প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Thursday, June 14, 2018

‘বাংলা’ একটি ভাষার নাম / সপ্তর্ষি বিশ্বাস

‘বাংলা’ একটি ভাষার নাম 
সপ্তর্ষি বিশ্বাস 

  

১। 
‘বাংলা’ একটি ভাষার নাম। 

না’কি ‘বাংলা’ একটি ‘দেশের’ নাম? 

অভিধানে, হয়, বাংলা একটি ভাষা। 

মানচিত্রে, হয়, বাংলা একটি দেশ।  
জন্মসূত্রে আমার ‘ভাষা’ বাংলা। আমার উর্ধতন, হয়তো হাজার পুরুষেরই ভাষা বাংলা। হয়তো বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এঁদেরো ঘটেছে বিবর্তন। সেই বিবর্তন লেখ্যভাষাকে নিয়ে গিয়েছে, যাচ্ছে এক স্রোতে। সমান্তরাল স্রোতে স্থানের প্রভাবে, বাংলা কথ্যভাষা পরিগ্রহ করেছে ভিন্ন ভিন্ন রূপ। সেরমই এক স্থানিক বাংলা, যা, হয়, ‘সিলেটি বাংলা্‌ আমার মুখের ভাষা। আমার লেখার ভাষা কালী সিংগী, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, মীর মোসর্‌রফ হুসেন,জীবনানন্দ, কমলকুমার, আল মাহমুদের বাংলা। 
তাহলে, সেই উত্তরাধিকারে ‘বাংলা’ কি আমার দেশ? আমারও দেশ? যদি,হয়, তা’ই, তবে কি তার মানচিত্র? কি তার ভূগোল? কি তার সংস্কৃতি? – অনুভব হয়, হয়তো এই একই প্রশ্নে আমর্ম কম্পিত, সুনিশ্চিত, তখন, ভিড়ের রেলগাড়িতে, আমার তখনযুবক ঠাকুর্দা। তখনবালক আমার বাবাকাকা, মামাসী – তারা নিশ্চয়ই, বয়সগত কারণে টের পায়নি এই সূচীভেদ্য প্রশ্ন, এই পারাপারহীন সংশয়। তথাপি এ’ও নিশ্চিত, যে, তাদের মর্মে, অপর অক্ষরে, অন্য মাত্রায় বেতে উঠেছিল এই কথাগুলিঃ “আমি চাইনি দিদি, আমি তোকে ভুলিনি, ইচ্ছে করে ফেলেও আসিনি – ওরা আমায় নিয়ে যাচ্ছে’ – 
না’ত আমি দেখেছি পাকিস্তান, না’ত বাংলাদেশ, না’ত বেয়াল্লিশ থেকে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন পর্যন্ত সেই সমস্ত ‘এক্সোডাস’ – যা মোসেসহীন, যা রক্তাক্ত, যা ধর্ষিত – পরে একাত্তর বাহাত্তরে আবার। আমি ভারতমানচিত্রের রাজনৈতিক নাগরিক হয়েই জন্মেছি। তথাপি, মর্মে, অদ্যাবধি আমিও বলি, প্রায় মহুর্মুহুই বলিঃ “আমি চাইনি দিদি, আমি তোকে ভুলিনি, ইচ্ছে করে ফেলেও আসিনি – ওরা আমায় নিয়ে’  এসেছে… 
বলি। কিন্তু কাকে বলি? কারা আমায় নিয়ে এসেছে? কেন নিয়ে এসেছে? কোথায় নিয়ে এসেছে? – এহেন প্রশ্ন, হে পাঠক, গো পাঠিকা, আপনাদের মর্মেই যখন জন্মদেয় পায়ে কুশের অংকুরের বিদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অসুবিধা, অস্বস্তি, তখন আমার মর্মে যে এই সকল প্রশ্ন শরশয্যারই নামান্তর তা টের পেয়ে যাওয়া,নয়্‌, তেমন দুরূহ। ভাবি, পুনরাগমনের সাধস্বপ্ন গহনে জলাঞ্জলি দিয়ে তবুও জোর করে –‘এ সকলই সাময়িক’ – এরকম এক অসম্ভব বিশ্বাসে থিতু হওয়ার প্রচেষ্টায় আমার তখনযুবক ঠাকুর্দা , তখনযুবতী ঠাকুমা, ঠাকুর্দার ভগিনী ‘দিদিভাই’ - যখন নিরত, যখন তারা পার হয়ে আসছে ‘ভিটাবাড়ি’র আঙিনা, তখন কি তাদের চলাপথে, কোনোও অশ্বত্থ, কোনোও অর্জুন, কোনোও বাঁশঝাড় তার লন্ডভন্ড ছায়া ফেলে বলেওঠেনি কানে কানেঃ “ যেখানেই যাও চলে হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর” ? অথচ আমি শুনি, এই বাক্যাংশটি আমি সতত শুনতে থাকি ‘আকাশ ভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণের’ বিস্ময়ের আবডালে। ‘বিপন্ন বিস্ময়ে’।  
কেন? 
‘কেন’ – এই প্রশ্নটির উত্তরের সন্ধানেই মূলতঃ আমার এই অক্ষরপ্রচেষ্টা। 
হে পাঠক, গো পাঠিকা, দুটি অভিজ্ঞতা, এখানে, যেহেতু ‘সংজ্ঞা অপেক্ষা উদাহরণ ভালো’, তাই, বিবৃত করছি। প্রথম অভিজ্ঞতার স্থানঃ কলিকাতার কলেজস্ট্রীটস্থ, ‘বুদ্ধিগর্বে’ ধূমায়িত, ‘কফিহাউস’। কালঃ সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটা। সালঃ ১৯৯২-৯৩। পাত্রপাত্রীঃ একঃ বর্তমান অধম, দুইঃ একজন  ‘দাদা’ যিনি কলিকাতা বাসকালে ‘কলিকাত্তাই’, নাগাল্যান্ড বাসকালে ‘নাগা’ –ইত্যাদি। তিনি ‘নকশাল বন্দীদের মুক্তি আন্দোলনের শরিক’, ‘হোমো সেক্সুয়েলদের অধিকার’ নিমিত্ত শিয়ালদা চত্ত্বরে পাজামা, পাঞ্জাবী এবং ঝোলাব্যাগসহ উওপস্থিত –ইত্যাদি। তিনঃ ‘দাদা’টিহেনই আরেক ‘কবি’ কাম্‌ ‘এক্টিভিস্ট’। চার, পাঁচ, ছয়, সাত ঐ দুইজনেরই মতন নানাজন। মহিলা, পুরুষ। ‘দাদা’ এই অধম ‘বাঙ্গাল’কে এনেছেন ‘সাব্‌ অল্টার্ণ স্পেসিম্যান’ হিসাবে, এই আসরে। এইবার পরিচয় পর্ব। আমি জানালাম ‘আমি 
 আসামে বাসকরি। আসামের করিমগঞ্জ শহরে’। ‘কবি’ কাম্‌ ‘এক্টিভিস্ট’টি বল্লেনঃ ‘ও বুঝেছি। আপনি আসামী! কিন্তু আপনার বাংলা লেখা পড়লেতো বোঝাই যায়না’। যদিও ‘অসমীয়া’ নই তথাপি ‘আসামে যাহারা বাসকরে তাহারা, হয় আসামী’ এই ব্যাকরণ গলাধঃকরনচেষ্টায়, আমি, তখন ‘আসামী’ থেকে ‘কাঠগড়ায়’।  
