অপরাজিত
একটি গল্পপ্রায় গদ্য
কথকঃ সপ্তর্ষি বিশ্বাস
সৌজন্যঃ অনুবর্তন,
দ্বাবিংশ বর্ষ, সপ্তবিংশ খন্ড, মাঘ ১৪১৯
‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে যাহা কিছু সব আছে আছে আছে
......’
উৎসর্গঃ ডাক্তার ডি.এন.ভট্টাচার্য,বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়,বাবু,দিদিভাই,
বড়, ছোটোরাণী, জেঠিমণি, জেঠু (মন্মথ দাস) ও পাব্লিক ইস্কুল রোডের সেই বাড়িটিকে.........
।।পর্ব্ব
এক।।
১।
সেই
অঙ্গুরীয় হারাইয়া গিয়াছে। চিরতরে। সেই পুকুর বুজিল। চিরতরে। সেইখানে এখন গ্রীলে
ঢাকা বিল্ডিং। বন্ধ ফটক। হাউ হাউ কুকুর। ঘাউ ঘাউ ডোবারম্যান্।
কুকুর
মরিয়া যাইবে। বিল্ডিং লয় পাইবে। তবু ফিরিবে কি সেই পুষ্করিণী ? যদি না’ই ফিরে তবে কি করিয়া সন্ধান মিলিবে সেই
চক্রান্তকারী মৎস্যের যাহা একদা ডুব দিয়াছিল অঙ্গুরীয় উদরস্থ করিয়া? আর সেই
অঙ্গুরীয় যদি না’ই মিলিবে
তবে ঋষি পিতার হাত ধরিয়া সে’ত ফিরিতে
থাকিবে, ফিরিতেই থাকিবে পথ হইতে পথে । রাজা তাহাকে চিনিবেন না আর কোনোদিন । রাজার
আর মনেও পড়িবে না তাহার কথা। সে’ও যাইবে
এমনি হারাইয়া ...
রাজার
আর তাহাকে মনেও পড়িবেনা কোনোদিন তথাপি হয়তো সুউচ্চ প্রাকারে ঘেরা প্রাসাদে রাজারো
ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইবে ... হয়তো কোনো শ্রাবণ নিশীথে, বসন্তের অসম্ভব জ্যোৎস্না রজনীতে
অথবা হেমন্তের ধূ ধূ হাওয়ার মধ্যযামে ... জাগিয়া উঠিয়া রাজা ভাবিবেন কি যেন
হারাইল, কে যেন হারাইল, কবে যেন হারাইল, কোথা যেন হারাইল। অথচ মনে পড়িবে না।
কিছুতেই না ... তারপর আবার ঘুমাইয়া পড়িতে পড়িতে হয়তোবা স্বপ্নের গহনে বাজিয়া উঠিবে
এক বৃদ্ধার স্বরঃ ‘হলুদ বনে
বনে ... নাক ছাবিটি হারিয়ে গেছে ... সুখ নেই’ক মনে ...’ ... হারাইয়া যাওয়া, কেবলি হারাইয়া যাওয়া, কোথাও
আংটির, কোনোখানে নাকছাবির, অন্যত্র পুকুরের, ছবির, মুখের ...
যদিও নাই সেই পুষ্করিণী তথাপি অবিনাশ আজো দাঁড়ায় তাহারি কিনারে। গ্রীলে
ঢাকা বিল্ডিং, বন্ধ ফটক, হাউ হাউ কুকুর, ঘাউ ঘাউ ডোবারম্যান্ সমস্ত মুছিয়া গিয়া
আলো উঠে সেই পুষ্করিণীর অতল হইতে। উঠে সন্ধ্যা –সকাল – নিঝ্ঝুম
দুপুর –হলুদ
আলোর বৈকাল ... সেই হলুদ আলোর অতলে গাছ গুলি অবয়ব নেয়, ক্রমে – জাম,
নিম, নারিকেল, সুপারী ... উড়িয়া আসে পাতাগুলি অতঃপর টুপ্ টাপ্ ঝরিতে থাকে
পুকুরের জলে। পাতা পড়ে। জল নড়ে। উঠে ঢেউ। বৃত্তাকার ঢেউ এর পরিধি বাড়ে। ছড়াইয়া পরে
পুকুরের শরীর ময়। প্রতিটি ঢেই এর সঙ্গে উঠিয়া আসে একটি একটি মুখ। একটি একটি একটি
ছবি । অবিনাশ দেখে। দেখিতে দেখিতে যায় হারাইয়া। যায়
তলাইয়া। ইচ্ছা হয় জলে ডুব দিবার। ডুবিয়া গিয়া ঐ মুখগুলি, ছবিগুলি তুলিয়া আনিবার।
ইচ্ছাহয় খোকাকে, খুকিকে সঙ্গে লইয়া ঐ মুখগুলির সম্মুখে, ঐ ছবি গুলির ছায়াতে আবারো
দাঁড়াইবার ...
২।
গোপীনাথ সিনেমা হল্ কে হাতের বাঁদিকে রেখে সোজা
হাঁটতে থাকলে প্রথমে আসে পাব্লিক ইস্কুল। হাতের ডান দিকে। ইস্কুলের পরেই গলী। গলীর
মাঝামাঝি তরজার নীচু বেড়া ঘেরা বাড়ি। মুখোমুখি জলা। কচুরী পানায় ঢাকা। জলার ঐ পারে
‘প্রফেসর
পাড়া’। বাড়ির উঠানের এক পাশে নিম গাছ। অন্যপাশে ভিতর
বাড়িতে যাওয়ার পথ। ভিতর বাড়ির উঠানের পাকঘর অন্য পাশে পুকুর। সেই জল থই থই পুকুর।
অন্তহীন পুষ্করিণী। তারি অন্য পারে ভয়। গা ছম্ ছম্। কলা গাছের সাড়। বড় বড় কচু
গাছের শিবির। কুয়াশা। অন্ধকার। ঐ অথৈ জলেই কতোবার ডুবে গেলো নৌকা, রাজা-রাজরার
ময়ূরপঙ্খী, চাঁদ সওদাগরের মধুকর। ঐ পারাপারহীন পুকুরেই কতো বুদ্ধু-ভুতুম পাড়ি দিলো
রাজকন্যার সন্ধানে ...
ঐ পুকুরই সীমা। বাড়িটির। সীমানার তরজার বেড়ার
কিনারে কিনারে আমগাছ। দক্ষিণের সীমানার ঐ পারে ইস্কুল। পাব্লিক ইস্কুল। জেঠু ঐ
ইস্কুলে পড়ান। ঐ ইস্কুলেই একবার নাটক হয়েছিল। সেই চল্লিশ চোরের গল্প। সেই ‘আলিবাবা-মর্জিনা’। সেই ‘চিচিং
ফাঁক-চিচিং বন্ধ্’। সেই থেকেই মর্জিনা’কে মনে ধরে গেলো অবনাশের। দিদিভাই, জেঠিমণি,
সুধাপিসীদের কিনারে বসে অবিনাশ যখন বিভোর নাটকে তখনি কে যেন বলেছিল ‘ তোর
সঙ্গে মর্জিনা’র বিয়া দিমু’। আহা, ‘বিয়া’ কি
মধুর, কি রহস্যময় একটি উচ্চারণ! সেই তখনি শব্দটি তার মতো করে একটা জায়গা করে
নিয়েছিল অবিনাশের অতলে ...
বাবু’র ফিরতে
রাত হয়। বাবু গান করেন। গান শেখান। গলা সাধেন সক্কালে উঠে। তাঁকে সবাই বলে ‘দাদু’ । বাবু’
অবিনাশের ঠাকুর্দার একটু দূরের সম্পর্কের মামা। তাই অবিনাশের বাবা’র ‘দাদু’,
পিসীর ‘দাদু’। তাই অন্যদেরো ‘দাদু’। অবিনাশের ‘বাবু’
ডাক হয়তো সেই ‘দাদু’রই অপভ্রংশ।
বাবু’র ফিরতে রাত হয়। বাবু
না ফিরলে অবিনাশ ঘুমায় না। জেগে বসে থাকে। গল্প বলেন দিদিভাই। রাত্রির শরীরের পাকে
পাকে মিশে যায় গল্প গুলি। জোনাকির আলোতের গভীরতর হয় অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ ডাকে। ...
ছিল এক বন। সেই বনে ছিল এক বাঘ। তার সাধ হলো মানুষের মেয়েকে বিয়ে করে। বনের কিনারে
গ্রাম। গ্রামের শেষে বামুনের বাড়ি। সেখানে থাকে ভাই আর বোন। তাদের মা নেই, বাপ
নেই। সেই বোনটিকেই চুরি করে তার ঘরনী করতে নিয়ে গেলো বাঘ। কেমন সেই বাঘের ঘর? তার
গেরস্থালী? অবিনাশ জিগায় দিদিভাইকে। রাত বাড়ে। শোনাযায় শেয়ালের হহুংকার। পাব্লিক
ইস্কুলের পেছনের মাঠ ধরে তারা এগিয়ে আসে। তারা এগিয়ে আসে প্রফেসর পাড়ার জলা
ডিঙ্গিয়ে। বাবু এখন কোথায়? বাবু’কে যদি শেয়ালে ধরে? ভাবতে ভাবতে শিউরে ওঠার মুহুর্ত্তে ছড়া
কাটে সেই চোর বাঘের পোলাপানগুলিঃ ‘বাবা গো বাবা, তোর যে শালা, মোর যে মামা, মা’র
যে সোদর ভাই ... পাটার তলে কুম্কুম্ করে, তুইল্লা দে’না ...খাই...’
নিশুত রাতের আবহে ঐ ছড়া অনুরণিত হয়, যেন স্থায়ী অন্তরা, যেন মালকোষ ...বাবু
আসেন। আওয়াজ ওঠে বাঁশের গেইট খোলার। বিছানায় উঠে বসে অবিনাশ। বাইর-বাড়ি থেকে ভিতর
বাড়িতে আসেন বাবু। উঠে আসেন বারান্দায়। তাঁর কোঠার দরজার ছিটকিনি থাকে সোজা করা।
বাইরে থেকে টান দিলেই খুলে যায়। নিজের কোঠায় ঢোকেন বাবু। টেবিলে নামিয়ে রাখেন
কাঁধের ঝোলা ব্যাগ। আলো না জ্বেলেই চলে আসেন ঐ কোঠায় যেখানে অবিনাশ। যেখানে
দিদিভাই। যেখানে প্রতীক্ষা। যেখানে গল্প। বাবু’কে জামা কাপড় ছাড়বার
সুযোগ না দিয়েই তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পরে অবিনাশ। বাবু’র গা’য়ে
কিসের ঘ্রাণ? ঘামের, সিগারেটের, গানের। ঐ ঘ্রাণের কোথাও মমতা, নির্ভরতা, আশ্রয় ...
