আর কে জৈন
ফুটবল টর্নামেন্ট এবং আমরা...
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
‘ ও রামা রামা
রামা রামা / রামা রামা
রে / মেনে মানা
মেনে মানা মে হুঁ মাওয়ালী /মাওয়ালী হুঁ মে / শয়তান তো নেহি /গিরা হুয়া কোই ইন্সান্
তো নেহি /ও রামা রামা রামা রামা
রামা রামা রে...’
শীতের
মাঝামাঝি। বাতাসে হিম। ঘাসের শরীরে শিশির। জাটিঙ্গার কমলার ঘ্রানে বাজার ম’ম। ফুরিয়ে
আসছে ইংরেজি বছর। এমন সময়ে হঠাৎ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাজনা ‘ ও রামা রামা রামা
রামা রামা রামা রে’ ...ইস্কুলের
ক্লাসঘরে বসে পরীক্ষার খাতায় ভূগোল,ইতিহাস কিংবা বিজ্ঞানের প্রশ্নের উত্তর দিতে
দিতে মন হারিয়ে যায় ঐ সব অদ্ভুত কথার,উদ্ভট সুরের টানে...ডিসেম্বর মাসে বাৎসরিক
পরীক্ষার সেই শেষ বছর। পরের বছর থেকেই বাৎসরিক পরীক্ষার মাস হয়ে গিয়েছিল গ্রীষ্মে।
এপ্রিল মাসে।
তখন ক্লাস
সিক্স। সাল ১৯৮৩-৮৪। ইস্কুলে চলছে বাৎসরিক পরীক্ষা আর আমাদের ইস্কুলেরি মস্ত বড়
মাঠ ঘিরে দেওয়া হয়েছে ঢেউ টিনের ঘেরাটোপে। দিকে দিকে মাইক। বাক্স লাউড্ স্পীকারের
জমানা আমাদের মফস্বলে আসেনি তখনো। খেলা আরম্ভ হলে ঐ সব মাইকে চলে ধারা বিবরণী আর
বাকি সময় বাজতে থাকে গান। কখনো “রামা রামা রামা রামা রামা রামা রে”, কখনো “ঝ ঝ ঝোপ্ড়ি
মে চা চা চারপাই/ জীবন মেরা উসি পর্ হি...” ...
খেলা আরম্ভ
হয় বিকাল চারটেতে। টিকিট কাইন্টারের সামনে ভিড় বাড়তে থাকে তিনটে থেকেই। রিক্সাওয়ালা থেকে কলেজ
শিক্ষক, জজ্-মেজিস্ট্রেট্ সকলেই উপস্থিত ঐ ভিড়ে। সেমি ফাইন্যাল আর ফাইন্যালের দিনে ছুটি দেওয়া হয় ইস্কুল
কলেজ। ছেলে বুড়ো বাচ্চা এমনকি বাড়ির মহিলারাও এসে হাজির হন সেই খেলা দেখতে। আবাল বৃদ্ধ
বণিতার এই হাজির হওয়ার গহনে যতোনা ক্রিয়াশীল ফুটবল প্রীতি তার চেয়ে ঢের বেশী
উদ্দীপনা উৎসবের। আমোদ সার্কাস দেখার।
শীতের মাঝামাঝি।
বাতাসে হিম। ঘাসের শরীরে শিশির। জাটিঙ্গার কমলার ঘ্রানে বাজার ম’ম। ফুরিয়ে
আসছে ইংরেজি বছর। নেতাজী মেলা এসে পড়লো বলে ...ঠিক এই সময়েই ইংরেজি
নতুন বৎসরের নাকি নেতাজী মেলার আগমনী হয়ে আরম্ভ হয় এই ফুটবল টর্নামেন্ট্। আর কে
জৈন স্মৃতি ফুটবল টর্নামেন্ট্।
মফস্বলের বুকে যেন এসে হানা দেয় এক ঝলক টাট্কা
দমকা বাতাস। খেলতে আসে ‘এ ডিভিশন’ দলগুলি— মিজোরাম,ত্রিপুরা,নাগাল্যান্ড,মনিপুর
থেকে। আসে আসাম পুলিশের দল। আন্তর্জাতিক দল আসে কুশিয়ারা নদী পারহয়ে। বাংলাদেশ
থেকে। খেলোয়াড়দের সবার স্থান সংকুলান হয়না মফস্বলি হোটেলে,মোটেলে। ডাক
বাংলোতেও ওঠেনা কুলিয়ে। ফলে তাঁবু পড়ে খেলার মাঠের পাশে। খেলোয়াড়দের তাঁবু। আমাদের ইস্কুলবাড়ির
কোঠাতেও আশ্রয় নেন খেলোয়াড়ের দল। আমরা গিয়ে ভিড় জমাই সেই কোঠাগুলোর আশে পাশে। হাঁ
করে দেখি তাদের জুতো,জার্সি,তাদের পৌরুষ। তাদের বীরত্বগাথা ছাপাহয় আঞ্চলিক
কাগজে। গতি,সোনার কাছাড়ের কাটতি বেড়েযায় হুহু করে। আমরা দিনগুনি কবে
শেষহবে এই কালান্তক বাৎসরিক পরীক্ষা ...
