প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Monday, September 25, 2017

'জানি, কিন্তু ক’মুনা’

‘জানি, কিন্তু ক’মুনা’
সপ্তর্ষি বিশ্বাস   


১।
‘এপার বাংলা,ওপার বাংলা,মধ্যিখানে চর ।
তারি মধ্যে বসে আছে শিব সদাগর’
বসেআছে তো বসেই আছে। নড়া নেই, চড়া নেই। সেইযে আরেক সদাগর গেল বসিয়ে সেই থেকেই শুধু বসেথাকা। খরায়, বন্যায়, দিনে, রাত্রে।
‘হ্যাঁ গা সদাগর, দিন নাই, রাইত তাই, কি অত চাইয়া চাইয়া দেখ তুমি?’
‘দেখি অনেক কিছু। কিন্তু ক’মুনা’।
‘এ’ত আরেকজনার কথা হে। সে হইত – জানি, কিন্তু ক’মুনা’।
‘হেরেও চিনি। তরেও চিনি’।
‘তুমি আমারেও চিনো সদাগর? তইলে কও আমি কে’
‘কইলাম যে – জানি, কিন্তু কমুনা’।
‘কিন্তু তুমি না কইলে আর কে কইব সদাগর? আমি যেমন নচিকেতা না তেমনই তুমিও যমদেব্‌তা না। তোমার কাছে আমি খুব কঠিন জবাব চাইনা। আমারে খুব সহজ কইরা কও আমি কে। কও আমি কুন্‌ দেশের মানুষ আমার ঘর কই, বাড়ি কই, ঠিকানা কই...”
“ সেইসব তো হারাইয়া গেছে। সেইসব তো ডুইব্যা গেছে। শকুন্তলার আঙ্গটির মতন বুয়াল মাছে গিল্লা খাইসে”
“সদাগর, তুমি পারনা সেই বুয়াল মাছরে তুকাইয়া আইন্যা তার পেট কাইট্যা হই আঙ্গটি আমারে ফিরাইয়া দিতে?”
“না পারিনা। আমি কেবল পারি বইয়া বইয়া দেখতে আর পরস্তাব কইতে...”
“তইলে আমারে আমার পরস্তাবখান কইবানা সদাগর?”
“হেই পরস্তাব কি আর একজন্মে কওন যায়? শুন্‌ন যায় এক জীবনে? এই পরস্তাবের না আছে শুরু, না আছে শেষ...”
“তবু কও সদাগর। আমারে আমার পরস্তাব কও। আমার মায়ের-বাপের পরস্তাব কও। আমার ঠাকুর্দা-ঠাকুর্মার পরস্তাব কও ...”
“আইচ্ছা। তবে হুনো। কম কথায় কই। আইজকাল আর লাচারি পারিনা। খেই হারাইয়া যায়গা...”
২।
যখন ঘোষিত হইয়াছিল ,মধ্যরাত্রে, যে, ভারতবর্ষ ইংরেজদিগের দখল হইতে নেহেরুর দখলে আসিয়েছে সেই মধ্যরাত্রেই ঘোষিত হইয়াছিল পাকিস্তানের জন্মকথাও। শুনিয়াছিল সকলেই। কিন্তু সকলেই যে ভাবিতে পারিয়াছিল যে এইবার ছাড়িতে হইবে ভিটাবাড়ি তেমন নহে। অনেকেরি মনে হইয়াছিল হয়তো রেডিওর আরো অসংখ্য খবর ও ঘোষনার মতো এই ঘোষনাও ইথার তরঙ্গে ভাসিয়া চলিয়া যাইবে দূর হইতে দূরান্তরে। এমন ভাবিয়াছিলেন হারান, ফটিক উভয়েই। অতএব পশু হাসপাতালের ডিউটি সাড়িয়া ফটিক, এই বেতার-ঘোষনার পরেও, পূর্ববৎ যান অন্য পাড়ায় আড্ডা মারিতে। ইস্কুল ছুটি হইলে, হারান চক্রবর্তীও গিয়া জুতিয়া যান কোনো না কোনো গানের আসরে। তেমন আসর না পাইলে নিজেই গান গাহিয়া, চেষ্টানেন, পূর্ববৎ জমাইয়া তুলিতে  আসর। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন ‘আরে হিন্দুস্থান হউক, ফাকিস্তান হউক, আমরারে কে কিতা করতো? অখন পইর্যন্ত তো জীবনের আধা কাটাইদিলাম জেলো...’  তখনো বাড়ি ফিরিতে প্রায় মধ্যরাত হয় উভয়েরই।
শিশির অভিযোগ করেন। “ মামাবাবুরো যেমন, তোরও তেমন, কান্ডজ্ঞেয়ান নাই, অতো রাইত কইরা ই সময় বাসাত আয়নি কেউ?” দিদির কথায় মৃদু মৃদু হাসিয়া ফটিক বলেনঃ ‘আরে তুমরারো যতো আন্দাজি ডর বইন্‌দি, জন্মত থেইক্যা যেখানো বড় হইসি হিখানো কে আমরারে কিতা করবো? ‘পাকিস্তান’ নাম দিলে কিতা সবতা বদলাই যায় নি? কিতা কইন মামা?’ সম্পর্কে হারান ফটিকের মামা। তবে বয়সের হিসাবে ইহারা সমবয়ষ্ক। হারানও হাসেন। বলেনঃ ‘অয় অয়, অতো ডরাইলে চলেনি?” শিশির বলেন “মামারে জিগাইয়া আর কিতা হইত? মামা’র নু তিন কূলো কেউ নাই ... তুমার নু বৌ আছে, পুলাপান আছে ...” ফটিক বলেনঃ ‘অয় অয়, বইনও আছে। নিজের কথা মন থাকে না’নি তুমার? নেও আরেকটু ঝুল দেও, মাছটা বড় ভালা হইসে, তুমি রানচো নি?”  টিমটিম করিয়া জ্বলন্ত চল্লিশ ওয়াটের বাল্বের আলোয় মাটিতে পিঁড়ি পাতিয়া হয় খাওয়া দাওয়া।
খাইয়া উঠিয়া আচাইতে যাইবার সময় হারান বলেনঃ ‘নাহ্‌, কালকের থেইক্যা তাড়াতাড়ি আইমু। ’ শিশির কোনো কথা বলেননা। ফটিকের পাতে আরেক টুকরা মাছ দিয়া উঠিয়া যান। পাক্‌ঘরের খোলা জানালা দিয়া অন্ধকারে তাকাইয়া থাকেন। তারপর বলেনঃ ‘শুন্‌ছইন ত ভট্‌বাবুর বাসাতও বেনামী চিঠি আইসে...’ ...
