প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Monday, May 25, 2015

আত্মা-কথা


আত্মা-কথা



 

আত্মা-কথা’র ভূমিকা

 

যেহেতু  সেকেন্দার কিংবা মার্কোপোলো নই

এ বান্দা’র তাই কোনো শিক্ষণীয় আত্মকথা নেই

যা আছে তা আত্মা-কথা ক্ষুরের ধারার মতো

নিশিতদুর্গম পথে হেঁটে যাওয়া একা একা

নরক ও স্বর্গের পথে – ভার্জিল ও বিয়াত্রিচে ছাড়া

লিওপোল্ড ব্লুম্‌হেন সারাদিন ডাব্‌লীনের পথে

হেঁটে হেঁটে ছুঁয়ে দেওয়া স্বাতী নাম্নী নক্ষত্রের জল।

শেষ দৃশ্যে ফিরে আসা পিনেলোপিবিবরে। তথাপি

নেশা বা ঘুমের ঘোরে টের পাওয়া,ফিরে,

আরেক যাত্রার টানে শিকড়ের ডানারা চঞ্চল ।

 

নিশিতদুর্গম পথে একা, ভিতু হেঁটে যেতে যেতে

সহসা সাহসী হয়ে হল্লাচিল্লা মদের আসরে কিংবা

বড়জোর গণিকা পল্লীতে – পাথেয় নিশ্ছিদ্র স্মৃতি

তাই মাধুকরী - নিশিতদুর্গম পথে - সূচীভেদ্য চাঁদের আলোতে

 

 

 

আত্মা-কথা

আলাপ

১।

প্রতিখানি সন্ধিপত্র নির্বিচার প্রত্যাখ্যানে আমি

জন্মের মুহুর্ত্ত থেকে এতাবৎ বদ্ধপরিকর

অতীত ও ভবিষ্য থেকে সে পত্র পাঠাক যে’ই -

-সেকেন্দার শাহ কিংবা স্বাভিমানী কোনো পুরুরাজা-

আমার জাহাজ, দুর্গ, মিনারের থেকে কোনো শুভ্র পতাকা

ওড়ানো হবেনা তবু – কোনোদিনই – মৈত্রী, প্রীতি, ভীতি কিংবা প্রেমে –

যদি যুদ্ধে জয়ী হইও তবু - তোমাদের রানী, নটী, দাসীদের আমি

কানের ভিতর দিয়ে শ্যামনাম শোনানোর ছলে বানাবো না সতী, দেবদাসী ।

বরং তাদের রাখব নিরোধশোভিত করে, সসম্মানে, মরমী হারেমে ।

তাদের স্তনের বৃত্তে দানা খাবে পারাবতগুলি - মৈত্রী, প্রীতি, ভীতি কিংবা প্রেমে ।

 

বরং প্রাসাদে একা স-উষ্ণীষ জেগে থেকো , মধ্যযামে, দাহ্য সিংহাসনে।

জয়ী হলে নিজে এসে আমি

স্বর্ণথালে কেটে নেবো এক কোপে তোমার মস্তক

অন্যথায় নিজদুর্গে, নিজহাতে হত্যা করে

রানী, নটী, দাসীদের আমি – অপেক্ষায় থাকবো তোমার ।

পারাবত প্রতীকের চেয়ে স্তনবৃন্ত ঢের সত্য,

ঢের সত্য ক্ষুরধার দগ্ধ তলোয়ার ।

 

২।

শব্দে, বাক্যে যতিচিহ্নে, নিদ্রাহীন প্রয়াসে প্রয়াসে

এই যে কুটিল নক্সা, সূচীভেদ্য জটিল নির্মাণ

সে আসলে কেমোফ্লেজ – ঢেকে রাখতে সে’ই বোকা বালকের মুখ –

“আজও কেন চালভাজা খাবো?” এই বলে থালা ছেড়ে উঠে

যে গিয়ে লুকিয়ে আছে পুকুরের ধারে, বাঁশঝাড়ে –

“আবার সাধিলে খাইব” – যে বালক লিখেছে দেওয়ালে ।

 

