"হাজার ঝরাপাতার বুকে"
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
[প্রথম প্রকাশঃ২০১০ সালে “আদম” পত্রিকায়, এটি ২০২০ সালে সম্পাদিত সংস্করণ]
১।
দেশগ্রামে আমাদের বাড়ির পিছনে বয়েযায় একটি ছোটোনদী। নদীও নয়। খাল। খাল যেখানে
গিয়ে মিশেছে নদীতে সেখানে বাজার। সেখান থেকে এক বিকালে এক খেয়া নৌকা ভাড়া করে ভাসতে
ভাসতে চলে এসেছিলাম আমাদের বাড়িরই পিছন দিকটাতে। দেখতে পাচ্ছি সেই অর্জুন গাছগুলি।
কলতলা। বাঁশঝাড়। পিছনের বারান্দা। দিদিভাই’র কোঠা। তবু যেন কেমন অচেনা
মনে হচ্ছে। মনেহচ্ছে অন্যরকম। আরেকবার রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম একটি মানুষ হেঁটে
চলেছে আমার খানিকটা আগে আগে। চেনা চেনা ঠেকছে। তবু পারছিনা চিনতে। বেশ খানিক্ষন পরে
বুঝলাম, একটু দূরত্বে, আমার আগে আগে গম্যমান ঐ মানুষটি আমার বাবা! দ্বিতীয় ঘটনাটিতে
এমনি আক্রান্ত হয়েছিল চেতনা যে একটি গল্পও লিখে ফেলেছিলাম ঐ নিয়ে।
একটু দূরের থেকে দেখলে, প্রকৃত প্রস্তাবে, চেনা জিনিসেই, জানা মানুষেই পাওয়া যায় এক অপরিচয়ের ইঙ্গিত যে ইঙ্গিত প্রতিদিনের মানুষটিকে, বস্তুটিকে, পারহয়ে চলেযায় যেন প্রায় আবহমানেরি দিকে। ‘নিকটের থেকে দেখা’ বলতে আমি বলতে চাই যে দেখায় মিশেথাকে আশা,আসক্তি,হতাশা,হাহাকার,অভিমান। ঐ ঘটনাগুলির অনেকদিন পরে একটি ছবি দেখেছিলাম। Ettore Scola’র ‘A Special Day’। সেখানে নায়ক Gabriele এক প্রতিবেশীনির বাড়ির থেকে তার নিজের বাড়িটিকে দেখে পারেনি চিনতে!কথাগুলি মনে এলো আলোক সরকারের কবিতার প্রেক্ষিতে। কেননা আমার অনুভবে আলোক সরকারের রচনার একটি মৌল অন্তর্বস্তু ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’... ঐ দেখা নিয়ত নিবিষ্ট ‘সামগ্রিক’এর অনুধাবনে...ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’ আর দেখানোই আলোক সরকারের কবিতার নিয়ম ও নিয়তি। যেমন নন্দলাল বসুর ছবিগুলি।
যেহেতু নিয়ম তাই
তাতে সচেতন প্রয়াস মিশে থাকতে বাধ্য। যেহাতু নিয়তি তাই তাঁর দেখার ভঙ্গীটিই মূলতঃ নিরাসক্ত।
জলরঙ্গে আঁকা বিকালের ছবির মতো ছায়াময় তার বর্ণ বিন্যাস। ছায়াময়, তবে কুহকময় নয়। নয়
বিষাদে আক্রান্ত। নিরাসক্তির এই বর্ণ বিন্যাস মনে করায় অমিয় চক্রবর্তীকে যিনি এইপথে
আলোক সরকারের একমাত্র পূর্বসূরী। বার্ধক্যের প্রায় সীমারেখায় এসে যে ভাষায় যে কথা কথা
আলোক সরকার বলেন তাঁর ‘আশ্রয়ের বহির্গৃহ’ তে তার সঙ্গে ১৭-১৮ বছর বয়সী
আলোকের ভাবের,ভাষার আপাত সংশ্রব নেই আর না থাকাই হয়তো স্বাভাবিক। তবু আমি যে সংশ্রবটি
লক্ষ্যকরি তা ঐ ‘দূরের
থেকে দেখা’র নিয়তিটির উপস্থিতি সাপেক্ষে। ঈশ্বর ও মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর
কবি মানসের প্রথম সাক্ষাতের দলিল হিসাবে আমি পাঠকরি তাঁর ‘উতল নির্জন’ গ্রন্থের ‘স্বজ্ঞা’ কবিতাটিঃ
তা আমি নেবোবা কেন আমার যা নয়?
দেখো দেখি আকাশের সুগম্ভীর মেঘের বিথার
খান খান হয়েগেলো একমুঠি হাওয়ার ইচ্ছায়।
তা আমি নেবোবা কেন আমার যা নয়?
ঈশ্বর ও মৃত্যুর মুখামুখি দাঁড়িয়ে ১৭-১৮ বছর বয়স্ক আলোকের যে উচ্চারন তাতে
অসহায়তার থেকে বেশী, অভিমানের থেকে বেশী ভাস্বর বর্ণনা। অথচ তা জীবনানন্দীয় ‘নীল ডিম’ (‘একদিন নীল ডিম করেছো বুনন’ ), ‘ধূপের ধোঁয়ার মতো ধলা’ কিংবা ‘নোনা মেয়েমানুষ’ (‘মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে
আসে তার নোনা মেয়ে মানুষের কাছে’)
ইত্যাদির নিকটবর্তী বা ঐ পথাবলম্বীও নয়। এ এক বর্ণিল বর্ণহীনতা যা নিরাসক্তির
পূর্ব শর্ত। আর এমনি সেই নিরাসক্তি যে তা অবশেষে বেজেওঠে প্রত্যাখানেঃ
আমার তো জানানেই সহসা এ রঙ্গের প্রণয়
কেন এতো কথা কয়?
আমাকে তা দেওয়া কেন যা আমার নয়?
পরবর্তীতে যেন এই প্রত্যাখ্যানটুকুকেও পারহয়ে যেতে চান তিনি। ক্রমে। আরম্ভ
হয় আরেক স্বরলিপির সন্ধান। ঐ সন্ধানের সূত্র যেন পাই, আমি, তাঁর আত্মজীবনি ‘জ্বালানী কাঠ, জ্বলো’র এই অংশেঃ
‘ শুদ্ধসত্ত্ব বসু’র ‘একক’ পত্রিকায় অমিয় চক্রবর্তীর একটি কবিতা
পড়লুমঃ
তুমি মোর এসেছো জীবনে ।
তুমি
চলে গেছ।
আর কিছু নয়।
দেখো খেজুরের বনে
নির্জন ছায়ার মহিমা।
ওই শোনো
পত্রের মর্মর ধ্বনি।
আকাশের অব্যক্ত ইংগিত জেনে মেনে।
দেখ গ্রামসীমাটুকু
ছাড়িয়ে এসেছি
আর ফিরব না।
হাহাকার নেই, কোনো অভিমান নেই, প্রত্যাশা, এমন কী কোনো স্বপ্নও
নেই। কেবল ধূসর অলক্ষ্যে চলে যাওয়া ...’
আলোকও ক্রমে চলেযেতে চেয়েছেন এমনি হাহাকারহীন, অভিমানহীন,প্রত্যাশা ও স্বপ্নহীন ‘ কল্পনার স্বরচিত নিশীথ যাত্রা প্রান্তর’এ।
এই যাত্রাপথটি সুগম নয়। কখনো সুগম ছিলোনা। হবেওনা কখনো। কেননা ঐ যাত্রায় পাথেয় হিসাবে কেবল মাত্র ‘ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’এ কাজ চলেনা। প্রয়োজন পরে ‘ট্র্যাডিশনে’র প্রকৃত দীক্ষার। তাকে আত্নস্থ করবার মতো প্রতিভার এবং অন্তর্গত অবকাশের। ফলতঃ রবীন্দ্রনাথের পর একমাত্র অমিয় চক্রবর্তীই সক্ষম এবং অগ্রসর হয়েছিলেন ঐ পথে যাত্রায়। অন্ততঃ কিছুদূর। আশ্চর্য্য এই যে যখন তাঁর সমসাময়িকেরা মত্ত হয়ে পরেছে ভাষায়,আঙ্গিকে,জীবনযাত্রায় আমদানী করেনিতে আরো বেশী পশ্চিমী মদ,কোকেন তখনি আলোক সরকার এবং তাঁরই মাত্র কয়েকজন সতীর্থ – দীপংকর দাশগুপ্ত, অলোকরঞ্জনেরা পা বাড়ানোর স্পর্ধা করলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। পরবর্তীতে অন্ততঃ অলোকরঞ্জন আর বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেননি সেই পথে। তাঁকে গিলে খেয়েছে পশ্চিমী মেধার রাক্ষুসীই, শেষ পর্য্যন্ত। দীপংকর দাশগুপ্তও, ক্রমে, আলোক সরকারের সঙ্গে একই পথে না হাঁটলেও তাঁর পথ বেঁকে যায়নি, অবশ্যই, অলোকরঞ্জনের পথেও।
( প্রসংগতঃ দীপংকর দাশগুপ্তর ‘নৌকো’ কবিতাটি মনে আসছে।
এই কবিতায় ‘সমুদ্র কি সত্যি সত্যি আছে কোনোখানে’বার বারই এই প্রশ্ন রেখেছেন দীপংকর দাশগুপ্ত। ভাষা এবং নির্মানের প্রশ্নেও তিনি এখানে আলোকের পথাবলম্বী নন। ভাবনার ( বা ‘ভাব’ এর ) দিক থেকে আমার মনে হয়েছে যে এই প্রশ্ন আলোকেও ষ্পষ্ট না হলেও প্রচ্ছন্ন আর এই প্রচ্ছন্নতা, ক্রমে, এমনি ‘সাট্ল্’ যে আমি মনে করেনিতে বাধ্য হই, যে, আলোক মূলতঃ জানেন ‘সমুদ্র’ নেই তথাপি নৈ্মিত্তিকতার প্রয়োজনে তাকে গড়ে নিতে হয় মনে মনে।)
যে পথে পা বাড়ালেন আলোক সরকার তাকে আমি বলবো অমিয় নির্দেশিত পথই, বহুদূর, যতোক্ষন না আলোকের ভাষা-নির্মান’এর প্রবনতা তাঁকে নিয়ে পাড়ি জমায়নি অপর বন্দরের পথে। । আলোক সরকারের সবগুলি কবিতা গ্রন্থ আমি এতাবৎ পড়িনি কারন হাতে পাইনি। সংগ্রহ করতে পারিনি। নানা সময়ে নানা পত্র পত্রিকায় ছাড়া মূলতঃ একত্রে, সময়ানুগ ভাবে পড়েছি দে’জ থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (জানুয়ারী ২০০৫ সংস্করন)। অসম্ভব ভালো লেগেছে ‘উতল নির্জন’ আর ‘সূর্য্যাবর্ত’ যদিও এ দু’টি গ্রন্থের থেকে খুব কম কবিতাই সংযোজিত হয়েছে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র এই সংস্করনে। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ঐ সংস্করনটি পড়তে পড়তে চমকে উঠেছিলাম ১৫ পৃষ্ঠায় এসেঃ
সকালবেলার আলো-আকাশ নতুন দেশের
বাড়ি
শান্ত ছবি এঁকেছিল।
দেখেছিল মাঠে মাঠে সংহতির কুয়াশা যেন রহস্যের প্রথম ছবি।
যেন একটি উন্মোচন হাজার সবুজ পাতায় কিংবা শুভ্রতায় তার-ই
প্রতিশ্রুতি। বড়ো-বড়ো টিলা-পাহাড় পরিস্রুত আত্মিয়তায়।
দেখেছিলে সাহসিকা পরিণয়ের উজ্জ্বলতা, প্রেমিক অভিবাদন।
মুহুর্তের পরিচয়ে জেনেছিলে অবিরোধী নিবিড় সমর্থন।
কালো-কালো গাছের ম্লান শাখায় শাখায় করুন প্রতিবাদ
এবং সেই বাগান-ঘেরা দেয়াল সব-ই সঞ্চারিত অসীম শ্রদ্ধায়।
... ... ... ... ... ... ...
... ... ... ... ... ... ... ...
যেন কিশোর আনন্দের রৌদ্রময় সবুজ ঘাসের পাখি
এবং সেই জারুলগাছ মাটির ঘরের সহজ বন্ধুতায়।
তার-ই নিবিড় ছায়া প্রখর উজ্জ্বলতা, একটি স্থির সংবেদনী আঁখি
জ্বেলে রাখে – যখন মলিন বিশ্বাসের কাছে
দেখায় গভীর নিমগ্নতা আত্মলীন সপ্রতিভ যায়।
বুকের মধ্যে শুনতে পাও আন্তরিক ধ্বনি –
হাজার ঝরাপাতার বুকে পায়ের চিহ্ন মর্মরিত আছে।
কবিতাটির নাম ‘আলোকিত সমন্বয়’। পাতা উল্টে দেখি গ্রন্থটিরো
ঐ নাম। টের পেলাম সমন্বয়ই বটে। ‘উতল নির্জন’ আর ‘সূর্য্যাবর্ত’ তে যা ছিল আলাপ কিংবা তরানা
তাই এখানে পূর্ণ হতে চাইলো একটি সম্পূর্ণ খেয়ালের অবয়বে। আমার মনে হলোঃ
অবিরোধী নিবিড় সমর্থন : এ যেন ‘স্বজ্ঞা’র ‘তা আমি নেবোনা কেন আমার যা
নয়?’ এর দ্বিধা পেরিয়ে ‘যা আমার নয়’ তারি সাথে সমন্বিত হওয়ার
অন্ত র্গত সমর্থন
যার কাছে প্রতিবাদ ও সঞ্চারিত অসীম শ্রদ্ধায়।
আর সেই অসীম শ্রদ্ধায় সঞ্চারিত পথেই কবি’র আত্মলীন সপ্রতিভ গমন সূচিত
হলো সেই নতুন দেশের বাড়িটির দিকে ......
অতএব ‘উতল নির্জন’ আর ‘সূর্য্যাবর্ত’র সেই মৃদু অভিমানী ইংগিতগুলি,
যেগুলি আমার অতিপ্রিয়, সেইগুলি, এখানে এসে সমন্বিত হলো নূতন আলোয়,ভাষায় ... তবু সেই
পংক্তিগুলি ‘উতল নির্জন’ আর ‘সূর্য্যাবর্ত’ থেকে উড়ে এসে আমাকে অদ্যাপি
দেয় উদাস করে...