ঐ বাঘে তুলে নেওয়া মেয়েটির জন্য কষ্ট হয় অবিনাশের, তারো চেয়ে বেশী কষ্ট হয় বাঘের ঐ
ছোট্ট ছানা দুটির জন্য যারা মারা পড়লো বামুনের মেয়ে আর তার ভাই’এর
হাতে ... বাবু’র তাকে কোলে নিয়ে পায়চারী করেন। কখনো ঘরে। কখনো বারান্দায়।
অবিনাশের চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে।
বৃষ্টি বাদ্লার দিনে সঙ্গী জানালা।
মাঝারি চৌকির কিনারে। জানলার সামনে কলাগাছের দঙ্গল। একটি দু’টি আমগাছ। তরজার
বেড়া। পার হয়ে আরেক পুকুর। পুকুর পারে বাড়ি। ঐ বাড়ির একটি ছেলে পাগল। যদিও তাকে
দেখেনি কোনোদিন তবু ‘পাগ্লা আসবে, নিয়ে যাবে’ বললেই ভয়। গা ছম্
ছম্।
তবু একদিন সে এলো। সত্যিই এলো। এলো এমনি এক বৃষ্টির দিনেই। সমস্তর পেছনে
মেঘলা আকাশ। আকাশে মেঘ। মেঘে মেঘে ভীষ্মের শরশয্যা। অর্জুনের রথের চাকার ডুবে
যাওয়া। কাদায়। পুকুরের জল নিথর। হঠাৎ হঠাৎ হাওয়া এসে কাট্ছে আঁকিবুকি। গাছেদের
ডালে ডালে পাতায় পাতায় অন্ধকার। হঠাৎ বৃষ্টি নামলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ঐ বৃষ্টির
ভিতর দিয়েই এসে এলো। আস্তে আস্তে হেঁটে এলো। তার ঐ ‘আসা’
দিকে তাকিয়ে এমনি বিহ্বল হয়ে গেলো অবিনাশ, যে, না’সে পারলো জানলা ছেড়ে
পালিয়ে আসতে না পারলো ডাকতে কাউকে। আঁকা ছবির মতো অবিনাশ দাঁড়িয়ে রইলো খিড়িকির
গরাদ ধরে ...
৩।
অবিনাশ থামিয়া যায়। পারাইতে
পারেনা রাস্তা। লাল বাতির নিষেধ উঠিয়া গিয়া তখন চলিতেছে গাড়িগুলি। কেহ হাঁটিতেছে
না। নামিতেছে না রাস্তায়। যাহারা নামিয়েছিল রাস্তা পারাইতেছে ত্রস্তে। অবিনাশ
পারাইতেছে না। সে দাঁড়াইয়া আছে। দাঁড়াইয়া পরিয়াছে। কি করিয়া পারাইবে সে? কোথায় যাইবে
সে? সে যে আর পারিতেছে না নড়িতেই। ঐ চোখ গুলি তাহার দিকে চাহিয়া আছে অপলক। সে’ও
আছে চাহিয়া। মধ্যে কলাগাছের দঙ্গল, আমগাছ, তরজার বেড়া। ঐ পারে ‘পাগ্লা’। তাহার দৃষ্টি স্থির।
যেন থম ধরিয়া থাকা পুকুর। বৈশাখে। ঝড়ের পূর্বে।
কি আছে ঐ দৃষ্টিতে? কি ছিল ঐ দৃষ্টিতে? ঐ দৃষ্টি রক্তহীন না’কি
রক্ত হিম করা? কেন সে থামিয়া গেলো জানালার কিনারে আসিয়াই? কেন চাহিয়া রহিল অপলক?
সে কি জন্মাবধি পাগল না’কি পরে পাগল হইয়াছিল? সে’কি অদ্যাপি এমনি
উন্মাদ না’কি
সুস্থ হইয়াছে কিছুটা? সে’কী এখনো জীবিত না’কি মৃত? সে’কি শিশু দেখেনাই কোনোদিন না’কি তাহাকে কোনো
কোঠায়, অন্ধকারে বান্ধিয়া রাখা হইত? প্রশ্নের পরে প্রশ্নের আধাতে, অভিঘাতে অবিনাশ
চলিতে পারেনা। স্থানুবৎ দাঁড়াইয়া পরে মধ্য রাস্তায়। দাঁড়াইয়া পরে এবং বিস্মৃত হয়
তাহার পারিপার্শ্বের বাস্তবতা। গাড়িগুলি হর্ণ দেয়। হর্ণগুলি শিং হইয়া খোঁচা লাগায়।
পথচারীরা চীৎকার করে। তথাপি অবিনাশ চলিতে পারেনা। ঠাহর করিতে পারেনা কিছুই। তাহাকে
ঘিড়িয়া থাকা নাগরিক সন্ধ্যা, সিলিকন্ সিটি, উইক্এন্ড্, তাহার বর্তমান ঠিকানার
অতলস্থিত ফ্ল্যাট্বাড়ি সমস্তই যায় অলীক হইয়া। পরিবর্তে ঐ চাহনির কুহক তাহাকে
টানিয়া লয়। সে আপনাকে প্রশ্ন করে এই কোন্ স্থান? কোন শহর? কোন্ নগর? কোন্ দিন?
কোন্ রাত্রি? কবে আমি আসিলাম এই স্থানে? কেন আসিলাম? আসিলামই বা কিভাবে? সে ভাবে – যদি
আসিলাম তবে ফিরিবই বা কি করিয়া? ভাবে যদি ফিরিতে হয় তবেতো এই খিড়িকি হইতে আমাকে
নড়িতে হইবে ... অথচ আমি’ত নড়িতেই পারিতেছি না ... যদি নড়িতে হয়, এই খিড়কি
হইতে, তবে তো ঐ পাগ্লা’র যাওয়া উচিত, অনুচিত ঐ ভাবে, নিষ্পলক চাহিয়া
থাকা ... অবিনাশ বাবু’কে ডাকিতে চেষ্টা লয়, চেষ্টা লয় দিদিভাই’কে
ডাকিতে ... পরিবর্তে আসে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট। কি যেন বলে। অবিনাশ পারেনা
বুঝিতে। তথাপি ঐ সাদা পোশাকের সার্জেন্টটি’ই যেন দিদিভাই, না’কি বাবু
হইয়া তাহার হাত ধরে। তাহাকে পার করাইয়া দেয় রাস্তা। যানজট।
ফুট্পাথে দাঁড়াইয়া অবিনাশ একটি সিগারেট
জ্বালায়। খুঁজিয়া নিতে চেষ্টা লয় আপন অবস্থানের স্থানাংক এই শহরে, এই পৃথিবীতে, এই
ব্রহ্মান্ডেও । তাহার ঐ বেবুব দাঁড়াইয়া থাকাকে খিস্তি দিয়া চলিয়া যায় আইটি শহরের
ব্যস্ত মানুষজন। ততোধিক ব্যস্ত গাড়ি গুলি।
৪।
এই বৃষ্টিদিনের দুপুরগুলি
মধ্যরাতের মতো। নিঝ্ঝুম। অন্ধকার। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শোয়া। কোঠায় একটি মাত্র
খিড়িকি। কোঠাময় গাঢ় সবুজ অন্ধকার। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। টুপ্টাপ্। উঠানে জল।
বারান্দার দিকের দরজা ভেজানো। হিম বাতাস। সেই বাতাসে ভেসে চলেছে বজ্রা। জমিদারের
ছেলে বৌ নিয়ে চলেছে শ্বশুরবাড়ি। চলতে চলতে চলতে চলতে সন্ধ্যা নেমে এলো। ঢেকেগেলো
চক্রবাল। দিগন্ত। নৌকা পরলো চলন-বিল’এ। মাঝি মাল্লারা সকলে সন্ত্রস্ত। এই বিলে
ডাকাতের বড় উপদ্রব। ঠিক এমনি সময় –
দুপুরের এই আসরগুলিতে আরেকজনও আসে।
তার নাম দুর্গা। জেঠু’র ছোটো মেয়ে। ‘জেঠু’ মানে যে
তিনি এই বাড়ির মালিক আর অবিনাশেরা ভাড়াটিয়া এমন মনে হয়না কখনো। তবে মাঝে মাঝে
দিদিভাই-বাবু’র নীচু গলার আলোচনায় বা বাবা এলে কথায় বার্তায় ঐ
শব্দ ও সম্পর্কটি আলোচিত হয়। তথাপি অবিনাশ বোঝেনা একই বাড়িতে, এক সঙ্গে থাকা
সত্ত্বেও কেন পাকঘর আলাদা, রান্নাবান্না আলাদা। জেঠমণি কিছু ভালো রান্না করলেতো
ওদের দিয়ে যানই। দিদিভাই’ও বাটিতে করে তরকারি পাঠান। তবে কেন রান্নাবাড়া,
থাকা খাওয়া হয়না এক সঙ্গে? সেই’তো দুর্গা দিদি আসে, দিদিভাই’র গল্প
শোনে। অবিনাশকে নিয়ে খেলে। ভাত মেখে খাইয়ে দেয়। সেইতো অবিনাশ কোনো কোনো রবিবারে
জেঠুর সঙ্গে খায়, ঘুমায় ...
