সাক্ষাৎকার
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
বৃষ্টি আর বাতাসে একাকার এক সন্ধ্যার ভিতর দিয়া হাঁটিতেছিল
অবিনাশ।
সারারাত্রি বৃষ্টি হইয়াছে অঝোরে। আজো ঝরিতেছে অবিশ্রাম। তবে
রাত্রির ঐ মুষলধার এখন আর নাই। এখন ঝরিতেছে ঢিমে তালে। মাঠের বুক চিরিয়া পথ। পায়ে
চলার পথ। মাঠের একপ্রান্তে বেড়া। কন্চির ফাঁক ফাঁক বেড়া। বেড়ার গোড়ায় জল। ঐ পারে
বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়দিগের মাথায় মাথায় বাঁধিয়া আছে মেঘ। কোমর জড়াইয়া উঠিয়া আসিতেছে
অন্ধকার। বাঁশঝাড়দিগের মাথাগুলি দুলিতেছে বাদলার বাতাসে। মাঝে মাঝে। পড়িতেছে
বিন্দু বিন্দু জল। নড়িতেছে পাতা। কাঁপিয়া উঠিতেছে মাঠের শরীরে দাঁড়াইয়া যাওয়া জলের
পাতলা আয়না। আয়নার জলজ ত্বক ভেদ করিয়া বাহির হইয়া আছে লম্বা আর সরু সরু মেঠো
ঘাসগুলি। দুলিতেছে বাতাসে। জন্মাইতেছে ছোটো ছোটো গোল গোল ঢেউ। মিলাইয়া যাইতেছে
অচিরে। যদিও জল আরেকবার চাপিয়া নামার আগেই ইষ্টিশানে পৌঁছানো দরকার তথাপি থামিল
অবিনাশ। নদী, লঙ্গাই, অদূরেই। বর্ষায় সে’ও মাতোয়ারা।
মক্ষিকার গুঞ্জন হেন তাহারো অষ্পষ্ট গমন শব্দ ভাসিতেছে বাতাসে। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া
একটি সিগারেট জ্বালাইয়া লইল অবিনাশ। চোখে ভাসিল খোকার মুখ। খোকা এখন কি করিতেছে
...
গতকাল মধ্যরাত্রে
বৃষ্টি যখন প্রবল হইল, হইল মুষলধার, তখন পিছনের দিকের আমগাছটির বেশ বড়োসরো শক্ত
একটি ডাল ভাঙ্গিয়া পরিল তাহাদের টিনের চালে। খোকা জাগিয়া উঠিল সেই শব্দে। কাঁদিয়া
উঠিল। বিদ্যুতের তার ছিঁড়িয়া গিয়া ইলেক্ট্রিক চলিয়া গিয়াছে অনেকক্ষণ। জানালা দরজার
ফাঁক ফোঁকড় ঠেলিয়া ঢুকিয়া পরা তাতার বাতাসে লন্ঠনের শিখাও কাঁপিয়া কাঁপিয়া
উঠিতেছে। আধো অন্ধকারে , সেই কম্পিত শিখায় তাহাদের নিজেদের ছায়াগুলিও যেন ভীতিপ্রদ
... তাহাদের নিজেদের ছায়াগুলিও দোল্যমান দেওয়ালে দেওয়ালে ... এই অন্ধকার আর ছায়ায়
মিলিয়া দ্বিগুন চতুর্গুন হইল খোকার ভয় ... ফলে মা’র কোল হইতে
বাবার কোলকেই সাময়িক তাহার মনে হইল নিরাপদতর।
মাল্যশ্রী’র কোল হইতে অবিনাশের কোলে আসিয়া তাহার
ক্রন্দন ক্রমে থামিলে ঘরময় পায়চারি করিয়া, পিঠে মৃদু চাপড় দিয়া তাহাকে পুনরায় ঘুম
পাড়াইবার চেষ্টা লইল অবিনাশ। সেই পিঠ
চাপড়ানোর তালে তালে নিজের অজান্তেই কখন যেন গাহিয়া উঠিল অবিনাশঃ ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার ... পরাণ সখা বন্ধু হে আমার ...’
ক্রমে ঘুমাইয়া পরিল খোকা। ঘুমন্ত খোকাকে সাবধানে মাল্যশ্রী’র কিনারে শোয়াইয়া দিয়া পাকঘরে আসিল অবিনাশ। পাকঘরের কাঁচের জানালায়
মুহুর্ত্তে, বিদ্যুচ্চমকে ষ্পষ্ট হয় হরেন সেনের নাবাল জমি। জমি পারাইয়া উঁচু মাটীর
গলী। গলীর পারাইয়া মজা ডোবা। ডোবার পারে বংকিম দাসের পাকা বাড়ি। এক দিকে এইসব আর
আরেকদিকে পাকা সড়ক বিদ্যুচ্চমকে তাহাকে যেন মনেহয় এক নদী ...বিদ্যুচ্চমকে সমস্তকেই
দেখায় অন্যরূপ। অপরূপ। চির পরিচিত আবহও যায় বদলাইয়া ... যেনবা এক টুকরা রূপকথা
পৃথিবীতে নামিয়া আসিয়া বিলুপ্ত হয় পর মুহুর্তেই ...
