এখনই “আনন্দঋতু”
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
উৎসর্গঃ শ্রী অনির্বান
ধরিত্রীপুত্র
আলাপ
১।
‘যখন আনন্দঋতু শেষ হয়ে আসে
দিবাজ্ঞান নিশাজ্ঞান সকলি হারায়’
‘যখন আনন্দঋতু’ অনির্বান ধরিত্রীপুত্র
এই ঋতু আনন্দের ঋতু, সকল ঋতুই আনে
শেষহীন আনন্দ-বারতা
এই সত্য প্রতিদিন জানি, তাই
আমার আনন্দ-গল্প সহজ স্বাধীন –
রীতি নীতি ধ্যানযোগহীন।
এই ঋতু আনন্দের ঋতু, সকল ঋতুই আনে
শেষহীন আনন্দ-বারতা
এ আনন্দ জেনেছি বলেই ব্যথাহত,
নই মৃত আনন্দ-ব্যাখ্যাতা।
২।
‘সব প্রশ্ন মুছে দাও হে দেবতা, তোমার আলোয়’
যাত্রামন্ত্র, অনির্বান ধরিত্রীপুত্র
প্রশ্ন আছে মর্মে তাই আনন্দও আছে।
কেননা প্রশ্নই শুধু জীবনের প্রকৃত যমজ।
সেই কথা জানে যম। জানে নচিকেতা।
হে দেবতা, দোহাই তোমার, প্রশ্নগুলি মুছে দিয়ে তুমি
আমাকে করোনা হত্যা নাবালক অর্জুনের মতো।
প্রশ্ন দাও, হে দেবতা, চেতনায় আরো দাও ক্ষত –
৩।
‘যাতনা অন্তরে থাক্ বাহির করোনা’
‘যখন আনন্দঋতু’ অনির্বান ধরিত্রীপুত্র
যাতনা রয়েছে মর্মে, বাহিরেও, তাই
আনন্দ রয়েছে মর্মে, বাহিরেও, তবু
ভিতর বাহির জুড়ে প্রশ্নগুলি উজ্জীবিত আছে –
উত্তরে শূন্য দেবে কেউ হয়তোবা
তবুও আমাকে
উদ্যাপন করে যেতে হবে
প্রশ্নটিকে - যেভাবে মজুর
দিন শেষে মদ খায়, গোল হয়ে, ভাঁটির কিনারে,
মাতাল মুহুর্ত্তে তারা ভুলে যেতে পারে
বৌ’এর আলসার, ঋণ, পাপ-পুণ্য,বানানো ব্যর্থতা –
টের পেয়ে আনন্দিত উদ্যাপনে বসে পড়ি পাশে
ঘাসের শরীরে রাখি মর্মগত প্রশ্নগুলি আর
হুইট্ম্যান দেহ নিয় দূরের বাতাসে
উদ্যাপন করে যান আবারো নিজেকে ...
৩।
ভোরবেলা নেশা কাটলে আবারো মজুর তারা।
গরীব দেহাতী। বৌ’এর আলসার পেটে।মেয়ে বেশ্যা।
ছেলে জেলে। ভাই গেছে বাড়ি ছেড়ে চলে ...
এই ভেবে ব্যথা পাই। আনন্দের বোনটিকে ডাকি –
নাম তার করুণা। লাজুক। সে এসে কিনারে
বসে পড়ে এইসব বাজে পোড়া সত্য ঈশ্বরের।
কাঁধে হাত রাখে, বলেঃ ‘ জেনো কোনোদিন
তোমরাও আনন্দিত হবে। আসিবে সুদিন ...’
সারারাত মর্মে জাগে সেই মুখগুলি,
অভিশপ্ত, ব্যর্থ, দাহ্য, মূর্খ, অসহায় –
এইসব মুখ দেখে ভেঙ্গেপরা নিবিড় ক্রন্দনে
অর্ধরাতে , সে’ও, হায়, আনন্দেরি দায় ...