সহানুভুতির কিছু নয় সান্ত্বনার কিছু নয়
আন্তরিকতার সাথে আমি তার করিনা অন্বয়
মুহুর্ত্ত পরেই চলেযাই।
দিইনা কিছুই তাকে যেহেতু সামর্থ্য নেই, ম্লান
ঝরা বকুলের মতো অষ্পষ্ট সুদূর এক ঘ্রাণ ...(করুণ কাকলী, সূর্য্যাবর্ত)
এখনো জানিনি তাকে। অন্ধকারে ফুলের মতন
কেবল সৌরভ তার দুঃখ আনে ...
........................... ......... শিশির ঝরেছে।
পথে, হেঁটে বাড়ি যাবো, মনেহবে কীযে হারিয়েছে । (মরমী, সূর্য্যাবর্ত)
যদিও অপূর্ব্ব, অনবদ্য এই পংক্তিগুলি
তবু তারা সমন্বয় দাবী করে। অভিমানী তরুণ কন্ঠের পরিবর্তে এবার যেন শুনতে পাই সেই ভাবী
কালের বনপ্রস্থানের যাত্রীর স্বর যে এখন দাবী করতে চলেছে তার গার্হস্থ্য। সে বলেঃ
বিবিধ রঙ, বিচিত্রিত রেখা কিন্তু স্বাভাবিকের।
প্রেমিকাকে নিয়ে তুমি শালবনের গভীর একাগ্রতায়
বিবেচিত স্রোতের সহজতার। সংহতির অরব আনন্দের
ধ্বনি যেন উন্মোচিত নীল শিখায় হৃদয়ময় যায়।
এলোমেলো পাতার ছায়া তোমার প্রিয়ার মুখের উপর
চন্দনের মতন মাত্র ! তুমি অমল অসংশয়ী যাও। (সমগ্রতা,আলোকিত সমন্বয়)
এই যে পথে নেমে পরেছেন আলোক সে পথ বিবেচিত। সেই স্রোতও বিবেচিত। এই পথ, এই স্রোত ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্টের সঙ্গে ট্র্যাডিশনের মেলবন্ধনের তাই ঐ পথে তিনি আশ্বস্ত। চাই ঐ পথে তাঁর যাওয়া অমল অসংশয় ।
কবিতাগুলি পাঠকরার এবং তা
থেকে উপর বর্ণিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কয়েক বছর পরে যখন পড়লাম তাঁর সেই অনন্য আত্নজীবনি
‘জ্বালানীকাঠ জ্বলো’ তখন, তারো শেষ পৃষ্ঠায় এসে,
চম্কে উঠতে হলো নিম্নোদ্ধৃত অংশটি পাঠকরেঃ... ১৯৫৪’র শেষ দিকে আমি ‘আলোকিত সমন্বয়’ রচনা করলুম। ... ... আমি
তখন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। তবু বুঝতে পারলুম
এই পটভূমির উপর দু’পা রেখে নিজেকে চতুর্দিকে আকীর্ণ হতে
হবে। বারবার পরিবর্তনের আঁকা বাঁকা পথ, রোমাঞ্চ বিস্ময়, তবু তারই ভিতরে এটাই আমার স্থির
কেন্দ্র।‘
১৯৫৪ সালে কবির বয়ঃক্রম তেইশ বৎসর (মাত্র)। ঐ বয়সেই আপনার রচনার স্থিরকেন্দ্রটিকে
চিনে নিতে পারার গহনেও কি কাজ করেনা সেই স্বাভাবিক ক্ষমতাটি, আলোকের, ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’র? দূরের থেকে না দেখলে কিভাবে
তিনি ঐ বয়সেই সমন্বিত হতে চাইবেন ‘অবিরোধী নিবিড় সমর্থন’ এ আর ‘সঞ্চারিত অসীম শ্রদ্ধায়’এর মতো ধ্রুবপদে? ঐ একই ধ্রুবপদ, রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কবিতাতে
একমাত্র ধারন করেছিলেন, করতে পেরেছিলেন তো একমাত্র অমিয় চক্রবর্তী’ই।
২।
অমিয় চক্রবর্তী প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে আলোক সরকার লিখেছেন ‘অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার অন্তর্বর্ণ বর্ণহীনতা। ... সব কিছুই মূলতঃ বর্ণময় , তবু আসক্তিই বর্ণের প্রকৃতি নির্দ্দিষ্ট করে। ( ‘অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা পাঠের ভূমিকা’ , অনুবর্ত্তন , ১০ম - ১১শ বর্ষ, ১৯ সংখ্যা, জানুয়ারী – জুন, ২০০১) পাশাপাশি তুলনীয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রসঙ্গে জীবনানন্দের সেই উপমা ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা’। দুইটি উপমাই লক্ষভেদী। আসক্তিরি একটি স্তর ‘আশা’ আর তারি বিপরীত শব্দ ‘নিরাশা’। সেই নিরাশাকেই তর্কে, যুক্তিতে,অপরূপ ভাষা ও শব্দ বিন্যাসে অক্লান্ত জাহির করে গেছেন সুধীন্দ্রনাথ। পক্ষান্তরে নিরাশার সাধক জীবনানন্দ নিজেও। অর্থাৎ আসক্তির জ্যামিতিতে তিনিও আবিষ্ট। কিন্তু তাঁর নিরাশার রঙ ধূসর। পাশাপাশি অমিয়র দৃষ্টিভঙ্গী নিরাসক্ত। তাই তাঁর রচনায় সংখ্যাতীত রঙ্গীন আবহের, বস্তুর উল্লেখ থাকলেও তাঁর আসক্তি সেই আবহ কে, বস্তুকে দেয়না কোনো বিশেষ রঙ। বরং একটু দূরের থেকে দেখা সমগ্রের বুননে তারা হয় কবির কাঁচামাল। বেশী খোঁজাখোঁজি না করে তাঁর যে কোনো কবিতা থেকেই তুলে নেওয়া যায় সংখ্যাতীত উদাহরনঃ
‘ রঙ্গের মাছের স্বপ্ন সচল, নৌকো তলায়
কোরাল্ জলে আদিম রঙ্গীন
ভাষা
নীল সমুদ্রে, নীচে।
পোর্ট সুদানে।। ‘(নামা ওঠা, সড়া)
‘পাহাড় দ্বীপের সারি রাঙ্গা-ছাত বাড়ি
ঠান্ডা শহর এলো পুরোনো
বন্ধুর;
দীপজ্বালা বিদেশী
বন্দর।‘ (কালো জলে, সড়া)
‘দরজায় সাড়া । ঘরে আনি
চেনা লোক , চেয়ারে বসাই
–
কথা শুনে যাইঃ
ফুল-সাজি, ছায়া স্থির
তা’র
নীল পর্দা, দুপাশে দুয়ার,
জেনে গেলো তাই।‘ (পরিধি, সড়া)
‘ কোথায় খুঁজে বার করেছে
খুদে কোরাল দ্বীপ,
উতল সাগর, একটু সবুজ টিপ
–
– ওদের কথা বলো না – ‘ (মানুষের কথা বলো না, অমরাবতী)
এমনি আরো অসংখ্য উদাহরন দেওয়া যায় অমিয় চক্রবর্তী থেকে যেখানে রঙ্গীন বস্তু
বা আবহের উল্লেখ বস্তুটির নিজস্ব রঙ ব্যতীত কোনো বিশেষ রঙ নিয়ে প্রতিভাত হয় না। নীল
সমুদ্র শুধু নীল সমুদ্রই। আশা বা হতাশার বিশেষ কোনো তুলিতে রাঙ্গানো নয়। নীল পর্দা
শুধু নীল পর্দাই। আর কিছু নয়। জীবনানন্দ বা সুধীন্দ্রনাথ থেকে প্রতিতুলনা হাজির করা
যায় অসংখ্য। কিন্তু তার প্রয়োজন নেই কেননা উপরের ইঙ্গিতগুলি থেকে পাঠক নিজেই সেগুলি খুঁজে নিতে পারবেন। বরং ফেরা যাক আলোক সরকার
প্রসঙ্গে।
অমিয় চক্রবর্তী প্রসঙ্গে যে কথা বলেছেন আলোক সরকার, আমি অনুভব করি, সেই একই
কথা প্রযোজ্য আলোকের নিজের রচনা প্রসঙ্গেও। বহুদূর। আলোক সরকারের কবিতাতেও রঙ্গীন বস্তু
আর বর্ণময় আবহের ছড়াছড়ি। কিন্তু সেই রঙ্গীন
বস্তু বা আবহের উল্লেখ , অমিয় চক্রবর্তীর মতোই, বস্তুটির নিজস্ব রঙ ব্যতীত কোনো বিশেষ
রঙ নিয়ে প্রতিভাত হয় না। এর কারনও, অমিয়র মতোই, আলোকের দেখাও নিরাসক্ত।
পথে নেমে দেখেছিলে দূরে দূরে ছড়ানো নীল গাছ
ফুল ঝরছে ঘুঘুর ডাকের মতো। (হেমন্ত, আলোকিত সমন্বয়)
বাড়িটা নেই, এমনকি সেই অশথগাছ।
যখন তোমার কাছে যাবো
তুমি এসে বসবে সেই লালরঙ্গের বারান্দায়?
নাকি ঘরের ভিতর তোমায় পাবো।
তোমার কাছে ফিরে যেতে ভীষণ ভয় করে।
আমের বউল ছিল সেদিন ফাগুন মাসে;
ভালো বাসতে পারবো সবুজ ফলের উজ্জ্বলতা?
চৈত্রমাস আসে।
( এখানে এসে কবি নিজেই যেন দ্বিধাগ্রস্থ।
তাঁর আহৃত নিরাসক্ততাহেতু তিনি যদি ব্যর্থ হন ফলের ‘সবুজ’ উজ্জ্বলতার কাছে আত্মসমর্পনে
... একই কবিতায়, পরের অংশে সেই দ্বিধাকেও পারহয়ে কবি সেখানেও লক্ষ্য করেন সমন্বয়...)
বাইরে লাল বারান্দার নির্জনতায়
চিরন্তনী বিরহী চাঁদ, কোনো
ভাষা তো নেই
আকাশ রাখে একজনের একটি সিংহাসন। (একক সিংহাসন,আলোকিত সমন্বয়)
( যদিও মানুষের গড়া বারান্দার রঙ লাল তবু চাঁদ বিরহী, নির্বিকার। অতএব সমন্বয়ের
ভাষা ভিন্ন অপর কোনো ‘ভাষা তো নেই’ ফলতঃ যতোই বিরহী হোক চাঁদ আকাশ তার বিরহ
নিরসনের নিমিত্ত অপর কোনো সিংহাসন প্রনয়নে অপারগ ...)
এই নিরাসক্তির বর্ণনা, আরো পরের দিকের আলোকে পাই এইভাবেঃ
... ... ... ...
... ... ... ... ... ... ..আমি কোনোদিন
অভিভূত নয় কোনো ফুল দেখে, পাখি দেখে। অথচ আমার
সারাদিন মনে পড়ে পাখিগুলি, বাগানের ফুলগুলি সচ্ছল রঙ্গিন
সারাদিন অত্যন্ত নিঃসংগ মনেহয়। (বিচ্ছিন্ন আঁধার, স্তব্ধলোক)
বর্ণকে, রংকে তিনি সংজ্ঞাবদ্ধ করেন এইভাবেঃ
বর্ণের মাধ্যমে সব মনে
রাখি। প্রেমিকার চলে-যাওয়া
পীতবর্ণ। দুপুরবেলার পাতা-ঝরা
ধূসরাভ।
অন্ধকার ঘরে সব বর্ণ জ্বালি। অন্ধকারে
দশ-বিশ-পঁচিশ রকম দ্যুতি। এইসব
অন্তহীন পরিশ্রম। (পদ্ম, মেঘনিবেশ)
অর্থাৎ এখানে পরিষ্কারই জানান দেন কবি, যে, বিশেষ অনুভুতিতে দাগিয়ে রাখা ভিন্ন,
যেমন পরীক্ষাকালীন ছাত্রেরা একেক রঙ্গে দাগিয়ে নেয় বইএর একেক লাইন, বর্ণের ভিন্ন কোনো
মূল্য আর নেই তাঁর কাছে আর এই জানান দেওয়ার আগে তাঁকে পারহয়ে আসতে হয়, ‘আলোকিত সমন্বয়’ এর পরেও আরো তিনটি কবিতা
গ্রন্থ। আরো কয়েকটি দশক।
বর্ণের সাপেক্ষে এখানেই অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে আলোক সরকারের এক প্রকারের সংশ্রব।
অমিয় চক্রবর্তীর মতো আলোক সরকারের কবিতার অন্তর্বর্ণও বর্ণহীনতা।
৩।
বর্ণ ও তার প্রয়োগ সম্বন্ধে লিখতে লিখতে মনে এলো চীনদেশের কবিতায় ( খৃঃ ৬০০
– ৭০০’র কাছাকাছি সময়ের) রঙ্গের,
বর্ণের প্রয়োগের ধারনার কথা। বিশেষতঃ লি পো’র কবিতায় এই প্রয়োগের কাছে
আমাদের ফিরে আসতে হয় বারবার।
Heaven’
fragrance everywhere pure
emptiness,
heaven’s music endless.
……….. ………………..
All bottomless
clarity, in which vast
kalpas begin and
end out of nowhere.
…. …. …. …. …. …
I hoard sky a
setting sun leaves
And love this
cold stream’s clarity
………. ……………….
……… ……….
এখানে emptiness,
clarity সকলি
ব্যবহৃত হয়েছে ‘অরঙ্গীন’ বা ‘বাহ্য বর্ণের উপস্থিতি হীন’ অর্থে। এই ‘বর্ণহীনতা’ দৃশ্যেবস্তুর সাপেক্ষে নয়।
এই ‘বর্ণহীনতা’ মূলতঃ অন্তরের এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীর।
লি’পো এখানে এইভাবে ব্যাখ্যা
করেন একেঃ
Blossoms pure,
no dye of illusions,
mind and water
both are pure idleness.
অর্থাৎ যখনি হয় বিধৌত তখনি সে প্রকৃত বর্ণে ভাস্বর। তখনি সে ‘শূন্য’, ‘বর্ণহীন’। তখনি নিরাসক্ত চোখে দেখা
সম্ভব হয় শুধু পৃথিবীকে নয়, স্বর্গকেওঃ
I sit once and
plumb whole kalpas,
see through heaven
and earth empty.