বিষ্ণু’র বাবার শ্রাদ্ধ ছিল আজ। অবিনাশের সন্ধানে বিষ্ণু প্রথমে আসিয়াছিল বাড়িতে।
পরে শিলচরে গিয়াও দেখা করিয়া বলিয়া আসিয়াছে। ফলে লোকজন, ভিড় ইত্যাদি এড়াইয়া চলিলেও
আসিতেই হইল অবিনাশকে।
বিষ্ণু আসিত মণিময়দের বাসায়। মাঝারি উচ্চতার শ্যামলা
ছেলেটির চোখে মুখে ছিল এক ভিতু ভাব। সে পড়িত শ্যামসুন্দর ইস্কুলে। ঐ ইস্কুলে মূলতঃ
পড়িতে আসিত তাহারাই যাহাদের অভিভাবকজনের ইহা জ্ঞাতই ছিলো যে তাঁহাদের
পুত্র-কন্যাদিগের পাশ দিয়া ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ার হইবার কোনা আশাই নাই ... আসিত দূর
গ্রামের ছেলেরা...আসিত বাজারের শব্জী বিক্রেতার ছেলেরা ... আসিত বিষ্ণুপদ। সে’ও গ্রামেরি ছেলে। গ্রামের নাম মহিষাসন। লঙ্গাই ষ্টেশন হইতে কয়েকটি ষ্টেশন
পারাইয়া। যেহেতু সেখানে নাই হাই-ইস্কুল তাই সকালের ট্রেইনে চাপিয়া করিমগঞ্জ আসিত বিষ্ণু
আর ইস্কুল ছুটি হইলে ফিরিত পায়ে হাঁটিয়া। ফিরিবার গাড়ি সেই রাত্রি আটটা নাগাদ।
বাসে যাওয়ার সঙ্গতি ছিলনা নিশ্চয়।
মণিময় ছিল অবিনাশের বন্ধু। তাহারা যাইত গবর্নমেন্ট স্কুলে। মণিময়ের মা অংক
আর বিজ্ঞান পড়াইতেন সেই শ্যামসুন্দর ইস্কুলে। বিষ্ণু যে লেখাপড়ায় ভালো ইহা বুঝিয়া
তিনি তাহাকে বাড়িতে ডাকিয়া আনিয়া পড়া বুঝাইয়া দিতেন। তাছাড়া সকালে বিকালে যে রাস্তায়
আসিতে যাইতে হইত বিষ্ণুর, সেই রাস্তা ছুঁইয়া গিয়াছে অবিনাশের বাড়িকে । ফলতঃ
মণিময়ের বাড়ি ছাড়াও বিষ্ণুর সহিত দেখা হইত অবিনাশের।
প্রথম
প্রথম একটু আড়ষ্ট হইয়া থাকিত বিষ্ণু। কিন্তু সেই আড়ষ্টতা একদিন গেলো ভাঙ্গিয়া। অকস্মাৎ।
তখন ক্লাস নাইন টেন্ হইবে। সেইদিন ইস্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হইয়াছিল। প্রতিদিনের
রাস্তায় প্রতিদিনের বন্ধুরা নামিয়া পরিলে হৈ হৈ করিয়া অবিনাশ ধরিয়াছিল অন্য
রাস্তা। সরল খাঁ’র দীঘির রাস্তা। ওই রাস্তা ঘুরপথ। ঐ রাস্তায়
বাড়ি ফিরিতে গেলে অনেকদূর উজাইয়া আসিতে হয় অবিনাশকে। ঐ রাস্তার একমাথা সেটেল্মেন্ট
রোডে’র বাজারের দিকে। শ্যামসুন্দর ইস্কুলের প্রায় মুখামুখি।
আরেক মাথা অবিনাশদের পাড়ায়। মাঝখানে কবরখানা। পারাইয়া পাগলা পীরের দরগা। টিলার
উপরে। টিলাময় বাঁশঝাড়। শীত বাতাসে তাহারা আলোড়িত। আন্দোলিত। টিলার নীচে ছোটো
সাঁকো। বাঁশগাছের ছায়ায় সেইখানে দিনমানেও অন্ধকার। শুকানো পাতার উপর দিয়া হাঁটিয়া
গেলে শব্দ ওঠে ঝরাপাতার। কিনারে শ্যাওলা ঢাকা পুকুর। তাহার শরীরে নুইয়া পরিয়াছে
আমগাছ। পায়েচলার ছোট্ট পথ। পথের ঐ ধারে সরল খাঁ’র কবর। কবরের
গায়ে ছায়াদায়ী বট। অশত্থ। ঝুড়ি নামিয়াছে
দশদিকে। যেন সহস্র আঙ্গুলে তাহারা আগলাইয়া রাখিয়াছে ঘুমন্ত সরল খাঁ’কে। এরপরে পথের ডানদিকে মাঠ। মিলিয়াছে ধানক্ষেতে। বাম দিকে সেই দীঘি। ‘সরল খাঁ’র দীঘি’। যদিও দীঘির
সেই থৈ থৈ জল শুকাইয়াছে বহুযুগ, জন্মাবধি দীঘির ঐ থৈ থৈ রূপ দেখেনাই অবিনাশ তথাপি
দীঘির আদিগন্ত বিস্তারের শরীরের ঝোপঝাড়, কচুরীপানার মানচিত্র আর পাখি পাখালির
ডাক...ঝিঁঝিঁ’র শব্দ এই সমস্ত জাদু করিয়া লয় তাহাকে ...
ডাকিতে থাকে দীঘির পারের সেই বিরাট দুই যমজ অশত্থবৃক্ষ ...
সেটেল্মেন্ট রোড হইতে ঐ পথে নামিবার মুখে
আজিজের পানবিড়ির দোকান। শ্যামসুন্দর
ইস্কুলের বহু ছেলেরাই ঐ দোকান হইতে বিড়ি সিগারেট কিনিয়া লইয়া দরগার টিলার উপরে
গিয়া টানিয়া আসে। আজ ঐ দোকান হইতে পাঁচটি ফিল্টার উইল্স্ সিগারেট কিনিয়া লইল
অবিনাশ। সঙ্গে একটি ঘোড়ামার্কা দিয়াশলাই। আজ না হইলে আবার কবে যে এমন সুযোগ আসিবে
কেজানে। আজ ইস্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হইয়াছে। আজ মা গিয়াছে মামাবাড়ি ছোটোভাইকে লইয়া।
শিলচরে। আজ কলেজে বাবার পরীক্ষার ডিউটি। ফিরিতে ফিরিতে সেই পাঁচটা ছয়টা। ফলে
সিগারেট টানিয়া বাড়ি গিয়া হাতমুখ ধুইয়া, ভাত খাইয়া প্রমাণ লোপ করা যাইবে অতি সহজে।
সেই প্রায় একযুগ আগে এমনি এক দুপুরে বিকাশের সঙ্গে বসিয়া, এইখানেই, এই যমজ
অশত্থগাছের ছায়ায়, ফিল্টার উইল্স্ টানিয়াছিল অবিনাশ...অদ্য সেই আমোদের
পুনরাবৃত্তি’র লোভে সে পা রাখিল সরল খাঁ’র দীঘির এই পায়েচলা পথে ... যে পথকে তাহার মনেহয় প্রায় অবাস্তব বলিয়া ...
মনেহয় একদিন যেনবা ভোজবাজির মতো হারাইয়া যাইতেও পারে এই পথ, এই দীঘি... কবরখানা...
পাগলা পীরের দরগা...টিলা ... সবকিছু ...
জ্বলিয়া
উঠিল বারুদ। দিয়াশলাই কাঠির। অবিনাশের ঠোঁট, সিগারেট সহ, নামিয়া আগাইয়া গেলো
আগুনের দিকে। তখনি সরল খাঁ’র দীঘির দমকা বাতাস আসিয়া নিভাইয়া দিলো ঐ
আগুন। আবার কাঠি ঠুকিল অবিনাশ। আবার নিভিল কাঠি। আবার – আবার
– সিগারেট জ্বলিল না। ঐ জ্বলানেভার খেলায় মগ্ন হইয়া গেলো
অবিনাশ। সাময়িক। ফলতঃ লক্ষ্যই করিলনা, যে, একজন দর্শক জুটিয়া গিয়াছে তাহার।
‘ আমাকে দাও, আমি দিচ্ছি ধরিয়ে ...’
চম্কাইয়া উঠিয়া মুখ ফিরাইল অবিনাশ। তাহার পশ্চাতে
দন্ডায়মান বিষ্ণু। বিষ্ণুর মুখে, এক্ষণে , আড়ষ্টতার বদলে এক রকমের মুচ্কি হাসির
রেখা চোখাচোখি মাত্র টের পাইল অবিনাশ। দিয়াশলাই এর বাক্স আস্তে আস্তে বাড়াইয়া দিল
বিষ্ণুকে। দুই হাতের দশ আঙ্গুলের ভিতরে বিষ্ণু অগ্নিকুন্ড জ্বালাইল অবলীলায়। সেই
আগুনে জ্বলিয়া উঠিল অবিনাশের ঠোঁটে রাখা ফিল্টার উইল্স্। টান দিয়া ধোঁয়া ছাড়িয়া
অবিনাশ বলিলঃ ‘আরো আছে, খাবে?’
‘দাও’...