 এই আরেক ব্যাপার। আসিতেছে বেনামী চিঠি। ‘বাড়ি ছাড় নাহলে মরবে’, ‘অমুকদিন তুমরার ঘরো আগুন দিমু’। চিঠির ভয়ে কেহ কেহ সত্যই পলাইয়াছে তবে আগুন দেওয়ার ঘটনা এখনো ঘটে নাই।হারান, ফটিক আর কথা বাড়াননা। খাওয়া সাড়িয়া ফটিকও আচাইতে যায়। শিশির নিজের ভাত বাড়েন।
     নদীর পারে বাড়ি। খাওয়া সাড়িয়া নদীর পারে গিয়া সিগারেট টানেন ফটিক আর হারান। নদীর অন্যপারে মুসলমান পাড়া। অনেকেই বলে মুসলমানেরা নদী দিয়া নৌকা লইয়া আক্রমণ করিতে পারে। আশে পাশের দুই এক বাড়িতে ঐ জন্য বেড়াও দেওয়া হইয়াছে নদীর দিকে। ফটিক বলে ‘মুসলমানরা যেমন বেড়া ডিঙ্গাইয়া আইত জানেনা, যতো বুকার মতো কারবার’। হাসেন হারানও। এমনি হাল্কা আড্ডায়, কথায় রাত্রি বাড়িলে উঠিয়া যান দুইজনে। ফটিক যায় বৌ বাচ্চার সঙ্গে ঘুমাইতে। হারান একা আসেন তাঁহার নিজের কোঠায়। হারানের, সেই অর্থে, সত্যই কেহ নাই। মা বাপ গত হইয়াছেন দীর্ঘদিন। এক ছোটোভাই সে’ও বহুকাল যোগাযোগ রাখেনা ...এখন এই ফটিক আর তাহাদের সংসারই হারানের সব। ফটিকের ছেলেটিকে বড় ভালবাসেন তিনি। সে’ও ‘দাদু’ বলিতে অজ্ঞান।
        একদিন মধ্যরাত্রে নদীর অন্য পারে সত্যই জিগীর উঠিল ‘আল্লা-হো-আকবর’। মধ্য রাত্রির আকাশ উঠিল রক্তিম হইয়া। কানে আসিল  হৈ হট্টগোল। আর্ত্তনাদ। খাওয়া দাওয়া সাড়িয়া, সিগারেট টানিয়া ফটিক আর হারান এইমাত্র আসিয়াছেন নিজেদের কোঠায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই চীৎকার। হতভম্ব ফটিক আর হারান আসিয়া দাঁড়াইলেন বারান্দায়। অন্ধকারেও যেন একে দেখিতে পাইলেন অপরের মুখের হতভম্ব ভাব। তবে দাঙ্গা বাঁধিল এই শহরেও? এই প্রশ্ন যেন উভয়ের মধ্যবর্তী অন্ধকারে দোদুল্যমান হইল। ক্রমে, পায়ে পায়ে তাঁহাদের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইলেন শিশির, সুলেখা। কাচ্চা বাচ্চা গুলি ঘুমের মধ্যে কাঁদিয়া উঠিল। ইহারাও কি কিছু টের পাইল?
কোথায় আগুন লাগিল? ফটিক বলিলেন ‘চলইন মামা বাইরইয়া দেখি চাইন গিয়া’...। স্বামীর জ্যেষ্ঠা ভগ্নীর সম্মুখে স্বামীর সঙ্গে কথাবার্তা বলার সঙ্কোচ তখনো ছিল বাতাসে ফলে বাক্যটি কানে যাওয়া মাত্র সুলেখা শিশিরের হাত চাপিয়া ধরিলেন। শিশির বলিলেনঃ ‘কিতা কস্‌ পাগলের মতো? ই সময় কেউ বাইরয় নি? সামনে সরস্বতী পূজা এর মইধ্যে ই আগুন’
‘ আরে আগুনটা কই লাগ্‌সে, কেনে লাগ্‌সে না জান্‌লে...’
‘না না অতোতা জাননের কুনো দরকার নাই, নিজের ঘরো বউ বাচ্চা কেমনে বাচাইতায় হিতা দেখো...’
আবহে জিগীর চলিতে লাগিল পূর্ববৎ। যেন আরেকটু জোর হইল জিগীর। যেন আরেকটু নিকটবর্তী হইল। শোনাগেলো সুলেখার ভীত স্বরঃ ‘ ...না... ই দেশো আর থাকন যাইতো না ...’