আপাতঃ মস্তিময় এই গপ্পো বলেছিলাম শক্তিকাকু’কে। শক্তিকাকু, অর্থাৎ, বাংলাভাষায় যথেষ্ট পরিচিত কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, যিনি আমার পিতার আবাল্যবান্ধব, যিনি আমাকে জ্ঞান করতেন পুত্রবৎ, যিনি, হায়, গত হয়েছেন প্রায় এক দশক। শুনে শক্তিকাকু বলেছিলঃ “শুধু আমার নয়, অবিভক্ত বাংলায় অনেকেরই এমন ছিল, যে, তাদের নিকটতম ইস্টিশান থেকে শিলচর আর কলকাতা দুই’ই সমান সমান পাড়ি।   
                                     শিলচর বা করিমগঞ্জ তখনো নয় আলাদা আলাদা ডিস্‌ট্রিক্ট। তখনো জেলাঃ কাছাড়। আর কাছাড়কে ‘আসাম’ বলে ভাববার কোনো কারণ ছিলনা যদিও ‘ভোট’ বা ‘লাঠি’র জোরে, রাজনৈতিক মানচিত্রে, ‘কাছাড়’ হয়তো তখন গোপীনাথ বরদলৈ’র ভাগেই। কাছাড়কে জানতাম বাঙ্গালীর জায়গা বলেই।  
                              কিন্তু যখন সত্যই পাড়ি দিতে হল ভিটেবাড়ি ছেড়ে, তখন, কাছাড়ের ট্রেনে যে উঠলাম তার একটি হেতু হতেপারে, যে, কলকাতার গাড়ি ইস্টিশানে আসার আগেই এসেছিল কাছাড়ের গাড়ি আর নাহলে কলকাতার গাড়ি থেকে ভিড়, কম ছিল, কাছাড়ের গাড়িতে”। - এই চিন্তাভাবনাছাড়াই চলে আসার মূল্যে ‘আসামী’। পশ্চিমবাংলাবাসীর কাছে। ‘কেলা বংগাল’ – অসমীয়াদের কাছে। ‘বাঙ্গাল’ কলকেত্তায়। আসল কথা ‘নতুন দেশে নতুন জিনিস। নতুন জিনিসের নতুন নাম ‘উদ্বাস্তু’। 
 দ্বিতীয় অভিজ্ঞতার কাল ২০০৪ কিংবা ২০০৫ সাল। স্থান মিসিসিপির নিকটশহর সেন্ট্‌ লুই’র একটি স্ট্রিপ্‌ ক্লাবের রাত্রি। যেহেতু আলোচ্য ক্লাবটিতে সম্পূর্ণ উদাম নৃত্য, মঞ্চে পরিবেশিত হয়, সুতরাং সেইখানে, হার্ড-ড্রিঙ্কস্‌, শুধুই বীয়ার। বারকাউন্টারের মুখামুখি একটি হাই চেয়ারে বসে মৃদু চুমুকে, বীয়ার এবং মঞ্চের পোল্‌ডান্স্‌ চাখার মস্তিমেদুর, তখন, আমি। এমন সময় এক নর্তকী, নাচ শেষকরে, সোজা এসে বীয়ার চাইল। ছুরিধার বারসেবিকা তাকে যা বল্লো, তার অর্থ এই, যে, তার আজকের ফ্রী-ড্রিঙ্কসের কোটা শেষ হয়েগেছে। অতএব এই গেলাস, সে যদি পানকরে, তবে তার খায় লিখে রাখা হমে। তারপর চোখটিপেঃ “এইতো সবে সন্ধ্যা। নিয়ে নাও। নিশ্চয় কাস্টমার পাবে এই গেলাসের দাম চুকানোর’। চোখাচোখি হল সুন্দরীর সঙ্গে। আগেই লক্ষ্য করেছিলাম তার মুখের আদলে মোঙ্গোলিয়ান আদল। এতদ্‌ভিন্ন কয়েক গেলাস বীয়ারে আমার মগজও তখন ‘হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া’। ছুরিধার বারসেবিকাকে বললাম সে যেন আমার আর ঐ মেয়েটির গেলাস ভরে দেয়। মেয়েটি হাসল। হাই চেয়ার টেনে এনে বসলো আমার গা ছুঁয়ে। পরপর কয়েকগেলাস বীয়ারের পরে সে বল্ল ‘প্রাইভেট ডান্স’ নিতে। নিলাম। পর্দাঢাতা প্রাইভেট কুঠুরীতে ঢুকে বল্লামঃ “যদি কিছু মনে না কর, তো একটা ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞাসা করি”। অনুমতি পাওয়া গেলে বল্লামঃ “তোমার মুখের আদল অনেকটা মোঙ্গোলীয় ছাঁদের” হে পাঠক, গো পাঠিকা, পর পর সাত-আটটি প্রাইভেটনাচের সময় কিনে নিয়ে যা শুনলাম, তা এই, সে জানালো আমাকে, কেননা আমি এশিয়ান, যে, এরা সপরিবারে ভিয়েৎনাম থেকে পালিয়ে এসেছিল আশি সালে। নৌকাযোগে। বুঝলাম এদেরই বলাহয় ‘ভিয়েৎনামিজ বোটপিপ্‌ল’। তখন এই নর্তকীর বয়ঃক্রম চার কিংবা পাঁচ। তারা আশ্রয় নিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার কোনো কোনো স্থানে। রিফিউজি ক্যাম্পে। অতঃপর গত প্রায় কুড়ি বৎসর এরা আমেরিকার বাসিন্দা। ক্রমে সবুজ বাসিন্দা।... “নৌকাটাত ভেসেই পড়েছিল। আমার মা আমাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে এসে ঝাঁপ দিল জলে। সাঁতরে ধরে ফেল্লো নৌকা। আমার বাবা পারলনা। বাবা আর ছোটোভাই রয়েগেল ...। সিগারেট দাও”। ভিয়েৎনাম-সুন্দরীর সঙ্গে এলাম ‘স্মোকিং এরিয়া’তে।  
“তোমার মনেআছে স-ব?” 
“না। মা’র আমাকে নিয়ে দৌড়ে আসা, নৌকায় জায়গা পাওয়া, এসব কিচ্ছু মনেনেই। তবে চারিদিকে শুধু জল আর জল এমন একটা ছবি প্রায়ই ভাসে বন্ধচোখে। আর ভাসে অনেক অনেক অচেনা লোকের ভিড়। ভয় ...” 
আমার হোটেলহদিশ আর ফোন নম্বর তাকে দিয়ে বারহয়ে এলাম। ভাড়ার ট্যাক্সিতে যেতে যেতে, আধোনেশায়, আধো সহানুভুতিতে দেখতে পেলাম সেই পিতাকে, যে উঠতে পারলোনা নৌকায়, যে দেখলো তার স্ত্রীকন্যা চলেযাচ্ছে। চলেযাচ্ছে বেঁচে থাকবার, বেঁতে উঠবার স্বপ্নের দিকে, লোভের দিকে ... 
শুনতে পেলাম শিশুকন্ঠ । যার ভাষা আমি জানিনা তবু ঢেউগর্জনের আবহেও ঠিক বুঝতে পারলাম সে বলছেঃ “আমি চাইনি দিদি, আমি তোকে ভুলিনি, ইচ্ছে করে ফেলেও আসিনি – ওরা আমায় নিয়ে যাচ্ছে’ – 

