প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Tuesday, December 6, 2011

পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়ঃ সপ্তর্ষি বিশ্বাস

 পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়

 সপ্তর্ষি বিশ্বাস



 

রামায়ণে রামের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন রাবণ, মহাভারতে পান্ডবের কাছে কৌরব, কারবালা প্রান্তরের সেই যুদ্ধে, অবশেষে, হজরতের শুভানুধ্যায়ীদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন এজিদ। ঠিক। কিন্তু এঁদের এই পরাজয়ের সঙ্গে কি কোনো ভাবেই তুলনা করা যায় হলিউড্‌ বা বলিউড্‌ ছবির নায়কের কাছে ভিলেনের পরাজয়ের? ঠাকুর সিংএর কাছে গব্বর সিংএর পরাজয়ের? যায়না। কেননা মহাকাব্যে নাত কেউ নায়ক, নাত ভিলেন। প্রতিটি চরিত্র তাঁর নিজ নিজ বিশ্বাসে অটল থেকে মেনে নেন আপন পরণতি ... যেমন ভীষ্ম, যেমন কর্ণ, যেমন ধৃতরাষ্ট্রসহ কৌরবেরা সকলে ... কিন্তু তথাকথিত ভিলেনএর সঙ্গে রাবণ বা কৌরবের দূরত্বটিও কিন্তু অতি সূক্ষ এবং অবশ্যই তর্ক সাপেক্ষ... সহজ কথায় একজন ভিলেন যেখানে তার ব্যক্তি আমির পার্থিব প্রলোভনের দ্বারাই লীপ্ত হয় সেই সব কাজে যা সে নিজেও জানে অন্যায় বলে সেখানেই মহাকাব্যের বা পরবর্তীতে ট্র্যাজিডির চরিত্রেরা তাই করে থাকেন যা তাঁদের বিশ্বাসে বিধৌত । আর যেহেতু বিশ্বাসে বিধৌত তাই তাঁর কাছে সত্যও সেই ক্রিয়াই।  

 

                    এমনি এক বিশ্বাসে ভর করে বাইবেলের আব্রাহাম্‌ বা কোরানের ইব্রাহিমও, স্নেহ-মায়া-মমতার সমস্ত আকূতি পার হয়ে গিয়ে নিজের প্রিয়তম পুত্রকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন দেবতার আদেশে। সেই দৃশ্যে স্বর্গের করুণা নেমে এসেছিল মর্ত্যে । সন্তুষ্ট দেবতা আব্রাহাম্‌ বা ইব্রাহিমকে নিরত করেছিলেন বলীদান থেকে। কিন্তু দেবতাকে সন্তুষ্ট করবার পথে মানুষ হিসাবে আব্রাহান/ইব্রাহিম কি আমাদের চোখে হয়ে ওঠেনি যথেষ্ট অমানুষ? আদতে ক্ষমতার কাছে নুয়ে থাকলে ক্ষমতা করুণা দেখালে দেখাতেও পারে এমনই একটি ইঙ্গিত আমাকে দেয় আব্রাহান/ইব্রাহিম কাহিনী। তবে এই কাহিনীও, এই হেজেমনিও সম্ভবতঃ সামন্ত প্রথারই সত্য। কেননা ভাঙ্গতে বসা সামন্ত আমলে, এই বিংশ শতকে যে মানুষটি তার বিশ্বাসের মূল্যে তার কন্যাকে তুলে দিল দেবতার গ্রাসে তার সেই বলীদানের শেষ দৃশ্যে নেমে আসেনি দেবতার করুণা । শিশু আসমাকে কেড়ে নিয়েছিলেন দেবতা। ঠিক যেমন পুতুল নাচের ইতিকথায় কেড়ে নিয়েছিলেন সেই কবিরাজ দম্পতীকে। আস্‌মার পিতা কাজী সাহেব যদি নিজ কন্যাকে বাঁচাতে শরণ নেন এলোপ্যাথির তাহলে তাঁর হোমিওপ্যাথির বিশ্বাসের ভিত টলে যায় । ঠিক যেমন আয়ুর্বেদের দ্বারা নিজ মৃত্যুদিন ঘোষনা করে দিয়ে সেই দিনে মৃত্যু বরণ না করলে ব্যর্থ হয়ে যায় সেই কবিরাজের মর্মগত বিশ্বাস - যে বিশ্বাস তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু, গ্রামবাসীর কাছে তাঁর ক্ষমতার জাদুকাঠি। তাই ঐ ঘোষিত দিনে গোপনে আফিং খেয়ে প্রকাশ্যে মৃত্যু বরণ করেন কবিরাজ দম্পতী। শশী ডাক্তার সবই টের পায় তবুও ঐ আত্মহত্যা দেখে নিশ্চুপে । দেখে, কোনো প্রতিকার করেনা কেননা সে জানে এখন যদি এঁদেরকে হাসপাতালে নিয়ে, এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় যায় বাঁচিয়ে তোলাও তাতে এঁদের দেহটা বাঁচবে শুধু, আর কিছু নয়। এগিয়ে আসা বুর্জোয়া সময়ের ছায়া তার মর্মে পড়লেও সামন্ততান্ত্রিকতার শশীও পারেনি সামন্ততান্ত্রিক ভাবনার ছায়া থেকে পুরোপুরি বার হয়ে আসতে।