চক্রবালে আগুনে দাউদাউ হইল। দমকলের ঘন্টি শুনা গেলো। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশী কেহই আসিলনা। হয়তো নিজ নিজ ভিটার রক্ষনাবেক্ষনে নিরত রহিয়াছে সকলেই। জিগীর কম হইল। অগ্নিশিখার লেলিহানতাও কম হইল। ক্রমে। পরদিন খবর শোনাগেলো সদর কাছাড়িতে কাহারা আগুন ধরাইয়া ... ‘কাহারা’ এই প্রশ্নের উত্তরে যদিও বলা হইল এনাম আর হাসিম নামের দুই দাগীর কথা, যদিও বলা হইল ইহারা আগুন দিয়াছিল মূলতঃ তাহাদের বিচারের কাগজপত্র গুলি লোপ করিতে নতুবা বিচারে দুই জনেরি ফাঁসি হইত। তথাপি হিন্দুরা আশ্বস্ত বোধ করিতে পারিল না।
পক্ষান্তরে মুসলমান শিবির বলিল, আকারে-ইঙ্গিতে, হিন্দুরা’ই লাগাইয়াছে এই আগুন। মাইকে প্রচার হইল হিন্দুরা পাকিস্তানের শত্রু।
৩।
‘সদাগর, ও সদাগর’
‘পরস্তাবের মইধ্যে আবার ডাকাডাকি কেনে?’
‘সদাগর, এই পরস্তাবো বাংলাদেশ কই? ই পরস্তাবোতো খালি হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান ...’
‘ মর্‌ জ্বালা। একই গল্প সব ...’
‘একই গল্প মানে’?
‘মানে? মানে হিন্দুস্থান ভাইঙ্গা পাকিস্তান। পাকিস্তান ভাইঙ্গা বাংলাদেশ। মানে ই স-অ-ব পরস্তাবই ভাঙ্গনের পরস্তাব। আর মইধ্যেখানো আমি। সদাগর। আমিও অই ভাঙ্গনেরই সদাগর ...’
‘তইলে অই ভাঙ্গনের পরস্তাবই কও সদাগর...’
‘তা’ই ক’ই। অখনো মনো আছে যদিও হেমন্তকাল তথাপি শীত যায়নাই, যায়নাই কুয়াশা। সামনেই সরস্বতী পূজা। মন্ডপ বান্ধা হইসে। গতবারও পূজায় পার্বনে মুসলমানরাও চান্দা দিছে, আইছে, প্রসাদ খাইছে। এইবার মুসলমানরা চান্দা দিলোনা না  হিন্দুরা গেলোনা চান্দা চাইত কিজানি। একটা বিভেদের ছায়া পরিষ্কার । দিনের বেলা টাউন হলো ডাকা হইল সভা। ‘নাগরিক কমিটি’র সভা ...”
৪।
সভায় হাজির ছিলেন হারান, ফটিক উভয়েই। ছিল আরো অনেক পরিচিত হিন্দু-মুসলমান মুখ। কিন্তু কেহই আগ বাড়াইয়া কাহারো সঙ্গে কিছু কথা বলিতে আসিল না। সভায়ও বলা হইল একই কথা “হিন্দুরা পাকিস্তানের শত্রু”। যে সকল মুসলমানেরা ইহার প্রতিবাদে কিছু বলিবার চেষ্টা করিল জনতার “রাজাকার” ‘শাল্লা রাজাকার” চীৎকারে থামিতে হইল তাহাদের। হিন্দু নেতা সুরেশ বিশ্বাস উঠিয়াছিলেন কিছু বলিতে। জনতা চীৎকার করিয়া নামাইয়া দিলো তাঁহাকে।অনেক চীৎকার, হৈ হল্লা, গালাগালির পর সভা ভাঙ্গিল।
টাউন হল্‌ হইতে পথে নামিলেন হারান, ফটিক। উভয়েরি চা’এর নেশা।  টাউন হলের সামনেই এক চাএর দোকানে ঢুকিলেন দুইজন। এই সকল দোকানে হিন্দু মুসলমান লইয়া কেহই মাথা ঘামায় নাই এতোদিন তবে আজ তাঁহারা লক্ষ্য করিলেন যে তাঁহারা দুই জনেই শুধু হিন্দু খড়িদ্দার। তাঁহাদের প্রবেশমাত্র চলিতে থাকা কিছু একটা উত্তেজিত আলোচনা থামিয়া গেলো। দোকানী হয়তো তাঁহাদের তাড়াতাড়ি বিদায় করিবার জন্যই সর্বাগ্রে দুই কাপ চা আনিয়া হাজির করিল তাঁহাদের সম্মুখে। চা শেষ করিয়া তাঁহারাও বাড়ির পথ ধরিলেন।
হেমন্তের বেলা বারোটা। রৌদ্রে তেমন তেজ নাই বরং মেঘলা ভাব। এমন দিনে, এমন সময়ে পথে হাঁটিয়া বেড়াইতে মন্দ লাগেনা। গন্তব্য নিকটে হইলেও মনেহয় একটু ঘুরপথে যাই। এমন কতোবার হইয়াছে হারানের। কিন্তু ঐ দিনে মন যেন কিসের আশঙ্কায় ভীত। তাই উভয়েই দ্রুত বাড়ি ফিরিতে চাহিলেন। আশ্চর্য এই যে একে অন্যকে কিছু না বলিলেও কি এক তরঙ্গের বিনিময়ের মাধ্যমে যেন একে বুঝিতে পারিতেছিলেন অপরের মনের কথা।
টাউন্‌ হলের মোড় ঘুড়িতে না ঘুড়িতেই কানে আসিল হৈ হল্লা। পথে টাউন হলের মিটিং ফেরতা হিন্দু মুসলমান যাহারাই ছিল তাহারাই চম্‌কাইল, উদ্‌গ্রীব হইল। অনতিবিলম্বেই দেখা গেলো একদল হিন্দু ছাত্র, কম বয়সী, তেকোনা পুকুরের দিক হইতে আসিতেছে ছুটিতে ছুটিতে। কাছে আসিলে এ’ও দেখাগেলো যে অনেকেরি গা’য়ে মুখে রক্তের দাগ। ইহারা থামিল না। ইহারা ছুটিয়া যাইতে যাইতে শুধু বলিয়া গেলো ‘আন্‌সার গুষ্টিও অপারেশনো লাম্‌সে। ভাগো ভাগো ’ ঠিক তখুনি টাউন হলের আশে পাশের চায়ের দোকানগুলি হইতে বাহির হইয়া আসিল মুসলমান ছেলে ছোকরার দল। তাহাদের হাতে অস্ত্র। প্রকাশ্য। ইহারা ঐ ছুটিতে থাকা ছাত্রদের পিছু পিছু ধাবিত হইল ...
