বক্রচেতনার চক্রপথ
সমস্যা, অদ্য, এই, যে, উন্মাদ কিংবা বক্র-মস্তিষ্ক চরিত্রদের জবানবন্দিতে লিখিত সাহিত্যের সমস্তই লিখিত তথাকথিত 'সুস্থ' বা অ-বক্র মস্তিষ্ক মানুষদের দ্বারাই। যে 'লড়াইখ্যাপা'
"হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচায় খালি চোখটি ক’রে ঘোলা,
“জগাই মোলো হঠাৎ খেয়ে কামানের এক গোলা!”
এই না বলে মিনিট খানেক ছট্ফটিয়ে খুব,
মড়ার মত শক্ত হ’য়ে এক্কেবারে চুপ।
তার পরেতে সটান্ ব’সে চুলকে খানিক মাথা,
পকেট থেকে বার করে তার হিসেব লেখার খাতা।
লিখ্ল তাতে-“শোন্ রে জগাই, ভীষণ লড়াই হলো,
পাঁচ ব্যাটাকে খতম করে জগাইদাদা মোলো।”
“জগাই মোলো হঠাৎ খেয়ে কামানের এক গোলা!”
এই না বলে মিনিট খানেক ছট্ফটিয়ে খুব,
মড়ার মত শক্ত হ’য়ে এক্কেবারে চুপ।
তার পরেতে সটান্ ব’সে চুলকে খানিক মাথা,
পকেট থেকে বার করে তার হিসেব লেখার খাতা।
লিখ্ল তাতে-“শোন্ রে জগাই, ভীষণ লড়াই হলো,
পাঁচ ব্যাটাকে খতম করে জগাইদাদা মোলো।”
তার জবানীটি, তার হুংকার ও হাহাকার
থেকে, যিনি নির্মাণ করে নিয়েছেন তিনি সুকুমার রায়, একজন 'সুস্থ' মস্তিষ্কের মানুষ।
তাঁর অন্যান্য 'বক্র-মস্তিষ্ক' চরিত্রদের, যেমন, 'কাঠবুড়ো', 'কাতুকুতু বুড়ো','ছায়াবাজ'
বা হঠাৎ করে মাথা বিগড়ে যাওয়া 'হেড অফিসের বড়বাবু'দের জবানী বক্র-চৈতণ্যের যতোই নিকটবর্তী
বলে বোধ হোক না কেন, অন্তিমে এদের শ্রষ্টা তথাকথিত "সুস্থ চৈতণ্যে"র অধিকারী
এবং তাঁর পাঠকবর্গও তা'ই। শেক্ষপীরের লীয়ার কিংবা লেডি ম্যাকব্যাথের চৈতণ্যও যে একটি
পর্বে এসে অনুসরন করে বক্রপথের তাও, তর্ক সাপেক্ষ হলেও, প্রণিধান যোগ্য। নিকোলাই গোগোলের
'নাক কাটা' নাপিত অথবা 'উন্মাদের দিনলিপি', ফ্লবেয়ারের 'উন্মাদের স্মৃতিগাথা' বা আরেকটু
আরেকরকম ফক্নারের 'দ্যা সাউন্ড এন্ড্ দ্যা ফিউরি'র বেঞ্জামিন - এদের বক্রচেতনার বর্ণন
অ-বক্র চেতনাসপমন্ন পাঠক কিংবা মনোস্তাত্ত্বিকদেরও যতোই বিমুগ্ধ করুকনা কেন - অন্তিমে
'অবক্র চেতনার মানচিত্র' হিসাবে এদের কোনোটিকেই নিখাদ ভেবে নেওয়ার কোনো হেতু, আমার
মর্মে, এতাবৎ পাইনি। দস্তয়েভস্কির 'ড্রিম অফ আ রিডিকিউলাস ম্যান্' বা 'নোট্স্ ফ্রম্
আন্ডারগ্রাউন্ডে'ও আমাদের দেখা মেলে অতি আদরণীয় দুইজন স্বঘোষিত 'বক্র চেতনা সম্পন্ন'
চরিত্রের সঙ্গে। 'ব্রাদার্স কার্মাজোভে' ইভান কার্মাজভের সঙ্গে শয়তানের কথোপকনের বাস্তব
দৃশ্য প্রমাণ করে তার চেতনাগতির বক্রতাপ্রাপ্তির বহির্বাস্তব। পক্ষান্তরে ডন কিহোতে'র
কাহনে, কিহোতে নিজে "ন্যারেটর" না হলেও লেখক আমাদের নিয়ে বারম্বার হানা দেন
কিহোতের "বক্র-চৈতন্যের" মর্মে। কিন্তু তাতেও পারিনা আস্থা রাখতে কেননা যখনই
মনেকরি সেই বাস্তব মানুষটিকে,যাঁর আদলে একটি চরিত্র সৃষ্টির বড় সাধ আমা্ তাঁর চলন-বলন
কোনো কিছুর অন্দরেই আমি টের পেতে অক্ষম হই সেই গূঢ় অন্তর্গত অভীপ্সা, যার প্রকাশনিমিত্ত
এস্থলে ইল্লিখিত সমূহ লেখকজনই, নির্মাণ করেছেন তাঁদের বক্র-চৈতন্যের চরিত্রগুলিকে।
এখানে এসে মনেপড়ছে Ferit Guven এর "Madness and Death in Philosophy" গ্রন্থে পঠিত এই সকল পংক্তিঃ
Derrida argues that any work that claimed to be speaking “in the name” of madness would inevitably end up
betraying madness by virtue of being a “work.” ... Derrida recognizes
that madness “stands for” negativity. However, for Derrida,
one cannot write the history of this negativity as madness, because history itself is always the history of reason and of meaning
Derrida recognizes, Foucault’s aim is not simply to write
a history of negativity. Foucault seems to recognize the
impossibility of writing a history of madness.
