প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Sunday, September 2, 2018

"শুধু যাওয়া আসা ..."


"শুধু   যাওয়া আসা ..."






ঘুম ভাঙ্গামাত্র মুন্না বল্লোঃ "সিদ্ধার্থদা'র বাবা চলে গেলেন, ভোর চারটায়"সঙ্গে সঙ্গে মনে এলোঃ
"শুধু   যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা"মনে এলো আমার আর মুন্নার বিবাহের ঠিক পরের দিনগুলি। ভোর ভোর উঠে হাঁটতে যেতাম লঙ্গাই নদীর পারে। ফেরার পথে সিদ্ধার্থদের গেট খুলে, উঠানে এলোমেলো দাঁড়িয়ে থাকা নানা ফুলের গাছের তলা থেকে মুন্না কুড়িয়ে নিতো ফুল। একদিন সিদ্ধার্থ'র বাবা ওই সময় বারান্দায় এসে দা৬ড়ালেন। আমি মুন্নাকে বল্লামঃ "ওই দেখো মেসো দেখছেন, মেসো কিন্তু খুব রাগী মানুষ!" মেসো শুনলেন। তারপর হেসে বল্লেনঃ "না'রে মা। তুমি নাও , যত খুশি ফুল নাও। ওরা আমাকে নিয়ে মজা করে"। আহ্‌,সেই সহাস্য-সস্নেহ মুখটি!সেই প্রায় ছয় ফুট উচ্চতা, মাথার সমস্ত চুল শাদা ধবধবে, সে অনেকদিন থেকেই। মেসোকে যখন থেকে দেখেছি, মনেহয় তখন থেকেই। তখন বলতে বারো কেলাস পার হয়ে আমি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে গেছি। ১৯৯০ সাল। সিদ্ধার্থ'রা, মেসোর বদলীর চাকরীহেতু, নানা স্থান ঘুরে এসেছে করিমগঞ্জে, তাদের সাবেক বাড়িতে বাস করতে।ছুটিতে বাড়ি এসে আমার আর সিদ্ধার্থ'র পরিচয় হয়েছে। পরিচয় দ্রুত পরিণত হচ্ছে বন্ধুত্বের প্রগাঢ়তায়। তখন থেকেই মেসোর চুল, হয় সত্যই ধবধবে শাদা আর নয়তো আমার মর্মচোখে তা তখন থেকেই ধবধবে শাদা।
মাত্র তিনদিন আগেই সিদ্ধার্থ তাঁকে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে। ফোনে জানিয়েছে। কথা হয়েছে সিদ্ধার্থ'র সঙ্গে, গতকাল রাতেও। তখনি মৃত্যু শংকা'র ছায়া ফেলে দিয়েছে সিদ্ধার্থর স্বরে।
-"কি রে, কি খবর, আজ?"
-"না'রে খবর ভালো না..."
আজ ঘুম ভাঙ্গামাত্র মুন্না বল্লোঃ "সিদ্ধার্থদা'র বাবা চলে গেলেন, ভোর চারটায়"সঙ্গে সঙ্গে মনে এলোঃ
"শুধু   যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা"মনে এলো"শুধু আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা" (হায়, প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদও যার মর্মে ডেকে আনে গান, উড়িয়ে আনে অক্ষর - সে'কি অভিশপ্ত না'কি বরপ্রাপ্ত? - জানিনা।)...
"শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা,
শুধু আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা" - মনে পড়লো আমার ছেলে, তখন শিশু, তাকে নিয়ে গেছি সিদ্ধার্থ'র বাড়ি। মেসো'কে দেখিয়ে বলেছি "এই দাদু অ-নে-ক গল্প জানে"। সঙ্গে সঙ্গে সে মেসো'কে ধরে বসেছে "তাহলে বলো, এখুনি বলো..." মিশকিন'কে নিয়ে মেসো বসলেন তাঁদের মধ্যের কোঠার বিছানায় আর আমি ফোটো তুলে চল্লাম, তাঁদের, একাদিক্রমে। কিছু ফোটো ফ্ল্যাশ্‌লাইটে ঝলকানো কিছু ফ্ল্যাশ্‌লাইট ছাড়া।- ওই তাঁদের মাঝের কোঠাটি, তার আলো-আঁধারি না'কি ফ্ল্যাশ্‌-লাইটের জ্বলানেভার আলো আঁধারিই মর্মে, তাঁর অনুষঙ্গে বাজিয়ে দিলো গানটি? ওই পংক্তিটি "শুধু আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা"? না'কি আরো গূঢ়তর কোনো ইঙ্গিত নিয়ে আমার নিরীশ্বর মহাবিশ্ব, স্বর্গহীন মহাকাশ আমাকে পাঠালো এই গানটি? আজ সকালে? মেসো আর নেই জানার সঙ্গে সঙ্গে? - আসলে আমাদের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য এই, যে, আমরা আদতে "বেজন্মা"। আমাদের একাধিক পিতা, একাধিক মাতা। না, বাবু নরেন দত্ত'হেন "দরিদ্র ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী - সক্কলে আমার ভাই"হেন এড্‌-জিংগলে নয় আমাদের এই "বেজন্মাত্ব"। প্রতিজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু'র মা'বাবা কখন যে কিভাবে আমাদের নিজেদের বাবা'মা হয়ে উঠেছেন তা আমরা জানিনি নিজেরাইশুধু জানি হায়ার সেকেন্ডারীর, আমার, রেজাল্ট অন্যদের আশানুরূপ না হওয়ার পর একরাতে বাড়িফেরা পথে এক 'বাবা'র, এক বন্ধুর বাবার আমাকে তাঁর সঙ্গে রিক্সায় তুলে নেওয়া আর আবেগে, নেশায় মাখামাখি তাঁর কথাগুলিঃ "আমার স্নেহ মমতা, তোমার রেজাল্ট", জানি মনিময়ের মা মারা যাওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাতৃ বিয়োগের হাহাকার, জানি জোনাকের বাবার শেষ আলিঙ্গনের উষ্ণতার হেউঢেউ, অদ্যাপি, স্বপ্নে ...