জানিনা কি করে আমি সেইসব উতরোল অভিব্যক্তিগুলি

হারিয়ে এসেছি কোন্‌ নীলকুঠিমাঠে কিংবা কোন্‌ মন্বন্তরে ।

অন্নদা ও দুর্গাদিদি না’কি দুর্গানামে গ্রামপ্রান্তে থাকা

অনেক ভাতারী সেই বেশরম্‌ আওরতের ঘরে ।

 

ফলতঃ অক্ষরে তুমি যা’ই দেখছো সকলি মুখোশ ।

“সেন্টিমেন্টাল ফুল্‌”

অন্যথায় “কান্ট্রি পাম্প্‌কিন” –

এইসব অভিধা এড়াতে।

গহনে এখনো আমি  “আবার সাধিলে খাইব”

– এই বোকা পংক্তিটিরই বশ।

 

 

 

৩।

“ জান,মাসি ? বৈশাখ-দ্বাদশীর রাত্রে আমাদের বিয়ে হয়েছিল-- কাল সেই দ্বাদশী আসছে-- কাল সেইদিনকার রাত্রের সব তারা আকাশে জ্বালানো হবে  মণির বোধ হয় মনে নেই-- আমি তাকে সেই কথাটি আজ মনে করিয়ে দিতে চাই ; কেবল তাকে তুমি দু মিনিটের জন্যে ডেকে দাও - শেষের রাত্রিরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরগল্পগুচ্ছ

 

শুনেছি জন্মেছি আমি উনিশ শো বাহাত্তর সালে, কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে।

আজ ভাবি সেই রাত্রে  পিয়ারীবাঈজীহেন খোলাবুক চাঁদটিকে ঘিরে

যে সকল বাবু নক্ষত্রেরা ঠুংরী, গজল শুনে আকাশের নগ্ন নাচঘরে

কাঁচা পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে, তারা’ই আজো আসে

প্রতিবার ?  কোজাগরী বাঈজীটির তরে?

সেই একই জন্মঅন্ধ ধাত্রী দেবতা

সিরিঞ্জ, সেলাইন নিয়ে চুপে

খাড়া থাকে প্রসব বেদনা-আর্ত

কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে

প্রসব বেদনা-আর্ত আমার মায়ের স্বর

জ্যোৎস্নারেনু হয়ে আজো ঝরে ।

 

 

 

 

আত্মা-কথা

বিস্তার পর্ব

 

প্রবেশক

 

অফিসে যাওনি আজ এইসব কথাগুলি লিখে রাখবে বলে

ঘুমাতে পারোনি কাল এটিভান, জোলাম খেয়েও

 

এ সমস্ত কথাগুলি লিখে রাখবে বলে

সঙ্গমের মধ্য পথে হয়েছ শিথিল তাই

গৃহবধূ, রেন্ডি -- দুজনেই

লাথি মেরে ফেলে চলে গেছে ।

তবুও জীবন, হায়, তবুও যাপন শুধু

কথা গুলি

কথা গুলি লিখে রাখবে বলে।

 

কথাগুলি লিখে রাখবে বলে

নীলরক্ত ঝরিয়ে ঝরিয়ে

আজ তুমি একা আছো

অগ্নিপরিধির মাঝে

আদমের সাজে ।

 

 

 

 

 

“কী-নোট্‌”

 

বড়জোর সন্ততিরা হয়তোবা আরো কিছুকাল

নিজগুনে টের পাবে শিকড়ে তোমার টান, মর্মমূলে মমতা তোমার ।

অতঃপর নিজগুনে তাদের কাছেও তুমি হবে

“ ... অসহিষ্ণু – ব্যর্থ – চমৎকার!” ** 

– যদিও ইচ্ছায় তুমি ভষ্ম হবে তবু

পারবে কি ছুঁয়ে দিতে

গত বছরের মতো

হাত গুলি, গাল গুলি, মুখ গুলি – তাহাদের – আর?

 

পারো কি পিতার হাত ছুঁয়ে দিতে আর?

পারো কি মাতার হাত ছুঁয়ে দিতে আর?

পারো কি ভ্রাতার হাত ছুঁয়ে দিতে আর?