বঙ্গ যাত্রাগানে একদা যে
ছিল 'বিবেক' তা'ই ক্রমে 'পাগল' রোল পেলো হালের নাটকে একদা। রবীন্দ্রনাথের 'বিশু'
ঠিক 'বিবেক' না হলেও সমগোত্রীয়। তাকে 'পাগল' বলে চালিয়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তথাকথিত
অ-পাগল বা না-পাগল, যা মুখরোচক 'সভ্যতা' শব্দের ভিত, তাকে সফল ধাক্কা দিলেও বিশু'
কোনোভাবেই 'পাগল' নয় - আমার বাল্যকালে দেখা আমাদের শহরের 'যিশু পাগলা'র মতো কিংবা
যাঁদের নিয়ে আলোচনা করেছেন ফুকো তাঁর 'মেড্নেস্ এন্ড সিভিলাইজেশন' এ। বরং
রবীন্দ্রনাথের 'মেহের আলি' বাস্তবিকই 'বক্র-চৈতন্যের"। তাকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ
চেষ্টা নেননা, কায়দায়, কিছু বলিয়ে নেওয়ার।স্টিফান কিং' এর কাহিনী নির্ভর, কুব্রিকের
ছবি "শাইনিং" এর কথা মনে আসে এখানে। আমার সীমিত দেখা-পড়া'র গন্ডিতে এই
আরেকটি চরিত্র যাকে ঘিরে চরিত্র নির্মাতার কোনো আল্টিরিয়র মোটিভ, অন্ততঃ আমি টের
পাইনি।
"আল্টিরিয়র
মোটিভ" থাক আর না'ই থাক, শাইনিং এর 'জ্যাক্ টরেন্সে'র দৃষ্টি,যা,ক্রমে তার
বক্র-চেতনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, আবিষ্কার করে নেবে ভিন্ আবহ ( না'কি এই বিরাট
নির্জনতার ভারে, আদতে, তার স্ত্রী-পুত্রের চেতনাই ক্রমে নিয়েছিল বক্রপথ? কুব্রিক
অতি চাতুর্যে, অন্ততঃ আমাকে, এই ধাঁধাটির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তারপর চলে গেছেন
রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে ) - তা'ও আমাদের দৃষ্টিগোচর এবং বিপ্রতীপে যা 'কাঠ বাস্তব' তাও
আমাদের দৃষ্টিসাধ্য। এইখানে 'সিনেমা' নামক মাধ্যম ভিন্ন রবীন্দ্রনাথের অক্ষর
মাধ্যমের থেকে। মেহের আলির 'দেখা' কে আমরা দেখিনা, শুধু কল্পনা করে নিতে পারি।
কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই আমি টেরপাই - চক্ষুগোচর এবং মর্মগোচর - দুটি 'অবক্র চেতনা'র
"ন্যারেটিভ"ই ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে বক্র-চেতনার অধিকারীদের মগজে।
এই ছুঁড়ে দেওয়া বা
'বিক্ষেপ' যে নিতান্ত শূন্যগর্ভ তা'ও মনে করা যায়না। যদিও সমগ্র গ্রন্থটি
পাঠকরা,কোনো উৎসাহী পাঠকের দ্বারা, সম্ভব হয়ও, তথাপি সম্পূর্ণ অনুধাবন
সাইকিয়াট্রি'র একাডেমিক পাঠভিন্ন এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানান ধারার সম্যক জ্ঞান
ভিন্ন, অসম্ভব। আমি যেহেতু উৎসাহী পাঠকমাত্র তাই গ্রন্থটি একাধিক বারের চেষ্টায়
একাধিক বার পাটঢ় করলেও অবশ্যই পারিনি অনুধাবন করতে। আমাহেন পাঠকদিগকে বলি, ফুকো'র
"মেড্নেস্ এন্ড সিভিলাইজেশন", হয়, এই গ্রন্থটির নাম এবং ফুকো লিখিত
গ্রন্থটির "প্রিফেস্" এবং "প্যাশন এন্ড ডেলিরিয়াম" এবং
"দ্য গ্রেট ফিয়ার" অধ্যায় দুইটি কিছুদূর অনুধাবনান্তে আমি টেরপাই যে সফল
শ্রষ্টাদের দ্বারা ছুঁড়ে দেওয়া বা 'বিক্ষেপ', বক্র-চৈতন্যের অন্তর্জগতের, নয়
নিতান্ত শূন্যগর্ভ। "মেড্নেস এন্ড সিভিলাইজেশন" এ ফুকো লিখেছেনঃ The possibility
of madness is ...