দুর্গা অবিনাশের চেয়ে বছর দুই’তিনের
বড়ো। রোগা লম্বাটে গড়ন। সকালে ইস্কুলে যায়। ঐটুকু
সময়ই দুজনের কাটে আলাদা । বাকি সময়টা কাটে একসঙ্গে। চলে সারা বাড়ি ঘুড়ে ঘুড়ে খেলা।
এক সময় স্নানের ডাক পরে। দুর্গা পুকুরঘাটে নেমে ডুব্ দেয়। অবিনাশকে তেল মাখিয়ে
স্নান করান দিদিভাই। বারান্দায়। কোনো কোনো দিন অবিনাশ বায়না ধরে ‘আজকে
ছুটোরানীয়ে খাওয়াইয়া দিবো’। দুর্গা দেয়। তারপর বসে দিদিভাই’এর গল্পের আসর। ঐ আসরে দিদিভাই’এর পাশে
শোয়া নিয়ে মাঝে মাঝে ঝগড়াও বেধে যায়। মোটাসোটা অবিনাশ দুর্গা’কে বসায়
কিলচড়ও। ‘তুই যা’ ‘তুই যা’ বলে ধাক্কা দিতে দিতে তাড়িয়েও দেয় কোনোদিন।
তথাপি বিকালে, বড়জোর পরদিন সকালেই আবার আসে দুর্গা। না এলে অবিনাশ যায় ডাকতে।
বায়না ধরে ‘আলিবাবা আর চল্লিশ ডাকু’ খেলার।
‘ ‘আলিবাবা
আর চল্লিশ ডাকু’, সে এক আশ্চর্য খেলা। সামনের বারান্দায় পাতা আছে
কাঠের বেঞ্চি। তার নীচে ঢুকে বসে থাকতে হবে আলিবাবা হয়ে। সামনের পথ দিয়ে যতো মানুষ
যাবে হেঁটে এরা’ই ‘ডাকু’। চল্লিশ ডাকু। সাইকেল গেলে, রিক্সা গেলে ঐগুলি ডাকাতের ঘোড়া। ঐভাবে
গুন্তে হবে চল্লিশ ডাকু’কে। তবে অবিনাশের গোনার দৌড় যেহেতু দশ পার হয়নি
তাই অবিনাশ যখনি ঘোষনা করবে ‘চল্লিশ’ তখনি দু’জনকে বেড়িয়ে আসতে হবে গুপ্তস্থান থেকে। উঠানের
প্রান্তে, ঘোড়া নিমের তলায় গিয়ে বলতে হবে ‘চিচিং ফাঁক’। খুলে যাবে গুহার দরজা। গুহায় ঢুকে কুড়িয়ে নিতে
হবে ডাকাতদের জমা করা ধনদৌলত। তারপর ‘চিচিং বন্ধ্’ বলে গুহার
মুখ বন্ধ করে চলে আসতে হবে নিজেদের ঘোড়া নিয়ে।
এমনি আরো অসংখ্য আশ্চর্য খেলা
বানিয়ে বানিয়ে, খেলে খেলে কেটে যায় দিন। সন্ধ্যাবেলা, জেঠু বাড়ি এলে, দুর্গাকে বই
নিইয়ে বসতে হয় খানিক্ষন। অবিনাশ ঘুর্ ঘুর্ করতে থাকে আশেপাশে। কোনো কোনোদিন ঐ
সময়টা জেঠু অবিনাশকে গল্প শোনান। বারন্দায়। অন্ধকারে। ইজি চেয়ারে শুয়ে। সেসব গল্পে
রাজা-রাজরা থাকেনা, থাকেনা ভূত পেত্নী। সেসব গল্প একজন মানুষ দিয়ে শুরু হয়ে কোথায়
কোথায় যে চলে যায় অবিনাশ কিছু খেই রাখতে পারেনা। তবু শোনে আর তাকিয়ে দেখে উঠান পার
হয়ে অন্ধকার ছড়িয়ে পরেছে সামনের জলায়। জলা পার হয়ে প্রফেসর পাড়ায়। নিম্বার্ক
আশ্রমে বাজে আরতির ঘন্টা। সামনের রাস্তা দিয়ে একজন দুজন মানুষ হেঁটে যায়। কদাচিত
রিক্সা আসে। রিক্সার সামনের হ্যান্ডেলে জ্বলে কাঁচের ঢাকনা দেওয়া ছোট্ট কেরশিন
কূপী। উঠানের কোনার নিম গাছ থেকে পাতা ঝরে পরে বাতাসে। পড়া শেষ হওয়ামাত্র দুর্গা
ছুটে আসে গল্পের ভাগ নিতে। জেঠুর কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। কখনো কখনো সেখান থেকেও তাকে
ধাক্কা দিয়ে তাড়ায় অবিনাশ। দুর্গা’র মন খারাপ হয়। তবু মুখে বলেনা কিছু।
তবে দুর্গাকে
অবিনাশের সত্যিই হিংসা হয় যখন দুর্গা, ভোরবেলা, বাবু’র পাশে
বসে, বাবুর সঙ্গে গান করে। হারমোনিয়াম বাজায়। অবিনাশের হিংসা যেসব দিনে পরিণত হয়
রাগে সেসব দিনে বাবু’কে সে মারে। কামড়ে দেয়। থু থু ছেটায় হারমোনিয়ামে।
একদিনতো তার টিনের খেলনা পিস্তল দিয়ে মেরে কেটেই দিয়েছিল বাবুর হাত। হাতের শিরা
কেটে গড়িয়ে গড়িয়ে পরেছিল জমাট রক্ত। বাবুর শাদা গেঞ্জি, পাঞ্জাবী লাল হয়ে গিয়েছিল
রক্তে। কিসব পাতা ছেঁচে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবুও বন্ধ হয়নি
রক্তপাত। অনেকক্ষণ।
ঐ দিন বাবা এসেছিল। বাবা এসেই ছুটে
গিয়েছিল দোকানে। কি একটা মলম এনে লাগিয়ে দেওয়ামাত্র বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রক্ত।
৫।
বাবা থাকে করিমগঞ্জে। সঙ্গে
মা। ছোটোভাই। বাবা আসে। আসে মা। তবে দুটো
আসার রঙ দুই রকম। বাবা আসার সঙ্গে রোদের রঙ মিশে থাকে। মা’র আসার
সঙ্গে মেঘের। বাবা এলে খেলনা আসে। মা এলে আসে বই। আসে ছোটোভাই। অবিনাশের অসুখ। তাই
এখানে আছে।
পাব্লিক ইস্কুল রোডের রাস্তাটা যেখানে গিয়ে
মিলেছে বালগোপালের আখড়ার পথে ঐ মোড়ে একটা ছোটো বাড়িতে থাকেন ডাক্তারবাবু। একটা
কাঠের টেবিল ঘিরে অনেকগুলো আলমারি। আলমারি ভরা ছোটো ছোটো শিশি বোতল। মাঝে মাঝে
সন্ধ্যাবেলা জেঠু নাহলে বাবুর সঙ্গে হাত ধরে যাওয়া তাঁর কাছে।
একটা হলুদ বাল্ব জ্বলে। চেয়ারে বসে থাকেন ডাক্তারবাবু। উঠে দাঁড়ানোর পর প্রত্যেকবারই বোঝাগেলো
অবিনাশের মনেহয় ছাতে লেগে যাবে তাঁর মাথা। শাদা লম্বা দাড়ি গোঁফে মুখ প্রায় ঢাকা।
ঠিক যেন বইয়ে ছবি দেখা কোনো সাধু সন্ন্যিসি। অবিনাশ’কে তাঁর
টেবিলের উল্টোদিকে একটা চেয়ারে বসান ডাক্তারবাবু। বাবা,বাবু অথবা জেঠু যে’ই যান সঙ্গে বসেন ঘরের আরেক পাশে রাখা বেঞ্চিতে।
পেট টিপে দেখেনন ডাক্তারবাবু। টর্চ্চ
জ্বেলে জিহ্বা, চোখ। অনেকক্ষণ দেখার পর ওষুধ দেন।
ফিরে এসে দিদিভাই’কে দিতে
হয় চিকিৎসার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা।
বাবা আসে। আসে মা। তবে দুটো আসার রঙ দুই রকম। বাবা আসার সঙ্গে রোদের
রঙ মিশে থাকে। মা’র আসার সঙ্গে মেঘের। বাবা এলে খেলনা আসে। মা এলে
আসে বই। মা’র সঙ্গে সঙ্গে আসে এক অন্য আবহাওয়া। আনন্দের সঙ্গে ভীতি। ভীতির সঙ্গে
ঈর্ষা। ঈর্ষার সঙ্গে মন খারাপ। দিদিভাই বলেছেন অবিনাশের মা অবিনাশকে ভালোবাসেনা।
মা’র সব ভালবাসা অরূপের জন্য। দিদিভাই বলেন অবিনাশের ঠাকুমা’ও খুব
খারাপ। উনিও অবিনাশের বাবা’কে ভালবাসেননা মোটে। তাই বাবা’কে নিইয়ে
এসেছিলেন দিদিভাই। সেই ছোটোবেলায়। কখনো কখনো দুঃখ করে বলেনঃ তবুও আমাকে পিসীমা
ডাকে। ‘মা’ ডাকলোনা’।
এসব শুনে ভয় লাগে অবিনাশের। মনেহয় তবে কি
তাকেও তার বাবা’র মতো সব সময় থেকে যেতে হবে দিদিভাই’র সঙ্গে?
মা’র কাছে আর যেতেই পাবেনা? আবার ভাবে এ’ই ভালো।
মা’র কাছে গেলে মা যদি তাকে আদর না করে ...
অথচ মা এলে এসব ভাবনা যে যায় কোথায় হারিয়ে।
মা আনে বই। ঐ বই’এ থাকে গল্পঃ
‘ গৃহস্থের ঘরের পিছনে বেগুন গাছ আছে। সেই বেগুন
গাছের পাতা ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে টুনটুনি পাখিটি তার বাসা বেঁধেছে। বাসার ভিতরে
তিনটি ছোট্ট-ছোট্ট ছানা হয়েছে। খুব ছোট্ট ছানা, তারা উড়তে পারে
না, চোখও
মেলতে পারে না। খালি হাঁ করে আরে চীঁ-চীঁ করে। গৃহস্থের বিড়ালটা ভারি দুষ্টু। সে
খালি ভাবে 'টুনটুনির ছানা খাব।'একদিন সে বেগুন গাছের তলায় এসে বললে, 'কি করছিস লা
টুনটুনি? ...’
একদিন মা তাকে নিয়ে গেলো সিনেমা দেখাতে। গলীর মোড়ে। গোপীনাথ সিনেমা হলে। অন্ধকার
আর বিরাট বড় ঐ ছবিঘরে ঢুকেই শির্শির্ করে উঠলো বুক। আবছা আলোয় সাড় সাড় আসনে আবছা
অন্ধকার অবয়ব। তারপর ঐ আবছা আলোটুকুও নিভে গেলে মা’র হাত আঁকড়ে ধরলো অবিনাশ। পর্দায় ভেসে উঠতে লাগলো
অক্ষর। ছবি। গান। দেখা গেলো একটা বাচ্চা ছেলেকে। সে গান গাইতে পারে। মা’র কোলে বসে ঘুমিয়ে পরলো ছোটোভাই আর অবিনাশ
ভালোবেসে ফেল্লো ঐ বিরাট, অন্ধকার ছবিঘরকে ...
৬।
অবিনাশ ভালোবাসিয়া ফেলিল ঐ বিরাট, অন্ধকার
ছবিঘরকে। ভালোবাসিয়া ফেলিল বিরাটকে। অন্ধকারকে। ছবিকে। মফস্বলের রাত্রি, সেই
রাত্রির আকাশ, সেই আকাশের দিকে চাহিয়া চাহিয়া কথা ভাবা। ক্রমে কথাগুলিই যেন নেয়
ছবির অবয়ব। কে লিখিয়াছিলেন “ বিশাল
ছবিঘরে নিয়ে চল ক্ষুদ্র ভাড়াঘরে সহে না যে” ’? মনে
নাই। যেমন মনে নাই সেই ফেলিয়া আসা, পারাইয়া আসা শৈশবের অনেক কথা’ই। তবু সেই
মফস্বলি ছায়ার ঢাকা নিবিড় শৈশবকে কেন্দ্রে রাখিয়া অদ্যকার এই নগর জীবনকে ব্যাসার্ধ
লইয়া মনে মনে একটি বৃত্ত আঁকিতে গিয়ে সে টের পায় ‘বিরাট’ এই
শব্দটিকে।
তাহার মনেহয় বাবু’র কথা,
দিদিভাই’র কথা।
আপাত ভাবে এই পরিবারের কিছুই ছিলেননা তাঁহারা তথাপি তাঁহাদেরকে ঘিড়িয়াই বাঁচিয়া
উঠিল সে নিজে। কোন্ সুদূর সরাইল গ্রামের জমিদারপুত্র এই শিবেন্দ্র চক্রবর্তী
স্বদেশী করার অপরাধে পিতার বিরাগভাজন হইয়াছিলেন। চলিয়া আসিয়াছিলেন সামান্য দূরের
সম্পর্কের ভগ্নীপতির আশ্রয়ে। তারপর? তারপর ঐ ভগ্নীপতি’র কন্যাটিকেও একদিন ফিরিতে হইয়াছিল স্বামী
পরিত্যক্তা হইয়া। সে আগ্লাইয়া, আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিল কনিষ্ঠ ভ্রাতার সংসার। তারপর?
তারপর সে, এই অবিনাশ, অদ্য দন্ডায়মান সেই মফস্বলের পথেই। অথচ হারাইয়া গিয়াছে কতো
কিছু। বদলাইয়া গিয়াছজে কতো কিছু। ‘গোপীনাথ
সিনেমা হল্’ নাই।
জেঠু নাই। নাই সেই পুকুর। ছোটরানী’র বিবাহ
হইয়া গিয়াছে। বড়’ও।
জেঠিমনি সেই বাড়িটি আগ্লাইয়া একা আছেন।
মফস্বল শহর নিঝুম হইয়াছে অনেকক্ষণ। অবিনাশ তবু হাঁটিতেছে। যেন প্রেতাত্মা।
হাঁটিয়া হাঁটিয়া খুঁজিতেছে ছবি। মুখ। কিছু আসিতেছে মনে। কিছু যাইতেছে হারাইয়া। মনে
পড়িতেছে ‘হরি’ নামের সেই বৃদ্ধ’কে। সে জেঠুদের বাড়িতে আসিত। মাঝে মাঝে। তাহার
একচোখ ছিল কানা। আসিয়া নানা কাজ দিত করিয়া। উঠানের ঘাস কাটিত। মেরামত করিত বাঁশের
পুকুরঘাট। বিড়ি টানিত। বিড়ির ঘ্রানের সহিত সে’ই প্রথম পরিচয় করাইয়া দিয়াছিল অবিনাশকে। ক্রমে এক্কেবারেই অন্ধ হইয়া গিয়াছিল হরি।
তখনো আসিত। মাঝে সাজে। পয়সা চাহিতে। এক সময় বন্ধ হইল হরির আসা। হরি যেন গেলো
হারাইয়াই।
এক্ষনে, এই অন্ধকার সড়কে দাঁড়াইয়া অবিনাশের কেন যেন মনেহয় হরি’র সঙ্গে আবারো দেখা হইবে। কিন্তু কোথায় হইবে?
