ভারত যুদ্ধে ভজা
প্রেমেন্দ্র মিত্রের
‘কুরুক্ষেত্রে ভজা ওরফে বৃহদ্ধজ’ গল্প অবলম্বনে
নাট্যরূপঃ সপ্তর্ষি
বিশ্বাস
উৎসর্গঃ নাটুকে দোস্ত্ ইন্দ্রনীল
দে’কে
পাত্রপাত্রী
ভজাঃ বছর
বারো তেরোর একটি ছেলে
অর্জুণঃ
একুশ বাইশ বছরের মাস্তানের মতো চেহারা
শ্রীকৃষ্ণঃ
বছর তিরিশের উকীল, চোখে চশমা
স্থানঃ
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মাঠ
কালঃ
দুপুরের দিক
কৃষ্ণ চালিত
রথে অর্জুন যাচ্ছে রণাঙ্গনে।
গানঃ
যুদ্ধ যুদ্ধ
যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ –
সবাই রাগতঃ
সবাই ভীষণ ক্রুদ্ধ!
একদিকে আছে
পান্ডব সেনা,
আর দিকে শত
কৌরব –
সেদিন
যুদ্ধে কুরুদের তেজে
সেরা
মাফিয়ার গৌরব
পান্ডব সেনা
হারালো বুঝিবা!!
অহো কি করুণ
পরাভব –
দুঃশাসনকে
খুঁজতে কোথায়
ওধাও হয়েছে
ভীমসেন –
কর্ণের বাণে
আকাশে উড়ছে
অযুত নিযুত
জেট্প্লেন!!
অর্জুন তাই
কৃষ্ণকে নিয়ে
তাড়াতাড়ি
যায় লড়তে –
এবং তখুনি
তাকে হয় সেই
ঘোর
গ্যাঁড়াকলে পড়তে!!
[ ভজার প্রবেশ। ভজা দৌড়ে এসে রথের পথ আটকায়।]
রথের সামনে
দাঁড়িয়ে রয়েছে
কোথাকার এক
পুঁচকে!!!
ভুরু খোঁচ্
করে অর্জুন বলেঃ
‘আরে রে রে
ব্যাটা তুই কে????
সড়ে যা
এখুনি নইলে যে যাবি
রথের চাকায় গুঁড়িয়ে’
–
‘সামান্য
কথা বল্লেই
যায় সবকিছু
ল্যাঠা ফুরিয়ে’
বল্লে ছোকড়া
একগাল হেসে
কাছে এসে আগ
বাড়িয়ে –
অর্জুন বলেঃ
‘আগে বল্ ব্যাটা
ভারতযুদ্ধে
তুই কে??’
ভজা। আইজ্ঞা,
আমি ভজা –
অর্জুন।
ভজা? কে ভজা? কোন্ ভজা? কোন পক্ষের ভজা? আমাদের না ঐ ব্যাটা শকুনীদের?
ভজা।
আইজ্ঞা, হিটা তো ঠিক জানিনা –
অর্জুন।
সেটাও জানিস না? আরে ও কিষ্ণ, এ ব্যাটা আবার গুপ্তচর টর নয়তো?
[ কৃষ্ণ তার সেল্ ফোনে গেইম খেলছিল। মুখতোলে
এবার।]
কৃষ্ণ। হুঁ,
তা বটে, তা বটে, হক্ কথা। একটু বাজিয়ে দেখো –
[ পুনরায় সেল্ ফোনে গেইম’এ মনঃসংযোগ]
অর্জুন।
(স্বগতঃ) জ্বালালে আমি যদি বাজাতে জানতামই তো ব্যাটা তোকে আর এতো ঝামেলা করে দলে
টানা কেন? (ভজার প্রতি) এই ব্যাটা, ঠিক করে বল্ তুই কোন্ পক্ষের নইলে এই এক কোপে
–
ভজা। আইজ্ঞা,
আমি ভজা, আমি খালি ইটুক্য়ই জানি। পক্ষ বিপক্ষের কিচ্ছু জানিনা, এক্বারে হাচা কথা
–
অর্জুন।
মানে?