মাটির ময়নাতে শশীর সমান্তরাল ভূমিকায় দেখাযায় কাজী সাহেবের ছোটোভাই মিলন’কে। তবে এ যেহেতু দুই নিঃসন্তান বৃদ্ধ-বৃদ্ধার যুগলে আত্মহত্যা নয়, একটি শিশুর, যা’কে মিলন বড় করেছে, করছে কোলে পিঠে নিয়ে, তারই জীবন সংশয়, ফলে শশী ডাক্তার’হেন নির্বিকার হতে পারেনা মিলন। দ্বিতীয়তঃ সময় তখন আরো কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে। পরিচালক তারেক মাসুদের মর্মে নেই ‘শশী ডাক্তার’হেন সামন্তবাদের খোঁয়াড়ি। তাই তারেক মাসুদের প্রোটাগোনিস্ট, যেহেতু কাহিনীর সময়কাল সত্তরের দশক আর আবহ গ্রামীণ বাংলাদেশ (তৎকালীন পাকিস্তান) তাই মিলন স্বাভাবিক ভাবেই সরাসসি সংঘর্ষে তখনো যায়না সামন্তবাদ ও তজ্জনিত মূল্যবোধের বিপক্ষে। পক্ষান্তরে সে রোগীর অবস্থা বলে এলোপ্যাথি’র মিক্‌শ্‌চার’ নিয়ে আসে ডাক্তারের কাছ থেকে। তা গোপনে দিয়ে যায় ভাবী’কে। কিন্তু কাজী সাহেব, ঐ ইব্রাহিমের মতনই, যেন শেষ দৃশ্যে তেমনি কোনো অলৌকিক করুণা নেমে এসে কন্যাকে বাঁচিয়ে দেবে, এই আশায় সেই এলোপ্যাথি’র মিক্‌শ্‌চার’দেন ছুঁড়ে ফেলে । কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মেই অন্তিমে নামেনা সেই অলৌকিক করুণা। আস্‌মা’ হয় গ্রাস। দেবতার। বিনিময়ে কাজী সাহেব বন্ধ করেন তাঁর হোমিওপ্যাথির প্র্যাক্‌টিশ্‌। এ কোনো প্রতিবাদ নয়। এ এক অক্ষমের অভিমানমাত্র।

এই কাজী সাহেব কি তাহলে ভিলেন বা সত্যজিতের দেবী’র শ্বশুরমশাই’টির মতো বিকৃতকাম বা উন্মাদ? না। তা নয় আদপেই। এই কাজী সাহেবই বিশ শতকের ইব্রাহিম আর তাই কোরাণের ঐ গল্পটি ইব্রাহিম মাঝির কন্ঠে আগে থাকতেই আমাদেরকে শুনিয়ে রাখেন পরিচালক তারেক মাসুদ।