পরীক্ষার
সময় একেক বেঞ্চিতে বসানো হয় মাত্র দুজন করে। বেঞ্চির দুই মাথায় দুইজন। তা’ও আবার
দুইজন দুই ক্লাসের। আমি সিক্স। আমার প্রতিবেশী সেভেন। ফলে লাভ হয়না উঁকি ঝুঁকি
দিয়েও। পরীক্ষা চলে দুই বেলাই। দশটা থেকে একটা। দুইটা থেকে পাঁচটা। অন্য ইস্কুলের
নিয়ম আলাদা। তাদের সকাল মানে ন’টা থেকে বারোটা। বিকাল মানে একটা থেকে চারটা।
আমার সব পরীক্ষাই বিকালে। আমার সীট পড়েছে ইস্কুলের যে কোঠাগুলো বড় রাস্তার দিকে তারি
একটাতে। ফলে চারটা বাজতে না বাজতেই দেখতে পাই ‘মদন মোহন মাধব চরণ
উচ্চতর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে’র বালিকারা নেমে পড়েছে রাস্তায়। ফ্রক পরে শাড়ি
পরে যেন চলেছে দলে দলে উড়ন্ত প্রজাপতি। আমি যেপাশে বসেছি বড় রাস্তা তার উল্টোদিকে।
তাই ঐ দিকে দেখতে গেলে দেখতে হয় ঘাড় ঘুড়িয়ে। আমি ঘাড় ঘোড়াই। একবার – দুইবার – তিনবার – মাষ্টার
মশাই না দেখলেও
দেখেফেলে আমার প্রতিবেশী সেই ক্লাস সেভেনের ‘দাদা’। সে ভালো ছেলে। বাঁদিকে সিঁথি কেটে, পরিষ্কার জামা কাপড় পরে
আসে পরীক্ষা দিতে। ধীরে সুস্থে লেখে। তারপর ‘রিভিশন’ দেয় খাতা
জমা দেওয়ার আগে ... তার নাম ‘সৌমিত্র’,তার বাড়ি ‘পাগলা পট্টী’ আর ‘হাসপাতাল
রোড’ এর ‘জাংশনে’। তার পছন্দ হলোনা আমার এই উঁকি ঝুঁকি। ঘাড় ঘুরিয়ে বল্লোঃ ‘জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলে লিখিবি কখন?’ – সত্যিইতো! লিখবো কখন? আর যে বাকী
মাত্র আধঘন্টা সময়! এখনো উত্তর লেখা হয়নি তিনটে বড় প্রশ্নের! আর কে জৈনের
মাইকে গান থেমে শুরু হয়েগেছে “রীলে”!!! চেষ্টা নিই
প্রশ্নোত্তরে মন দেওয়ার কিন্তু মন টেনেনেয় ‘মদন মোহন মাধব চরণ উচ্চতর মাধ্যমিক বালিকা
বিদ্যালয়ে’র উড়ন্ত প্রজাপতিরা...মন টেনেনেয় আর কে জৈনের
রীলে ...উত্তর তিনটে
শেষ হওয়ার আগেই বেজেযায় শেষ ঘন্টা। বাড়ি এসে বাবাকে মিথ্যে বলি,মিথ্যে বলি
মাষ্টার মশাইকে। বলিঃ সব উত্তর দিয়েছি ... “রিভিশন” দিয়েছি শেষ
আধা ঘন্টা... ... মনে মনে ঠিক করি আর নয় – পরের পেপারটা
দিতেই হবে ভালো করে। কিন্তু ইস্কুলের কাছাকাছি যাওয়ামাত্র যেই কানে আসে আর কে
জৈনের মাইকে গান ...সেই একই রকমের আজব সুরের, অদ্ভুত কথার গানঃ ‘মামামিয়া / পম্ পম্’, ‘নয়না মে সপ্না
