‘ তার অন্ত নাই গো নাই ’
নিজের সঙ্গে একটু একা থাকার লোভে অফিস পালিয়েছিলাম। পালিয়েছিলাম বাড়ি।
কিন্তু এই ‘বংগালোর’ নাকি ‘ভংগালোর’ এমনি স্থান যেখানে পালানোর ও পথ নেই।
সব পথই পৌঁছেযায় নির্ভুল গন্তব্যে কেননা আর কিছু না হোক সেল্ফোন আর ইংরেজি সর্বত্র।
‘Yes man, just chilling’,
‘Yep, they offered 6% more...’
হাফ্পেন্ট পরা বুড়ো হাবড়ার স্বাস্থ্য ফেরানোর ফিকির। বসে থাকবার উপায় নেই গাছতলাতেও। গাছতলা গুলোও যেন এদের স্পর্শে অপবিত্র। আর গাছতলাই বা কোথায়? এ সমস্ত তো ‘পার্ক’। সাজানো গোছানো। আইটিবাবুদের সংসারের মতো।
অতএব পালাতেও বেছে নিতে হয় একটি গন্তব্য। যাই British Library’তে। কিছু বই আর ডিভিডি এনেছিলাম মাস খানেক আগে। ফেরৎ দেবো বলে পিঠব্যাগে ভরে রেখেছি কবেই। ব্যাগ ছিল আজো পিঠে। তাই ভাবলাম ফেরৎ দিয়েই আসি আর দেখি কিছু দেখার, পড়ার পাই কিনা।
British Library’তে ও এরাই। এই বারমুডা স্মার্ট এর দল। তবে বইপুঁথি কিছু মেলে । একটা পছন্দ মতন বই টই নিয়ে এক পাশে বসে থাকা যায়। অন্যথায় যাপন পরিধি বলতে মলদ্বার থেকে বার হয়ে পাব্। কেতা দুরস্ত পাব্। ব্যস।
বৃটিশ লাইব্রেরীতে পেয়ে গেলাম Thom Eberhardt এর Without a Clue ছবিটা। ছবিটি বিষয়ে পড়া ছিল। তাই হাতে নিয়ে ভাবলাম বাহ্। বেশ মস্তিতে দেখাযাবে বাড়ি গিয়ে। বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। খেয়াল হলো ছেলের জন্য নূতন ‘আনন্দমেলা’ টা নিয়ে যেতে হবে। এলাম সেই একমাত্র দোকানে যেখানে পাওয়া যায় ‘আনন্দমেলা’। এসে দেখি সেখানে রয়েছে ইংরেজি আর বাংলা ‘স্টেট্স্ম্যান’ পূজা সংখ্যা। ইংরেজি খানা হাতে নিয়েও রেখে দিলাম। কিশোর চ্যাটার্জী ইত্যাদি হাতে গোনা দেড় দুইজন ছাড়া আর সব্বার ইংরেজি থেকেই ভুর্ ভুর্ করে বেরোয় ‘দেবেন বিড়ি’, ‘নগেন বিড়ি’ আর ‘নন্দন’, ‘একাডেমী’, ‘কফিহাউসে’র ঘ্রাণ। পড়লে মনে পড়ে “ও মাউন্ট ব্যাটন সাহেব অ, তুমার সাধের ব্যাঠন কার হাতো থুইয়া গেলায় গো…’।
এবারে স্টেটস্ম্যানের বঙ্গ ভার্সন। গত বছরও কিনে ছিলাম। আদতে শুধুমাত্র বাংলা অক্ষরের মায়ায়, টানে। ওই বাংলা ‘স্টেট্স্ম্যান’ পূজা সংখ্যাটিও যে কি হবে তার একটা ধারণা ছিল। উল্টে দেখি এবার কিন্তু বেশ ভালো চাল চেলেছেন তাঁরা। সর্ব যুগের সর্ব কালের বেষ্ট-সেলার’কে নিয়েই এবারের পূজোয় তাঁদের বাণিজ্য। সংখ্যাটি রবীন্দ্রনাথের উপর এবং তাতে ছাপা হয়েছে কাননবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কিছু অপ্রকাশিত রচনা। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে। ফলে আর কে কি উগ্ড়েছে না দেখেই এ পক্ষের ‘আনন্দমেলা’র সঙ্গে ওটাকেও বগলদাবা করে চালক মহাশয়কে বললাম বাড়িমুখো হতে। প্ল্যান বাড়ি গিয়েই চালিয়ে বসব Without a Clue ...
আনমনে পাতা ওল্টাচ্ছি সেই বাংলা ‘স্টেট্স্ম্যান’ পূজা সংখ্যাটির। হঠাৎ’ই চোখে পড়লো একটি শিরোনামঃ ‘রবীন্দ্রনাথ কেন সর্বজনের...’।
মনেহলো দেখা যাক্তো, ইশ্কুলের নীচু ক্লাশ থেকে যে বিষয় নিয়ে ‘রচনা’ লিখে লিখে আঙ্গুল ছিঁড়েগেলো ছেলেমেয়েদের তা নিয়ে পূজো সংখ্যায় কি লেখা হয়।
লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরি ।
যদিও রবীন্দ্রনাথ যে ঠিক কেন সর্বজনের সে ব্যাখ্যার বা চিন্তার দিকে যায়নি রচনাটি তবে ব্যক্তিগত অনুভুতি-নির্ভর এ এক অনন্য লেখা। পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে চলে এলাব তৃতীয় পাতায় আর সেখানেই উল্লেখ ওই গানটিরঃ ‘তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ/ তার অণু-পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ,/ও তার অন্ত নাই গো নাই ...’
...পড়া আর এগোনো গেলো না।
গানটিই টেনে নিলো।
গেয়ে উঠলাম নিজেই। হেঁড়ে গলায়। সাময়িক ভুলে গেলাম আমি আছি ‘ভংগালোর’ এ। ভুলে গেলাম আমার পরিকল্পণা … Without a Clue …
গানটি বাজতে লাগলো ভিতরে ভিতরে।
না’কি গানটিই বাজিয়ে দিলো আমাকে?
জানিনা। বাড়ি এসে চালিয়ে দিলাম ঐ গান ‘তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ/ তার অণু-পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ,/ও তার অন্ত নাই গো নাই ...’ আর প্রকৃতই যেন আমার অঙ্গের প্রতিটি অনু-পরমানু পেতে লাগলো আনন্দের সান্নিধ্য...
এমনি হয়। যতোক্ষন না একটা বড় স্রোত এসে টান মেরে নিয়েযায় ততোক্ষনই ছোটো ঢেউগুলি সত্য। আর একবার যদি ঢেউ এলো, যেই ঢেউ এলো অমনি সব গেলো ভেসে।
শুধু রইলো ঢেউ।
রইলাম আমি। আর রইলো গান।
‘তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ/ তার অণু-পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ,/ও তার অন্ত নাই গো নাই ...’
২৬/১০/২০১০
সামান্য অদল বদলঃ ২৯/০৬/২০২২