যাত্রাপথের
গানঃ প্রণব কুমার বর্মণের কবিতা
সপ্তর্ষি
বিশ্বাস
১।
একজন মানুষের হেঁটে আসা দেখি। দেখি তাঁর এগিয়ে আসা মন্থর
দৃঢ়তায়। দেখি তাঁর সাধনা দিনগত 'ক্ষত যত, ক্ষতি যত', 'দিবসের কুশাঙ্কুর' - সমস্ত
পারহয়ে এগিয়ে যাওয়ার। পারহয়ে যাওয়ার, যেন, চক্রবালও। একদা 'কবি' শব্দে মিশে থাকতো
এমন একটি যাপনছবি যা অন্-অনুকরনীয়, যা সন্ন্যাসে গৈরিক হয়েও মায়ায় সবুজ, করুণ।
একদা 'কবি' শব্দে মিশে থাকতো 'মন্ত্রদ্রষ্টা' শব্দটিরো ছায়া। অর্থাৎ 'কবি' শব্দটির
সঙ্গে, একদা, পৃথিবীর সমস্ত মানচিত্রেই মিশেছিল এক রকমের যাপনছবি। দ্বৈপায়ন ব্যাস
থেকে কালিদাস, টু ফু, লি পো হয়ে হোল্ডারলীন ... অতঃপর ক্রমে 'কবি' সর্ব দেশে, হয়ে
উঠলো এক আজব প্রজাতি যারা একটি কি দুইটি সফল পংক্তিরো জনক-জননী হওয়ার দাবী রাখুক
বা না রাখুক বহিরঙ্গ উৎকটতায় উড্ডীন। - এই যে সময়, আমরা যার সন্ততি, যার পথিক তার
অলীগলী, পথঘাট এমনই বহিরঙ্গ উৎকটতায় উড্ডীন। এই সময়ে
'কবি যশোলোভ', যশের বিনিময়ে অর্থলোভ - সবই ষোলো আনা খাঁটি। এই সময়ে 'সাধনা'
অর্থহীন। অবান্তর। এখানে প্রকৃত কবিতা সৃষ্টির অন্তর্গত অগ্নিতে, 'কারুবাসনা'র
দাবীতে দগ্ধ হয়ে শুদ্ধ হয়ে উঠতে নারাজ সিংহভাগ 'কবি যশোলোভী'। পরিবর্তে অতঃশ্বাসশূন্য
একটি চমকদার, বিজ্ঞাপনের জিঙ্গলহেন পংক্তি নির্মাণের চেষ্টাই সিংহভাগের মোক্ষ। - এবং 'যুদ্ধ ও বাণিজ্য' সঞ্জাত এই বানিয়া সময়ে
এ'ই বিজ্ঞাপন-মনস্কতা, এই প্রচার-সর্বস্বতা,হয়, স্বাভাবিক। সুতরাং এই চালচিত্রকে
পেছনে ফেলে একজন মানুষের হেঁটে আসা মন্থর দৃঢ়তায়, অন্তর্গত সাধনায়, এগিয়ে আসা,
ক্রমশঃ কবিতার অন্তর্গত নৈঃশব্দের দিকে, আমাকে আশ্চর্য করে, আচ্ছন্ন করে, মুগ্ধ
করে।
ষাটোত্তীর্ন প্রণব কুমার বর্মনের কবিতা-সাধনা যে নিতান্ত
যশোলোভ নয়, ভুঁইফোঁড় নয়, তা আমি কবির সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়রের সূত্রে যেমন জানি
তেমনি তাঁর কবিতাগুলি পাঠ করে জানতে পারবেন, না সকলে নয়, শুধুমাত্র প্রকৃতপাঠকজনই।
বছর চার আগে প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ "অন্তহীন আবর্ত" বর্মনদার