পাঁচটি সিগারেটই, ক্রমে, নিঃশেষ করিল দুইজনে। শীত দুপুরের
সূর্য্য হেলিলেন বৈকালের দিকে। ইতোমধ্যে ইহারাও ‘তুমি’ হইতে পৌঁছিল ‘তুই’ এর নৈকট্যে
...
‘জগ্দীপ পাল ছুটি দেবে?’ –
বলিয়াছিল মাল্যশ্রী।
‘ দিয়েছে’ বলিয়া
সামলাইয়া নিয়াছিল অবিনাশ কেননা নামটি উচ্চারিত হওয়ামাত্র জগ্দীপ পালের মুখটি শুধু
নয় সমগ্র অস্তিত্বটিই যেন জাগিয়া উঠিল অবিনাশের গহনে। ... জগ্দীপ পালের কারখানায়
এই চাকুরী মূলতঃ জগ্দীপ পালের বদান্যতা। বেতনও সামান্যই। কাজের মধ্যে কাজ বিক্রি
বাটার ডাটা এন্ট্রি করা। সে’তো ফুরাইয়া যায় ঘন্টা দুইএর
মধ্যেই। অতঃপর শুনিয়া যাইতে হয় জগ্দীপ পালের বক্তৃতা। জীবন বিষয়ে। সাহিত্য বিষয়ে।
মূল কাজ ঐ টি’ই। জগ্দীপ পাল অবিনাশের চেয়ে বছর সাত আটের বড়
হইলেও পয়সা করিয়াছে বিস্তর। একদা চেষ্টা করিয়াছিল সাহিত্য করিবারও। যখনো সে হয়নাই
উঠতি জামশেদজী টাটা সেই আমলে যাহারা তাহাকে পাত্তা দেয়নাই বা ছাপে নাই তাহার রচনা,
অধুনা সে বদ্লা লইতেছে সে সমস্তের। মোটা টাকার বিজ্ঞাপন দিতেছে ঐ সব ‘লিট্ল ম্যাগ্’ এর পাতায়। অতএব তাহার লেখা ফিরাইয়া
দেয় এমন সাহিত্য সেবক এতদ্অঞ্চলে ... এতদ্অঞ্চলে কেন কোন্খানে আছে কে জানে ...
তাহার একটি গল্প সংকলনও প্রকাশিত হইল বলিয়া...
অন্যদিন সকালের মতোই আজো সে বাহির হইয়া পরে মাল্যশ্রী খোকাকে লইয়া ইস্কুলের
পথে বাহির হইবার আগেই। রোদ-জল ভাঙ্গিয়া প্রতিদিন মাল্যশ্রীর ইস্কুলে যাওয়ার ঐ
দৃশ্য হইতে অবিনাশ পলাইয়া থাকিতে চায় প্রকৃত প্রস্তাবে। সমীর বা বাবলু দেবের বউ এর
মতো শখের চাকুরী হইলে বাধা ছিলোনা। কিন্তু মাল্যশ্রীকে চাকরিতে যাইতে হয় নিতান্ত
প্রয়োজনের তাগিদেই আর এতাবৎ এই বাস্তবতাটির সহিত আপনাকে মানাইয়া লইতে পারেনাই
অবিনাশ...
রাস্তায় নামিয়া জগ্দীপ পালের কারখানার দিকে না গিয়া সে চলিল বাস ডিপোর
রাস্তায়। টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি হইতেছে সমানে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। এই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
শিলচরের মতন একটি আদ্যন্ত দেউলিয়া শহরকেও করিয়া তুলিতে পারে কি’যে মোহময়! এই শহরেই সে পড়িয়াছে হোষ্টেলে থাকিয়া। কলেজের বাসে চড়িয়া
আসিয়াছে সিনেমা দেখিতে। সেই আমলে লুকাইয়া চুরাইয়া মাল্যশ্রীকে লইয়াও কতো ঘোরাঘোরি
এই শহরেই ... তখন এই শহরটিকেই কেমন অপরূপ স্বপ্নবৎ মনে হইত ... মনে হইত প্রতিটি
রাত্রির শেষে প্রতিটি সকাল আসিতেছে না জানি কোন্ বিপুল ঐশ্বর্য্য লইয়া ...এখন আর
মনে হয়না তেমন। কেবল প্রতিরাত্রে খোকার ঘুমন্ত মুখের দিকে চাহিলেই মনেহয় পরদিন
সকালবেলা কখন জাগিবে খোকা ... কখন হাসিয়া উঠিবে ... বলিবে কোন্ নূতন কথা ...
অদ্ভুত শব্দ ... খোকার ঐ স্বর্গীয় মুখের দিকে চাহিয়াই কখনো মনেহয় চলিয়া যাইতে
বোম্বাই ... যদি ইহাতে কোনোভাবে নিরাপদ করাযায় খোকার ভবিষ্যৎ ... কিন্তু এই দুই
ছন্নছাড়া শহর – করিমগঞ্জ আর শিলচর তাহাকে কি জাদু করিয়াছে
কেজানে ... মায়ায়, হতাশায়, জিঘাংসায়, কামনায় একাকার ব্যর্থ প্রেমিকের মতো সে
থাকিয়া যায় এই গন্ডীর ভিতরে ... পারেনা পারাইয়া যাইতে ...
বাস ছাড়িয়া দিল অনতিবিলম্বে। মেঘলা
সকালের ভিতর দিয়া বাস পারহয় তারাপুরের ওভারব্রীজ। পারহয় ছোটোনদী ঘাঘ্রা। পীচ
রাস্তার কিনারে বরাক নদী আসিয়া পরিয়া চলিতে থাকে পথের পাশাপাশি। খোকার মুখটি
ভাসিয়া ওঠে অবিনাশের গহনে…
করিমগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নামিয়াই রিক্সা লইল অবিনাশ। বৃষ্টি
পরিতেছে টিপ্ টিপ্। তবে বৃষ্টি হইতেও বেশীভয় পরিচিত মুখগুলিকে। বৃষ্টিতে মায়াময়
হইয়া উঠিয়াছে এই শহরটিও। অলস একখানি ছোটো খাল চলিয়া গিয়াছে বড় রাস্তার কিনারে
কিনারে। শহরের কি হইল, শহরবাসীর কাহার কি হইল এ সমস্তের প্রতি উদাসীন এই যাওয়া তাহার।
আহা, এমনি ভাবে সে’ও যদি পারিত, এমনি উদাসীনতার ভিতর দিয়া এই
জীবনটি কাটাইয়া দিতে ...
বাড়ি আসিয়া, ঝোলা ব্যাগটি রাখিয়াই বাহির হইয়া পরিয়াছিল সে।
বাড়িতে তখন মা শুধু। ছোটভাই টিউশান পড়াইতে গিয়াছে।
‘ বাবাকে দেখছিনা, বাবা কোথায়?’
‘ সকাল সকাল বেড়িয়েগেছেন আজ। কোথায় কৃষকমঞ্চ
না কিসের যেন মিটিং আছে বললেন..., তুই স্নান করে ভাত খেয়ে বেরো যেখানে বেরোনোর...’
‘ স্নান করবো। তবে ভাত খাবোনা। নিমন্ত্রণ আছে
...’
‘ মালা’রা আসবেনা আজ?’
‘ আসবে। বিকেলের বাসে ...’
‘ তুই যাবি আনতে? বাসস্ট্যান্ডে? যা
দুর্যোগের দিন করেছে ... বাচ্চা নিয়ে একা এতোটা আসা...’