পারো কি বন্ধুর হাত ছুঁয়েদিতে আর?

বটের আঠার মতো ঈষদুষ্ণ ফ্লুইড্‌ ব্যাতীত

পত্নীটির সাথে আছে

অন্যবিধ কোনো পারাপার?

 

 

** “ ... অসহিষ্ণু – ব্যর্থ – চমৎকার!” – জীননানন্দ দাশ, কয়েকটি লাইন, ধূসর পান্ডুলিপি

 

 

 

বিস্তার

১।

তোমার শৈশবের পাশে, বেড়ার কিনারে

ছিল এক ঘোড়ানিম গাছ। বিরাট পুকুর ছিল আর

দিদিভাই, বাবার পিসীমা, গল্পতরুবৃক্ষ ছিল

একলা তোমার।

যদিও ভাড়াটে বাড়ি - মালিকের মেয়ে তবু ছিল

“ছোটোরানী” দিদিটি তোমার।

 

তোমার শৈশব জুড়ে রাজপ্রাসাদ ছিল 

তাতে ছিল অপু,দুর্গা,সর্বজয়া, মিনি –

ফিরিঙ্গি মাইকেল ছিল, ভিতু ভিতু শ্রীকান্তর পাশে

দুঃসাহসী বাজ –

ইন্দ্রনাথ ! ছিল নিঘুম রাতেরা

ছিল, মেঘলা দুপুরবেলা আর

মেঘের আড়ালে ছিল মহাবীর - একা মেঘনাদ।

তোমার শৈশব জুড়ে এতোকিছু ছিল তবু

কেবল ছিলনা মাটি, যেহেতু প্রাসাদে মা’টি

ছিলনা তোমার।

 

তাই বুঝি এতাবৎ তুমি এরকম “অসহিষ্ণু –

-ব্যর্থ – চমৎকার”!!

 

 

 

 

২।

মা’টি ছিল ভিন্‌ গাঁয়ে মাটির কুটীরে।

দুয়োরানীটির মতো। সঙ্গে ছদ্মবেশে

তোমারি সাক্ষাৎ ভ্রাতা। কনিষ্ঠ কুমার।

তবু যেন ভ্রাতা নয়। কেননা নিষিদ্ধ ছিল

সব পারাপার।

 

দিদিভাই, বাবার পিসীমা, সত্যই কি জাদু জান্‌তো তবে?

বাবাও তো এঁরই ছায়া এবং মায়াতে

নিজের মায়ের কথা ভুলেযেতে বসেছিল কবে ।

 

বাবারো শৈশবে তবে মা’টি নেই বলে

ছিলনা নরম মাটি ঘাসের আড়ালে?

যতো ভাবো ততো বর্নমালা বিশ্বচক্র সিরিজের মতো

ক্রমশঃ জটিল হয় মাকড়সার

আঠাতে ও জালে ।

 

বাবা রেলগাড়ি যেন

এই দুটি স্টেশনকে ছুঁয়ে। অন্যথায়

রেল-লাইন বাবা। তথাপি গভীরে ওই স্টেশন দুটিতে

সংযোগ স্থাপনে বাবা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

 

পারেননি “বাবু”ওতো।

“বাবু” মানে বাবা যাঁকে ‘দাদু’ ডাকে।

ঠাকুর্দার ইনি মামা হন। বন্ধুওতো বটে।

তোমার শৈশবের পাশে ঘোড়া নিম গাছের ছায়াতে

তাঁরো ছিল গল্প, গান, প্রশ্রয়ের তুমুল উজানে ।

 

৩।

অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ। ব্যালকনী। গোপীনাথ হল্‌।

বাইরে আকাশে মেঘ। ম্যাটিনী শো। পর্দায় ধ্রুব ও দেবতা।

আগমনী, বোধন ছাড়াই

মা আজ এসেছে।

সকালের ট্রেনে চেপে।

ছোটোভাইটিকে নিয়ে। বড় মাসীদের বাড়ি তাকে জিম্মা রেখে

মা এখানে একাই তোমাকে

দেখতে এসেছে আজ।  সঙ্গে এনেছে

ছবিটবি আঁকা এক “গোঁফচুরি” বই।

কিছুক্ষন পড়ে শুনিয়েছে।

অতঃপর বাবার সে পিসীমা বুড়িকে – বহু কষ্টে রাজি করে

এসেছে তোমাকে নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে। গোপীনাথ হল্‌’এ।

