'.. সত্য যদি এ বিষাদ হয়,
ফিরে আসবে প্রতিধ্বনিময়
সে-সভ্যতা, সেই বাল্যকাল ---
ফিরে যাবে কালের রাখাল
বাঁশীটি বৃক্ষের তলে ফেলে ---
তুলে নেবে যেটি সেই ছেলে,
যাহার বুকের মাঝে এক
আছে রে নিশ্চিন্দিপুর, দ্যাখ্ ---
যে-অপু, যে-কাজল অমর :
সপ্তর্ষি যে, যে সূর্যশেখর ... ...' - অনির্বান ধরিত্রীপুত্র
‘সহজ পাঠে’র সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’, ‘পথের পাঁচালী’র সঙ্গে অবণীন্দ্রনাথ আর অবণীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দ কোথায় যে যায় একাকার হয়ে । রাজগঞ্জের ঘাটে বাঁধা মধুমাঝির নৌকার ছবি কখনো ফিরিয়ে আনে ‘বুড়ো আংলা’র রিদয় কে । কখনো অপুকে ।
সেই নিশ্চিন্দিপুর তার সকাল, তার সন্ধ্যা, তার বাঁশ ঝাড়, তার আমবন। যেন ক্রমে ক্রমে অবয়ব নেয় বাংলা। আবহমানের। রূপসী। যার রূপে মুগ্ধ হয়েই সম্ভব হয় ঐ স্পর্ধিত,সবুজ, সজল প্রত্যাখ্যানঃ
‘তোমরা যেখনে
সাধ চলে যাও,আমি এই বাংলার পারে রয়েযাবো...’
এখন দুঃখ বলতে একটাই – অতীতকে হারানোর দুঃখ ।
কোনো ব্যক্তিগত অতীত নয় । একটি জাতির অতীত । একটি ভাষার অতীত ...
এখন ক্ষতি বলতে একটাই । সন্ততিতে তার আবহমানের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে না পারবার ।
বেজেওঠে কথাগুলিঃ ‘চরে বসে রাঁধে ঙ চোখে তার লাগে ধোঁয়া’। আসে ছবিগুলি । নন্দলালের।
মাটীর উনুন জ্বালিয়ে রাঁধতে বসেছে ঙ।
কুমোড় পাড়ার গরুর গাড়ি চলেছে মেঠো পথে ...
কবরের গায়ে আঁকা এপিটাফহেন ছবিগুলি নিয়ে আসে অনাদিকালের
বিষন্নতা। বয়ে আনে নিরবচ্ছিন্ন পরাজয়ের কাহিনী। কারোর একার নয়। একটি সভ্যতার। একটি
জাতির।
আমাদের সন্ততিরা দেখবেনা মাটীর উনুন, দেখবেনা জ্বালানী কাঠ বোঝাই ঠেলাগাড়ি, দেখবে না
প্রতিটি গৃহস্থের নিজস্ব পুকুরে নুয়েপড়া আম্রবৃক্ষের মহিমা,শুনবেনা জন্মান্তরের সেই
ডাক ‘আ চই চই চই...’ সন্ধ্যাবেলা সেই পুকুরের পারে, হাঁসেদেরকে ফিরিয়ে আনার...