৪।
আনন্দকে যে ছুঁয়েছে সেই লেখে বেদনার কথা
আনন্দের ক্ষতগুলি প্রাণে বাজে বলে
আনন্দ-তত্ত্বে তার বিরাগ অপার
অশ্রুই আনন্দ তার, ব্যথা নীরবতা –
৫।
এখনই আনন্দ-ঋতু , সব পথই মনে মনে নদী –
আনন্দই দুঃখকথা, বলি, শোনো যদি ...
বিস্তার
১।
কোমরে প্রবল ব্যথা। দুর্ঘটনা। বাসে যেতে ভেঙ্গেছে
পাঁজর।
তবু বিছানায় শুয়ে, কোমরে বালিশ গুঁজে সারারাত জাগি।
লিখেরাখি অকাজের এইসব কথা ও অক্ষর –
অক্ষর-ক্রীড়ায় মেতে ভুলে যাই ব্যথা ও পাঁজর ...
এই ভুলেথাকা ছাড়া আনন্দের ঠিকানা জানিনা,
জানি আনন্দিত তাই যোগধ্যানহেন কোনো বানানো ব্যায়াম
কোনোকালে
আমার হবেনা।।
২।
ধ্যান যোগ আমার হবেনা।
কেন হবে? আমি কি সে অভিশপ্ত যারা
আনন্দের গৃহটি চেনেনা?
খুঁজে ফেরে প্রত্নলিপি ঘেঁটে
আনন্দ-ফসিল, ভ্রম, ধাঁধা ...
ধ্যান যোগ আমার হবেনা
কেননা এ নাগরিক জানালারো পারে
যে আকাশ আজো নীল সে আমাকে ছেড়ে
কোনোদিন কোথাও যাবেনা –
আমার টেবিলে বসে চোখ বন্ধ করে
সে আকাশ দেখি মনে মনে –
সে আকাশ সঙ্গে চলে
যখন নিশীথে খুঁজি
শুড়িদের বাড়ির ঠিকানা
এ আমার নিরীশ্বর আনন্দের ঋতু,
ঈশ্বর কড়িকাঠে ফাঁসি দেয়ও যদি
এই ঋতু কভু ফুরাবেনা ...
৩।
অসময়ে ফোন বাজে সাইরেনের মতো।
নারী কন্ঠ। ইমার্জেন্সি। হাত কেঁপে ওঠে।
ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি ছুটেছে হোটেলে।
অজানা হোটেল কক্ষে মৃত তার চিরচেনা নারী।
হাতব্যাগে ঠিকানা। রুমাল।
অন্যহাতে শাদা ফুল। এখন ঝরেছে।
অজানা হোটেল কক্ষে কিকরে এসেছে লাশ
এ নারীর? যে বিগত দশ বছর ধরে
তার চেনা? নিভৃত ঘরনী?
কেন কাল রাত্রে সে’ই ঘরেতে ফেরেনি?
হতভাগ্য এ নায়ক। ভাগ্যহীনা এ নায়িকা। মৃতা।
আমি ওই হতভাগ্য নায়কের সাথে
মদ খাই শস্তা বারে বসে।
ক্রমে সে মাতাল হয়। ক্রমে খুলে যায়
বেদনার গুপ্ত কথামুখ।
ক্রমে ক্রমে ভার তার থাকে নেমে যেতে।
তার এ আনন্দটুকু নিজহাতে ছুঁয়ে
আমিও মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরি রাতে।
গৃহবন্দী আনন্দের টোটেম শিকারী
আনন্দের এ ঠিকানা তুমি
কোনোরূপ ব্যায়ামে পাবেনা।
৪।
আনন্দ-শিকারী,জ্ঞানী, বলেছেন ছাপার অক্ষরেঃ
‘আনন্দ বারতা শুধু ভারতীয় যোগী ঋষি জানে –
অন্য কেউ কিছুই জানেনা’ –
হতভাগ্য ‘জ্ঞানী’ ঐ বুড়োকে চেনেনা
যার সাথে সারারাত মিসৌরির তীরে
ঘুরে ঘুরে কেটে গেছে আমার রজনী।
লক্ষ ডলার অর্ক অপরের বৌ’ঝি কে দিয়ে
নিঝুম মার্কিন রাত্রে সে এখন একা বাঁশিওলা।
ভারতের শিলচর থেকে বাঁশ কিনে এনে
বানায় বাঁশের বাঁশি। বাজায় আর বেচে।
বেঁচে থাকে সেই মূল্যে। মাঝে মাঝে মেয়ে ভাড়া করে
মোটেলে কাটায় রাত। ‘সেন্ট্ লুইস্ স্ট্রীপ্বার্’
থেকে
সে আমার সঙ্গী ছিল বহু বহু নিদ্রাহীন রাতে।
আনন্দ ছুঁয়েছে তার ছোটো সেই বাঁশির ঠিকানা –
এখনই আনন্দ-ঋতু শুধু সেই আনন্দ-ভিখিরী একা জানে।
আমরা সংজ্ঞা জানি। জলজ্যান্ত নমুনা জানিনা।
৫।
আমরা সংজ্ঞা জানি। জলজ্যান্ত নমুনা জানিনা।
এখনই আনন্দ-ঋতু , সব পথই মনে মনে নদী –
আনন্দই দুঃখকথা, বলি, শোনো যদি ...