হইবে সেই ইষ্টিশান্টিতে যেখানে থামেনা কোনো রেলগাড়ি’ই, কেবলমাত্র সিগ্ন্যাল্ না পাইলে দাঁড়ায়
কিছুক্ষন, তেমনি কোনো ষ্টেশানে তাহার আবারো সাক্ষাৎ হইবে হরি’র সঙ্গে। হরি’কি তখনো অন্ধ থাকিবে না’কি ডাক্তার ডি.এন.ভট্টাচার্যের
চিকিৎসায় সে তখন ফিরিয়া পাইয়াছে তাহার দৃষ্টি? ... কেজানে ... তবু অবিনাশ
প্রতীক্ষা করে। প্রতীক্ষা করে হরি’র।
প্রতীক্ষা করে সেই বুজিয়া যাওয়া পুকুরটির। এই সকলের অভ্যন্তরে আরো কি এক প্রতীক্ষা
যেন তাহাকে ঘিড়িয়া ধরে।
এই
কথাগুলি, প্রতীক্ষাগুলি সে বলিতে পারেনা কাহাকেও। বলিতে চাহেনা কাহাকেও। তবে খোকা
আর খুকি’কে বলিতে
ইচ্ছা যায়। দেখাইতে ইচ্ছা যায়। তাহার মনেহয় ঐ সকল ছবিতে, গল্পে তাহার আর অধিকার
নাই। এই সকলি এখন ইহাদের। খোকার, খুকির। ঐ আইটি নগরে কে তাহাদিগকে ছায়া দিবে এমন
করিয়া যেমন ছায়া অবিনাশকে ঢালিয়া দিয়াছিল জেঠুদের পুকুর পাড়ের ঐ গাছগুলি? তাহাদের
শক্ত অসুখ হইলে ঐ সাধু-সন্ন্যাসী চেহারার ডাক্তারটি ভিন্ন কে আসিয়া অভয় দিবে? দিবে
নিরাময়?
তাহার
এই আইটিপ্রো জীবন, কক্টেল্ উইক্এন্ড্, পে-রোল্ জনিত মসৃণতার ভিতর হইতে হঠাৎ
হঠাৎ উঁকি দেয় মুখগুলি। দৃশ্যগুলি। সে অসহায় বোধ করে। সে বোধ করে তাহার সন্ততির
উত্তারাধিকার হইতে সে’ই বঞ্চিত
করিয়াছে তাহাদের। তাহাদের জীবনে আর বিরাট, অন্ধকার ‘ছবিঘ্র’ নাই।
যাহা আছে তাহার নাম শপিং মল্। আইনক্স্। মাল্টিপ্লেক্স্। সে পলাইতে চায়। খোকা ও
খুকিকে লইয়া সে পলাইয়া আসিয়া আশ্রয় চায় ঐ ছবি গুলির কাছে। ঐ মুখ গুলির কাছে ...
৭।
একদিন এক চোর ধরা পরলো। সে কি রকমের চোর, কি চুরি
করছিল, কোথায় চুরি করছিল কেজানে। একদল লোক তাকে ধরে রাস্তায় পেটাচ্ছিল বেধড়ক। জেঠু
বাড়ি আসছিলেন দুপুরে। টিফিনে। ভিড় দেখে জানতে চাইলেন কি ব্যাপার। কেউ পরিষ্কার
কিছু বলেনা। শুধু বলে ‘চোর’। জেঠু
বললেন ‘তে পুলিশ
ডাকো, তুমরা তারে পিটিয়া মারি
লাইতায় নি?’ জেঠু যেহেতু এই পাড়ার অনেকেরি ‘মাষ্টারমশাই’ ফলে
তাঁর কথা ফেলা গেলোনা একেবারে। জেঠু বললেন ‘পুলিশ আনো, এ থাকুক আমাদের বাড়িতে’। কিন্তু
যদি পালিয়ে যায়? ঠিক করা হলো ভেতরের দিকের উঠানে, কাপড় মেলার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে
রাখা হবে ওকে। ততোক্ষনে খবর দেওয়া হবে পুলিশে।
অবিনাশ ছিল ঘুমে। ঘুম
থেকে উঠে, উঠানে এসে, দেখতে পেলো মানুষটাকে। বাঁধা মানুষ সে দেখলো এই প্রথম। লোকটি
তাকালো তার চোখে। কি রকম সেই চাওয়া? ঐ পেছনের বাড়ির পাগল ছেলেটির মতো কি? না।
অন্যরকম। কি রকম? তবে কি রকম? ... লোকটি তাকে ডাকলো। মাথা নেড়ে ডাকলো।
ম্যাজিকগ্রস্থ পায়ে অবিনাশ এগিয়ে গেলো তার
কাছে। দুপুর তখন হেলে যাচ্ছে বিকালের দিকে। পুকুরপারে ছায়ার আলপনা। সদ্য ঘুম থেকে
উঠলে এই সময়টা খুব মন কারাপ লাগে। আজো লাগলো।
একটু কাছে যেতে লোকটি বল্লোঃ ‘একটু জল
খাওয়াও বাবা... গলা শুকাইগেছে’ ...
৮।
গলা শুকাইয়া গিয়াছে। অথচ কোথাও জল
নাই। জলাশয় নাই। হাঁটিতে হাঁটিতে চলিতে চলিতে শরীর অসার হইয়া আসে। দ্রৌপদী থামেন।
প্রথমে। একে একে নকুল, সহদেব, অর্জুন, ভীম, যুধিষ্ঠির’ও থামিয়া
যান। বৃক্ষতলে বিশ্রাম লওয়া স্থির হয়। কিন্তু জল ব্যতিরেকে বিশ্রামেও দূর হইবার নয়
শ্রান্তি। যুধিষ্ঠির আরোহন করেন বৃক্ষে। দূরে দেখাযায় এক বিরাট জলাশয়।
জল আনয়নে গমন করেন নকুল সহদেব। সময় যায়।
ইঁহারা ফিরেন না। অতঃপর অর্জুন যান ভ্রাতাদের সন্ধানে। ফিরিয়া আসেননা তিনিও। অতঃপর
ভীম .... তাঁহারো বিলম্ব হইলে, অবশেষে
জলাশয়ের নিকটে গিয়া উপস্থিত হন যুধিষ্ঠির স্বয়ং।
সম্মুখে বিপুল জলাশয়। পারাপারহীন। তাহার তীরে
ভ্রাতাদিগের প্রাণহীন দেহ গুলি শায়িত। শোকাকূল যুধিষ্ঠির যখন কিংকর্তব্য বিস্মৃত
তখনি শোনাগেলো বজ্র নির্ঘোষ কন্ঠঃ ‘হে যুধিষ্ঠির, আমি শৈবাল ও মৎস্যভোজী বক। যেহেতু
তোমার ভ্রাতাগন আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়াই জলপানে মতি হইয়াছিল অতএব আমি
উহাদিগকে সংহার করিয়াছি। হে যুধিষ্ঠির, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর প্রদানে সক্ষম
হইলে তবেই তুমি কেবল জল পানেই নহে তোমার মৃত ভ্রাতাদিগের জীবনদানেও সক্ষম হইবে।
কিন্তু উত্তর প্রদানে ব্যর্থ হইলে তোমার গতিও হইবে তোমার ভ্রাতা দিগের ন্যায়...’
মনেহয়
গ্রীষ্মকাল। মনেহয় শুক্লপক্ষ। কেননা পুকুরের দিকের জানালাটি ছিল খোলা। ছিল একটি
গোলাকার চাঁদ। জানালার ঠিক মাঝামাঝি। দিদিভাই’র গল্পের
আরম্ভে। গল্প যখন মধ্যপথে আসিয়াছিল চাঁদ জানালা পারাইয়া পাড়ি দিয়াছিল অন্যত্র।
অবিনাশ পড়িয়াছিল ঘুমাইয়া। ধর্ম বক ও যুধিষ্ঠিরের উপাখ্যানটি তাই বহুদিন থামিয়াছিল
ঐ পর্যন্ত আসিয়া। পরবর্তী পর্বের সূত্রপাত হইল এইভাবে, রাত্রে, খোকাকে মহাভারতের
গল্প শুনাইতে গিয়াঃ
যক্ষ বলিলেনঃ “ হে যুধিষ্ঠির, তবে বলো এই জগতে বার্তা কী?”
যুধিষ্ঠির বলিলেনঃ “মহা মোহ
রূপ কড়াই’এ প্রাণিসমূহ
কালের দ্বারা রন্ধিত হইতেছে। সূর্য্য ঐ ক্রিয়ার অগ্নি। রাত্রিদিন ইহার ইন্ধন। মাস-ঋতু-ইহার হাতা। এই বার্তা”।
যক্ষ বলিলেনঃ “হে যুধিষ্ঠির, বলো এই জগতে আশ্চর্য্য কী?”
যুধিষ্ঠির বলিলেনঃ “ অহনি অহনি ভূতানি গচ্ছন্তি যম মন্দিরম্ ... শেষাঃ স্থিরত্বম্ ইচ্ছন্তি
... কিম্ আশ্চর্যম্ অতঃপরম্?””
যক্ষ বলিলেনঃ “ হে যুধিষ্ঠির, তোমার উত্তরে আমি মুগ্ধ।
এইবার আমার অন্তিম প্রশ্নটির উত্তর দাও।
বলো এই জগতে সুখী কে?”
যুধিষ্ঠির বলিলেনঃ “ হে যক্ষ, যে মানুষ অঋণী,
অপ্রবাসী, যে মানুষ নিজ সামর্থ্যে দিনান্তে শাকান্ন ভক্ষণে সক্ষম, তিনিই সুখী...”
অবিনাশের কানে বাজিয়া উঠে দেবব্রত
সোমের কন্ঠস্বর। মনেপড়ে জীবনের সেই ‘সবুজ-করুণ’ অধ্যায় যখন বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার মতন গান, মূলতঃ
রবীন্দ্রসঙ্গীত ঢুকিয়া পরিতেছে অস্তিত্বের
আনাচে কানাচে। প্রথমবারের মতো নিজের গহনে জাগিয়া উঠিতেছে ছে আরেক ‘আমি’ ... সেই ‘আমি’র অতলে মুহুর্মুহু ভাঙ্গিতেছে,গড়িতেছে আরেক পৃথিবী। সেই আরেক পৃথিবীর আরেক আলোয়, আরেক অন্ধকারে নতুন
অবয়ব লইয়া জাগিয়া উঠিতেছে মফস্বলের প্রতিটি নদী-নালা-খাল-বিল-ইস্কুলঘর-বাঁশঝাড়-প্রতিটি চেনামুখ-অচেনা
মেঘমালা ... সেই ক্লাশ এইট-নাইনের দিনগুলি ... সেই যেখানে জীবনের সমস্ত শরৎকাল শিউলী হইয়া আজো ছড়াইয়া রহিয়াছে ঘাসে ঘাসে ...