২। 
“আমি তোমাকে ঈর্ষা করি” 
“কেন? বল্লাম না, আমিও তোমারই মতন দেশছাড়, তাড়াখাওয়া পলাতক। উদ্বাস্তু...” 
“সে’তো তুমি নও। তোমার গ্রান্ড ফাদার। তোমার ফাদার ...” 
“তবুও আমারো কোনো দেশ নেই” 
“ না থাক। চাকরিতো আছে। তোমার দেশে তোমার ফ্ল্যাটবাড়ি আছে। সুন্দর সংসার আছে ...” 
“তা হয়তো আছে। তবু” – 
“ আমি জানি আমার বাবা আর ভাইকে, তারা যদি বেঁচেও থাকে, তাহলেও, খুঁজে পাওয়াটা বা হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াটা, নাসম্ভব, নাবাস্তব। এখন আমি যা চাই, তা, যে কোনো দেশে, যে কোনো উপায়ে একটি নিরুদ্বেগ যাপন। আমি আর আমার মা। আমাকে এই দেশে একটা বাড়ি কিনতেই হবে। আমার জন্য না। মা’র জন্য ...” 
সেন্ট লুই আর্চের দিকে পিঠদিয়ে ডিসেম্বরের রোদে বসে আছি। আমার এইযাত্রা বিদেশ সফরের মেয়াদ আর এক হপ্তা। তারপরেই আরম্ভ হবে বরদিনের ছুটি। 
‘হাউস’ বলছিল কখনো। কখনো ‘হোম’। হায়, আমি টের পাচ্ছিলাম মিসিসিপির স্রোতের থেকে উঠে আসছে সেই আপ্তবাক্যঃ “ যেখানেই যাও চলে হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর”  
‘ঘর’ ছেড়ে ঘরের সন্ধানে একজন অভিনয় করেযাচ্ছে নগ্ননটীর ভূমিকায়। হয়তো তার হারিয়ে যাওয়া পিতা আর ভ্রাতাও এই যুক্তরাষ্ট্রেরই কোন্ও রাতবাসরের ‘বাউন্সার’ কিংবা ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ … 
একটা সিগারেট জ্বেলেনিয়েঃ “আমরা টাকা জমাচ্ছি। আমার মা’ও কাজকরে। একটা পেট্রোলপাম্পে 
হে পাঠক, গো পাঠিকা, ‘সুবর্ণরেখা’র ঈশ্বর চক্রবর্তীকে মনে আছে? মনে আছে তার বোন “সীতা”কে? এমনি একটি ‘ঘর’, ‘হোম’, ‘গৃহ’ ঈশ্বর চক্রবর্তী দিতে চেয়েছিল তার ভগিণীকে। আর  নিজেকে যতোনা গৃহ দিতে চেয়েছিল ঈশ্বর চক্রবর্তী তার চেয়ে বেশী নতুন গৃহকে ঘিরে সীতার আনন্দ-আলোড়নকে একটু দূরে বসে দেখতে চাওয়াতেই ছিল তার শান্তি। এই শান্তিটুকুর জন্য ঈশ্বর চক্রবর্তী যখন ছেড়ে আসছিল তাদের রিফিউজি কলোনী, তার সাথীদের, তাকে হেঁটে আসতে হয়েছিল নিজ আদর্শেরো বিপরীত মুখে। –তখন কি সে’ও বলেনি, মনে মনে, “আমি চাইনি দিদি, আমি তোকে ভুলিনি, ইচ্ছে করে ফেলেও আসিনি – ওরা আমায় নিয়ে যাচ্ছে’ – 
পরিবর্তে সে’কি পেয়েছিল সেই ‘গৃহ’ কিংবা সেই যাপন যা ‘নিরুদ্বেগ’?   
কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে, ভারতমানচিত্রে, যখন ঢুকেপড়েছিলেন আমার ঠাকুর্দা শ্রী শক্তিকেশ বিশ্বাস, তখন, আমার পিতা শ্রী সুকেশ রঞ্জন বিশ্বাস ফোর্‌ কিংবা ফাইভ্‌ কেলাসের ছাত্র আর যখন  সুকেশ রঞ্জন সেভেন কেলাসে শক্তিকেশ তখন ইহলোকে নেই । শক্তিকেশের নাতিদীর্ঘ জীবদ্দশায় তিনি তিনটি পুত্র এবং চারটি কন্যাসন্তানকে দেখিয়েছিলেন আলো, এই পৃথিবীর। এদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সুকেশ রঞ্জন। সর্বকনিষ্ঠ, সে মেয়ে, সীমা, দুগ্ধপোষ্য,তখন। 
অতএব অদ্য যখন দেখা যায়, যে,  সেই সাত ভাইবোনই ঘরেদোরে, স্বামী স্ত্রী পুত্রকন্যাসহ, স্বাচ্ছন্দ-অধিষ্ঠিত- ‘সুখী’ কি’না জানিনা – তখন হে পাঠক, গো পাঠিকা, অনুমানে কষ্ট হয়না তাদের “সংগ্রাম” – শিকড়হীন যাপনপর্বে। ওই সংগ্রামপর্বও আমার নাদেখা। আমি জন্মে দেখেছি আমার বাবা, মফস্বল শহরে হলেও, একজন অধ্যাপক। তবে টের পেয়েছি ‘গৃহ’, ‘গৃহ’নির্মাণের উথালপাথাল, এঁদের প্রায় সকলেরই মর্মে। যেন এই চেষ্টা, ‘গৃহ’ , মুছেদেবে ‘উদ্বাস্তু’ পরিচিতি তাদের, এই ভারতমানচিত্রে।  
খ্যাঁক্‌ খ্যাঁক্‌ হাসতে হাসতে আমাকে আমার এক বেংগালোরবাসী ‘বংগ্‌’ বস্‌ একবার এক পার্টিতে আমাকে বলেছিলেনঃ “যারাই পূর্ব বাংলা থেকে এসেছে প্রত্যেকে, ইন ফ্যাক্ট্‌ ইচ্‌ এন্ড এভ্‌রি ওয়ান, বলে যে, পাকিস্তানে ওদের জমিদারী ছিল। ওএমজি!! সিকিউরিটি বাদলও বলে। সো, বিশ্‌ওয়াস্‌, তোমারো ছিল না’কি হে...” বাক্যটি সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আমার ভিতর থেকে যে “না” শব্দটি ছিট্‌কে এসেছিল তার অভিঘাতে আমার নিজেরই নেশা চৌপাট। সুতরাং বস্‌ মশাই’এর কর্ণেও তা মধুবর্ষণ করেনি নিশ্চিত। বস্‌’মশাই চুপ মেরে গিয়েছিলেন। আরেকটা গেলাস নিয়ে আমি এসে বসে পড়েছিলাম ‘কপার চিম্‌নী’র ঝুল বারান্দায়। 