‘ আমার ফিরতে দেরীহবে... রতনকে বলেদেখো ও
পারে যদি ...’
বিষ্ণুর বাড়ির নামসংকীর্তণ বেশ জমিয়া উঠিয়াছে। এতো দূরে আসিয়াও হানা
দিতেছে সেই আধো সুরেলা কোলাহল। বিষ্ণুর বাবার আত্না কি তৃপ্ত হইতেছেন? এই ‘বাবা’ মহাশয়
নিরুদ্দেশ হইয়াছিলেন বিষ্ণু’র বয়স যখন তিন চারি বৎসর। কেন যে
হইয়াছিলেন নিরুদ্দেশ কেজানে। বিষ্ণু নিজেই বলিয়াছিলঃ বাবা অভাবে বাড়ি ছেড়েছিল
তেমনো ভাবার কোনো কারন নেই। মা বলেছে, মামারাও বলেছে দেশে বেশ বড়ো সড়ো দোকান ছিল
বাবার ... আমার ঠাকুর্দার আমলের দোকান ...’মাধ্যমিকে ফার্ষ্ট
ডিভিশান পাইয়াছিল বিষ্ণু। শ্যামসুন্দর ইস্কুলের দশ বৎসরের থার্ড ডিভিশন আর
সাপ্লিমেন্টারির রেকর্ড ভাঙ্গিয়া দিয়া শহরে হৈ চৈ ফেলিয়া দিল বিষ্ণু। মণিময়ের মা’কে প্রণাম করিতে আসিল মিষ্টি লইয়া। অবিনাশ বুঝিল মাষ্টার রাখিয়া নিয়মিত
পড়িবার সুযোগ পাইলে বিষ্ণু নির্ঘাৎ আরো ভালো ফল করিতে পারিত। তারপর কলেজে ভর্তির
হট্টগোলে চাপা পড়িয়া গেলো বিষ্ণূ কিছুদিন। সেইদিন সকাল সকাল কলেজে যাইবার তোড়জোর
করিতেছে অবিনাশ। ক্লাসের আগ্রহে যতোটা নয় তার চাইতে ঢের বেশী আড্ডা দিবার আগ্রহে।
এমন সময় বিষ্ণু আসিয়া হাজির।
-
‘কি’রে এতোদিন তোর কোনো
দেখা সাক্ষাৎ নেই? ছিলি কোথায়? কোথায় এড্মিশান নিলি?’
-
‘না’রে আমার কলেজে পড়া
হবেনা ...’ এইবার বিষ্ণুর চোখ মুখ স্পষ্ট বিষন্ন।
-
‘ কেন?’
-
‘ মামারা আর কতো পারবে বল্? ইস্কুলে
পড়িয়েছে। মা’কে দেখছে
...ওঁদেরোতো খুব কিছু নেই ...’
কথায় কথায় আসিয়া পড়িল তাহার বাবার নিরুদ্দেশ হওয়ার কাহিনী।
সেই নিরুদ্দিষ্ট পিতার প্রতি বিষ্ণুর না আছে কোনো অভিযোগ না, কোনো ভালবাসা। অন্য
কোনো মানুষের গল্প বলিবার মতো করিয়া বিষ্ণু বলিয়া গেলো কথাগুলি।
-
‘ এখন কি করবি?’
-
‘চাকরী। নেভিতে চান্স পেয়েছি ...’
খাওয়া দাওয়ার শেষে একশো টাকা দক্ষিণাও জুটিল
ব্রাহ্মণভোজনের। বিষ্ণু বলিল ‘আমার কোঠায় শুরে আরাম কর্ ,
ট্রেন তো সেই রাত্রিবেলা ...’
বাড়ির পিছনে বিষ্ণুর কোঠাটি বেশ নিরিবিলি। বিষ্ণুর বিছানায়
কাত্ হইয়া শুইয়া থাকিয়া আর পিছনের পুকুরে, গাছপালায় বৃষ্টি দেখিয়া এলোমেলো কথা
ভাবিতে লাগিল অবিনাশ। বিষ্ণুর সেই খোয়া যাওয়া বাপ ফিরিল বছর দুই আগে। নিমন্ত্রণ
করিতে আসিয়া বিষ্ণু বলিয়াছিলঃ ‘ বাপ না কাকা না ঠাকুর্দা কে
জানে, তবে মা যখন বলেছে বাপ, তখন বাপই ধরে নিতে হবে ...’
এইবার বিষ্ণুর স্বরে তিক্ততা। বিষ্ণু এখন থাকে পুণাতে। নেভির তেমন সাংঘাতিক সাহেব
সুবো না হইলেও অনুমান করাযায় আয় উপায় ভালোই। বাপ ফিরিলে তাহাকে দেখিতে আসিয়াছিল
বিষ্ণু। তখনি শেষদেখা অবিনাশের সঙ্গে।
-
‘ মা আর মামারা হুলুস্থুল লাগালো বলে এলাম
...’ বলিয়াছিল বিষ্ণু।
বিষ্ণুকে দেখিয়া মন্দ লাগেনাই অবিনাশের। বাল্যজীবন অকথ্য
দারিদ্রে কাটাইয়া পরবর্তীতে যাহারা বেশ টুপাইস্ করিয়া লয় তাহাদের প্রায় সকলেরি
চরিত্রের মর্মে ছায়াফেলে শূকর কিংবা বরাহ। বিষ্ণুতেও যে তেমন ছায়া একেবারেই নাই
তেমন নহে। তথাপি মন্দ লাগেনাই অবিনাশের। ফিরিয়া আসিবার সময় বিষ্ণু বলিল ‘ তুই আসায় বড়ো খুশি হয়েছি রে ...যাবার আগে সময় করে উঠতে পারলে যাবো তোর
বাসায় ...’
