প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Sunday, June 13, 2010

বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালী


                                               
          অর্ক,অর্চ্চিতা আর আরও যেসব বাচ্চারা আজো গল্প শুনতে চায় তাদের জন্য ...
১।
যেখানে সেই রেলগাড়িটা থামে, সেইখানে এক পাহাড় আছে। পাহাড়ের নাম ‘হারেংগাজাও’। হারেংগাজাও পেরিয়ে নদী। ‘জাটিংগা’  সে। নদীর ধারে গ্রামের ছেলে কিংকু থাকে । কিংকু বাবামায়ের সাথে পাহাড়ে যায়। পাহাড় থেকে কম্‌লা এনে মা আর বাবা বাজারে বেচে। তাইতে তাদের দিন চলেযায়।
পাহাড় চড়া শক্ত ভীষণ। কিংকু’কে মা পিঠের মধ্যে কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিলে বাবা একটা চাদর এনে পেঁচিয়ে বাঁধে। পিঠের মধ্যে দুলতে দুলতে কিংকু চলে। চলতে চলতে কোনোও দিন ঘুমিয়ে পড়ে। কম্‌লা গাছের পাতার ফাঁকে রোদ ঝল্‌মল্‌। ছায়ায় ছায়ায় চলতে চলতে এগিয়ে আসে কম্‌লার বন। কিংকু’কে মা পিঠের থেকে নামিয়ে রাখে । কোনোও দিন কিংকু ঘুমায়। কোনোও দিন কিংকু জাগে। সেই একটাই গাছের তলায় কিংকু থাকে। মা-বাবা যায় দূর পাহাড়ে...
                   সেই যেখানে একলা একা সমস্তদিন কিংকু থাকে ঐ গাছেরি পাতায় পাতায় আলতো পায়ে লাফিয়ে বেড়ায় কাঠবাড়ালী। বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালী। তার বাবা আর মা’ও যে যায় খাবার আনতে। এগাছ ও গাছ লাফিয়ে তারা খাবার খোঁজে। বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালী পাতার ফাঁকে তাকিয়ে থেকে সূর্য্য দেখে। আকাশ দেখে, মেঘকে দেখে। কোনোও দিন গাছের থেকে লাফিয়ে নেমে ঘাসের মধ্যে, ঝোপের মধ্যে নিজেই খেলে।
                  খেলতে খেলতে দিন চলেযায়। আঁধার ঘনায়। বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালীর গা ছম্‌ছম্‌ । ঐ বুঝিবা ঝোপের থেকে একটা কোনো জন্তু আসে...বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালী গাছের ওপর লাফিয়ে ওঠে। পাতার দিকে তাকিয়ে ভাবে ঐ বুঝি তার বাপ্‌-মা এলো ...
        একটু পরে বাপ্‌-মা আসে। চিড়িক্‌-চিড়িক্‌-চিড়িক্‌-চিড়িক্‌ শব্দ ওঠে। খাবার দাবার সাবাড় হলে বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালী মা আর বাবার মাঝখানেতে আরামে শোয় গাছের ডালে। কম্‌লা গাছের পাতার ফাঁকে তারারা জাগে। মা আর বাবা সারাদিনের গল্পশোনার তখন তাকে। শুনতে-শুনতে-শুনতে-শুনতে পাতার ফাঁকে তারার আলো দেখতে-দেখতে-দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে বাচ্চাছেলে কাঠবিড়ালী...
       কিংকুও ঠিক এমন সময় মায়ের কাছে গল্প শোনে ...বাবা ঘুমায় নাক ডাকিয়ে। বাজারে খুব ধকল বাবার। বস্তাভরা   কম্‌লা নিয়ে বেচ্‌তে যাওয়া তারপরে ফের পয়সাকড়ির হিসাব নিকাশ...পরের দিনই আবার ভোরে উঠতে হবে...জান্‌লা দিয়ে দূরের পাহাড় দেখতে দেখতে কিংকু ভাবে কম্‌লা বনে আমার যদি একটা কোনো বন্ধু হতো...জান্‌লা দিয়ে দূরের পাহাড় দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে কিংকু কখন হঠাৎ করে ঘুমিয়েপড়ে...


২।
গাছের তলায় কিংকু সেদিন ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ কিসের সুড়সুড়িতে ঘুম ভেঙ্গেযায়। জেগে উঠেই কিংকু দেখে আজব ব্যাপার! ছোট্ট একটা কাঠবিড়ালী দেখছে তাকে - দেখছে তাকে সামনে বসে অবাক চোখে ... শোওয়ার থেকে বসল উঠে কিংকু তখন।  বাচ্চাছেলে কাঠবিড়ালী ভয় পেলোনা। পাবেই কেন? মানুষ  খারাপ এই কথাটা সবাই জানে। মা বলেছে। বাবাও বলে। কিন্তু এটা মানুষ তো নয়। বাচ্চা মানুষ। ছোট্ট মানুষ। তার মতনই। ছোট্ট মানুষ কেমন করে খারাপ হবে? ছোট্টরা কি খারাপ হতে পায় কখনো? বাচ্চাছেলে কাঠবিড়ালী চেয়েই রইলো...
    কিংকু তখন পকেট থেকে কয়েক টুকরো বাদাম নিয়ে এগিয়ে দিল। বাচ্চাছেলে কাঠবিড়ালী লাফিয়ে এসে বাদাম নিলো হাতের থেকে। মুখে দিতেই নতুন স্বাদের আমেজ পেলো...কিংকু বললে ‘তুমি আমার বন্ধু হবে?’ বাচ্চাছেলে কাঠবিড়ালী ল্যাজ নাড়ালো। হাত বাড়ালো কিংকু তখন। বাচ্চাছেলে কাঠবিড়ালী সে হাত বেয়ে উঠলো কাঁধে। কিংকু তখন হাততালিতে সমস্ত বন মাতিয়ে দিল...
বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালীর বন্ধু হলো ...একলা ছেলে কিংকু একটা বন্ধু পেলো...