ভজা। মানে
আর কিতা কইতাম,মানে কিতা আমিই কিচ্ছু বুঝিনি? আমি উমাপতি পুরের ভজা। পঞ্জিকা
ঘাইট্টা পুরইত’এ নাম দিস্লা বৃহধ্বজ। গ্রামো আস্লাম আরামেউ। এই এর গরুটা, তার মইষটারে মাঠো নিয়া
ঘাস খাওয়াইয়া, জল খাওয়াইয়া, মা-বাপের গাইল
বকাটা আর আল্লাদটাও পাইয়া সুখেয়ই আস্লাম কওয়ন লাগবো। আত্কা কথা নাই বার্তা নাই,
মোড়লে আইয়া কইন্ যুদ্ধত্ যাওন লাগবো। মা’য় কান্দইন, বাফে কান্দইন, আমি কান্দি।
কিন্তু কে আর তখন দেখে আমার কান্দা? গরুর গাড়ি বোঝাই দিয়া আইলাম যুদ্ধত্। আইয়া ত্
দেখি আরে বাব্বা! ইতো মস্ত মস্তির কারবার!
হাতি-ঘুড়া-লুক-লস্কর-সৈন্য-সামন্ত-রাজা-গজা-খাজা-মাছ-মাংস-পাঠা-মুর্গী-পোলাও-
অর্জুন। আরে
থাম্তো! মাছ-মাংস-পাঠা-মুর্গী’র নিকুচি করছে! চট্পট্ বল ব্যাটা আমাকে কিছু
বলবার থাকেতো – নইলে ভাগ্! এখুনি ওই টিলার উপর উঠে আমার কর্ণকে ঠেকাতে চেক্ মেট্
বাণ মারতে হবে –
ভজা।
আইজ্ঞা, একটা প্রশ্ন আছিল্। মানে আপ্নার কাছে ... মানে ঐ কানাইদা’র কাছে ... [ ভজা
কৃষ্ণের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে]
অর্জুন।
মানে? কানাইদা! কানাইদা আবার কে????
ভজা। ঐ যে
আপনের ডাইভার, ঐ কে কিষ্ণ ঠাকুর –
অর্জুন।
মানে!! ইনি আবার তোর কানাইদা হলেন কোন সম্পক্কে???
ভজা। আরে
তান্ লগে আবার কিয়ের সম্পর্ক? তাইন তো কেউরউ কিচ্ছুনা। তেও কেউ ডাকে ছিক্কিষ্ণ,
কেউ রাধামাধব, কেউ আবার কয় তাইন বুলে ‘মধুসূদন দাদা’, আমি ডাকি কানাইদা –
অর্জুন।
বটে!! তা এখন আমার রাস্তা থেকে ভালোয় ভালোয় সড়ে পর দিকিনি, আমার তাড়া আছে –
ভজা। আরে না
না, দাড়াইন দাড়াইন, যেদিন থেকিয়া ইখানো আইসি হিদিন থেইক্কা কানাইদা’র খুজ করি। পাইনা।
আইজ কপাল ভালা। আপ্নারা দুই জন্রে এক লগে পাইলাইসি। আইজ আমার কথাটা কইয়ায়ই যাওন
লাগব –
অর্জুন। কি
কথা?
ভজা। আইজ্ঞা
যুদ্ধ তো খুব হইতাসে, কতো বুমা, বারুদ, আওয়াজ – এক্বারে ফাটাফাটি কান্ড, কিন্তু ই
যুদ্ধটাযে ঠিক কিতার লেইগ্যা হিটাত বুঝিনা
–
অর্জুন।
মানে? মানে এটা তোর প্রশ্ন? মানে এটা কোনো প্রশ্ন হলো??? যা বেটা ভাগ্ আমার আর
সময় নষ্ট করিয়ে দিস্নে –
ভজা। আইজ্ঞা
আমার ই কথার জবাব না দিলে আপনারারে আমি যাইতেউ ত দিতাম নায়! অই দেখইন ধরসি আপনার
রথের চাক্কাত্, দেখি আমারে পিষিয়া না মারিয়া কেমনে রথ চালাইন –
অর্জুন।
মানে? আরে ব্যাটা করে কি! অ কিষ্ণ ব্যাটা যে সত্যি আমার রথের চাকা চেপে ধল্লো! এখন
উপায়? আরে ও কিষ্ণ, খুবতো গেইম খেলছো আর মিটি মিটি হাসছো! একটা বুদ্ধি টুদ্ধি দাও,
ব্যাটাকে তাড়াই । যুদ্ধের আগে, আমার যখন ফাস্টেশান হলো, তখন তো কতো লম্বা বুলি
ঝাড়লে –যদা য়দা হি ... শ্বাশত অয়ং আরো কতো কি –
এ ব্যাটাকে
দাওনা এমন একটা কিছু –
কৃষ্ণ। আরে
ওসব তো তোমার জন্য, যারা ইন্টেলেক্চুয়াল তাদের জন্য, যারা ডিস্কোর্স ইত্যাদি
বোঝে তাদের জন্য। এসব প্রলেটাতিয়েটদের জন্য নয় –
অর্জুন।
মানে? কি বল্লে? প্রলয়? পটল? পট্লা –
কৃষ্ণ। আরে
না না। ‘প্রোলেটারিয়েট্’। অর্থাৎ যারা গায়ে খেটে খায়। এই ভজার মতো। যারা হাজারে
হাজারে এই যুদ্ধে মরছে। আরো মরবে। এদের মোটা মাথা। সোজা বুদ্ধি। গীতা, উপনিষদ এই
প্রলেটাতিয়েটদের জন্য নয় –
অর্জুন।
মানে? তবে কি বলি ওকে বলোতো?