এই ঝুলবারান্দা থেকে দেখাযায় রাত্রির চক্রবাল। দেখাযায় আলো আর উজ্জ্বলতার আয়োজন এই আইটি ক্যাপিটেলের। আমি এই ‘আইটি ক্যাপিটেলে’র বহুদিনের বাসিন্দা। সত্য। কিন্তু এই শহরের একটি বৃক্ষও চেনেনা আমাকে। এই শহরের একটি ছায়াতেও দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেয়নি আমার বালকবয়স। এই শহরের কোনোও বাজারে কোনো মাছ বিক্রেতা নেই, শব্জী বিক্রেতা নেই যে চেনে আমার বাবাকে। ‘এই শহর’ জানেনা ‘আমার প্রথম’ কোনো কিছু – আমার ‘প্রথমবার স্কুলে যাওয়া, প্রথমবার ফেল’, আমার প্রথম পাপ, আমার প্রথম ছাপা হওয়া কবিতা, আমার প্রথম দেখা চিতা,শ্মশান,মৃত্যু – কিছুই তারকাছে নেই গচ্ছিত। তবু আমি এখানেই এসেছি। এসেছি পেটের ধান্দায়। এসেছি, কেননা, আমার ‘রিফিউজি মা-বাবা’ যদিও আমাদের ‘পারভারিশ’এ ত্রুটি রাখেননি কোনো তথাপি আমরা, ক্রমে, টের পেয়েছি, যে, এবার নিজেরা উপার্জনক্ষম না হলে, হয়তো এই মাতাপিতাকেই বার্ধক্যে অপারগ হব ন্যূন নিরপত্তাটুকু দিতেও। ফলতঃ ‘আইটি প্রো’ হয়েছি যেমন রাতবাসরের নগ্না নর্তকী হয়েছে সেই ভিয়েৎনাম-পলাতকা মেয়েটি। আমি বেঙ্গালোরে এসেছে যেমন সেন্ট্‌ লুই’এ এসেছে সেই ভিয়েৎনাম-পলাতকা মেয়েটি। হ্যাঁ, সত্য, হয় এই, যে, অনেক ‘রিফিউজি’ই বলে তাদের জমিদারী ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, থুড়ি, পূর্ব বাংলায়। এই দাবী অনর্থক হলেও, সত্য হয়, এ’ও, যে, নেহেরু-গান্ধী-জিন্না’ ধর্ষনপ্রাক্‌ যে ভারতমানচিত্র তার একটি কোনায়, যা অধুনা ‘বাংলাদেশ’, সেখানে ‘ভদ্রাসন’ অন্ততঃ ছিল অনেকেরই। অনেকেরই ছিল ছোটো ছোটো নীড়, সুখের না হোক্‌ শান্তির, স্বস্তির।   
                                    অতঃপর, হে আমার “খ্যাঁক্‌ খ্যাঁক্‌ হাসতে থাকা বেংগালোরবাসী ‘বংগ্‌’ বস্‌”, ‘যাহা ঘটিল’ তাহা এই, যে, যাঁহাদের কিছু প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল ‘পূর্বাশ্রমে’ আর কমবেশী ‘বিদ্যা’ ছিল যাহাদের উদরস্থ, শুধুমাত্র তাহাদেরই একাংশ, কিছু বৎসরের কিংবা মাসের উঞ্ছবৃত্তিশেষে, অন্ততঃ পেটেভাতে খাইয়া বাঁচিতে সক্ষম হইয়াছিল। অন্যেরা, সেই ভিয়েৎনাম-সুন্দরী ও তাহার মাতাহেন – শক্তি, শরীর, মন – যাহাই ব্যবহারযোগ্য তাহারই ব্যবহারদ্বারা চাহিল টিঁকিয়া থাকিতে। হে আমার “খ্যাঁক্‌ খ্যাঁক্‌ হাসতে থাকা বেংগালোরবাসী ‘বংগ্‌’ বস্‌”, যে সীমান্ত-গঞ্জটিতে আমার জন্মনাভি প্রোথিত, সেইখানে এবং এবম্বিধ আরো অনেক ‘রিফিউজি’ থাকা শহরে বাজারে দুই চারিজন ‘জামাই’ থাকিত, যাহারা কমলকুমার কথিত কাহিনীর সেই নোলাসর্বস্ব বাহ্মনের ন্যায়, গিয়া হাজির হইত সমস্ত উৎসবানুষ্ঠানে এবং গিলিত। যথেচ্ছা গিলিয়া লইত যেনবা তাহারা জাবড় কাটিবে, পরে, অনাহারকালে। ক্রমে আমোদ দেখিতে উহাদেরো দাওয়াত দেওয়া হইত এবং মস্তিপ্রিয় পাব্লিক দাঁরাইয়া দাঁড়াইয়া তাহাদের সেই মরণ-খায়া দেখিত। মস্তিতে জনতা ইহাদের নাম দিত ‘জামাই’। - এই ‘জামাই’গণ, প্রত্যেকেই, ছিল ‘রিফিউজি’। ইহাদের কয়েকজন ছিল রীতিমত খাদ্যরসিকও। অনেক ব্যাপার-বাড়িতে ইহাদের ডাকিয়া ব্যঞ্জনের স্বাদ হইত পরীক্ষা করানোও। ‘পূর্বাশ্রমে’ ইহারা জমিদার ছিলনা নিশ্চয় তবে পেটেভাতে যে ছিল তাহা আন্দাজ করাযায়। ‘বস্‌ মহাশয়’ আমি জন্মিয়া দেখিলাম আমার পিতা, মফস্বল শহরে হইলেও, একজন অধ্যাপক। কাকাপিসীরাও নানাবিত্তে, নানাবৃত্তে প্রতিষ্ঠিত। তবুও আমার মর্মে কেন আমি আজও দেশছাড়া? কেন বিষণ্ণ? - ভিয়েৎনাম-পলাতকা মেয়েটিও রাখিয়াছিল এই একই প্রশ্ন। 

