“আলোয় ঢাকা অন্ধকার, ঘন্টা বাজে …”
“সুপরিচিত সাংবাদিক ও টেলিভিশন তারকা মারিউশ এফ.-এর বিরুদ্ধে একটি গাড়ি দুর্ঘটনার অভিযোগ হেতু তাঁকে গতকাল রাত্রে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। উক্ত দুর্ঘটনায় এক অন্তঃসত্তা তরুণীর মৃত্যু হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, যে, মারিউশ এফ.-এর রক্ত এবং শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষায় অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যালকোহল এবং অন্যান্য পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। … তদন্ত সাপেক্ষে মারিউশ এফ.-কে জামিন দেওয়া হয়েছে। আমরা তাঁর নিজের মন্তব্যের জন্য এখনো তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি”। সংবাদ। টেলিভিশনে। এই সংবাদ আমরা যখন শুনছি, দেখছি তখন আমাদের সঙ্গে উপস্থিত Kuba Nitecki (Jacek) আর Pazina (Maria Pazińska)। কুবা সেই যুবক, যে আগের রাত্রে, দুর্ঘটনার অব্যবহিত আগেই “সুপরিচিত সাংবাদিক ও টেলিভিশন তারকা মারিউশ এফ” এর আস্তানায় হাজির হয়ে তাকে বিক্রি করে আসে কোকেন ইত্যাদি ড্রাগ। এই “সুপরিচিত সাংবাদিক ও টেলিভিশন তারকা মারিউশ এফ.” হয় ড্রাগ “রিটেলার” কুবা’র এক পুরনো এবং সাচ্চা খরিদ্দার। পাজিনা, সেই রাত্রে, ছিল কুবে’র সঙ্গেই। কুবে যখন “সুপরিচিত সাংবাদিক ও টেলিভিশন তারকা”র আস্তানায় বাণিজ্যে রত, তখন, নিচে, তারকার ফ্ল্যাটের বাইরে পাজিনা বসে আছে কুবে’র গাড়িতে। পরের সকালে, এই খবর শুনেছ পাজিনা। ছুটে এসেছে কুবে’র ফ্ল্যাটে, যেখানে কুবে একাই থাকে, খবরটি দিতে। এই খবর দেওয়া নেওয়ার অন্দরে অবশ্যই আছে তাদের আত্মরক্ষার প্রশ্ন এবং তজ্জনিত ভীতি। মিশে আছে এক রকমের অপরাধবোধও। এই অপরাধবোধ আমার মনে আনে আরেকটি পুরুষ-নারী জুড়িকেঃ Joseph Lambert আর Edmonde Pampin।
জোসেফ, তার সেক্রেটারি পাম্মিনের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু দিন। এক বিকালে গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে, মূলত জোসেফের উত্তেজনা বাঁধ ভাঙ্গে। সে পাম্পিনের …। মুহুর্তের বে-খেয়াল নিমিত্ত গাড়িটি রাস্তার মাঝখানেই ঘুরে যায় আর ফলে উলটো দিক থেকে আসা স্কুলবাসটি হয় দুর্ঘটনার শিকার। বাসটি একটি দেওয়ালে ধাক্কা কায়। ফলে আগুন ধরে যায় বাসটিতে। প্রাণ যায় একাধিক বালকবালিকার। অন্তিমে দুটি কাহনের অভিমুখ ভিন্ন হলেও জোসেফ আর পাম্পিনের অন্দরেও তাদের আত্মরক্ষার প্রশ্ন এবং তজ্জনিত ভীতি। মিশে আছে অপরাধবোধ।
জোসেফ-পাম্পিন জর্জ সিমোনোর "The Accomplices" (Les Complices, 1956) উপন্যাসের যাদের বসত ফ্রান্সের কোনো মফস্বল শহর। কাহিনীর চালচিত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফ্রান্স। কুবে-পাজিনা’র আবহ Warsaw, সময় – এই সময়। Jakub Żulczyk এর উপন্যাস Blinded by the Lights এর প্রকাশকাল ২০১৪ সাল। দুটি কাহিনীর কাল, চরিত্র, লেখনভঙ্গি দুই কালের, দুই স্থানের দুইজন লেখকের