পথে নামিয়া
অবিনাশ টের পাইল যে সে বড় ক্লান্ত। অথচ সে নিজেই জানিত না যে সে এতো ক্লান্ত। টের
পায় সে ছুটি চাহিয়াছিল। যেন কতো কতো যুগের বন্দীত্ব তাহাকে ভুলাইয়া দিয়াছিল ছুটির
কথা। ছুটির প্রয়োজন। এক সময় মনে এমনি কোনো বন্দীত্বের বোধে তাড়িত হইয়াই কি
নিরুদ্দেশ হইয়াছিল বিষ্ণুপদ’র বাবা? অবিনাশও কি এমনি
নিরুদ্দেশ হইয়া যাইবে একদিন? ... বৃষ্টি আসিল। অঝোরে না হইলেও এইবার বেশ জোরেই
নামিল জল। তবে ততোক্ষণে রেললাইনের কিনারের সেই একচালা, যাহার নাম ‘মহিষাসন ষ্টেশন’ সেই একচালায় আসিয়া গিয়াছে অবিনাশ। সংলগ্ন একটি টিকিট ঘর। এখন বন্ধ।
সকালেও বন্ধ ছিল। বন্ধই থাকে সচরাচর। তবে যেহেতু ট্রেইন থামে এইখানে, লোক উঠে, লোক
নামে – তাই ইষ্টিশান। সেই ইষ্টিশান, অধুনা, অন্ধকারের অতলে। দূরে
টুকরা টুকরা ভাঙ্গা ভাঙ্গা আলোক বিন্দুর চলাচল। লন্ঠনের নতুবা কূপীর আর বাতাসে
ভাসমান বিষ্ণুদের বাড়ি হইতে আগত কীর্তনের নাছোড় সুর।
ট্রেইন আসিতে আর
কতো দেরী? ভাবে অবিনাশ। ঘড়ি দেখিবার ইচ্ছাও হয়না, অর্থও হয় না। আরো খানিক্ষন
অপেক্ষা করিবে। নেহাৎই না আসিলে ট্রেইন হাঁটা দিবে রেল লাইন ধরিয়া। চারখানিতো মোটে
ষ্টেশন। ঢিমে তেতালায় চলা এই রেলগাড়ির তাহা পারাইতেই লাগে দেড় ঘন্টা। জোরে হাঁটিলে
কতক্ষন লাগিবে তাহার? বড়জোর তিনঘন্টা? তা লাগে লাগুক। খোকা ঘুমাইয়া পড়িবার আগে
কোনোমতে বাড়ি পৌঁছিতে পারিলেই হইল আর খোকা, এইখানে আসিলে, কদাপি ঘুমায়না রাত্রি
বারোটা-একটার আগে ...তবে খট্কা একটিই ... এই বৃষ্টি বাদ্লার দিনে মাল্যশ্রীকি
আসিল,আসিতে পারিল খোকাকে লইয়া? আরেকটি সিগারেট জ্বালাইয়া লয় অবিনাশ।
হেমন্তের বৈকালগুলি
মনেপড়ে ... ইস্কুল হইতে ফিরিয়া আসিয়া কোনোমতে হাতমুখ ধুইয়া, ভাত খাইয়া ‘মা খেলতে যাই ...’ বলিয়াই দৌড়। এক দৌড়ে বাজার
পারাইয়া চলিয়া আসা ঐ ন্যাড়া রেলব্রীজের কিনারে । তারপর মনেমনে জল্পনা কল্পনা
কিভাবে রাখিবে প্রথম পা ঐ ব্রীজে অতঃপর কিভাবে পারাইবে ঐ ব্রীজ। তাকাইয়া দেখা শুধু
আর ভাবা শুধু। পা রাখা নয় ...পার হওয়া নয় ... ব্রীজের এই দিকের প্রান্তে পাশাপাশি
দুইটি অর্জুনগাছ। ঐ দিকের প্রান্তে ঝোপঝাড়। মাঝখানে এই ব্রীজ, এই নদী। ঝোপঝাড়ের
আড়ালে সূর্য্যের অস্ত যাওয়া। তারপরে এক সময় বাড়ি ফিরিয়া আসা।সঙ্গে ব্যর্থতা – আজো পারানো হইলনা ঐ ব্রীজ। অতলে আশার জোনাকি ... হয়তো হইবে আগামীকাল ...
হঠাৎই
অন্ধকার উঠিল সশব্দ হইয়া। ইঞ্জিনের ঘোলাটে আলো ভিন্ন আর কোনো আলোনাই গাড়ির কোনোখানে।
সচল সেই আলোকবৃত্তটি একসময় অচল হইয়া দাঁড়াইয়া পরিল দন্ডায়মান অবিনাশের নিকটে। রেল
লাইনে। শোনাগেলো হুইসেলের অস্ফুট ইঙ্গিত। একটি দুইটি কামরা হইতে নামিল জনা চারেক
অন্ধকার মানুষ। কামরার ভিতর হইতে একজনের বোঝা, বস্তা নামাইয়া দিল দুইটি অন্ধকার
হাত। তাহার সন্মুখে দাঁড়ানো কামরাটির হাতলে ধরিয়া তাহাতে উঠিয়া পরিল অবিনাশ।
আরেকবার হুইসেলের অস্ফুট ইঙ্গিত করিয়া চলমান হইল রেলগাড়ি।
অন্ধকারে চোখ সহাইয়া লইবার চেষ্টায় কামরার এক কোনায়
দাঁড়াইয়া রহিল অবিনাশ। কামরায় লোক জনের অস্তিত্ব অনুভুত হইলেও অবয়ব এখনো অন্ধকার।
একটি আলো, জোরালো, টর্চ্চের, তখুনি আসিয়া পরিল তাহার চোখে মুখে আর সঙ্গে সঙ্গে
শুনাগেলো একটি পরিচিত কন্ঠস্বরঃ আরে, অনি’না ...
এই স্বর অব্যর্থভাবে ফণীজ্যাঠার!
‘এই গাড়িতে, এখন, তুমি? কি ব্যাপার হে? আবার
কি নতুন কোনো গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিলে না’কি...’ বলিয়াই কামরা কাঁপাইয়া হাসিয়া উঠিলেন ফণীজ্যাঠা।
‘এসো হে, বসে পরো, এই কামরার মালিক এখন আমরাই
...’ আবার সেই হো হো হাসিতে ফাটিয়া পরিলেন ফণীজ্যাঠা। বসিল
অবিনাশ। ফণী জ্যাঠা কামরায় একা নন। রহিয়াছে আরো তিনটি অবয়ব।
‘আপনি ... ইয়ে আপনারা ...’ বলিল অবিনাশ।
‘ আমরা তো গুপ্ত সমিতি করিনা...আমাদের আনাগোনা
সবই প্রকাশ্যে ...’ কলেজে থাকিতে একবার এক ইতি বাম দলে যোগ
দিয়াছিল অবিনাশ। ঐ লইয়া অবিনাশকে খ্যাপাইবার চেষ্টা ফণীজ্যাঠা করিতেথাকেন সুযোগ
পাইলেই। অবিনাশ খ্যাপে না। বরং আমোদই পায়। সে’ও আজ কতোকালের
কথা। সেই কলেজে পড়িবার সময় অবিনাশ ‘নকশাল’ হইয়া গিয়েছিল । বাক্যটি ভাবিয়া নিজেরি
হাসিপায় অবিনাশের। মনেহয় মিশন রোডের অমিত কুত্তার কামড়ে পাগল হইয়া গিয়াছিল আর সে
হইয়াছিল ‘নকশাল’ -
‘ প্রকাশ্যেযে আনাগোনা করেন সে’তো দেখতেই পাচ্ছি ... তা প্রকাশ্যে গিয়েছিলেন টা কোথায়?’
‘ কৃষক সমিতির মিটিং ছিল একটা...’ এই কন্ঠ নগেন্দ্র চৌধুরি’র। কথাটি বলিয়া লইয়া
দিয়াশলাই জ্বালাইলেন নগেন্দ্র চৌধুরি। এইবার জ্বলিবে বিড়ি। ১০ নং শেখ নাসিরুদ্দিন।
দিয়াশলাইএর ক্ষণিক আলোয় অবিনাশ দেখিল ফণী জ্যাঠা, নগেন্দ্র চৌধুরি ছাড়া রহিয়াছে
একটি অচেনা অবয়ব ... ফণীজ্যাঠার পাশাপাশি। ঐ ব্যক্তির মুখামুখি, জানালার কিনারে
উপবিষ্ট যে অবয়ব ...
