প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Tuesday, November 14, 2017

“…এখন কোথায়?”

“…এখন কোথায়?”
সপ্তর্ষি বিশ্বাস

‘আমার মাথা নত করে দাও, হে তোমার, চরণধূলার তলে’
১।
ছিলনা কিছুই তবু ছিল অনেক।
ছিল শহরের দুই প্রান্তে দুই নদী আর শহরের কিনার ধরিয়া, রেল লাইনের কিনারে কিনারে ধাবিত টেলিগ্রাফের তারহেন, খাল। নটী খাল। ঐ নটী খালের পাড়েই ছিল বাড়ি। ‘বাসা’ নয়, ‘বাড়ি’। ছিল ভোর ভোর ঘুমভাঙ্গা অতঃপর মা’র তাহের ‘দুধমুড়ি’অন্তে রাস্তায় নামা। সাইকেলে। ‘বড় রাস্তা’র আগে ঐ “কাল্ভার্ট অব্দি যেখানে খালের বক্ষকাটা নালা মিশিয়াছে ভুক্কুরের কচু ক্ষেতে, উমেশ শ্যামের, কালা মিয়ার ধান ক্ষেতে। ঐ খানেই মুখামুখি দোকান – মণীন্দ্রমাজন আর সুভাষের। আগইয়া গিয়া ভুক্কুরের কচুক্ষেত, ধান ক্ষেত। পারাপারহীন জলা। লোকমুখে সরল খাঁ’র দিঘি। পার্শ্বেই কবর। সরল খাঁ’র। বাঁশ ঝাড়। টিলা। হাট্মেন্ট রোড। - এইবার বড় রাস্তা। সেটেল্মেন্ট বাজার। বাজারের উল্টাদিকের পাকা রাস্তায় শহর ফুরায়।  আসে টিল্লা বাজার। ‘বডার। মফস্বলেরও ‘শহরতলী’…
        রোলা বার্থ, সেই বিদগ্ধজন, বলিয়াছেন “মীথ্ আসলে, হয়, এক বিশেষ ভাষাপ্রক্রিয়া”। জন্মিতেছে আমারও, বিশ্বাস,তাহাতে, ক্রমে। হ্যাঁ, সকলই এখন মীথ্ । মীথ্ নেতাজী মেলা। মেলার “বিদ্যুৎকন্যা”, মীথ পথিপার্শ্বে যুগলবৃক্ষের বিস্তার, মীথ সরল খাঁ, সরল খাঁ’র কবর, মীথ ‘সন্তর’ বাজাররাস্তায় “লোহার ব্রীজ” , লঙ্গাইনদীর কাঠের পুল, বনমালী রোডের বাঁশের সাঁকো। মীথ, অদ্য, সেই সকল “মানুষ গড়ার কারিগরেরা”ও – মীথ্ দেবব্রত সোম, দিলীপ পাল, রঞ্জিত দাস, অমিতাভ চৌধুরি … অদ্য হয় অসম্ভব, সত্যই, ভাষায় নির্মাণ করা সেই চালচিত্র, যে চালচিত্রে ছিলেন ইঁহারা, অর্পিত। সেই পৃথিবী, ভাষাপৃথিবী, রচনার অক্ষমতা লই স্বীকার করিয়া তথাপি চেষ্টা লই, জলের লিপিতে, রাখিতে কিছু ইঙ্গিত, কেজানে কোন্ অনাগতজনের নিমিত্ত…







২।
ছিলনা কিছুই তবু ছিল অনেক।
ছিলেন স্যার, অমিতাভ চৌধুরি। ছিল তাঁর মোটা কাঁচের চশমা আর বিরাট, বিষণ্ণ এক উঠানের আরধারে তাঁর প্রায় জনশূন্য বাড়িটি।