নিজ অতীতের বর্ণনায় নিজ সহৃদয় পিতার কথা বলতে গিয়ে সন্ত অগাস্তিন লিখেছেনঃ Yet the same
father of mine took no trouble at all how I was growing ...or whether I was
chaste [ যদিও চেস্টিটি’তে, সে ক্যাথলিক,
প্রোটেস্টান্ট, হিন্দু, মুসলমান যারই হোক, মোটা অর্থে, আমি বিশ্বাস করিনা তাই এখানে
‘চেস্টিটি’ বলতে আমি ধরে নিচ্ছি একটি শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশ ] or not .He
cared only that I should have a fertile tongue...’ কেননা রাজ
কর্মচারী বৃত্তিতে রসনাই কর্মচারীর মূল সহায় আর পিতা চেয়েছিলেন অগাস্তিন যাজকই হোন,
যা এক রাজকর্মই, ভবিষ্যতে। - অগাস্তিনের পিতাহেন আমরাও সন্ততির বহিরঙ্গকে ঝক্ঝকে উজ্জ্বল
করবার তাগিদে ছিনিয়ে নিচ্ছি তার অন্তর্গত আশ্রয়ভূমির সংকেত গুলি। বস্তু সাফল্যের মোহে
ভুলে, ভিটেমাটী ছেড়ে এসে আমরা হয়েছি অভিশপ্ত, হয়েছি উদ্বাস্তু আর সন্ততিকেও টেনে আনছি,
ক্রমে, সেই অভিশাপের আবর্তে।
যে বালক দিশাহারা হয়ে দৌড়ে বেড়ালো না রঙ বেরঙ্ প্রজাপতির পাখার ইশারায়, যে বালক হেমন্তের
মাঠ থেকে নিজহাতে খড় কেটে আনলো না তার পৌষ সংক্রান্তির ‘মেরামারি’র ঘর তৈয়ার করতে,
যে বালক আরো অসংখ্য বালক বালিকার সঙ্গে তেল চুকচুকে চুল নিয়ে দাঁড়ালো না হতশ্রী ইস্কুলের
বারান্দায় – দেবী সরস্বতীকে অঞ্জলী দেওয়ার পংক্তিতে, আষাঢ়ে শ্রাবনে ঘনায়মান মেঘের দিকে
চেয়ে থেকে শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মকে দেখলোনা যে বালক, হায়, তার এই দুর্ভাগ্যের ক্ষতি
কি দিয়ে পূরণ করা, কিভাবে?
মা মরা ছেলে কাজল কে অপু নিয়ে রেখে এসেছিল সেই নিশ্চিন্দিপুরেই । যে নিশ্চিন্দিপুর তার শোণিতে বহমান। সে ‘বিভূতিভূষনের’ অপু।
আজকের অপু ঋণ কর্জ করে হলেও কাজলকে রেখে আসবে কোনো মস্ত হোস্টেলে। সে’ও মহানুভব। যেমন ছিলেন সন্ত অগাস্তিনের পিতা। তৎকালে তাঁদের থেকে বহুবেশী বিত্তশালী পরিবারের পিতারাও সন্ততির শিক্ষার জন্য অতোটা ব্যয় করতেন না। কিন্তু ঐ শিক্ষা কোন শিক্ষা? ‘He cared only that I should have a fertile tongue...’... অগাস্তিন শনাক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন ঐ ভ্রমকে। অন্যথায় তিনিও মিশে যেতেন তৎকালীন ঐ সব অসংখ্য ওজস্বী রাজ কর্মচারীর কিংবা ধর্মের বিক্রেতাদের দলেই। এক বিশেষ ধর্মের কিছু মানুষের, কিছুদিনের ‘সন্ত’ যাদের নাম আজ মনে রাখেনি শ্মশানে কবরে জাত শৃগাল সারমেয়দের মলজাত ধূলিকণাও। পক্ষান্তরে, যদিও স্থান, কাল ও শ্রেণীর দূরত্ব অনেক, তবু, বলতেই হয়, যে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন এমন এক পিতা যিনি পুত্রকে ইস্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন হিমালয়ের শোভা দেখাতে।
প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলি, আমার মনে হয়েছে, শিশুর অভিভাবকত্ব করতে হয় যাদের,করতে হবে যাদের তাদের অবশ্যপাঠ্য রবীন্দ্রনাথের “জীবনস্মৃতি’।
তবে, অন্তিমে, আমাকেও, পেটের ধান্দায়, হতে হয়েছে উদ্বাস্তু।
ঐ বেদনা নিয়ে হারিয়ে যাই রূপসী বাংলায়ঃ
যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি প’রে কোন এক সুন্দরীর
শব
চন্দন চিতায় চড়ে- আমের শাখায় শুক ভুলে যায় কথা;
যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ- সবচেয়ে গাঢ় বিষণ্ণতা;
যেখানে শুকায় পদ্ম- বহু দিন বিশালাক্ষী যেখানে নীরব;
যেইখানে একদিন শঙ্খমালা চন্দ্রমালা মানিককুমার
কাঁকন বাজিত, আহা, কোনোদিন বাজিবে কি আর !
