প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

অচেনা মুখ, চেনা মুখোশ ।। ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস ।।

 অচেনা মুখ, চেনা মুখোশ

                                                            সপ্তর্ষি বিশ্বাস

 

 [ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে অরিজিৎ আদিত্য সম্পাদিত ‘দৈনিক বার্তালিপি’ তে। প্রতি রবিবারে। প্রকাশের পরবর্তী রবিবারে এখানেও প্রচারিত হবে প্রকাশিত পর্ব গুলি। ক্রমে। -- সপ্তর্ষি বিশ্বাস ]

 


১।

 

 রঙচঙে মলাট আর পাতলা কাগজে ছাপা, খুলতেই বোল্ড হরফে লেখা 'কলেজ স্টুডেন্ট দের জন্য' রহস্য-রোমাঞ্চ কিংবা 'বিশ্বচক্র সিরিজ' কাহিনীর আরম্ভের মতোই এই কাহিনীর আরম্ভেও একটি ঝড়বাদলের রাত। লোডশেডিং।  নিরালোক এক  ইস্টিশান। শহরের এক প্রান্তে। বৃষ্টি বাদলায় এখানে কারেন্ট, শুধু রেল ইস্টিশানে কেন সরকারি হাসপাতালেও, থাকেনা। অঝোর ধারা ক্রমে ঝিরিঝিরি র দিকে চলেছে। ইস্টিশানের বাইরে একা এক বুড়ো বট ভিজছে। ছিল জোড়া বট। ইস্টিশানের ডেভলাপমেন্ট কোতল করেছে একজনকে। বটগাছতলে দোকান। দুটো। এখন ঝাঁপ ফেলা।

      মধ্যরাত না হলেও ঘড়ির কাঁটা পেরিয়েছে ১১টার দাগ। শেষ ট্রেনের পেসেঞ্জার ধরতে এই সময়েও অন্ততঃ দুই তিনটা রিক্সা থাকে। আজ নেই। বিষ্টি বাদলায় চলে গেছে ঘরমুখো। ইস্টিশনের মুখোমুখি, পিচ রাস্তার ওই ধারে, পুকুর। রেল কলোনীর পুকুর।

       বর্শাফলার মতো জল-বাতাস উড়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে। শেষ গাড়ি পার না করে যাদের ফেরার উপায় নেই শুধু তারাই আছে স্টেশনে।

 

ঘড়ির কাঁটা বেয়ে রাত যখন পাড়ি জমাবে বারোটায় তখুনি, স্টেশনের দুটি প্ল্যাটফর্মের যেটি ১ নম্বর  তাতে এসো থামলো একটি ট্রেন। কাংখিত শেষ ট্রেন। ট্রেনের ইঞ্জিন, কামরা চুঁইয়ে সামান্য আলোয় ইস্টিশানের অবয়ব এবার ভূতুড়ে। যাওয়া, তার, আরো অনেকটাই বাকি। দূরের যাত্রীরা ঘুমে। তারা জানলোও না ট্রেন থামলো কিনা, কারা নামলো বা কেউ উঠলো কিনা। ট্রেনেরো যেন উৎসাহ নেই জানার। সিগন্যাল মিল্লো। তাই থামলো কয়েক মিনিট। চলে গেলো বাঁশি বাজিয়ে। যেন তার জানাই আছে রাতের এই রেলগাড়ীতে, এই সব পুঁচকে ইস্টিশান থেকে কেউ ওঠেনা কখনো। মাঝে মধ্যে নামে। নামে শুধু তারাই যারা রাতের এই রেলগাড়ীকে ব্যবহার করে লোকাল ট্রেনের পরিবর্তে। আজো তেমনি। তিন চারজন, যারা নামলো, তারা সবই হপ্তায়, মাসে এখানে নামা-যাত্রী। শুধু একজন নতুন মানুষ নামলো তাদের সঙ্গে। তবে অন্ধকারের করুনায় কেউ পারলো ঠাউর করতে।

          সেই নতুন মানুষ নামলো। এগিয়ে গেলো রিক্সার ক্যারোসিন বাতির দপ দপ আশা করে। কিন্তু ইস্টিশানের সামনে অন্ধকারের প্রাচীর আর বর্শাফলার মতন জল-বাতাস। তথাপি তাকে চিন্তিত মনেহলোনা খুব। পিঠে-ঝোলানো ব্যাগ থেকে বর্ষাতি সে সম্ভবত বার করে রেখেছিল আগেই। দ্রুত তাতে নিজেকে জড়িয়ে ছাতা খুলতে ব্যস্ত ও ব্যতিব্যস্ত দুই সদ্যনামা যাত্রীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো: " আচ্ছা, বানী গেস্টহাউসটা এখান থেকে.. "

এই অঞ্চলের নিজস্ব বাংলায় কথাগুলি বল্লেও বলায় বাজলোনা আঞ্চলিক সুর। অতএব ওই দুইজন টের পেয়ে গেলো, এবং এই শহরে এরাই প্রথম টের পেলো, একজন নতুন মানুষের আসাকে।

" এতো রাতে, এই অন্ধকারে,  বিষ্টি বাদলায়…  আপনি বানী হল.. "

" আরে গাবলুদা, বানী হল চিনলে ত উনি বানী হোটেলও… "

নতুন মানুষ বল্লো " বানী হোটেল..?  ওদের কার্ডে লেখা বানী গেস্ট হাউস, ফোনেও বলেছিল… "

"মানে দাদা বোধহয় এই প্রথম এলেন। পয়সা দিয়ে থাকার জায়গা এখানে একটাই। ওই বানী হলের লাগোয়া। তা আপনি বানী গেস্ট হাউস বলুন আর হোটেলই বলুন"।

" আচ্ছা, আমাদের সঙ্গে হাঁটা দিন। কিছুদূর গিয়ে আমাদের রাস্তা অন্য। আমরা দেখিয়ে দেবো"।

ছত্রধারীদের সঙ্গে নতুন মানুষ চল্লো বর্ষাতি গায়ে। চল্লো পিছু পিছু। খানিকটা দূরত্ব রেখে। আর আলাপচারিতার বিপক্ষে বেজে উঠলো তার শিস। " নয়না বরষে, রিম ঝিম রিম ঝিম" এর সুর উড়ে চলতে লাগলো তাদের সঙ্গে, জল-বাতাসে ভেসে।

এই ভাবে এই চরিত্রটি, যার নাম, ক্রমে জানা যাবে, তার প্রবেশ কিংবা আগমন ঘটলো এই কাহিনীতে।

 #

    যে শহরে সে নামলো এবং প্রবেশ করলো এই বিষ্টি বাদলার, লোডশেডিং এর রাত্রে, সেই শহর এখনো ততোটাই শহর, যে, প্রায় পা দেওয়ামাত্রই প্রত্যেকটি নতুন মুখ চোখে পড়েযায় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার। হয়ে ওঠে নানান কিসমের আড্ডার,আলোচনার খোরাক। অন্তত কিছু দিন। বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু মাস। কারন এখানে বড় একটা কেউ আসেনা। এখান থেকে খুব কেউ যায়ওনা কোনোখানে। এখানে জন্মে, এখানে বেড়ে উঠে, ক্রমে, এখানেই মরে যায় একদিন। সুতরাং এই মানচিত্রে একটিও নতুন মুখ আমদানি হলে, তা, ক্রমে সিংহভাগ চোখেই ছায়া ফেলে। তাই দিবাকরও যে চোখে পড়ে যাবে এদের, শহরে আট চল্লিশ ঘন্টা না-হতেই, সে’ই স্বাভাবিক।

এই নতুন লোক, এই দিবাকরকে, উৎসাহী চোখদের খপ্পরে পড়ার আগে, এই শহরের রাস্তায় নামার আগে এই শহরের আরো কিছু কথা বলা থাকুক এখানে।

ছোটো শহর। দুই প্রান্তে দুই নদী। তাদের মধ্যে যোগ রেখে, শহরের টানা লম্বা পিচ রাস্তার পাশাপাশি চলেছে একটি খাল। এখানকার যাপন প্রণালীর মতো তারও গমন প্রণালী ঝিম ধরা। ঝিম মারা। শহরের মাঝামাঝি বাজার।  ‘সেন্টার’ বা ‘সেন্ট্রাল’ মার্কেট থেকে বহুযুগ ‘সন্তর বাজারে’ পরিণত। পিচ রাস্তা থেকে এই বাজার এতোটাই নিচে, যে, নেমে যেতে হয় সিঁড়িবেয়ে। নেমে-যাওয়া সিঁড়ি-ধাপের কিনারে এক ঝুলন্ত সেতু। গিয়ে পৌঁছেছে যে দালানে, তার কপালে লিখিত “সাধনা ঔষধালয় (ঢাকা)”। এর পিছনে খাল,গিয়ে মিশেছে নদীতে, যে নদী পার হতে পাসপোর্ট লাগে, ভিসা লাগে, থাকলে, নৌকা করে সাড়ে সাত মিনিটে পাড়ি দেওয়া যায় ভিনদেশে - সেই বাজার-সিঁড়ির মুখোমুখি ‘রিসকা-স্ট্যান্ড’। সাইকেল রিক্সা আর ঠেলাগাড়ি চালকরা এখানেই করে থাকে যাত্রী এবং মাল তোলা-নামানোর কাজ। অপেক্ষা করে পরবর্তী ভাড়া’র। না হলে শান্ত হয়ে বসে শুধুই ঝিমায়।

   এই 'রিসকা স্ট্যান্ডে' ই আমরা থামবো আপাতত কেননা রিকসা চালকদের বিস্ময় হয়েই দিবাকরের আত্মপ্রকাশ এই শহরে,যে শহরের নাম সঙ্গত কারণেই গোপন রাখা হবে কাহিনীতে। রিকশা স্ট্যান্ডের আশেপাশে দিবাকরকে দেখলেই নড়েচড়ে বসে সকল রিক্সা চালকেরা । অনেকে এগিয়ে গিয়ে জিগিয়েও ফেলে ‘ যাইতানি বাবু?” গত আট চল্লিশ থেকে বাহাত্তর ঘন্টায় এটুকু রাষ্ট্র হয়ে গেছে, যে, এই বাবু ভাড়া নিয়ে ঝামেলা করে না।  দ্বিতীয়তঃ এই বাবুর ভাড়া মানে লম্বা ভাড়া। শহরের এই মাথা থেকে ওই মাথা।

 দু চারটা পাড়ার নাম জানত বাবু। অন্তত প্রথম দেড়-দুই দিন ওই নামগুলি জপেই উঠেছে রিক্সায়। তবে পরের দেড় দুই দিনে রিকশায় ঘুরে ঘুরে শিখে ফেলেছে আরো পাড়া, আরো গলী।

“যাবেন আজাদ সাগর রোডে?” দিয়ে যে যাত্রার আরম্ভ তাই হঠাৎ এবং প্রায়শই “আচ্ছা, বলছিলাম বাঁদিকের ওই রাস্তাটা ধরে গেলে কেমন হয়?” হেন আব্দারে পরিবর্তিত। প্রথম প্রথম চালকেরা বলতো “ওই রাস্তা তো আজাদ সাগর রোডে যায় না বাবু “ সামান্য থেমে, ভেবে নিয়ে “যাওয়া যায় । তবে অনেকটা ঘুরতে হবে”। ঢোঁক গিলে “ ভাড়া বেশি লাগবে”। বাবুটি, দিবাকর, তার উত্তরে সতত স্থিরঃ “ভাড়া নিয়ে ভাববেন না।”  এহেন সওয়ারীই যে চালকদের মধ্যে হয়ে উঠবে কিংবদন্তী, সে’ও স্বাভাবিক।

 