বর্ণের ব্যবহারের এই চৈনিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি অমিয় চক্রবর্তীর এই কবিতাটি
পাঠ করলে অমিয়’র তথা আলোকের বর্ণ বিষয়ে দার্শনিক
ধারনাটি পরিষ্কার হয় আরো ...আমি পুরো কবিতাটি উদ্ধৃত করছিনা। উদ্ধৃত করছি শুধু প্রাসঙ্গিক
পংক্তিগুলোঃ
চিন্তার সমস্ত রং ধুয়ে গেছে শাদা হয়ে,
... ... ... ...
... ... ... ...
বাসনার আলোগুলি ঝিমিয়ে ঝাপসা হয়ে জ্বলে পাশে। (এই বৃষ্টি, পালা
বদল)
অমিয় চক্রবর্তী’র কাছে এই হলো নিরাসক্তির সংজ্ঞা। তার
রঙ। মায়ার ঊর্ণাজাল ছিঁড়ে শ্বাশতকে দেখা। দৃষ্টিভংগীর দিক থেকে ‘আলোকিত সমন্বয়’ এ এই পথেই চলে এসেছেন আলোক
সরকার। এই আসা, আগে যেমন বলেছি, স্রেফ ভাবের ঘোরে চলে আসা নয়। একটি সুচিন্তিত আসা। এই আসার পথে তাঁর মনোজ একক সংগ্রামের কাহন তাঁর নিজের ভাষায় বলে নিয়েই এই অংশ
শেষ করবোঃ
পুরোনো প্রেমিকা আমি তাকে দূরে রেখে
এখানে এসেছি। তার হাত পুড়ে গেছে
মুখ পুড়েগেছে।
সারাদিন পথের ধারের জানালা
খোলা রাখি। ভালোবাসবো নতুন মেয়েকে।
এখনো আবছা মনেপড়ে। কুৎসিত আঙ্গুলগুলো
চোখের তারার সর্বনাশ
আমাদের পূর্বরাগ তাও মনে পড়ে।
দিনে দিনে রচিত ভালোবাসা
আজ তার ধূলো
মুঠি ভ’রে এনেছি। আমি নতুন মেয়েকে
সেই ধূলো দেবো, দেবো প্রথম বিশ্বাস। ( শরৎকাল, আলোকিত সমন্বয়)
কে এই দগ্ধ পুরাতন প্রেমিকা? “আধুনিকতা”র গণিকালয়টিই কি?
৪।
‘আলোকিত সমন্বয়ে’র প্রায় সমস্ত কবিতাই সেই নূতন পথকে খুঁজে
পাওয়ার, বুঝে নেওয়ার কবিতা। এই পর্ব্বের সকল কথাই ভাষার,শিল্প রীতির,প্রকাশভঙ্গিমার
পরিত্যাগের আর পালাবদলের মর্মর । এই নূতন আলোকে সমন্বিত পথের প্রতীক কিংবা objective
correlative
হয়ে ফিরে ফিরে এসেছে ‘বাড়ি’ আর ‘বন্ধু’র উল্লেখ।
তুমি ভালো আছো। আমি এখন নতুন বাড়ির
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। পশ্চিমের আকাশে
সমারোহে মৃত্যু তাকে সমর্থন করে।
( বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেননা এখনো দ্বিধা কাটেনি সম্পূর্ণ। ‘তুমি’ টি ভালো আছেন কেননা বাড়ি
তাঁকে হয়নি এখনো বদলাতে। অব্যবহিত পরেই এ সম্বন্ধে কবির আরো সরল স্বীকারোক্তি পাবো
আমরা।)
পরিশ্রান্ত পাখি বিকেলবেলার অবকাশ
সাদা অনুভবের হাওয়ায়।
কী ক’রে যে তুমি এমন ভালো আছো!
সহজ মেঘ স্বার্থপর অন্যমন অসহায়ের খেয়ায়।
( কি করে ভালো থাকবে তারা যারা এখনো পার হলোনা সেতু? আঁকড়ে পরে রইলো সেই ভাষার
ও প্রকাশের ক্লিশে ধারণাকে! কিকরে ভালো আছে তারা? কি করে ভালো থাকবে তারা? কই, আলোকতো
পারলেন না সেখানে, সেভাবে ‘ভালো’ থাকতে! তবে এ’কী তাঁরি ভুল? পরাজয়? অথচ
তাকে পেরিয়ে আসতে গিয়েও কি এক বাধা যেন জড়িয়ে থাকে পায়ে পায়ে...)
কিকরে যে আমি এখন নতুন বাড়ির
ফাঁকা ঘরে বিস্ময়ের রহস্যের
মতন
কথা বলিঃ প্রতিধ্বনি চাই
আমার প্রতিধ্বনি চাই।
( ‘প্রতিধ্বনি চাই আমার প্রতিধ্বনি
চাই’ উচ্চারনটি লক্ষ্য করার মতন।
কেউ কথা বলছেনা তাঁর ভাষায়। তাঁর আঙ্গিকে। এযেন ‘form’ এর একাকীত্বর নিজেরি উচ্চারন!)
আপনার মর্মে প্রতিষ্ঠিত
একটি ধারনার থেকে অপর একটি ধারনায় উত্তরনের গহনেও থেকেযায় সংকট। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও
বলতে হয়েছেঃ
জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম,
এমন ধন আর
নাহি যে তোমা-সম,
তবু যা ভাঙাচোরা
ঘরেতে আছে পোরা
ফেলিয়া
দিতে পারি না যে।।
চতুর্দিকে সবাই যখন আরো বেশী ঝক্ঝকে,
আরো বেশী রহস্যময়, আরো বেশী তুখোড় হতে ব্যস্ত আলোক তখন আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই দক্ষিণারঞ্জনের
চিত্রকল্পে। চতুর্দিকে সবাই যখন ‘নেতি’ আর ‘নাস্তি’র মহিমা কীর্তনে সোচ্চার আলোক
তখন তাঁর চলার পথের পার্শ্বের প্রতিটি দৃশ্যে,গাছে, পাতায়,পাখিতে খুঁজে পেতে চাইছেন
যা শাশ্বত। সে খোঁজার অন্তিম নিয়ে তখনো দ্বিধাগ্রস্থ হলেও কোথাও তিনি পেয়েছেন সেই ইংগিত
যা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছেঃ
‘তুমি যুবক হবে কবে কিশোর কবি!’ আলোক লিখছেনঃ
সময় দেখো সরল ডানায় উড়ে
কাছে যারা ছিলো তাদের শান্ত ইতিকথায়
রেখেছে। আজ একলা অচেনা দেশ।
তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত নিয়মে, তারা অপর মালা গলায়।
তুমি একা চেনা-ছবির ভালবাসায় দূরে
কাকে রাখো। যেন রাখো। কালো মেঘের একাগ্র নির্দেশ
অসীম তিরস্কারে। তুমি যুবক হবে কবে কিশোর কবি! (কিশোর কবি, আলোকিত সমন্বয়)
তবে এই পর্বের সমস্ত দ্বন্দ্বের, অভিঘাতের প্রায় পূর্ণ রূপ ‘শিল্পীর আক্ষেপ’ এ শিল্পীত। এই কবিতাটি হাঁতে
এমন এক সূতোর উপর দিয়ে যা থেকে পা হড়কে যাওয়া যে কোনো মুহুর্ত্তে স্বাভাবিক আর তা হলেই
রচনাটি তার কবিতা রূপ হারিয়ে হয়ে উঠতে পারে একটি মেধাবী প্রবন্ধের কঙ্কাল। কিন্তু শেষ
পর্যন্ত তা হয়না আলোক সরকারের নির্মান কুশলতায়।
বাড়ি ফিরে টেবিলে দ্বীপ জ্বালবো।
একটি গোপন চিরকিশোর অনিদ্রিত ফুলে
আমার ঈপ্সিতার মুখ তাকে কি আমি জানবো?
তোমার জলে তারা আসে নিজেই পাল তোলে।
আমার জল তাদের সমরাগে
না-যদি হয় তারা আমায় ভোলে।
এখানে লক্ষ্য করার মতো পংক্তিগুলি হলো ‘আমার জল তাদের সমরাগে / না-যদি
হয় তারা আমায় ভোলে’ কেননা যে আস্তিকতার আলোকিত সমন্বয়ের
অন্তর্গত আবিষ্কারের মন্ত্রে আরম্ভ হয়েছিল আলোকের এই পর্বের পথচলা উদ্ধৃত এই উচ্চারন
লক্ষ্য করি তার বিরুদ্ধ্বাচার কেননা, এই উচ্চারন, হয়, নাস্তিকের। কেননা আলোক সরকার,
যেহেতু এই যুগেরি সন্ততি তাই তাঁকে, সমন্বিত হওয়ার কারনে, নির্মাণ করে নিতে হয় তাঁ
নিজস্ব ঈশ্বরকে ফলতঃ ঐ উচ্চারনের হাত তিনি পারেন না এড়াতে।
তাঁর ‘শিল্পীর আক্ষেপ’এ কবি লিখছেনঃ
তুমি আমার বিশাল অনুভুতি
তোমার জন্যে আমি নতুন ভাষার প্রত্যাশী।
............
............ ............
কিন্তু ভালবাসার দাবি একি প্রতিশ্রুতি
শিল্পী তার আপাতগৌরবের কাছে চায়!
নতুন অভিভাবে দেখো আমার গান ওঠেনা উচ্ছ্বাসি’
এখন তার পরিশ্রমী সাধনা আয়োজন।
............
............ ............
তোমার ভালবাসা আমি গ্রহন করার অসামর্থ্যে
গ্রহণ করি অন্য ম্লান ব্যাখ্যা এনে।
কিন্তু আবার
বিশাল অনুভুতি।
কিন্তু কবিতাটির একেবারে শেষে এসে কবি আবার তাঁর প্রত্যয়ের বিশ্বস্ততায় আমাদেরো
করে তোলেন যেন প্রায় সমান প্রজ্ঞাবানঃ
অন্ধকারে আকাংখিত সিঁড়ির সন্ধান
হিরন্ময় দুয়ার খোলো, চাবি।
‘ কিন্তু আমি ব্যবহৃত ছন্দে জেনো তোমার
সন্মান
চাইনি। আরো অনাশ্রয়ী অন্ধকারে জ্বলি।
প্রত্যাশার দু-বাহু বাঁকা আকাশ করে দাবি
যোগ্যতায়, সপ্রতিষ্ঠ মাটির পরিচয়েঃ
হিরন্ময় দুয়ার, তোমার দুয়ার খুঁজে পাবো
নতুন অভিভাবে যখন আমার গান উঠবে উচ্ছলি’
‘আলোকিত সমন্বয়’ এর আলোচনা শেষ করবার আগে লিখে রাখি আরেকটি
প্রমানের কথা ... লিখে রাখি এখানেই আলোক ‘বর্ণ’ বিষয়ে তাঁর ধারনার প্রথম
সূত্রটি রেখে গিয়েছেন... রেখে গিয়েছেন এইভাবেঃ
বাসনা এক প্রবণতা। এবং হৃদয়ের
মৌল স্রোত অপর দিকে যায়। (শ্রাবণ)
এর সঙ্গে কী সরাসরি মিলেযায় না তাঁর এই উক্তির, যা আগেও আমি উদ্ধৃত করেছি,
ভাবার্থঃ সব কিছুই মূলতঃ বর্ণময় , তবু আসক্তিই বর্ণের প্রকৃতি নির্দ্দিষ্ট করে ...
এর পরের গ্রন্থ ‘অন্ধকারের উৎসব’। এবার আমরা তারদিকে এগিয়ে
যাবো। ক্রমে।
৫।
‘অন্ধকারের উৎসব’ এর ধ্রুবপদটি, আমার মনেহয়,
‘ ... ... আমি আজ যাবো পাহাড়তলীর
নিরুদ্দেশ গ্রামের ভিতরে। (অমূর্ত বিস্ময়)
এবার নিজের নূতন পৃথিবীকে দেখেনিতে,চিনে নিতে। এবার তাঁর পথে আসে, একে একে,
‘নদী’, ‘তেপান্তর’, ‘বকুলতলা’ ‘বিদেশীমাঠ’ ,’ অশথগাছ’, ‘ফণিমনসার ফুল’ ... এইগুলি তিনি দেখেন না’কি পুনরায় নির্মাণ করেনেন
নিজের মতোকরে, নিজের জন্য? নামগুলি পরপর দেখেগেলে মনেহয় এ যেন সত্যিই এক ভ্রমণ কাহিনী
... তাঁর সামনে কেউ যেন ক্রমে উন্মোচিত করেদিচ্ছে একটি যাত্রার পথ আর তার কিনারের সমূহ
দৃশ্যাবলী...
অরব আলোর দেশ হাওয়ার সঙ্ঘতি ধ্বনি সম্পূর্ণ পৃথিবী
উন্মোচিত আবির্ভাবে বিস্ময়ের নিবিষ্ট স্বাক্ষর। ( নদী )
ময়ূরপংখির নায়ে আমি সেই তরঙ্গের একাকী নাবিক
চিরদিন আরো দূরে চলেযাবো। আমি ঘুমিয়ে পড়বো না। (রূপকাহিনী)
যেন একটিই কবিতা লেখা হয় গোটা বইটা জুড়ে। যেন একটি অভিযান কাহিনী...আর এই অভিযান
কাহিনী’র তলে তলেই দানা বাঁধেন আলোক।
‘অন্ধকারের উৎসব’এ’ই আমরা প্রথম লক্ষ্য করি তাঁর
শব্দ-বন্ধ সৃষ্টির প্রবণতা, যে প্রবণতা কমলকুমারীয় নয় এই কারনে,যে, যে শব্দ গুলির নিকটবর্তীতায়
আলোকের শব্দ-বন্ধ গুলির দেহ ধারন সেইগুলি চলিত
শব্দ। কিন্তু নির্য্যাসের প্রশ্নে উভয়ের প্রবণতা একই দিকে। নিজভাব প্রকাশের মারাত্মক
প্রয়োজনে ভাষার গতিপথকে নিয়ন্ত্রিত করার প্রচেষ্টার স্পর্ধা। কিন্তু এখানে যে প্রশ্নটি
কমলকুমার কে নিয়েও ওঠে তা’ই ওঠে আলোককে নিয়েও। কখনো অনুভব হয়, যে,
ভাব প্রকাশের নিমিত্ত ভাষাকে ব্যবহার না করে ভাষার প্রয়োজনে ভাব কে এঁটে দেওয়া হয়েছে
যেন। হ্যাঁ কখনো কখনো। সর্বত্র নয়। কদাপি। এই কথা আজ প্রমাণের তর্কের অপেক্ষা রাখেনা,
যে, ভাষাকে ঐ ভাবে ব্যবহার না করে সম্ভব ছিলনা ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। কিন্তু ‘সুহাসিনীর পমেটম’? আলোকেও, তাঁর লেখার অনেকটা
সময় জুড়ে, আমার মনে হয়েছে একই কথা। কোনো কোনো সময়ে যেন ভাষার টানেই ভেসে গিয়েছেন তিনি
...