‘আমরা রীতিমতো সদলবলে গিয়েছিলাম হে ... সাহস
জোগাতে তোমার বাবাকেও নিয়েছিলাম টেনে ...’ অকস্মাৎ সমস্ত
দৃশ্যটি যেন আপনাকে হাজির করিল সম্পূর্ণ নতুন এক বাস্তবতায় ... জানালার কিনারে
উপবিষ্ট যে অবয়ব সে অবয়ব তাহার বাবার ... তাহার অতি নিকটজন, তাহার অতি পরিচিত
তাহার বাবা’র ... কিন্তু এই মুহুর্ত্তে, এই আবহে সেই বাবাকেই
মনেহইতেছে অচেনা ... যেন ট্রেইনের কামরায় দেখা হইয়া যাওয়া যে কোনো একজন মানুষ ...
‘ নেহাৎ টর্চ্চটা ছিল সঙ্গে তাই তোমাকে
চিনিতে পারলুম ... নাহলে হয়তো অন্ধকারে ভূতের মতো বসে চলে যেতাম ... হাঃ হাঃ হাঃ
...’ আবার ফণীজ্যাঠা।
ফণীজ্যাঠা বাবার বয়োজ্যেষ্ঠ। কলেজে পড়াইতেন। রিটায়ার
করিয়াছেন হইল বছর দশ। বাবকে রাজনৈতিক প্রত্যক্ষতায় টানিয়া আনার মূলে ইঁহার রহিয়াছে
বিশেষ ভূমিকা। কতো দিনরাত্রি তিনি গুজরাইয়া দিতেন, আজো দেন, আড্ডা দিয়া, তর্ক
করিয়া অবিনাশদের বাড়িতে। টেরই পাওয়া যায়না বয়স পারাইয়াছে পঁচাত্তরের কোঠা। থাকেনও
একা একা। ইঁহারি ছেলে অয়নদা মাধ্যমিক হইতে ইঞ্জিণীয়ারিং সবকিছুতেই ষ্ট্যান্ড করিয়া
বহুদিন আমেরিকাবাসী। ফণীজ্যাঠাকেও নিতে চাহিয়াছিল অয়নদা। আসিয়াছিল লইয়া যাইতে। ‘ নিতে হয় তোর মা’কে নিয়ে যা ... আমি আর যে কটা দিন
আছি আমাকে থাকতে দে এই লঙ্গাই-কুশিয়ারার জল খেয়েই ...’ এই একমাত্র উত্তরেই থিতু তিনি। অদ্যাপি।
একথা সেকথায় পার হইয়াগেলো আরো একটি ষ্টেশান। ফণীজ্যাঠাই
একাই জমাইয়া রাখিলেন আসর। কথার বেনোজলে অবিনাশ কোথায় গিয়েছিল, কেন, কখন – ইত্যাদি প্রশ্নগুলি গেলো একেবারে ভাসিয়াই।
‘এখন তো নামতে হচ্ছে হে গুপ্ত সমিতি...’ বলিলেন ফণীজ্যাঠা।
‘ আরো মিটিং বাকী রয়েগেছে না’কি?’
‘না, আজকের জন্য শেষ। তবে কাল আবার সকালে
একটা বৈঠক আছে নগেন্দ্রর ওখানে... রাতটা ভাবছি ওখানেই কাটিয়ে ফিরব...’
নগেন্দ্র চৌধুরিও বাবারি সমবয়ষ্ক। বিপত্নিক এই মানুষটি
চাকুরী করিতেন উত্তরবঙ্গের কোথাও। রিটায়ার করিয়া আস্তানা লইয়াছেন নিজের পৈতৃক ভিটা
‘বিশকোট’ এ। ইনি -
আরেক
অন্ধকারের ভিতরে থামিয়া পরিল ট্রেইনগাড়ি। নামিলেন নগেন্দ্র চৌধুরি। অচেনা মানুষটিও
নামিল। সহসা যেন ভীত হইয়া উঠিল অবিনাশ। এইবার নামিয়া যাইবেন ফণীজ্যাঠাও! তারপর?
তারপর সে আর বাবা একা!এক কামরায়! মুখামুখি!তাহার শিরদাঁড়া বাহিয়া একটি বরফস্রোত
নামিয়া গেলো যেন! ফণীজ্যাঠা নামিতে নামিতে বলিলেন ‘ও হে গুপ্ত
সমিতি, পিতৃদেবকে দেখেশুনে নিয়ে যেও ... তিনিতো আবার টর্চ্চ রাখেননা ... টর্চ্চ
রাখি আমরা ... যারা এখনো পথ খুঁজছি অন্ধকারে ... তোমার বাপ্ মনেহয় পথ পেয়ে গেছে
... হাঃ হাঃ হাঃ ...’ ওই হাসির শব্দ মিলাইয়া না যাইতেই আবার শোনাগেলো
হুইসেলের অস্ফুট ইঙ্গিত। ছাড়িয়াদিলো রেলগাড়ি। ট্রেইন চলিতে লাগিল। প্রায়
সূচীভেদ্য অন্ধকারের আনাচে কানাচে মন্থরতায় চলিয়া যায় একটি দুইটি আলোকবিন্দু। হইবে
কোনো গ্রাম্য বউ-ঝি’র হাতের কূপী-পুকুরপারে অথবা বাঁশঝাড়ের
আব্ডালে। হইবে লন্ঠন, কোনো ন্যালাখ্যাপা
মুদীর ক্ষুদ্র দোকানের ...গাড়ির খোলা জানালা দিয়া হানাদেয় বাদ্লার দমকা বাতাস । চেনা
অচেনা ঘ্রাণ আসিতেছে ভাসিয়া। কামরার লোহার দরজা বিকট শব্দে খুলিয়া গিয়া আবার
যাইতেছে বন্ধ হইয়া । আবহের অষ্পষ্ট আলোকে, রেলগাড়ির জানালার চতুর্ভুজাকৃতি ক্যান্ভাসে,
বাবার মুখের সীমারেখাগুলি এই মুহুর্ত্তে দৃশ্যমান হইয়া পরের মুহুর্ত্তে মিলাইয়া
যাইতেছে অন্ধকারে ...
বেশ
কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হইল এইভাবে। নীরবতায়। সমস্তকিছুকেই কেমন যেন অবাস্তব,
অসম্ভব মনে হইতেছে অবিনাশের। জানালার কিনারে উপবিষ্ট যে অবয়ব সে অবয়ব তাহার বাবার কিন্তু
এই মুহুর্ত্তে, এই আবহে সেই বাবাকেই মনেহইতেছে অচেনা। যেন ট্রেইনের কামরায় দেখা হইয়া
যাওয়া যে কোনো একজন মানুষ। আচ্ছা, বাবাকে কি সে চিনেছে কোনোদিন? চিনবে কোনোদিন?
ভাবে অবিনাশ। সময় বহিয়া যায় নীরবতায়। অবশেষে বাবাই ভাঙ্গিল এই নীরবতা। একসময়।
‘ কোথায় গিয়েছিলি?’
