"ডেকোনা তারে ..."
এই "ইউ-টিউব" আর "আমাজন প্রাইমে"র এক নিঝ্ঝুম দুপুরে, বাড়িতে
একা বসে "ওয়ার্কিং ফ্রম হোম্" করতে করতে মনে একটা সুর উঠলো বেজে আর
ইউ-টিউব-ম্যাজিকে মুহুর্তে সে গান, সেই সুর বেজে উঠলো আমার ল্যাপটপে। আর ওই কথা,
কন্ঠ, সুরের টানে যেখানে চলে গেলাম সেখানে 'আজাদ সাগর' নামের
দিঘি।
বিরাট। শ্যাওলা ঢাকা। সারাবছর। পার হয়ে সুপারীগাছের ছায়ায় ঢাকা ছোটো একটি বাড়ি।
তার পরের বাড়িটিই সম্ভবতঃ। অম্বাম্যাডামদের বাড়ি। ম্যাডাম বাংলা পড়াতেন এগারো-বারো
কেলাসে। গভর্নমেন্ট ইস্কুলে। আমি ওই ইস্কুলেই। তবে তখন আট বা নয় কেলাসে বড়জোর।
ম্যাডামদের বাড়িত বিশাল চত্ত্বর। সামনের দিকে নারকোল গাছ। উঁচু। বেশ কয়েকজন। তাদের
ছায়ায় মূল বাড়িটি। বিরাট ।পিছনে আম-নিম-সুপুরির সারি। চত্ত্বরের সামনের দিকে, এক কোনে
আসাম-টাইপ আরেকটি ছোটোবাড়ি। হালকা হলুদ দেওয়াল। তারও সামনে-পিছনে নারকোন-সুপুরী-আম-নিম।
ইস্কুলে আসাযাওয়ার পথের ধারের প্রতিটি বাড়িরই তখন ছিল এক একটি
ভিন্ন চরিত্র, ব্যক্তিত্ব। এই বাড়িটাও তেমনি। নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ছাড়া ওটা
"ম্যাডামের বাড়ি" - এতদ্ভিন্ন বাড়িটির প্রতি আলাদা কোনো উৎসাহের হেতু,
আমাদের, ছিলনা। বহুদিন।তবে হঠাৎই বাড়িটি, অন্ততঃ আমার কাছে, উঠলো অতি রহস্যময় হয়ে,
আকর্ষণীয় হয়ে।
হয়তো সে ছিল কোনো শনিবার নয়তো ইস্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল জলদি
জলদি। বাড়িফেরা পথে অম্বা ম্যাডামদের বাড়িটি পারহয়ে যেতে গিয়েই থম্কে দাঁড়াতে
হলো।ভেসে আসছে সুর। উড়ে আসছে গান। ততোদিনে আমাদের প্রত্যন্ত মফস্বলেও ঢুকে পড়েছে
টেপ রেকর্ডার, "স্টিরিও"। তবু যে সুর,অম্বা ম্যাডামদের বাড়ির চত্ত্বরের
ওই ছোটো, হলুদ দেওয়াল আসামটাইপ বাড়িটি থেকে উড়ে এসে ভাসিয়ে দিচ্ছিল দুপুরের আকাশ,
আবহ, ঘুম-ভাব, তা, আমার আট কেলাসে পড়া কানও মানতে নারাজ ছিল টেপ রেকর্ডারজাত মেনে নিতে।
যে কন্ঠ, যে অপূর্ব পুরুষকন্ঠের সুরটি নির্মাণ করছিল এই ইন্দ্রজাল সে'ও যেন মানায়
না টেইপ রেকর্ডারে। সম্পূর্ণ আবহটি যেন রেকর্ড প্লেয়ারের। শুধুমাত্র রেকর্ড
প্লেয়ারেরই।
যতটা সম্ভব শুনে নিলাম সেদিন অম্বা ম্যাডামদের বাড়ির নিচু
বাউন্ডারি দেওয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে। সুর রইলো মর্মে জেগে। গানের কথা কিছুই প্রায়
আঁচ করা গেলোনা। 'অল্ ইন্ডিয়া রেডিও' র দৌলতে ততোদিনে শুনেছি যতো গান তাতে রাগাশ্রয়ী, আধুনিক, টপ্পা... ধরতে
পারি কানে শুনে। আবছা শুনে টেরপেতে পারি রবীন্দ্র আর অতুলপ্রসাদী সংগীত। সেইটুকু
জ্ঞান সম্বল করেই টের পেয়েছিলাম, যে, এই কন্ঠ আগে শুনিনি আর এই সংগীত রাগ প্রধান
হলেও রামকুমারী রাগপ্রধানের সঙ্গে এর দূরত্ব্ব দুস্তর।
এরপর থেকে ওই
বাড়ির কাছাকাছি হলেই কানখাড়া রাখতাম সুরের সন্ধানে। কোনো কোনো দিন সুর বাজতো। কোনো
কোনো দিন বাজতো না। তবে প্রথম দিনে শোনা কন্ঠের একটি গানের একটি পংক্তি, ক্রমে
দুইটি গানের - ঠাউরানো গেলঃ "ব্যথা কেমনে জানাবো বল শ্যামরায়", "
ডেকোনা তারে চলে অভিসারে..." টের পেলাম " কাটেনা বিরহা কি রাত" এর
ছায়া ""ওগো, শ্যাম বিহনে বৃন্দাবনে কাটেনা বিরহীর রাত" গানে ...
কার কন্ঠ? আগেই ঠিক করে রেখেছি রাজাদা জেনে নেবো। হোস্টেলে
থাকে রাজাদা। আরশহরে। কখনো বাড়ি আসে শনি-রবিবারে। কখনো অন্য ছুটিছাটায়। যদিও আগেই ঠিক
করে রেখেছি রাজাদা জেনে নেবো তবু মাঝে রাজাদা দু'একবার এলেও অন্য কথায়, অন্য গালগল্পে
ভুলেগেছি কথাটা।
শনিবার-রবিবার
না'কি অন্য ছুটির দিন খেয়াল নেই। বাড়িতে, সকালবেলা, সদ্য লেখাপড়া একপ্রস্থ শেষ
করেছি হঠাৎই ভেসে এলো সুর, কথাঃ "ওগো, শ্যাম বিহনে বৃন্দাবনে কাটেনা বিরহীর
রাত" । তবে কানে বাজলোনা সেই রেকর্ডপ্লেয়ার বিভা। কান পেতে বুঝলাম গানটা ভেসে
আসছে রাজাদাদের বাড়ি থেকেই। তবে কি রাজাদা এসেছে? এক দৌড়ে রাজাদাদের বাড়ি গিয়ে
দেখি রাজাদা এসেছে। ও'ই টেপরেকর্ডারে বাজাচ্ছে গানগুলি। বল্লো কাল আসতে আসতে বেশ
রাত হয়েছে তাই আর আমাকে ডাকেনি। আমি বল্লামঃ "এই গানগুলো ..."
"অখিলবন্ধু ঘোষ। খুব রেয়ার। তোদের অম্বা ম্যডামের
বাড়িতে যাঁরা নতুন ভাড়াটে এসেছেন ওই বাড়ির বৃদ্ধ শোনেন। রেকর্ড আছে তাঁর। আমি
একদিন ঢুকেপড়েছিলাম ওঁদের বাড়িতে। তারপর টেপ রেকর্ডারে ধরে এনেছি গানগুলো। এদ্দিন
হোস্টেলেই ছিল ক্যাসেটটা। এবার নিয়ে এসেছি ..."