নয়না মে সজনা / সজনী কা দিল্ আ গয়া’ কিংবা ‘বক্ বক্
বক্ মত্ করো নাক তেরা লম্বা / লাকড়ি কা খম্বা...’ অমনি মহম্মদ
ঘোরী আর আলাউদ্দিন খিলজীর জীবনীর বদলে চোখে ভেসে ওঠে ‘মদন মোহন মাধব চরণ
উচ্চতর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে’র উড়ন্ত প্রজাপতিরা...চোখ অপেক্ষা করে থাকে
কখন পরীক্ষা শেষকরে তারা নামবে রাস্তায়...
পরীক্ষা শেষ হয়। হয়ে যায় আর কে জৈনের ফাইন্যাল।
বাবার সঙ্গে গিয়ে একদিন আমরা দুইভাই দেখে আসি সেই ফাইন্যাল। আসাম পুলিশ আর মণিপুর
রেজিমেন্টের খেলা!! বাঁশের বানানো প্রতিটি টিকিট ঘরের সামনের ভিড়ই
উপ্চে ওঠে চলেগেছে হয় বড়ো রাস্তায় নয়তো সিভিল কোর্টের আঙ্গিনা পেরিয়ে। মাঠের
পাশেই ছোট্ট টিলা। সেখানেই ডাক বাংলো। টিলার যতোটা সম্ভব টিন দিয়ে ঘেরাও করা হলেও
টিলায় ঊঠে পরেছে বিন্টিকিটের দর্শকেরা। ভিড় জমেছে সিভিল কোর্টের ছাতেও। শীত
দুপুরের রোদের মায়া আলস্যের মতো ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। ভিড়ের আশে পাশে,ভিড়ের খাঁজে
খাঁজে খুলেগেছে পানবিড়ির দোকান, এসেছে ‘জাটিঙ্গার
কমলা’র ফিরিওয়ালা-ফিরিওয়ালির
দল। কমলার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরছে বাতাসে।
সিমেন্টের গ্যালারীর পিছনে পাকা
রাস্তা। তার ওপারে ‘ট্রেজারী অফিস’। সেই অফিসের বারান্দায়
কমলা হাতে আমাদের দ’ভাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে বাবা গেলো টিকিট করতে। ফিরে এলো
সিমেন্টের গ্যলারীর প্রায় সামনের দিকের তিনটে টিকিট নিয়ে। তখনো মফস্বলে ইস্কুল-কলেজের
মাষ্টারমশাইদের এটুকু সন্মান ছিলো যে তাদের কে ভিড়ে দাঁড়াতে দেখলে ছাত্র বা
প্রাক্তন ছাত্রেরা এসে খোঁজখবর নিতো কিংবা বাসে ট্রেইনে ছেড়ে দিতো সীট। বাবারো
কোনো প্রাক্তন ছাত্রই বাবাকে যোগাড় করে দিয়েছিল ঐ টিকিট তিনটি নাহলে ফাইন্যালের
দিনে সিমেন্টের গ্যালারীর টিকিট পাওয়া ছিল সর্বৈব অসম্ভব। বাবার নেতৃত্বে, ভিড় ঠেলে
আমরা ঢুকতে লাগলাম ভিতরে। মাইকে বাজছে সেইসব আজব সুরের, অদ্ভুত কথার গানগুলিঃ ‘তাকি তাকি
তাকি রে’ কিংবা ‘সাথ্ মেরে আয়োগি / আইস্ক্রিম খায়োগি...’