৩। 
হে পাঠক, গো পাঠিকা, পাকিস্তানের জন্মলগ্নে, পরে বাংলাদেশের গর্ভযন্ত্রণাকালে, মোসেস্‌হীন রক্তাক্ত এক্সোডাসে ভেসে আসা জনতাকাতারের যে অংশ, অন্তমে ‘সুবর্ণরেখা’র সীতাহেন, হরপ্রসাদ মাস্টারহেন গেলো নিশ্চিহ্ন হয়ে কিংবা মাণিকের ‘প্রাগৈতিহাসিক’হেন রইল অদ্যাপি টিঁকে তাদের সংবাদ, কিছুদূর রাষ্ট্র হয়েছিল কাকদ্বিপ কাহনে, তৎকালে। পরে আসামের নেলী-গোহপুরের গণহত্যায়, যদিও নেলী-গোহপুর অদ্যাপি ধামাচাপা এমন কি প্রামাণ্য তথ্য, ফোটো মাত্র তিন চার বৎসর আগেই হাপিস হরে দেওয়া হয়েছে ইউ-টিউব থেকেও। এতদ্‌ভিন্ন আমার বিশুদ্ধ নীল মধ্যবিত্ত রক্ত প্রকৃতই জানেনা সেই “লোয়ার ডেপ্‌থে’র মর্মসংবাদ। সুতরাং ‘গুগুল্‌ সার্চ ইঞ্জিন’ আর ‘কর্মী’দের কাঁধে সেই “লোয়ার ডেপ্‌থে’র মর্মসংবাদ উদ্ধার ও পরিবেশনের দায়িত্বটি দিয়ে ফিরেযাই আমার মধ্যবিত্ত কাহনে। 
                               হ্যাঁ, সত্য, হয় এই, যে, অনেক ‘রিফিউজি’ই বলে তাদের জমিদারী ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, থুড়ি, পূর্ব বাংলায়। এই দাবী অনর্থক হলেও, সত্য হয়, এ’ও, যে, নেহেরু-গান্ধী-জিন্না’ ধর্ষনপ্রাক্‌ যে ভারতমানচিত্র তার একটি কোনায়, যা অধুনা ‘বাংলাদেশ’, সেখানে ‘ভদ্রাসন’ অন্ততঃ ছিল অনেকেরই। অনেকেরই ছিল ছোটো ছোটো নীড়, সুখের না হোক্‌ শান্তির, স্বস্তির। কাঁটাতারের পরপারের যে ‘পূর্বাশ্রম’ তাতে ফেলে আসা সেই শান্তির নীড়টিকেই, ভারতমানচিত্রে, বহুক্লেশে জুটিয়ে নেওয়া একচিলতে জমিতে পুনরায় স্থাপনের আকাশকুসুমই সম্ভবতঃ, ছিল, তাদের শোণিতের আদত জ্বালানী। কেউ কেউ এক প্রজন্মের চেষ্টাতেই আকাশকুসুমের চারা মাটিতে রোপন করতে হয়েছিলেন সক্ষম। কারোরবা লেগেগেছে দুটি-তিনটি প্রজন্ম। অনেকে অদ্যাপি ‘একটুকু বাসা’র আশায় যাযাবর ... 
যেহেতু ঠাকুর্দা গত হয়েছিলেন বাবা যখন নিতান্ত বালক, তখনি, যেহেতু ‘বাবু’, অর্থাৎ অকৃতদার শ্রী শিবেন্দ্র চক্রবর্তী, সম্পর্কে ঠাকুর্দার মামা হলেও ঠাকুর্দারই সমবয়সী, ভারতমানচিত্রে একটি আধা সরকারী চাকরি জুটিয়ে নিতে সক্ষম হলেও, বাবাকে, আমার ছোটো পিসীকে মধ্যবিত্ত মানদন্ডে যথেষ্ট ‘বাবুয়ানি’তে বড় করে তুল্‌লেও উদ্‌বৃত্ত কিছুই ছিলনা যাতে ‘ধরণীর এক কোনে’ একখানি গৃহ স্থাপনের স্পর্ধা দেখাতে পারেন। তাই আমরা বড় হচ্ছিলাম ভাড়াবাড়িতেই আর হয়তো সেইহেতুই বাপ-ঠাকুর্দা’র মর্মগত আকাশকুসুমের বীজ উড়ে এসে পড়েছিল আমাদের শিশুশোণিতেও। বীজ, শোণিতে, কিকরে ক্রমে হয়ে উঠলো বিরাট মহীরুহ, তাকে অনুধাবন করতে গেলে, হে পাঠক, গো পাঠিকা, আমার সঙ্গে হেঁটে যেতেহবে আমার শৈশবের ‘উতলনির্জনে’। 
       আমার,আমাদের পূর্ববঙ্গীয় শৈশব, সে হোক্‌ কুশিয়ারা-বরাকের, হোক্‌ সুরমাপাড়ের, তাতে ‘আম আঁটির ভেঁপু’র স্থানটি যার, সে, হয় , কলাপাতার নয়তো সুপারীগাছের পাতার বুক চিরে বানানো বাঁশি। পাতার বাঁশিতে বেজেওঠা আমার শৈশবের পরতে পরতে আছেন দিদিভাই। আমার বাবার পিসী। দিদিভাই’র বলা গল্পে, ‘পরস্তাবে’ই ডালপালা মেলতে শিখল আমার কল্পনা।  
গল্পের যেখানে আরম্ভ সেইখানে ছিলেন এক চাঁদরাম মুন্সী।  
৪। 
গল্পের যেখানে আরম্ভ সেইখানে ছিলেন এক চাঁদরাম মুন্সী।  
মুন্সী ছিলেন ‘প্লীডার’। আঠারোটি ভাষা জানা এই মানুষটির দৈনিক উপার্জনের মাপজোখ হইত মোহর ভরা বস্তার হিসাবে। বাঘেগরুতে একঘাটে জল খাওয়ানো তিন তল্লাটের সাহেব মাজিস্ট্রেটের দল ‘মুসাবিদা’র ধরন দেখিয়া বলিয়া দিতে সক্ষম হইতেন উহা চাঁদরামের মুসাবিদা কি’না। 
দীর্ঘদেহী, তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ এই মানুষটির দূর্বলতা ছিল মাত্র একটিই। তাহা মদ ।  