স্বপ্নের গহনে, মগ্ন চৈতণ্যের অতলে এই যে "শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া" - এ'ই মনেহয় যাপনের বাস্তব।ভাবি, 'শুধু দেখা পাওয়া" ছাড়া আর কি? জীবন, যা মৃত্যুরই যমজ, তার পথে এসে চলে যেতে যেতে সকলই তো দেখা পাওয়া শুধু। জন্মমাত্র মা, দাই'মা'র দেখা পাওয়া। ক্রমে পিতা,ভ্রাতা, ভগিনী। ক্রমে মিত্র, পুত্র। দেখা পাওয়াই শুধু। আমাদের ভ্রম আমাদিগকে বোঝায় - এদের আমরা চিনেছি, জেনেছি, এরা,এঁরা আমাদের চিনেছেন, জেনেছেন। কিন্তু আদপে চেনার, জানার আবহটি নির্মীত হতে হতেই বেজেওঠে "                শুধু দূরে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া"এই "দূর" কখনো রেলের গাড়িতে চড়ে, অথবা বিমানে, পেটের ধান্দায় চলে যাওয়া দূর আইটি নগরে, কখনো চিতার আগুনে পুড়ে, কখনো কবরের অন্ধকারে।ওই দূরের পথে চলে যেতে যেতে কেবলই কি মনে হয়না ফিরে আসব? ফিরে আসবে? মনেহয় না'কি যে ফিরে এসে মা'বাবার কোঠার কাছাকাছিতে বানিয়ে দেবো একটি বাথরুম যাতে রাতবিরেতে পায়খানা পেচ্ছাপের দরকারে না পেরোতে হয় লম্বা বারান্দা? মনেহয় না'কি যাওয়ার আগে দেখে যাওয়া যাবে সিদ্ধার্থ'র বিবাহ? বরকর্তা হয়ে আপ্যায়ন জানাবেন অতিথিদের?মনেহয় এই সকলই কত স্বাভাবিক, সহজ, ছোট আশা।মনেহয় কেননা আমাদের ভ্রম আমাদেরকে এমনটাই মনেকরাতে চায়।অথচ এই "শুধু যাওয়া,আসা"র পথের পথিকের, সকল পথিকজনেরই এই সকল দুরাশাই, প্রকৃত প্রস্তাবে। "শুধু নব দুরাশায় আগে চলে যায়                     পিছে ফেলে যায় মিছে আশা॥" তথাপি আমাদের এই যাত্রা ওই সকল দুরাশাকে বয়ে নিয়েই, ঐ সকল দুরাশার দিকেই ...। আমরা, মানে, আমি সিদ্ধার্থ আর জোনাক যারা প্রায় বুলেট ও পিস্তলহেন একাত্ম, তার মধ্যে জোনাক,সিদ্ধার্থ দুজনেরই পিতৃবিয়োগ ঘটেগেলো।ক্রমে।ওই মুহুর্তগুলিতে গিয়ে আমার গিয়ে দাঁড়ানো হলোনা কারোরই কিনারে অথচ দাঁড়াবো এই দুরাশায় ভর করে চলে এসেছি এতোটা পথ। পারবো কি, আমার সহোদরের কিনারে দাঁড়াতে আমাদের পিতৃ-মাতৃবিয়োগের মুহুর্তে? জানিনা। তবু 'পারবো' ওই দুরাশায় ভর করেই পথ চলি। চলেছি।চলেছে গানটিও, বেজে, মর্মে। চলতে চলতে এসেছে সঞ্চারীতেঃ
ভাঙা তরী ধরে ভাসে পারাবারে,
ভাব কেঁদে মরেভাঙা ভাষা।
ভাবি 'ভাবের' কথা। ভাবি ভাষা'র কথা। ভাবি এই বছরের গোড়াতে যখন বাড়ি গিয়েছিলাম তখন এক সকালে সিদ্ধার্থ'র বাড়ি গেছি। গিয়ে গল্প জুড়েছি মেসোর সঙ্গে। আমাদের পাড়ার বাসিন্দাজনদের নানান কীর্তি কলাপ-কাহিনী শোনাচ্ছি। মেসো শার্ট-প্যান্ট পরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বাজারে যাওয়ার। এই 'বাজারে যাওয়া' এই সিভিল ইঞ্জিনীয়ার মানুষটির ছিল দ্বিতীয় পেশার মতো। বাজারে যতেই হবে। তা'ও সেই "সন্তর বাজার", সেই আমাদের মফস্বলের "সেন্টার" এর বাজার। কেনাকাটার দরকার থাক আর না'ই থাক। সেই বাজার ফেরৎ পথেই হয়েছিল তাঁর প্রথম হার্ট এটাক্‌। চলতি অটোরিক্সায় বসা অবস্থাতেই। - এহেন বাজারপ্রিয় মেসো, সেদিন, আমার বলতে থাকা আজব-সব গপ্পে মেতে শার্ট খুলেফেলে বল্লেনঃ "নাহ্‌, আজ আর বাজারে যাবোনা , তোমার গপ্পই শুনবো'। আহ্‌, যেন শিশুটি।