কৃষ্ণ। আরে,
সেই রাষ্ট্র সংঘের মিটিঙ্গে যেটা বলেছিলে সেটাই বলে দাওনা এ ব্যাটাকে –
অর্জুন।
মানে? ও আচ্ছা, বুঝেছি – (ভজার প্রতি) বুঝলে হে ভজহরি –
ভজা। আইজ্ঞা
না, ভজহরি না, ভজা –
অর্জুন।
মানে? এঁ, হলো, ঐ একই হলো ... তা এই যে যুদ্ধ, ভারত যুদ্ধ, মহাভারত যুদ্ধ, এটা
হলোগে ধম্মোযুদ্ধ, বুঝলি রে ব্যাটা?
ভজা। আইজ্ঞা
না –
অর্জুন।
মানে? এই সহজ ইয়েটাও মাথায় ঢুকলো না? শোন্, এ হচ্ছে ধম্মো যুদ্ধ। এ যুদ্ধ মানুষের
কল্যাণের জন্য। তোর মতো সাধারন মানুষের ভালোর জন্য যুদ্ধ। এর পরে পৃথিবীতে আর যেন
কোনো যুদ্ধ নাহয়, এ যুদ্ধ তারি জন্য –
ভজা। (কৃষ্ণের
প্রতি) ও কানাইদা তুমি কিচ্ছু কওনা দেখি বা? ইটা কিতা ঠিকয়ই নি? ই যুদ্ধ আমরার মতো
মানুষের ভালার লেইগ্যা যুদ্ধ? এই যুদ্ধের পরে মারামারি-কাটাকাটি যুদ্ধ আর ঠিকয়ই হইত
না? ও কানাইদা কওনা ( ভজা এবার দর্শকের দিকে এগিয়ে যায়, জনান্তিকে বলে) বুচ্ছি, অতোদিনে
বুচ্ছি, ইটা হইল ধম্মো যুদ্ধ। ই যুদ্ধ মানুষের
ভালার লেগিয়া। আমার মতো, আপনার মতো মতো সাধারন মানুষের ভালার লেগিয়া যুদ্ধ। এর পরে
পৃথিবীত আর কুনো যুদ্ধ হইত না, ই যুদ্ধ যুদ্ধ
বন্ধ করবার যুদ্ধ –
[এমন সময় বিকট শব্দে বোমা ফাটে কাছেই। হাহাকার ওঠে।
ধোঁয়ায় মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। বোমার আঘাতে ভজা ছিট্কে পরে মাটিতে। সে মারা গেছে।]
গানঃ
এমন সময়
‘ আর দেরী নয়’
কৃষ্ণ বলেন ডেকেঃ
‘ডিনামাইট বাণ
মেরেছে কর্ণ!
পলাও এখান থেকে’
বলেই ওধাও
কৃষ্ণের রথ –
আর সে বেচারা
ভজা
বোম্ পরে তার
উড়েগেলো মাথা
আহারে কেমন মজা!
তখুনি প্রান্তে
আগুয়ান হলো
দুর্যোধনের ধ্বজা
–
অর্জুন শুনে
টিলাটিতে উঠে
তীরে দিলো টংকার
–
আবার তুমুল যুদ্ধ
জমলো
অতীব চমৎকার!
ভজার মৃতদেহকে মঞ্চে রেখে সকলের প্রস্থান।
সমাপ্ত
১০/০৩/২০১৩
বেঙ্গালোর