যন্ত্রণা’কি হয় না কাজী সাহেবের? হয়। কেননা তিনিও’ত মাটির ময়না’ই। তাঁকেও’ত বার বার অনুভব করতে হয়, হয়েছেঃ .... মাটির তৈরি ময়না বলেঃ তাইলে কেনে মনটা দিলে,না দিলে জোর যদি ডানায় .. পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়’ ( এই গানের কথায়, সুরে মিশে আছেন লালন থেকে হাসন রাজা তথাপি গানটি আমার কাছে একটি মৌলিক সৃষ্টির অবয়ব নিয়েই ধরা দেয় ..) তাঁর ধর্ম, যেহেতু তা আদপে পাকিদের মতোই, এক মোহ মাত্র, তাই , তা এক সময় তাঁকেই বন্দী করেছে। নিজের মর্মকোঠায় আলোবাতাসের প্রবেশপথ নিজেই দিয়েছেন বন্ধ করে। প্রতীক হিসাবে বারবারই আমরা দেখি নদীর দিকের জানালাটি বন্ধ করে দিচ্ছেন কাজী সাহেব আর সেই জানালাই খুলে দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী আয়েষা যিনি মাতৃত্বের, মমতার স্বাভাবিকতায় মুক্ত, মুক্ত সামন্ততন্ত্রের হেজিমনি থেকে, ধর্মমোহ থেকে। সেই জানালা খুলেই মিলন দিয়ে যাচ্ছে মেলায় কেনা কচুরী, ডক্তারের কাছ থেকে আনা ওষুধ

আয়েষা জানালা খুলে দেন, আয়েষা বলেনঃ আমারই কুনো যুদ্ধ নাই ...

         আয়েষা যখন বলেনঃ আমারই কুনো যুদ্ধ নাই’তখনই কিন্তু এক দিকে খান সেনা ঝাঁপিয়ে পরেছে পুব পাকিস্তানকে আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার হেন বস্তু দাবী করবার জন্য সমুচিত শিক্ষা দিতে, পূর্ব পাকিস্তানের গড়িষ্ঠ সংখ্যক জনতা নেমে আসছেন প্রতিরোধের যুদ্ধে, আরেকদল ভাবছে পশ্চিম পাকিস্তানের জয় ইসলামের জয় ।  এরা প্রস্তুতি নিচ্ছে আরেক যুদ্ধের। গৃহযুদ্ধের।আয়েষা যখন বলেনঃ আমারই কুনো যুদ্ধ নাই’তখন স্বামী’র অনড়-অটল বিশ্বাসের মূল্যে চিকিৎসা বিভ্রমে বা বিন-চিকিৎসায় মারা গেছে তাঁর কন্যা আসমা । ছেলে আনু চলে গেছে, সেই স্বামীরই ইচ্ছায়, শহরে, মাদ্রাসায়। আয়েষার গুন্‌গুনিয়ে গান গাওয়া থেমে গেছে, থেমে গেছে সূঁচ-সূতোয় কাপড়ে ফুল তোলা । তবু আয়েষা বলছেন  আমারই কুনো যুদ্ধ নাই’ ...

আমি যেন স্তব্ধ হয়ে যাই। আমি টের পাই বাইরের, ভিতরের জানালাটিকে খুলে রাখার মূল্যে আয়েষা শুধু জেনেছেন বেঁচে থাকাটাই, থাকাটা’ই শেষ কথা । তাই শেষ দৃশ্যে খান সেনার হাত থেকে পুত্রটিকে রক্ষা করবার স্বাভাবিক তাড়নায় তিনি নেমে আসেন পথে। তখন তাঁর, তাঁদের আর হারাবার কিছু থাকেনা। পিছনে রয়েযায় খান সেনার তান্ডবে ছারখার হওয়া ভিটে, পুড়ে যাওয়া পুঁথির পাতা আগ্‌লে বসে থাকা কাজী সাহেব।

ছেলের হাত ধরে জীবনের সন্ধানে পথেনামেন আয়েষা কেননা তাঁর কোনো পুঁথিপড়া বিশ্বাসকে বহনের দায় নেই কাজী সাহেবের মতো। তাঁর ধর্ম মানবের ধর্ম। তাঁর ধর্ম মাতার ধর্ম। ... তবে যারা অত্যাচারী তাদের বিরুদ্ধে যাঁরা সংগ্রামে যান সেই সব মহাপ্রাণদের প্রতি আছে তাঁর মর্মে দরদ, মমতা।  তাই খানসেনা’র সঙ্গে যুদ্ধে মিলনের মৃত্যু সংবাদে কেঁদে ওঠেন তিনি । তথাপি শিশু পুত্রটিকে বাঁচানোর জীবন্ত বিশ্বাসের হাতে সঁপে দেন নিজেকে, ,ঐ সময় তাঁর পাশে থাকে সেই ইব্রাহিম মাঝি যে কখনো মিলন’কে বলেছিল যে প্রকৃত ধর্ম মানুষকে অন্ধ করেনা বরং আরো বেশী দেখতে শেখায়।