বাইরে আকাশে মেঘ।  পর্দায় ধ্রুব ও দেবতা।

প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার। তুমি আর মাতা।

এ টুকুই মনেআছে শুধু।

এ টুকুই মনেপড়ে শুধু।

আর মনেপড়ে মা’র একা ফিরে যাওয়া।

একা।

একা একা।

রিক্সা চেপে। হঠাৎই বৃষ্টিনামা

নিঝুম বৈকালে।

 

৪।

দু বছর চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে উঠেছিলে তুমি।

অকস্মাৎই দুইটি ঠিকানা

জুড়েগেলো একটু ভিটেতে।

বাবার সে গানকরা দাদু, প্রকৃতার্থে গানের টানেই, তোমার শৈশবের পাশে, বেড়ার কিনারে

সেই প্রিয় ঘোড়ানিম গাছের ছায়াতে

রইলেন

সঙ্গে নিয়ে শূন্য কোঠা,স্বরলিপি, হারমোনিয়াম আর

“মহুয়া” গানের দল। গানে গানে ভেসে গেলো

কিংবা ডুবে গেলো

নাওয়া খাওয়া এবং বিশ্রাম।

 

তুমি এলে। আর দিদিভাই।

তুমি পেলে মা আর ভাই।

পেলে, তবু পারলে কি “দাদা” হতে ঠিক?

পেলে, তবু পারলে কি “ছেলে” হতে ঠিক?

আজ জানো, পারো নাই। পারো নাই

বহু মাস, অনেক বৎসর।

দিদিভাইও ওই না-পারা’ই

কায়ে-মনে চেয়েছেন বলে

তোমার শৈশবঘুমে প্রায়শই দুঃস্বপ্নের ছলে

প্রশ্ন উঠতো – সত্য এই ভাইটি তোমার? নাকি তুমি

ত্যক্তপুত্র

কোনো বিমাতার?

 

 

 

৫।

মা গিয়েছে মামাবাড়ি। সঙ্গে গেছে ভাই 

মামার বাড়িতে যাওয়া তোমার নিষেধ।

অথচ যখনি গেছো বড়মাসীদের বাড়ি

দিদিভাই ও বাবাকে লুকিয়ে

বড় মাসী, হাসাহাসি, স্নেহ-স্পর্শ, স্পর্শাতীত আরো

বহু কিছু । একজন মিতুদি ও

মিতুদির শুকতারা বই। প্রশ্রয়ের লৌহদুর্গ – মা’র সাথে আরো

মামামাসিদের বাড়ি । অনেক বাচ্চারা মিলে

হৈহৈ বালকের তোমার ভালো লাগে। তাই

কলকাতায় মাসীর বিয়েতে

মার সাথে তুমিওতো যেতে চেয়েছিলে।

সে রাত্রেই দিদিভাই অসুস্থ ভীষণঃ “ যাবে যাও মা’র সঙ্গে

হিল্লি দিল্লী কলিকাতা – যথা ইচ্ছা তথা -

আমি হয়তো মরেযাবো। আমাকে পাবেনা আর

তুমি ফিরে এলে বেড়ে যাচ্ছে শ্বাস-কষ্ট,

কোমরের ব্যথা...”

 

 

৬।

 

মা গিয়েছে মামাবাড়ি। সঙ্গে গেছে ভাই ।

তখন কি সিক্সে পড়ো তুমি? না’কি সবে উঠেছো সেভেনে?

যতোদূর মনেপড়ে তা’তে

মনেহয় “আম আঁটির ভেঁপু” আর সাহিত্য সংসদ দ্বারা সংক্ষেপিত “পথের পাঁচালী”

ততোদিনে পড়া হয়েগেছে । বাবার আলমারি খুলে

 “বিভূতি রচনাবলী” এইবার চুপে খুলে বসে ...