এক সময় বাড়ি থেকে ফোন এলো, ছেলেকে না'কি মেয়েকে এনেছিলাম সঙ্গে করে। তার স্নান খাওয়ার বেলা হচ্ছে। ফলে আসর ভাঙ্গতে হলো। মনে মনে স্থির করেছিলাম সে যাত্রায় যদি না'ও হয় পরের বার এসে নিশ্চয় একটা গোটা দিন মেসোর সঙ্গে কাটাবো এইসব আজগুবি গপ্পে।আজ, সেদিনের সেই "মনে মনে স্থির করা" বেজে উঠছে, মর্মে, এই সুরেঃ "হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়,
আধখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়..." - এ শুধু আমার নয়, তোমার নয়, হায়, সকলেরই, এই যে পথ, যাকে আমরা যাপন বলি, তার প্রতিটি পদক্ষেপেই এই "হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়। জন্মমাত্র মা, দাই'মা'র সঙ্গে পরিচয়, কুহক ভাষায় বলতে চাওয়া কথা'র নৌকাডুবি। ক্রমে পিতা,ভ্রাতা, ভগিনী। ক্রমে মিত্র, পুত্র।পরিচয়
যা ঘটে, যতোটুকু ঘটে, সেই পরিচয়ের মূল্যে যতোটুকু 'চেনা' সম্ভব হয় আদতে, তার অনেক অনেক বেশী 'না চেনা' চক্রবাল, নিজের এবং অন্যজনের, পরস্পরের কাছে রয়েযায় অচেনা, অজানা। আদপে চেনার, জানার আবহটি নির্মীত হতে হতেই বেজেওঠেঃ
""হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়,
আধখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়..."                 
যা সাঙ্গ হয় তা কি? তা'কি জীবন? তা'ই কি 'জীবন'? যা কেটে যায়, কেটে গেলো, কেটে যাচ্ছে "লাজে ভয়ে ত্রাসে আধো-বিশ্বাসে"?
না,"লাজে ভয়ে ত্রাসে আধো-বিশ্বাসে" যা কাটে, কাটছে, তা বোধকরি জীবন নয়। যাপন।
তাহলে জীবন আর কোথায়? সবই তো মৃত্যু ...ভাবি। ভাবি জীবন বোধকরি এই গানটির ওই শেষ পংক্তিটিইঃ "শুধু আধখানি ভালোবাসা"। জন্মান্তর, পুনর্জন্ম,মুক্তি, মোক্ষ - এই সমস্ত অবান্তরকে পার হয়ে যা থাকে, যা থাকবে, তা'ই এই "আধখানি ভালবাসা" যা অদ্যাপি, দেশগ্রামে, রাত্রিপথে হাঁটতে হাঁটতে চার্চ্চ রোডের মোড়ে এলেই আবেগে, নেশায় মাখামাখি আরের 'বাবা'র কথাগুলিঃ "আমার স্নেহ মমতা, তোমার রেজাল্ট", যে মন্ত্রবলে আজো জোনাকদের বাড়ি ঢুকলেই মনেহয় এইতো বারহয়ে আসবেন রোগা, লম্বা গণেশ দে। মুখে না কামানো কাঁচাপাকা দাড়ির আবহে অদ্ভুত স্নেহসিক্ত কন্ঠে ধ্বনিত হবেঃ "সপ্তর্ষি, আইসো..." ভাবি জীবন বোধকরি এই গানটির ওই শেষ পংক্তিটিইঃ "শুধু আধখানি ভালোবাসা"। জন্মান্তর, পুনর্জন্ম,মুক্তি, মোক্ষ - এই সমস্ত অবান্তরকে পার হয়ে যা থাকে, যা থাকবে, তা আমার আন্‌মনা হয়ে যাওয়া কোনো মেঘলা সকালে সিদ্ধার্থদের বাড়িতে, গেট খুলে, ঢুকে পড়তে পড়তে। কেউ জানবেনা তখন মেসো ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকে আর মুন্নাকে বলছেনঃ"না'রে মা। তুমি নেও ,যত খুশি ফুল নেও।  এরা আমারে লইয়া মজা করে"।















ঘুম ঘর