সপ্তর্ষি
বিশ্বাস
কৈশোরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু যখন নানান
বৈদ্যুতিন মাধ্যমে উস্কানিমূলক, বিভ্রান্তি মূলক তথ্য পাঠাতে থাকে তখন, ক্রমে, সহ্যের
সীমা, বন্ধুত্বের সংজ্ঞা - সকলই নড়েওঠে অদ্যাপি। হয়তো এই নড়েওঠা অনুচিত, নির্বোধজনোচিত
কেননা এই সত্য এতোদিনে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত, যে কোনো সাধারণ বুদ্ধিমত্তার লোকের কাছেই,
যে, এই সময়, এমন এক সময়, যখন স্রোত চলেছে বিনাশের, আত্মবিনাশের লক্ষ্যে। সঙ্গে চলেছি
আমরাও। সুতরাং বিশ্বের শত্রু মুসলমান, আসামীর শত্রু বাঙ্গালী - ইত্যাদি জিগীরই স্বাভাবিক,
সেই সকল জিগিরে গলা মেলানো, তাল মেলানো - স্বাভাবিক এবং সেই স্বাভাবিকতাবশতঃই আমার
কৈশোর-বন্ধু, তোমার বাল্যবন্ধু, তার সমপাঠিনী, এর প্রিয়সখা -বৈদ্যুতিন মাধ্যমে উস্কানিমূলক,
বিভ্রান্তি মূলক তথ্য পাঠায়। এইগুলি না দেখে মুছে ফেল্লে কোনো সমস্যা থাকেনা। বন্ধুত্বও
বজায় থাকে। মনও থাকে শান্ত। তথাপি আমার মর্মে, ওই সকল উস্কানিমূলক, বিভ্রান্তি মূলক
প্রচার আন্দোলন তোলে। অশান্ত হয় মর্মহ্রদের গভীরতম স্তরটিও। - আমার এই মূর্খামির হেতু'র
সন্ধানই আপাততঃ প্রতিপাদ্য।
নানান জাতির নিমিত্ত রক্ষিত হুঁকায়
ফুঁকা দিয়া 'জাত' যায়কি'না দেখবার কল্প-নিরীক্ষা আমাদের কারোরই শৈশবে নাই। তথাপি শৈশবাবধি
একটি বোধ - মানুষ শুধুমাত্র মানুষই কিভাবে যে থিতু হয়ে গিয়েছিল কেজানে। যেহেতু দেশভাগজাত
"নতুন জিনিস", "নতুন জিনিসের নতুন নাম 'উদ্বাস্তু'" - জুটেছিল
আমার তখন-বালক পিতা,পিতামহসহ সেই প্রজন্মের সকলেরই, এই দেশে, 'হিন্দুস্থানে', ফলতঃ
আমার ঠাকুমা, আমার বাবার পিসী, তাঁদের মুখে "মুসলমান মানেই মির্জাফর" শুনেছি
অনেক, নানান দাঙ্গার গল্প, নানান কুকীর্তিগাথা, শুনেছি। চমকেও উঠেছি সেইসব কাহনের নিষ্ঠুরতায়,
হিংস্রতায়। তথাপি সাহাদাদ্ এর সঙ্গে "গুল্লি খেলা"র সময় কদাপি মনে আসেনি
যে, সে, মুসলমান না'কি হিন্দু। ঠাকুমা-দিদিমা'রা মনে করিয়ে দিলেও ভুলেগেছি। হিন্দু-মুসলমানের
ফারাক থেকে যেটা চোখে পড়েছে অবলীলায়, তা, 'ধনী-গরীবের" ফারাক। কাজের মাসী 'সবিতার
মা", "হরেন্ড'র মা" - এরা গরীব। লন্ডনে গিয়ে পিঁয়াজ কেটে, বেচে - সুনির্মল
পুরকায়স্থ'রা 'ধনী'। - ধনী-গরীবের এই তফাৎ চোখে দেখেই গিয়েছে চিনে নেওয়া। পরে এমন অনেক
"সেকুলার" এর কাছে এসেছি যাঁরা প্রথমে পুঁথিপড়ে "সেকুলার" হয়ে
অতঃপর জেনেছেন, গেয়েছেন "আমরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান"...