শীত বাতাসে
উড়িতেছে জানালার নীল পর্দ্দাগুলি। শান্ত, নিরিবিলি পাড়াটির প্রশান্তির
ভিতর মাঝে মধ্যে বাজিয়া উঠিতেছে সাইকেলের টিং টিং। ঐ রাস্তায়, ঐ সময় খুব বেশী রিক্সাও চলাচল করিত না। ‘গুরুগৃহ’ বলিতে অবিনাশের চোখে অদ্যাপি যাহা ভাসিয়া ওঠে তাহা দেবব্রত সোম স্যারের ঐ বাড়িটি। ইংরেজি ‘এল’ এর আকৃতির বারান্দার এক দিকে
তাহাদের পড়িবার কোঠা। অন্যদিকে তাঁহার ছেলে দীপুদা’র কোঠা। পড়ার কোঠার লাগোয়া স্যারের কোঠা। ভিতরের দিকে আরো
কয়েকটি কোঠা। টানা বারান্দা। সামনে ছোট্ট উঠান। সকালে বিকালে পড়ুয়াদের নানা রকমের
সাইকেলে ভরা। তারপর রাস্তা। রাস্তার পাশে বড় নালা। নালার ঐ পারে নাম না জানা
গুল্মের আব্ডালে আরেক পাড়া। তাহাদের পুকুরপার। অবিনাশদের পায়ে চলার পথ। শর্ট-কাট্। উড়িতে থাকা পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে
পর্দ্দার ফাঁক দি্যা, নামহীন গুল্মের বেড়ার আড়াল দিয়া
চুঁইয়াইয়া আসা আকাশের দিকে খানিক্ষন
চাহিয়া থাকিতেন স্যার। তখন অনুভব হইতো অবয়বটি থাকিলেও তিনি আর নাই এইখানে। বছর
সত্তরের রোগা চেহারার মানুষটির আশ্চর্য দুই চোখে
কি’যে তখন যাইত ছায়া ফেলিয়া কেজানে ...কিছুক্ষন পর যেন সম্বিৎ
ফিরিত তাঁহার। নড়িয়া চড়িয়া বসিয়া বলিতেনঃ ‘ কিতা কইস্লাম তোরারে? ...’
ঐ সময় অবিনাশের ঝোঁক চাপিয়াছিল যে সে রবীন্দ্রগান ইংরেজিতে অনুবাদ করিবে। করিয়াও
ছিল বেশ কিছু। আনিয়া দেখাইয়া ছিল দেবব্রত সোম’কে। পিঠ চাপ্ড়াইয়া দিয়াছিলেন স্যার ফলে সে রোজই কিছু না কিছু রবীন্দ্রগান অনুবাদ করিয়া আনিয়া দেখাইতে লাগিল
তাঁহাকে। উত্তেজিত হইতেছেন স্যার। বলিতেছেন ‘ “তুই জিনিয়াস্, তুই ইংরেজিত গোল্ড মেডেল পাইবে’” ... তারপর হঠাৎ একদিন বলিলেনঃ ‘ ‘তুই লিখতে পারস্। লেখাটা তোর হইব।
নিজের মনের ভাব নিজের মতো করিয়া, কবিতায় হউক্, গইদ্যে হইক্। সবে লেখতো পারেনা।
অটা একতা ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা। তুই লেখ। যে’উ যেতা কউক্, লেখাটা কুনোদিন ছাড়িছ্না।
কিন্তু ইংরেজিতে না। অতা ট্রেনশ্লেশন অতা কর্। অতা ভালাউ হর। কিন্তু অতা ইংরেজি
শিখার লেগিয়া। যতো ভাষা পারস্ শিখ। ভালামতে শিখ। কিন্তু সাহিত্যটা করবে নিজর
ভাষায়।ই কথাটা মধুসূদনের মতো ক্ষণজন্মায় ও কম বয়সে বুচ্ছিলা না ...’ বলে নিয়েই গড়
গড় করে আবৃত্তি করে গেলেনঃ
আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু,হায়,
তাই ভাবী মনে?
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে?
দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন ,—
তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!
রে প্রমত্ত মন মম! কবে পোহাইবে রাতি?
জাগিবি রে কবে?
জীবন-উদ্যানে তোর যৌবন-কুসুম-ভাতি
কত দিন রবে?
তাই ভাবী মনে?
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে?
দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন ,—
তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!
রে প্রমত্ত মন মম! কবে পোহাইবে রাতি?
জাগিবি রে কবে?
জীবন-উদ্যানে তোর যৌবন-কুসুম-ভাতি
কত দিন রবে?
পড়ানো শেষ হইয়া গেলেও এমনি গল্পের টানে, কবিতার টানে অবিনাশ বসিয়া
থাকিত তাঁহার কাছে। ঐ রকম একটি দিনেই স্যার বলিয়াছিলেন এই শ্লোকটিঃ ‘দিবসস্য অষ্টমে ভাগে শাকং পচতি যো নরঃ ... অঋণী চ অপ্রবাসী
চ বারিচর মোদতে...”
৯।
অবিনাশের ভাবনার পুকুরে যেন
ডিল পরে। এক সঙ্গে অনেকগুলি ঢিল। সমস্ত এলোমেলো হইয়া যায়। যায় তালগোল পাকাইয়া।
কোথায় বা বাপের পিসীর মুখে বার্ধক্য রেখার সেই কিলবিল, কোথায় বা কালী সিংগী’র মহাভারত, বাবার আলমারি হইতে বাহির করিয়া লইয়া সেই
প্রথমবার পাঠ, কোথায় বা সেই দেবব্রত সোম, সেইসব সকাল-সন্ধ্যা-দিনরাত্রি – ঐ হলুদ আবহ হারাইয়াছে। বুজিয়াছে সেই পুকুর। মরিয়াছে বাংলার
ডাকাইতেরা। মরিয়াছে রঘু ডাকাত। নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে নিশ্চয়ই মহাভারতও নতুবা
অদ্যকার যক্ষের প্রশ্ন গুলির উত্তরে এমন সব অদ্ভুত কথাগুলি বলিবে কেন যুধিষ্ঠির? নিঝঝুম্ রাত্রির ভিতর দিয়া একা একা হাঁটিয়া
যাইতে যাইতে অবিনাশ যেন শুনিতে পায় যক্ষ বলিলেনঃ
“ হে যুধিষ্ঠির, তবে বলো এই জগতে বার্তা কী?”
যুধিষ্ঠির বলিলেনঃ “ ফেইস্ বুক্। যাও, উইক্ এন্ডে কোনো আজীব
জায়গায় গিয়া ঘুড়িয়া আসো। সঙ্গে ক্যামেরা লইয়ো। ফটো খিঁচিও। নিজেদের মধ্যে
চুলাচুলির মুহুর্ত্তে নহে। চুলাচুলি অন্তে ফেয়ার এন্ড লাভ্লী হাসি মাখাইয়া। মিনিট
দশের জন্য। অতঃপর দিয়ো ফেইস্বুকে আপ্লোড্ করিয়া। অতঃপর গণিয়া লইয়ো কতো জন উহা ‘লাইক্’ করিল। ইহাই আজিকার
বার্ত্তা। ... ফেইস্ বুক গিয়া কেইস্ বুক্ আসিবে। কেইস্ বুকের পরিবর্তে আসিবে
অন্য কিছু। কিন্তু বার্তা একই থাকিবে। জমি, জঙ্গল কাটিয়া মল্ উঠিবে, ফ্ল্যাট্
উঠিবে। ‘স্পেস্’ কমিবে। সাইবার স্পেস্’ই হইবে আপনতর। ... এই বার্তা’।
যক্ষ খুশি হইলেন। গেলাসে
আরো একটু হুইস্কী ঢালিয়া বলিলেনঃ “হে যুধিষ্ঠির, এইবার বলো,
এই জগতে আশ্চর্য্য কি?”
যুধিষ্ঠির বলিলেনঃ “ আশ্চর্য এই যে , যদিও ইহা
প্রমাণিত যে প্রযুক্তির বলে প্রগতি এখন সর্বত্র , অনতিকালের মধ্যেই ‘উইঙ্গস্ অফ্ ফায়ার’এ চাপিয়া সারা পৃথিবীর লোক মঙ্গলে যাইবে পিক্নিক্ করিতে তথাপি মূর্খেরা
বলিয়া বেড়ায় পৃথিবীতে অনাহার আছে, আছে উষ্ণ ও শীতল প্রবাহে মৃত্যু!”
যক্ষ বিরাট ফুর্ত্তি
পাইলেন। যুধিষ্ঠিরের দিকে গেলাস ও বোতল আগাইয়া দিয়া বলিলেনঃ “ হে যুধিষ্ঠির,
তোমার উত্তরে আমি মুগ্ধ। ত্রেতা, দ্বাপর ইত্যাদি যুগে তোমার মগজ ততোটা খোলে নাই
যতোটা খুলিয়াছে এই কলি যুগে। এইবার আমার অন্তিম
প্রশ্নটির উত্তর দাও। বলো এই জগতে সুখী কে?”
যুধিষ্ঠির বলিলেনঃ “যে, যাহারা, আমেরিকা না
হোক্, অন্ততঃ বেংগালোরে থাকে এবং থাকিয়া যাহারা আইটি’তে চাকুরি করে এবং উহাদের মধ্যে যাহাদের সিটিসি টোটেল্
ইয়ার্স অফ এক্স্পিরিয়েন্সের ডবল্ বা কিছু বেশী। যাহাদের আইপড্ আছে, এপ্লের
ল্যাপ্টপ্ আছে, যাহাদের ইন্সিওরেন্স করা আছে...”
কিন্তু এই যুধিষ্ঠিরকে তো অবিনাশ জানেনা। সে’ত সে’ই সর্বত্যাগী যুধিষ্ঠিরের
সন্ধানই দিতে চায় খোকাকে, খুকিকে। ঐ জন্যইতো সে তাহাদের লইয়া আসিয়াছে এই মফস্বলে।
চিরতরে না হোক্ অন্ততঃ দেখাইয়া লইয়া যাইতে আসিয়াছে ঐ পুকুর, ঐ ছবিগুলি, ঐ মুখগুলি
... কিন্তু ঐ যুধিষ্ঠিরই যদি লুপ্ত হইয়া গিয়া থাকে তবে সে এইখানে কেন আসিল? কেন
আনিল খোকা খুকি’দের? ... একদা যেখানে
রাঙ্গিরখাঁড়ি বাজার ছিল, অধুনা যেখানে উঠিয়াছে ফ্ল্যাট বাড়ি, সেইখানে, কালভার্টে
দাঁড়াইয়া, আকাশের দিকে চাহিয়া তাহার মনে পড়িতে লাগিল পংক্তিগুলিঃ
কখন সোনার রোদ নিভে গেছে — অবিরল
শুপুরির সারি
আঁধারে যেতেছে ডুবে — প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস
ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ অন্ধকার ফেলিতেছে শ্বাস;
কোন চৈত্রে চলে গেছে সেই মেয়ে — আসিবে না করে গেছে আড়ি :
ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি
কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে তাহার শরীর থেকে শ্বাস
ঝরে গেছে বলে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ,
কোথাও সে নাই আর — পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি?