বলিল বাবা।
কেমন যেন হকচকাইয়া গেলো অবিনাশ। যদিও এই মুহুর্ত্তে ইহাই
স্বাভাবিকতম প্রশ্ন তথাপি অবিনাশের মনেহইল যেন অপ্রাসঙ্গিক। মনেহইল সে যেন আরো
কোনো প্রশ্ন, কোনো কথা শুনিতে চাহিয়াছিল বাবার মুখে। এক্ষণে। যেন বাবাও বলিতে
চাহিয়াছিল অন্য কথা। কিন্তু কি’কথা? সে উত্তর দিল ‘বিষ্ণু’র বাড়িতে’। কে
এই ‘বিষ্ণু’ কেনইবা তাহার বাড়িতে
গিয়াছিল অবিনাশ সেইসব কথা না বলিল সে, না জানিতে চাহিল বাবা। অথচ এই ‘বিষ্ণু’র গল্প, ‘বিষ্ণু’র পলাতক বাপের গল্প বাবাকে বলিতে চাহিতেছে অবিনাশ একদা যেমন চাহিত, কিছু
একটা লিখিলেই বাবা’কে পড়াইতে। বাবা বাড়ি না থাকিলে ফিরিয়া আসার
পথ চাহিত উদ্গ্রীব হইয়া । নতুন বই পড়িলেও বাবাকে না বলা অবধি শান্তি ছিলোনা তাহার
। কলেজের লাইব্রেরী হইতে বই আনিয়া দিত বাবা - নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ আর সুধীন্দ্রনাথ রাহা’র অনুবাদে ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’, ‘এরাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইস্’, হেমেন
রায়ের ‘ভগবানের চাবুক’, ‘দেড়শো খোকার কান্ড’...অদ্যাপি সেই নামগুলি,
প্রচ্ছদগুলি, পৃষ্ঠার ঘ্রাণগুলি ফিরিয়া ফিরিয়া আসে চেতনায়...অথচ আজ সে বলিতে
পারিতেছে না কিছুই ... কেন?
আরো
কিছু সময় অতিবাহিত হইল নীরবতায়। অবিনাশের মনেহইল এমনতো পারিতই ঘটিতে, যে, ট্রেইনে
চাপিয়া কোথাও যাইতেছে বিষ্ণু, সেই একই কামরায় চলিয়াছে বিষ্ণু’র বাবাও। তাহারা কথা বলিতেছে। বলিতেছে পরের ষ্টেশনে গাড়ি থামিবে কতক্ষন
তাহা লইয়া, কথা বলিতেছে দেশ-দশের হাল-হকিকৎ লইয়া তথাপি একে চিনিতেছে না অপরকে ...
এইবারো বাবাই ভাঙ্গিল নীরবতা। বলিলঃ আজকাল আর কবিতা লিখিসনা
একেবারেই?’ আবার খেই হারাইয়া ফেলিল অবিনাশ। কথা ভিড়
করিয়া আসিল তাহার মগজে, কন্ঠনালীতে। তথাপি ‘লিখি। তবে কম’ এই বাক্যাংশটি ভিন্ন আর কিছুই সে পারিলনা বলিতে। বাবাও আর বলিলনা কিছু।
সামান্য পরে বাবা জ্বালাইয়া লইল একটি সিগারেট। সেই ভঙ্গী সিগারেট জ্বালাইবার, সেই
পরিচিত ঘ্রাণ। বাবার সিগারেট জ্বালাইবার ঐ ভঙ্গীটিকে নকল করিতে গিয়াই সিগারেট টানা
শিখিয়াছিল অবিনাশ। চুপচাপ বসিয়া জানালার দিকে মুখ করিয়া সিগারেট টানিতেছে বাবা। কিছু
ভাবিতেছে কি বাবা? বাবারো কি গহনে এমনি কথার উথাল পাতাল? হেউ ঢেউ? বাবারো কথাগুলি
কি হারাইয়া যাইতেছে গম্যমান রেলগাড়ির এই অন্ধকার কামরায়? জানালা দিয়া ছুটিয়া আসা
ধূ ধূ বাতাসে? ছড়াইয়া যাইতেছে কথাগুলি ঐ জলে, ঐ অর্ধেক ডোবা ধানক্ষেতে? কি সেই
কথাগুলি? আজ না বলিলে আর কবে বলিবে বাবা? কবেই বা বলিবে সে? বলিতে পারিবে কি, কেহ,
কোনোদিন, আদৌ? কথাগুলি একদিন বাবার সহিত পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইবে বাবার চিতাতেই ...অবিনাশের
স্মৃতিতে না’কি ভবিষ্যতের গহনে দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল
এক চিতা ...অকস্মাৎ ...
খোকারো জীবনে আসিবে এইদিন ... তাহার হাতও একদিন এমনিভাবে
আগুন জ্বালাইয়া দিবে অবিনাশের মৃত মুখবিবরে ... হায়, তবেকী আসিবে সেই দিনও যখন
এমনি অন্ধকার কামরায় অবিনাশের সহিত একা একা বসিয়াও খোকার মুখে জুগাইবেনা কোনো কথা
অথচ অসংখ্য কথার আলোড়নে কাঁপিয়া উঠিবে অস্তিত্ব ...
তাহাকে লইয়া
বড় আশা করিয়াছিল বাবা। আশা করিয়াছিল ঠিক কিন্তু নিজেও হয়তো পরিষ্কার জানিতনা ঐ
আশার স্বরূপটি যে কী ... পরীক্ষায় ভালো
নম্বর পাইলেও আহ্লাদিত হইত বাবা আবার আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পুরষ্কৃত হইলেও একই
দীপ্তিতে ভাস্বর হইত বাবার মুখমন্ডল । আঞ্চলিক একটি নামী সাহিত্য পত্রিকায় তাহার
কবিতা প্রথমবার ছাপা হইলে বাবা ঐ পত্রিকার একটি সংখ্যা লুকাইয়া আনিয়া রাখিয়াছিল
বাবার সংগ্রহে। অবিনাশের অনুপস্থিতে বাড়িতে আত্নিয়-স্বজন বা বাবার বন্ধুবান্ধব
আসিলে ঐ কাগজ বাবা দেখাইত তাহাদের ...
ইতোমধ্যে ঢিমেতালে চলা রেলগাড়িটিও পারাইয়া যায় আরো একটি ইষ্টিশান। আপন
ভাবনার অতলে ক্রমতলায়মান অবিনাশ লক্ষ্যই করেনা। এইবার শুনাযায় বাবার কন্ঠ, পুনরায়ঃ
‘কাজটা কেমন লাগছে? জগ্দীপ পাল লোকটাকে তো মনেহয় ভালোই ...
আজকালকার যুগে কে আর কাকে বাড়ি বয়ে এসে কাজ দিয়েযায় ...’
এইবারো আপনার গহনে কথার উথাল পাতাল টেরপায় অবিনাশ। কিন্তু
সেই কথাগুলি ধ্বনির অবয়ব পায়না। যথারীতি। সে বলেঃ ‘লাগে একরকম
... ঐ ব্যবসায়ীগুলো যেরকম হয় আর কি ...’
বাবা বলেঃ ‘সেদিন বাজারে
মনোজকে পেয়েছিলাম, মনোজ চক্রবর্তী। তোর কথা খুব বললে। বললে তোর লেখার কথা ...’
মনোজবাবু। মনোজ চক্রবর্তী। হায়, আরেক অধ্যায়। বাবার কলেজেরি
অধ্যাপক। অপত্যহেন স্নেহের চক্ষে দেখেন অবিনাশকে। নিজের বাড়িভরা বইএর মালিকানা
একদা অবিনাশকে দিয়াছিলেন অকাতরে। সেই বইঘর তোলপাড় করিয়াই অবিনাশের বিশ্বসাহিত্য
পাঠের প্রথম পর্য্যায় ...