কবি-জীবনের ইতিহাসে, আমার মতে, জীবনানন্দ দাশের "ঝরা পালক" - যা একজন
কবির জন্মকে ঘোষনা করলেও, কবিত্বকে নিশ্চিত করলেও সর্বত্র কবিতা হয়ে ওঠেনা। কবিতা
হয়ে ওঠেনা, তবে ওই গ্রন্থ, "অন্তহীন আবর্ত" বাদ দিয়েও প্রণব কুমার
বর্মনকে স্পষ্ট পাওয়া যায়না - ঠিক যেমন "ঝরা পালক" বাদ দিয়ে চেনা যায়না
জীবনানন্দকে। অতঃপর প্রকাশিত হয় "ধূসর পান্ডুলিপি"। প্রমাণিত হন
জীবনানন্দ দাশ। - ঠিক তেমনই "ভিক্ষা"তে প্রমাণিত প্রণব কুমার বর্মন।
'ভিক্ষা'তে প্রমাণিত এই হেতু নয়, যে, এটি প্রকাশ করেছে আনন্দ পাবলিশার্স, প্রমাণিত
এই হেতু যে, প্রায় একই সঙ্গে প্রকাশিত "ভিক্ষা" আর "দুয়ারের
ওপাশে" ( প্রকাশকঃ কমলিনী প্রকাশন) দুটি গ্রন্থর মধ্যে
"ভিক্ষা"তেই, ঘটনাচক্রে, তাঁর এতাবৎকালীন প্রকৃত পরিণত কবিতাগুলি হয়েছে
সন্নিবিষ্ট।তবে বইগুলিত সোপানমাত্র। বর্মনদার
উঠে আসার পদশব্দ, তাঁর ইদানীংকার লেখায়, শুনতে পাচ্ছিলাম অনেকদিন যাবৎ। প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্প এক সাধনা। আমাহেন
নিরীশ্বরের কাছে একমাত্র সাধনা। বিষ্ণু
দে লিখেছিলেন "কাব্যচর্চা মাধুকরী, শিল্পই সন্ন্যাস"। এই বিজ্ঞাপন-যুগ, এই আত্মপ্রচার-সর্বস্ব সময়েও
প্রণব কুমার বর্মন উদাসীন এসকল ছলাকলার প্রতি। নিয়ত
নিরত প্রকৃত কবিতার সৃষ্টির সাধনাতেই।।
২।
কবিতায় ঠিক কি আঁকেন প্রণব বর্মন ?
যতোদূর মনে আছে, তাতে মনেহয়, যে, আঁদ্রে ব্রেঁতোই বলেছিলেন
কথাটি। বলেছিলেন কবিতা যেন রানওয়ে ধরে ছুটতে থাকা এক বিমান। মাটি ছুঁয়ে ছুটতে
ছুটতে অকস্মাৎই সে উঠে যায় মাটি ছেড়ে। শূন্যে। ওই উড়ানটি যদি আসে কোনো রচনায়, যখন
আসে কোনো রচনায় তখনই সে হয়ে ওঠে কবিতা, প্রকৃত অর্থে। - এই প্রেক্ষিত, কবিতার,
মনেরেখে, প্রণব কুমার বর্মনের কবিতার দিকে দেখলে টের পাওয়া যায়, যে, তাঁর যে সকল
রচনা সক্ষম হয়েছে এই উড়ানে, তারা, অক্ষরে, আঁকতে চায় এমন এক ছবি যা বিরাট
বৃক্ষহেন, মাটিতে শিকড় প্রোথিত করেও শাখায় শাখায় ধাবমান মহাকাশের মহানীলের দিকে।
প্রতিদিনের যাপন-অভিজ্ঞতাকে সোপান করে নিয়ে, সেই সকল সোপান বেয়ে উঠে আসা রাত্রির
খোলা ছাতে। চেয়ে দেখা, চেয়ে থাকা মহানীলে, মহাকাশে...
