসব বলেছিলাম। তাতে কয়েকজন বলেছিলেন, "আমাদের
সূর্য তো কয়েক বিলিয়ন বছর পরে নিভে যাবে। তাই বলে কি আমরা এখনি সব উন্নয়ন বন্ধ করে
গুহাবাসী হয়ে যাব?"
আমরা এখন কোন্ দিকে দাঁড়াবো? দেবল দেবের দিকে না ঐ “আঁতেল”টির
দিকে? আমি গাড়ি কিনে, এসি লাগিয়ে যে আমারই পরবর্তী প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছি
অসুস্থতার দিকে তা মেনে নেবো না’কি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অমূলক যুক্তি খাড়া করব?
আমি কোনোদিন শিকড়ের টান টের পাইনি বলেই কি অস্বীকার করব শিকড়ের সত্যকে? মনেপড়ছে
সেই কৈশোরে, প্রথম যৌবনে শোনা একটি গানঃ ‘আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দুটো দল / আর
মাঝামাঝি নেইত কিছুই/ এক পা’চাটা দালাল আর নয়ত/ এক লড়াকু মজুর হবি তুই/ কোন্ দিক,
সাথী কোন্ দিক্ / বল্ কোন্দিক বেছেনিবি তুই?
…”
“পা’চাটা দালাল” আর “লড়াকু মজুর” এর স্থূল প্রতীককে বাদ
দিলে যে বার্তাটি অদ্যাপি ভাস্বর তাহলো “কোন্ দিক, সাথী কোন্ দিক্ / বল্ কোন্দিক
বেছেনিবি তুই? …”
অন্তিমে বলতে চাই Max Frisch এর The Fire Raisers (১৯৫৩) নাটকটির কথা যার চুম্বক এই, যে, একটি শহরে কিছু
মানুষ অন্যের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরা আসে নানারকম ছদ্মবেশে। নাটকের
কেন্দ্র চরিতের বাড়িতে তাদের দুজন এলে কেন্দ্র চরিত্রটি প্রথমে ভেবে নেয় যে ওরা
অন্যদের ঘরে আগুন দিলেও তার ঘরে দেবেনা। ক্রমে সেই আশা ভঙ্গ হয়। কিন্তু তাদের
সামনে সে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়না যাতে তারা টের পেতেপারে যে সে তাদেরকে
অগ্নিসংযোগকারী বলে চিনে নিয়েছে। ওরা দেশলাই চাইলেও সে দেয়। ভাবে গল্পে গল্পে ওদের
ব্যস্ত রেখে সে বেঁচেযাবে। বাঁচাতে সক্ষম হবে তার বাড়িকে। তার বাড়ির চিলে কোঠায়
আছে পেট্রোল। ঐ ছদ্মবেশীরা ঐ কোঠায় যেতে চাইলেও সে বাধা দেয়না। সঙ্গে যায়। ভাবে “ম্যানেজ”
করে নেবে… অন্তিমে রক্ষা পায়না তার বাড়িটিও। -অর্থাৎ বিপদকে ইচ্ছায় বা অক্ষমতায়
চিনতে না পারলেও সে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়না। বরং না চেনার ভান করে থাকলে
নিজের হাতেই সংঘটিত হয় নিজের বিনাশ…( সম্প্রতি সুমন মুখার্জী’র পরিচালনায় এর
বঙ্গানুবাদ ‘যারা আগুন লাগায়’ অভিনীত হচ্ছে। সম্ভবতঃ কলকাতায়…) … মনে আসছেন
সুধীন্দ্রনাথঃ ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? / আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরি ক্ষতি /
ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে…”
হ্যাঁ, আমাদের মগজেও ঢুকেবসে আছে সেই আগুন লাগানোর
ছদ্মবেশীরা। আমরা তাদের সঙ্গে বাস করছি। এড়িয়ে যাচ্ছি প্রকৃত আশংকা। ভাবছি ‘নাহ্,
আর যার হয়েছে হয়েছে, ওরা কি আমার মতো ধীমান, বুদ্ধিমান? আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো
...” – ভাবছি আর তার হাতে তুলেদিচ্ছি দেশলাই। তাকে নিজেই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছি সেই
চিলেকোঠার দিকে যেখানে সঞ্চিত আছে আমাকে আমার আপনজনসহ আমূল পুড়িয়ে দেওয়ার সরঞ্জাম
...
... তবু, এখনো কিছুটা সময় আছে। এখনো বাকি আরো কয়েকটা সিঁড়ি।
যদিনা একা এদের প্রতিরোধ করতে পারি তাহলে অন্ততঃ চীৎকার করে এটুকু জানান দিই, যে,
আমি আক্রান্ত ...