 ২।

 শহরে একটা নতুন লোক এসেছে। অনেকেই দেখে নিয়েছে তাকে। দেখেছে অনেক জায়গাতে। পলান ঘোষের বীয়ার-দোকানে, সিভিল হাসপাতাল চত্বরে, সরকারী হায়ার সেকেন্ডারী ইস্কুলের বারান্দায়, খুশিনদীর ঘাটে, রেড ক্রশ সোসাইটির দাতব্যে, "ছাত্রসাথী লাইব্রেরী"তে, মাতন নদীর কাঠের পুল'এ,এমন কি তাকে দেখেছে শেফালী-গীতালী-চৈতালী'দের গলীতেও। তাকে দেখা গেছে হেঁটেচলে ঘুরে বেড়াতে, দেখাগেছে রিক্সায় চেপে চলেযেতে সেটেলমেন্ট্‌ রোড পার হয়ে টিলাবাজারের দিকে। দেখাগেছে চড়া রোদ্দুরে ঘুরে বেড়াতে স্টেশান রোডে। তুমুল বিষ্টিতেও দেখা গেছে বর্ষাতি গায়ে সরল খাঁ'র দিঘির কিনার ধরে মন্থর চলেযেতে। ফলে শুধু রিক্সাচালকরাই নয়, সময় যাদের অঢেল এবং কাজ নিতান্ত কম তারাও, ক্রমে, লক্ষ্য করল যে,  এই নতুন মুখটি দিনের বেলা রিক্সা চেপে ঘুরে বেড়ায় তবে সন্ধার পরে রিক্সায় ওঠেনা । ঘুরে বেড়ায় । কিন্তু পায়ে হেঁটে ।

 এক সন্ধ্যায় নিমু মোক্তার তাকে দেখলো বিপিন পাল রোডে। সাড়ে সাতটা নাগাদ। মন্থর পায়ে হাঁটতে।  সেই রাত্রি নটা নাগাদ শিবু পাল দেখল তাকে পিডাব্লিউডি-কলোনীতে হেঁটে বেড়াতে । আবার রাত্রি এগারোটা নাগাদ সন্তরের সামনের দোকানদারদের অনেকেই ঝাঁপ ফেলতে ফেলতে তাকে দেখল ফিরছে । ফিরছে কারণ সে যে উঠেছে ‘বানী’ নামক শহরের একমাত্র ‘গেস্ট হাউসে’ যা ‘বানী সিনেমাহলের’ লাগোয়া এবং শহরের একমাত্র কো-এড কলেজের মুখোমুখি, , তা’ও  গত আট চল্লিশ থেকে বাহাত্তর ঘন্টায় জানা হয়ে গিয়েছে অনেকেরই। প্রসঙ্গতঃ এই ‘বানী গেস্ট হাউস”, লোকমুখে যা ‘বানী হোটেল’ তা’ই  একদা পরিচিত ছিল "লেকচারারর্স কর্ণার" বলে। এখানে থাকতো ভিন শহর থেকে এই কলেজে পড়াতে আসা মাস্টরেরা। ছোকরা থেকে বুড়ো সবই ছিল।  এখন তা'ই এক গেস্ট হাউস। কারণ কলেজের অন্দরেই  ‘লেকচারার্স হোস্টেল’ হয়েছে সে’ও প্রায় এক দশক। তবু ‘বানী হোটেলে’ও  ছোকরা লেকচারার এক দুজন এখনো বাসা নেয়। তবে নিয়মিত অতিথিদের বেশীরভাগই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভ। আসে, থাকে, যায়। দিবাকরকে  লক্ষ্য করে এরাও। ‘ফরিদপুর মিষ্টান্ড ভান্ডারে’র আড্ডায় দোকান মালিকের ছোট ভাই অমৃত ঘোষ, যিনি বিজ্ঞ ব্যক্তি, বললেন “আরে তোমরা এখনো ওই নতুন ছোকরাকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো? হবে আরকি, কোনো বেচু বাবু।”

 উপেন, যে নিজে বেচু, বল্লোঃ “দাদা বেচু হলে তো সঙ্গে ব্যাগ থাকতো”।

 বিপিন, সে  বেচু নয়, বীমা কোম্পানীর করণিক, বল্লোঃ “সব বেচু’ই  কি তোমার মতো, যে ব্যাগ কাঁধে করে ঘুরবে অষ্টপ্রহর”?

 রাজু, সামান্য উঁচু পদের বেচু, এবার গলা ঝাড়লো। অর্থাৎ সে কিছু  বলবে। রাজুর বয়স এবং দড় কম হলেও কদর ঢের। শুধু এই আড্ডায় নয়। শহরের বেশ ক’টি আড্ডাতেই তার স্থান এবং কদর রয়েছে। এখানেও, মুরুব্বী হিসাবে, তার স্থান অমৃত ঘোষের পরেই। কেননা সে ‘স্টুডিয়াস’। সে নানা রকমের বই, যথা, সত্যদাস সাঁতরা অনূদিত ‘সার্ত্রের ৫টি নাটক’, কৃষ্ণকান্ত দেববর্মা’র ‘ ফ্রয়েড ও তাঁর যৌন যাপন’, সুপ্রবীর ঘোষের “পরলোকে বিশ্বাস করিও না” থেকে ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’, ‘ কেয়া পাতার নৌকো’ হেন গ্রন্থাদি, আনায়,‘ছাত্রসাথী লাইব্রেরী’তে অর্ডার দিয়ে। আনায় ডেল্‌ কার্নেগী, আনায় ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’। ‘ছাত্রসাথী লাইব্রেরী’র মালিক মুখার্জীবাবু নিজে বলেছেন এসব। তাছাড়া রাজু নাটক করে। আবৃত্তি করে কম্বু কন্ঠেঃ “সেই বি-ইরাট খামারটায় কঅ-খন-অ বৃ-স-টি হয়না’ … ইত্যাদি। তদুপরি 'কলকাতা'র বনগাঁ নামক স্থানে তার আত্মিয় রয়েছে। অতএব রাজুর কথার দাম আছে।

 রাজু বল্লেনঃ “না । এই ছোকরা বেচু নয়। আমিও প্রথমে বেচুই ভেবেছিলাম। তবে লাকিলি সেদিন বাণী হোটেলের আড্ডায় ছিলাম । ছোকরা ঢুকলো। তার কেতা দেখে প্রশ্ন না করে পারলাম না ‘ও দাদা, কোন ফার্মা থেকে এলেন?’ একটু থামেন রাজু। দর্শক-শ্রোতাদের দেখে  নিয়ে আবার আরম্ভ করেনঃ “ছোকরা আড়চোখে আমাকে দেখে নিয়ে, দেওয়ালের দিকে মুখ করে বলে কি, মাল বটে, বলে ‘ দাদা ফারমা না ফার্ম, মুরগি না ডিম নিজেই তো জানি না  এখনো’। তারপর চাবি নিয়ে চলে গেলো। আমি পরে বেনুদাকে বল্লাম দেখতে খাতায় কি এন্ট্রি করেছে। দেখি ‘ফ্রম শাহারানপুর’। পার্পাস অফ ভিসিট ‘পার্সোন্যাল’।

অমৃত ঘোষ, মুগ্ধ কন্ঠেঃ ‘এই হলো রিয়েল প্রেজেন্স অফ মাইন্ড। হোটেলের এন্ট্রি দেখার কথাটা আসতো তোমাদের কারো মাথায়?’

এখানে এসে আড্ডার বাঁক, আডডার নিয়মেই ঘুরে যায়। অমৃত ঘোষ রাজুর 'প্রেসেন্স অফ মাইন্ডের' পুরনো গল্পগুলির সূতো ধরিয়ে দিতে থাকেন নতুন করে আর রাজু সেই সূতো-গুলি গড়িয়ে দেন নিজ-মুখে। যথাসম্ভব ভাবলেশহীনতার মুখোশ এঁটে।

এই সকল মুখোশ, যেমন এই মুহুর্তে রাজুর ভাবলেশহীনতার, কিংবা অজিতেশ ডাক্তারের বৌ ভেগেছে শুনে,মস্তি ঢেকে যে দুঃখ দুঃখ মুখোশ অমৃত ঘোষের অথবা সকলে তাকে দেখলেও সে যেন কাউকে দেখছেনা মুখোশ, দিবাকরের,তা মুখোশধারী নিজে যেমন জানে মুখোশ বলেই, তেমনি জানে দর্শকরাও। অতএব ভাবলেশহীনতার মুখোশ এঁটে, রাজুও জানে, সে আদতে আড়াল করতে পারছেনা কিছুই। তবু চেনা এই সকল মুখোশের আবডাল নিতে হয়, নিতেই হয়, আরো আড়ালের অচেনা মুখটির স্বার্থে।

রাজুর বীরগাথাতেই সে রাতের আড্ডা, ফরিদপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের, শেষ হয়।

রাত বাড়ে। রাত গড়িয়ে যায়।

 ৩।

 


রাস্তায় পা রাখামাত্র দিবাকর আবারো অনুভব করলো তাকে লক্ষ্য করা হচ্ছে। লক্ষ্য করা হচ্ছে তবে লক্ষ্য রাখা হচ্ছেনা। আকাশে পারদ-রঙ্গ মেঘের স্তম্ভ খিলান এখন দুর্গে পরিণত। বৃষ্টি নামবে অচিরেই। তবু রাস্তায় পা রাখলো দিবাকর।ঘড়ির হিসাবে দুপুর গড়িয়ে গেছে তবে বিকাল নামেনি এখনো।  কৌতুহলী দৃষ্টি গুলির ছুঁড়ে দেওয়া অস্বস্তি সয়ে নিয়েই চলছে দিবাকর।  অন্তত এখনো। 'ক্রমে সবই স্বাভাবিক হবে' – হয়তো এরকম একটা আশা রয়েছে মনে। আবার ‘যদি না হয় স্বাভাবিক, যদি এদের কৌতুহল জানার চেষ্টা করে আরো বেশী কিছু? যদি সেদিনের ঐ রাজু ছেলেটার মতো…” এই ভাবনাও ঢেউ দেয়। কিন্তু ঢেউ কে সে দেয়না তরঙ্গ হতে। সামলে নেয়। নিচ্ছে। নিতে পারছে। এখনো অন্তত। ভবিষ্যতে …

শহরের ঠিক মাঝখানে এই মেসবাড়িমার্কা গেস্ট হাউস। গায়েই  সিনেমা হল্‌। পুব দিকে হেঁটেগেলে বাজার। পশ্চিমে ইস্টিশান, বাস স্ট্যান্ড। শহরের ভিতরে চলেনা বাস। পাশ-শহরে, গঞ্জে যায়। যায় এক রাতের দূরত্বে গৌহাটি তে। 

বড়রাস্তার দুপাশে সার সার দোকান। শাড়ি কাপড়ের। মনোহারী জিনিসের।চা-মিষ্টির ' ফরিদ পুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার'। ভাতহোটেল "অন্নপূর্ণা"। বাঁ দিকে গেলে শিব মন্দির।  ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে দিবাকর। ঢিমেতালে। তার ঠিক কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই আবার আছেও বটে। তাড়া নেই। আবার নেইও কি?...

                 তাড়া নেই কারন আজ যদি না'ও যাওয়া যায় তাহলে কাল যাবে। আর আজই যাও, কালই যাও বা পরশুই যাও, যেখানেই যাও, মনে হবে যেন আগের কিংবা পরের দিনের মতোই সব। ছিল। থাকবে। আছে।  দেড় দুইদিনের ঘোরাঘুরিতেই এটা সে টের পেয়ে গেছে। আর টের পেতে তেমন বেগও পেতে হয়নি কারন এই রকমের গঞ্জ, মফস্বলের অভিজ্ঞতা …

প্রতি মোড়েই পানবিড়ির দোকান। খুব খুঁটিয়ে না দেখলে মনে হতেই পারে যে একই দোকান, একই দোকানী সব মোড়ে। অফিসবাবুরাও তা'ই। প্রতিটি আড্ডারও বাঁধা সদস্য। আড্ডাগুলিও নির্দিষ্ট সময়ে, দিনের, রাত্রের, বসে নির্দিষ্ট জায়গায়। সব আড্ডাতেই দেখা যায় নানা বয়সী সদস্য। তবু প্রতিটি আড্ডা ও তার সদস্যদের একত্রিত হওয়ার হেতু কোথাও না কোথাও বিভিন্ন। ওই হেতু গুলিকে বুঝতে সময় লাগবে। তবে বুঝতে হবে। হবেই।