         আদালত হইতে সোজা শুঁড়ি খানায় যাইতেন চাঁদরাম আর সেইখান হইতে ফিরিতেন বেহেড হইয়া । প্রতিদিন । মদ্যপানের প্রয়োজনীয় অর্থ সঙ্গে রাখিয়া দিনের বাকি উপার্জন ঘরে পাঠাইয়া দিতেন আর্দালী মারফৎ। আশা করাযায় আর্দালীগন নিজ প্রয়োজনের অর্থটুকুই শুধু তাহা হইতে সংগ্রহ করিয়া লইয়া উদ্‌বৃত্তটুকু তুলিয়া দিতেন ‘মা জননী’র হাতে। তাহাতেও সংসার চলিত ‘রাজার হালে’। সাহেবসুবোরা মুন্সী’র গৃহে আসিলে যে সকল মদ দিয়া তাহাদের আপ্যায়ন করিতেন মুন্সী সেই সকল মদ সেই সাহেবসুবোদেরো অনেকেই যে চোখে দেখেন নাই স্বদেশেও - তাহা সাহেবসুবোরাও প্রায়শ লইতেন স্বীকার করিয়া। 
       ‘মা জননী’ দুইটি পুত্র সন্তানের গর্ভধারিনী। গুণে লক্ষী। রূপে দুর্গা। সুশীল পুত্র দুইটি ইস্কুলে যাইত। পাশ দিতো। জলপানি পাইতো। স্ত্রী দেখভাল করিতেন অন্তঃপুরের। দিনান্তে আসিত বস্তা ভরা মোহর। তথাপি মুন্সী একদিন আদালত হইতে আর গৃহে ফিরিলেন না। আর্দালীরা বস্তা বহিয়া ফিরিয়াছিল ঠিক সময়েই তবে রাত্রি বাড়িল কিন্তু মুন্সী ফিরিলেন না। শুঁড়ি খানায় লোক ছুটিল। জানা গেলো সেইদিন সেখানেও যাননাই মুন্সী। রাত্রি কাটিল। দিন কাটিল। কাটিতে লাগিল। মুন্সী ফিরিলেন না। কেহ বলিল কোনো দুর্বৃত্ত খুন করিয়াছে অথবা কোনো মামলার কোনো পুরাতন শত্রু লইয়াছে প্রতিশোধ। লাশ পাওয়া যাইবে অনতিবিলম্বেই। কেহ বলিল নিশ্চিত মুন্সীর কোনো রক্ষিতা রহিয়াছে। সেইখানেই গিয়াছেন মুন্সী।  
         আরো দিনরাত্রি কাটিয়া গেলো এমনি জল্পণা কল্পণায়। আলোড়ন,মহকুমা শহরে, আশেপাশের অন্যান্য শহরে বাজারেও, ক্রমে স্তিমিত হইল। ।কিন্তু বছর ঘুরিয়া গেলো চাঁদরাম ফিরিলেন না। বৎসরাধিক কাল কাটিয়া গেলে আবার ঘটিল এক ঘটনা। 
একদিন অজ গ্রাম হইতে মহকুমার আদালতে জমির মামলা লড়িতে আসিল এক গ্রামবাসী। প্রায় কপর্দক শূন্য। সম্বল এক উকীলের ‘মুসাবিদা’ করা মামলার কাহন। তুখোড়, সেই মুসাবিদায়, আইনের মারপ্যাঁচ। পাঠমাত্র সন্দিহান ম্যাজিস্ট্রেট্‌ সাহেব। বলিলেন ‘ এই মুসাবিদা কাহার লিখিত?” লোকটি বলিল ‘ আজ্ঞা , আমি কিছু জানিনা। আমার গ্রামের মোক্তার বাবু লিখে দিয়েছেন...’ 
সাহেব বলিলঃ কি নাম সেই মোক্তারের? 
একটা নাম বলিলে সাহেব ভ্রূকুটি করিল। বলিল ‘তুমি মিথ্যা কথা বলিতেছ। এই মুসাবিদা তোমার গ্রামের কোনো উকীল মোক্তারের হইতেই পারেনা। ওই সকল গর্ধভদের ক্ষমতা তাই এমত মুসাবিদা লিখিবার। সত্য বলো কে তোমাকে লিখিয়া দিয়াছে এই কাগজ, নতুবা তোমারই বিপদ বাড়িবে। সত্য বলিলে আমি নিজে এই মামলায় তোমার সহায় হইব’। 
     অবশেষে মুখ খুলিল সে। বলিল, যে, প্রয়াগে, এক মেলায়, এক সাধুজন তাহার দুঃখকথা শুনিয়া লিখিয়া দিয়াছে এই মিসাবিদা। 
সাহেব মুন্সীর বাড়িতে সংবাদ পাঠাইলেন ‘চাঁদরাম জীবিত। সে সন্ন্যাসী হইয়া গিয়াছে ...’ 
                                    যবনিকা, পুনরায় উঠিল, গ্রীষ্মের এক করাল দ্বিপ্রহরে। মুন্সীপুত্র শিবেন্দ্রচন্দ্র অধুনা যুবক। বিবাহিত। নিদাঘ দ্বিপ্রহরে সব কাজ সাড়িয়া শিবেন্দ্র-পত্নী ধীরে সুস্থেই বড়ঘরের দিকে পা বাড়ানোমাত্র দাসী আসিয়া বলে কে এক সাধুবাবা ভিক্ষা করিতে আসিয়া বাড়ির বধূর খোঁজ করিতেছেন। বাহিরবাড়ি গিয়া শিবেন্দ্র-পত্নী আভূমি প্রনাম করেন সন্ন্যাসীকে। অতঃপর ভিতরবাড়িতে  গিয়া এক কুলা চাল আনিয়া সন্ন্যাসীর ঝুলিতে ঢালিয়া দিলে সেই চাল হইতে এক চিমটি চাল ফিরাইয়া দিলেন সন্ন্যাসী। ইহা ভাঁড়ারে রাখিতে হয়। ইহাতে মঙ্গল হয় গৃহস্থের। সন্ন্যাসী একটি ধাতব মুদ্রাও তাঁহাকে দেন। বলেনঃ ‘মা, তোমার ঠাকুরের আসনে ইহা রাখিয়া দিও। দেখিও ইহার একপিঠে রহিয়াছে শ্রীরামের বনগমনের ছবি, অন্য পিঠে সিংহাসনে আসীন রামচন্দ্র। ঐ দিকটি সর্বদা উপরে রাখিবে। ’ মুদ্রাটি কপালে ছোঁইয়াইয়া সন্ন্যাসীকে আরেক বার প্রণাম করিতে গিয়া শিবেন্দ্রজায়া দেখেন সন্ন্যাসী নাই। যেন অদৃশ্য হইয়াছেন মুহুর্তে। ভিতর বাড়ির দিকে যাইতে যাইতে অকস্মাৎই কথাটি উদয় হইলো তাঁহার মনে, যে, তাঁহার কর্ত্তার পিতা গিয়াছিলেন সাধু হইয়া। তবে? 
লোক ডাকাইয়া তাড়াতাড়ি সাধুর খোঁজ আরম্ভ হইল। লোক গিয়া খবর দিয়া আসে শিবেন্দ্র চন্দ্র’কেও। কাছাড়ি মুলতুবি রাখিয়া আসেন তিনি। খোঁজ খবর চলে সারাদিন। কিন্তু সাধুর আর কোনো খোঁজ মেলেনা। দিন যায়। 