মতোই, ভিন্ন। তবে যা ভিন্ন নয়, তা এই, যে, যাদের কে লেফাফা সেঁটে করে দেওয়া হয় ‘অপরাধী’ তাদেরো অন্দরে থেকে যাওয়া নিরপরাধ মানুষটি, মানুষগুলি। যা ভিন্ন নয় তা এ’ও যে, যা নিতান্ত দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটে যাওয়া ‘দুর্ঘটনা’, তার আবডালে কোথাও থেকে যায় ঘটিয়ে ফেলার দায়। ড্রাগ রিটেলার কুবে কি জানতো না, প্রথম দিন থেকেই, যে, তার জীবিকা সক্ষম এই রকমের অসংখ্য দুর্গটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জন্ম দিতে? স্টিয়ারিং হুইলে এক হাত রেখে অন্য হাত পাম্পিনের তলায় চালান করে দেওয়ার মুহুর্তেই জোসেফও কি মেনে নেয়না দুর্গটনার সম্ভাবনা? – অবচেতনে নিশ্চয় নেয়। তবু চেতনা তাকে দোষারোপ করে।
লেখক জ্যাকুবের জন্ম ১৯৮৪ সালে। এই তরুন পোলিশ লেখকজন পেশায় সাংবাদিক। তবে নিতান্ত ‘সাংবাদিক’, “ঔপন্যাসিক” গোছের নিরামিষে তাঁকে চিনতে যাওয়াটা ভুল হবে। ২০২০ সালের নভেম্বরের এক সন্ধ্যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরপরই,যখন সারা বিশ্ব জো বাইডেনকে বিজয়ী হিসেবে দেখে নিয়ে নাচানাচি দিয়েছিল আরম্ভ করে, তখন পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ডুডা একটি টুইট করেন যা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে—যার মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও চিত্রনাট্যকার জুলচিকও। ডুডার বার্তাটি ছিল অস্বাভাবিকভাবে সতর্কতামূলক; তিনি বাইডেনকে কেবল একটি "সফল প্রচারণার" জন্য অভিনন্দন জানান এবং দাবি করেন যে তিনি ইলেক্টোরাল কলেজের "মনোনয়নের" জন্য অপেক্ষা করছেন। আমেরিকান রাজনীতি নিয়ে রীতিমতো পন্ডিত জ্যাকুব তখুনি ফেসবুকে স্পষ্ট লিখে দিলেন, যে, মার্কিন ব্যবস্থায় এমন কোনো "মনোনয়ন" এর কথা কোথাও নেই। তিনটি স্পষ্ট শব্দে জ্যাকুব রায় দেন: "আন্দ্রেজ ডুডা একজন নির্বোধ।" এর কয়েক মাস পরে, ২০২১ সালের ২৩শে মার্চ, ওয়ারশ জেলা প্রসিকিউটরের কার্যালয় পোল্যান্ডের বিতর্কিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অধীনে আনুষ্ঠানিকভাবে জ্যাকুবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তদ্দেশীয় দণ্ডবিধির ১৩৫ ধারায়,, যার সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড।
গল্পটি অবশেষে ২০২৩ সালের মে মাসে পোল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্টে শেষ হয়। সর্বোচ্চ আদালত জানায়,যে, জ্যাকুবের পোস্ট কঠোর বা আপত্তিকর ভাষায় হলেও একজন নাগরিক হিসেবে তাঁর সেই অধিকার আছে এবং তা স্বীকার করা একজন নেতার অহং রক্ষা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অবশেষে মুক্তি পান জ্যাকুব জুলচিক । এ’ও মনে রাখতে হবে, যে, তাঁর উপন্যাস Czarne Słońce (The Black Sun) র বিষয় ফ্যাসিবাদী ধর্মতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান। এই উপন্যাস রূপকের ভিত্তিতে আদতে দক্ষিণপথা আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-দুর্নীতির, যে ক্ষমতা খোলা বাজারের নামে পুঁজিবাদের অবাধ, অগাধ শোষনের, তারই সমালোচনা, তাকেই আক্রমণ।