শহরের যে প্রান্তে কুশিয়ারা নদী, সেই প্রান্তের এক মনখারাপ গলীতে স্যারের বাড়ি। বাড়িতে স্যার একা’ই থাকতেন তখন। বারান্দা থেকে পাওয়া যেতো তাঁর ফিল্টার উইল্স্ সিগারেটের ঘ্রাণ। সামনের বারান্দা থেকে একটা অন্ধকার করিডর ধরে এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে স্যারের পড়ানোর ঘর। দেওয়ালে কাঠের তাক। বই। স্টেট্স্ম্যান্ পত্রিকা। মস্ত একটা কাঠের টেবিল ঘিরে দুটি কাঠের বেঞ্চি। কয়েকটা চেয়ার। এদেরই পাশাপাশি স্যারের খাটিয়া। উল্টোদিকের দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে ডাঁই করা ফিল্টার উইল্সের প্যাকেট। খালি আর না-খালিতে মেশানো। ঐ ডাঁই থেকে, বাজি ধরে সিগারেট চুরি করেছিল আমার ছোটোভাই।
ছিলেন স্যার, অমিতাভ চৌধুরি। তাঁর মোটা কাঁচের চশমা। ছিল সন্ধ্যায় নিত্যি লোডশেডিং আর সিগারেট দু আঙ্গুলের ফাঁকে নিয়ে তাঁর হাত বাড়িয়ে দেওয়া মোমের শিখার দিকে। না’ত মুখ নেবেন মোমের কাছে,না’ত মোমবাতিকে হাতে করে আনবেন মুখের কাছে। প্রায় শিক্ কাবাব বানানোর কায়দায় মিনিট দুই সিগারেটের মাথাটা মোমের শিখায় চেপে রেখে তারপর তিন চারটে ব্রহ্ম টান। সিগারেটের জ্বলে ওঠা।
                              সিগারেট দু আঙ্গুলের ফাঁকে নিয়ে মোমের শিখার দিকে ঐ হাত বাড়িয়ে দেওয়া থেকে সিগারেটের প্রকৃত জ্বলেওঠার মুহুর্তটি ছিল আমার কাছে, আমাদের কাছে  থ্রীলারপ্রায়। চোখের পলক ফেলতে পারতাম না, ক্যালকুলাসের প্রব্লেম কিংবা ডিনামিক্সের সমস্যা সমাধানরত আমাদের হাতগুলি থেমে যেতো। … সেটা ১৯৮৮/৮৯ সাল। এগারো কেলাস। করিমগঞ্জ কলেজ।  শতকরা ৩০০ ভাগ মফস্বলি “ইন্টেলেক্চুয়াল” হয়ে উঠছি। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, পায়ে হাওয়াই চটি, মুখে চারমিনার আর মগজে “বিপ্লব”। কলেজের দেওয়াল পত্রিকায় কবিত্বের বিজ্ঞাপন। “দিদি”দের আস্কারা। সহিপাঠিনীদের চোরা চাউনি। মর্মে সতত সঙ্গীতঃ “বালকবীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়, একি গো বিস্ময়…”  আমরাও, ক্রমে বিড়ি সিগারেটে হয়ে উঠিছি সড়গড়। এক সন্ধ্যায় স্যারের বাড়ির পাঠশেষে মোড়ের দোকানেই সিগারেট কিনে জ্বালাতে গিয়ে বাদ্লা বাতাসে নাজেহাল হচ্ছি। তখনই স্যারও এসেছে ওই দোকানে সিগারেট কিনতে। সিগারেটপ্রজ্জ্বলনপ্রক্রিয়ায় প্রায় সমাধিস্থ আমরা লক্ষই করিনি স্যারকে। জানিনা কতক্ষণ এনন চলছিল। অকস্মাৎ পরচিত কন্ঠের একটি মাত্র বাক্য বা খন্ড বাক্যঃ “তিন লেটার ফাইয়া মেট্রিক্ ফাশ্ করলায় আর সিকেরেট ধরানি দেখ্স্না’নি?” – বাক্যটি উচ্চারিত হওয়ামাত্র –আমি- সঙ্গে আর কে কে ছিল? , রাহুল, দেবর্ষি, অরূপ দাশ, পঙ্কজ দাশ, অয়ন, জয়দীপ বণিক? ঠিক মনে পড়ছেনা … প্রত্যেকের মুখে এবং পেটে হাসির হুলুস্থুল গুড় গুড় করেই আবার তলপেটে চালান। হাসলে উপায় নেই। অতএব হজম করো এবং কর পলায়ণ।