আমি কিছু উদাহরন রাখছি, আপাততঃ শুধু
‘অন্ধকারের উৎসব’ থেকেই। যেহেতু এখানে তাঁর
শব্দ-বন্ধ সৃষ্টির প্রবণতার প্রাথমিক স্বাক্ষর গুলি আছে শুধু তাই উদাহরন গুলি তর্কাতীত
না’ও হতে পারে। তবে, ক্রমে, যথাস্থানে
আরো উদাহরন পাওয়া যাবে।
মুহুর্ত নিবেছে ধূপ স্বাগত সৌরভ। রক্তিম মমতা
নাকি তুমি রজনীগন্ধার আলো তার মূর্ত সমাহিত কাছে।
...... ... ...
...... ... ... ...... ... ... ...
ভালোবাসার ধ্বনি আজো চারিদিকে। আন্তরিক তাকে মগ্ন শোনো।
...... ... ...
...... ... ... ...... ... ... ...
হাওয়া যেন উপহাস, আবর্তিত সঙ্গত নিরালা। (সঙ্গত নিরালা)
ওদিকে হাওয়ার জানলা অভিমানী। ফিরেগিয়ে নিবিড় হারাবো। (হাওয়ার জানলা)
তুমি নিজে ছুটে আসো, আমার আশ্চর্য্য – তুমি আগে কাছে এলে। (সচ্ছল
সোপান)
এই গ্রন্থের অনেকগুলি কবিতাই আমার প্রিয়। তাই তালিকা দেওয়ার মানে হয়না। শুধু
আরেকটি কবিতার কথা বলেই শেষ করবো ‘অন্ধকারের উৎসব’ প্রসংগ কেননা, এই কবিতা,
‘রোমাঞ্চিত নদী’ তে, আমার মনে হয়েছে আলোক
আরেকবার বলেছেন তাঁর নিজস্ব শিল্প সংজ্ঞার সূত্রগুলি।
‘ প্রজাপতি, আমি ঘৃণা করি তোমাদের।
... ...
ভাঙ্গা ডালে কী ক’রে যে বসো!’
প্রজাপতি’র সঙ্গে এই পর্বের আলোকের প্রথম মিল বোধকরি এই, যে, উভয়েরি ছিল
আরেকটি পূর্ব চেহারা। সেই অবয়বকে অতিক্রম করে আলোক আজ তাঁর নূতন পৃথিবীর সম্রাট। প্রজাপতিও।
তথাপি প্রজাপতি, নিজে সুন্দর হয়েও, দ্বিধা করেনা ‘ভাঙ্গা ডালে’ বসতে। ‘ভাঙ্গা ডাল’ প্রকৃতির বাস্তব। প্রজাপতিও।
তাই এমন ঘটে। কিন্তু আলোক তাকে সমর্থন করেন না এই কারনে, যে, তিনি ‘ভাঙ্গা ডাল’কে সড়িয়ে দিয়ে গড়ে নিতে চান
আপনার শিল্পীত শাখা। পর মুহুর্তেই বলেন আলোকঃ
‘ কী করে বিবর্ণ ডালে একটি ফুলের ঘৃণ্য
কৃপণতা মানো?
ভালোবাসো শীতের বাগান!’
এখানেও সেই অস্বীকার । পাঠক, মনেপড়ে ‘তা আমি নেবোবা কেন যা আমার
নয়’ ? যা যেমনটি আছে সে তো তোমার।
আমি যদি নিই নেবো তাকে শিল্পীত করে। আমার করে।
এই পর্বে আমার মনেপড়ে Baudelaire যিনি কোনো ভাবে প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে
পারেননি মেনে নিতে। Baudelaire চেয়েছিলেন সমস্ত প্যারীস হোক সোনায় মোড়া। কিন্তু সেই ‘চাওয়া’র আলোকের নেই। তাই প্রজাপতির
জন্য আরেক স্বাভাবিক উপায় নির্দেশ করেই আরম্ভ হয় কবিতাটিঃ
‘সমান মাপের গাছ কোনোদিন দেখিনি। অথচ
কত গাছ দেখলুম’।
অর্থাৎ ‘ভাঙ্গাডাল’, ‘বিবর্ণ ডালে একটি ফুল’ এসমস্ত কৃপণতার পক্ষান্তরে
সে অপর বৃক্ষ, অপর শাখাকে পারে নির্বাচন করে নিতে আর তা’ই তার উচিত কেননা দুটো গাছ
যেহেতু সমান হয়না কদাপি অতএব এই গাছের, এই শাখার রিক্ততা সে অন্যত্র পাবেনা। এই শীতের
বাগান ছেড়ে সে উড়ে যাক সেই গোলার্ধে যেখানে এখন বসন্ত অথবা – অথবা সে তাঁর মতো চেলেযেতে
পারে ‘ কল্পনার স্বরচিত নিশীথ যাত্রা
প্রান্তর’এঃ
‘ কল্পিত বসন্ত চোখে রাত্রিদিন , নিহত
উদ্যম যত নিপুণ সাজানো
আমার বিশ্বাস। ... ... ... ... ...... ... ... ... ... ......
জ্বলেওঠে রোমাঞ্চিত
নদী
বিচ্ছিন্ন দুঃখের তবু বিস্তৃত গতির – এটুকুই আমার সন্মান’ ।
কখনো মনেহয় তবে কি এই ধারনারি বশবর্তী হয়ে আলোক নিবিষ্ট হয়েছিলেন শব্দ-বন্ধ
সৃষ্টির ‘অন্ধকার উৎসব’ এ’ও?
আচ্ছা ‘অন্ধকার উৎসব’ এই নামটিকে যদি এভাবে ব্যাখ্যা
করি, যে, এ সেই মাতৃ গর্ভের অন্ধকারের ইঙ্গিত যেখানে এখনো জন্ম-প্রস্তুতিরত ‘অমূলসম্ভব রাত্রি’ বা ‘নিশীথবৃক্ষ’ এর আলোক সরকার?
৬।
‘বিশুদ্ধ অরণ্যে’ এসেছেন আলোক সরকার। তাঁকে অনুসরন করতে
করতে সেই অরণ্যে ঢুকে পরবার আগে চকিতে একটি প্রশ্ন এসে হানা দিয়ে যায়। মনেহয়, কি সেই
বিশুদ্ধ অরণ্য? সে’কি তাঁর সদ্য নির্মীত নিজস্ব ভাষা-ভূগোলের আরণ্যক না’কি আর কিছু? চেতনায় চালচিত্রের মতো এই প্রশ্নটিকে রেখে দিয়ে পাতা ওল্টাতে
থাকি। টেরপাই তাঁর ভাষা ভূগোল এবার একটি ষ্পষ্ট রূপ পরিগ্রহের প্রক্রিয়ার প্রায় রাজপথে
এসে দাঁড়িয়েছে। ভাষা দেবীর সঙ্গে এবার তাঁর
প্রকৃত দ্বৈরথ। মনেপড়ে ‘অন্ধকার উৎসব’ এর সেই প্রতিজ্ঞাঃ
‘বিপক্ষে ঈশ্বর তবু কিছুতেই হার মানবো
না’। (রাজপুত্র)
হয়তো তাই ভাষা দেবীর, ভাষা-পাঠকের তোয়াক্কা না করেই এবার তিনি
লিখে ফেলতে পারেনঃ
‘ ... ... ... ... ... ... ... ...
... ... ... ... ... ... ... স্থবির নির্বোধ কোলাহল
অবিচ্ছিন্ন উদ্ধত বাগানে আর নিয়ম নিরুদ্ধ প্রীতস্বরে
গন্ধরাজ কেবল নিপুণ বিন্যাসের, বেলফুল বিনত শুভ্রতা’। (জাগ্রত জ্যোৎস্নায়)
বাক্যের এই গঠন যেন আর ভাষার ‘নিয়ম নিরুদ্ধ’ স্বরে কথা বলে প্রীত নয়।
এইবার বিন্যাসের নৈপুণ্যে তাকে পার হয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই ...
এখানে এসে বলেনিতে বাধ্য হই, যে, আলোকের এই বিন্যাস-নৈপুণ্যে’র বিজ্ঞাপিত পথে, পরে, হেঁটে
যেতে চেয়ে হোঁচট খেয়েছেন, এমনকি, অনেক প্রকৃত কবিও। সেই হোঁচটের আঘাত যে আজো কাটেনি
বাংলা কবিতা থেকে তার উদাহরন দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। তথাপি এ’ও সত্য,যে, উপরে উদ্ধৃত পংক্তি
গুলির মতো পংক্তি, যেখানে form আর content মিলেমিশে গিয়েছে অবলীল একাকারে,তেমনটিও আর পেয়েছে কি বাংলা
কবিতা?
একই গ্রন্থে এমন আরো প্রায় অসম্ভব উচ্চারনের চিহ্ন রয়ে গিয়েছে ...
‘বিকেলবেলায় খুব ঝড় হয়েছিল, তাপসী অশথগাছ
তোমার নির্ভয়
তখন আমার রক্তে। ...
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...’ (স্বাভাবিক)
‘... ... ... ... ... ... তোমরা এসে দেখে যাও
দশটি পাপড়ি গাঢ় নির্নিমেষ
একাগ্র জেগেছে। (রাজকন্যা)
নৌকো চলেছে দূর নিরুদ্দেশে জলধ্বনি বিস্তীর্ণ বিরাম –
দু-হাতে জানালা খুলে বিদ্যুতি আকাশে দেখো আলুলিত শ্রাবণ সহসা।
(জলধ্বনি)
এদেরি পাশাপাশি, দেখি, এই পর্বেও, স্বাভাবিক নিয়মেই ছায়া ফেলে ভাষা-ভূগোলে
নির্মাণের মারাত্মক কবন্ধ গুলিওঃ
সারাদিন অসহ্য রাত্রির অন্ধ কুটিল বাদামী। (শাণিত বিষাদ)
আমি দাঁড়ালেই স্তব্ধ অন্ধ উপনীত। (ভূত)
এবার চেতনায় চালচিত্রের মতো যে প্রশ্নটিকে
রেখে দিয়ে পাতা ওল্টাতে শুর করেছিলাম এই গ্রন্থের, আরেকবার সেখানেই ফিরি। উত্তর খুঁজি
সেই প্রশ্নেরঃ ‘কি সেই বিশুদ্ধ অরণ্য?’ ... প্রথমে শুনি তাঁর নিজের
কথাতেই ... শুনি ‘বিশুদ্ধ অরণ্য’ নামের নাম-কবিতায় তিনি কি সংজ্ঞা দিয়েছেন
এরঃ
‘দুইপাশে সবুজ ঘাসের স্বাভাবিক। কোনো পদচিহ্ন
নেই’।
এই ঘাস, এই বৃক্ষ, অবশেষে এই অরণ্য স্বাভাবিক কেননা কোনো পদচিহ্ন নেই। কোনো
পদচিহ্ন নেই – অর্থাৎ এই পথে হেঁটে যায়নি
কেউ, এতাবৎ। অতএব ভাষার এই ‘কুমারী’ অরণ্যই তাঁর বিশুদ্ধ চরাচর।
ব্যবহৃত আঙ্গিক ছেড়ে এই বিশুদ্ধ অরণ্য নির্মাণ করা ছাড়াও গতি নেই তাঁর কেননা এই পর্বেই
তাঁর অনুভবঃ
‘ সব সৎ চেতনাই ব্যর্থ হবে মনোনিবেশের
পরিশ্রমে’ (স্বাভাবিক)
এখানে এসে তাঁর এই ঘোষনা তাঁকে আরো অন্য পথে নিয়ে যায় অমিয় চক্রবর্তীর থেকে।
শুধু অমিয় কেন, জীবনানন্দ এমনকি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও। কেননা তাঁরা প্রত্যেকেই রচনা
করে গিয়েছেন এই বিশ্বাস নিয়ে,যে,সব সৎ চেতনাই একমাত্র প্রকাশিত হতেপারে মনোনিবেশের
পরিশ্রমে । আলোকের এই উচ্চারন বরং পরবর্তি ইউরোপীয় ‘শব্দই কবিতা’ এই ধারনার সমান্তরাল একটি
ঘোষনা এবং আলোক পরেও হেঁটে গিয়েছেন, স্বচ্ছন্দে , ঐ পথেই। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন অন্যেরা,এই
পথে হাঁটতে গিয়ে,কেননা, ঐ পথে হাঁটতে গেলে যতোদূর প্রতিভার প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয়,
যতোদূর, নিজ ‘ট্র্যাডিশন’ এর সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও সচেতনতার,
তা ছিলোনা তাঁর অনুগামীদের । ফলে নিজ নিজ ভাষা-ভূগোল সৃষ্টির অনর্থক দায়িত্ব নিয়ে,
এমন কি, অলোকরঞ্জনের মতো কবিও, অন্তিমে, যা
করলেন তাকে বলাচলে ‘শব্দমেধ’।
এই গ্রন্থেও,
মনেহয়, আলোক সংস্থিত নন সেই চিন্তায়, যে এই ভাষা শরীর অন্তিমে শোনাবে কি গল্প, কোন
গল্প। তথাপি তাঁর ধ্রুবপদগুলিকে এখানেও যায় শনাক্ত করা। এখানে তিনি নিরাসক্ত ভাষা-পথিক
আর সেই নিরাসক্তির শিক্ষা, এখান থেকেই হয়ে উঠতে থাকে তাঁর দর্শন ...