implicit in the very
phenomenon of passion. Madness, which finds its first possibility in the
phenomenon of
passion, and in the deployment of that double causality which,
starting from passion itself, radiates both toward the
body and toward the soul, is at the same time suspension
of passion, breach of causality, dissolution of the elements
of this unity. Madness participates both in the necessity
of passion and in the anarchy of what, released by this
very passion, transcends it and ultimately contests all it implies.
Madness ends by being a movement of the nerves and
muscles so violent that nothing in the course of images,ideas or
wills seems to correspond to it: this is the case of mania
when it is suddenly intensified into convulsions, or when
it degenerates into continuous frenzy. Conversely, madness
can, in the body's repose or inertia, generate and then
maintain an agitation of the soul, without pause or pacification,
as is the case in melancholia, where external objects
do not produce the same impression on the sufferer's mind
as on that of a healthy man; "his impressions are weak
and he rarely pays attention to them; his mind is almost
totally absorbed by the vivacity of certain ideas."
এই অংশটি প্রথমপাঠের সময়েই আমার মনে নিয়ে
এসেছিল "ক্ষুধিত পাষাণ"। আজ "ক্ষুধিত পাষাণ" থেকে চিন্তা উড়ে
গেলো ফুকোর উদ্ধৃত পংক্তিগুলিতে। মনেহল এই কাহিনী যেন সেই মেলাংকোলিয়ারই সন্ততি যা
ক্রমে বিস্তার নিচ্ছিল টেক্সো-বাবুটির অন্দরে, ওই মহলটিতে আগমনমাত্রঃ" সমস্ত বাড়িটা একটা সজীব পদার্থের মতো আমাকে তাহার জঠরস্থ মোহরসে অল্পে
অল্পে যেন জীর্ণ করিতে লাগিল। ... বোধ হয় এ বাড়িতে পদার্পণমাত্রেই এ প্রক্রিয়ার আরম্ভ হইয়াছিল — কিন্তু
আমি যেদিন সচেতনভাবে প্রথম ইহার সূত্রপাত অনুভব করি সেদিনকার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে"।অতঃপর Madness ends by
being a movement of the nerves and muscles so
violent that nothing in the course of images,ideas or wills seems to correspond
to it ... "আমার মনে হইল, আরব্য উপন্যাসের একাধিক সহস্র রজনীর একটি রজনী আজ উপন্যাসলোক
হইতে উড়িয়া আসিয়াছে। আমি যেন অন্ধকার নিশীথে সুপ্তিমগ্ন বোগদাদের নির্বাপিতদীপ সংকীর্ণ
পথে কোনো এক সংকটসংকুল অভিসারে যাত্রা করিয়াছি। ...অবশেষে আমার দূতী একটি ঘননীল পর্দার
সম্মুখে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া যেন নিম্নে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল"। অর্থাৎ মেলাংকোলিয়া থেকে জন্ম নিলো frenzy, কিহোতের ক্ষেত্রে continuous
frenzy ...
কিন্তু শেক্ষপীর থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলেই দেখেছেন শুধুমাত্র
ফ্রেন্জি-তাড়িত আচরণ কোনো না কোনো মানুষের এবং তারপরে সেই ফ্রেন্জি'র গহনের
প্যাশন,মেলাংকোলিয়া,মেনিয়া'কে নির্মাণ করে নিয়েছেন নিজেদের 'স্বচ্ছ' চেতনার
দ্বারা। সুতরাং, অন্ততঃ এই মুহুর্ত অবধি, আমারও বিশ্বাস - উন্মাদের মর্মকথা
না-উন্মাদের দ্বারা কদাপিই লিখিত হতে পারেনা সঠিক ভাবে। তবে শ্রষ্টাটি শেক্ষপীর,
রবীন্দ্রনাথ, দস্তয়ভস্কি, সুকুমার রায়'হেন বিরাট এবং গভীর হলে তাঁদের নির্মীত বক্রচেতনার
মানচিত্রের অন্দরে তাঁরা সকল প্রকৃত পাঠকজনকে টেনে নিয়েযান অবলীল।