স্বর্ণজলে নামাঙ্কিত এই গ্রন্থগুলি

সেইথেকে আজ অবধি

ডেকে যায় দিনেরাত্রে

নীরবে তোমাকে।

 

মনেপড়ে জানালায় বসে “পথের পাঁচালী” হাতে

কি নিবিড় কান্না কেঁদেছিলে? মনেপড়ে

সেই জেনেছিলে

মা’যে হয় মাটি আর

মা’টি ছাড়া বাঁচেনা শাবক? সমূহ মমতা প্রীতি অনুধ্যানসহ

দিদিভাই – আসলেই যখ ।

 

৭।

সেবারই তোমার খুব জ্বর হয়েছিল।

দিদিভাই আছেন তবু তুমি যেন বাবাকেই বেশী

ভরসা করতে মনে মনে শিখে নিচ্ছিলে।

বাবা মাথা ধুয়ে দিচ্ছে। মুছে দিচ্ছে জ্বরের শরীর।

যখনি কারেন্ট যাচ্ছে তালপাতার পাখা নিয়ে বাবা।

তবু জ্বর বেড়েযাচ্ছে দুপুরের দিকে।

তুমি ঠিক বুঝতে পারছোনা। বিছানায় বন্দিদশা ভুলে থাকতে চেয়ে

প্রোফেসর শঙ্কু, ঘনাদা এবং কিকিরা, মানে,

কিঙ্কর কিশোর রায়। সে এক দুপুরবেলা। স্পষ্ট মনে আছে

বাবা বলছেঃ “বই রাখ্‌।

চোখ বন্ধ কর্‌। আমি তোকে গল্প বলি শোন্‌ ...”

... অনেক বৎসর পরে নানাবিধ বইপুঁথি পড়ে

জেনেছো সে গল্পটির নাম। জানবার প্রয়োজন ছিল।

কেননা বাবার মুখে গল্পশোনা-অভিজ্ঞতা তোমার প্রথম ।

জানবার প্রয়োজন ছিল – কেননা বাল্যকালও শৈশবের রাতে

কখনো যাওনি ঘুম তুমি

বাবা ও মায়ের কাছে শুয়ে ।

অদ্যও নির্বাসিত তুমি -- কৃতান্ত নগরে শুধু

পত্নীপুত্রকন্যাদের নিয়ে।

অমরণ এই নির্বাসন। জানো, তবু জানবেনা ব’লে

তুমিই শোনাও গল্প রোজ রাত্রে খোকা ও খুকিকে। শোনাতে শোনাতে

সেই “জাজ্‌মেন্ট”, সেই “জাজমেন্ট অফ প্যারীস” গাথাটি

রোজই মনেপড়ে ।

৮।

বসন্তের আগমনহেন ইস্কুলের চৌকাঠটি ছেড়ে

লাফিয়ে কলেজে ঢুকেপড়া –

সে’ও এক ঋতুরংগ। “জীবনের যাত্রাপথে” সে প্রথম বনমহোৎসব।

অপর্ণার মোটা চশমা, উৎপলার বেহিসাবী বুক,

পূরবী দত্তর হাসি, অতলান্ত চোখ ।

ইলেকশান, দলাদলি, পলানের দোকানে বীয়ার,

গাঁজা টেনে অলৌকিক সুখ –

ফিজিক্স ল্যাবের পিছে নামে অন্ধকার ।

এনুয়েল ফেস্টিভ্যাল,

স্বরচিত, প্রযোজিত, অভিনীত নাটকের পর

গাঁজা, মদ দুই’ই চললো মস্ত্‌। রাতভর অডিটোরিয়ামেই। বাড়িতে জানাতে গেলে

অনুমতি পাওয়া অসম্ভব। অতএব “জয় বাবা বজরং বুলি”র –

চারমিনার-বিধবা-শরীরে

গঞ্জিকার অবাধ সঙ্গম।

দিব্যদৃষ্টি মর্মে জাগে। হা জীবন! কি যে মনোরম !