‘চিরদিন আজ্ঞাবহ থেকে যাবো। বৈশাখ দুপুরে
একা
তোমার গোপন চিঠি হাতে নিয়ে খররৌদ্রে যাবো
তোমার প্রেমিক তার বাড়ি। ... ... ... ... ... (প্রকৃতি)
কি মারাত্মক প্রকাশ নিরাসক্তির! কিন্তু কেন এই নিরাসক্তি? সমগ্র আলোক পাঠ করে আমার যে কথাটি
মনে হয়েছে তাই দিয়েই আরম্ভ করেছিলাম এই লেখাটা। বলেছিলাম দেশগ্রামে আমাদের বাড়ির পিছনে
বয়েযায় একটি ছোটোনদী। নদীও নয়। খাল। খাল যেখানে গিয়ে মিশেছে নদীতে সেখানে বাজার। সেখান
থেকে এক বিকালে এক খেয়া নৌকা ভাড়া করে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছিলাম আমাদের বাড়িরই পিছন
দিকটাতে। দেখতে পাচ্ছি সেই অর্জুন গাছগুলি। কলতলা। বাঁশঝাড়। পিছনের বারান্দা। দিদিভাই’র কোঠা। তবু যেন কেমন অচেনা
মনে হচ্ছে। মনেহচ্ছে অন্যরকম। আরেকবার রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম একটি মানুষ হেঁটে
চলেছে আমার খানিকটা আগে আগে। চেনা চেনা ঠেকছে। তবু পারছিনা চিনতে। বেশ খানিক্ষন পরে
বুঝলাম, একটু দূরত্বে, আমার আগে আগে গম্যমান ঐ মানুষটি আমার বাবা! দ্বিতীয় ঘটনাটিতে
এমনি আক্রান্ত হয়েছিল চেতনা যে একটি গল্পও লিখে ফেলেছিলাম ঐ নিয়ে।
একটু দূরের থেকে দেখলে, প্রকৃত প্রস্তাবে, চেনা জিনিসেই, জানা মানুষেই পাওয়া
যায় এক অপরিচয়ের ইঙ্গিত যে ইঙ্গিত প্রতিদিনের মানুষটিকে, বস্তুটিকে, পারহয়ে চলেযায়
যেন প্রায় আবহমানেরি দিকে। ‘নিকটের থেকে দেখা’ বলতে আমি বলতে চাই যে দেখায় মিশেথাকে আশা,আসক্তি,হতাশা,হাহাকার,অভিমান।
ঐ ঘটনাগুলির অনেকদিন পরে একটি ছবি দেখেছিলাম। Ettore Scola’র ‘A
Special Day’।
সেখানে নায়ক Gabriele
এক প্রতিবেশীনির
বাড়ির থেকে তার নিজের বাড়িটিকে দেখে পারেনি চিনতে!
কথাগুলি মনে এলো আলোক সরকারের কবিতার প্রেক্ষিতে। কেননা আমার অনুভবে আলোক সরকারের
রচনার একটি মৌল অন্তর্বস্তু ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’... ঐ দেখা নিয়ত নিবিষ্ট ‘সামগ্রিক’এর অনুধাবনে...ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’
আর দেখানোই আলোক সরকারের কবিতার নিয়ম ও নিয়তি। যেমন নন্দলাল বসুর ছবিগুলি
...
ঐ দূরের থেকে দেখাতেই তাঁর নিজস্বতা। ওই “দূরত্ব”টুকুই তাঁর ঈশ্বর।
আলোক বাংলা কবিতাকে সেই নিরাসক্তি’র স্পর্ধা, প্রতিভা যার বলে
বলীয়ান হয়েই তিনি, কোনো আবেগের চিহ্ন ছাড়াই, বলতে সক্ষম হন, নিজ প্রেমাস্পদাকেঃ
‘বৈশাখ দুপুরে একা
তোমার গোপন চিঠি হাতে নিয়ে খররৌদ্রে যাবো
তোমার প্রেমিক তার বাড়ি’।
এর অর্থ কি তাঁর প্রেম নেই? কাম নেই? আদপেই তা নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে এই শিক্ষাই
তিনি পেয়েছেন ‘প্রকৃতি’র কাছে তাই তাঁর প্রকৃতিঃ
‘ ... ... ... ... । নিরাসক্ত জাগ্রত প্রকৃতি’
এখানে ‘জাগ্রত’ শব্দটি লক্ষ্যনীয়। ঐ শব্দটি’ই বলে, যে, তাঁরো প্রেম আছে,
কাম আছে। ঠিক। তবে রয়ে গিয়েছে কোনো গুরুতর দায়িত্বও ... যে দায়িত্ব পালনের কারনেই তিনি
আজ্ঞাবহ। যে দায়িত্ব পালনের কারনেই তাঁর কবিতায়, উদাহরণ স্বরূপ যৌনতা নিয়ে, যৌনাভ্যাস
নিয়ে প্রক্ষিপ্ত “স্মার্টনেস্" নেই।পক্ষান্তরে শিল্প সৃষ্টির, শ্রষ্ঠার যে
সংজ্ঞা ঐ ‘প্রকৃতি’ কবিতাতেই লিখে রাখলেন আলোক
তা এইঃ
কোনো অভিমান নয়, অশ্রুজল, নিশ্চেতন প্রবাহিত রীতি
নতুন বৃক্ষের ধারাবাহিকতা উন্মীলন অপর জ্যোৎস্নায়।
অথবা
কেবল একটি ধ্যান একটি নিঃশেষ। (বৃক্ষ)
এই পংক্তি পাঠকরে মনেহয় যেন বৃক্ষ’কে প্রথম জানলাম...যেন এতো
দিন ‘গাছ’ই দেখেগেছি শুধু...
আলোকের কবিতা বিশ্বে ‘বিশুদ্ধ অরণ্য’র আরেকটি বিশেষ ভূমিকা মনেহয়
এই, যে, এই পর্ব্ব থেকেই তাঁর মৃত্যু চেতনার নিজস্ব উন্মেষ ঘটেযায়ঃ
খেলার মাঠের ঠিক পুবদিকে একদিন দরজা খুলে যাবে,
কাশবন লজ্জিত দু-হাত মেলে
বলবে এসো-এসো। আমি এক দৌড়ে যাবো, বিকেল হবার আগে
লাল রঙ আলোর ভিতরে ঝলমল ক’রে উঠবে সেই বটগাছ –
লুকোনো তলোয়ার বের ক’রে নেবো একেবারে আলো না জ্বেলেই।
...... ...... ...... ...... ......
...... ...... ...... ......
দুটি অন্ধকার মেঘ জানলার আকাশে নিঝুম – মনেহয় সেই বটগাছ।
গভীর কোটরে আছে সোনার মুকুট আমার হীরার জামা
একদিন অনায়াসে চলেযাবো। এইবার বুঝি বৃষ্টি এলো। (বটগাছ)
এখানে আসে আমার মনে পড়ে দক্ষিনারঞ্জন, মনেপড়ে অবন ঠাকুর ...
পাঠক, আপনারো মনেপড়ে না কি?
৭।
আলোক সরকার এমনি একজন কবি যাঁর প্রায় প্রতিটি কবিতা, তাদের অন্তর্গত প্রতিটি
শব্দের চয়ন এবং বিন্যাস দাবী করে মনন,চিন্তন,আলোচন। প্রায় সেই ভাবেই আমরাও এতক্ষন হেঁটেছি
তাঁর সংগে। এ যেন তাঁর আহ্নিক গতির নিয়মটির আবর্তকে আপন অনুভুতির মর্মে স্থাপিত করার
প্রয়াস। এখন, ক্রমে, আমরা উন্মোচিত করার চেষ্টা নেবো তাঁর বার্ষিক গতির আবর্তায়নের
রহস্যকে কেননা এতদ্ভিন্ন তাঁর, শুধু তাঁরি
কেন, যে কোনো কবির – যিনি বিরাট,ব্যাপ্ত – অভিযানকে, সেই অভিযানের অভিকেন্দ্র-অপকেন্দ্রকে,
যায়না মর্মাধীত করা। যে সকল কবিকে আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন পরেনা এই বার্ষিক গতির নয়মের
ইংগিতকে অনুধাবনের তাদেরি হয়তো এলিয়ট বলেছেন ‘anthology poets’।
এতোক্ষনে আমরা ইঙ্গিত পেয়েছি তাঁর
ধ্রুবপদটির, তাঁর নিজস্ব ভাষা-ভূগোলের নির্মাণ প্রচেষ্টার। আভাস পেয়েছি তাঁর অন্তর্গত
ট্র্যাডিশনের, তাঁর মৃত্যু চেতনার। লক্ষ্য করেছি তাঁর গল্প-কথনেচ্ছার। এই সকল ইঙ্গিতগুলিই
হবে আমাদের এই যাত্রার কম্পাস,সূর্য্য-ঘড়ি,জ্যামিতির সরঞ্জাম। ‘উতল নির্জন’ থেকে ‘আলস্যরঞ্জিতা’ হবে আমাদের ম্যাপ কেননা যে
সংকলনটি আমার “গাইড” তার ওভারকোটের পকেটে ‘আলস্যরঞ্জিতা’ই শেষ গ্রন্থ। যেহেতু চলেছি তাঁর বার্ষিক গতির সূত্রের
ইঙ্গিত উন্মোচনে তাই এক্ষনে বলবো তাঁর নির্জন’ থেকে ‘আলস্যরঞ্জিতা’ অবধি যাত্রার অন্তমে আমার
অভিজ্ঞতার কথা। পক্ষান্তরে, আগে যা বলেছি তা ছিল তাঁর একটি পর্য্যায় থেকে অপর পর্য্যায়ে
গমনের দিনলিপি।
‘উতল নির্জন’ থেকে ‘আলস্যরঞ্জিতা’র যাত্রাপথে আলোক সর্বাধিক
আলোড়িত,আন্দোলিত হয়েছেন যে চিন্তায়, যে চিন্তায় পাঠককেও তিনি ডেকে নিতে চেয়েছেন সর্বাধিক
তা বোধকরি ভাষা-ভূগোলের নির্মাণের প্রক্রিয়াটির। তার নানান পর্য্যায়ের। ফলে স্বাভাবিক
ভাবেই চলে এসেছে দুইটি বিষয়। একঃ ভাষার ক্ষমতা-অক্ষমতা। দুইঃ নির্মাণ প্রক্রিয়ার রহস্যের
নিজস্ব উন্মোচনের অভিজ্ঞতার কথা। এতদ্ভিন্ন, যেহেতু তাঁর কাছে বলার ভঙ্গী আর বলার
কথার সামঞ্জস্য ও একটি নিবিড় ভাবনার এবং নির্মাণের বিষয় অতএব এদেরি সঙ্গে, ক্রমে বিস্তৃত
হয়েছে তাঁর নিজস্ব দর্শণের ঢেউ, জল তরংগ।
‘বিশুদ্ধ অরণ্য’ অবধি গমনের পরেও আলোকের মনেহয়ঃ
‘ উচ্চারন সাধ্য নয় সব কিছু। সাধারণ ভাবনায়
অবশ্য যে-কোনো শব্দ উচ্চারণ করাযায়। যেমন ঈশ্বর
যেমন আকাশ কিংবা ভালবাসা এইসব শব্দগুলি
কত সহজের উচ্চারণ। কিন্তু রাত্রির একায়
কোন আবির্ভাব আসে অনিবার্য । কোন অসম্ভব সরোবর
চারিদিকে স্ফুরিত বিশ্রামে জাগে – পরিচিত শব্দগুলি
মনে হয় অলৌকিক প্রাসাদের বড়ো-বড়ো থামের দরজার’। (অসম্ভব সরোবর, স্তব্ধলোক)
এখানে এসে আমার মনেপড়ে যায় আরেক কবিকে যিনি লিখেছিলেনঃ
‘……. ………….. …………….. …………….
what’s said is not said, the
Unsaid is unsayable,’ ( The River, Octavio Paz,
Early Poems 1935 – 1955)
এই উচ্চারণের ভূমিকা হিসাবেই যেন, এই স্তবকটি আরম্ভ হয় এভাবেঃ
‘In mid-poem a great helplessness overtakes me,
everything
abandons me,
there is no one beside me ……… ……… ……… ……… ………
……… ……… ……… ……… ………the pen mutinies,
there is neither beginning nor end nor even a wall
to leap,
the poem is a deserted esplanade, ……… ……… ……… ……’
যদিও ‘সার্বিক’ অর্থে এই দুই কবি সম্পূর্ণ
দুই বিপরীত মেরুর তথাপি উদ্ধৃত পংক্তিগুলির সাপেক্ষে উভয় কবির উক্তির মর্মগত যে সাধারন
দার্শনিক অনুভুতি তা যেমন নিকট তেমনি নিকটবর্তী তাদের ‘ভাষা’ বিষয়ে অভিমত। তবে আলোকের
ক্ষেত্রে ‘ভাষা’ থেকেও,বোধহয় বলা উচিত, ‘শব্দ’ এই ‘প্রতীক’টির সীমাবদ্ধতা । ‘ভাষা’ বলছিনা এই কারণে,যে, ভাষায়
শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয় ক্রিয়াপদ। কিন্তু ক্রিয়াপদকে তাঁর কবিতায় আলোক ইতিমধ্যেই দিয়ে
ফেলেছেন বা দিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন এক গৌণ অবস্থান। পূর্বজ যে কোনো কবির যে কোনো রচনার
সঙ্গে আলোকের যে কোনো রচনাকে পাশাপাশি রাখলেই এই সত্য প্রমাণিত হয় সহজে। উদাহরণ হিসাবে
একটি বহু পঠিত কবিতা যা আমার একটি অতি প্রিয় কবিতাও বটে তারি একটি অংশ দিচ্ছি তুলেঃ
একদা এমনই বাদলশেষের রাতে—
মনে হয় যেন শত জনমের আগে—
সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে ;
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে ;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে ।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী ;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি ;
একটি পণের অমিত প্রগল্ভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ দিল অবারিত ক’রে ||
সুধীন্দ্রনাথের ‘শাশ্বতী’র এই অংশে ( বা যে কোনো কবিতার
যে কোনো অংশে) ব্যবহ্বৃত ‘ক্রিয়া’পদের সংখ্যার সঙ্গে যদি চুলনা
চালানো যায় আলোকের ‘অসম্ভব সরোবর’ এর উদ্ধৃত অংশের বা এই সকল
পংক্তি গুলির তাহলেই পাওয়া যায় আমার বক্তব্যের যুক্তি।
‘ ... ... ... ... ... ... ... ...