না, ঐ মুহুর্তে হারান-ফটিক শুধু নয় কেহই গেলোনা ঐ ছাত্রদিগকে রক্ষা করিতে। যে সকল মুসলমান ভদ্রলোকেরা সভায় হিন্দুদের পক্ষ লইয়াছিলেন তাঁহারা নত মুখ হইয়া চলিয়া যাইতে লাগিলেন দ্রুত। জোর কদমে পা চালাইলেন হারান আর ফটিকও।
পার্লিয়ামেন্ট সেস্‌নে হাজির হইবার আগেই কি এক মামলা আনিয়া সুরেশ বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করিয়া লইল আন্‌সার বাহিনী।
৫।
সদাগর, শিব সদাগর। তুমি যে পরস্তাব বল,বলছো, বলেযাচ্ছ তার সমান্তরালে আমার মর্মচোখে ভাসছে গোপীনাথ সিনেমা হল্‌ কে হাতের বাঁদিকে রেখে সোজা হাঁটতে থাকলে প্রথমে আসে পাব্লিক ইস্কুল। হাতের ডান দিকে। ইস্কুলের পরেই গলী। গলীর মাঝামাঝি তরজার নীচু বেড়া ঘেরা বাড়ি। মুখোমুখি জলা। কচুরী পানায় ঢাকা। জলার ঐ পারে ‘প্রফেসর পাড়া’। বাড়ির উঠানের এক পাশে নিম গাছ। অন্যপাশে ভিতর বাড়িতে যাওয়ার পথ। ভিতর বাড়ির উঠানের পাকঘর অন্য পাশে পুকুর। সেই জল থই থই পুকুর। অন্তহীন পুষ্করিণী। তারি অন্য পারে ভয়। গা ছম্‌ ছম্‌। কলা গাছের সাড়। বড় বড় কচু গাছের শিবির। কুয়াশা। অন্ধকার। ঐ অথৈ জলেই কতোবার ডুবে গেলো নৌকা, রাজা-রাজরার ময়ূরপঙ্খী, চাঁদ সওদাগরের মধুকর। ঐ পারাপারহীন পুকুরেই কতো বুদ্ধু-ভুতুম পাড়ি দিলো রাজকন্যার সন্ধানে ...
      ঐ পুকুরই সীমা। বাড়িটির। সীমানার তরজার বেড়ার কিনারে কিনারে আমগাছ। দক্ষিণের সীমানার ঐ পারে ইস্কুল। পাব্লিক ইস্কুল। জেঠু ঐ ইস্কুলে পড়ান। ঐ ইস্কুলেই একবার নাটক হয়েছিল। সেই চল্লিশ চোরের গল্প। সেই ‘আলিবাবা-মর্জিনা’। সেই ‘চিচিং ফাঁক-চিচিং বন্ধ্‌’। সেই থেকেই মর্জিনা’কে মনে ধরে গেলো।
      বাবু’র ফিরতে রাত হয়। বাবু গান করেন। গান শেখান। গলা সাধেন সক্কালে উঠে। তাঁকে সবাই বলে ‘দাদু’ । ‘বাবু’ ঠাকুর্দার একটু দূরের সম্পর্কের মামা। তাই অবিনাশের বাবা’র ‘দাদু’, পিসীর ‘দাদু’। তাই অন্যদেরো ‘দাদু’। বাবু’র ফিরতে রাত হয়। বাবু না ফিরলে কেন যেন গল্প শুনেও, তোমার এই পরস্তাবগুলি শুনেও ঘুম আসেনা চোখে। রাত্রির শরীরের পাকে পাকে মিশে যায় গল্প গুলি। জোনাকির আলোতের গভীরতর হয় অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ ডাকে। ...   নিশুত রাতের আবহে ঐ ছড়া অনুরণিত হয়, যেন স্থায়ী অন্তরা, যেন মালকোষ ...
এই ছবিটিতে এসে পৌঁছতে তোমার আর কত দেরী সদাগর?
৬।
‘এই পরস্তাবতো হিন্দুস্তানের পরস্তাব’
‘ তাইতো কই, সদাগর, তোমার পরস্তাব সব পাকিস্তানের আর আমার ঘুমের মইধ্যে যত ছবি স-অ-ব আরো কুনখানের...’