৫। 
এই সেই বাড়ি, এই সেই গৃহ, যা চাঁদরাম মুন্সীর,যা, দিদিভাইকথিত গল্পের প্রতিটি শব্দে, যতিতে, ক্রমে নির্মীত হয়ে উঠছিল আমার মর্মে। সেই গৃহটির পিছনে নদী। খোয়াই। গৃহ আর নদীকে ঘিরে আছে আশ্চর্য নামগুলি – হবিগঞ্জ, বানিয়াচং, সিলেট ... ঈশ্বরমাস্টর, কানকাটা গোপাল, কানা আজিজ, আলিমপীর, বাচ্চু ওস্তাগর, সরল খান ...। সেই গৃহে, নদীর ধারে, আছে এক মন্দির, যা শূন্য। যা শিবের। যা চাঁদরাম মুন্সী নির্মাণ করেছিলেন কন্যা সন্তানের পিতা হওয়ার মানসে। যে বাসনা, চেষ্টা অসম্পূর্ণ রেখেই মঞ্চ থেকে ফেরার হয়েছিলেন মুন্সী...মন্দিরের আবডালে, নদীর ঘাটে, হরিমুদ্দি মাঝির হুঁকায় টান দিয়ে ধূমপানের স্বাদ, প্রথমবার, পেয়েছিলেন আমার তখনকিশোর ঠাকুর্দা। এই গৃহের মুখামুখি যে ধূধূ মাঠ, যা বর্ষায় সমুদ্র, সেখানেই, এক শীতদুপুরে হরেন্ড’র বিড়িতে টান দিয়েছিলেন আমার তখনবালক বাবা। বাবু, শিবেন্দ্র চক্রবর্তী, দেখেফেলেছিলেন সেই দৃশ্য। আমি জানতাম, একদিন, ওই মাঠেই, হাডু ডুডু খেলব আমিও, জানতাম ওই হরিমুদ্দির হুঁকায় টান দিয়ে তামাক খাওয়া শিখবার কথা আমারও।  
                       সেই গৃহের বারান্দা খুব উঁচু। তাই বর্ষায় যদিবা উঠানে আসতো জল, বারান্দায় উঠতে পারতোনা। উঠানের সীমানা সূচিত সুপারী আর নারকোলের কাছে। বাইরের যে কোঠায় লোক এলে বসতে দেওয়া তার জানালার ধারে পাতাবাহারের পাহারা। বড়কোঠার পাশাপাশি কোঠায় দুটো ছোটো চৌকি জুড়ে দিয়ে বড় বিছানা। বাবা আর দিদিভাই ঘুমায়। যদিও চৌকি দুটি গায়ে গায়ে লাগানো তবু মাঝখানে ছোটো একটা ফাঁক। একটি চৌকিকে ‘হিন্দুস্থান’ আর অন্যটিকে ‘পাকিস্তান’ কল্পনা করে নিয়ে লাফ দিয়ে ‘স্তান’ থেকে ‘স্থানে’ আসা যাওয়ার খেলা খেলতে খেলতে ওই দুয়ের মাঝখানে হঠাৎই পা গলে গেলো আমার তখনবালক বাবার। চৌকির কোনায় লেগে মাথা ফাটল। অতঃপর, যথারীতি ডাক্তারবদ্যিহাসপাতাল। কপালে সেলাইব্যান্ডেজ। প্রায় বিঘৎগভীর সেই কাটা দাগ এখনো বাবার কপালে সুস্পষ্ট। - আমি জানতাম ওই দুই চৌকির বিছানাতে আমারো খেলা, আমারো মাথাফাটা – সমস্তই পুনরাভিনীত হবে। মনেহতো এই যে বাসা, ভাড়াবাড়ি, এই যে শহর - শিলচর, করিমগঞ্জ – সমস্তই সাময়িক। সমস্তই অবাস্তব। অলীক। মনেহতো একদিন না একদিন – এই ভাড়াবাড়ির পুকুরপাড়ের ঝোপঝাড় থেকে নয়তো পুকুরের ওই ধারে, বেড়া পারহয়ে, যে ধূধূ মাঠ, সেই মাঠ থেকে নয়তো পড়শীবাড়ির বাঁশঝাড়ের রহস্যময় আব্‌ছায়া থেকে একজন আসবেই। এসেই বলবেঃ “ ...এইবার চলো তোমার আসল বাড়িতে, নিজের বাড়িতে। চলো তোমার আপন রাজ্যে, রাজত্বে, যে রাজ্যের তুমি রাজকুমার। শেষ হয়েছে তোমার অজ্ঞাতবাস পর্ব ...” –সুতরাং বাবা যেদিন বাড়ি ফিরে বল্লো ‘কোর্টের কাজ হয়েগেছে, এই দেখ কাগজ”, যেদিন সব্বার মর্মের আনন্দটুকু টের পেলো নেহাৎ শিশুরাও অথচ দেখল সবারই চোখে জলের রেখা, সব্বার কথায় বার্তায় বোঝাগেলো বাবা জায়গা কিনেছে, সেখানে আমাদের ‘বাড়ি’ হবে তখুনি আমি, আমার মর্মের ময়দানবকে হুকুম দিলাম সেই গৃহের বারান্দা খুব উঁচু করে দিতে যাতে বর্ষায় যদিবা উঠানে আসে জল, বারান্দায় যেন উঠতে পারেনা। হুকুম দিলাম উঠানের সীমানা সূচিত করেদিতে সুপারী আর নারকোলের কাছে। বাইরের যে কোঠায় লোক এলে বসতে দেওয়া হবে তার জানালার ধারে বসাতে বললাম পাতাবাহারের পাহারা। মর্ম-ময়দানবকে এ’ও হুকুম দিলাম যে বড়কোঠার পাশাপাশি কোঠায় দুটো ছোটো চৌকি জুড়ে দিয়ে বড় বিছানা করে রাখতে ... 
অবশেষে একদিন সূচিত হল যাত্রালগ্ন আমার নিজস্ব ইন্দ্রপ্রস্থে গমনের। এসে দেখলাম, আশ্চর্য হয়ে, যে, খোয়াই নদি নাহোক্‌, একটি বহতা খাল সত্যই আমার মর্ম-ময়দানব এনে রেখেছে আমার গৃহের আবহে। দেখলাম নারকোল গাছ না হোক সুপুরীর সাড়ির প্রহরা রয়েছে সীমানায়। রয়েছে অর্জুনবৃক্ষেরা, রয়েছে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের হুহু বাতাস। এ’ও আশ্চর্য, যে, আমাদের বাড়ির সীমানায় না হলেও মুখোমুখি, বড় রাস্তার ওই ধারে, প্রমেশ ভট্টাচার্যের বিরাট পুকুরের পাড়ে একটি শিব মন্দির। সেও, হায়, হয় শিবহীন। আমার স্বপ্নের সেই গৃহেও, এক শিব মন্দির, যা শূন্য। যা শিবের। যা চাঁদরাম মুন্সী নির্মাণ করেছিলেন কন্যা সন্তানের পিতা হওয়ার মানসে আর প্রমেশ ভট্টাচার্যের মন্দিরে শিব ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মর্মে ছিল, দুইটি কন্যার পরে, পুত্র সন্তানের পিতা হওয়ার সাধ। 
অবশ্যই কৃতজ্ঞ বোধ করেছিলাম মর্ম-ময়দানবের প্রতি করিমগঞ্জ কলেজ কো-অপারেটিভ থেকে ‘লোন’ নিয়ে কেনা জমির উপরে তৈয়ার হওয়া এই গৃহটির জন্য। তথাপি কেন যেন এ’ও মনে হয়েছিল এখনো সময় হয়নি আমার আত্মপ্রকাশের। শেষ হয়নি আমার অজ্ঞাতবাস পর্ব। এ শুধু বনবাস পর্বের সমাপ্তি।  
হ্যাঁ, এইভাবেই, বাপ-ঠাকুর্দা’র মর্মগত আকাশকুসুমের বীজ উড়ে এসে পড়েছিল আমাদের, আমাহেন কিছু অতীতবিলাসীর, শোণিতে। বীজ, শোণিতে, এইভাবেই, ক্রমে হয়ে উঠেছিল বিরাট মহীরুহ। সুতরাং, হে পাঠক, গো পাঠিকা, অদ্যাবধি ‘মন চল নিজ নিকেতনে’র উদাস, উদাত্ত সুর আমার অতলে কোনো মেটাফিজিক্যাল ‘নিকেতন’ এর পরিবর্তে নির্মাণ করে এক না দেখা নিকেতনের চিত্র - যে নিকেতনের আবহে আজো বহমান খোয়াই নদী, যে নিকেতন থেকে একদিন হারিয়ে গিয়েছিলেন চাঁদরাম মুন্সী নামের এক রহস্যময় মানুষ, যে নিকেতনে ‘স্তান’ আর ‘স্থান’ ঘোষিত হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই, আসছিল উড়োচিঠিঃ “ মানে মানে চলেযাও নাহলে ...”, এই নিকেতনের বারান্দায় দাঁড়িয়েই, অর্ধরাত্রে, ‘স্তান’ আর ‘স্থান’ ঘোষিত হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই, বাসিন্দারা অবিশ্বাসী অথচ শিউরে ওঠা চোখে দেখেছিলেন অদূরে আগুনের দাউ দাউ, শুনেছিলেন “আল্লাহুআকবর’ জিগীর...যে নিকেতনের থেকে আমার প্রপিতামহ শিবেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, পিতামহ শক্তিকেশ বিশ্বাস, তাঁর ভগিনী শিশিরকণা বিশ্বাস, তাঁদের মাতুল শিবেন্দ্র চক্রবর্তী বহুবার হয়েছিলেন রাজবন্দী, হায়, ‘স্বাধীনতা’, যা অন্তিমে ‘স্তানে আর স্থানে’ রক্তাক্ত কাহিনী শুধু, তারই জন্য... 