হাঁটতে হাঁটতে "সংবাদ বিচিত্রা" নামের ম্যাগাজিন-দোকানের সামনে এসে পড়লো দিবাকর।  এই 'সংবাদ বিচিত্রা'র ঠিক কোনাকোনি, রাস্তার ওপারে, সাধনা ঔষধালয় (ঢাকা)”, সন্তর বাজার, রিসকা স্ট্যান্ড। "সংবাদ বিচিত্রা"য় দাঁড়িয়ে গিয়ে পত্র পত্রিকা ঘাঁটার, বিশেষ করে লোকাল পত্র পত্রিকার খবরাখবর নেওয়ার তালে দাঁড়িয়ে গেলো দিবাকর আর  তখুনি বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামলো। তবে কয়েক সেকেন্ডেই আবার থেমে গিয়ে জানান দিলো আসছে। অচিরেই আসছে বেশ বড় করে। অতএব আজ আর কোনোদিকে  যাবে কি যাবেনা ভাবতে ভাবতে একটা সিগারেট ধরালো দিবাকর। ধরিয়ে টানতে টানতে টেরপায়, দিবাকর  নয়, দিবাকরের অবচেতনই হয়তো, যে,বৃষ্টিনামার ভয়ে ভীত-দ্রুতগামী হলেও আশপাশের লোকজন তাকেই লক্ষ্য করছে। সোজা কিংবা আড়চোখে দেখতে দেখতে খুলছে ছাতা। উঠছে রিক্সায় কিংবা হাঁটছে ত্বরা করে। তবু লক্ষ্য আছে দিবাকরের দিকে।

 দিবাকরও তাকায় তার আশেপাশে। ভাবে, হয়তো এমনই কৌতুহলী, গল্প … না গল্প নয়, মূলতঃ কূট-কচাল সন্ধানী হতো সে নিজেও যদি সে’ও বেড়ে উঠতো এই বেড়াজাল-যাপনে। আবছা কিছু ছবি তার মনে আসতো। তার কয়েকটি এখন, ক’দিনে, খানিকটা স্পষ্ট হলেও আরো আরো জট খোলা বাকি। কিছু জট খুলবেনা কোনোদিনই। শুধু একটি জট, একটি তথ্য, একটি সত্য …

          যে যাপন-বৃত্তে তার বেড়েওঠা, শেষ পর্যন্ত, ঘটেছিল, সে’ও কি খুব খোলামেলা? ভাবে, যদিবা সে বেড়ে উঠতো, বা যারা বেড়েওঠে, উঠেছে, নগরে, ‘কসমোপলিট্যান’ শব্দের সহায়তায়, তারাই বা ঠিক কতোটা ভিন্ন, আদৌ ভিন্ন এদের চেয়ে? তার মনেহয় ‘নগর’, ‘কসমোপলিট্যান’ ইত্যাদি শব্দের গুমোড়ে বেড়ে উঠলে যা হতো, যা হয়, এমনই কূট-কচাল, অনর্থক কৌতুহল-চারা গজায় চোখের গভীরে তবে দৃষ্টিকে তারা ঢেলে রাখে রং-চশমায় নয়তো আড়চোখে তাকানোর শিল্প-দক্ষতায়।

মনে মনে হাসে দিবাকর। হায়, এই মফস্বল প্রতিটি নতুন মুখের কাছে গল্প খোঁজে, কৌতুহলে। অথচ তারা জানেওনা যে ঠিক কি বিরাট, বিপুল,নিবিড়,গভীর কাহিনীর ফল্গু বয়ে চলেছে তাদেরই এই প্রায়-ঘুমন্ত যাপনের তলে তলে।

 ৪।



 বিষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই উঠলো ঝড়।

 ধূলোবালি, খড়কুটো, ফাঁসা কন্ডোম, ছেঁড়াফাঁরা প্লাস্টিক প্যাকেটে বাতাস হয়ে উঠলো বারুদ। ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেলো ‘সংবাদ বিচিত্রা’র। ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেলো, প্রায় নিমেষে, আশেপাশের সব দোকানের। যেটুকু বাড়তি চাল রেখেছে দোকানগুলি তার তলায় দাঁড়িয়ে মাথা বাঁচানো যায় যদি সহজ, সোজা বৃষ্টি হয়। কিন্তু এ’যে বাস্তবিক কুত্তা-বিল্লী-বিষ্টি। সুতরাং আশ্রয় খুঁজতে হলো দিবাকরকে।

                                 বাজারের সামনেই কবিরাজি ঔষধের সাবেক দোকান। "সাধনা ঔষধালয়"। কিনারে, দ্বিতীয় বন্ধনীতে, লেখা "ঢাকা"। দোতলা কোঠাবাড়ি। একতলার বারান্দায় আর দাঁড়াবার জায়গা নেই। কোনোক্রমে  দোতলায় উঠে এলো ইন্দ্রনাথ। লোক জমেছে সেখানেও। এই আবহেও কৌতুহলী চোখের অভাব নেই।

 কোনোদিকে না তাকিয়ে বারান্দার কোনের দিকে গিয়েই দাঁড়ালো দিবাকর। ওই দিকে বিষ্টির ছাঁট আসে বলে ভিড় নেই। উড়ন্ত ধূলোবালি, খড়কুটো, ফাঁসা কন্ডোম, ছেঁড়াফাঁরা প্লাস্টিক প্যাকেটের গতির বিপরীতে মুখকরে দাঁড়ালো।নীচে তাকালে বাজার দেখাযায়। দেখাযায় বাজারের পেছনে খুশিনদীও। খুশিনদীর ওইপারে আরেক দেশ। বাস্তবিকই আরেক ‘দেশ’। বাংলাদেশ।

           হাতের মুঠোর আবডালে, কায়দা করে বাতাস-বারুদ এড়িয়ে সিগারেট জ্বালানো গেলো। পারদ-কালো মেঘপর্দার নীচে সমস্ত চেনা ছবিও যায় অচেনা হয়ে। আর এই আবহ দিবাকরের অচেনা।  তাই জোর-বাতাসে পাতার পিঠগুলো, যেগুলো বুকের চেয়ে কম সবুজ, সেগুলি নেচে উঠতেই আরো হারিয়ে গেলো দিবাকর। মনেহলো যেন আরেক দেশ। ‘বিদেশ’? মনেহলো কে বেশী বিদেশ? তার সাপেক্ষে? এই যে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে “সাধনা ওউষধালয় (ঢাকা)”র আশ্রয়ে না’কি খুশি নাম্নী নদীর ওপাড়ে, যে দেশ, যা ‘বাংলাদেশ’?

 

তথ্য বলছে এই শহরেই জন্মেছে দিবাকর। আবছা স্মৃতি সাক্ষ্যও দিচ্ছে।  শুধু মাঝখানে কুড়ি-বাইশ বছরের ব্যবধান। সবই প্রায় মুছে গিয়েছিল। হয়তো পুরোটাই মুছে যেতো যদি না …

  যদি সে চলে না যেতো তাহলে এই শহরের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি জানালা, প্রতিটি আকাশটুকরো হতো তার চেনা। এই শহরেই কাটবে তার আরো কয়েকটি দিন। দিন? না সপ্তাহ? না’কি মাস? … তিন চারটি দিন তো কেটে গেলো কোনো সূত্র না পেয়েই। আগামী দিন, সপ্তাহ, মাস কি দেবে তাকে কোনো সূত্র? কোনো ইংগিত অন্তত?

 এই যে এতো এতো অচেনা, কৌতুহলী মুখ তাকে ঘিরে রয়েছে, থাকছে, থাকবে এদের কাছে কি কোনো সূত্র নেই? ইঙ্গিত নেই? ইশারা নেই? তাদের কেউ পারবেনা কিচ্ছু বলতে? মন বলে ‘নিশ্চয় পারবে’। দিবাকর বলে ‘কি প্রশ্ন করবে তুমি? কার কাছে করবে?” মন বলেঃ ‘ বলবে আমি এখানে এসছি আমার খোঁজে। চীৎকার করে বলবে, ওই সিমেন্ট-রেলিং এ দাঁড়িয়ে। বলবে এখানে যারা উপস্থিত, তাহের প্রত্যেককে বলছি …”

 "এখানে কে অভিনয় করতে পারে?"

  চম্‌কে উঠলো দিবাকর। কে বল্লো কথাটি? সে নিজে বল্লো কি? সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল? যদি তাই হয় তাহলেও এই কথাটিতো তার স্বপ্নেও ছিলনা? তাহলে? নিজের ঘোরে নিমগ্ন থাকার নিমিত্ত দিবাকর প্রথমটা লক্ষ্য করলো না,যে, সে একা নয়, চম্‌কে উঠেছে গোটা ভিড়টাই।

  শোনাগেলো, পুনরায়ঃ

 "এখানে কে অভিনয় করতে পারে? একজন ছাড়া? “ চড়া, রাগর সুর।

 “ঐ আঙ্গুর, সে করে অভিনয়। আমরা জলে আঁক কাটি।” এবার সুর একটু মোলায়েম। বিশেষ করে আঙ্গুর শব্দে।

 “শিখিয়ে নেবে। বেণিমাধব চাটুয্যে পাথরে প্রাণ প্রতিষ্টা করতে পারে, কাষ্ঠপুত্তলির চক্ষু উন্মীলন করে দিতে পারে”  এবার আত্মবিশ্বাস।

 “গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানাতে পারে" ...মিশলো ইয়ার্কি। স্বরে। সুরে।

 


                     সক্কলে তাকালো বাক্যগুলির উৎসের দিকে। তারপর সকলেই, যেন এটাই স্বাভাবিক, এইভাবে আবার ফিরলো নিজ নিজ দাঁড়িয়েথাকাতে। দিবাকরও তাকালো। দেখলো ভিড়ের থেকে আলগা হয়ে গিয়ে একটি মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছে সিমেন্টের রেলিং’এ। পরনে লুঙ্গি। হাঁটুর কাছে তুলে বাঁধা। গায়ে শার্ট। সম্ভবতঃ সাদা। মেঘাচ্ছাদিত সন্ধ্যায় খুব স্পষ্ট নয়, অন্তত রঙ। তীক্ষ্ণনাশা মানুষটি দন্ডায়মান। দৃষ্টি শূন্যের দিকে। কাঁধে ঝোলা। মুখে সাদা দাড়ি। সামান্য থেমে তারপর ঐভাবে দাঁড়িয়েই বলে চলে মানুষটিঃ

 “নিশার স্বপনসম তোর এ বারতা,

 রে দূত! অমরবৃন্দ যার ভুজবলে

 কাতর, সে ধনুর্ধরে রাঘব ভিখারী

 বধিল সম্মুখ রণে? ফুলদল দিয়া,

 কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?

 হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি!

 কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?" ...

 থামে মানুষটি। শেষের দিকে যেন তার কন্ঠ হয়েওঠে বাষ্পাচ্ছন্ন। দিবাকর দেখে একমাত্র সে নিজে ছাড়া আর কেউ কিছুই শুনছেনা যেন, যেন শুনতে পাচ্ছেনা। যে যার মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছে আবার। অথচ মানুষটির এই ‘বলা’ তা দিবাকরের চেনা পংক্তির মতো মনে হলেও সে ঠিক মনে আনতে পারছেনা তবে টের পাচ্ছে এই বলার আবডালে আছে সাধনার ইতিহাস। আছে দক্ষতা। মানুষটি পাগল। অবশ্যই। পোশাক, দৃষ্টি, অন্যদের অভিব্যক্তি এবং মানুষটির হঠাৎই রেলিং থেকে নেমে মেঝেতে বসেপড়া, সমস্তটাই জানান দেয় তার পাগলামির। তথাপি …

 কানে আসে কাদের বলাবলি। আর সব বলা কওয়ার হট্টগোল, জল-বাতাসের হাহা ছেঁচে দিবাকর আলগা করে নিতে পারে যেটুকু বার্তালাপ, তা নিম্নরূপ:

  ‘বিশু পাগলা আবার ক্ষেপেছে’

  ‘হ্যাঁ, কিন্তু এখন তো বিষ্টিদিন, জেনারেলি পাগলরা তো গরমকালেই”,

 “পাগল-ছাগল যাই হোক, মেমোরি রে বাবা"

 " তা ঠিক।  ক’দিন আগেই তো, ট্রাফিক পুলিশের ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে প্রায় আধঘন্টা কিসব মুখস্থ বলে গেলো”

 “আর আপনেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলেন? টাইম আছে মশয় আপনের”

 “আরে না। আমি আর পরিতোষ গিয়েছিলাম পরীর দোকানে। ভিড় ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওয়েইট… "

  “আরে, ওসব যাত্রার ডাইলগ। আগে যাত্রা করতো”

 “যাত্রা না, নাটক। মেজোমামা চেনে"

 " ডিফারেন্স কি? আলটিমেটলি স্টেইজে উঠে বক-বকানোই তো"