‘ অই আরো কুন্‌খানের দিকে যাওনের আগে দেইখ্যা লও- দেইখ্যা লও এই মন্দির। পাক্কা-গাঁথনীর শিবমন্দির। চাঁদরাম মুন্সীর প্রতিষ্ঠিত। নিরুদ্দেশ হইবার  চাইর পাচ বচ্ছর আগে এই মন্দিরের স্থাপন। কথা আছিল কইন্যা সন্তান হইলে মন্দিরো বিগ্রহ বইব। কিন্তু চান্দরাম নিজেঅই তারপরে নিরিদ্দেশ ...”
“সদাগর, চান্দরাম কে?”
“চান্দরাম তুমার ঠাকুর্দাদার বাবা”
 ৭।
   অনেকেই বলিতেছে যে সুরেশ বিশ্বাসের উপর দেওয়া মামলাটি ধোপে টিঁকিবেনা। এ স্রেফ সাজানো মামলা। তথাপি প্রায় তিন মাস হইল সুরেশ বিশ্বাস হাজতে।যে কোনো দিন যে কোনো মামলায় ইহাদেরো জড়াইয়া দিতে পারে আন্‌সারেরা। তারিক সাহেবও একজন আন্‌সারই বটে। তথাপি গান বাজনা ভালবাসে বলিয়া লোকটি হারানকে শ্রদ্ধা করে। ফটিকের পিতা শিবেন্দ্রচন্দ্রকেও সে জানিত। তাহার জেঠা নিজেও স্বদেশী করিতেন। পরের দিকে ‘লীগ’এ গেলেও হিন্দু বিদ্বেষ তাঁহার ছিলোনা। বরং শিবেন্দ্র বিশ্বাস, সুরেশ বিশ্বাসের প্রতি ছিল শ্রদ্ধাই। তারিক সেই জেঠার হাতেই মানুষ।
সে আসিয়া খবরাখবর দেয় বটে তবে সেই খবরেও উদ্বেগ। আন্‌সার সাহেবের মনেও উদ্বেগ। বিতৃষ্ণা। সে বলেঃ ‘পাকিস্তান হইয়া সব শালারা যেমন হাতো চান্দ পাইসে। আরে বাবা পাকিস্তান তরার না ঐ বেটা তুর্কীর বেটারার হিটা ত দেখতে ভাইব্যা। মরার আগে জেঠা মশয়েও কইতা ‘রে তারিক, ‘পাকিস্তান’ সাপোর্ট কইরা ভুল করলাম না কিতা’  থামে আন্‌সার সাহেব। তারপর আবার বলেঃ’ কিতা করা মাষ্টরবাবু, পেটের দায়ে চাকরি করা ...” অন্য মুসলমানরাও ইহাকে ‘হিন্দু’ বলিয়া সম্বোধন করে। ক্রমে অবস্থা এমনি হইয়াছে যে আনসার সাহেব ফটিকদের বাড়িতে দিবালোকে আসা ছাড়িয়াছেন। রাত্রেও আসেন নদী পারের পথটি ধরিয়া। বলিয়া যান খবরাখবর। রাস্তা দিয়া সাইকেল চালাইয়া চলিয়া যায় মুসলমান দারোগা পুলিশ। যাইতে যাইতে মন্তব্যও করিয়া যায়। ‘ই শালারা আর যাইতো না না’কিতা  রে’, ‘যাইতোনা? শালারজাতের  বাপ যাইব ...’ কথাগুলি শিশিরের কানে আসে। আসে সুলেখার কানে।
সন্ধ্যা হইতে দোকানে পাটে বসিয়া আড্ডা জমায় মুসলমান যুবকেরা যাহারা কিছুদিন আগেও ফটিক বা হারানকে দেখিলে বিড়ি লুকাইত। আজ তাহারাই আওয়াজ দেয় ‘কিতা ফটিকদা হিন্দুস্থানো যাইতা না’নি?”
খবর আসে কলিকাতা ‘রিফিউজি’তে ভরিল বলিয়া। কাছাড়ের দিকে গেলে কেমন হয়? সেইখানেও রিফিউজি। শোনা যায় লোকে গরু রাখিবার বাঁশের চালাঘরও রিফিউজি দিগের কাছে ভারা দিতেছে চড়া দামে। মাথা গুঁজিবার প্রয়োজনে তাহাতেও আশ্রয় লইতেছে লোকে। - এই সকল ভাবনায় ভুবিয়া,ভাসিয়া, সাঁতার দিয়া রাত্রিপথে চলিতেছিলেন হারান। আসিয়াপড়িয়াছেন
তেকোনা পুকুরের পাড়ে। অতোদূর পথ যেন নিজের অজান্তেই পারাইয়া আসিয়াছেন হারান। তিন চারিটা অন্ধকার মানুষ যেন এই মাত্র মাটি ফুঁড়িয়া উঠিয়া আসিয়া ঘিরিয়া ধরিল হারানকে। বলিলঃ” কে? মাস্টরবাবু নি?”
কি চায় ইহারা? পিটাইবে? খুন করিবে? সম্‌বিৎ ফিরিয়া পাইয়া হারান বলিলেনঃ ‘অয়, আমি হারান মাষ্টার। কিন্তু তুমরারে তো চিনলাম না...”
“মাষ্টারবাবু, আমরারে  চিনার দরকার নাই। আমরা যে আপনারে চিনছি হিটাই ভালো। দিনকাল ভালা নায়। অতো রাইত বাইরে থাকবা না”।
“ না, থাকি না’ত। আজকে একটা কাজে ...”
“ঠিক আছে মাষ্টারবাবু। আপনে যাইন। আমরা আপনার পিছে পিছে আইতাছি। কিন্তু  অতো রাইত আর বাইরে থাকবা না ...”