তাই, হে পাঠক, গো পাঠিকা, গো পলাতকা ভিয়েৎনামমেয়ে, হে বেংগালোরবাসী ‘বংগ্‌’ বস্‌, আমি জেনেছি, আমার ফ্ল্যাট্‌জীবন, আইটিযাপন সত্ত্বেও জেনেছি, যে, অন্তিম প্রস্তাবে “ যেখানেই যাও চলে হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর” । জেনেছি ‘বাংলা’ একটি ভাষারই নাম।  ‘বাংলা’ একটি ‘দেশের’ নাম নয়। ‘বাংলা’ একটি ‘দেশের’ নাম নয় কেননা আমারও ভাষা বাংলা। আমার উর্ধতন সহস্র পুরুষের ভাষা বাংলা, আমাহেন, আমার রিফিউজি বাপঠাকুর্দাহেন কোটি কোটি রিফিউজির ভাষা বাংলা তথাপি তারা বিতাড়িত, অদ্যাপি, তাদের নিজ নিজ ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে। তাদের যাপন আসলে এক অনন্ত অজ্ঞাতবাস। তাদের মর্মে সতত বেজেওঠে – চেতনায়, অবচেতনে - “আমি চাইনি দিদি, আমি তোকে ভুলিনি, ইচ্ছে করে ফেলেও আসিনি – ওরা আমায় নিয়ে যাচ্ছে’ – 
ভাবি, ‘ওরা’ কারা? সঙ্গে সঙ্গে আমার ভাবনাঘুড়ির সূতো – গান্ধী, জিন্না, জহরলাল, সুরাবর্দি, শরৎ বোস, কাকদ্বীপ, নোয়াখালি – ইত্যাকার সংখ্যাতীত শাণিতমাঞ্জা সূতোর কাটাকুটি খেলায় অসহায় বোধ করে। কাটাপড়ে অন্তিমে। আমি আমার স্বপ্নের ভিতরে, আজো, ঝোপেঝাড়ে, বাঁশ বনে, খোলামাঠে, পরিত্যক্ত প্রাঙ্গনে, আঙ্গিনায় – খুঁজি সেই ঘুড়িটিকে আর আবহে কে যেন গায়ঃ “এ পরবাসে রবে কে...” 


ঘুমভেঙ্গে ভাবি, এ’ও, যে, সাতচল্লিশ সালে ‘স্তান’ আর ‘স্থান’ না হলেই কি এই ইতিহাস আদৌ ধাবিত হত কোনো অন্য ধারায়? 

উত্তর মেলেনা। 

সপ্তর্ষি বিশ্বাস 
২৫/৯/২০১৭ – ২/১০/২০১৭ 
বেঙ্গালোর 



  
























ঘুম ঘর