আর আমার বা আমার মতো আরো বহু মূর্খই "সেকুলারইজম" না জেনে, "সেকুলার"
তক্মা না এঁটে, স্বাভাবিক বোকাদের মতো টের পেয়েছে মানুষ আদতে মানুষই, আর টের পেয়েছে
মানুষের আদতে দুটি জাত - ধনী আর গরীব।
"মানুষের আদতে দুটি জাত - ধনী
আর গরীব" - এই কথাটিই যখন আবিষ্কার করলাম কুখ্যাত "কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো"র
বঙ্গানুবাদ, আটের না'কি নয়ের কেলাসে পড়ে, তখন মনেহলো গ্রন্থটিই বলছে আমার কথা। আমি
অনুনাদ তুলছিনা গ্রন্থের। "মানুষের আদতে দুটি জাত - ধনী আর গরীব" - কেন?
কিভাবে? কবেথেকে? - এর উত্তর জানার ইচ্ছা যতোটা তীব্র ছিল বাল্যে, অদ্যাপিও তা'ই। আর
যেহেতু "মানুষের আদতে দুটি জাত - ধনী আর গরীব" - তাই হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-কিরিশ্চান
নিয়ে ভাববার কথা মনেই জাগেনি বহুদিন। বরং ক্রমে, "গল্পগুচ্ছ", "নৌকাডুবি",
"চোখের বালি" হয়ে "গোরা", "ঘরে বাইরে" থেকে "যদি
প্রেম দিলেনা প্রাণে, কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে" তে এসে গর্বিত হতাম
এই ভেবে যে - এই সকল যে ভাষাতে লিখিত আমারো মুখের ভাষা তা'ই। - আরো পরে ইংরেজি অনুবাদে
রিল্কে পাঠান্তে মনে হয়েছি আহা, যে ভাষায় এই সকল বাক্য লিখেছেন রিল্কে সেই ভাষা যদি
আমার মুখের ভাষা হতো! - অথচ সেই ভাষা যা'র মুখে ছিল তার নাম হিটলার, 'বিশ্বত্রাস হিটলার",
শান্তিগোপালের 'হিটলার', রতুন অপেরার "হিটলার" ...
"মানুষের আদতে দুটি জাত - ধনী
আর গরীব" - কেন? কিভাবে? কবেথেকে? বাল্যদশায়, চারিদিক দেখেশুনে যা মনে হয়েছিল
তা এই, যে, ধনীরা যদি তাদের কিছু ধন দিয়ে দেয় গরীবদের তাহলে ধনীরা হয়তো অতো ধনী আর
থাকবেনা তবে গরীবেরা বেঁচে থাকতে পারবে। - এই আবিস্কারের সুত্র ধরেই মর্মে রবিনহুডের
আস্তানা গাড়া - "শেরউড্ বনের রবিন হুড্", "বুদ্ধির যুদ্ধে রবিন হুড্"
- ময়ূখ চৌধুরীর রেখায়, লেখায় - মাসিক "শুকতারা"র পাতায় ...(অদ্যাপিও অনেকের
ধারনা ওই রবিনহুড্গিরি'ই বুঝি মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র - ইত্যাদি, ইত্যাদি। ) ... রবিনহুড,
যেহেতু 'ধনীর শত্রু আর গরীবের বন্ধু" তাই সেখানেও হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-কিরিস্তান
ছিলনা। সুতরাং সাহাদাদ, বাবুলমিয়াঁ, আলেকদা - কাউকেউ "দুশমন" বলে ভাবা গেলোনা।
এতোদূর বোঝাগেলো ওদের পূজাপালির কায়দাকানুন অন্য, সাজপোশাকের ঢং, কখনো কখনো অন্য। যেমন
বাংলাদেশ টেলিভিশনে বছরের কিছু বিশেষ সময়ে সংবাদ-পাঠিকারা বোরখা পড়ে খবর পড়েন। ওদের
ঈদ এক পরব। ঈদে নিমন্ত্রণ হয়। বাড়িতে লক্ষী-সরস্বতীর পূজোয় সাদাদ, বাবুলেরা আসে। একসঙ্গে
মিলে ঝুলন করি... দিন যায় ...
