একানড়ে'র এলকেমি
এমা বোভারি স্বপ্ন দেখতো একটি জাহাজের। তার যাপনের উৎসবহীন বন্দরে একদিন এসে ভিড়বে একটি উৎসব-ভরা জাহাজ। মাদাম বোভারি-কথা'র অন্তে আমরা দেখেছি ডুবে যাওয়া। জাহাজের নয়। জাহাজ-স্বপ্নে মশগুল এমা'র। পক্ষান্তরে মরিস দ্যুদো জানতো একদা ঘটবে একটি অঘটন। এক আশ্চর্য অঘটন যা তারও যাপনকে দেবে নতুন প্রচ্ছদ। আরম্ভে মরিস দ্যুদো’র যে যাপনের ঝলক —- যবনিকা তুলে নয়, চাবি-ফুটায় চোখ রেখে — আমাদের দেখান সিমোনো, তা আড়ম্বরের না হলেও নিরুৎসব নয়। তা বরং খচিত নিজস্ব, গোপন উৎসবে, উদযাপনে। সে সকল উদযাপন উপলক্ষের একটি মরিস দ্যুদো'র ওই স্বপ্ন,নাকি প্রত্যয়, যে একদা ঘটবে, ঘটবেই এক আশ্চর্য অঘটন যা তার যাপনকে দেবে নতুন প্রচ্ছদ। কি রকম হবে সেই প্রচ্ছদ? নতুন নিজস্ব, গোপন উৎসবে, উদযাপনে খচিত? নাকি ছেঁড়াফাড়া? — জানতে না জানতেই ঘটে যায় কাঙ্খিত অঘটনটি। ঘটে যায় এবং যেহেতু কাঙ্ক্ষিত, তাই থেকে যায় একটি সন্দেহও, যে, এটি ঘটে গেলো না'কি ঘটালো মরিস দ্যুদো নিজেই? — যা ঘটলো, যা'ই ঘটলো, সিমোনের প্রোটগোনিস্টদের নিরিখে সতত এই খটকাটুকু থেকেই যায় — ঘটলো নাকি ঘটতে দিলো, ঘটতে দেওয়া হলো? The Man Who Watched The Trains Go by’ র Kees Popinga, The Mahé Circle এ . François Mahe… প্রতি সিমোনো-কাহনের প্রতিটি কেন্দ্রজনের ক্ষেত্রেই, অন্তিমে, পাঠিকা-পাঠক-চিন্তায় সিমোনো উসকে দেন এই প্রশ্নটি — যা ঘটলো তা'কি নির্বিকল্প না'কি ঘটতে দেওয়া হলো? অনেক অনেক সম্ভাবনার থেকে এই সম্ভাবনার হাতেই ন্যস্ত করা হলো নিজেকে? ন্যস্ত করা হলো —- যদি স্ব-অবচেতন-ইচ্ছায়, তথাপি এ'ই নির্বাচন, এই নিজেকে ন্যস্ত করা, কতোটুকু প্রকৃতই ব্যক্তিটির স্ব-অবচেতন-ইচ্ছা আর কতোটুকু বাধ্যতা? বাধ্যতা ভিতু বিড়ালনির কোনঠাসা হ'তে হ'তে হ'তে হ'তে, শেষে আঁচড়ে দেওয়ার “choice”? এবং এর মূল্যে থ্যাঁতলে যাওয়া থানইঁটে? এই বাধ্যতামূলক “ইচ্ছা”র একপ্রান্তে
"Dirty Snow" কাহনের সদ্য-প্রাপ্তবয়স্ক কেন্দ্রচরিত্র Frank Friedmaier’এর ফাঁসীসেল, আরপ্রান্তে, জেল-দেওয়াল পার হয়ে, দূরে, অনেক দূরে, প্রায় অবাস্তব-হেন দূরে, শস্তা বহুতলের একটি জানালা – যেন আকাশেই … “ The window over there, beyond the gym or assembly hall, stayed open longer.”
সেখানেঃ “ One time he could make out from the woman’s movements that she was ironing. And there had been another time that was wonderful, and completely unexpected. Probably because she was taking advantage of the warmer weather to do her spring-cleaning, the window had stayed open for more than two hours!” যাপনের নিতান্ত সাধারণ, হয়তো বা তুচ্ছও, ছবি-টুকরোগুলি – উনিশ বছর বয়সেই হত্যা-দায়ে ফাঁসি ঝুলিতে যাওয়া ফ্রাঙ্কের সাপেক্ষে – ছায়া,ছবি-ছায়া,ছায়াছবি। যে ছবি গুলি সহজেই ভাস্কর্য হ'তে পারতো ফ্রাংকের নিজের যাপনে। কিন্তু হলো না। হলো না কেননা জীবন আরম্ভ হওয়ার আগেই “খুনী” হয়েগেল ফ্রাংক।
হয়েগেলো স্ব ইচ্ছায়? নাকি বাধ্য হলো হয়ে যেতে?