           তবে ঐ ওতোটুকুই। বেশী কথা স্যারকে বলতে শুনিনি কোনোদিন। স্থির চোখে, চশমার কাঁচের ভিতর দিয়ে একটি চাউনি। ঐ যথেষ্ট। কলেজ ইলেকশনের সময়েও দেখেছি কুমারেশ,সজল দত্ত’হেন “মাস্তান”ও স্যারকে আসতে দেখেই সর্দারি ছেড়ে ভোঁকাট্টা দিয়েছে। অথচ তেমন লম্বা চওড়া ত ননই – রীতিমতো বেঁটে’ই ছিলেন স্যার। ছিল এক আরোগ্য-অসম্ভব চর্মরোগ যার প্রকোপে স্যার বহুযুগ ইন্দ্রলুপ্ত। একদা আমাদের বাড়িতে, প্রতি রবিবারে এক আসর বসতো। বলাযায় “স্টাডি সার্কল”। পালা করে পাঠ হতো “দাস ক্যাপিটেল্”। পরে “ওরিজিন অফ্ স্পেসিস্”। আসতেন নানা বিষয়ের অধ্যাপকেরা। ফিজিক্সের তুষারকাকু আর স্যার, অমিতাভ চৌধুরি। বোটানি-জুলজির প্রদীপ বিকাশ বাবু। আরো আসতেন কেউ কেউ। স্মৃতি এখন প্রতারণা করছে। কয়েকদিন জেঠু, মানে সুজিৎ চৌধুরিকেও দেখেছি আসতে। তখন আমি পাঁচ-কিংবা ছয় কেলাসের ছাত্র। স্যারকে তখন থেকেই দেখছি ঐ ইন্দ্রলুপ্ত মস্তকে। আরোগ্য-অসম্ভব ওই চর্মরোগই হয়তো তাঁর আজীবন অকৃতদারত্ব পালনের হেতু। নতুবা বেঁটে খাটো হলেও ওই রকম সুপুরুষ, একদা প্রেসিডেন্সির নামজাদা এই ছাত্রটির অবিবাহের অন্য কোনো হেতু পারেনা থাকতে। একদা আরো কয়েকজন অধাপক বন্ধুর সঙ্গে মিলে বাড়িতে পোলট্রি ফার্ম খুলেছিলেন স্যার সম্ভবতঃ সমবায় তত্ত্বের প্রয়োগপরীক্ষার নিমিত্ত। কুক্কুটদিগের খাদ্য কিংবা ব্যবহার্য কোনো পদার্থ, যা ছিল বিষাক্ত, তা’ই স্যারের এই মারাত্মক অসুখের হেতু।
যদিও কলেজে উঠেই, অংকস্যার রঞ্জিত দাশ স্যারের ভাষায়, “প্রেমময়” পুরুষ হয়ে গেছি, যদিও সিগারেট টান্তে শিখেছি সেই সাতের কেলাস থেকে, যদিও কলেজ ইলেক্শানে দাঁড়ানোর তোড়জোড় গিয়েছে আরম্ভ হয়ে –তথাপি স্যারের হোম্টাস্ক মিস্ করবার সাহস ছিলনা।
দাবা খেলতেন স্যার। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের কিনার দিয়ে যেতে যেতে আড়চোখে তাকিয়ে অনেকদিনই দেখেছি স্যার দাবায় নিমগ্ন। প্রতিপক্ষে কখনো ফিজিক্সেরই সুব্রত লালা, কখনো আমার বাবা। মাঝেমাঝে তুষারকাকুকে সঙ্গে নিয়ে, কখনো একাও – স্যার আসতেন বাবার সঙ্গে আড্ডা দিতে। ওই রকম সময়ে যদি আমারও বেরোতে হত নিজ আড্ডার দরকারে সামনের দরজা দিয়ে বেরোতে সাহস পেতাম না। পেছন দিয়ে চুপি চুপি গেটের কাছে এসে, প্রায় নিঃশব্দে গেট খুলে বেরোতাম। - না, একে ‘ভয়’ বলেনা। বলে ‘সমীহ’, বলে ‘সম্মান’ যা শুধুমাত্র ‘প্রফেসর’, ‘গোল্ড মেডেলিস্ট’, ‘তোমার মাননীয় শিক্ষক’ – ইত্যাদি দ্বারাই যায়না অর্জন করা।