আঁধারে যেতেছে ডুবে — প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস
ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ অন্ধকার ফেলিতেছে শ্বাস;
কোন চৈত্রে চলে গেছে সেই মেয়ে — আসিবে না করে গেছে আড়ি :
ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি
কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে তাহার শরীর থেকে শ্বাস
ঝরে গেছে বলে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ,
কোথাও সে নাই আর — পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি?
১০।
নাই। থাকিবেনা। হয়তো কিছুই
থাকিবেনা। হয়তো থাকিবেনা কখনো যে কিছু ছিল সেই চিহ্নটুকুও। অতএব মুছিয়া যাইবে সেই
অভাববোধ টুকুও যাহার নিরিখে মানুষের সহিত অমানুষের তফাৎ করা সম্ভব হইতে পারে। তবে
মনেহয় ইহাতে জনতার জীবন সুখের হইবে। সংজ্ঞা থাকিবে হয়তো। কিন্তু উদাহরণ থাকিবে না।
ফলে মর্মে থাকবেনা কোনো কর্তব্যবোধ, অপরাধবোধ। জমি বেচিয়া, বাড়ি বেচিয়া, রূপ
বেচিয়া, প্রেম-প্রীতি সকলি বেচিয়া যাহারা সক্ষম তাহারা আমেরিকা যাইবে। অন্ততঃ পক্ষে আসিবে বেঙ্গালোর।
যাহারা অক্ষম তাহারা ক্রমে যাইবে নিশ্চিহ্ন হইয়া ...
এইবার ‘ ‘অক্ষম’’ শব্দটি দখল করিয়া লয়
অবিনাশের চেতনা। এ’কি কেবলি অর্থনৈতিক অক্ষমতা
না’কি আরো কিছু? যদি কেহ না
চায় এইভাবে পলাইতে? টিঁকিয়া থাকিতে এইভাবে? যদি কেহ চায় অপর কোনো আশ্রয়, যেমন সে
নিজে চাহিতেছে, তবে? যদি খোকা কিংবা খুকি কিংবা উভয়েই, যেহেতু অবিনাশের জিন্
রহিয়াছে তাহাদের গহনেও, একদিন চায় ঐ আইটি নগর হইতে, ঐ সিকিওর্ড্-ইন্সিয়র্ড্
বধ্যভূমি হইতে মুক্তি পাইতে? তবে? তবে কোথায় গিয়া দাঁড়াইবে তাহারা? কোথায় গিয়া
দাঁড়াইতে চাহে অবিনাশ নিজে?
নিজেকে এই প্রশ্ন করিয়া সে বার বারই পায়
একই জবাব সে আসিয়া দাঁড়াইবে এইখানেই। এই পুকুরের পারে, এই ঝোপ জংলার দেশে ...
তখনি আবার শোনা যায় যক্ষের
স্বরঃ ‘পুকুর কোথায় দেখলে হে? সে
তো কবে মরে হেজে গেছে। দেখছোনা এখন সেখানে বাড়ি করেছে চোরা কারবারি রতন দাস।
রাত্রে খুলে রাখে দু দুটো ভয়ংকর ডোবারম্যান্ ...’
অবিনাশ বলেঃ ‘সে’ তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু আপনি কি দেখেছেন একটা জিনিস?”
যক্ষ বলেনঃ ‘কী’?
অবিনাশ বলেঃ ‘ কবরখানা, গোরস্থান”?
যক্ষ বলেনঃ ‘হাসালে। সে আর দেখবো না! কিন্তু কেন বলোতো?’
অবিনাশ বলেঃ ‘ আপনি দেখেছেন কত মানুষ ফুল নিয়ে, মোমবাতি নিয়ে বা স্রেফ
নিজেকে নিইয়ে এসে বসে থাকে তাদের প্রিয়জনের কবরে?’
যক্ষ বলেনঃ ‘দেখেছি’
অবিনাশ বলেঃ ‘ কেন বসে থাকে বলতে পারেন?’
যক্ষ বলেনঃ ‘ কেন?’
অবিনাশ বলেঃ ‘শান্তি পায়। আশ্রয় পায়। ঐ কবরের, গোরস্থানের বাতাসে তার
কাছে ফিরে আসে সেই বিলুপ্ত মানুষ, সেই বিলুপ্ত সময়। তখন ঐ জ্যান্ত মানুষটা গাছ হয়ে
যায়। তার শরীরে জন্ম নেয় ক্লোরোফিল। ঐ ক্লোরোফিল্ এই আলো-বাতাস শুষে নিয়ে তৈরী
করে তার খাদ্য। তার বেঁচে থাকার সম্বল ... এ’ই যে আমি, এইযে দাঁড়িয়ে আছি এখানে, অন্ধকারে, সে’ও তো এমনি একটি কবরই, গোরস্থানই। তবুওতো শান্তি পাচ্ছি।
পাচ্ছি সাহস। ... কিন্তু আমার সন্ততিদের জন্য কি থাকবে এমন একটি কবরস্থানও’?
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া যক্ষ
বলেনঃ ‘হে যুধিষ্ঠির, তবে বলো, বার্তা কি?’
যুধিষ্ঠির বলেঃ এসেছে
আদেশ, বন্দরে বন্ধনকাল এবারের মতো হল শেষ ,পুরানো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে শুধু বেচাকেনা,আর চলিবে না ।
বঞ্চনা
বাড়িয়া ওঠে ,ফুরায় সত্যের যত পুঁজি ,কাণ্ডারী ডাকিছে তাই বুঝি –তুফানের
মাঝখানে নূতন
সমুদ্রতীর - পানে দিতে হবে
পাড়ি ...’
যক্ষ বলেনঃ “হে যুধিষ্ঠির, এইবার বলো,
এই জগতে আশ্চর্য্য কি?”
অবিনাশ বলেঃ ‘হে
নির্ভীক , দুঃখ অভিহত , ওরে ভাই ,কার নিন্দা কর তুমি ? মাথা
করো নত ।এ আমার এ তোমার পাপ ...’
যক্ষ বলিলেনঃ “ হে যুধিষ্ঠির, বলো
এই জগতে সুখী কে?”
যদিও এই সময়টায় এই অঞ্চলে
নামে ঘোর বর্ষা তবু গত কয়েকদিন বৃষ্টি হয়নাই। এইমাত্র একটি বৃষ্টির ফোঁটা আসিয়া
নামিল অবিনাশের হাতের চামড়ায়। ঝরিল আরো এক ফোঁটা। আরো। আরো। আরো ... এইবার বৃষ্টি
নামিল মুষলধারে। আপনার বেসুরা, হেঁড়ে গলাকেই সম্বল করিয়া সে গাহিয়া উঠিলঃ ‘সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি, দুঃখে তোমায় পেয়েছি, পেয়েছি প্রাণ
ভরে ..সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি ...’
বৃষ্টি মাথায় লইয়া হাটিয়া
চলিল অবিনাশ। চলিতে চলিতে টের পাইলো তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে সেই নাছোড় যক্ষও।
তখন, গানের আবডালে, সে যক্ষকে বলিল, বলিতে লাগিলঃ ‘ হে যক্ষ, সুখী কে আমি জানিনা তবে জানি দুঃখী কে। যার কোনো
স্মৃতি নেই, যার স্মৃতির অতলে নেই কোনো ‘রেইন্ ট্রী’ যা বৃষ্টি থামার পরেও তার
জন্য বুকে করে রাখে সেই বর্ষণ, সে’ই দুঃখী। হে যক্ষ, আমার
সন্ততিরা যদি বেছে নেয় দুঃখী হওয়ার পথ তাহলে কেউ তাদের পারবেনা আটকাতে। তবু আমি,
পিতা হিসাবে নিজের কর্তব্য করে যাবো। ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো এই কবরখানা’র সমস্ত কবরের। পড়ে শোনাবো পাথরের ফলকে লেখা কাহিনী গুলি।
প্রতিটি কবরের শিয়রে দাঁড়ানো গাছেদের নীচে এসে দাঁড়াবো তাদের নিয়ে। বলবো আশ্রয় দাও
... হে যক্ষ, আমি সুখী নই। জানি আমার সন্ততিরাও পারবেনা কোনোদিন সুখী হতে। তবু
সুখের পথটি আজ আমি তাদের চিনিয়ে দিতেই এসেছি এখানে, এ দেশে, সঙ্গে করে নিইয়ে এসেছি
তাদের ... হে যক্ষ, আশীর্বাদ করো, সুখী না হই, আমার এই বাঞ্ছা যেন পূর্ণ হয়...’
যক্ষ বলিলেনঃ ‘ তথাস্তু’।
অবিনাশ তখন গাহিতেছিলঃ ‘চির জীবন আমার বীণা তারে, তোমার আঘাত, লাগলো আঘাত, লাগলো
বারে বারে ... তাইতো আমার নানা সুরের গানে প্রাণে তোমার পরশ নিলেম বুকে ভরে ...’
।। পর্ব্ব দুই।।
১।
যদিও ঘড়ির কাঁটায় রাত এগারোটা বেজে
পনেরো মিনিট তবু মফস্বলের পথে ঘাটে মধ্যরাত। তার মধ্যে আমাদের বাড়িটা যেহেতু
মফস্বলেরো সীমান্তে তাই সমস্ত নিঝুম হয়ে যায় আরো তাড়াতাড়ি। আমাদের ছোটোবেলা থেকে
অনেকদিন পর্যন্ত এটা ছিল কাঠের পুল। বছর দশ আগে সিমেন্টের ‘ব্রীজ’এর সম্মান পেয়েছে। ব্রীজের
ঐপারে লঙ্গাই বাজার। গতবার থেকে দেখছি এই পারেও বসছে বাজার। শব্জী বাজার। মাছ
বাজার এখনো একচেটিয়া ঐপারেই।
আকাশে মেঘ। টাল মাটাল হাওয়া
বইছে। বৃষ্টি নামতে পারে যে কোনো মুহুর্তে। এমনিতেও এদিকটাতে পথে ঘাটে বা কারোর
বাড়িতেও আলো খুব একটা থাকেনা। তার মধ্যে লোডশেডিং এর জন্য গোটা অঞ্চল ডুবে আছে
নিঝুম অন্ধকারে। নদীর শরীর থেকে উঠে আসছে জলের ঘ্রাণ, ঢেউ’এর ছলাৎছল।
ইন্দ্রনীল বল্লোঃ ‘আজকে বাজারো দীপকের সঙ্গে দেখা হইসিল। কইলাম তুই আইসস্।
কইলো একদিন লইয়া আইতাম’।
আমি বল্লামঃ ‘হুঁ, যাইবার ইচ্ছা’ত আমারো আসিল, কিন্তু হাতো’ত আর মাত্র দুই দিন...’
সিদ্ধার্থ চম্কে উঠলো যেন।
‘দুই দিন? দুই সপ্তাহ এর মইধ্যে শেষ হইগেলো????’
দুই সপ্তাহের ফুরিয়ে যাওয়ার, ফুরিয়ে আসার
বাস্তবতাটা আমাকেও যেন তখনি চেপে ধরলো প্রথম বারের জন্য। দুই সপ্তাহ সত্যি ফুরিয়ে
গেলো তাহলে! রঞ্জুদা’র সঙ্গে দেখা করা হলোনা।
বাবু’দার সঙ্গে একদিন পথে দেখা
হলো শুধু। আড্ডা দেওয়া হলোনা। তনুদা’দের বাড়িতে বৌ বাচ্চা সমেত
যাওয়ার কথা ছিল। হলোনা। বৌ বাচ্চা সমেত কিশোরদা’র বাড়িতে কাটানোর কথা ছিল একরাত। হলোনা। ভেবেছিলাম খোকা’কে নিয়ে নৌকা চরে যাবো কর্ণমধু গ্রামে। হলোনা। দেবব্রত
সোমের বাড়িটা’ও এবার দেখে আসা হলোনা।
দীপক, কল্লোল, বিষ্ণু – এদের কারোর সাথে দেখা করা
হলোনা। ইস্কুলে গিয়ে দেখা করে আসা হলোনা জলিল স্যারের সঙ্গে... তবুও ছুটি ফুরিয়ে
এলো!