সিমেন্টের
বাঁধানো গ্যালারী মাত্র একটাই। তাই মাঠ ঘিরে বানানো হয়েছে বাঁশের গ্যালারী। রয়েছে
দাঁড়িয়ে দেখার ব্যবস্থাও। সিমেন্টের গ্যালারীর একপাশে শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে ‘ভি আই পি
লাউঞ্জ’। ‘ভি আই পি’ বলতে শহরের
ডি সি, এস পি, বরফ কলের
মালিক মনোরঞ্জন বণিক, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী সমিতির হোমড়া চোমড়া ক’জন আর
কোথাকার দুজন এম পি না এম এল এ । তাদের সামনে রাখা সার সার কাপ্-শীল্ড।
আজকের খেলার শেষে হবে পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। তারি স্পেশাল ঘোষক হিসাবে শিলচর
থেকে আনানো হয়েছে কোন্ এক ‘দাদা’কে যিনি শিলচর-করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দিতে
‘গলাদা’ নামে
সুবিখ্যাত।
ভিড়ের মধ্যে কোনোক্রমে জায়গা করে বসে
পড়াগেলো। মাইকের গানও থেমেগেলো একসময়। দুই দলের খেলোয়াররা এসে দাঁড়ালো মাঠের
মাঝামাঝি। হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়লো দর্শকদল। আমরাও যতোটা সম্ভব চীৎকার করে নিলাম এই
সুযোগে। রেফারীর বাঁশিতে আরম্ভ হলো খেলা আর তখনি আমার গেলো মন খারাপ হয়ে। - এই খেলার পরেই আর কে জৈন শেষ! মাইকের গান বন্ধ! শিউড়ে উঠলাম
এইকথা ভেবেও যে পরীক্ষার রেজাল্টও বেরোবে একদিন...অনতিদূরেই...
দুই এক গোলে
আসাম পুলিশকে হারিয়ে কাপ নিলো মণিপুর রেজিমেন্ট না’কি ঘটলো ঠিক উল্টোটাই? আজ আর মনে
পড়েনা... মনেপড়ে আলো কমে আসছে বলে পুরষ্কার বিতরণীর জন্য
জ্বালানো হলো বড় বড় লাইট। আমরা একেই বলতাম ‘ফ্লাড্ লাইট্’। কিন্তু মাথার উপরে হিম পড়ে ঠান্ডা লাগতে পারে
বলে বাবা আমাদেরকে নিয়ে ফিরে এলো পুরষ্কার বিতরণী শেষ হওয়ার আগেই। রিক্সা পাওয়া
গেলোনা বলে পুরো রাস্তাই আসতে হলো হেঁটে। পাড়ায় ঢুকে মনেহল কি যেন নেই...যেন আরো
মিট্মিটে হয়েগেছে বাড়িঘরের ষাট কিংবা আশি পাওয়ারের বাল্বগুলি...
... ...শেষ হয়েগেলো
আর কে জৈন। খুলে নেওয়া হলো সেই ঢেউ টিনের ঘেরাটোপ, অস্থায়ী টিকিট ঘর, তাঁবু...ইস্কুলের
কোঠা খালিকরে চলেগেলো খেলোয়াড়ের দল... ইস্কুলের পাশের পথে ঘাটে
পরে থাকলো টিকিটের ছেঁড়া টুকরো...পোষ্টার...কিছুদিন...তারপর তাদেরো
উড়িয়ে নিয়েগেলো বাতাস...মন খারাপের মতো রয়ে গেলো রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, ইস্কুল, কেলাস, লেখাপড়া আর
ইস্কুলের ঐ মাঠের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা পরের বারের আর.কে.জৈন’এর জন্য ...
২২/০৮/২০১০
বেঙ্গালোর