যদি বাধ্য হয়ে থাকে, তবে কে, তবে কি —- সেই বাধ্যতার নির্মাতা?
আকাশ-জানালার নারীটিকে ফ্রাংক চেনেনা। “ He hadn’t really seen her, but it didn’t matter: she was beautiful!”
কিভাবে সে জানে, যে, নারীটি সুন্দরী? নারীটি সুন্দরী কারন “ Somewhere in town there was a man who went to work every day knowing that in the evening she’d be waiting for him, with their child in its cradle, their bed that smelled of them.” — আহ, মায়া! মোম-পুতুলের মতো মায়া! এর অর্থ হয়, যে, আড্ডায় নিজেকে সর্বজ্ঞ দাবী-করা এবং একদা একটি ফুল-মার্ডার এবং কিছু হাফ-মার্ডারের মূল্যে অন্যরাও যাকে মেনে নিয়েছে সর্বজ্ঞ বলেই, সেই Timo আদতে জানেনা। কিছুই জানেনা। তবু সেই Timo’র চোখে কিছু একটা হতে চাওয়ার..। নাহ, এ'ও হয়তো ঠিক বলা নয়। এখানেও চলে আসছে “কারন” শব্দ, “because” শব্দ আর ফ্রাংক জেনেছে, অন্তত এখন, যেঃ “Timo only knew pieces of the truth—ready-made truths, like the ones you read in the papers.” জানে, জেনেছে, এ-ওঃ “ because was always wrong”
তথাপি, জীবনানন্দের স্বরেই যেন “আমরা দন্ডিত হয়ে” দেখি, দেখে যাই “ Because. Because.” —- এই “because, because” কখনো "words, words" হয়ে, কখনো "tomorrow, tomorrow " হয়ে বেজে যায় আমার গহনে। ফ্রাংক টের পায় “ His whole life he’d seen people going wrong with their becauses.” — আর এই টের পাওয়ার আবডালে জমাট হয়, তীক্ষ্ণ হয় প্রশ্ন, তীব্র হয় দ্বন্দ্ব — স্ব-ইচ্ছা বনাম বাধ্যতামূলক ইচ্ছার। — আমাদের ইচ্ছাকেও, শ্রমজাত তৈজস টি থেকে শ্রম করা মানুষটির মতোই, আমাদের নিকট থেকে আলগা করে নিয়েছে পুঁজি'র, লোভের লাভের “সভ্যতা”। আরো অনেক মাত্রার সঙ্গে সিমোনো-রচনার একটি মাত্রা এ'ও, যে, এরা প্রত্যেকে কার্ল মার্ক্সের “Economic and Philosophic Manuscripts of 1844” এর Alienation ধারণার একেকটি রক্ত মাংসের তথা রক্তান্ত উদাহরণ।
ফিরে যাই মরিস দ্যুদো'তে, ফিরে যাই “A New Lease of Life” উপন্যাসে যার আরম্ভেই জানা যায় প্রোটাগনিস্ট-জনের মর্মকথা “He had expected a disaster for so long – and a disaster that happened just precisely at a moment like that – that he felt no terror and so to speak no surprise. If he felt a certain inner astonishment, it was that having imagined the most complicated events he found himself faced with an ordinary news item, the sort you read in the papers every day.”