সিদ্ধার্থ বল্লোঃ ‘ নেক্সট্ কবে আওয়ার প্লেন?’
ইন্দ্রনীল বল্লোঃ ‘পূজাত আওয়ার একটা ট্রাই মার্ ইবার...’
টের পেলাম ঐ ছুটি ফুরিয়ে
যাওয়ার ভাবনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত
হচ্ছে তাদেরো চিন্তা প্রবাহ। তাদের প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিলোনা আমার কাছে। তাই চুপ
করে ব্রীজের রেলিঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে লাগলাম। এই ‘ব্রীজ’ যখন ‘কাঠের পুল’ ছিল তখন থেকেই এ আমাদের
নৈশ আড্ডার স্থান। যখন এগারোটার বেশী দেরী করে বাড়ি ফেরার নিয়ন ছিলোনা তখনো, রাতে,
বাবা বা খেয়ে দেয়ে বিছানায় উঠে গেলে দেওয়াল ডিঙ্গিয়ে আসতাম বারহয়ে। ছোটোভাই খুলে
রাখতো দরজা।
সিদ্ধার্থ’র শোয়ার কোঠায় ছিল গরাদহীন জানালা। বিশাল বপু হলেই কি করে
যেন সে নিজেকে গলিয়ে নিতো ঐ জানালা দিয়ে। ইন্দ্রনীলের কাছে থাকতো তাদের বাড়ির
চাবি। মা বাপ’কে ঘুম পাড়িয়ে তালা বন্ধ করে সে চলে আসতো। ছোটো বোন নোয়া’র জানানো ছিল বাবা কিংবা মা কোনো কারনে মাঝরাতে উঠলে তাঁদের
বলতে হবে ‘ নরেশ সোম খুব অসুস্থ। দাদা’কে ওদের বাড়ি থেকে এসে ডেকে নিইয়ে গেছে’।
ক্রমে
ঐ ফাঁড়ির পুলিশেরো জানা হয়ে গিয়েছিল যে এরা এখানে এসে জুটবে প্রতি রাতেই প্রায়।
আড্ডা দেবে। সিগারেট টানবে। বৃষ্টি বাদল এলে গিয়ে দাঁড়াবে নদীর পাড়ে, শ্মশান
কালীবাড়ির বারান্দায়। পুলিশের যেটা জানা ছিলোনা তা হল শুধু বৃষ্টি বা শীতের হাত
থেকে বাঁচার প্রয়োজনে নয় আমরা ঐ মন্দিরে মাঝে মাঝে যেতাম বসে গাঁজা টানতেও।
সিদ্ধার্থ যদিও ঐ সমস্ত রসে নিজগুনে অদ্যাপি বঞ্চিত তবে সঙ্গ দেওয়ার ব্যাপারের তার
বদান্যতা অনন্য।
এখনো বাড়ি এলে ঐ ‘কাঠের পুল’এ রাতের আড্ডা আমাদের
নৈমিত্তিক প্রয়োজন। এমনিতে না এলেও আমি এলে আমার ছোটভাই’ও কোনো কোনো দিন এসে সামিল হয় এই আড্ডায়। দিনের বেলা
সিদ্ধার্থ, ইন্দ্রনীল আমাকে যথাসম্ভব সময় দিলেও যেহেতু তাদের ‘ছুটি’ নয় তাই এক সময় ওদের যেতেই
হয়। তবে রাত্রি আট’টার পরে প্রথমে এসে একজোট
হওয়া যায় সেটেল্মেন্ট্ রোদে। আব্দুল’এর চা আর তেলেভাজা’র দোকানে। তারপর দফায় দফায় আড্ডা সেড়ে শেষ ষ্টেশান এই ‘কাঠের পুল’।
নেহাৎই যখন বাড়ি না ফিরলে নয় কাঠের পুল’ থেকে নেমে আসি আমরা। সিদ্ধার্থ’কে আর যেতে দেওয়া হয়না বাড়ি কেননা সেই একমাত্র ব্যাচেলার। অন্ততঃ
বিছানায় কেউ বা কারা নেই তার অপেক্ষায়।
সিদ্ধার্থ’কে নিয়ে বাড়ি ফিরে আরেক দফা
আড্ডা চলে প্রায় ভোর অব্দি। এরপর, চোখ যখন আর যায়না খুলে রাখা সিদ্ধার্থ আস্তানা
নেয় আমার ছোটো ভাই’এর কোঠায়। সে’ও আরেক ব্যাচেলার। কাজেই বিছানা ভাগাভাগির ব্যাপারে সে’ও অদ্যাপি স্বাধীন।
আমি এসে শুয়ে পরি বউ আর
খোকা খুকি’র কিনারে।
২।
শেষবার বাড়ি এসেছিলাম প্রায় তিন বছর আগে।
খুকি তখন মাস ছয়ে’র। খোকা ছয় থেকে সাতে পা
দিয়েছে সদ্য। এখানে এসে ওর একটাই ছিল অভিযোগ ‘আমার সমান কেউ এখানে নেই কেন’। ফলে ‘সমান’ হয়ে খোকা’কে সঙ্গ দিয়েছে আমার
ছোটোভাই। দিয়েছে ইন্দ্রনীল, সিদ্ধার্থ। আমি সঙ্গে করে নিয়ে গেছি যখনি গেছি যেখানে।
দেখিয়েছি সরল খাঁ’র দীঘি। বলেছি সরল খাঁ’র গল্প । বলেছি দুপুরের পরে দুপুর, রাতের পর রাত আমরা যে
কাটিয়েছি ঐ বিশাল দীঘি’র কিনারে বসে। খোকা বলেছেঃ ‘তবু ভূতটাকে দেখোনি?” –
‘ভূত’ মানে সরল খাঁ’র ভূত। সরল খাঁ মানে যে
মানুষটি তাঁর সরলতার জন্য পেয়েছিলেন এই নাম। তাঁর আসল নাম আজ আর কেউ জানেনা। তাঁরই
সম্পত্তি এই সব। এই পারাপারহীন দীঘি যা এখন পুরোটাই ঢেকে গেছে কচুরীপানায়। তারি
কিনারে, বক্র রেখার ইঙ্গিতে যে পায়ে চলার পথ, তার ঐ পাড়ে,বয়সের গাছপাথরহীন একটি বট
গাছের তলায় ঘুমাচ্ছেন সরল খাঁ। কবর-শয্যা’র দেওয়ালে ধরেছে ফাটল। তা দিয়ে যাতায়াত করে সাপ। বেজী। নামহীন গুল্মে ঢেকে আছে
কবর-শয্যার চারপাশ। শোনাযায় কখনো মধ্যরাতে নাকি সরল খাঁ উঠে আসেন তাঁর দীঘি দেখভাল
করতে। না, তাঁর সামনে পড়লে বিপত্তি ঘটেনা কিছু। জীবদ্দশায়ো ছিলেন যেমন লাজুক, সরল,
মুখচোরা, পরলোকেও থেকে গিয়েছেন সে রকমই। মানুষের সামনে পরলে তিনি তখুনি মিলিয়ে যান
হাওয়ায়, কুয়াশায়, অন্ধকারে।
সরল খাঁ’র কবর পার হয়ে ধান ক্ষতের দিকে যাওয়ার পথে পড়ে দুটো
পাশাপাশি লাটিম ফুলের গাছ। ঐ জোড়া গাছের তলায় আমরা বসে থাকতাম ইস্কুল পালিয়ে। পরে
কলেজ পালিয়ে। দুপুরবেলা। অনেক সন্ধ্যা, রাত্রিও কেটেছে এখানে বসে। সিদ্ধার্থ গান
করতো। কখনো গলা মেলাতো ইন্দ্রনীল। আমার গলা মেলানো ছিল বারন। আমি গাইলে না’কি তাদের সুর তাল সব ভুল হয়েযায় ...
খোকাকে নিয়ে ঘুড়ে বেড়িয়েছি ঐ দীঘির পাড়ে পাড়ে।
আমোদ পেয়েছে খোকা। ভয়ও পেয়েছে,
বাঁশ ঝাড়ের ছায়ায় বসে গল্প
শুনতে বার বার তাকিয়েছে পেছনে। ঐ বছর এসেছিলাম শীতে। পাতা
ঝরার মরশুমে। গাছের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাতার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের
শব্দকে সে ভেবে নিয়েছে সরল খাঁ’র পদধ্বনি।
ওকে নিইয়ে গিয়ে দেখিয়ে এনেছি আমার
ইস্কুল। পাঠশালা। আমার মাষ্টার মশাই আর দিদিমনিদের মধ্যে যাঁরা এখনো রিটায়ার
করেননি তাদের সবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। বাড়ি এসে চোখ বড় বড় করে, হাত পা নেড়ে
শুনিয়েছে সেসব গল্পও। কিন্তু যখনি একটু একা হয়েছে, ফাঁকা হয়েছে অমনি বহাল রয়েছে অভিযোগ ‘আমার সমান কেউ এখানে নেই কেন’।
কাছাকাছির মধ্যে সমান বলতে ইন্দ্রনীলের
বড় ছেলে যশ্ খোকার চেয়ে বছর খানেকের বড়। কিন্তু ঐ বার, ঐ সময়টায় যশ্ ছিল তার
মামাবাড়িতে। খোকাকে বলা হয়েছে ‘যশ্ এলে খেলবি’। তাই রোজই প্রশ্ন তুলতো ‘কবে আসবে যশ? কখন আসবে যশ? আসেনা কেন যশ?’ এবারে তাই বাড়ি আসার পরিকল্পনা হওয়া মাত্র ইন্দ্রনীলের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিলাম যশের হাজির থাকার ব্যাপারে।
৩।
রাতে ঘুমাতে দেরী হয়। তাই উঠতেও
দেরী। প্রত্যেকদিনই ইন্দ্রনীল বা সিদ্ধার্থ এসে ডেকে তোলে। যখন জাগি তখন
বাবা-মা-বউ-ভাই-খোকা-খুকি সকলের দিন এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা। খোকার তো পাত্তাই পাওয়া
যায়না। খুকিও ব্যস্ত। কাকা-ঠাকুর্দা-ঠাকুরমা, পাড়ার দিদা,মাসী,পিসী কারোর না কারোর
সঙ্গে হয় চলছে খেলা নয়তো অনবরত কথা’র তুবড়ি। মুখ ধুয়েই স্নান করে নিই। চা খেয়েই চেষ্টা নিই বেড়িয়ে পড়ার। মা’র কাছে ধরা পড়ে গেলে সকালের খাবারটা খেয়ে
বেরোতে হয়। তারপর আরম্ভ হয় শহরময় টই টই।
সাবর্ণিদা’র অফিস থেকে আড্ডা সেড়ে কিশোরদা’র অফিস। পথে হয়তো দেখা শ্যামাদা’র সঙ্গে। সে উকীল। তার সঙ্গে হানা দেওয়া
তার কাছাড়িতে। সিদ্ধার্থ, ইন্দ্রনীল যতক্ষন সম্ভব সঙ্গে থাকে। যখন নিতান্ত আর
এড়ানো যায়না চাকরি আর যাপনের দায়, তখন ছুটি নেয়। আবার একটু ঝাড়া হাত’পা হলেই ফোন আসে। ঠিক হয়েযায় কোথায় দেখা
হচ্ছে। তিন জনের বাড়ি একই পাড়ায় বলে চেষ্টা নেওয়া হয় একসঙ্গে ফেরার।
ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা উত্রে যায়।
দেখা যায় মা-বউ-খোকা-খুকি কেউ বাড়িই নেই। দল বেঁধে গিয়েছে পাড়া বেড়াতে নয়তো কোনো
কুটুমজনের সঙ্গে দেখা করতে। আবারো বাবার ধমকে চা আর জলখাবারের সময়টুকু বাড়িতে।
তারপরেই আবার বেড়িয়ে পড়া। সেটেলমেন্টের চা’র দোকান নয়তো পলান ঘোষের বীয়ারের ঠেক নয়তো অন্য কোথাও ...