অতএব, গো পাঠিকা, হে পাঠক, এহেন জ্যাকুবের উপন্যাস সমকালীন রাজনীতি তে না গিয়ে, এড়িয়ে গিয়ে পাঠ করলে, ‘থ্রিল’ হয়তো পাওয়া যায়, দর্শন ইত্যাদিও মিলে যেতে পারে, যা মেলেনা, তা হলো সত্য। জর্জ সিমোনোর সঙ্গে জ্যাকুবের মিলটি এখানেই, যে, উভয়েই ‘অপরাধ’ কে নিয়েছেন নিতান্ত বহিরঙ্গ হিসাবে। স্থান কালানুযায়ী উৎপাদন ও বন্টন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের চরিত্রানুযায়ী, যেহেতু এই উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা, সিমোনো যুগ থেকে অদ্যাপি, পুঁজিবাদী আর প্রতিজন মানুষই পীড়িত এই পুঁজিবাদের দ্বারাই – হত থেকে হত্যাকারী – এই সত্যটিকেই উন্মোচনের নিমিত্ত ‘অপরাধ’ কে উপজীব্য করেছেন উভয়ে।
ড্রাগ ‘রিটেলার’ কুবে তার যাপনে অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ। সে নিভৃতচারী। সে Warsaw বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ফাইন আর্ট নিয়ে পাশ দিয়েছে। সেখানেই তার পরিচয় পাজিনার সঙ্গে। অতঃপর দুই ভিন্ন পথে কুবে আর পাজিনা নেমেছে ড্রাগ ব্যবসার বড় রাস্তায়। পাজিনা সরাসরি ড্রাগ ব্যবসায় থাকেনা। সে একজন স্থানীয় শিল্পী, সে কুবা’র ব্যবসা সম্পর্কে জানলেও এর বাইরেই থাকে। সে কুবা’র একমাত্র প্রকৃত বন্ধু । এক অর্থে মানসিক অবলম্বনও বটে। উপন্যাসটির অন্তর্গত স্পষ্ট রাজনৈতিকতার দিকে যাওয়ার আগে আমরা কুবে, যার জবানীতেই লিখিত এই উপন্যাস তার একটি সপ্তাহের মন-ডায়েরী, তার জবানবন্দীতে শুনে নিই তার নিজের কথাঃ “All I do is all about money. Nothing else. Making money, laundering it and then storing it safely. I only deal coke for the money. Not for the things I could buy with the proceeds, just for the cash alone. That is what matters. The sense money gives you, the awareness that you are present and capable of anything. There’s nothing more valuable than that. It is a sort of superpower. Like the ability to walk through walls. … … I went to university to get my folks off my back, and to see for myself just what it was like. I moved to Warsaw because I no longer wanted to live in Olsztyn – a small, pretty, leafy town good for foreign students and retirees. I chose to study art for some unclear motive, shaped by indie music tapes I had copied from my sister’s collection, from reading books about art, murky films watched on VHS: Lynch, Jarmusch, etc., the joints I smoked all the time on our housing estate, and some inherited talent for drawing. … এই সবকিছুর উপরে আরেকটি বাস্তবতা এই, যে, আমি একটি অদ্ভুত, অবাস্তব পরিবারে বড় হয়েছি, যেখানে বই পড়াকে তোল্লা দেওয়া হয়। যেখানে উৎসাহ দেওয়া