এই অঘটন- আকাংখা'র কোনো সংশ্রব রয়েছে কি সেই ‘'সর্বনাশের” যায় “আশায় সকল নিয়ে বসে” থাকা যায়? কিংবা সেই “তীব্র দহনের” যার মূল্যে জড় ধূপ জীবন্ত গন্ধ ঢালতে সক্ষম? দীপ, আলো দিতে? অথবা সেই ঝড়ের যা দুয়ার ভেঙ্গে ঘর'কে মিলিয়ে দেয় বাহিরের সঙ্গে? নিয়ে আসে দূরের স্পর্শ, স্পন্দন? —- না। যে অঘটন- আকাংখা'র কথা শুনি সিমোনো'তে, শুনি যাদের মর্মকথা — তারা অক্ষম তেমন সর্বনাশকে ধারনা করতে যে সর্বনাশ ঘরকে মিলিয়ে দেয় পথে, পথকে করে তোলে পথিক। পুঁজি সভ্যতার অন্তর্গত Alienation মানুষকে, মানব কে অক্ষম করে দিয়েছে, দিচ্ছে, দেবে —- যাতে তেমন বিরাট আকুতিও আর সে টের পাবেনা মর্মে। এই সকল বিচ্ছিন্ন, টুকরো মানুষ নিয়ে “আউটসাইডার” মার্কা কাঁদুনি, সার্ত্রে মার্কা বাঁকা বুলির ফাঁকা দর্শন, হায়, প্রতিদিন লিখিত হচ্ছে —- যা আদতে এই পুঁজি সভ্যতারই চোরা ইস্তাহার। দস্তয়েভস্কি, অংশত টলস্টয়ের পরে টুকরো মানুষের টুকরো হয়ে যাওয়ার, হতে থাকবার অন্তর্গত চোরা কান্নাকে প্রকৃত শিল্প-রূপ দিতে সক্ষম মুষ্টিমেয় দিগের প্রধান, আমার মর্মে, অবশ্যই সিমোনো। বহুদূর সফল অবশ্যই মুদিয়ানো। সামান্য ভিন্নার্থে গ্রাহাম গ্রীন। অবশ্যই হেমিংওয়ে। হেমিংওয়ে সরাসরি আমার মনে এসেছেন এই সিমোনো গ্রন্থে। যথাস্থানে চেষ্টা নেবো সামান্য বিস্তারের। আপাতত মরিস দ্যুদো'র অঘটন- আকাংখা'র একটি সূত্র, সিমোনোরই, পূর্বাহ্নে আলোচিত “Dirty Snow” বা “The Snow was dirty” থেকেঃ The true reason, the only one, was perhaps that he didn’t want to be set free, didn’t want to return to everyone else’s life.” — এখানে “he” বলতে ফ্রাংক। তবে নিছক ফ্রাংকই নয়। এখানে রয়েছে মরিস দ্যুদো, রয়েছি আমি নিজে, রয়েছেন, হে পাঠিকা-পাঠক, আপনারাও। রয়েছে সেই একানড়ে মৃত্যু বিলাস যাকে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের নামে চালিয়ে দিয়েছে, বাজারে, পুঁজিবাদ। ছলে বলে কৌশলে মানুষের মর্ম থেকে গোষ্ঠী বদ্ধতার ধারণাকে উপড়ে ফেলা'ই, নিজ বাণিজ্য-স্বার্থে, পুঁজিবাদের অমোঘ প্তয়োজন। ফলে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য’র নামে পুঁজিবাদ যা রটায় তা একানড়েত্ব। “আমার ইচ্ছা” নামে, এইভাবে, আমরা যা পরিপাক করি, প্রচার করি, তা বাধ্যতা। যে বাধ্যতার হেজিমনি আদতে একানড়ে নির্মাণের এলকেমি। পুঁজিতন্ত্রের মুমূর্ষু মুহুর্তে যা তার একমাত্র দাবাই।
অঘটন- কাঙ্খী মরিস দ্যুদো'র জীবনে কিভাবে ও ঠিক কি অঘটন নেমে আসে তা, গো পাঠিকা, হে পাঠক, অনুরোধ করি, জেনে নিন গ্রন্থটি পাঠ করে। শুধু এইটুকু বলি, যে, হাসপাতাল-কোঠাটি থেকে বার আসবার, তথাকথিত অর্থে “সুস্থ” হয়ে উঠবার সাপেক্ষে মরিস দ্যুদো'র অবস্থান, হয় এইরূপঃ “ preferred to stay still in bed and look
at the room lit by the gentle light that he had long called his buoy.” – এই অবস্থানের সঙ্গে সদ্য বয়োঃপ্রাপ্ত ফ্রাংকের সেল-কোঠা তথা ফাঁসি যাওয়ার “ইচ্ছা” র যোগাযোগ টি, হে পাঠিকা-পাঠক, দেখেছি আগেই। এইবারে ফিরে দেখা যাক সেই অতি খ্যাত, পঠিত সেই ছোট্ট গল্পটিকে, যেখানে এক রাত্রি-কাফে'তে, রাত্রি গভীরতর হলেও, অন্য খরিদ্দার রা বিদায় নিলেও উঠে যায় না এক বৃদ্ধ-বধির খরিদ্দার আর যার ফলে দোকান বন্ধ করে বাড়িমুখো হতে পারেনা দুই ওয়েটার-জনও, যাদের মধ্যে বয়োকনিষ্ঠটি নববিবাহিত এবং এর দেরীর নিমিত্ত বিরক্ত। পক্ষান্তরে তুলনামূলক বয়স্ক যে ওয়েটার-জন, সে, ওই বৃদ্ধ-বধির, রাত গভীরতর হতে থাকলেও উঠে যেতে না চাওয়া খরিদ্দার-জনের একাকীত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল…। হ্যাঁ হেমিংওয়ে'র “A Clean, Well-Lighted Place” গল্পটির কথাই বলছি।… হে পাঠিকা-পাঠক, মনে আছে কি হেমিংওয়ে সুলভ — নিতান্ত প্রয়োজনীয় বাক্যাংশ তবু যারা একেকটি উপন্যাসেরই ইঙ্গিতবহ - ওই অংশটি, অবশেষে বৃদ্ধ-বধির খরিদ্দারটি উঠে গেলে দোকানের বাত্তি নিবিয়ে তুলনামূলক বয়স্ক যে ওয়েটার-জনের স্বগতোক্তি হেন ভাবনা অথবা ভাবনা হেন স্বগতোক্তিঃ “... It was the light of course but it is necessary that the place be clean and pleasant. You do not want music.” কিন্তু কেন দরকার এই অপ্রাকৃত আলোর? বাত্তির? যাদেরই দরকার, যার'ই দরকার — তারা ভয় পায়। নিশ্চিত ভয় পায় অন্ধকারে। প্রাকৃত, স্বাভাবিক অন্ধকারেও। কিন্তু কেন? “What did he fear? It was not a fear or dread. It was a nothing that he knew too well.”