৩।
সমস্তদিন খেলায় খেলায় কাটলো তাদের। লুকোচুরি, দৌড়াদৌড়ি,পাতার ঘাসে, ঝোপের ভিতর,গাছের ডালে...খেলতে খেলতে খেলতে খেলতে দিন ফুরালো...হারেংগাজাও পাহাড় বেয়ে সূর্য্য ডুবলো...বাচ্চাছেলে কাঠবিড়ালী তবুও তেমন ভয় পেলোনা । ভয়বা কিসের? বন্ধু যদি সংগে থাকে ভয় বা কিসের? কিংকুও আজ সাহসী খুব। বাচ্চাছেলে কাঠবিড়ালীর বন্ধু হয়ে ভয় কী মানায়? একটি দু’টি তারা জাগলো তবুও তারা বসেই রইলো গাছের তলায়...
    একটু পরে কম্‌লা নিয়ে মা-বাপ্‌ এলো পাহাড় ভেঙ্গে। কিংকু তখন বল্লো তাদের ‘একটু থাকো, বাচ্চাছেলে কাঠবিড়ালী বন্ধু আমার, তার মা-বাবা আসলে পরে আমরা যাবো...’ মা-বাপ্‌ শুনে হেসেই খুন। ‘মানুষের আমার বন্ধু হবে কাঠবাড়ালী...কেমন কথা? কাঠবাড়ালীর মা-বাপ থাকে? হাঃহাঃহাঃ সাত জন্মেও কেউ শোনেনি অমন কথা...চল্‌, বাড়ি চল্‌ ...কম্‌লাগুলো ঝুড়িতে ভরে বাবা আমার বেচতে যাবে ... দেরী করলে বাজারে আর থাকবেনা কেউ...তা ছাড়া এই অন্ধকারে, রাতবিরেতে...’ শুনতে শুনতে রাগহলো খুব কিংকুর আর বাচ্চাছেলে কাঠবিড়ালী সে’ও ভীষন দুঃখু পেলো ... ‘ মানুষ  খারাপ এই কথাটা সবাই জানে। মা বলেছে। বাবাও বলে। দেখছি এখন কথাটা ঠিক্‌, তবে আমার বন্ধু ভালো...কিন্তু আরো একটা কথা বড়হলে বন্ধুও কি এমনি হবে...’ ...মা-বাপ যখন টান্‌ছে তাকে কিংকু তখন কান্না জুড়লো। কিংকু জানে এ এক ওষুধ। সবাই কাবু কাঁদলে পরে... বাপ-মা তখন বল্লো তাকে ‘ ওতেই হবে,ওতেই হবে ...দেখি তোমার কাঠবেড়ালীর কেমন মা-বাপ, কখন আসে ...’ বলে তারা পোঁটলা খুলে সকালবেলার শুকনো রুটি বাড়িয়ে দিল – কিংকুকে আর বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালীর জন্য দিল একটু ছোটো টুকরো ছিঁড়ে...এমন সময় পাতায় পাতায় শব্দশুনে বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালী লাফিয়ে উঠলো ‘মা এসেছে!মা এসেছে! বাবাও এলো ...!!!’
৪।
উপর থেকে তাকিয়ে দেখে মা-বাবা তো ভীষণ অবাক্‌! বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালী তাদের ছানা দিব্যি বসে খাচ্ছে রুটি গাছের নীচে! সংগে মানুষ!! আজব ব্যাপার! মানুষ তবে খারাপ কি নয়? কিকরে হয়? সুযোগ পেলেই পুষবে খাঁচায়...গুল্‌তি ছূঁড়ে মারবে বুঝি!!!মা-আর বাবা দৌড়ে নামলো গাছের থেকে... ‘আমাদেরকে ধরে ধরুক্‌ ...ছানাটাকে বাঁচাই গিয়ে...’ নেমেই এসে বল্লো বাবা ‘পালিয়ে আয় ...করছিস্‌ কি?মানুষ ওরা ! দুষ্টু ভীষণ!! কি মতলব যে আছে মাথায়...‘পালিয়ে আয়্‌ - ‘পালিয়ে আয়্‌’ ...
বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালী বল্লো ‘বাবা, ভয়পেয়োনা, কিংকু আমার বন্ধু ভীষণ, ওরা দুজন ওর মা-বাবা...আমায় ওরা একা রেখে যাবেনা বলে তোমরা আসার অপেক্ষাতেই এখানে বসে...’ ...শুনে ও দেখে খানিকটা ভয় কাটলো ওদের। মা বল্লো ‘ মানুষ হলেও বাচ্চাটা বেশ...’ বাবা তখন জোড়করে হাত, ল্যাজ উঁচিয়ে নমষ্কারের মতন করলে মানুষরাও জোড়করে হাত নমষ্কারটা ফিরিয়ে দিলো ... থলীর থেকে রুটির আরো কয়েক টুকরো ওদের দিয়ে, পিঠের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে কিংকুকে ফের চল্লো ওরা ...
মা আর বাবা কাঠবেড়ালী অবাক চোখে তাকিয়ে রইল...
কম্‌লাগাছটা নাড়িয়ে মাথা বল্লো তাদেরঃ ভালোই হলো, বাচ্চাছেলে কাঠবেড়ালীর বন্ধু হলো ...একলা ছেলে কিংকু একটা বন্ধু পেলো...
১৩/৬/২০১০

ঘুম ঘর