 " ওই যাত্রা-থিয়েটার করতে গিয়েই কোন এক নটীর প্রেমে পাগল হয়েছে বোকাচোদা”

  “এভাবে বোলো না।  ওর ঘরবাড়ি ভালো, সায় সম্পত্তিও আছে। তাছাড়া ভালো বংশের, বাহ্মন”,

  “ তো, যা না, একটা প্রণাম ঠুকে আয়, পুণ্য হবে”,

 “আরে পাগল হোক, ছাগল হোক, হাজার হোক ব্রাহ্মণ মানুষ ত', ওই জন্যই মসদ্দর-উরিল্লা’র মতো ঢিল-ঢাল ছোঁড়েনা। কোনোদিন কাউকে মারামারি? উঁহু। নো। নেভার। বায়ু চড়লে এমনি যাত্রার ডাইলগ বলে, ব্যস”

 “ তোমার মতে মসদ্দর-উরিল্লা’ও ব্রাহ্মন হলে ঢিল-ঢাল দিতো না?”,

  “ আরে সে কথা বলছি না।  তবে বাঙ্গালদের.. ”

 " তবে কি, এই বিশু বাঙ্গাল হলে… "

 আলোচনা থেকে বিশু পাগল ফেড আউট। পরিবর্তে মুসলমানরা বাস্তবিকই কতোটা খতরনাক সেদিকেই গড়িয়ে গেলো বার্তালাপের জল - যদিও অকুস্থলে উপস্থিত মুসলমান লোকজনও। এই রকমের আলোচনা, প্রকাশ্যে চলাকালে, দিবাকর অন্যত্রও দেখেছে, যে উপস্থিত মুসলমান মানুষজন চুপ মেরে যায়। না শোনার ভান করে চলে যায় স্থান ত্যাগ করে। এখানেও হয়তো ঘটতো এরকমই কিন্তু ঝড়-জলের দাপটে স্থান পরিত্যাগ অসম্ভব। সূর্য্য ডুবে গেছে। বাতাস বওয়া-মাত্র বিজলীও গেছে। ঔষধালয়ের অন্দরে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে জেনারেটার। নাকে আসছে পোড়া তেলের তীব্র গন্ধ আর জেনারেটারের উদাত্ত আওয়াজে ডুবে গেছে সকল রকমের আলাপ-সালাপই।

           ‘বিশু পাগলা’ বসে আছে। বসেই আছে। ঔষধালয়ের ঝাঁপ গ’লে আসছে জেনারেটার-আলোর কয়েকটি ম্লান রেখা। এমনিই একটি রেখাতে চেষ্টা করছে কি একটা বই পড়বার। ঝোলা তার থাকে বইয়ে ভরা।

 চেয়ে থাকে দিবাকর।

 কষ্ট হয় কি?

 মায়া?

 ঠিক কি হয় কেজানে।

 তবে কিছু একটা হয় গহনে। তাই চোখ ফেরাতে পারেনা।

 কত হবে মানুষটির বয়স? ষাট? সত্তর? সত্তর হয়তো না। অন্তত কন্ঠস্বরে তো মনে হয়নি। তবে যদি অভিনেতা হয়ে থাকে মানুষটি তাহলে গলার স্বরে বয়স আন্দাজ করা মুশকিল।  দিবাকর মনে করে, মনে ধরে রাখবার চেষ্টা করে বিশু পাগলার কথাগুলি। না-কি ডায়লগ গুলি? এগুলি যাত্রার সংলাপ? নাটকের? কোন নাটক? কোন যাত্রা? নাটক তো….

 ‘এখানে কে অভিনয় করে, আঙ্গুর?’ ‘আমি বেণিমাধব । পুতুলের চক্ষু গড়ে দিতে পারি’

 ‘নিশার স্বপনসম আমি হারানু তোমা হেন ধনে”...  'ধন' মানে কি সেই আঙ্গুর? সেই নটী? গদ্যে, পদ্যে বলা অংশ-দুটি কি একই নাটকের? আঙ্গুর,বেনিমাধব আর নিশার স্বপনসম এই শব্দ তিনটি যেন…

 যাকে, যাদেরকে এইটুকু সূত্র দিলেই সব বলে দিতে পারতো, তারা তো …

 #

 ঝড় থেমেগিয়ে বিষ্টি নেমে আসে গাঢ় হয়ে। বাজ পড়ে। চোখে ঝিলিক লাগে। তারপরে উড়ে আসে আওয়াজ। বজ্রপাতের।

৫।

 


কালঃ যুবতী-সন্ধ্যা। অর্থাৎ রেডিওতে চাষাবাদের কথা শেষ। আঞ্চলিক সংবাদ চলছে কিংবা আরম্ভ হলো ব’লে। তবে অনুরোধদের আসরের এখনো দেরী আছে।

 সন্ধ্যার ঠিক আগে, যা ত্রিসন্ধ্যা, যখন আজান শেষ হয়, উলুধ্বনি ওঠে, তখন বৃষ্টি নেমেছিল। বেশ কুত্তা-বিল্লী বৃষ্টিই । কুত্তা, মানে বিষ্টি ঝমঝম। বিল্লী, হাওয়া। ঝড়ো হাওয়া। হাওয়ায় হাওয়ায় ঝাড়ু চেপে উড়ে বেড়ানো ডাইনি। নাবিকরা, মাঝিরা নাজেহাল। নাজেহাল ডাঙ্গার সান্ধ্য মাঝি-নাবিকরাও। সান্ধ্য আড্ডার হাতছানি রক্তে বাজে ঝন ঝন। তবু বিষ্টিতে উপায় নেই এক পা বেরোনোর। ছাতা, বর্ষাতি সব বেক্কার। অতএব এই বিষ্টি, এই সকল বিষ্টি ঝাড়ু-বাহন ডাইনীদেরই খেল। তাদেরই কুত্তা বিল্লী। এর দরুনই দেরী করে বসে আড্ডাগুলি। আজ। কিশোরী সন্ধ্যা চাষাবাদের কথায়,আঞ্চলিক সংবাদে – যুবতী।

 

স্থানঃ চা-দোকান। খুশি-নদীর পাড় ঘেঁষে। বড় রাস্তার ধারে। বিজয়িনী বুক স্টল আর দীপ নারায়ণ ট্রেডিং এর মাঝামাঝি। পাকা মেঝে। ছনের চাল। কারেন্ট থাকলে ষাট পাওয়ারের ফিলিপ্স। না থাকলে লণ্ঠন। ঝুলন্ত। যেমন আজ। কাঠের বেঞ্চি। দুইটি। হাতলহীন কাঠের চেয়ার। দুইটি। মাঝারি লোকের কোমর অব্দি উচ্চতার কাঁচ-কাঠের বাক্স। ফনিদা বলেন ‘শো-কেস’। আড্ডা-ছোকরাদের কেউ কেউ বলে ‘শো-পীস্‌’। আর ওই বাক্সের বৈয়াম ক’টি, দুই রকমের দেশী বিস্কুট, এক বৈয়াম ‘কেইক’ আর ‘পপ্‌’কে ‘শো-বিজ্‌’। দোকান কোঠার হাফ্‌-ওয়ালের উপরের অংশে বাঁশের বেড়ায় সিমেন্ট দিয়ে দেওয়াল। ‘আসাম-টাইপ’। দেওয়ালে নানা বছরের ক্যালেন্ডার। অতি-বাম একটি দলের বড়সড় পোস্টারের কিনারেই রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান। আড্ডা-ছোকরাগুলি বলে ‘ফনিদা আমাদের ধর্মেও আছে, জিরাফেও আছে’। ফনিদা টের পান কথাটির কোথাও ইয়ার্কি আছে। কিন্তু ইয়ার্কিটা ঠিক কোথায় ধরতে পারেন না। তাঁর যুগালি দিলীপ। তাঁর হাঁটুর বয়সী। সামনে বকাঝকা করলেও মর্মে দিলীপের প্রতি একটা ভক্তিভাব রয়েছে ফনিদার। দিলীপ বারো ক্লাস অব্দি পড়েছে। সে’ও সাইন্সে। কপালের ফেরে …। হ্যাঁ, খানিকটা মমতাও টের পান ফনিদা দিলীপকে ঘিরে। তাই কথাটার মানে, দিলীপকে, অবশ্যই খানিকটা ঘুড়িয়ে, জিজ্ঞাসা করেও, জবাব পাননি ফনিদা। আরো কায়দা করে এড়িয়ে গিয়েছে দিলীপ।

 

স্থান এই চা-দোকান, ফনিদা’র।

 

পাত্র/পাত্রীঃ এই মুহুর্তে ‘পাত্রী’ কেউ নেই। সকলেই পাত্র। কুড়ি থেকে ত্রিশের কোঠায় বয়স। আরেকটু বেশী বয়সের, চল্লিশ বা পঞ্চাশের ‘পাত্র’ও আছেন এই আড্ডা-খাতায়। তবে আজ, সম্ভবত সান্ধ্য কুত্তা-বিল্লীর নিমিত্তই, অনুপস্থিত। ছোকরা দলের সিনিয়রদের মধ্যেও অনেকেই আজ গরহাজির।

 

                               মঞ্চের যবনিকা উঠে গেছে প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট। এই বিল্লী-কুত্তা বিষ্টিতে আমাদেরো দেরী হয়ে গেলো। আড্ডা তখন ‘বাপ রে কি বৃষ্টিই না দিলো’, ‘ যেন বৃষ্টি না হলে তুই আসতি সবার আগে’, ‘ কাল আবার সেজো জেঠুকে নিয়ে চোখ দেখিয়ে আনা’, ‘ তোর ওই ছাত্রীটি আর এগোলো’, ‘ স্কুটার পাংচার, তাই হেঁটে আসতে হলো, নইলে তোকে তুলে নিতাম’ ইত্যাদি নৈমিত্তিক বাক্যালাপ পেরিয়ে, ক্রমে, বাঁক নিচ্ছে ‘বিশেষ’ দিকে। এই ‘বিশেষ’ বাঁকটিও অবশ্য নৈমিত্তিক। আগে যা’ই থাকুস লোকাল কোনো ঘটনা, রাজনীতি, খেলা, মেয়ে-চর্চা… অবশেষে আড্ডার স্রোতের গতিপথে আসবেই এই ‘বিশেষ’ বাঁক অথবা আড্ডাস্রোত ঘুরে যাবে ওই বাঁকে। আমরা যখন দর্শকাসন নিলাম তখন রথী আরেকটা চারমিনার ধরিয়েছে। অর্থাৎ সে উত্তেজিত। সে’ও নিত্য-কর্মেরই অংশ যদিও। লম্বা টান, সিগারেটটাকে যেন শেষই করে দেবে, টেনে, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রথী বল্লোঃ “ হুঁ। কি আর এমন বাহাদুরি তাতে? অন্যের লেখা। তুমি শুধু স্টেইজে নামিয়ে দিলে। ব্যাস্‌। হোয়ারএস্‌ অরিজিন্যাল কিছু কনসিভ করা…”

 

নীল, যে অন্দরে উত্তেজিত, এখন অথবা অনেক সময়ই, প্রায় রথীরই মতো, তবু বাহ্যিকে সদা শান্ত, স্থির, সে রথীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বল্লোঃ “ বাংলা ভাষায় এখনো যে শতকরা ২ভাগ নাটকও মৌলিক না সে শুধু বাঙ্গালী ছাড়া আর সক্কলের জানা”। আরেকটা ছোটো টান দিয়ে রথী হাতের চারমিনার চালান দিলো নীলকে। হয়তো কিছু বলবে। তবে নীলের বক্তব্য তখনো শেষ হয়নি। সিগারেট নিয়ে, তবু তাতে টান না দিয়েই বল্লোঃ ‘আর কেউ চেষ্টাও করেনা।’

 

রথী। আরে চেষ্টা করবেই কেন? শর্টকাট মারে। বুঝে না বুঝে শেক্সপিয়ার বড়জোর আর নাহলে হয় ওই মনসা নাচ আর ওঝা নাচ ..