টেরপাই এ এক সভ্যতার গল্প যে সভ্যতা বিনিঃশেষ হয়েগেছে ।
শুধু ভূগোলের পৃষ্ঠা থেকে নয়, মানুষের-মানবের চৈতন্য থেকেও। আজকের অপু যদি তার কাজলকে নিয়ে ঐ খানে আশ্রয় চায় তাহলে সে বিচূর্ণ হয়েযাবে আজকের নব সভ্যতার আঘাতে। মিশেযাবে বিচূর্ণ সভ্যতার এক ফসিল জগতে ।
আমি ভীত হই। আমি চোখ বন্ধ করি । বন্ধ চোখে, ক্রমে ভেসে উঠতে থাকে মোতিবিল,ছোটোনদী,বক্সী গঞ্জের পদ্মাপার ...
অকস্মাৎ টেরপাই বিগত কোনো সভ্যতার ফসিল নয় এরা । এরা বর্তমান । নতুবা এই দুঃখবোধের উত্তরাধিকার আমি পেলাম কিভাবে, আমার রক্তে? আর যদি আমি পেয়েই থাকি সেই বেদনার, বিচ্ছেদের বোধের, অনুভবের উত্তরাধিকার, তা আমার বর্তমান আবহের সঙ্গে, দ্বন্দ্বে, নির্মান করবে, করেছে সেই অন্য বাস্তবতা যা আমার সন্ততিকে কোনো না কোনো ভাবে অধিকার দেবে একই বেদনার, একই বিচ্ছেদের। না শুধু ইচ্ছার জোরে নয়, সাহসকে মিলিয়ে সন্ধান চালালেও পাওয়া যাবে না ঐ ছোটোনদী,মোতিবিল,মধুমাঝি আর কুমোড় পাড়ার গরুর গাড়িগুলিকে। সত্য। এ’ও সত্য যে, ওই ‘পাওয়া যাবে না’র সঙ্গে ছিল’র, আছে’র দ্বন্দ্বে, নিজমর্মে, কাজলের,দুর্গার হাতধরে একদিন সত্যই গিয়ে দাঁড়ানো যাবে ঐ নিশ্চিন্দিপুরে, মোতিবিলের কিনারে। কেননা তারা আছে। মহাবিশ্বের মহাস্মৃতিতে, মহাসময়ে এরা জীবিত। লোভ আর লাভের যাপন প্রণালীর শিক্ষকেরা তাদের নিজ দরকারে ভুলিয়ে রেখেছে আমাদের। এই ভুলিয়ে রাখা মদ। নেশা। কিন্তু নেশা, সে যত গভীরই হোক না কেন কাটে। কাটবেই।
... কানে আসে কে যেন গায়ঃ
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে–
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।
টেরপাই নিঝুম রাত্রির ভিড়ে অভিশপ্ত আমি আর গৃহহীন আমার সন্ততি একপাশে আর এই ঘাতক সভ্যতা
আমাদের প্রতিপক্ষে। ওদের হাতিয়ার লোভ, নেশা। আমাদের অস্ত্র সহজ পাঠ,পথের পাঁচালী,বুড়ো
আংলা,রিদয়,রূপসী বাংলা...
টের পাই জীবনানন্দের অক্ষরগুলি,নন্দলালের ছবিগুলি এপিটাফ
নয়। তারা প্রতিমা। তারা অক্ষয় । বছর বছর বিসর্জনেও।
আদিলেখনঃ
২৮/১২/২০০৪, বেঙ্গালোর
ফিরেলেখাঃ ৪/৮/২০১০,বেঙ্গালোর
সামান্য অদল বদলঃ ২৯/০৬/২০২২, বেঙ্গালোর