... ... ... ... ... ... ... স্থবির নির্বোধ কোলাহল
অবিচ্ছিন্ন উদ্ধত বাগানে আর নিয়ম নিরুদ্ধ প্রীতস্বরে
গন্ধরাজ কেবল নিপুণ বিন্যাসের, বেলফুল বিনত শুভ্রতা’। (জাগ্রত জ্যোৎস্নায়)
‘ কল্পিত বসন্ত চোখে রাত্রিদিন , নিহত
উদ্যম যত নিপুণ সাজানো
আমার বিশ্বাস। ... ... ... ... ...... ... ... ... ... ......
জ্বলেওঠে রোমাঞ্চিত
নদী
বিচ্ছিন্ন দুঃখের তবু বিস্তৃত গতির – এটুকুই আমার সন্মান’ ।
অর্থাৎ আমি বলতে চাই,যে, narration এর এক নিজস্ব কাঠামো প্রায় গড়ে নেওয়ার
পরেও আলোক চিন্তিত তারো গহন ব্যর্থতার বিষয়ে। শব্দের সীমাবদ্ধতার এই কথাটি নানা কবি
নানা সময়ে বলেছেন নানা প্রসঙ্গে। কিন্তু নিজ প্রয়োজনে ভাষাকে পুনর্নির্মাণের দিকে সঠিক
পা ফেলতে পেরেছেন কতোজন? এমনকি কমলকুমারো । যদিও কমলকুমারীয় ভাষা ভঙ্গী পরবর্তী সময়ে
ভাষার গতিপথে কেটে দিয়েছে আরেক খাল, যে খাল, ক্রমে, এখন নদী ...
আলোকের গমনেরো পদছাপ, বাংলার ভাষা-পৃথিবীকে দেখাতে সক্ষম হয়েছে আরেক দিগন্ত
রেখা ... তবে ঐ দিগন্তের দিকে সদলে কোনো গমন হয়তো সম্ভব নয়। মনেহয় এ’ও অনুভব করতে সক্ষম হয়েছিলেন
বলেই হয়তো লিখতেও সক্ষম হয়েছিলেনঃ
‘ সর্বজনীন কোনো ভাষা নেই। এমনকি মাতৃভাষা
প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে
স্বতন্ত্র বিশেষ’। ( সহজ বিকেল বেলা, স্তব্ধলোক)
যদিও ‘স্তব্ধলোক’ গ্রন্থেরি কবিতা তথাপি ‘অসম্ভব সরোবর’ থেকে ‘সহজ বিকেল বেলা’য় যুক্ত হয় আরো একটি মাত্রা।
তাঁর নিজস্ব জীবণ দর্শনের পথে এক সহজ আলো ফেলে এই কবিতা। যদিও পরের পংক্তিতেই ফিরে
আসবে ভাষার অনুষংগ তথাপি এই উক্তিগুলির একটি সাধারন আবেদনও রয়ে যায়না’কিঃ
‘যেখানেই মিলিত আনন্দ দেখি সেখানেই রুগ্ন
অক্ষমতা
স্পষ্ট হয়’।
এখানে এসে মনে পড়তে বাধ্য জীবনানন্দের ‘কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা
’ বা বুদ্ধদেবের ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত’ উচ্চারণ গুলি। আলোকের এই
পংক্তিগুলিকে তাদেরি সমগোত্রীয় বললে কি ভুল হবে? হয়তো হবেনা। কেননা, মনেহয়, যদিও রবীন্দ্র
পরবর্তী বাংলা কবিতায় অমিয়’র মতো আলোকও চলেছিলেন সেই পথেই যে পথে
যে কোনো রবীন্দ্রগান বাংগালীর প্রকৃত লোকগান তথাপি রবীন্দ্রনাথের মতনই তিনিও পাশ্চাত্যমুখী
আধুনিকতার হাত থেকে সর্বতো রেহাই পাননি । সম্ভবতঃ তাই একই কবিতার পরের অংশটি আমার কাছে
উপস্থিত হয় আরো বেশী সংশয় নিয়ে যখন আলোক বলেনঃ
‘ সহজ বিকেলবেলা চিরদিন অবোধ্য নির্জন’
এ উচ্চারন আলোকের সাবেক। মিলেযায় তাঁর অপর অনেক উচ্চারনের সঙ্গেই। ঠিক। তথাপি
আলোকের জীবন দর্শনের দৃষ্টির ইঙ্গিতে আমি অনুভব করি একরকমের দ্বন্দ্ব। কুয়াশা... হয়তো
সেই কুয়াশাকেই আলোক লিখে রাখতে চান এইভাবেঃ
‘ ............ ............
............ ............ ............ ভাবনায়
ছায়া নেমে আসে! আমি কতদিন
দুইটি বিষণ্ণ পাখি দেখেছি , স্পষ্টত বসন্তকালে
ফুলগুলো মুদ্রিত নিশ্বাস, ত্রস্ত চোখ আপাতরঙ্গিন।
সহজতা কোথায় যে আছে, আমি ভাবি। ( সহজতা, স্তব্ধলোক)
যেন এইবার এই ‘সহজতা’কে’ও, ‘সহজ’কেও নির্মাণে নিমগ্ন হলেন
আলোক। ফলতঃ ‘স্তব্ধলোক, বা তৎপরবর্তী ‘মেঘনিবেশ’ এর কয়েকটি লেখা ব্যতীত আমাদের
চেনা আলোককে ফিরে পেতে অপেক্ষা করতে হয় ‘অমূলসম্ভবরাত্রি’ পর্যন্ত। ঐ পর্বের গ্রন্থগুলি,
‘হিমপ্রহর’, ‘ অর্থহীন অর্থহীনতা’ , ‘তমঃশংখ’ আমি পারহয়ে আসি, মূলতঃ অস্বস্তিতে।
সেই অস্বস্তির মর্মে থাকে মূলতঃ তাঁর ভাষা-নির্মানের প্রবণতার মারাত্মক উচ্চাশা
... সেইসঙ্গে প্রয়াস ‘সহজে’র কৃত্রিম নির্মাণের। এখানে একটি জিনিস
শুধু লক্ষ্যনীয়, যা থেকে অনুভব হয়,ঐ পর্বের কবিতাগুলির রচনায় সময়েও আলোক নিজেও অবগত
ছিলেন এই প্রচেষ্টার আশু ব্যর্থতা বিষয়ে ...... লক্ষ্যনীয়,হয়,ঐ পর্বের গ্রন্থগুলির
নাম...‘হিমপ্রহর’, ‘ অর্থহীন অর্থহীনতা’ , ‘তমঃশংখ’...নামগুলিই কি নয় পরাজয়ের
গহন সহশব্দ?
কিন্তু আলোক যেহেতু কবি, আর যেহেতু ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’, তাই, ঐ হিমান্ধকারে আবর্তে অর্থহীন শংখধ্বনিতে বেশীদিন নিরত থাকেন না আলোক। তাঁর পুনর্জন্ম না হলেও তাঁর ভাষা-ভূগোল নির্মাণের প্রচেষ্টা একটি স্তর থেকে আরেক স্তরে, আরেক ধাপে উঠেযায় তাঁর ‘অমূলসম্ভবরাত্রি’তে।
৮।
‘অমূলসম্ভবরাত্রি’, মনেহয়, মূলতঃ লিখিত তাঁর ভাষা নির্মাণ
যাত্রার নতুন বন্দর খুঁজে পাওয়ার ঘোষনার পুলকেই। এখানেও, বাক্যে, ক্রিয়াপদ গৌণ তথাপি
চোখে পড়েনা তাকে গৌণ করার প্রয়াস। এখানে অবশ্যই তাঁর ভাষা নির্মাণ যাত্রা পায় এক রকমের
সিদ্ধি । যেন সত্যই নির্মীত হয় এক ‘অমূলসম্ভবরাত্রি’:
‘রাজত্ব কোথাও নেই, শুধু এই রাজা আর মৃগনয়না
সুন্দরী –
অমূলসম্ভব
রাত্রি বড়ো হলো।
বড়ো হওয়াটাই চাওয়া আরো বড়ো-হওয়া আরো পরিণত।
রঙ আনো যেমন তেমন মেশাও খুশির ঝোঁকে দেখো মৃগনয়না সুন্দরী
রাজত্ব কোথাও নেই তবু সাত মহলের শেষের জানলায়
শেষ বাপ্রথম যাই বলো’। (অমূলসম্ভব রাত্রি)
এখানে আমার মনেপড়েঃ
‘এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে
ভোরের ভিতর থেকে অন্য
এক পৃথিবীর মতো;
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
... কেননা এমন স্থান পাথরের ভারে কেটে তবু
প্রতিভাত হয়েথাকে নিজের মতন লঘুভারে;’ (মহিলা,জীবনানন্দ দাশ, বেলা
অবেলা কালবেলা)
আলোকও শূন্যে, এইবার, প্রকৃতই নির্মাণ করলেন তাঁর অনুধাবনীয় ভাষার প্রাসাদ।
রচনা করলেন মৃগনয়না সুন্দরী। সত্য। কিন্তু সেই নির্মীত ভাষায়, অন্ততঃ এই গ্রন্থে তিনি
‘ভাব’কে শেষ পর্য্যন্ত ছুঁতে পারলেন
কি? শুধু একটিবার মাত্র তিনি শোনালেন, এই সদ্য হওয়া ভাষার, এই ভাষারি সৃষ্টি কাহিনী,
এতদ্ভিন্ন, এই গ্রন্থের প্রায় সর্বত্র তাঁর এই নির্মীত ভাষা-শরীর রয়েগেলো ছায়া শরীরই...তবু
অন্ততঃ একটি রচনায় তিনি পুনরায় এমনভাবে শোনালেন তাঁর সেই নিরাসক্তির সাধনার কথা, সেই সাধন-শক্তির কথা যে
নিস্তব্ধ শুনতে বাধ্য হলেন, হয়তো, ভাষা-দেবীওঃ
তাপস তরুন অরুনবরুন কিরণে মেঘ পারহয়ে এলো
আমারই আঙ্গিনায় । আসবার
কথা ছিল।
আমার কোনো বিস্ময় নয়। আমি কেবল বলি তুমি এবার জ্বলো। (অরুনবরুন
কিরণে)
কিসের এমন প্রত্যয় যে তিনি জানেন তাপস তরুনের আসবারই কথাছিল তাঁরি আঙ্গিনায়?
এরও উত্তর আছে, এইখানে, আলোকের, আমাদের পূর্ব্ব পরিচিত আলোকের মতো করেইঃ
‘ ............... ............... ...............
............... আমার ছিল শ্রম
আমার ছিল একাগ্রতা
একধরনের নিশিজাগরণ।
............... ............... ...............
............... ............... ...............
মানে খুঁজতে গেলেই ফেনিয়ে উঠবে কৌতুক – শ্রমটাই তো আসল কথা’।
পাঠক, আমার মনে আসেন রবার্ট ফ্রস্ট, তাঁর ‘দি মাউন্টেন’
"Warm in December, cold in June, you say?"
"I don't suppose the water's changed at all.
You and I know enough to know it's warm
Compared with cold, and cold compared with warm.
But all the fun's in how you say a thing."
পাঠক, এ কি নেহাতই কাকতালীয়?
এরপর তাঁর সদ্য প্রাপ্ত ভাষার সিদ্ধিতে মিলিত হয় ভাব। সেই ভাবের বিস্তারে রচিত
হতে থাকে ‘নিশীথ বৃক্ষ’, ‘আমার বাবার গলা’, ‘রৌদ্রময় অনুপস্থিত’, ‘যে কোনো নিস্তব্ধ’... তারপর? তারপর যেন আবার
একটু ক্লান্ত দেখায় আলোককে। সেই ক্লান্তির কথা বলবার আগে আরেকটু দেখেনিই তার পূর্ববর্তী
যে টুকু যাত্রায় আলোক উজ্জ্বল, ভাস্বর... আমারো আরো অনেকগুলি প্রিয় কবিতাই তাঁর এই
পর্বের...
‘বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে
সন্ধে হয়েগেছে অনেকক্ষণ
বাড়ি ফিরে আসেনি ছেলে।
অন্ধকারে দেখা যায়না ভালো উঁচু নিচু আলপথ
বাবলাগাছ আকন্দফুলের গাছ।
আঙ্গুল গোল ক’রে ঠোঁটে রাখে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে
বলে নাম
শব্দ এগিয়ে যায় গুমরে গুমরে
শব্দ এগিয়ে যায় অনেকদূর – বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে।
দুয়ারের ধান-কেটে-নেওয়া মাঠ আলো জ্বালিয়ে চলেছে গোরুরগাড়ি
মড়মড় করে উঠছে খড় সড় সড় করে উঠছে শুকনো পাতা।
হেমন্তের শেষদিক
কুয়াশা থেমে রয়েছে চারিদিকে কুয়াশা চিরে চিরে জ্বলছে জোনাকি।
কুয়াশা চিরে চিরে জ্বলছে দুটো চোখ –বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে
বড়ো বড়ো দুটো পা কুয়াশা ভেঙ্গে ভেঙ্গে এগোচ্ছে।
ঝটপট করে উঠছে বাদুড় ককিয়ে ককিয়ে উঠছে প্যাঁচা
লাফিয়ে উঠলো ইঁদুর সড়সড় করে উঠলো খড়।
বড়ো বড়ো দুটো পা কুয়াশা ভেঙ্গে ভেঙ্গে এগোচ্ছে
বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে।
বড়ো বড়ো দুটো পা মড়মড় করে উঠছে সাপের খোলস
আলো জ্বালানো গোরুরগাড়ি হারিয়ে যাচ্ছে চোখের ওপারে’। (বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে,
নিশীথ বৃক্ষ)
ভাষা এখানে পাহাডের ঢালু গা বেয়ে গড়িয়ে নামা নুড়ির অনায়াসের মতো মসৃণ। ছুরি-কাঁচি-সীজারের
কারসাজির দাগ-চিহ্ন-হীন। নির্মীত ভাষা,এখানে, অবশেষে পেয়েছে সেই ‘প্রসাদ’ যাও বশেই কেবল সম্ভব ‘রচনা’। ‘প্রকৃত’ রচনা। রচিত হয়েছে এমন এক চিত্রকল্প যা প্রকৃতই ‘অমূলসম্ভব’। চিত্রকল্পের ইঙ্গিত দার্শনিক
অভিব্যক্তিকে ছুঁয়ে তারপর তাকে পারহয়ে চলে গিয়েছে পৃথিবীর আকাশ পারহয়ে আরেক আকাশের
দিকে ... যেন নীড় আর আকাশের দ্বন্দ্ব গিয়েছে ঘুচে। যেন একে অপরের প্রিতিভায়,মহিমায়
লীন হয়ে গিয়েও,দুইটি চক্রের মতো গতিশীল রেখেছে রথকে ... এই পর্বের তাঁর রচনার
অন্যান্য বৈশিষ্ট গুলিকে নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে সেড়ে নিই এই কবিতাটি ঘিরে আরো কয়েকটি
আবর্তন যা হবে আমাদের এই পর্বের অভিযানের প্রস্থান বিন্দু।
‘বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে’র কোথাও, তবে জানা যায় না
ঠিক কোথায়, রয়েযায় উইলিয়াম ব্লেকের যে উপস্থিতি তা কবিতার মধ্য-মেধার পাঠকের কাছেও
ধরাদেয় সহজেই আর আলোকও তাই চান এখানে কেননা অব্যবহিত পরেই, তিনি নিজেই, ব্লেক’কে ঘোষনা করবেন তাঁর কবিত্বের পিতা বলে। জানান দেবেন
সেও পিতার অন্তর্ধানে তিনি প্রায় বালক হেন অসহায় ... এই উচ্চারণটিও আসবে ব্লেকেরি একটি
বহু পঠিত কবিতা ‘The Little Boy Lost’ এর প্রতিধ্বনি হয়ে ... আলোকের সেই কবিতাটিও
আমার অতিপ্রিয়। সেই কবিতাটিতে যাওয়ার পূর্বাহ্নে ‘বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে’ প্রসঙ্গে আর একটি ভাবনাকে
লিখে রেখে যাবো শুধু...