এমত মহাছবির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, আমার মতে, 'ভিক্ষা' কবিতাটিঃ
সরল, অনর্গল ভঙ্গিতে নিতান্ত আটপৌরে বর্ননে কবিতাটি
ছুটতে ছুটতে "আমরা তখন ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বসব দুজন" এ এসেই যাপনবাস্তবতার
'রান্ওয়ে' ছেড়ে উড়ান দেয় নীলিমার দিকে। 'দুজন' শব্দটির মাত্রা কোনো রক্তমাংসের
অস্তিত্বের চক্রবাল ছিঁড়ে হয়ে উঠতে চায় কবির, পাঠকের মগ্ন চৈতন্য, 'জীবন দেবতা' - যাঁর ছায়াপাতে, মর্মে, জাগে গান,
বিস্ময়ে। উদ্ধৃত করতে ইচ্ছা করে "রাত্রি এবং আমি" কবিতাটিও, একই কারনেঃ
( যদিও 'নিশার', 'ঊষার' আর 'আশায়' এর অনুপ্রাস সত্ত্বেও আমি
কেন যেন স্বস্তি পাইনা, এইখানে, 'ঊষা' শব্দটির ব্যবহারে...)
"ভিক্ষা"
গ্রন্থে আমার পছন্দের কবিতাগুলিঃ "ভিক্ষা", "আহরণ",
"রাত্রি এবং আমি", "পরিষেবা", "নিরুদ্দেশ",
"ভূত চতুর্দশী", "দুর্গামন্দির", "উঠোন",
"রান্নাঘর" ...গ্রন্থের অন্য
কবিতা গুলি? অন্য কবিতাগুলি, মনেহয়, দাবী রাখে পুনর্লেখনের, সামান্য প্রকরণ, শৈলীর
কুশলতার। 'সামান্য' - খুব বেশী নয়। প্রকরণের, শৈলীর পথ বাউল-কবিয়ালের নিমিত্ত না
হলেও তাঁদেরো, নিতান্তই শিল্পের খাতিরে কিছু কিছু অনুসরন করতে হয়। ওই ততোটুকুই
শুধু দরকার যাতে রক্তমাংসের "তুমি" টি যাতে যাপনিক অস্তিত্বের চক্রবাল
ছিঁড়ে হয়ে উঠতে পারে কবির, পাঠকের মগ্ন চৈতন্য, 'জীবন দেবতা' । যেমন হয়েছে "রান্নাঘর"
কবিতাটিতে। কোনো এক রন্ধন পটিয়সীর হাত, তার রান্নাঘর, ক্রমে হয়ে উঠেছে সৃষ্টির সেই
অন্ধকার গর্ভগৃহ যার অতল থেকে একদিন উঠেছিল ইচ্ছার আলোড়ন, প্রকাশিত হয়েছিল
"আলো হোক" - এই বার্তায়। এই রান্নাঘর আশ্চর্য, কেননা তাতেই মুহুর্মুহু
নির্মীত হছে, সৃষ্ট হচ্ছে, সুষম অনুপাতে মশলার মিশেলে, সহজ কথায় "জীবন"।
যে জীবন ঘিরে "আকাশ ভরা সূর্য্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ" তাকেই প্রণাম করে
"বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান"। এই "রান্নাঘর" আমার মর্মে আনে
সেই বিরাটের ইঙ্গিত।
এমন সম্ভাবনা, উড়ানের, ছিল "ভিক্ষা" গ্রন্থের আরো বেশ কিছু
রচনাতে তবে অন্তিমে তারা কবিত্বের, চিন্তার মাধ্যাকর্ষণে পারেনি উড়ান দিতে।
তবে পারবে। অচিরেই তারাও উড়ানে সক্ষম হবে কেননা প্রণব কুমার
বর্মন সাধক। তাই তাঁর আসা মানেই এগিয়ে আসা। এগিয়ে আসা মন্থর দৃঢ়তায়। বর্মনদার সেই
এগিয়ে আসার দিকে আশা-চোখ মেলে চেয়ে আছি। থাকব।