ঢেকে যাওয়া তারা, ঝরে যাওয়া বালি
নানান অনুষঙ্গেই মনে আসে “মেঘে ঢাকা তারা”, কেননা “মেঘে ঢাকা তারা” র আবহের দেশভাগ আর তজ্জনিত উদ্বাস্তুত্ব, ক্রমে, চিরন্তন প্রতিমা। ক্রমে প্রমাণিত, যে, পুঁজি-বিশ্বে পুঁজি-বৃত্তের বাইরের সকলেই উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তু অশোকমিত্রনের “বালু” গল্পের সরোজাও, ঋত্বিকের নীতার…না নীতার চেয়েও নিঃস্ব সরোজা। কাল-স্থানের যে বিন্দুতে নীতা, সেই বিন্দুতে বিশ্বব্যাপী হাহাকারের মূল্যে ইতিহাসের শিরায় পালা বদলের সম্ভাবনা — আদর্শবাদ থেকে মার্ক্সবাদ —- সকল সৃষ্টিশীল উন্মাদনায় শামিল হতে প্রস্তুত হচ্ছিল ঐতিহাসিক কারনেই। পালাবদলের যে নিদর্শন গুলি ৭০ এ বিশ্বের নানা মানচিত্রে নানাভাবে অবয়ব নিয়েছিল, এই সকলের সূত্র ৪৭-৪৮ সালে নিহিত ছিলনা কি? না থাকলে ৬৩ সালে কেন ছবিটি করবেন ঋত্বিক আর কীভাবে নীতার পিতা তারনবাবু হেন চরিত্রই থাবতে তা'তে? পক্ষান্তরে এক দশক পরে লিখিত অশোকমিত্রনের “বালু” গল্পের সরোজার পিতা, তার নিজের ভাষাতেই “inert as a doll” সতত। অসহায়, অক্ষম হলেও নীতার পিতার ছিল স্নেহ,ছিল দৈনন্দিন-কুশাংকুর কে অগ্রাহ্য করবার মনন। এক ভ্রাতা, নীতারও, সরোজার এক ভ্রাতা হেন — আখের গুছিয়ে পলাতক। ভগিনী-ভাগ্যেওও, সামান্য তারতম্য সহ, নীতা-সরোজা,এক। কিন্তু দাদা, নীতার, ছিল বাস্তবিক। পক্ষান্তরে সরোজা'র দাদাও, একই সংসারে থেকেও, পলাতক। সরোজার ‘someone has to stay back in every house.' উচ্চারণে, আপাত ভাবে সে তার নিজেকেই ইঙ্গিত করলেও, মাতৃবিয়োগান্তে, এই বাসায়, পালাক্রমে প্রত্যেকেই সেই ‘‘someone’ যে ‘has to stay back in every house.'। কেননা সরোজা'র কাল-স্থান অবস্থানে house যদিবা কারো কারো জুটে যায় কিন্তু home বিলুপ্ত। বিলুপ্ত পালাবদলের ঐতিহাসিক আবহ। ঠিক যেন “মেঘে ঢাকা তারা” য় পিতাজনের “দ্যাখ, মইধ্যবিত্ত জীবন যাত্রার মান কুন চড়ায় গিয়া ঠেকে” বাক্যের উদাহরণ। সরোজার পরিবার। সরোজাদের পরিবার। কোনোমতে খেয়েপড়ে, কোনো মাসে শো পাঁচেক ব্যাংকে — পরিবার। জীবনযাত্রা যেহেতু মনকেও বোঝায়, ফলে যাপন-মানের তলানির অর্থ মনেরও তলানো। অতএব “মেঘে ঢাকা তারা” র মরণ বাসর ঘরের ডাক না আসা অবধি নীতা ঘরেই থাকে আর সরোজা ঘরের, বালুর ঘরের মতো, আমূল বিনষ্ট হওয়াকে অনুধাবন করে তবু সেই বালি-ঘর সূত্রেই নিজের “পিসী” হওয়ার বাসি খবরে, বালি-বাসার সকল বালি-আসবাব, বালির ঠাকুর দেবতাকে, ধোয়ামোছা করবার অন্তে বাসা'র বা'র হয়। তবে এই বার হওয়াও বাসা ভাঙ্গারই নামান্তর। বিদ্রোহ এখানে বিপ্লবের ডাক দেয়না। বালির মানুষের বালি-শরীর গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ঝরে যায় “সুন্দরম পার্ক” এর আন্ধারে।
ভেঙ্গে গুঁড়োগুঁড়ো অন্যরাও —- বাবা, দাদা। পলাতক ভ্রাতা ও অন্য ভগিনীরাও কি নয় এমনই? বালি? ধূলি? গুঁড়োগুঁড়ো? —- অবশ্যই। তথাপি আর সকলের গুঁড়িয়ে যাওয়ার চাপও এসে পড়ে সরোজাতে। সরোজা হেন আইবুড়ি দিগে। এরাই তো, রক্তে-মাংসে ‘has to stay back in every house.' —- এ'ই মা'রা, কন্যারা, ভগিনীরা।
কাল-স্থানের এই বিন্দতে এসে পৌঁছালে, নিশ্চিত, নীতাও যেতো “That man from Mohan Photo Studio” র কাছে, যেতো “তারাত্ব” ছিঁড়ে, যেতো ধূলি হয়ে, বালি হয়ে।
যেতো না কি?
[“Sand and other stories”, ASHOKAMITRAN
Translated from the Tamil by N. KALYAN RAMAN and GOMATHI NARAYANAN ]