হয় শিল্পকলার কিছু একটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে। … যখন তোমার পকেট ফাঁকা, তখন তুমি অসহায়। সব রকমের ক্ষতির, বিপদের শিকার হওয়ার ঝুঁকি তখনই সর্বাধিক। – এটা অনেকটা দুরারোগ্য ব্যাধির শেষ পর্যায়ের মতো, নিকৃষ্টতম অক্ষমতার মতো। কারো বন্দুকের নিশানার মধ্যে বাস করবার মতো। এই অসহায়তা তোমাকে গান্ডু পাব্লিকের মানুষের ভিড়ে যেতে বাধ্য করে, তাদের চাকার নিচে ঠেলে দেয়, যেখানে তুমি তাদের ঘাম, লালা, জুতোর তলা আর শক্ত মাটির সাথে মানিয়ে নিতে বাধ্য হও।” – গো পাঠিকা, হে পাঠক, এখানে ‘পাব্লিক’ অর্থ আম জনতা নয়। এখানে পাব্লিক অর্থ সেই জনতা যারা তার ক্রেতা, যারা তার হোলসেলার। যারা, মনে রাখতে হবে, সন্ততি ১৯৯০ এ অর্থমন্ত্রী লেশেক বালসেরোভিচ এর ‘শক থেরাপি’র যে ‘থেরাপি’ পোল্যান্ডকে একটি পরিকল্পিত অর্থনীতি থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তরিত করার জন্য আমূল বাজার সংস্কারের বাস্তবায়ন আর যা ১৯৮৯’র বিশ্ব জুড়ে বাজার খুলে দেওয়ার বা বিশ্বকেই খোলা বাজার বানোনোর পুঁজিবাদী হামলার ফসল।
গো পাঠিকা, হে পাঠক কুবে’র কথিত কথা গুলি নেহাতই একজন ড্রাগ রিটেলারের কথা নয়, বকলমে বিশ্ব বাণিজ্যের মহা যন্ত্রটি যাদের পিষে ফেলে চলতে চলতে, নিঙ্ড়ে নেয় যাদের মজ্জা-শোণিত তার চলার নিয়মে, তাদেরই অসহায়তা, হাহাকার। আমি এখানে শুনি জর্জ সমোনোর স্বর, তাঁর ‘প্যারিস রিভিউ’র সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষঃ “ people are afraid of the big organization in which they are just a little part, for them reading certain novels is a little like looking through the key-hole to know what the neighbor is doing and thinking — does he have the same inferiority complex, the same vices, the same temptations?’ – উপন্যাস Blinded by the Lights এ ড্রাগ-বিশ্ব আদতে আন্ডারগ্রাউন্ডের বকলমে গ্রাউন্ডের অনেক উঁচুতে স্থাপিত পুঁজিবাদের রূপক। যদিও আরম্ভেই জানা গেছে, যে, কুবে অত্যন্ত নিয়ম মেনে চলা, কখনো টাল না খাওয়া, স্রেফ টাকার নিমিত্ত টাকা করবার পুঁজিবাদী বাসনার দ্বারা চালিত একজন, কিন্তু, ক্রমে, আমরা দেখবো কিভাবে নিয়মনিষ্ঠার মোড়কে তার বানিয়ে তোলা নিরাপত্তা, যে নিরাপত্তা আদতে অসম্ভব, যে নিরাপত্তার বোধ সাময়িক “মেডিটেশন” কিংবা কোকেন-নেশা, তা কিভাবে বিচূর্ণ হয়ে যায়, যাবে – ঠিক যেমন গাজা কিংবা মণিপুরের জনতার জীবন, তাদের বোধগম্য কোনো হেতু ছাড়াই মুহুর্মুহু মৃত্যুতে পরিণত – তার নিজের সমস্ত সাবধানতা সত্ত্বেও।
গো পাঠিকা, হে পাঠক, আপনাকে বলি পাঠ করতে গ্রন্থটি এবং সামান্য ধৈর্য সহকারে কেননা গ্রন্থটির বহিরঙ্গের একশন, গ্রন্থটির বুনন শৈলী যা নানান ‘রকম’ কে, ফর্ম কে করেছে আত্মস্থ, পারে আপনার চোখ এমনই ধাঁধিয়ে দিতে, যে, আপনি লেখকের আদত বার্তাটির নিকটে না পৌঁছেই লেখক ও লেখাটিকে ‘দারুম! দুর্ধর্ষ’ অথবা ‘অখাদ্য’ বলে অভিহিত করে বসতেই পারেন।