হাতে এলো "টেল্ অফ টু সিটিজ"
, সুধীন্দ্রনাথ রাহা না'কি নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ'র অনুবাদে? ঠিক মনে নেই। বালকমনে যে আন্দোলন
তুল্লো গ্রন্থটি তার মূল কথা এই, যে - ধনীরা নিজের ইচ্ছায় কিচ্ছু দেবেনা, দেয়না গরীবকে।
নিতেহলে কেড়ে নিতে হয়। আর এই কেড়ে নেওয়া কোনো একলা রবিনহুডের কাজ নয়। - তাহলে? ওই
"তাহলে"র উত্তরের কিছুটা ইঙ্গিত, আটের-নয়ের কেলাসে এসে মিল্লো সেই কুখ্যাত
গ্রন্থেই, যার নাম "কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো" এবং তখনো যা ঘটলো তা আমার অপরিণত
ভাবনার পরিণত ছায়া দেখলাম গ্রন্থটিতে। সুতরাং ওই গ্রন্থের লেখকদ্বয়ের আরো রচনা পাঠে
যে উৎসাহী হয়েছিলাম তা আর বলা বাহুল্য।
সাত কেলাস অব্দি "সুখপাঠ্য ভারতবর্ষের"
ইতিহাস পাঠে জেনেছিলাম, যে, ইংরেজেরা সাংঘাতিক খারাপ কেননা তারা "ডিভাইড এন্ড
রুল" করেছিল। ওরা দ্বিজাতি তত্বের উপরে দেশভাগ করেছিল। ক্রমে দেখলাম,যে, বড়লোকেরাই
আরো বড়লোক হওয়ার লোভে আনে "ডিভাইড এন্ড রুল"। বাধিয়ে দেয় লড়াই - গরীবে-গরীবে।
এক গরীবকে বোঝায় "তুই "হিন্দু", মুসলমান তোর শত্রু, ওকে মার্, তাহলেই
তোর আর দুঃখ থাকবেনা", মুসলমানকে বলে "ওই ব্যাটা হিন্দুর জন্যই তুই গরীব"
... অথবা "ইহুদীদের পাপেই ইউরোপের পতন অতএব বারো শালার সব ইহুদীকে" ... হ্যাঁ,
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, কন্ডিশন অফ ওয়ার্কিং ক্লাস ইন্ ইংল্যান্ড, ক্যাপিটেল - এই
সকল গ্রন্থে যা পেয়েছি, যা পাই, আজো, তা, আমার নিরক্ষর সত্তার দ্বারা আবিষ্কৃত সত্যগুলিরই
যৌক্তিক ব্যাখ্যা। সুতরাং আমার "সেকুলারিজম" এর দায় "প্রোগ্রেসিভ"ত্ব
দেখানোর প্রয়োজনের দায় নয়। এ আমার অন্তর্গত দায়। তাই কৈশোরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু যখন
নানান বৈদ্যুতিন মাধ্যমে উস্কানিমূলক, বিভ্রান্তি মূলক তথ্য পাঠাতে থাকে তখন, ক্রমে,
সহ্যের সীমা, বন্ধুত্বের সংজ্ঞা - সকলই নড়েওঠে। আমি টেরপাই, যে, আমি আর তার
'বন্ধু' নই। বন্ধু নই কেননা সে যে চোখে মানুষকে দেখে আমি সেভাবে দেখিনা। দেখতে
পারিনা। দেখতে পারিনি আবাল্য। দেখতে পারবোনা আমরণ। - আমার দুঃখ হয় এই ভেবে, যে,
আমি জানলাম ( কেন জানলাম? হায়!) স্পস্টতই জানলাম, যে আরো একটি মানুষও ওই দলে যারা
ধনীদের আরো ধনী করবার কারসাজিতে আটকে গিয়েছে কলেপড়া ইঁদুরের মতো। - তার জন্য আমার
দুঃখ হয়। কিন্তু যেহেতু "ক্ষমা"ই মানবের শ্রেষ্ঠ গুণ- এহেন বাক্যকে অবিশ্বাস
নয়, ঘৃণা করি, তাই, তাকেও পারিনা ক্ষমা করতে। ফলতঃ নিজের মধ্যে, আমাহেন আর সকল
মূর্খদের মতোই, পুড়তে থাকি আর ছাই হয়ে উড়েযায় এইসব অক্ষর আমার...