"আমি যে পথ চিনি না”
যে রেলগাড়ী কোথাও যায় না, আসেওনা কোনোখান থেকে — শুধু থামে, শুধু চলে –লোক ওঠে, লোক নামে — তেমনি এক রেলগাড়ী থেকে কেউ নামলো। নামলো এমনই এক গঞ্জে, মফস্বলে যেখানে রাত নিজেই ঘুম যায় ঘড়ি-কাঁটা ন'টা না ছুঁতেই। এই দৃশ্যে সে নামলো ন’টা সামান্য পার করেই। মানচিত্রে প্রায় না-থাকা ভূগোলের প্রায় নিঝুম পিচ সড়ক, কিনারে কিনারে ঝিম-ধরা লাইটপোস্ট, ঝাঁপ আধাখোলা দোকান-দাকান, পার হয়ে বাসাবাড়ি-পাড়া — ঝিঁঝিডাক, নিভে আসা নামতা-আওয়াজ —- তা'ও পার হয়ে — না আদৌ “সহজ পাঠ” থেকে উঠে আসা নয়, অদূরেই উঠতে থাকা নগরের উঠবার কাঁচামাল জোগান দিতে দিতে দেউলিয়া হ'তে থাকা, দেউলিয়া হ'তে হ'তে একদিন বিকিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা —
মাঠ-মেঠোপথ —- কাদা, বাঁশ-সাঁকো — দেখা যায় দেড়-দুইটি চল্লিশ পাওয়ার বাল্ব। কিছুটা এগিয়ে যেতেই ভেসে আসে গান। বয়স্ক তবু সুরেলা, পুরুষ কন্ঠের গান। অন্দরে গেলে দেখা যায়, যেন “গুরুদক্ষিণা” অথবা কখনো সুখেন দাস নামের কোনো পরিচালক-কৃত সিনেমাতে, যেন বৃদ্ধ কালী ব্যানার্জী। অশীতি-পার তবু যেন নন অশীতিপর। সামনে হারমোনিয়াম। রীডে আঙ্গুল গুলি, শিরা বারকরা হলেও, চলনে নিখুঁত। যে গানটিতে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেলো তার আরম্ভেরও আরম্ভে সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোনো একটি ছেলে বলছে, এখনো বয়ঃসন্ধি তে দাঁড়ানো এক মেয়েকে, যে, তার ছুটি ফুরিয়েছে। কলেজ-কেলাস আরম্ভ হলো বলে। বলছে ওই মেয়ের কন্ঠের গানেই তার সকাল হয়েছিল। সন্ধ্যা হোক তারই গানে। কিন্তু এ গান যেন না হয় মেয়েটির নৈমিত্তিক ব্রাহ্ম-প্রার্থনার গান। ১৯৬৭ সালে যে গানটি গাইলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় তা'ই গীত হয়েছিল শতবছর আগে দেবী আঙ্গুরবালার কন্ঠে। ১৯৬৭ সালে “ছুটি” ছবিতে এই গান গীত হলো যে চরিত্রের কন্ঠে, কাহিনির সমাপ্তি তারই অকালমৃত্যুতে আর অদ্য আমি যে মানুষটির, যাঁর কন্ঠের মুখামুখি দাঁড়িয়ে আমূল কম্পিত, আজ, তাঁর কন্ঠে
“তোমারই উপর করিনু নির্ভর, তোমা ছাড়া কারো জানিনা” — শ্রবণমাত্র গানের “তুমি” টি হয়ে ওঠে মৃত্যু। মৃত্যু, কিন্তু না'ত সে “শ্যাম সমান”, না বিভীষিকা। এখানে মৃত্যু এক বিয়োগ-ইঙ্গিত তবু বিয়োগও নয় যেন।
ইউটিউবে “আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা” সন্ধান করতে গিয়ে এই ভিডিও, এই বৃদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ। ভিডিওটি কয়েক বচ্ছর আগের আপলোড। জানিনা অদ্য গায়কজন জীবিত কি'না। এই গায়কজন জীবিত কি'না। তবে এমন একা, একলা, অশীতি-পেরোনো তবু অশীতিপর নয় গায়িকাজন, গায়কজন অনেক অনেক, অনেক অনেক মানচিত্র-হীন ভূগোলে, অনেক নগরনাভিতে জীবিত। ভাবি, গানটির আবহ এই গায়কজনের সাপেক্ষে। ভাবি, গানটির আবহ এহেন আরো গায়িকা-গায়কজনের সাপেক্ষে। ভাবি, এই গান কি উঠে আসে কোনো স্মৃতি নিয়ে? কি রকমের, কি রঙ্গের, ঘ্রাণের স্মৃতি? গ্রাম্য, লাজুক বাসর রাতের? কলেজ অনুষ্ঠানে গীত হওয়ার? শ্মশান-কবরিস্তানের অদূরে দাঁড়ানো জীবন্ত অন্ধকারের? নাকি যে দিনগুলি, যে রাত্রিগুলি আর ফিরবেনা, যারা বিযুক্ত, যাদের বিয়োগ ঘটে গিয়েছে —- যাপন থেকে, তবু জীবন থেকে নয় — তাই ইহজীবন পার হয়ে গিয়ে —- সেই সকল দিনরাত্রি, সেই সকল সখা সখী — “ছুটি” ছায়াছবির প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল যেমন, যেমন “অগ্নিশ্বর”, দিনগত যাপনের নিকটতম সঙ্গী-সঙ্গিনী —- ফিরে পাওয়ার? নাকি বৃদ্ধ গায়কজন যখন ক্যামেরায়, তখনই, আবডালে, উইংসের আন্ধারে, চোখ থেকে জল গড়ায় আরো একজনের? “আজ হতে তুমি হৃদয়ের রাজা” অথবা “রানী” — নিতান্ত শস্তা এই বাক্যটিও ভিন্ন ভাবে মনেহয় অর্থবহ। যায় পার হয়ে “তোমারই আমি করিব গো পূজা” বাক্যাংশের পূজা শব্দের আবডালে কোনো ব্রাহ্ম, ব্রাহ্মণ, খৃশ্চান, মুসলমান — ঈশ্বর, দেবতা, অতিপ্রাকৃত ইঙ্গিত থেকে থাকলে, তাকে। পার হয়ে, আসে, ফের মৃত্যুশীল, হাড্ডিমাংসের মানুষের নিকটেই। তাই মানুষের প্রেম, প্রীতি, মমতা সকলই অপূর্ণ —- বিচ্ছেদের ছায়াপাত না ঘটলে।
ভাবি, “জীবন এতো ছোটো ক্যানে” প্রশ্নের সঙ্গে মুহুর্মুহু নিরুত্তর পরিচিত হয়েও আমি, আমরা, কেন পারিনি, পারিনা বিচ্ছেদের, বিয়োগের বৃত্তে গিয়ে হাহাকার করবার আগে, একবার অন্তত, তাদেরকে, শুধুই তাদেরকে, যারা আমাদের নিজ নিজ “জীবন” শব্দের অক্ষরহেন, তাদেরো বলতে “এসো, হাত ধরো”। বলতে “ আমি যে পথ চিনিনা”।
===