Nothing – কারন “ a man was a nothing too. It was only that and light was all it needed and a certain cleanness and order. Some lived in it and never felt it but he knew it…”.. যে গৃহের নয়, স্নিগ্ধ নয়, যে পরিচ্ছন্নতা, যে শৃঙ্খলা স্বাভাবিক নয় – কেননা স্নিগ্ধতা, স্বাভাবিকতা পুরো মানুষের, পূর্ণ মানুষের — যে মানুষ পূর্ণ সমাজের —- তারই শুধু, তাদেরই শুধু — শান্তির, যাপনের নিমিত্ত। কিন্তু এই যে টুকরো সমাজের টুকরো টুকরো মানুষ, এই যে উৎপাদন আর বন্টনের অহরহ অমিমাংসিত দ্বন্দকে ঢেকে রাখবার, চেপে রাখবার নিমিত্ত যতোটুকু দরকার ততোটুকু সমাজ, যার একদিকে গাজা আরেকদিকে তথাগত'র মুচকি হাসি, সেখানে প্রত্যেকেই টুকরো। টুকরো টুকরো। সেখানে
“A clean, well-lighted café was a very different thing.” – হে পাঠিকা-পাঠক, শহরের, নগরের, গঞ্জের ATM কোঠাগুলির যে উজ্জ্বলতা, যে শান্তি — এমনই অবাস্তব আলো আর শান্তির ভিতরে ঢুকে আদতে পলায়ন চেষ্টা, নিজের কাছ থেকে, নিজ আবহের কাছ থেকে, অতীত, ভবিষ্যত, ইতিহাস — সমস্তর কাছ থেকে। জেল-কোঠা, হাসপাতাল-বিছনা, কৃত্রিম শৃঙ্খলায় দীপ্যমান বার, ক্যাফে, ম্যাসেজপার্লার খোপ — সমস্তই আদতে টুকরো টুকরো মানুষের নিজস্ব ব্যারিকেড চেষ্টা যা হেমিংওয়ের গল্পের বয়স্ক ওয়েটার-জনের ভাষায়… না… পরিভাষায় “… it's probably only insomnia. Many must have it.”
… “ many must have it…” – এবং তা'ই সত্য। কিন্তু এই নিপুন-নির্মীত ইনসমনিয়ায় আক্রান্তরা যদি কোনো জাদুতে, কোনোদিন বসেপড়ে এক টেবিলে, তাহলে? তাহলেই নিজ নিজ খন্ডতার মূল্যে দেখা দিতে পারে সম্ভবনা। সম্ভাবনা চেষ্টার। টুকরো টুকরো মানুষ বানানোর, একানড়ে বানানোর — এলকেমিকে চিনে ফেলবার চেষ্টার, তাকেই টুকরো করে দেওয়ার চেষ্টার। — এই সম্ভাবনাকে মুহুর্মুহু খুন করতে চাওয়াই পুঁজিতন্ত্রের বীজমন্ত্র, তার টিঁকে থাকবার বীজমন্ত্র। পুঁজিতন্ত্র-পীড়িত এই মুক-মুখ গুলির যাতনা-কাহনের আবডালে যাতনার উৎসটিকে চিহ্নিত করা — আমার মর্মে, সিমোনোর এই গ্রন্থ “ A New Lease of life”, পুঁজিতন্ত্র-পীড়িত এই মুক-মুখ গুলির যাতনা-কাহনের আবডালে যাতনার উৎসটিকে চিহ্নিত করা — আমার মর্মে, সিমোনোর প্রতিটি গ্রন্থের প্রত্যেকটি যতি ও অক্ষর।
.