‘ একবার গিয়ে দেখাকরে আসিসনা কেন একদিন ...’ বাবা বলে। অবিনাশ, যথারীতি, বলেনা কিছু। কিন্তু বলিতে চায় ‘বাবা, আমি দেখা করলে মনোজকাকু খুশি হবেন নিশ্চিত ...তথাপি ... বাবা ...
যাপনের স্বাভাবিক নিয়মে দৈনন্দিনতার, যাপনের প্রশ্নগুলি যে উঠে পরবেই ... আর
বাবা...তুমি তো জানো...তুমি তো বোঝো ঐখানে আমি ঠিক কতোদূর অসহায় ...’ - মা বলে, মাঝে মাঝেই বলে, ‘এখনো সময় আছে ... একটা
কিছু স্থির কর ... বোম্বাইতেই নাহয় চলেযা কিছুদিনের জন্য...মালা’র দাদা আছে ...নিজের মানুষ ...এমন সুযোগ ক’জনের থাকে
বল্ ... বাচ্চাটারোতো একটা ভবিষ্যৎ আছে ... তাছাড়া অসুখ বিসুখ আছে ...
বিপদ-বিপর্য্যয় আছে ... আর এ’ও যদি বুঝতাম এটা কোনো সরকারী
চাকরী ...’ বাবা ঐভাবে বলেনাই কিছু। অদ্যাপি । তথাপি সে টেরপায় বাবার উদ্বেগ। তাহাকে
ঘিড়িয়া । খোকার নিরাপত্তাকে ঘিড়িয়া । মনেপড়ে শীতের সন্ধ্যা । বালক বয়সের। শীতকালে সন্ধ্যাবেলায়
কারেন্ট থাকেনা প্রায়ই। তাই মোমের আলোয় পড়া করিতেছে তাহারা দুই ভাই।এমন সময়
শোনাযায় বাবার কন্ঠ, শোনাযায়ঃ ‘ এখনো সমুখে রয়েছে সুচির শর্বরী...ঘুমায় অরুণ সুদূর
অস্ত-অচলে! ...বিশ্বজগৎ নিশ্বাসবায়ু সম্বরি ...স্তব্ধ আসনে প্রহর গনিছে বিরলে। ... সবে দেখা দিল অকূল তিমির সন্তরি ...দূর
দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা – ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ
মোর – এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা ...’
বাবা বলেঃ ‘গত সপ্তাহে যখন এসেছিলি ভাই’এর পেটটা ঠিক ছিলোনা ... এখন কেমন?’
‘এখন তো ঠিকই আছে ...’
‘তবু একবার কাল সকালে অমূল্য সরকার’কে দেখিয়ে নিয়েযাস ...’ একটু থামিয়া ‘আমিই নাহয় নিয়ে চলেযাবো কাল সকালে ...’
‘তুই কি ওদেরকে বাড়িতে রেখে তারপরে
বেড়িয়েছিলি...?’
‘নাহ্। আমি চলেএসেছি সকালেই ... মালা’র আসার কথা ইস্কুল সেড়ে ...’ একটু অপরাধীর মতোই বলে
অবিনাশ।
‘এই বৃষ্টি বাদ্লার দিনে ভাই’কে নিয়ে একা আসা...অটো বা রিক্সা পাওয়াও হবে মুশকিল...’ একটু পরে বলে বাবা। বাবার কন্ঠে
কি ভর্ৎসনা? আহা! আনন্দিত বোধকরে অবিনাশ।
কতোদিন তাহাকে সরাসরি ভর্ৎসনাও করেনাই বাবা ... আজ কি করিবে? সে আশাকরে ... সে
তাকাইয়া থাকে বাবা আর তাহার মধ্যে দোল্যমান অন্ধকারের দিকে ... রেলগাড়ি পারহয় আরো
একটি ইষ্টিশান। এইবার দেখাযায়, দূরে, লঙ্গাই বাজারের আলোর বিন্দুগুলির লক্ষণ ... ঐ
বাজারে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নাই। ছোটো দোকানীদের কূপী বা লন্ঠণ আর মহাজনদের
পেট্রোমাস্ক ... ঐ বাজারে বাবার সঙ্গে আসিত অবিনাশ আর তাহার ভাই। তবে দুইজনকে
একত্রে আনিলে সামলানো মুশকিল বলিয়া একদিন ছিল অবিনাশের পালা। একদিন ছোটোভাইএর।
বাজার হইতে দেখাযায় রেলরাস্তা। রেলব্রীজ। নদী পারাইয়া সেই রেলরাস্তা যেন পারাইয়া
গিয়াছে দিগন্তকেও ... অবিনাশের মনে হইত ঐ ব্রীজটা দূর আর ঐ রেলরাস্তা যেন অনেক দূর
... অনেক অনেক দূর ... ঐদিকে চাহিয়া সে প্রায়শই জিগাইত বাবাকে ‘ ঐ রেল লাইন কোথায় যায় বাবা?...’
‘ অনেক দূর ...’
‘কতোদূর?’
‘অ-নে-ক অ-নে-ক দূর...’
‘অতোদূরে তুমি কখনো গিয়েছো,বাবা?’
‘না এখনো যাইনি ...’‘কবে যাবে...?’
‘যাবো একদিন ...’
‘আমাকে নিয়েযাবে? সঙ্গে?’
বাবা কি বলিয়াছিল মনেপড়েনা
কিন্তু কথাগুলি
মনে আসিতেই কেমন যেন ভারাক্রান্ত হইয়া ওঠে মন। যখনকার কথা এইসব তখন বাবার ঐ অনেক
দূরে যাওয়ার প্রস্তাবটি যেমন অবাস্তব ছিল অবিনাশের মনে হয়তো বাবার মনেও প্রায়
সমানই অবাস্তব ছিল তাহা। কিন্তু অদ্য
উভয়েরি মর্মে হানাদেয় এই সম্ভাবনা তাহার চূড়ান্ত বাস্তব চেহারাটি লইয়া ...
অবিনাশের ইচ্ছাহয় বাবাকে জিজ্ঞাসা করে ‘ অনেক দিন তো হয়েগেলো এই পৃথিবীতে ... তা
জীবনটাকে কেমন দেখলে বাবা? কেমন বুঝলে? ... আমার কাছে তো এখনো সমস্তই ধোঁয়া ধোঁয়া,কুয়াশা ... জীবনটা তোমার কাছে কেমন, বাবা?’ ... কিন্তু,
যথারীতি, সে উচ্চারন করিতে পারেনা কথাগুলি। পরিবর্তে সে দেখে অন্ধকারের রেলগাড়ি
তাহাকে আর বাবাকে লইয়া ঢিমেতালে চলিয়া যাইতেছে আরেক অন্ধকারের দিকে। সে টের পায় এই
সাক্ষাৎকারটির অন্তরায় সে পৌঁছাইতে পারিবেনা কোনোদিন। সে টেরপায় কেবল তাহার নিজ
মর্মেই এই সাক্ষাৎকারটি নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিম্মাণ করিতে করিতেই সে’ও হারাইয়া
যাইবে। একদিন। হয়তো এমনি অন্ধকারের অতলে।
আদিলেখনঃ ৭/১২/২০০৬ হোটেল অক্ উড্, সেন্ জোসে,
ক্যালিফোর্ণিয়া
ফিরেলেখাঃ
২৬/১১/২০১০ – ১৮/০৪/২০১৩ বেঙ্গালোর