স্যার ‘প্রাইভেট’ পড়াতেন। ঠিক। কিন্তু তা অর্থলোভ বা অর্থের প্রয়োজনহেতু নয়। পড়ানোর বাসনায় পড়ানো, পড়াতে ভালোলাগার সম্মোহনে পড়ানো। কলেজে স্যার এগারো-বারো কেলাসে পাঠ দিতে আসতেন না। মূলতঃ অনার্স’ক্লাসেই পড়াতেন। কিন্তু অনার্সছাত্রদের প্রাইভেটে পড়াতেন না স্যার। মাঝেমধ্যে অতিপ্রিয় এবং অতিমেধাবী এক আধজনকে বাড়িতে আসতে বলতেন বিশেষ কিছু বুঝিয়ে দিতে। তারই সমান্তরালে ছিলেন সেইসব ‘অধ্যাপক’রাও যাঁরা অনার্সের ক্লাসে অর্ধেক পড়িয়ে বা না পড়িয়ে প্রকারান্তরে ছাত্রদের জানিয়ে দিতেন ‘প্রাইভেটে পড়তে এসো, নোট্ পাবে’। ‘নোট’ এর চল এগারো-বারো কেলাসেও ছিল। কিন্তু অমিতাভ চৌধুরি নোট্ দেননি কোনদিন।
তবে আমার বিধি ছিল বাম। আমাদের এগারো কেলাসের মাঝামাঝি  স্যারের চর্মরোগের প্রকোপ এমনই বেড়ে গেলো যে স্যারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কলকাতা চলে যেতে হলো চিকিৎসাহেতু।
         অতএব অমিতাভ চৌধুরি স্যারের অনুপস্থিতির সুযোগে সেই আকাশ, বাতাস, ঘোষ ডায়রী, যশোদা, অশোকা রেস্টোরেন্ট, বাজারের বাইরে পলানের বীয়ারের দোকান, বাজারে নেমেই হাতের ডান দিকে বাঁশের বেড়া দেওয়া, ঝাঁপ টানা স্বদেশী, বিদেশী মদের দোকান, কলেজের ফিজিক্স্ লেবরেটরীর পেছনের পুকুরধার, সহপাঠিনীদের স্তনের ভাঁজ, চোখের সঙ্গীতে নিজেকে দিলাম পুরোপুরি বিলীন করে। সাইকেলে চেপে ঘুড়ে বেড়াই শহরের এই মাথা থেকে ঐ মাথা। এইতো আরশোলা-পাখির মতন এক শহর তারি অলী-গলী-রেল লাইন, ছোটো দোকান, বড়ো দোকান, মাঝারি পার্ক, দুই শ্মশান, দুই নদী, নালা নর্দমা, থানার টিলা, টিলার উপরে সরকারি গেস্ট হাউস, ওল্ড মিশন রোডের শেষ প্রান্তে পুরোনো মিশনের ভাঙ্গা দেওয়াল – এই সব দেখে দেখে, দেখে দেখে আশ মেটেনা – তখনো, হায়, এখনো…
    এমনি করে ভোলানাথের ষাঁড়ের মতো সাইকেলে শহর চষে বেড়ানোর এক বিকেলে হঠাৎই শুনলাম এক কন্ঠঃ “অরেবা, সাইকেলখান্ এট্টু থামাও চাইন…” পরিচিত কন্ঠ। প্রিয় কন্ঠ।ব্রেক্ কষলাম। সাইকেল থামলো। রাস্তার বাঁদিকে। ফুটপাথ। কৃষ্ণা স্টোর্স। রিক্সায় স্যার। রঞ্জিত দাস।
সে আরেক কাহিনী, আরেক মহাবৃক্ষের উপাখ্যান। সে’ও বলব। বলে যাব তবে আরেকদিন। আপাততঃ ফিরেযাই অমিতাভ চৌধুরির কথায় যাঁর মৃত্যুসংবাদের হাহাকার এখনো মর্মে হেউঢেউ  …
৩।
কে ছিলেন এই অমিতাভ চৌধুরি?