হারান হাঁটিতে লাগিলেন।
পরদিন সকালেই খবর পাওয়া গেলো  তিন কোনা পুকুর আর মেমের ইস্কুলের মাঝামাঝি স্থানে বিলাস দাস আর শচীন পালের লাশ পাওয়া গিয়াছে।
৯।
সন্ধ্যাবেলা আসিলেন আন্‌সার সাহেব।যথারীতি পিছনের পথে। নদীর পার দিয়া। সাইকেলটি শিব মন্দিরের নিকটস্থ ঝোপে লুকাইয়া।
সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে বেশ কিছুক্ষন। ফটিক বাড়ি নাই। কাছে পিঠেই কোথাও গিয়া থাকিবেন। পিছনের তুলসী তলায় প্রদীপটি জ্বলিতেছে মিট্‌মিট্‌ করিয়া। সমস্ত অশান্তি, উত্তেজনা, ভীতি সত্ত্বেও এই আবহের কোথাও যেন শান্তি ছিল, ছিল ক্ষনজীবি হইলেও, স্থিরতা।আন্‌সার সাহেবের হঠাৎ আগমন এই আবহকে যেন টলাইয়া দিলো।
        দ্রুত আসিয়া বারান্দায় উঠিলেন আন্‌সার সাহেব। অন্য দিন নদীর পার হইতে নীচু স্বরে হারান কিংবা ফটিকের নাম ধরিয়া ডাক দেন নতুবা গলা খাঁকারি। আজ সটান উঠিয়া আসিলেন পিছনের বারান্দায়। উঠিয়াই নীচু গলায় ডাকিলেনঃ ‘মাষ্টারবাবু আছইন নি ? মাষ্টারবাবু?’ আন্‌সার সাহেবের স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যাহা সন্ধ্যার শান্ত নীরবতাকে মুহুর্ত্তে রক্তাক্ত করিল। ঐ স্বর কানে যাওয়ামাত্র শিশির যেন আমূল উঠিলেন কাঁপিয়া। হাতের কাজ রাখিয়া সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়া আসিলেন।
‘না, মামা ত’ নাই। কেনে কইন চাইন?’ তারপরই মনে হইল মানুষটিকে অন্ততঃ বারান্দায় আমন্ত্রন জানানো উচিত। তখন বলিলেন ‘... আইন, ভিত্‌রে আইন্‌...’
‘ না দিদি। ভিত্‌রে আওনের সময় নাই। আমার পিছেও চর ঘুরে।  আসল কথা হইল মাষ্টারবাবুর নামে হুলিয়া বাইর হইব, আজকে সব কাগজ পত্র বানানি হইসে।’
‘হুলিয়া? কিয়ের হুলিয়া?...’ শিশির যেন চিত্রে অর্পিত। আধো অন্ধকার দাওয়ার মধ্যেই বসিয়া পরিলেন আন্‌সার সাহেব। বলিলেন ‘দিদি একটু জল খাওয়াইবা নি? গলাটা শুকাইয়া গেছে। শালার চর ইতারে এড়াইতে কত পথ ঘুইরা যে আইতে লাগ্‌সে ...’
ত্রস্তে জল আনিয়া দিলেন শিশির। আন্‌সার সাহেবের কন্ঠস্বরের তলোয়ার, শিশিরের ত্রস্ততা ভীত করিল সুলেখাকেও। পিছনের দিকের দরজার চৌকাঠে আসিয়া দাঁরাইলেন তিনি। তাঁহাকে ঘিড়িয়া কাচ্চাবাচ্চা গুলি। বড় মাপের পিতলের গেলাসের জলটুকু গলাধঃকরন শেষে ক্রমে স্থিত হইলেন আন্‌সার সাহেব। অতঃপর যাহা বলিয়া গেলেন তাহার তর্জমা হয় এই রূপ, যে,কাছাড়িতে আগুন দেওয়া, সরস্বতী পূজার দিনের দাঙ্গা, তিকোনা পুকুরের জোড়া খুন এই সমস্ত মামলায় এস.ডি.ও সাহেব বড়ই বিপাকে পড়িয়াছেন কেননা এই সমস্তের হোতা মূলতঃ তিনি নিজেই। ঐ কারনেই সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাসকেও পুরিয়াছেন জেলে। নতুবা ভয় এই, যে, সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাস যেহেতু নির্বাচিত এম এল এ ফলে আসন্ন কাউন্সিলে তিনি তুলিবেন প্রসঙ্গ গুলি। এইবার মামলাটিকে আরো জোরদার করিতে মিছা সাক্ষীর সহিত আরো কিছু হিন্দু, যাঁহারা ‘স্বদেশী’ আমলে ছিলেন নেতৃস্থানীয় উহা দিগকেও আনিতে হইবে মামলার আওতায়। আজ হারানের নামে হুলিয়ার কথা চলিতেছে কাল চলিতে পারে ফটিকের নামেও হুলিয়া বাহির করিবার তোড়জোর।
এইবার ‘দিদি মাপ করবা’ বলিয়া, ঐ দাওয়াতে বসিয়াই একটি কাঁচি সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করিলেন আন্‌সার সাহেব। কিছু সময় নিঃশব্দে ধূমপান করিয়া গেলেন। অতঃপর নদীর শরীরের ঘনবদ্ধ কুয়াশা ও অন্ধকারের দিকে চাহিয়া যেন করিলেন স্বগতোক্তিইঃ ‘ দিদি, অখন পাকিস্তান হইসে। অখন এইরকম আর কতো কিচ্ছু যে হইব ...’ থামিয়া যান আনসার সাহেব। হাতের সিগারেটে টান দেন। আবার বলেনঃ ‘আমার তো রুটির গুলাম। আমরার হাত পা বান্ধা। ইরকম অই বইয়া বইয়া দেইখ্যা যাওন ছাড়া আমরার গতি নাই। জানিনা আজ যে টুক করতে পারছি ভবিষ্যতে এ’ও পারমু কি’না’ ...