 

সহসা আসরমধ্যে আবির্ভাব পিওন “নাগা”র।

সে আবার রাত্রিকালে কলেজের চৌকিদারও বটে।

“ সাইকেল চালিয়ে স্যার নিজে এসেছেন –

তালা খুলতে বলেছেন। আমি

‘চাবি আন্‌ছি বলে’ -- আপনাদের জানাতে এসেছি –“।

 – “স্যার” মানে বাবা। বাবা এই কলেজেই

ইংরেজী পড়ায়। তাই জানা আছে  সকলেরি

রেগেগেলে তোমার বাবার

কান্ডাকান্ড হিসাব থাকেনা ।

“দাঁড়া নাগা, কিছুতেই তালা খুলবিনা।

আমি যাই। কথা বলে আসি ...”

শাদা শার্ট, শাদা রং পাজামা পরনে

কলেজের গেইটে বাবা। চালচিত্রে

ধুধু মধ্যরাত। পশলা দুই

বৃষ্টি হয়েগেছে। আর খুব কিছু আজ

মনেনেই তোমার, তথাপি

আজ বোঝো সেই রাত্রে যে কথা বোঝোনি?

কোনোও দিন খোকা কিংবা খুকিটির বাস্‌

গলীর সামনে এসে তাদেরকে ঠিক সময়

নামিয়ে না দিলে

তোমার কি সেই দৃশ্য, সেইসব কথা মনেপড়ে?

 

৯।

এইবারে শার্প কাট। জাম্প-কাট্‌ও

বলা যেতে পারে। এই বার কলিকাতা।  শূন্যে উড়ে নিচের ভাগারে

যে রকম মরা খোঁজে শকুনের চোখ

সে রকমই চাকুরীর খোঁজ

সারাদিন কলকাতার সমূহ বাজারে। ধপু-ঋষি বলেছিল

সোনাগাছি দেবতার কাছে নিরোধ মানত করলে

চাকরী হতে পারে

 

ডাক বিভাগ ভরসা করে মাসে টাকা আসে।

বাবার বয়স বাড়ছে। রিটায়ার হতে দেরী নেই।

চৌরঙ্গী ও পার্ক স্ট্রিট মোড়ে তোমারি মতন দেখতে

সংখ্যাতীত দালাল রয়েছে। তাদের পকেটে আছে

মেয়েমানুষের নাম, ঠিকানা ও ছবি। কলেজস্ট্রীটের পথে

ঝোলা ব্যাগ ও দাড়ি সহ অমেরুদন্ডী প্রানী

অনেক রয়েছে। রয়েছে ডব্‌কা মেয়ে

মেস্‌ মালিকের। কলকাতায় সব আছে। কলকাতায়

শুধু চাকরী নেই।

 

ডাক বিভাগ ভরসা করে চিঠিপত্র আসে।

কোনোএক চিঠির উত্তরে – কবিতা উদ্ধৃত করে – সম্ভবতঃ মিল্টনের থেকে –

বাবা লিখেছিলঃ “যে মানুষ প্রতীক্ষা করে সে’ও

অভিনেতা, যাপনের এ আজব নাটকে”। মা’র চিঠি

– রুল করা খাতার পাতায় “নিবিড় ঘন আঁধারে

জ্বলিছে ধ্রুবতারা...” মনে আছে? চিঠিগুলি খোয়া গেছে

কবেইতো। কতো যুগ হলো আর

চিঠিপত্র কিছুই লেখোনা?

 

 

অন্তরা

১।

তোমার শৈশব জুড়ে রাজপ্রাসাদ ছিল 

তাতে ছিল অপু,দুর্গা,সর্বজয়া, মিনি –

ফিরিঙ্গি মাইকেল ছিল, ভিতু ভিতু শ্রীকান্তর পাশে

দুঃসাহসী বাজ –

ইন্দ্রনাথ ! ছিল নিঘুম রাতেরা

ছিল, মেঘলা দুপুরবেলা আর

মেঘের আড়ালে ছিল মহাবীর - একা মেঘনাদ।

তোমার শৈশব জুড়ে এতোকিছু ছিল তবু

কেবল ছিলনা মাটি, যেহেতু প্রাসাদে মা’টি

ছিলনা তোমার।

 

তাই বুঝি আজো ভাবো মনে

মা’কে নিয়ে যাবে কোনো দূরে । চারটি বেহারা ছুটবে

মা’র পাল্কী কাঁধে আর তুমি

লালরং ঘোড়ায় সওয়ার, পাশে পাশে, তলোয়ার হাতে।

এই ভাবে যেতে যেতে যেতে যেতে তবে

একদিন পৌঁছেযাবে না’কি

জন্মদিনে? জন্মের

প্রথম বিচ্ছেদে?