যদি বলি ছিলেন সফল অধ্যাপক। পদার্থবিদ্যার। ছিলেন কৃতী ছাত্র। তাতে আর যা’ই বলাহোক্, বলা হয়না সেই মীথ্টির কথা যে মীথ্টি পিতামহ ভীষ্মপ্রায়, যে মহীরূহটি বনস্পতিপ্রায়। কেননা ছিলেন সফল অধ্যাপক কেবল পেশায় নয়, মর্মেও। মর্মেও, কেননা ‘পাশ দেওয়ার পড়া’র, পড়ানোর আলপথটি ধরে সাবধানে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে যেতেই, আমাদের মর্মে তিনি প্রোথিত করে দিয়েছিলেন সেই রাজপথটির খসড়া, যা, সিন্হা-রায় চৌধুরির ‘ইন্টারমিডিয়েট ফিজিক্স’ হয়ে ক্রমে চলেগেছে, হয়তো ‘গ্রভিটেশন্যাল ওয়েভ’এর দিকে, চলেগেছে যেখানে গঙ্গা মিলেছে আকাশগঙ্গায়। এমনকি আমাহেন ছাত্র – যে নয় ‘রিসার্চ স্কলার’, নয় মার্কাকরা ‘সাইন্টিস্ট’ বা নিতান্ত অধ্যাপকও – সে’ও যে পুস্তক বিপণীতে গিয়ে কিনেফেলে ফাইনম্যানের লেকচার সিরিজ বা ‘ইন্‌ সার্চ অফ শ্রডিংগার্স ক্যাট্‌’হেন গ্রন্থ আর সভয়ে হলেও রত হয় পাঠে – এর রহস্য, উৎস নিহিত অমিতাভ চৌধুরি এবং অমিতাভ চৌধুরিহেন মুষ্টিমেয় মনীষারই নিমিত্ত। বারো কেলাসের পরে যেহেতু প্রযুক্তি ছিল আমার পাঠ্য সুতরাং “হাইয়ার ফিজিক্স”এর কোনো “স্কুলিং” আমার নেই যা, এমন কি তথাকথিত “পাশ্‌ কোর্স” এ বিএসসি বন্ধুদের আছে। সুতরাং ‘আমি কে’, ‘আমি কেন’ হেন প্রশ্নের তাড়নায় পদার্থবিদ্যার দিকে ধাবিত হওয়ার আমার যে দুঃসাহস তার মর্মে ওই বারো কেলাসে, ওই অমিতাভ চৌধুরির পড়ানো ‘কোয়ান্টাম ফিজিক্স’ এর অধ্যায়গুলিই ছিল সম্বল। এখানে উল্লেখ্য স্যারের এক অতিপ্রিয় ছাত্র দেবাশিস ভট্টাচার্যের নামও। পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম আমরা। রাজাদা – মানে দেবাশিস ভট্টাচার্য – আর আমি। আমার বাবা, রাজাদার বাবা উভয়েই পড়াতেন সেই ‘করিমগঞ্জ কলেজে’ই যেখানে পড়াতেন অমিতাভ চৌধুরি। হ্যাঁ, বারো কেলাসের পরে রাজাদা’ও পাঠ নিয়েছে প্রযুক্তির তথাপি অদ্যাপি তার অনুসন্ধিৎসা ও পাঠ, পদার্থবিদ্যার, তারও মর্মে এই স্যার, এই অমিতাভ চৌধুরি। রাজাদাহেন আরো অসংখ্য কৃতীছাত্র, স্যারের, ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। তাদের কৃতিত্বের তুলনায় আমি সত্যই ‘অকৃতি অধম’ তথাপি, এগারো-বারো কেলাসের সেই দিনরাত্রিগুলির দিকে তাকিয়ে টেরপাই, স্যার, অমিতাভ চৌধুরি, আমাকেও “কম করে কিছু” দেননি।
৪।
আমি স্যারের জন্মসন জানিনা। জীবনী জানিনা। আমি তাঁর যাপনের ক্রনোলজি জানিনা। আমি জানি তাঁকে ততোটুকুই যতোটুকুর আলোতে তিনি আমার মর্মে ভাস্বর অদ্যাপি। মাত্র কয়েকমাস আগেই, প্রায় ২৬/২৭ বৎসর পরে, শুনেছিলাম তাঁর কন্ঠস্বর, শেষবার, টেলিফোনে। জানতাম স্যার করিমগঞ্জ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছেন গৌহাটিতে, অনেকদিন। আর কিছুই জানতাম না। ক্রমে, ২০১৬ সালের মাঝামাঝি স্যারের কণিষ্ঠা ভগিনী দেবীদত্তাদি’র সঙ্গে নিতান্ত আকস্মিকভাবেই পরিচয় হয়েগেল। তাঁর কাছেই পেলাম স্যারের খবর। আমার সঙ্গে দিদির যোগাযোগ হয়েছে শুনে স্যার দিদিকে বলেছিলেন আমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চান।