 বাবু এদের থেকে বয়সে সামান্য বড়। সাতাশ-আঠাশ। সে না আছে চা’য়ে, না’ত সিগারেটে। মাঝে মাঝে একটা দুটো দেশী বিস্কুট খায় অন্যদের সঙ্গ দিতে। কথা বলে কম। তবে কোনোভাবে একবার তার মুখ খুলে দিতে পারলে …। সেই বাবু এবার বল্লোঃ বেশি হ’লে কোনো কলকাতার সেকেন্ড বা থার্ড গ্রেড কারোর অনুবাদে ব্রেখট থেকে ব্যাকেট ।

 নীল। আসলে যারা গান্ডু তারা অতি করিৎকর্মা আর যেগুলোর মাথায় ঘিলু আছে সব শালা লেজি-র ডিম। এই যে আমাদের মহান সোমক, প্রায় তিন বছর ধরে ‘ব্রাদার্স কারমাজভ’ বঙ্গায়ন ও নাট্যায়ন করছেন …

 সোমক এতোক্ষন নিবিষ্ট ছিল তার চা এবং সিগারেটে।  এবার, যেনবা কিছু বলতেই হবে বলে জানালোঃ “দুটো কথা। একঃ তিন বছর নয়। মাত্র মাস চার আগেই আমি … দুই নম্বর, ‘ব্রাদার্স কারমাজভ’ নয়। ‘ব্রাদার্স কারমাজভ’ থেকে শুধু দুটো সীন।

 রথী। মানলাম মহান নাট্যকার নীলবাবু দিনক্ষণের ভুল করেছেন। কিন্তু প্রিন্স মিশকনের বঙ্গ হয়ে জন্মানোর খবের পর তুইও তো আর কোনো খবরই দিলি না…।

 সোমক এবার আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ে। ধোঁয়া ছাড়ে সিগারেটের। সে’ও আস্তে আস্তে। খানিকটা উদাসও দেখায় কি তাকে? " মিশকিন কারমাজভে কোথায়? সে তো "ইডিয়ট" এ.. "

 " তোর মতো টক রাশিয়ান লিটারেচার, ইট রাশিয়ান লিটারেচার, ব্রিদ দস্তয়েভস্কি তো নই আমরা" - বাবু বলে। স্মিত হেসে।

 কথা অন্য মোড় নিয়ে নিতে পারে টের পেয়ে রথী হাল ধরে: "মৌলিক নাটক কনসিভ করা তো অবশ্যই কঠিন ব্যাপার। তবে …”

 বাবু। ঠিক। তবে নিশিদার মতো প্রোডাকশন … শুধু নিশিদা কেন? অমল সেনের মতো প্রোডাকশন করাও কিন্তু স্রেফ হেলাফেলার ব্যাপার নয়”

 বুদ্ধ।  হ্যাঁ।.. ওরা কিন্তু সব অন্যের নাটকই করেছে।

 রথী। । মানছি করেছে অন্যের লেখা নাটক ওরা স্টেজে তুলেছে। কিন্তু সেই নাটকগুলো কি? সেগুলো কি ওই কলকাত্তাইয়া মনোজ মিত্র দেখে এসে, বোকার মতো কইলকাত্তাইয়া প্রোডাকশান নামানোর ফ্লপ চেষ্টা?  ৩২৫ বার 'মারীচ সংবাদ’, '৫০০ বার ‘শতাব্দীর পদাবলী’ আর দেড় বার ‘পাগলা ঘোড়া’, ৭৫৩ বার " চাক ভাঙ্গা মধু' ‘ত নামায়নি –

 নীল। নামিয়েছে। অমল সেন নামিয়েছে।

 বুদ্ধ, সে’ও রথী-নীলেরই বয়সী,অর্থাৎ তেইশ-চব্বিশ, তবে একটু গা’য়ে গতরে বলে মনেহয় যেন সাতাশ আঠাশ, বলেঃ গিরিশ ঘোষের ‘সিরাজদ্দৌলা'র কথা বলছিস?

 বাবু। ওই একটাই বোধহয় নামকরা নাটক,  যেটা কিছু ফেমাস গ্রুপ করেছে, ওরা নামিয়েছিল। এটা বাদ দিলে আর যা’ই নামিয়েছে সেগুলো আগে কেউ কোথাও করেনি।

 রথী। এটা অবশ্য ঠিকই। শালা, বাঙ্গালী রোবিন্ডনাথ বলে কেত্তন দেয়। রবীন্দ্রনাথের যে "শোধবোধ" বলে একটা নাটক আছে, ক'শালা যে জানে।

 বুদ্ধ। ওই রকম প্রোডাকশন করতে পারার লোকও আর নেই। ওই এক অমল সেন আর ওই নিশিদা…

 রথী। নিশিদা'ত থেকেও নেই। শালা অমল সেনের সিরাজদ্দৌলা'তে সিরাজের রোল, বাব্বা, নিশিদা! সেই ক্লাস নাইনে দেখেছিলাম বোধহয়…

 আলোক, যে বাবুরও সামান্য বয়োজ্যেষ্ঠ, হাসে। স্নেহের হাসি। সিগারেট ধরায়। ইংগিতে ফনিদাকে জানায় আরো এক কাপ ক’রে চা দিতে। অতঃপর বলেঃ “ওহ, তুই তো আবার জুনিয়র।  কিন্তু এমন মুরুব্বিয়ানা করিস যেন সব্বার ঠাকুরদাদা। শোন, আমি দেখেছি নিশিদার সিরাজ। আমি তখন ডিগ্রি পড়ি। চান্দখিরায় করেছিল। শুধু সিরাজ রোল নয় ঐ নাটকে লুৎফাও জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছিল …

 বুদ্ধ। কে করেছিল করেছিল লুৎফা’র রোলটা?

 বাবু। ইশ, আমি জানি। চিনতামও …  ওহ কি যেন নাম ভদ্রমহিলার…

 আলোক। এই মনে পড়েছে। আরে মঞ্জুলা। মঞ্জুলা গুপ্ত।

 বাবু। ইকোনমিকসের প্রভাত গুপ্তর..

 রথী। মাল?

 আলোক। না। বৌ। ওই ভদ্রমহিলাই ত  নিশিদার 'শোধবোধ' এ হিরোইন করেছিল বোধহয়।

  বাবু।  মনে নেই। তবে প্রস্টিটিউট নিয়ে ব্রেখটের একটা নাটক নামিয়েছিল অমল সেন। সেটাতেও ওই মহিলা ফাটিয়ে দিয়েছিল। শালা, যেমন দেখতে, তেমনি এক্টিং।

 নীল। ব্রেখটের কোন নাটক রে রথী?

 রথী। সম্ভবত গুড পিপল না গুড পার্সন অফ সেজুয়ান না সেটজুয়ান। পড়িনি।

 বুদ্ধ। বাংলা অনুবাদ..

 বাবু। সম্ভবত মন্টুদা…  না'কি অমিদা…

 এবার সোমক - যেন সে এখানে থেকেও নেই, থাকেও না কখনোই যেন, তবু থাকেও আবার, আড্ডায়, নাটকেও –--- বলে, আস্তে আস্তে বলে: কিন্তু পরের দিকে, মানে আমরা যখন রেগুলার নাটক দেখতে আরম্ভ করলাম তখন স্টেইজে দেখেছি বলে..

  আলোক। না হে বালক। তোমরা যদ্দিনে লায়েক হয়েছো তদ্দিনে ওরা টাউন ছেড়ে, প্রভাত গুপ্ত বাইরের কোন কলেজে..

 রথী। হুঁ। " মা জননী বসে আছেন, চোখের সামনে খালি / শহরে কাজ নিতে পালায় বলাই বনমালি'। মফস্বলের লাট্য প্রতিভাদের এ'ই হয়। পোচ্ছিম বাংলার অজগ্রামে থেকে তু করে ডাক পেলেই…

 আলোক। না, ঠিক এই কেস না। প্রভাত গুপ্ত লোকটা এসেইছিল বাইরে থেকে। বাবু, তুমিও গুপ্ত'কে কলেজে পাওনি?

 বাবু। নাহ। তোমরাই বোধহয় লাস্ট ব্যাচ।

আলোক। আমরাও পাইনি। প্রবীরদারা পেয়েছিল।

 রথী। আজকাল প্রবীরদাও মনেহয় নিশিদার লাইনে হাঁটতে লেগেছে।

 রথীর স্বরে এবার হাল্কা সুর।

 নীল। নিশিদার লাইন? মানে? প্রবীরদার সঙ্গে আজই দেখা হলো। দুপুরে। কই …

 সোমক। হ্যাঁ, আমিওতো ছিলাম তোর সঙ্গে। কিছুতো –

 রথী। তোদের বলেনি?

 বলে নিয়েই আরেকটা সিগারেট ধরাতে যায় রথী। বাবু বলেঃ “তোর কাঠি এখন আর ধরাস না। আজ ফনিদার টোটাল নো কাস্টমার। শুধু আমাদের জন্য খুলে রেখেছে। দশটা প্রায় বাজতে চল্লো …এবারে না উঠলে

 নীল। আরে দাঁড়াও বাবুদা। দশ মিনিট। কি একটা বলছে রথী প্রবীরদার কথা। শেষ করুক তো –

 আলোক। ফনিদা, তুমি হেভি ভালো লোক।

 ফনিদা চরিত্রটি এতোক্ষন টুলে বসেছিল তার ‘শো-কেসের’ কিনারে। চোখ রাস্তায় থাকলেও কান ছিল, এরা সকলেই জানে, যে, এদের কথাবার্তায়। ফনিদা নিজেও জানে এদের জন্যই সে, আজ শুধু নয়, অন্য আরো অনেক সন্ধ্যা, আর একজন কাস্টমারও জুটবেনা জানা সত্ত্বেও দোকানের ঝাঁপ তোলে। কিন্তু সোমকের দিকে তাকালো এমন চোখে যেন ভস্ম করে ফেলবে।

 আলোক। আজ দিলীপও দেখি সেকেন্ড হাফ কাট্‌ মারলো। তুমিই আরেকটু কষ্ট করো ফনিদা। আমাদের আর একেক কাপ…

 ফনিদা, জলদ গম্ভীর কন্ঠেঃ ‘ফিকা?’

 


আলোক। চলবে।

 এই বার্তালাপের সমান্তরালে চলছিল আরেকটি আলোচনাও। ফলত ফনিদার কান রাখতে হচ্ছিল দুদিকেই। ওই সমান্তরাল আলোচনায় রথী তখন বলছেঃ কে না কে এসেছে। প্রবীরদা কয়েকদিন না কয়েকবার দেখেছে । ব্যস। বিরাট শাসপিশাস…

 

নীল। ওহ, এই ব্যাপার, সে’তো শুধু প্রবীরদা নয়। ওই যে গলা-রাজু …

 

বলে, নিজের স্বরকে স-বিকৃত-মোটা করেঃ ‘একটা মিস্টিরিয়াস ক্যারেকটার এসেছে বানী হোটেলে’, আমাকে বলেছে।

 

আলোক। রাজুটা একটা ছ্যাবলা। ইম্পর্টেন্স পাওয়ার জন্য যা খুশি বলতে পারে ও।

 

রথী। কিন্তু প্রবীরদা তো ছ্যাবলা না। তাই মনেহলো পাগল হয়ে যাচ্ছে।

 

বাবু। আসলে কি জানিস, এই যে আমাদের শহর, মানে চামচিকে-পাখি, এতে লোকের স্বভাবই এ’ই। একটা অচেনা মুখ দেখ দেখলো কি শুরু হয়েগেলো …।

 

রথী। তা ঠিক। ক্লাস … নাহ্‌ এটা ক্লাস নয় “লুক্যাল ক্যারেকটার”। তবে এই  ‘লুক্যাল ইমাজিনেটিভিটি’ টা আমাদের এই ‘লুক্যাল’ ‘শেক্সপীয়া্রের যদি থাকতো তাহলে এদ্দিনে আমাদের রিহার্সেল আরম্ভ হয়ে যেতো …।

 

বুদ্ধ। মানে?

 

নীলের দিকে ফিরে “ কি রে, আমরা রিহার্সেল ধরছি? না’কি ধরছিনা?”

 

নীল। ১০০% ধরছি।

 

এবারে অবশ্য তার স্বরেও উত্তেজনা। তার হাত রথীর সিগারেটের দিকে। তার কন্ঠ বলেঃ “ আমার যদি ক্যান্সার হয় তাহলে এই রথীটার জন্যই হবে। যতো বার সিগারেট ছেড়ে দিই, শালা আবার ধরায় …”

 

রথী। ধরাই মানে? আমি তোকে কি সেধে সেজে দিই নাকি?