কিন্তু কাজী সাহেব দেখেননা, দেখেননা আনু’র মাদ্রাসা’র বড় হুজুর। তাই একজন সর্বদা নিজের কোঠার জানালাটি রাখেন বন্ধ করে আর আরেকজন অন্য’কে বন্ধ করে রাখার হুকুম জারি করেন ।  মনে আসছে তার্‌কোভস্কি’র নস্টালজিয়া’ যেখানে একজন যাজক তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে বারো বৎসর পাতাল ঘরে রেখে দিয়েছিলেন তাঁদেরকে পৃথিবী জোড়া পাপের কলুষ থেকে দূরে রাখতে।

মনে আসে মিলন আর তার বন্ধুদের সেই কথোপকথন যেখানে, ঠাট্টার মেজাজে হলেও, তারা বলে, যে, স-ব বাদ’ , মার্কসবাদ থেকে ফ্যাসীবাদ, জন্মেছে পশ্চিমেই আর আমরা সেইসব বাদ’ নিয়ে বাদাবাদি’ করে মরছি কিন্তু অবশেষে সেই মিলনই, সেই বন্ধুদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কেননা তখন আর কারোরই কিছু নেই হারাবার

 

                 ছবির আরেকটি বিশেষ মাত্রা আনু’র মাদ্রাসা’ জীবন, আনু আর রোকনের বন্ধুত্ব । রোকনের সেই নিজস্ব পৃথিবী যেখানে সে এনে জড়ো করে রেখেছে ভাঙ্গা সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে সিনেমার পোস্টার , যেখানে সে একা একা বসে ছবি আঁকে নিজের মনে । এর পাশাপাশি রয়েছে তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতার দ্বান্বিক ( এবং মার্কবাদীও বটে ) উন্মোচন রয়েছে সেই প্রশ্ন ... ধর্ম না রাজনীতি কে নিয়ন্ত্রণ করে কাকে? ... পূর্ব পাকিস্তানের পতন কি প্রকৃতই ইসলামের পতন? গহনে কিন্তু রয়ে যায় সেই খোলা জানালা আর বন্ধ জানালার কাহিনী ।

 ছোটো হুজুর কেন ভালো? কেননা মাদ্রাসার এই শিশু গুলি তাঁকে মনে পড়ায় তাঁর কন্যাকে ... যেনবা কাবুলিওয়ালা’ আর বড় হুজুর, সেই কাজী সাহেবেরি মতন নিজেকে বন্ধ করে ফেলেন তাঁর অক্ষর কেন্দ্রীক ধ্যান ধারনায় আর সামন্ততান্ত্রিক অহংএ । ফলে দশ বছরের বালক রোকন বুঝতে পারে যে তার সহপাঠীটির ফার্সী হস্তলিপি ভালো নয় কেননা তার অভ্যাস বাঁ হাতে লেখার আর এখানে তাকে লিখতে হচ্ছে ডান হাতে । কিন্তু বড় হুজুর বোঝেননা ।তাঁর মনে হয় বাঁ হাতে ফার্সী লিখতে যাওয়াও যেন ইসলামের অবমাননা ...

        ছবিটির আরেকটি মাত্রা তার শেষ দৃশ্যে। কাজী সাহেব খান সেনা’কে ভেবেছিলেন শান্তির দূত। ইসলামের রক্ষাকর্তা। ফলে তিনি প্রকৃতই বিশ্বাস করতে পারেননি যে খান সেনা’র হাত থেকে যে তিনিও রক্ষা পাবেন না। কিন্তু বাস্তবে তা যখন ঘটলো না, তখন? ... মনে পড়ছে মিলান কুন্দেরা’র জোক’ উপন্যাসের একটি চরিত্র। সে এক কট্টর কমুনিষ্ট। তথাপি তৎকালীন কমিউনিষ্ট সরকার তাকে বন্দী করেছে এন্টি কমিউনিষ্ট’ সন্দেহে। জেলে এসে, জেল কর্তৃপক্ষ, যারা নিজেদের বলে কমিউনিষ্ট, তাদের ব্যাপার স্যাপার দেখে সে নিশ্চিত হয় যে এরা মূলতঃ নিও নাজি’ আর কমিউনিষ্ট’দের ভাবমুর্তি নষ্ট করার জন্যই এরা নিজেদেরকে বলে কমিউনিষ্ট । যুবকটি তখন গোপনে এক চিঠি লিখে তার আবাল্যের কমিউনিজ্‌ম্‌’ এর গুরুকে যিনি তখন কমিউনিষ্ট শাসন ব্যবস্থায় এক চাঁই ব্যক্তি।