বাবাকে সঙ্গে নিয়ে তুমি

বাবার শৈশব-নদী ফিরে দেখতে যাবে?

মনে মনে। এবং বাস্তবে

পত্নীপুত্রকন্যাসহ তুমি

অচিরে জীবন্ত এক যখ হয়ে যাবে ।

 

 

২।

এ নগরে নির্বাসিত তুমি

অচিরে জীবন্ত এক যখ হয়ে যাবে । জানো। তবু কতো যুগ হলো

চিঠিপত্র কিছুই লেখোনা । ফোনেও বলোনা কিছু।

চুপ থাকো। কেন থাকো?

নিজে জানো? অথবা

জানোনা?

হয়তোবা চাও তুমি, তবু

কিছুতেই তুমি আর কথার বাঁশের

সাঁকো বানাতে পারোনা।

অথচ তোমার মর্মে জ্যোৎস্নায় বরফের মতো

কেবল তাদেরি জন্য কতশত কথা জমে আছে ...

 

নির্জন স্নানঘর তাই তোমার গ্রীনরুম।

স্নানঘরে আয়না তাই তোমার দর্শক।

সেখানে প্রস্তুতি নাও বারে বারে তবু

মঞ্চে এসে ভুল সংলাপ

টেলিফোনে, সাক্ষাতেও, হায়, তোমার জ্যোৎস্না জুড়ে বরফের মতো

কেবল তাদেরি জন্য কতশত কথা জমে আছে।

 

 

৩।

তবে কি অজ্ঞাতে তুমি

নৌকাটি পুড়িয়ে এসেছো?

কিভাবে সম্ভব? তুমি আজো

বৃক্ষদের টানে, তুমি আজো

নদীদের টানে, আজো

হাড় পাঁজরা বার হয়েপড়া

রাস্তাদের টানে ...

উল্কা-টুকরোর মতো ছিটকে যাও

লুপ্ত হয়ে আসা ওই বিকালের দিকে।

যেতে যেতে

ভাবো কথা, ভাবো ছবি, ভেবে তোলো বিনিময়গুলি।

বিমানবন্দরে তুমি টয়লেটে গিয়ে

রিহার্সেলও করে নাও পারো যতোখানি।

অথচ মঞ্চে আলো জ্বলে উঠলেই –

 

৪।

অথচ মঞ্চে আলো জ্বলে উঠলেই –

কি হয় তোমার? বিভাবে সংলাপ গুলি

ঢেকে যায় অপর প্রলাপে?

কেন ঢাকে?

নিজে কি জানোনা?

অথচ প্রেক্ষাগৃহে অন্ধকার হওয়ামাত্রই

কাকে ডেকে বলো “বাবা, এবার তোমাকে নিয়ে আমি

প্রকৃতই ভেসে যাবো তোমাদের দেশের নদীতে...”

কাকে বলো “ নেতাজী মেলায় যাই চলো,

কিনে আনি পছন্দের ফিতে

তোমার চুলের জন্য ...”

বলো তুমিঃ “ এ কথা কি জানো

যখনি রাত্রে আমি খোকা আর খুকিটিকে নিয়ে

গল্প বলি, স্পর্শ করি চিবুক, কুন্তল –

টেরপাই তোমাদেরি স্পর্শ করে আছি ...”

বলো তুমি তোমারো দুচোখে

অশ্রু নয়, নেমে আসে

স্বাতী নাম্নী নক্ষত্রের জল ...।

 

 

 

 

 

 

 

ঘুম ঘর