 

নীল। তা কেন? নাকের কাছে বসে ফুঁকিস। সেটা আরো ডেঞ্জারাস। পেসিভ। তাই বাধ্য হয়ে আমি এক্টিভ …

 

চা বিতরণ করে ফনিদা।

 

বাবু। তার মানে নীল-বাবুর কলমে কিছু আসছে?

 নীল। এসে গেছে।

 রথী। ট্রাজিডি? সোফোক্লিস না শেক্সপীয়ার? না’কি মার্লো?

 নীল। গাধা। ওসব কিছুনা। এক্কেবারে অন্য রকমের মাল।

 বুদ্ধ। সত্যি? না শালা মই এ ওঠাচ্ছিস, কাল আবার টেনে নিবি?

 নীল। আরে নাহ্‌। সত্যি। একটা সাইন্স ফিকশন ধরনের..

 রথী। সাইন্স ফিকশন? গুড। তোর হবে, আমি বলছি তোর হবে

 নীল। যা হওয়ার তো হয়েই আছে। আর কি হবে?

 রথী। লাট্যকার। লা-ট্য-কার হবিই তুই। এটা কবে পড়াচ্ছিস?

 নীল। জাস্ট আর ৩টা দিন দে।

 অতঃপর আবার নৈমিত্তিক কথাবার্তায় ফিরে যায় চরিত্রেরা।

 কে, কোন রাস্তা ধরে বাড়ি যাবে, কে কাকে কতোটা এগিয়ে দেবে, কাল কখন কার সাথে কার কোথায় দেখা হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। এর আবডালে আবার ফিরে আসে বিল্লী। হাওয়া। বিষ্টি-হাওয়া। আড্ডা ভাঙে পথে বৃষ্টি নামার আশংকায়।

৬।

 

 


 

প্রথমে দুই এক ফোঁটা পড়েছিল। মনে হয়েছিল বাঁশের পাতার থেকে ঝরছে জমা জল। তারপরে বেশ বড় বড় ক’টি ফোঁটা দেখে আকাশে তাকালালেন সল খাঁ এবং উঠে বসলেন, ক্রমে।  ওঠা আর বসা। এই দুই কাজের বাইরে যা আছে … নাহ, তবিয়তে সবসময় মানেনা। তাই শুয়ে বসেই কাটাতে হয় তাঁকে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখে ব্যথা ধরে। তবু চোখের পাত্তি ফেলবার উপায় নেই।

                      আজ প্রায় তিন কুড়ি বচ্ছর ধরে আর কোথাও যান না সরল খাঁ। এখানে, এই ফাটলধরা দেওয়ালে বসে বসেই তাঁর দিনরাত্রি কেটে যায়। তাঁকে ভেদ করে যে আমপিঁপড়ার দল চলে, তাদের যাওয়া দেখেন চেয়ে চেয়ে। দেখেন দেওয়ালের ফাটল থেকে বার হয়ে সাপ চলে গেলো। গেলো আবার ফিরেও এলো মুখে একটা ব্যাঙ নিয়ে। দেখতে পান শ্যামাসুন্দরী ইস্কুলের কেরানীবাবু সময় বাঁচাতে চলেছেন হনহনিয়ে।

           সামনে বিরাট হাওড়। এখন এরা বলে দিঘি। এখন সবই জার্মানীফেনার আর আগাছার কবলে। কিনার ঘেঁষে পথ। উঠেছে বড় সড়কে। কোনাকোনি ক্ষেত। ধানের। আলে আলে টুকরো। আলে আলে ঝগড়া,মারামারি। মাঠের এক ধারে ছোটো যে বাঁধ তাই লোকমুখে ‘বান্ধ’ হয়ে, ক্রমে ‘বন্দ্‌’। ধান উঠে গেলে এর নাম ‘বন্দের মাঠ’। আবার ধানের দিনে শুধু ‘বন্দ্‌’। কিনারে কিনারে সুপারীর গাছ। কোথাও দ্বীপের মতন ছোটো টিলা। কবর। কবরে শায়িতজনকে শীতল রাখতে গাছ কিংবা বাঁশঝাড়। সরল খাঁ দেখেন ছাগল চড়াতে এসে এনামুল ঘুম দেয় সুপারী গাছের ছায়ায়। আসে মাস্টরবাবুর ছেলে ‘ফাগলা স্বপন’। বসে থাকে বাঁশঝাড়ে। কোনোদিন বিকালের দিকে উঠে যায়। কোনো কোনোদিন ওঠেনা। গাছের ছায়া লম্বা থেকে লম্বাতর হয়। বিকালের দিকে বন্দের মাঠে পুলাপানেরা খেলতে আসে।  তারা যখন ফিরে যায় তখন গাছের গা থেকে, ঘাসের গা থেকে, আসে সন্ধ্যার ঘ্রান।

                                       আজান-উলুধ্বনির পরে সন্ধ্যাকে নিয়ে আসে জোনাকিরা। তারাদের মতোই আস্তে আস্তে জ্বলে ওঠে । ঝিঁঝিঁ ডাক হয় স্পষ্টতর। একদুইজন হাট-ফেরতা মানুষ যায়। কেউ কেউ যায় রেডিও বাজিয়ে। কেউ সাইকেলের রডে ঝুলিয়ে নেয় রেডিও। মাঝে মাঝে রেডিওর কোনো কোনো গানে হু হু করে ওঠে সরল খাঁ’র মন। ‘ হলুদিয়া পাখি, সোনারই বরন, পাখিটি ছাড়িল কে’... ওই গানঅলার সঙ্গে তিনি চলেযান কিছু দূর। - এই তাঁর বহুদিনের ভ্রমণ-সীমানা।

   রাত ক্রমে বাড়ে। কমেযায় মানুষের আনাগোনা। দিঘির জলে মাছের ঘাই দেওয়ার শব্দ ওঠে। হিম পরে। বাতাস চন্‌মনে হয়ে ওঠে নানান রান্নার ঘ্রানে। কেউ শুঁটকি পোড়ে, কেউ বেগুন। কেউ ডালে সম্বাস্‌ দেয়। সরল খাঁ’র লোভ হয়। ইচ্ছে করে চলেযান ঐ পাক্‌ঘরগুলিতে। কিন্তু আলস্যে আর যাওয়া হয়না শেষ পর্যন্ত। অথচ তাঁর দুই বিবিরই রান্নার হাত ভালো। আগে দুজনে সারাদিন বাড়িতে কুর্মুস্থুলি দিতো। এখন মিটেমাটে আছে। আছে টিলার ঐপারে। জমি-কাছারি-বাজারের কিনারে। তাই ঐ দিকটা এড়িয়ে চলেন সরল খাঁ। তাঁকে পেলেই দুই বিবি পাকড়ায়। খুলে বসে এ’র তা’র ডেগের গল্প…

  যদিও আমার মতো আরো অনেকেই  জন্মাবধি দেখে আসছে, যে, এই প্রান্তর এমনি ঘাস আর জার্মানী ফেনায় ভরা তবু এর নাম দিঘি। ‘সরল খাঁ’র দিঘি। একদা এই দিঘি নাকি ভরা ছিল টলটলে জল। বর্ষায় শুধু নয়, শীতেও এই দিঘি পার হতে নৌকা লাগতো। দিঘি পার হয়ে পাক্কা রাস্তা। ছোটো নৌকা হলে মাঝিরা ধরাধরি করে ঐ নৌকা নিয়ে যেতো রাস্তা পার করে তারপরে ভাসতো খালে। পার হয়ে নৌকা যেতো নদীতে। সে এক আমলে নাকি সরল খাঁ নিজেই নৌকা চেপে যেতেন নদীর বাঁকে। মধু-গ্রামে। ঈদে। দুর্গাপূজায়।


          ছিলেন সরল খাঁ। নামের মতোই সরল এই মানুষটি জমিদারের চেয়ে কিছু কম ছিলেন না বিষয়-সম্পত্তির হিসাবে। কিন্তু জমিদারগন-হেন ঘৃণিত ছিলেন না তিনি। তাঁর চোখ শাদা ছিলোনা। চোখে খুন ছিল। দয়ামায়া ছিল। এই মাঠ, এই জমি, এই অঞ্চল ছিল তাঁরই। যাননি পাকিস্তানে। তাঁর সাধ্যমতো রুখেছেন মারামারি, খুনাখুনি। তারপর, ধীরে ধীরে আবার সব, ঠিক যেই কে সেই না হলেও, ঠান্ডা হয়ে এলে চলে গেছেন সব ছেড়েছুড়ে। চলে গেছেন তবে সাধু-দরবেশ-ফকির হয়ে নয়। স্রেফ চলে যাওয়ার জন্যই তাঁর যাওয়া। দাবা খেলা ছিল তাঁর একমাত্র নেশা। ছিলেনও দাবাড়ু তুখোড়। একদিন বাজি ধরে ফেললেন তাঁর সমস্ত স্থাবর, অস্থাবর আরেক দাবাড়ুর প্রতিপক্ষে।

হেরে গেলেন।

লোকে বলে হারতেই এই বাজি ধরেছিলেন সরল খাঁ। নাহলে এতো বছরের দাবা খেলায়, জিন্দেগীতে, ‘বাজি’ রাখেননা কোনোদিন। হেরে গেলেন আর হারিয়ে গেলেন সব স্থাবর, অস্থাবর রেখে দিয়ে।

 ৭।

 অনেকেই বলে তাঁর সরলতার কারনে তিনি এই নামটি প্রাপ্ত হয়েছিলেন।মা বাপের দেওয়া নামের খবর আর কেউ রাখেনা। এই বিরাট দিঘি তাঁর সম্পত্তি।   রাত বাড়ে। আকাশে তারা গুলি স্পষ্ট হয়। মাস্টারের ফাগ্‌লা ছেলে বাড়ি না ফিরলে তাকে তাড়া দিয়ে আসেন সরল খাঁ। সামনের অন্ধকার আর উপরের গাঢ় বেগুনীরঙ্গের দিকে চেয়ে চেয়ে পুরোনো কথা মনেহয় তাঁর। তাঁর সারল্যে অভিভূত হয়ে লোকে তাঁর নাম দিয়েছিল ‘সরল’! ‘সরল খাঁ’!

 মনে মনে হাসেন তিনি। নিজেকেই বলতে গিয়ে অভ্যাসবশে মাবুদকে এনে ফেলেন মাঝখানে। “হায় মাবুদ, তুমিই বলো। আমি না’কি ‘সরল’! হায়! আমি সরল তো মোটেই না বরং অন্যদের চেয়ে ঢের বেশী কূটিল। লোকে বলে সরল না হলে কেউ বাজারিঘাটের জমির মামলা না লড়ে ছেড়ে দেয় এমনি এমনি? সরল না হলে কেউ করিমুল্লার সঙ্গে এমন বাজি ধরে? হার খায় দাবাতে, তা’ও করিমুল্লার কাছে? হাঃ হাঃ” … হেসে ওঠেন সরল খাঁ। হায় মাবুদ, লোকগুলো কবে বুঝবে যে তিনি তাঁর বাবাকে মামলা জিতে জিতে জমি বাড়াতে দেখেছেন, দেখেছেন সেই জমিঅলা আব্বার নিঘুম রাত্রি, দিনভর দুশ্চিন্তা। দেখেছেন আব্বার প্যাঁচে জমি হারানো মানুষগুলির নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। তাদের কান্না, অভিশাপ আজো বেজে ওঠে স্মৃতির খোপে, কোঠায়। প্রতিধ্বনি তোলে বন্ধ নয়টি দরজায় ধাক্কা খেয়ে।

 “ এরা বোঝেনা । বোঝেনি নিজের পুলাপানগুলিও। জমির,  দিঘির ভাগাভাগি নিয়ে মামলা লড়ে মরছে!” … সামনের জমেওঠা কুয়াশাকে লক্ষ্য করে বলেন সরল খাঁঃ ‘সব শেষে কিতা? শেষে’ত অই মাটির তলে নাইলে উপরে – কও মাবুদ, কার কি লাভ হলো?একটা আরেকটার উপরে মামলা দিলো আর এই বিরাট দিঘি কার কামো লাগলো?এই দিঘির জল এক সময় ছিল ই-দিকের সবার পানীয়।  আর এখন বেবাক দিঘি ভর্তি জার্মানি ফেনা। ইটা এখন এক জলা। এক কিনারে  ভক্কুরে কচু খেত্‌ করে। জানি ভুক্কুরের অইন্য কারবারো আসে। তাও কিচ্ছু কই না। গরীব মানুষ। বউ-পুলাপান নিয়া খাইয়া থাকুক …’

           এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখে ব্যথা ধরে। তবু চোখের পাত্তি ফেলবার উপায় নেই। হায় আল্লা, ই কি গরদিশ্‌! বাঁধানো সিমেন্টের উপর সরল খাঁ গা ঢালেন। মাস্টরের ফাগ্‌লা ছেলেটা বেশী রাত অব্দি এখানে থাকলে দুশ্চিন্তা হয় আবার চলে গেলে খারাপ লাগে। অন্যেরা ফাগল-ছাগল বল্লে কি, তিনি ত জানেন আসল কথা। কোনো কোনো দিন আলস্য ভেঙ্গে তার সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়ি যান সরল খাঁ। তার মায়ের পাক্‌ঘর থেকে হিন্দু ব্যঞ্জনের ঘ্রান আসে। নিজের মনে বলেন সরল খাঁ- ‘হিন্দুরার রান্দার গন্ধ, মাংস রান্‌লেও একটু অইন্য রকম। রসুন দিলেও অইন্য রকম। খালি শুট্‌কি রান্দার গন্দ্‌ - হিন্দু মুসলমান সবের একরকম ...’