তারপরে আবার যখন ফেরা তখন বাড়ি
নিঝুম। সবাই চলেগেছে ঘুমাতে। পাকঘরে বসে ভাত খাই আমি আর অনীক। আমার ছোটোভাই।
কোনোদিন সিদ্ধার্থ বা ইন্দ্রনীলকেও বসিয়ে দি খেতে। কোনো কোনো দিন ওদের কারোর
বাড়িতেই হয়ে যায় আমার রাতের খাওয়া। অতঃপর সেই ‘কাঠের পুল’। ভোরের দিকে এসে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ
করা।
এমনি করেই ফুরিয়ে এলো ছুটি। তার মধ্যেই একদিন
ছেদ পরলো আমার রুটিনে। সেদিনও বেলা এগারোটা নাগাদ সিদ্ধার্থ ডাকতে উঠলাম। কিন্তু
উঠেই টের পেলাম জ্বর এসেছে। মাথায় টন্টনে ব্যথা। তা’ও দুতো কেল্পল্ খেয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পরার
ইচ্ছে ছিল আমার। আরতো মাত্র চব্বিশটা ঘন্টা। তারপরেই কোথায় সরল খাঁ’র দীঘি, কোথায় টিংকু’র চা-পানের দোকান, কোথায়
সিদ্ধার্থ-ইন্দ্রনীল, কোথায় আমি ...
কিন্তু সিদ্ধার্থ’ই বাদ সাধলো। বল্লোঃ ‘আরে কাইল বাদে পরশু জার্ণি করতে, শরীর
অসুস্থ থাকলে বাইচ্চা-কাইচ্চা লইয়া ঝামেলাত পড়ি যাইবে। এট্ লীষ্ট্ আজকের দিনটা
রেষ্ট ল’। সন্ধ্যার দিকে ঠিক লাগলে বারনি যাইবনে...’। ফোনে একই মতামত ঘোষনা করলো ইন্দ্রনীল।
আমার বাইরে যাওয়া হলোনা। চা জল খাবার খেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলাম বিছানায়।
জানালার পর্দ্দা সড়িয়ে দিয়ে চেয়ে রইলাম রাস্তার দিকে। এমনি রাস্তা দেখে দেখে,
রিক্সা আর মানুষ দেখে দেখেও কেটেছে আমার কতো কতো দুপুর।
খোকার দেখা পেলাম না। শুনলাম সে
না’কি সকাল থেকে থাকে ইন্দ্রনীলদের বাড়িতেই। যশের সঙ্গে খুব ভাব হয়েছে তার। খুকি
সামনের বারান্দায় পাশের বাড়ির মাসিমা’র সঙ্গে চালাচ্ছিল তার কথার চড়ুইভাতি। এক ফাঁকে এসে জানিয়ে গেলোঃ ‘পাপা, তোমার উক্কু হয়েছে? কেঁদোনা। সেড়ে
যাবে। আমি তোমাকে ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে
যাবো’ ... শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশ
দেখতে দেখতে সিগারেট ধরালাম একটা। তেতো লাগলো। ফেলে দিলাম। তারপর এক সময় দু চোখ
জুড়ে ঘুম নেমে এলো।
দিনটা গেলো প্রায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই।
একবার উঠে স্নান করে, খেয়ে , আবার কিছু কেল্পল্ ঠেসে ঘুমিয়ে পড়া। এবার ঘুম
ভাঙ্গলো ইন্দ্রনীলের ফোনে।
‘কিতারে শরীর অখন কেমন?’
‘বেটার। জ্বর’ত নাই মনোহয়’
‘তে এক কাজ কর, আইজ আর বেশী দূরে যাওয়ার
দরকার নাই। সন্দীপনদা’র বাসাত আইযা। আমরাও তার বাসাত...’
ওহ্, বাইরে যাওয়ার ছাড়পত্র মিল্লো তাহলে। বিছানা ছেড়ে উঠে হাত মুখ ধুয়ে
নিলাম। মা-বউ আর খুকি’র পাড়া বেড়ানো আরম্ভ করার সময় এটা। বিকাল সাড়ে পাঁচটার মতো হবে। কাজের বৌ’টি চা করে দিলো। চা খেয়ে বারান্দায় বসে জুতো পরছি। সিদ্ধার্থ’র ফোন এলো। ‘আইরে ত?’
তেমন অঝোরে না হলেও দিনের বেলা দু’এক পশলা বৃষ্টি হয়েগেছে। আকাশে ছেঁড়া
ছেঁড়া মেঘ। বারান্দা থেকে নেমে গেট খুওতেই চোখ গেলো রাস্তার অন্য পাড়ে, শ্রীভূমি
পাঠশালার ছোট্ট মাঠের দিকে। মাঠ না বলে ইস্কুলের উঠান বলাই বোধহয় সমীচীন হয় এ’কে। তবু এ’ই মাঠে শ্রীপল্লী’র ছেলেদের সাথে কতো যে চ্যালেঞ্জ ম্যাচ্
খেলেছে ইন্দ্রনীল আর সিদ্ধার্থ তার ইয়াত্তা নেই। হারজিত নিইয়ে হয়েছে মারপিটও।
আজ ঐ দিকে চোখ যেতেই কেমন যেন বিহ্বল
হয়েগেলাম । আমি আর যেন পারলাম না নড়তেই। সেল্ ফোন বেজে চল্লো। একবার। দুইবার।
তিনবার। টের পেলাম সিদ্ধার্থ, ইন্দ্রনীল বা সন্দীপনদা’ই ফোন করছে। কিন্তু হাতে তুলতে পারলাম না
ফোন। আমি তাকিয়ে রইলাম। তাকিয়েই রইলাম ...
৪।
একটি লাল বল ছুটিয়া আসিল। মাটির দিকে। সদ্য বৃষ্টিতে ভিজিয়া থাকা ঘাসের দিকে।
বল মাটি স্পর্শ করিল। জল ছিট্কাইয়া উঠিল। বলটি ভিজিল। বলটি সামান্য লাফাইতে
চেষ্টা নিলো অতঃপর ভিজা ঘাসের শরীর ধরিয়া সামনের দিকে গড়াইয়া গেলো। একটি কাঠের
ব্যাট, শাদা, ঠেকাইল বলটিকে। বল আবার উঠিল। মাটি, ভিজা ঘাস ছাড়াইয়া উপরের দিকে।
একটি আম গাছের একটি শাখার দিকে চলিল বল। বল শাখাটিকে ধাক্কা মারিল। ধাক্কা মারিল
শাখাও বলটিকে। বলটির গতিপথ বদলাইয়া গেলো। ইহা এইবার নামিতে লাগিল । তবে মাটির দিকে
নয়। একটি টিনের চালের দিকে। ঢং করিয়া শব্দ হইল। বল টিনের চালে আঘাত করিল। টিনের
চাল বলটিকে গড়াইয়া দিলো। চাল হইতে বল এইবার নামিতেছে। চালের ঠিক নীচেই টিনের
বোর্ডে কালোর উপরে শাদা দিয়া লিখিত ‘শ্রীভূমি বিদ্যাপীঠ’। বলটি ঐ বোর্ডটিকে নাড়াইল। বোর্ডের শরীরের জমা জল ঝরিল। বলটি এইবার ‘শ্রীভূমি’ পাঠশালার বন্ধ জানালা পারাইল। ... বলটি
এইবার নামিতেছে। নামিতেছে মাটির দিকে, ঘাসের দিকে। কিন্তু সে পারিলনা নামিতে। দুই
জোড়া কচি হাত শূন্যে ঝাঁপাইল। ধরিয়া ফেলিল বলটিকে। কিন্তু কে ধরিল? ধরিল দুই জনেই।
কিন্তু ইহাদের একজন তো বেট্স্ম্যান্। বলকে মাড়িয়া দূরে পাঠানোই তো তাহার
দায়িত্ব। সে’ও কেন গেলো ঘাসের উপরে ব্যাট্ রাখিয়া দিয়া বল লুফিতে? যদিবা গেলোই তবে কে সে? সে অবিনাশ? যশ?
সিদ্ধার্থ? খোকা? ইন্দ্রনীল? কে সে? ... বলটি ঠিক কোথা হইতে আসিতেছিল তাহাদের
দিকে? এই এক মুহুর্ত্ত আগে না’কি কুড়ি বৎসর আগে এমনি কেউ ছুঁড়িয়া দিয়াছিল বল’টি? কে ছুঁড়িয়া দিয়াছিল? অবিনাশ? সিদ্ধার্থ?
ইন্দ্রনীল? কাহারা লুফিয়া লইল বলটি? অবিনাশ? যশ? সিদ্ধার্থ? খোকা?
ইন্দ্রনীল? কাহারা এখন গলাগলি করিয়া, হাসাহাসি করিয়া আবার নূতন নিয়ম বানাইতেছে
খেলার? অবিনাশ? যশ? সিদ্ধার্থ? খোকা? ইন্দ্রনীল? হে যক্ষ, আপনি কি দেখিতেছেন এই
দৃশ্য, এই খেলা? হে যক্ষ আপনি কি দেখিতেছেন এই খেলা দেখিয়া বিহ্বল হইয়া দাঁড়াইয়া
পরা একটি মাত্র দর্শককে? কে সে? অবিনাশ? যশ? সিদ্ধার্থ? খোকা? ইন্দ্রনীল? কে? ...
হে যক্ষ, আপনার ন্যায় তাহারো
যায়না সংশয়। আপনার ন্যায় সে’ও স্থির করিতে পারেনা এই দৃশ্যের আয়ুর স্থায়িত্ব। তথাপি হে যক্ষ, যুগে যুগে
অপরাজিত জীবন রহস্য কি অপূর্ব মহিমাতেই আবার আত্মপ্রকাশ করে! প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের
অনুপস্থিতির পর অবোধ বালক অবিনাশ আবার ‘শ্রীভূমি বিদ্যাপীঠ’এর উঠানে ফিরিয়া আসিয়াছে!
সে’কি আবার যাইবে ফিরিয়া না’কি এই খানেই থাকিয়া যাইবে, অন্ততঃ মনে
মনে, হে যক্ষ, এই প্রশ্ন এই মুহুর্তে অবান্তর এমনকি অবাস্তবও বটে। অতএব সকল সংশয়
বিস্মৃত হইয়া, এই মুহুর্তে, আসুন, হে যক্ষ দেখি এই ক্রীড়া। দেখি পরস্পরের প্রতি এই
দুই বালকের সবুজ, করুণ সৌহার্দ্য...
১০/০২/২০০৬ – ২৩/০৬/২০১২
বেঙ্গালোর