বাবা তখন আমার কাছেই। ফোন করলাম এক দুপুরে।
ফোন বাজছে। মনিটরে দেখাচ্ছে “ডায়ালিং”। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড ... আর আমার চেতনা পিছিয়ে যাচ্ছে দশ বছর, পনেরো বছর ... “ওয়েট্‌ আর মাস্‌ এর ডিফারেন্স”, “ আন-সার্টেনিটি প্রিন্সিপল”, মোটা কাঁচের চশমা ,বিরাট বিষণ্ণ এক উঠানের আরধারে প্রায় জনশূন্য একটি বাড়ি, একটি সিগারেটের জ্বলেওঠা …
অবশেষে ধ্বনিত হলঃ”হ্যালো” …
হায়! ‘সময় করেনা ক্ষমা’। যদিও কন্ঠের সেই গাম্ভীর্য, সেই ব্যক্তিত্ব প্রায় অটুট তবু যা গিয়েছে টুটে তা’ই ক্লোরোফিল। ওই স্বরে হলুদ শিরার আভা। “স্যার প্রণাম” এটুকু বলে নিয়েই বাবাকে দিলাম ফোন। তাঁদের বার্তালাপ দাঁড়িয়ে শুনবার মতো অবস্থা আমার নেই তখন। ফোন স্পীকারে থাকায় কানে আসছে সবই তবু যেন ঠিক বুঝতে পারছিনা। আমি ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি। চোখে ভাসছে আমাদের ছোতো বসবার কোঠাটি, আমি সেই কেলাস ফোর-ফাইভ, “অরজিন অফ স্পেসিস” পড়া হচ্ছে, অনেকের মধ্যে স্যার আর বাবা, আশি পাওয়ার বাল্বের আলোয় আলোকিত সন্ধ্যা, বাবা-তুষারকাকু-স্যার …আড্ডা চলছে, চা চলছে, দাবা চলছে, পুড়েযাচ্ছে সিগারেট …
“আমি ডিসেম্বরো করিমগঞ্জ আইমু …”
“আইন রঞ্জুবাবু আইন, আইয়া খালি একটা খবর দেইন যে” …
“রঞ্জুবাবু”! হ্যাঁ, স্যার অনেকের কাছে খ্যাত ছিলেন “রঞ্জুবাবু” বলে, “রঞ্জুদা” বলে …
হ্যাঁ, ক্যালেন্ডারে এই বছরের ডিসেম্বর মাস আসবে, পরের বছরেও আসবে, আরো অনেকবারই আসবে তবে “রঞ্জুবাবু” আর করিমগঞ্জ আসবেন না …
৫।
... এতদূর এসে জীবনানন্দ দাশের পংক্তি গুলি মনে পড়ছেঃ
আমলকী গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিক
কার্তিকের রোদে আর জলে
……….
সূর্য? না কি সূর্যের চপ্পলে

পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে
পৃথিবীর থেকে উড়ে যায়
এ জীবনে ঢের শালিক দেখেছি
তবু সেই তিনজন শালিক কোথায়।


... “এ জীবনে ঢের শালিক দেখেছি, তবু সেই তিনজন শালিক কোথায়”?
আমি বলি, নিজ মনে প্রায়শই বলিঃ এ জীবনে ঢের “অধ্যাপক”,”শিক্ষক”, ‘মাস্টারমশাই” ও “মাস্টর” দেখেছি, দেখবোও, তবু সেই  দেবব্রত সোম, দিলীপ পাল, সুশান্ত পাল, রমাপদ ভট্টাচার্য, রঞ্জিত দাস, অমিতাভ চৌধুরি’রা এখন কোথায়? …



সপ্তর্ষি বিশ্বাস
১৩/১১/২০১৭
বেঙ্গালোর

ঘুম ঘর