    আস্তে আস্তে সব বাসার বাত্তি নিবে। কুয়াশা পরে। কোনো কোনো রাতে আকাশ তারায় চক্‌চক্‌ করে, কোনো রাতে তারা দেখাই যায়না। তবু উপরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকেন সরল খাঁ। রাতের বাতাস বয়। জোড়া বুড়ো বটের পাতা নড়ে। পাতা ঝরে। যেন সেই পাতাদের আর বাতাসের কাছেই বলেন তিনিঃ ‘আমার ছুটো সময় ই দিঘির মালিক আস্‌লা আমার আব্বা।  মাছ মারতে দিতেন না কাউকে। আপত্তি করতেন জল নিতেও। তবু যাদের নিদান্ত দরকার, তারা ত লুকাইয়া চুরাইয়া নিবেই। তখন মাইর-ধইর-থানা –ফুলিশ –  খালের জল ভালো না। তখন উমেশ শ্যামের শ্যামের পুকইরও ছিল না। যাওয়া লাগত টিলা পার হয়ে জমি-কাছারির পুকুরে...। আমি ছুটো। আমার হাত পা বান্ধা। আব্বার ইন্তেকালের পরেপরেই  সবে রে ডেকে  বল্লাম ‘যার মাছ মারার, মারো। যার জল নেওয়ার নাও। – খালি কাপোড়টা ধুইয়ো না আর সান্‌টা কইরোনা, জল খারাপ হইব, পানীয়-জল থাকতোনা...’

 একটা দীর্ঘশ্বাস বার হয়ে আসতে চায় সরল খাঁ’র। কিন্তু তা অসম্ভব বলেই হয়তো হাওয়া, জলো-হাওয়া, দিঘির হাওয়া, বিষ্টি-মিশানো হাওয়া, তাঁর হাহাকারটিকেই উড়িয়ে নিয়ে ছড়িয়ে দেয়ঃ “হায় মাবুদ, কবে যে এদের সুবুদ্ধি …”

 বাক্যের বাকিটুকু শোনা যায়না।

 বাক্যের বাকিটুকু, বৃষ্টি হয়ে নেমে আসা আকাশের তলায়, যারাই তখনো পথে, রাস্তায় কিংবা বৃষ্টি থামার অপেক্ষার দাঁড়িয়ে বা বসে রয়েছে, তাদেরকে ছুঁয়ে দিয়ে, উড়ে যায়।

 উড়ে চলে যায় ।

 শুধু শুনতে পায়না কেউই।

  ৮।

 


"এখন প্রচারিত হচ্ছে মহাপুরুষদের রচনা থেকে পাঠ । পাঠ করে শোনাচ্ছেন শ্রী শমিত হালদার"।

 

ঘুম আর 'ঘুম থেকে না-ঘুমে' উঠে আসার মাঝখানে থাকে এক সাঁকো। একটি মাত্র বাঁশ ফেলে বানানো সাঁকো। পার হয়ে আসতে কয়েক মুহুর্ত হয়তো। তবু টালমাটাল। ঠিক কোনখানে যে ঘুম-গ্রাম শেষ আর জাগা-শহরের আরম্ভ, যায়না ঠাউর করা। ওই সাঁকোটির কোনোখানে টলোমলো দাঁড়িয়ে সোমক শুনলো ওই ঘোষণা।  ঘুম ভেঙ্গে উঠেই যতিন চালিয়ে দেয় তার চার সেলের ট্রানজিস্টার। তারপর যতক্ষণ না বার হয়ে যায় রিক্সা নিয়ে, চলতে থাকে রেডিও। চলতে থাকে বাচ্চা তিনজনের হুড়োহুড়ি। যতিন আর তার বৌএর দৈনিক ঝগড়া-বচসা। আবহে বেজে চলে রেডিও। অথবা রেডিওর আবহেই চলে আর সমস্ত। অন্তত যতিনের সাপেক্ষে। বেশ কয়েক বছর হলো যতিনরা এসেছে এখানে। সেই আসার প্রথম দিন থেকেই বাজছে তার রেডিও। হপ্তা এখন রথীর মনেহয়  যতিন আদতে জেগেই ওঠে এই রেডিও চালিয়ে দেওয়ার জন্য।   এই রেডিও চালিয়ে দেওয়ার সাধে। আশায়। "অতি তরুণ অবস্থা হইতেই আমার মনে এই প্রশ্ন উদিত হইত, “এ জীবন লইয়া কি করিব?” “লইয়া কি করিতে হয়?” সমস্ত জীবন ইহারই উত্তর খুঁজিয়াছি।"  এই অনুষ্ঠানের নাম  "অমৃতবানী"। এর পরে দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান ।আজ ঘুম থেকে না-ঘুমে আসার সাঁকোটিতে দাঁড়িয়েই সোমক টের পায় যে তার ঐ ‘ভাল্লাগেনা’র রোগটি ফিরছে।

  মাঝে মাঝেই এরকম হয়।

  ভাল্লাগেনা। কিচ্ছু ভাল্লাগেনা।

 সমগ্র অর্থবহ বিশ্ব যেন পালিয়া যায় তাকে একলা রেখে। টিলার উপরে বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে বসে থাকবার জায়গাটা  তার অত পছন্দের সেখানেও ভাল্লাগেনা।

 কিন্তু এই 'ভালো না লাগা'র কোনো কারন থাকেনা। থাকলেও সে টের পায়না। তাই রাগ ওঠে। রাগ ওঠে নিজের উপরেই। এই রাগ সাঙ্ঘাতিক রাগ।

               এই “ভাল্লাগেনা” তার অসুখ বল্লে অসুখ, বন্ধু বল্লে বন্ধু। যদি এই “ভাল্লাগেনা”টা না থাকতো তার, তাহলে সে’কি বিশ্ব সংসার ছেড়ে ছুড়ে এসে দিনের পরে দিন, কখনো রাত্রিও গুজরান করে দিতে সক্ষম হতো এই সরল খাঁ’র দিঘির কিনারে, নীচু টিলায়, বাঁশ ঝাড়ের আব্‌ডালে? নিজেকে কখনো প্রিন্স মিশকিন, পাভেল, রাসকল নিকভ, অপু, জিতু, বিশু পাগল,কখনো দানসা ফকির, কখনো সরল খাঁ বলে ভেবে নিয়ে, ভাবনায় ডুবে গিয়ে, নিজের মনে কথা বলে যেতে পারতো অনর্গল? সর্বসমক্ষে এই সকল চরিত্র হয়ে উঠবার টানেই না এক সময় ঘুর ঘুর করতে আরম্ভ করেছিল রথীদের নাটক-দলের আশেপাশে, আড্ডায়।

 সে'ও আজ অনেক বছরের কথা। ঠিক যেমন এই " ভাল্লাগেনা" অসুখের ইঙ্গিত, সে'ও শেষবার কবে…

 যদি এই " ভাল্লাগেনা" রোগটি ভর না করতো তাহলে না'ত হতো নাটকের দলে ভিড়ে যাওয়া। হতোনা "ভাল্লাগা" ঠিক কাকে বলে তার ইশারাটিও পাওয়া। যাদের সান্নিধ্য তার অন্দর  থেকে বার করে এনেছে প্রায় একজন নতুন মানুষকে, আশ্চর্য, এদের অনেককেই সে আবাল্য দেখলেও, চিনলেও, এরা কেই তার বাল্যবন্ধু নয়। "বাল্যবন্ধু".. শব্দটি নিজের মনে বলে মাঝে মাঝে আর বাঁকা একটা হাসি আপনিই উঠে আসে।

 এই " ভাল্লাগেনা" রোগটি ভর না করলে নিশ্চয় সে’ও যেতো বাজারের আড্ডায়, বাপ্পীর মোটর সাইকেলের পেছনে চেপে ভুম্‌ ডাকিয়ে যেতো ইস্টেশন রোড, নইলে  রঞ্জুর মতন পার্টি করতো, ‘নীরেন দাশ’কে ভুট্‌ দিন, ভুট্‌ দিন’ করে করে পথে পথে ঘুড়ে বেড়াতো নয়তো সুমিতের মতন চাকরি করত, বিয়ে সাদি করে সকাল সন্ধ্যা ছাত্র ঠেঙ্গাতো – বা যা হোক্‌ একটা কিছু করতো যা তাকে উপ্‌ড়ে ফেলতো। উপড়ে ফেলতো এক আশ্চর্য শিকড়ের থেকে।

       "ভাল্লাগেনা" আমলের পরেও ওই দিঘির ধার, নিচু টিলা, বাঁশঝাড় তাকে টানে। সে যায়। সময় সুযোগ পেলেই যায়। বসে থাকে। শুয়ে পড়ে ঘাসে। একেক সময় নিজেকে মনেহয় ঐ বাঁশগাছগুলোর মতনই যেন। যেন তারো শিকড় এখানে গেঁথে বসে গেছে। যেন "ভাল্লাগেনা" রোগেরই নিমিত্ত সেই শিকড় আজো জীবিত। আর…

 আর সরল খাঁ...

         ‘কেন জন্মালাম’ আর ‘না জন্মালে কি হতো’ – এই প্রশ্ন দুইটির একটি মোটামোটি উত্তর তার কাছে আছে। কিন্তু সেই উত্তর হারিয়ে যায়, যেতো, এই "ভাল্লাগেনা" র কুয়াশায়। জাগতো নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলার প্রবণতা। অন্তর-বাহির ঢেকে যেতো অচেনা রঙের কুয়াশায়। ওই কুয়াশা গাঢ় হ'তে হ'তে এমনই প্রাচীর, যে, বাঁশ ঝাড়ের ডাকও সে শুনতে পেতোনা। আর তখনই, ক্রমে, অজান্তেই সে হয়ে যেতো কখনো প্রিন্স মিশকিন, পাভেল, রাসকল নিকভ, অপু, জিতু, বিশু পাগল, কখনো দানসা ফকির, কখনো সরল খাঁ। বলে যেতো তাদের কথা। তাদের মতো। তাদের চোখ দিয়েই দেখতোও যেন।

 তারপর হঠাৎই এক সকালে আবার স-ব ঠিক। মন আবার কাকচক্ষু সরোবর। শান্ত। গভীর। অবলীল নেমে আসা কুয়াশা কেটেও যেতো অনায়াস। তখনো প্রিন্স মিশকিন, পাভেল, রাসকল নিকভ, অপু, জিতু, বিশু পাগল, কখনো দানসা ফকির, কখনো সরল খাঁ তাকে ঘিরে থাকতো। কিন্তু এই ঘিরে থাকার সঙ্গে " ভাল্লাগেনা" ঘিরে থাকার তফাৎ অনেক।

 ঘুম ভেঙ্গে উঠেই মনেহয় এই’যে আলোটুকুকে সে দেখতে পাচ্ছে, এই যে মায়ের রান্নাঘর জুড়ে ছড়ানো কাটা-আনাজের ঘ্রান – এই সমস্তই তার বেঁচে থাকার অর্থ। না মরে যাওয়ার পুরস্কার। মনে আসে টিলার উপরে, তার বাঁশের পাতা কাঁপছে। তাকে ডাকছে। হাওয়া খেলছে তার মাথায়, মগজে। নিজের  অজান্তেই সে তখন ভুলে যায় তার গত কাল অবধি পুড়তে থাকার, “ভাল্লাগেনা”র কথা। আত্মহননেচ্ছার কথা। হননেচ্ছার কথা। বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে হাঁক দেয়ঃ ‘মা, চা  দেও’ –তার এই চীৎকারে মা’ও যেন কিকরে টের পেয়ে যান যে সে এখন ভালো। আপাততঃ ভালো। আবার কবে খারাপ হবে সেই দুর্ভাবনাকে আঁচলে মুছে মা কপালে হাত ঠেকান –“ঠাকুর-ঠাকুর” – তারপরে এনে দেন চা।

 সে চা খায়। উঠে হাগা-পাদা সাড়ে। খালে নেমে ডুবাইয়া স্নান করে। ভাত খায়। চেয়ে খায় ডালভাত। মা’র কাছে আবদার করে রাতে শুটকি বানানোর। টাকু’র দোকান থেকে বিড়ির বান্ডিল নিয়ে টিলায় যায়। যাওয়ার পথে দেখে সুভাষের দোকানের সামনের আড্ডায় জোর তক্কো চলছে ইলেক্‌শান নিয়ে। দেখে সমর পালে’র মেয়ের রিক্সার পেছনে মোটরসাইকেল নিয়ে চলেছে রাণা। দেখে ...