পাঁচজন দলে ছিল। তিনজন ‘বাবু’ পেয়ে
আনন্দিত, চলে গেছে ঝোপের আড়ালে।
দুইজন বেশ্যা বোন এখনো দাঁড়িয়ে।
আমার আনন্দ আমি তাদেরো গহনে
সংক্রামিত করে দেবো বলে
হাত ধরি দুজনেরি, মাঠে অন্ধকারে
তাদের কিনারে শুয়ে দেখি মেঘ, দেখি তারা, দেখি ছায়াপথ
–
পকেট উপুড় করে তাদের দুপায়ে ঢালি সমূহ সম্বল,
বাপের ওষুধ আর ছেলেটির দুধ
কেনার সুরাহা হলে আনন্দিত তারা যায়,
চলে যায় আনন্দের স্পষ্ট গৃহপথে।
তাদের আনন্দ ছুঁয়ে আনন্দিত আমি
নিশি নগরের পথে একা যেতে যেতে
টের পাই আনন্দের রীতি নেই, নীতি নেই
ভোরে উঠে ছাদে যাওয়া, পায়চারী, ধ্যান যোগ নেই –
সব ঋতু, সব মাস আনন্দেরি, তাই
আনন্দের চক্রে কোনো পঞ্জিকার মলমাস নাই।
অন্তরা
১।
আনন্দের রীতি নেই নীতি নেই
ভোরে উঠে ছাদে যাওয়া, ধ্যান যোগ নেই –
তাই বুঝি কেউ কেউ আনন্দ ভিখিরী হয়,
আনন্দিত ভিখিরীও, আর
কেউ কেউ তথ্যে তত্ত্বে আনন্দ-শিকারী,
আমি,হায়, জানিনা কেন যে
নিরানন্দ মুখগুলি ছাড়া আমার পরম নেই,
আমার প্রেরণা নেই, নেই মুক্তি, ধ্যান,পরকাল –
প্রতিটি মুহুর্ত্ত তাই আমার ধ্যানের লগ্ন,
প্রতিটি সকালই তাই
আমর অন্তর্গত যোগের সকাল।
২।
আমার আনন্দ-উৎসে জানা নেই আছে কি’না নিরাকার-সাকার
ঈশ্বর,
আমার আনন্দ তার পথে যেতে মুহুর্মুহু নিজের ঈশ্বর
গড়ে, ভাঙ্গে, হাসে কাঁদে, লাথি দিয়ে ছেড়ে চলে যায়
কখনো ঈশ্বর তাকে, কখনো বা সে’ই, দেবতাকে –
নীরবে অক্ষর হয়ে ক্রমে ক্রমে লেখা হয় সেই ছবিগুলি –
বেদনার রঙ্গে ধৌত,আনন্দের সরল কাকলী।
আমার আনন্দ জানে ঈশ্বর যতোটা সত্য তারো চেয়ে বেশী
সত্য
এইক্ষনে লিখে চলা এ খাতায় এই ক’টি মাটির অঙ্গুলী।
সমাপ্ত
১২/০২/২০১৩ - ২৭/০৩/২০১৩, বেঙ্গালোর