কথাগুলি বলিয়া লইয়া যেমন আকস্মিক ভাবে আসিয়া ছিলেন তেমনি আকস্মিক ভাবে চলিয়া যান আন্‌সার সাহেব। যেন মিলাইয়া যান নদীর বুকে নামিয়া আসা অন্ধকারের সূচীভেদ্যতায়। কাচ্চাবাচ্চা সহযোগে শিশির-সুলেখা দাঁড়াইয়া থাকেন স্থানুবৎ। বাতাস হইতে নিঃশেষ হইয়া যায় ধূপের সুঘ্রানটুকু।
হঠাৎই চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠেন সুলেখা।
১০।
বড় রাস্তার কিনার ঘেঁষিয়া নীচু পাঁচিল। পাঁচিলের কিনারে কিনারে বড় বড় গাছ। ফটকের দুই পাশে দুইটি বকুল গাছ। সমান করিয়া কাটা ঘাসের মাঝগান দিয়া লম্বা হাঁটিয়া হেড মাষ্টারের অফিসঘর। দুই দিকে ছড়ানো বারান্দা। কেয়া ফুলের ঝোপ বারান্দার কিনারে কিনারে। পিছনে বিরাট পুকুর। পুকুরের এক পারে লাইন দেওয়া শৌচাগার। পুকুরে নুইয়া পরিয়াছে গাছ গাছালির বৃদ্ধ শাখা। পুকুরের অন্য পারে ধূ ধূ মাঠ। ঐদিকের পাঁচিলের অনেকটাই ভাঙ্গিয়া পরিয়াছে ছেলেদের দেওয়াল পারানো লাফালাফিতে।
ইস্কুল বসিয়া গিয়াছে। পার হইয়া গিয়াছে প্রথম দুইটি পিরিয়ডও। হারানের ক্লাস ছিল একটি কিন্তু কি’যে পড়াইলেন, কি’যে পড়া নিলেন নিজেই যেন টের পাইলেন না কিছু। বাড়িতে বাঁধা ছাঁদা আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আন্‌সার সাহেব যে কেন হারানকে ইস্কুলে আসিতে বলিলেন তাহার কিছুই এখনো বোঝা গেলোনা। ফটিক হাসপাতালে যান নাই। মাঝে মাঝেই যাননা। কাজেই কেহ কিছু ভাবিবে না। হয়ত হারান ইস্কুলে না আসিলে কাহারো কোনো সন্দেহ হইতে পারে –এই জন্যই বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছেন আন্‌সার সাহেব। কেজানে হয়তো ইস্কুলের মাষ্টার, এমনকি ছাত্রদের ভিতরেও রহিয়াছে পাকিস্তানি চর ...
     অফ্‌ পিরিয়ডে পুকুরপারে গেলেন হারান। পায়খানা-ঘর গুলি পারাইয়া নারিকেল গাছের তলায় দাঁড়াইয়া জ্বালাইয়া লইতে গেলেন সিগারেট। দমকা বাতাসে কাঠি জ্বলিলনা। আবার চেষ্টা লইলেন। জ্বলিল এইবার। দমকা বাতাসের গায়ে সিগারেটের নীল ধোঁয়া ভেলা হইল। পুকুর পার হইয়া গেলো। ‘মাষ্টারবাবু!!’ কে যেন ডাকিল চাপাস্বরে। হারান মুখ তুলিলেন। পায়খানা ঘরের পিছন হইতে যে ছেলেটি উঁকি দিয়া আছে তাহার নাম হাবিব। সে কোন্‌ ক্লাসে পড়ে? এইটে না নাইনে??? ঐখান হইতেই চাপাস্বরে বলিল হাবিবঃ ‘মাষ্টারবাবু, ‘আন্‌সার সাহেব’এর চিঠি’ বলিয়াই একটি সাদা খাম, পায়খানা ঘরের আড়ালে, ঘাসে, রাখিয়া দিয়া পলাইল হাবিব। কাঁপা হাতে, তিন চারিটি কাঠি পোড়াইয়া, আরেকটি সিগারেট জ্বালিলেন হারান। কুড়াইয়া লইলেন খামটি। কাপড়ের খাম। মোহর করা। খামটি কুড়াইয়া লইয়া ঢুকিয়া গেলেন তিন জোড়া পায়খানা ঘরের একটিতে।
‘ খলিফা নামাজে যাইতেছেন তাই বেশী বোঝা লইলে হইবে কেন? নামাজের জন্য এক কাপড়ই যথেষ্ট’ –এই পর্যন্ত পড়িয়া চম্‌কাইলেন হারান। কি সব আবোল তাবোল লিখিয়াছে আন্‌সার সাহেব? আবার মনে হইল কেনইবা লিখিবে আবোল তাবোল? এই হস্তলিপি যে আন্‌সার সাহেবের ইহারিবা স্থিরতা কি??? সমস্ত যাইতেছে জট পাকাইয়া। তথাপি পড়িতে লাগিলেন হারান। ‘ কিন্তু সকলে একত্রে গেলে নামাজে ব্যাঘাত ঘটিতে পারে। খলিফা একা গেলেই ভালো। অন্যেরা আলাদা। মশজিদে খলিফা পরিচিত লোক পাইবেন। সন্ধ্যার আজানের সময় সকলেরি মশজিদে থাকা উচিত। খলিফার সেই বন্ধু অন্য সকলকেও ইহা জানাইয়া দিয়াছে। সুতরাং কাগজের বোঝাও বাড়াইয়া লাভ নাই। দোস্থ মানুষেরা এই কাগজ পুড়াইয়া শীতে আরাম পাইবে’ ...