 এই সব দেখাকে পার হয়ে সে চলেযায় একা হেঁটে হেঁটে। উঠেযায় নীচু টিলা বেয়ে। সেখানে সব বাঁশগাছ গুলো তাকে বলেঃ ‘ অদ্দিন কই আস্‌লায় বা?” তখন সে তার ‘ভাল্লাগেনা’ রোগকে আবারো সাধুবাদ জানায়। 

 আবার যখন ‘ভাল্লাগেনা’কে ভালো না লাগার টাইমটা আসে, তখন “ভাল্লাগেনা”কে নিয়ে ভালোথাকার সময়েরর কথা তার মনেই থাকেনা। তখন মনেহয়, হালার বাপ্পী, বাবু, রঞ্জু, সুমিত’দের মতন হলেই বোধহয় ভালো ছিল ... তাদের ত এই ভাল্লাগেনার বা ভাল্লাগের যন্ত্রনা নাই! হেউ ঢেউ নেই! কেন নেই?

 ৯।

 

 

 অনেকেই তাকে ‘ফাগল’ বলে। সে নিজেও নিজেকে পাগল বলেই ভাবতো যদিনা ...

              ঘটনাটি ফিরে ফিরে আসে।আর আশর্য, ঝাপসা থেকে ঝাপসা-তর হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, প্রতিবারই নতুন কিছু খুঁটিনাটি যোগ হয়ে যায়। কোথায়? স্মৃতিতে? না'কি  কৃপন স্মৃতি বিন্দু বিন্দু করে ঝরে?

 ইস্কুল যাওয়ার পথে থানার টিল্লা। আসলে থানাটাই টিল্লার উপরে। টিলার শরীরে বড় বড় ঘাস। ফার্ণ, ঝোপ। জঙ্গলমতন। একেবারে উপরে গাছের বেড়া। তারপরে থানার দেওয়াল।

         ঐ টিল্লা দেখলেই মনে হতো পাহাড়। মনে হতো ঐ টিলা বেয়ে উঠে গেলেই পাওয়া যাবে শংকর কে, চলে যাওয়া যাবে চাঁদের পাহাড়ে। ইচ্ছা সত্ত্বেও ইস্কুল-যাওয়ার সময় টিলা বাওয়ার প্রশ্ন ছিলনা। দেরী করে ক্লাসে গেলে ওয়াসালি স্যারের সাংঘাতিক জালিবেত। যেসব দিনে সে পালাতো ইস্কুল, সেইসব দিনেও, ঝিম ধরা দুপইরা সময়, টিলায় উঠলে তাকে নির্ঘাৎ দেখে ফেলবে কোনো না কোনো চেনা লোক। অতএব ইস্কুল ছুটির পরটাই টিল্লা বাওয়ার মেইন্‌ টাইম্‌। ইস্কুল একটু আগে আগে ছুটি হলে ত আর কথাই নাই। সবার আগে এসে টিল্লা বেয়ে উঠে উপরে বসে থাকতেই হবে তার। ক্লাশের যে ছেলেদের তার পুষায় না তারা ঐ পথে গেলে ঢিল মারার আরেক দায়িত্বও ছিল তার। ক্রমে তার দেখাদেখি আরো কয়টা ছেলেও টিল্লায় ওঠা শিখে নিয়েছিল। তবে ওদের সঙ্গে তার কোনো কথাবার্তা ছিলনা। ছিলনা বিবাদ বচসাও। সে টিলায় উঠে বড়্‌ই গাছের তলায় চুপচাপ বসে  থাকত – এখনো যেমন বসে থাকে বাঁশঝাড়ের ছায়ায়।

 বেশ যাচ্ছিল তার দিনকাল। হঠাৎই মুশকিলে ফেল্‌লেন লীলা মাসী।সোমকদের ইস্কুল, মানে গম্মেন্ট ইস্কুল পার হয়ে, ডানদিকের রাস্তাটা ধরে একটু গেলেই মেয়ে-ইস্কুল। লীলামাসী সেখানে দিদিমনি। মা’র বন্ধু। আগে থাকতেন অন্য পাড়ায়। ক’দিন হল তালগাছঅলা বাড়িটাতে ভাড়া এসেছেন। তাঁর আবার বান্ধা রিস্কা আছে। চালক মতিদা। সকালে ইস্কুলে দিয়েযায়। বিকালে আনে।

 সেদিনও ইস্কুল ছুটির পরে সোমক জোর পায়ে আসছিল হেঁটে। বাকিরা আসার আগেই গিয়ে উঠে পরতে হবে টিল্লায়। দখল নিতে হবে নিজের গাছতলার। এর মধ্যেই লীলামাসী তাঁর রিস্কা নিয়ে এসে হাজির। “সোম-নি'রে, আইয়, আমার লগে রিস্কাত যাইবে গিয়া’। সে চম্‌কায়। প্রথমে। তারপরে বিরক্ত হয়। এ’ত মহা ঝামেলা। কই সে এখন টিল্লায়, তার গাছতলায় গিয়ে বসবে, তারপরে ঠিক করবে আজ সে রবিন্‌সন্‌ ক্রুশো না গালিভার না’কি জিম করবেট – কাটিয়ে দেবে ঘন্টাখানেক সময়- তারপরে আস্তে আস্তে নামবে, বাকি সব ছেলেরা চলে গেলে, খালি রাস্তা। রাস্তা থেকে একটা ভালো পাত্থর বার করে নিয়ে লাত্থি দিতে দিতে সেই পাত্থরসহ বাড়ি যাওয়া তার –তা’না, এখন লীলামাসীর সঙ্গে উঠো রিস্কায়। তাঁর হাজার হাজার প্রশ্নের জবাব দাও! –তা’ও প্রথমদিন কিচ্ছু না বলে সে উঠে পরেছিল। পরে মনে হয়েছে ঐ ওঠাটাই তার ভুল হয়েছিল।

 এরকম গেলো দিন দুয়েক। সে ইস্কুল থেকে বার হয়ে আসে। টিলার দিকে হাঁটে। পেছন থেকে লীলামাসী এসে হাজির হন তাঁর বান্ধা রিস্কা নিয়ে। তাকে তুলে নেন। তারপর বাজে বক্‌তে বক্‌তে বাকি রাস্তা ...

 তখন  বার করলো আরেক বুদ্ধি। ইস্কুল ছুটি হলে সে বারহয় না। গৌরাঙ্গদার দোকানের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে লীলামাসীর যাওয়া। বান্ধা রিস্কায়। লীলামাসী তল্লাট ছেড়ে গেলে সে বারহয়। যদিও তখন অন্য পুলাপানেরা উঠে গেছে টিলায় তবু তার গাছতলায় কেউ বসেনা। সে টিল্লায় ওঠে। বসে তার গাছতলায়। এই ব্যবস্থাও মন্দ না।  এই ব্যবস্থায় নির্বিঘ্নে চলে আরো দিন দুই।  সেদিন মনেহয় লীলামাসীরো দেরী হয়েছিল। বেশ কতসময় গৌরাঙ্গদার দোকানের পিছনে দাঁড়িয়েও যখন দেখলো লীলামাসীর বান্ধা রিস্কা আসেনা, সে মনোকরলো তবে মাসী আজ আসেননি ইস্কুলে। সে মহা ফুর্তিতে রওয়ানা দিলো টিল্লার দিকে।

 টিল্লায় খালি উঠতে যাবে তখনি লীলামাসীঃ ‘বাবা সোম, তর্‌ও আইজ দেরী দেখি, আইয়’ – বলেই রিস্কা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরেন লীলামাসী।

 ‘আমি অখন যাইতাম নায়, পরে যাইমু’

 ‘আর কত পরে বে? ইস্কুল ছুটির এক ঘন্টা হইগেল’

 ‘তুমি যাও, আমি অখন যাইতাম না’

 ‘আইয় বাবা, আর দেরী করিস্‌ না’

 হঠাৎই মাথায় আগুন লেগে গেলো তার। হালা, দেরী করে ইস্কুল থেকে বার হয়েও  এই বেটির হাত থেকে রক্ষা নাই! দাঁড়াও! রাস্তা থেকে পাত্থর তুলে এক ঢিল। লীলামাসীকে নয়। রিস্কাকে। ‘তুমি যাও, আমি যাইতাম নায়’। লীলামাসী  ভড়কে গেলেন। ‘কিতা হইল বে তর?’

 ‘কিচ্ছুনা। কইসিনু যাইতাম না- তুমি যাও’ – আরেক ঢিল ...

 মতি রিস্কাঅলা বলে ‘থাকুক, ইগু ফাগল, দিদি চলইন’ –

 মতির রিক্সা চলে গেলো লীলামাসীকে নিয়ে।

 গল্পটাও ছড়িয়ে গেলো অচিরেই। জুটে গেলো 'পাগল' শব্দটি। না চাইতেই।

      "উত্তর খুঁজিতে খুঁজিতে জীবন প্রায় কাটিয়া গিয়াছে। অনেক প্রকার লোক-প্রচলিত উত্তর পাইয়াছি, তাহার সত্যাসত্য নিরূপণ জন্য অনেক ভোগ ভুগিয়াছি, অনেক কষ্ট পাইয়াছি।"

 "অমৃতবাণী" চলছে। পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়তে গিয়েও শোয়না। আধশোয়া হয়ে, বিড়ির বদলে, একটা সিগারেট জ্বালায়। মাথায় শিরা গুলি সামান্য দপদপ করে।

 তবে কি এত বছর পার করে আবার ফিরছে তার "ভাল্লাগেনা" রোগ? "অমৃতবাণী" জানান দেয়: "এ প্রশ্নের এই উত্তর পাইয়াছি।" - মৃদু হাসির রেখা, যা এক রকম ব্যঙ্গেরই, খেলে যায় রথীর ঠোঁটে। সিগারেটে জোর টান দিতে দিতে শোনে "ইহাই যথার্থ উত্তর, আর সকল উত্তর অযথার্থ। লোকের সমস্ত জীবনের পরিশ্রমের এই শেষ ফল; এই এক মাত্র সুফল"।

       মাথায় শিরার দপদপানি বেড়ে যায় যেন। সোমক  বলে "এই শালা বাঙ্গালী মহাপুরুষদের এই এক ঝামেলা। "জীবন লইয়া কি করিব", কে কার জীবন নিয়ে কি করবে, তাতে তোর কি রে?- এর উত্তরও ওঁরা ওদের নোট বইয়ে লিখে রেখে গেছে..."

 

 

 

[ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে অরিজিৎ আদিত্য সম্পাদিত ‘দৈনিক বার্তালিপি’ তে। প্রতি রবিবারে। প্রকাশের পরবর্তী রবিবারে এখানেও প্রচারিত হবে প্রকাশিত পর্ব গুলি। ক্রমে। -- সপ্তর্ষি বিশ্বাস ]

 

 

 

ঘুম ঘর