যদিও আমরা লক্ষ্য করেছি এই কবিতায় ব্লেকের উপস্থিতি, যদিও আমরা জানি তাঁর বার্ষিক
গতিপথে তিনি ব্লেকের দ্বারা প্লাবিত হবেন অদূরেই,তথাপি,‘বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে’র নির্মীত আবহের সঙ্গে গ্যেটের
নিম্নোদ্ধৃত আবহের মিল আমাকে ঠেলেদেয় চিন্তনের
আরেক পথেঃ
‘Who rides so late through night and
wind?Crop_erlkoenig
It is the father with his child.
He has the boy close in his arms,
he holds him safe, he keeps him warm.
My son, why are you hiding your face in
such fear?
Father, don't you see the Elf King?
The Elf King, with crown and tail?
My son, that is a wisp of cloud.
You darling child, come, go with me!
Such nice games I'll play with you,
there are many bright flowers on the
beach,
my mother has many golden robes.
My father, my father, and don't you hear
what the Elf King is softly promising
me?
Be still, be still, my child,
in the dry leaves the wind is rustling.
Would the young master like to come with
me?
My daughters shall wait on you
beautifully,
my daughters lead the nightly lines
and they'll rock and dance and sing you
in.
My father, my father, and don't you see
the Elf King's daughters in that gloomy
place?
My son, my son, I see it quite well:
it's the old willows shining so gray.
I love you, I'm drawn by your handsome
form,
and if you aren't willing, I'll take you
by force!
My father, my father, he's grabbing me
now,
the Elf King has hurt me.
The father shudders, he rides like the
wind,
he holds in his arms the moaning child,
reaches the yard with the utmost pains,
in his arms the child was dead. (Goethe,
The Elf King)
মনেহয় গ্যেটের এই কবিতাটি একটি ভিত্তি হতেপারে ব্লেক আর গ্যেটের এক তুলনামূলক
আলোচনার যা হয়তো করবো কোনোদিন। ভবিষ্যতে। আলোকে এই কবিতার আবহের চিহ্ন কিছু থেকে গেলেও
এই কবিতার ‘ব্যালাড’ধর্মীতা আলোকের চরিত্র নয়।
কদাপি। যদিও এই পর্ব্বে আলোক অনেক সময়েই কথা বলেছেন গল্প বলার ঢঙ্গে...বরং এবার ফিরেযাই
সেই কবিতায় যেখানে ব্লেক্কে তাঁর নিজের রচনার পিতৃ পুরুষ বলে ঘোষনা করেলেন আলোক সরকার।
‘চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে বাবা বাবা তুমি
কোথায় যাচ্ছ!
দামাল সেই কিশোর তার বাবা
পালিয়ে যাচ্ছে দূরে।
মরা জ্যোৎস্নার
বাঁশবন
তার পাশে দ্রুত নেচে উঠলো
ছায়া, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে।
সারাটা পথ হাত
ধরা ছিল
আর সে লাফিয়ে ধরতে চেয়েছে প্রজাপতি কুড়োতে চেয়েছে জামরুল।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে চারদিকে শেয়াল ডেকে উঠলো তিনবার
বাঁশবনের ওধারে
কাপাসতলির শ্মশান।
তার গলা যতো উঁচু ততো বেশী হারিয়ে যাচ্ছে ছায়া
ভয়ে শিরশির করছে শরীর তবু দৌড়োচ্ছে কচি পা
বনতুলসী বিছুটির
ঝোপ
হোঁচট খেয়ে লাফিয়ে উঠছে আমার উঁচু হয়ে খুঁজে দেখছে চারদিক।
আর তার বাবা কত দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে
মরা জ্যোৎস্নার মধ্যে অন্ধকার বোবা একটা পলায়ন।
হাতধরা ছিল সারাদিন
কাপাসতলির শ্মশান সেইখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। (ব্লেকের প্রতি,
যে কোনো নিস্তব্ধ)
এই কবিতা ব্লেকের পিতৃত্বকে বরন করে নিয়ে মূলতঃ বরন করেনেয় ‘ক্ল্যাসিকেল’ কে। শুধু তত্ত্বে নয়। প্রয়োগেও। একই সঙ্গে বলে ‘ক্ল্যাসিসিজম্’ থেকে মুক্তির কথাও। ভাষা,নির্মাণ ইত্যাদির সাপেক্ষে এই কথাগুলি যদি কোনো পাঠকের মর্মে নাও প্রবেশকরে, কেননা এই প্রবেশ মূলতঃ মেধাও পাঠ জনিত, তথাপিও এই পর্বের আলোক তার গহনে প্রবেশ করতে বাধ্য এই কারণে, যে, এই কবিতা বা এই পর্বের তাঁর আরো অনেক কবিতাই, রচনা করে এমন সব আবহ, চিত্রকল্প, যা সর্বজন গ্রাহ্য...সত্যের খাতিরে এ’ও বলতে হয়,যে, যা প্রায় অনুপস্থিত ছিল এতোদিনের আলোকে ...
আমার মনেপড়ে সেই বিকাল যখন বালক অপু যাচ্ছিল, নেচে নেচে দৌড়ে দৌড়ে, তার বাবার
সঙ্গে, কুঠীর মাঠে নীলকন্ঠ পাখি দেখতে ... মনেপড়ে নিজের বাবাকে ঘিরে অসংখ্য ব্যক্তিগত
স্মৃতি ... মনেপড়ে বয়সের নিয়মে বা অনিয়মে কিভাবে পিতা ও পুত্র, ক্রমে, হয়েওঠে দুইটি
বিভিন্ন দ্বীপ, তাদের মধ্যেকার সেতু কিভাবে ভেঙ্গেপরে দৃশ্যতঃ...মনেপড়ে রিল্কেও...মনেপড়ে
সেই এলিজি যেখানে মাতা’র অকুন্ঠ সাবধানতা সত্ত্বেও পুত্রকে কেড়েনেয়
তার নিয়তি ...কেড়েনেয়? না’কি পুত্র নিজেই অনুসরন করে তাকে?
Yes, you did frighten his heart; but
more ancient terrors
plunged into him at the shock of that
feeling. Call him . . .
but you can't quite call him away from
those dark
companions.
Of course, he wants to escape, and he
does;
... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
... ...
How much you hid from him then. The room
that filled
with suspicion
at night: you made it harmless
... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
... ...
There wasn't a creak that your smile
could not explain,
as though you had long known just when
the floor would do
that...
And he listened and was soothed. So
powerful was your
presence
as you tenderly stood by the bed; his
fate,
tall and cloaked, retreated behind the
wardrobe, and his
restless
future, delayed for a while, adapted to
the folds of the
curtain. (Duino Elegies - The Third
Elegy)
‘ক্ল্যাসিকেল’এর সঙ্গে ‘কন্টেম্পরারি’র, অরিয়েন্টালের সঙ্গে ওয়েস্টার্নের
এই মেল বন্ধনের এই বিশেষ রূপটি অবশ্যই আলোকের
দান । বাংলা কবিতাকে। জীবনানন্দেও রয়েছে এই মেল বন্ধন তবে তার অভিযাত্রার পথটি যেহেতু
ভিন্ন অতএব তার প্রকাশরূপটিও ভিন্ন। এতদ্ভিন্ন আর যে সব প্রচেষ্টা লক্ষ্যিত হয়েছে,
অপর ‘কবিতা লিখিয়ে’দের হাতে, সেখানে ঘটেনি কোনো
মেল বন্ধন। সেখানে আপনাকে পাশ্চাত্যের মোড়কে আপনাকে মুড়ে নেওয়ার চেষ্টাই হয়েছে শুধু
...
এই পর্বে আলোককে আমরা বার বারই দেখি ব্লেকের দিকে ধেয়ে যেতে। কখনো প্রায় সরাসরি।
কখনো বৃত্তাকার পথে। এই পর্বেই রচিত হয় ‘নেই’,’অভিযাত্রা’, ‘ঈশ্বর’, ‘নিস্তব্ধ’, ‘সহজপাঠ ‘ বা ‘চোখ’ হেন মারাত্মক কবিতাগুলি – এ যেন আলোকের প্রকৃত ‘ক্ল্যাসিকেল’ যুগ। এবার যেন ‘সহজের নির্মাণ’ নয় , ‘সহজেই’ ফিরে এলেন আলোক। সহজ পথে।
হয়তো এই কারণেই তাঁর এই পর্ব্বের কবিতা এতো ‘মুক্ত’ যে অর্থে রবীন্দনাথ বলেছিলেন
‘ মুক্তি এই সহজে ফিরিয়া আসা
সহজের মাঝে...’
৯।
এরপরে আসে আরেক পর্ব্ব যেখানে আবার আলোক পথিক। আবার তাঁর কড়া নাড়া ভাষা-নির্মাণের
নানান পান্থ নিবাসের দ্বারে দ্বারে। কিন্তু যারা একবার আস্বাদ পেয়ে গিয়েছে, পূর্ববর্তী
পর্বের, সেই ‘ক্ল্যাসিকেল’ আলোকের তারা যেন ঠিক স্বস্তি
বোধ করেনা ‘মঙ্গলদীপ’, ‘মেঘময়’ বা ‘নির্মেঘ মন্থর’ এ। সেই ‘ক্ল্যাসিকেল’ পর্য্যায়ে আলোকের কবিতা পরিগ্রহ
করেছিল যে অবয়ব তা এখানে এসে পুনরায় ছায়া শরীরঃ
‘ এখন বর্ষাকাল। দিন
প্রলম্বিত একটা
বর্ষণ
আঁধারিম স্তব্ধ আর মূক অনিঃশেষ
তা যাবতীয় দৃশ্য এবং উজ্জীবন
যথার্থ এবং অনিবার্য্য
একটি দৃশ্য এবং একটি উজ্জীবনের’ ( বর্ষাকাল, মঙ্গলদীপ)
এখানে শব্দ যেন পায়না কথার অবয়ব, কথা পায়না ভাষার পরিণতি ... সত্য ... কিন্তু
তার আড়ালেও কোথাও ললতে থাকে আরেক প্রস্তুতি – যে গোপন ‘উদ্যোপ পর্বের’ কথা ‘অমূলসম্ভব রাত্রি’ তে আগেও বলেছিলেন আলোকঃ
‘ ............... ............... ...............
............... আমার ছিল শ্রম
আমার ছিল একাগ্রতা
একধরনের নিশিজাগরণ।
............... ............... ...............
............... ............... ...............
মানে খুঁজতে গেলেই ফেনিয়ে উঠবে কৌতুক – শ্রমটাই তো আসল কথা’।
এই একাগ্রতার, নিশি জাগরণের ফসল, ফলে,
পুনরায়, পুষ্পিত হয়ে, ‘নির্মেঘ প্রহরের’ অন্ত পর্য্যায় থেকে ‘পিতৃনিলয়’, ‘ঘর উঠোন’ হয়ে ‘খেলার সময়’, ‘গৃহনিলয়’, ‘জবা ভালো হয়েগেছে’ পেরিয়ে ‘ঘাস রঙের আলো’ অবধি। ‘নির্মেঘ প্রহরের’ অন্তিমে এসে তাঁর উক্তি যেন
বলে, মৃত্যু চেতণার আপাত মোড়কে জড়িয়ে, এই পথ
হারানো আর পথ খুঁজে পাওয়ার অভিযানের অন্তর্কথাগুলিকেইঃ
‘ওগো প্রভু, আজ আমাদের বেলাশেষ। আজ
তোমার আমার বেলাশেষ। তুমি
ঠিক আছো ? তুমি
অন্ধকারে চিনতে পারছ পথ?
আমি কিছুই দেখিনা। আমি
হাত এলোমেলো ছুঁড়ি নিষ্ফল
প্রয়াস। তুমি কোন দিকে? (মৃত্যুফুল)
‘মৃত্যুফুল’ এ মৃত্যু চেতণা আধারের মতো হলেও তার
পরিণত বিস্তার দেখি আলোকের এই পর্ব্বে। দেখি প্রয়াস মৃত্যুকেও নিরাসক্ত দেখারঃ
‘ জলের পাশের বালি মাড়িয়ে যাচ্ছিলুম
সন্ধে বেলায়। হঠাৎ ঝলক হাওয়া
প্রশ্ন করলো – মৃত্যুভূমি জানো? কতোকালের
বাসি প্রশ্ন! ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
... অনেক দূরে যাবো, অনেক অনেক ঘন আঁধার
দাঁড়িয়ে আছে সারা আকাশ জুড়ে। ...’ (মৃত্যুভূমি, পিতৃনিলয়)
‘ কালো গোরুর বিকেল হলো আনমনা রঙ বাড়ি
ফিরছে
... ... ... ... ...
... ... ... ... ... ... ... ... ...
বিকেল যেন লুটিয়ে আছে
সারা মাঠে, ওগো বিকেল
তোমার কোথায় দুঃখ বলো?
তুমিও তো
আঁধার হলেই বাড়ি ফিরবে। ... ... ... ... ... ...