চিঠি শেষ। হারানের মাথা যেন ঘুড়িতেছে। কি লিখিয়াছেন আন্‌সার সাহেব? না’কি এই চিঠি আগাগোড়াই জাল? ‘খলিফা নামাজে যাইতেছেন’ - কে খলিফা? কেন যাইতেছেন নামাজে? কেন লইবেন না বোঝা? - চিঠিটি পকেটে পুরিয়া পায়খানা ঘরের বাইরে আসেন হারান। ঘড়ি দেখেন। আর দশ মিনিট পরেই সেভেনে যাইতে হইবে বিজ্ঞান পড়াইতে।
ইস্কুল বাড়ির দিকে আগাইলেন হারান। যদিও তাঁহাকে দখল করিয়া রহিয়াছে আন্‌সার সাহেবের সেই অদ্ভুত চিঠি তথাপি ক্লাশঘরে ঢুকিতে হইবে হারানকে। ঢুকিলেন।ঢুকিয়াই ব্ল্যাক বোর্ডে লিখিয়া দিলেনঃ ‘ ব্যাঙ্গের জীবন চক্র আর সালোক সংশ্লেষ চিত্র সহ ব্যাখ্যাকর’ তারপর আবার ভাবিতে বসিলেন আন্‌সার সাহেবের চিঠিটি লইয়া...
১১।
দ্রুত পায়ে ইষ্টিশানের দিকে চলিয়াছেন হারান। দ্রুত চলিলেও চলিতেছেন না ঠিক সোজা পথে। আন্‌সার সাহেবের অদ্ভুত চিঠির খলিফা যে তিনি নিজে, তাঁহাকেই যে বলা হইয়াছে ষ্টেশানে একা যাইতে এই কথাগুলি ক্রমে স্পষ্ট।
হারান এইবার স্পষ্ট বুঝিতে পারেন যে মশজিদ বলিতে ষ্টেশানই বুঝাইয়াছেন আন্‌সার সাহেব ... আর শেষে আগুন? হায়, এই সহজ কথাটিও আসিলনা তাঁহার মগজে, নিজেকেই গালি দিলেন হারান ... এই চিঠিটি পড়িয়া পুড়াইয়া ফেলিতে হইবে ... নতুবা কাহারো হাতে গিয়া পরিলে ...
    তিনটার ভূগোল ক্লাস শেষ করিয়া আরো একঘন্টা চুপ করিয়া কমন্‌রুমে বসিয়া থাকিলেন হারান। এখুনি ষ্টেশনে গেলে নির্ঘাৎ লোকে সন্দেহ করিবে। আচ্ছা, ফটিকদেরকে সত্যই খবর দিয়াছেন তো আন্‌সার সাহেব? উহারা বুঝিতে পারিয়াছে সমস্ত? উহারা সব ব্যবস্থা আন্‌সার সাহেবের পরিকল্পনা মতো করিতেছে ত? বিকালের আখাউড়ার গাড়িটি ধরিতে হইবে। প্রতি গাড়িতেই এখন ভিড়। ইতিমধ্যে খুলনায়, রাজশাহীতে রায়ট হইয়াছে, কৈবর্ত্যখালিতে হইয়াছে রায়েট। রেলে বাসে দাঁড়াইবার স্থান নাই। রেলের, বাসের ছাতে বসিয়া যাইতেছে লোকে ... এমতাবস্থায় কিভাবে এই কাচ্চাবাচ্চা গুলিকে পার করা? কিভাবে পার করা পোয়াতী সুলেখাকে? শিশিরের জন্য ভাবনা নাই। সে শক্ত ধরনের মেয়ে। তিনবার জেল খাটিয়াছে স্বদেশী আমলে। সে পারিবে ...
 এইসব কি ভাবিতেছেন তিনি? আবার হতবাক হইয়া যান হারান। সিলেট হইতে, তাঁহার নিজের শহর হইতে পলাইতেছেন হারান? পলাইতেছে ফটিক, শিশির যাহাদের জন্ম এই স্থানে? কাহারা পলাইতেছে? যাহাদের প্রত্যেকে এই দেশের স্বাধীনতার জন্য,একদা, নিজ নিজ সামর্থ মত আগাইয়া দিয়াছে নিজেকে সে’ই তাহারাই পলাইতেছে। পলাইয়া যাইতেছে কোথায়?
হারান টের পাইতেছেন দুইটি ষোলো সতেরো বছরের ছেলে তাঁহাকে অনুসরন করিতেছে। ইহারা কারা? ইহারা কি আন্‌সার সাহেবের ঠিক করিয়া দেওয়া কেহ না’কি?না এখন আর সময় নাই ভাবিবার। ইষ্টিশানে গিয়া দেখিতে হইবে ফটিকেরা আসিল কি’না-
১২।
‘তারপরে কি হইল সদাগর?’
উত্তর মেলেনা।
‘ও সদাগর! তারপরে কি হইল? কথা কওনা ক্যানে?’
তথাপি নিরুত্তর সদাগর।
‘ও সদাগর, তারপরের কথা তুমি জানোনা?”



সদাগর না’কি চরাচরব্যাপ্ত অন্ধকার বলে উঠলোঃ ‘জানি, কিন্তু ক’মুনা’।



১২/৩/২০১২ – ১৬/৮/২০১৭
বেঙ্গালোর







ঘুম ঘর