সে চিঠি লিখে এবং আশা করে তিনি অবশ্যই এর কিছু একটা বিহিত করবেন।

     দিন সাতেক পরে, তার ডাক পরে জেলারের কোঠায়, সেখানে অন্য সমস্ত বন্দীদের সামনে জেলার তাকে দেখায় সেই চিঠিটি যা সে পাঠিয়েছিল তার কমিউনিজ্‌ম্‌’ এর গুরুকে ... তিনিই চিঠিটি পাঠিয়ে দিয়েছেন , ঐ জেলারের কাছেই । বিশ্বাসের এই অপমৃত্যু সইতে পারেনা সে ।  যে ছেলে অন্য সমস্ত বন্দীদের জীবনের আশা জোগাতো সে’ই ছেলেই ঐ রাত্রে আত্মহত্যা করে কন্ঠনালীতে ক্ষুর চালিয়ে।

     বিশ্বাস ভঙ্গের এই এক পরণতি। কাজী সাহেব কি যাবেন সেই দিকে? আবার আমরা’ত এ’ও জানি, যে, যে রাতে সকল দুয়ারই ঝড়ে ভেঙ্গে যায়, সে রাতেই তিনিও এসে দাঁড়ান আমাদের ঐ ঘর ভরা শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলতে। তবে কি কাজী সাহেব, আজ যখন তাঁর ঘর-দোর-ভিতর-বাহির সবই ভেঙ্গে গেলো ঝড়ের আঘাতে, তখন, দেখা পাবেন সেই বিরাটের যা’কে তিনি জানালা বন্ধ করে দূরে সড়িয়ে রেখেছিলেন এতো দিন? ...

 

   এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়েই অন্ধকার পর্দায় ভেসে ওঠে নামলিপি। আর আমি টের পাই মহাকাব্যে কেউ ভিলেন হয়না, হয়না ট্র্যাজিডিতেও ।  না এখানেও খান সেনা’ও নয় ভিলেন এরাও লড়ছে ইসলাম বাঁচাও’ হেন উন্মাদনার ঝোঁকে । কিন্তু এই বিংশ শতকে ভিলেন ভিন্ন সম্পূর্ণ হতে পারেনা কোনো কাহিনী’ই আর তা’ই মহাকাব্য কেন সঠিক ট্র্যাজিডিও হয়না আর রচিত । তাই মাটির ময়না’ও বলে এক ভিলেনের কথা ... তবে ইয়াহিয়া খান নয়, সে বলে ক্ষমতা’ই আসলে ভিলেন, অন্ধ ক্ষমতা, লোভ,যার কেন্দ্রে মাকড়সার মতন ওঁৎ পেতে বসে থাকে সাম্রাজ্যবাদ, নতুন চেহারায়। সেই ছদ্মবেশী লোভের হাত এড়াতে পারেননি মার্লো’র ফস্টাস্‌, গ্যাটের ফাউস্ট ... অতি উৎপাদন আর বিশ্ব বাণিজ্যের হাতে জন্ম যে মেফিস্টোফিলিসের তাকে  ফস্টাস্‌ বা ফাউস্ট’ও যদি এড়াতে না পারে তাহলে কি করে পারবে গ্রামের সরল, বোকা মানুষেরা, কাজী সাহেব সে’ওত এক জন মানুষই ... যেহেতু মানুষ সেই হেতু সে’ও কি নয় এক মাটীর ময়নাই? ...

 

আদিলেখনঃ ৫ ডিসেম্বর ২০১১

সম্পাদনাঃ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

ঘুম ঘর