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
... ... ... ... ... ... ... ... ... আঁধার
কতো নিথর তৈরি করছে একটা
দুটো বাড়ি।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কী দেখাযায়? – আঁধার কেবল বাড়ি, আঁধার ফিরে-আসার।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
চিরদিনের চেনা বিরাম এক দুই তিন আঁধার গুনছি। (বাড়ি,পিতৃনিলয়)
এই তাঁর ‘পিতৃনিলয়’। এই তাঁর মৃত্যুর স্বরূপ। বিকেলবেলা
বাড়ি ফেরা। অন্ধকারে। বাড়িও অন্ধকার। তারপর কী? আবার ফিরে আসা? মুক্তি? আলোক নীরব।
কেননা, পূর্বে, দীপংকর দাশগুপ্ত’র কথা বলতে গিয়ে, লিখেছিলাম, যে,দীপংকর
দাশগুপ্ত’র ‘সমুদ্র’ কবিতায় ‘সমুদ্র কি সত্যি সত্যি আছে
কোনোখানে’বার বারই এই প্রশ্ন দীপংকর
দাশগুপ্ত স্পষ্ট রাখলেও আর এই প্রশ্ন আলোকেও ষ্পষ্ট না হলেও প্রচ্ছন্ন আর এই প্রচ্ছন্নতা,
ক্রমে, এমনি ‘সাট্ল্’ যে আমি মনে করেনিতে বাধ্য
হই, যে, আলোক মূলতঃ জানেন ‘সমুদ্র’ নেই (তথাপি নৈ্মিত্তিকতার
প্রয়োজনে তাকে গড়ে নিতে হয় মনে মনে।), অতএব ‘মৃত্যু’ই তাঁর কাছে শেষ কথা। তারপরে
আর কিছু নেই।
শেষ হয় ‘পিতৃনিলয়’। আলোক রাখেননা জন্মান্তর বা পূর্বজন্মের
কোনো ইঙ্গিত। তথাপি ‘ঘর-উঠোন’ আলোকের যা ঘটে তা এক পুনর্জন্মই। ভাবনায়।
প্রকাশ ভঙ্গিমায়। এখানে সকলি চিত্র। ছোটো ছোটো নৈমিত্তিকতার ছবি। যে ছবিগুলির মৃত্যুনেই
...
দুলে দুলে বলছে একটা না-বলা
বলো আরো বলো, সবুজ আমতলা
গন্ধ ম-ম করছে।
গন্ধ কিছু বলছে?
গন্ধ বলছে বাজনাওলা, ও বাজনাওলা।
... ...
মোহনপুর, মোহনপুর স্টেশন।
হুহু করছে অন্ধকার, লন্ঠন
ঢালুপথে দুলতে দুলতে
নামছে।
লন্ঠন কারুকে খুঁজছে?
লন্ঠন ঘুরে ঘুরে বলছে – সুমন, আমার সুমন। (‘ঘর-উঠোন’)
এই রকম পরিচিত, অথচ গভীরতায় দিগন্ত বিস্তারী দৃশ্যগুলির কাঠামো, এই পর্বে, রচনা করে তাঁর নিজস্ব নির্মীত ভাষা। অনায়াসে। আরেক সিদ্ধিতে হয় তাঁর উত্তরনঃ
প্রথম কিশোর জানলায় দাঁড়িয়ে।
আর ওই তার বাবা
বাগানে কাজ করছে মুখ নিচু।
... ... ... ... ... ... ... ...
বাবা কাজ করছে ! কতো কতো দিন
কাজ করছে বাবা। সে জানে
তার বাবার সব কাজ
ওই ফুলটার জন্যেই।
সে গলা উঁচু করে বলছে
কষ্ট হচ্ছে! বাবা তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব!
একটা ছাতা নিয়ে
দৌড়ে গিয়ে মাথায় ধরবো তোমার বাবা? (বাবা কাজ করছে, ঘাস রঙের আলো)
কে ওই অনন্ত কালের বাবা আর কে ঐ অনন্ত কালের কিশোর? প্রথম কিশোর? অপু-হরিহর,
আমি আর আমার বাবা না’কি সেই পরম পিতা যাঁর সন্ততি আমরা সকলে? যিনি প্রতিদিন, আপন অন্তরে
বয়েনিয়ে সকল ব্যথাকে, আমাদের জন্যেই ফুটিয়ে চলেছেন ফুল, মুহুর্মুহু? বোঝা যায়না। তবু
বোঝা যায়ও যেন...হায়, আমরা যদি বুঝতে পারতাম, প্রকৃত, যে,
‘ বাবার সব কাজ
ওই ফুলটার জন্যেই ...’
১০।
মৌল স্রোত পেরিয়ে, তেপান্তরের মাঠ ছাড়িয়ে, পাহাড় ভেঙ্গে পথ করে, পথ কেটে নদী
করে হেঁটে চল্লেন আলোক সরকার। কিন্তু কোন দিকে?
কি নূতন মাত্রা তিনি এনে দিলেন বাংলা কবিতায় ? – এমন প্রশ্ন তুলতেই পারেন
তার্কিকেরা। পন্ডিতেরা। এই সাত কান্ড রামায়ণ পড়বার পরেও। এমনি তাঁদের পান্ডিত্য। প্রতিভা।
তাই তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অছিলায় আমি এক্ষণে লিখে রাখবার চেষ্টা করবো আমার
এই সাত কান্ড রামায়ণের সারাংশ। পণ্ডিতদের জন্য শুধু নয়। আমার নিজের জন্যও।
পড়েছি কমল কুমার নাকি বলেছিলেন
যে এমন একটি উপন্যাস লিখবেন যাতে জল রঙ্গের ছবি আর ভাস্কর্য যাবে একাকার হয়ে ( ‘একটি নারী যে একবার জল রঙ
এর চিত্র আবার কখনো ভাস্কর্য’ ... ‘গোলাপ সুন্দরী’ আনন্দ সংস্করনে কমল কুমারের
উপন্যাস সমগ্রের ভূমিকায় সুনীল, এ ছাড়াও অন্য কারোর লেখায় পড়েছি প্রসংগটি, এখন মনে
আসছে না)। ‘গোলাপ সুন্দরী’ নাকি তাঁর সেই নিরীক্ষার
ফসল। কমল কুমারের উপন্যাস বা তাঁর উপন্যাসের তালিকায় ‘গোলাপ সুন্দরী’র অবস্থান কি এই মুহুর্তে তা আমার বিচার্য্য বিষয় নয়। তবে এটুকু মনে হয়েছে
যে, সত্যিই কোনো কোনো মুহুর্ত্তে, যেমন বিলাসের অন্ধকার কক্ষে মণিক চ্যাটার্জী’র আগমনের দৃশ্যে মণিক যেন
প্রায় অবাস্তব। বিলাসের আরেক খেয়ালী কল্পণা... ‘ ... বিলাস তাঁহার সুন্দর
কপালের দিকে লক্ষ্য করিল। এ কপালে একটি তারা আসিয়া দেখা দিতে পারে’। ... অবণ ঠাকুরের জল রঙের
সঙ্গে কোনো সংশ্রব কি নেই এই ছবির?
তারপর মণিক ক্রমে ক্রমে ভাস্কর্য...গোলাপ,
গোলাপ সুন্দরী... ‘মণিক ... সূক্ষ চতুর নর্তকীর মতো নিমেষেই, ঝটিতি, চকিতে গোলাপের
নিকট হইতে অনিন্দনীয় ভঙ্গী সহকারে, হলের এক কোণে এক পা মেলাইয়া দিয়া হস্তদ্বয় শেল্পের
নিকটে রাখিয়া, অসম্ভব ভাবে স্থির করিয়া এখন, “আঃ” বলিয়া মহা যন্ত্রণায় মাথা
দুলাইতে লাগিল...’ ... এইভাবে মণিক ক্রমে রঁদ্যা...
কমলকুমার ও ‘গোলাপ সুন্দরী’র এই প্রসংগ টেনে আনলাম এই কারনে, যে,
যদিও অমিয় চক্রবর্তীর পথেই পা বাড়িয়ে যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল আলোক সরকারের তবে কিয়দ্দুর
গমনের পর, উপস্থাপনার ক্ষেত্রে, প্রথমতঃ, আলোক নিলেন জল রঙের তুলি যেখানে অমিয়র হাতে
আমরণ ছিল ভাস্করের ছেনী। আলোকের হাতে শিল্পের ‘মণিক চ্যাটার্জী’র যে ললাট অঙ্কিত হতে থাকল
তাতে সর্বদা’ই ‘এ কপালে একটি তারা আসিয়া দেখা
দিতে পারে’র সম্ভাবনা রয়ে গেলো এবং ওই
সম্ভাবনার ভাগীরথ আলোক সরকারই।
অমিয়’র উপস্থাপনা ভাস্করের। যা
আছে, তা’ই আছে। আছে সর্বাংগ সহকারে।
সে একেবারে তাঁর প্রথম গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি থেকে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘খসড়া’র প্রথম কবিতা ‘বাড়ি’ সত্যিই বাড়ি। তার সিঁড়ি দিয়ে
ছাতে যাওয়া যায়। দেখা যায় কোথায় কি রয়েছে, রয়েছে কি রকম। পক্ষান্তরে আলোকের ‘বাড়ি’ একটি ধারনা। একটি objective
correlative
। অমিয়র কোথাও নেই কোনো objective correlative ।
জলরঙ্গের ছবির ঐ পথটিতে যেতে গিয়ে আলোক দৃশ্যকে, পারিপার্শ্ব কে দিলেন ডানা।
সে ডানা কেবল ঝিলমের আকাশে উড্ডীয়মান বলাকার ডানার আন্দোলনে পর্বতের বৈশাখের নিরুদ্দেশ
মেঘ হতে চাওয়া নয়। আলোকের রচনা বিশ্বে ডানা রয়েছে সকলেরি। তারা নির্ভার। তারা সকলেই
যেন চরিত্র ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র। দক্ষিণারঞ্জণের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র। এদের মধ্যে আছে শেফালী
গাছ, বটগাছ, প্রেমিকা, কিশোর, তার কর্মরত পিতা, জবা ফুল, প্রপিতামহের গানের খাতা – অর্থাৎ দৈনন্দিনের সাধারন
জিনিস,স্বাভাবিক ঘটনা। যেমন অমিয়’তে। কিন্তু আলোকে তাঁরা থেকেও যেন নেই।
রোগা অন্ধ ছেলে আলপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে
অভ্যস্ত নিপুণ হেঁটে যাওয়া।
জিজ্ঞেস করতে বলল সুর্যাস্ত দেখতে যাবে। (অভিযাত্রা,নিশীথবৃক্ষ)
প্রথম পংক্তিতে যা ছিল ধরা ছোঁওয়ার —‘রোগা অন্ধ ছেলে আলপথ ধরে হেঁটে
যাচ্ছে’ তৃতীয় পংক্তিতে তা’ই হয়েগেল প্রায় রূপক। তার
অন্ধত্বের ভার, তার রোগা শরীরের বাস্তবতা ভেসেগেলো তার (সুর্যাস্ত
দেখার) ইচ্ছার কাছে । অথচ নেই কোনো ম্যাজিক বাস্তবতার কোনো জাদু লন্ঠনের ছোঁয়া। এযেন
লাল কমল আর নীল কমলের গল্প, গল্প বুদ্ধু ভুতুমের। এইমাত্র তারা বানর। অথচ তারা রাজপুত্রও।
ফলে তাদের দুঃখী জীবন ভারি করেনা বাতাস কে। বরং তাদের অভিযানে খুলেযায় সেই ভারকে লাঘব
করবার রাস্তা।
অস্তির সত্যের প্রতি প্রত্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে আলোক ওই নির্ভারতাকেও নিয়ে এলেন
বাংলা কবিতায় আর আমার ধারনা ঐ প্রকরনটি ততোদিনে বাংলা ভাষায় না এসে পরলে পরবর্তী সময়ের
কোনো ভগীরথকে তা নিতে হতো আবিষ্কার করে।
যে বিষয়বস্তু ( কবিতার যদি সেভাবে কোনো বিষয়বস্তু থেকে থাকে...) নিয়ে গৌতম
বসু লিখলেন ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ তাতে যদি ওই ডানা না থাকতো
তাহলে ‘বাদল’ এর ভার বহন করতে গিয়ে হাঁপিয়ে
উঠতো কবিতা। হাঁপিয়ে মরতাম আমরা। ‘পথে বিপথে অন্নের থালা’র ‘বৃত্তাকার ক্ষুধা’ আমাদের গ্রাস করে নিতো। বাংলাভাষা
আরেকটু এগিয়ে গিয়ে পারতোনা উচ্চারন করতে ‘এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু,
এইজল রামপ্রসাদ সেন’...
১১।
আমার আলোক পরিক্রমা সাময়িক এখানেই স্থগিত। তবে এ শুধু আলোচনা ‘কবি’ আলোকের। কিন্তু বাংলা ভাষাকে
আলোক দিয়েছেন অলোক-সামান্য গদ্য। গল্প। সংলাপ কবিতা। সেইখানেও আলোক এমনি ভগীরথ । আলোকের
গঙ্গা আনয়নের সেই পথটিও পরিক্রমা করতে হবে আমাকে, আমাদেরকে। অতি সত্ত্বর। অতি শ্রদ্ধায়।
আপাততঃ শুধু এই বলেই থামি, যে, কোনো মহৎ কবিরি যেমন কোনো সরাসরি অনুগামী হওয়া অসম্ভব,
তেমনি আলোকেরো নেই কোনো সরাসরি অনুগামী। প্রকৃত বাংলা কবিতার যে স্রোত তাতে আলোকের
ছায়া আশ্বাসের মতো বিদ্যমান । সমসাময়িক বহু প্রকৃত কবির রচনা প্রক্রিয়ার গহনে টের পাওয়া
যায় আলোক সরকারের দ্যুতির ইঙ্গিত । আমার মনেপড়ে তাঁরি রচিত পংক্তিমালাঃ
বুকের মধ্যে শুনতে পাও আন্তরিক ধ্বনি –
হাজার ঝরাপাতার বুকে পায়ের চিহ্ন মর্মরিত আছে ...
আদি লেখনঃ ৩১/০১/২০১০
ফিরেলেখাঃ অক্টোবর, ২০১০ ( “আদম” পত্রিকায় প্রকাশিত সংস্করণ)
ফিরেদেখাঃ ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০, বেঙ্গালোর