‘নাইয়ারে নাও’এর বাদাম তুইল্লা’ : সপ্তর্ষি বিশ্বাস
[সুকুমার রায় লিখেছিলেনঃ
ট্যাঁশ্ গরু গরু নয় আসলেতে পাখি সে;
যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে়]
যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে়]
সারাদিনের
অফিসের বিরক্তি আর ক্লান্তি নিয়ে ঢোকামাত্র আজ মনটা আনন্দে ভরে গিয়েছিল কারন কারেন্ট্
চলে গিয়েছিল কোঠায় পা রাখা মাত্র । আকাশে সুগোল চাঁদ, আবছা কুয়াশা । অন্ধকার ঘরে
রহস্যের আব্ছায়া । আহ্, এক মুহুর্ত্তে ফিরে আসতে চাইছিল ‘ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলি
...’
অমনি
জ্বলে উঠলো বিজলীবাতি গুলি। মুছে গেলো গগন ঠাকুরের ছবির মতো সেই অন্ধকার । মুছে গেলো
ফ্ল্যাট্ বাড়ি থেকে। তবু তা জড়িয়ে রইলো
এই ‘ফলাট্’এর মুখোমুখি ‘গরীব গুর্বোদের ভিটে গুলোকে । অর্থাৎ জেনারেটার চল্লো ফলাটে
। বাবু-বিবিরা নিশ্চিন্দি হলেন। এলসিডি পর্দায় ঝিকিয়ে উঠলেন ওবামা , হোম্ থিয়েটারে
‘কলা-বারি’ গেয়ে উঠলেন রজ্নীর জামাতা । বৈদ্যুতিন লোম তোলা মেশিন চলতে লাগলো বিবিদের
বগলে বগলে। কার্টুন নেট্ওয়ার্কে শোনাগেলো শিন্চেন্’এর
এক ঘেয়ে কন্ঠস্বর । এক দল বাচ্চা ডুব দিলো
তাতে আর আরেক দলকে গিলে খেলো ‘হোমটাস্ক্’। আমি সহ অন্যান্য “বাবু”রা আয়েসে চুমুক
দিলেন বীয়ারের, হুইস্কীর গেলাসে । হায়, হারিয়ে গেলো রহস্য, শৈশব, চাঁদ, জ্যোৎস্না
... আমার মনে পড়লো ডেভিড্ ফিন্চারের ‘ফাইট ক্লাব্’
ছবির নায়ককে, যে অবচেতনে এমনি বিধ্বস্ত হয়ে পরেছিল এই ফ্ল্যাট কেন্দ্রীক জীবনে, যে,
একদিন, নিজের অজান্তেই তার ‘অল্টার ইগো’
গিয়ে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল ঐ জন-জঙ্গল। তারপর থাকতে চলে গিয়েছিল শহরের
প্রান্তে এক পোড়ো বাড়িতে ...
মনেপড়ে বালকবেলার কথা ...কারেন্ট্
চলে যাওয়া মানেই ছুটি। পড়াশোনা নেই। মা বা বাবা হ্যারিকেন, মোমবাতি জোগাড় করে জ্বালিয়ে
দিলেও পড়ানোর উদ্দীপনা যেন কমে যেতো ওদেরো। কখনো জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতো ঘর, বারান্দা
। কখনো বাদ্লার বাতাস এসে উড়িয়ে নিতো দরজার, জানালার পর্দ্দা ... কখনো, পেছনের বারান্দায়
গিয়ে বসতাম খালের পাড়ে । কখনো সামনের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করতাম কখন ঝন্ ঝনাৎ
শব্দ তুলতে তুলতে চলে যাবে একটা দুটো রিক্সা, সাইকেল...
বয়ঃসন্ধির থেকে কৈশোরের দিকে
যেতে যেতে ঐ কারেন্ট চলে যাওয়া আত্মপ্রকাশ করলো আরেক অবয়বে - ব্যাটারী চালিত রেডিও’র
নব্ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে গান শোনা ... মনেপড়ে ঐ ভাবে, নব্ ঘোরাতে ঘোরাতেই একদিন শুনেছিলাম,
অশোকতরু’র কন্ঠেঃ ‘যদি প্রেম দিলেনা প্রাণে / কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে
/ কেন তারার মালা গাঁথা, কেন ফুলের শয়ন পাতা/কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে
কানে ...’ কতোদিন এমন হয়েছে যে কারেন্ট নেই এই অছিলায় ফিরিয়ে দিয়েছি মাষ্টার মশাইকে
। কোনো কোনো দিন ঐ অছিলায় মাষ্টার মশাই নিজেই চলে গেছেন আর কারেন্ট না থাকার রাত্রিটি
ডাল পালা মেলে ছড়িয়ে যেতে যেতে পার হয়ে গেছে ঘড়িতে ধরাবাঁধা সময়ের চক্রবাল
...
একদিন, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের
দিকে, নামলো বৃষ্টি, ছুটলো বাতাস । যথারীতি চলে গেলো কারেন্ট । বৃষ্টি হলো সারারাত
। টিনের চালে ঝরে গেলো বৃষ্টি, উড়ে আসা পাতা, ডালপালা । ভরে উঠলো নদী, খাল, বিল । সন্ধ্যায় ঘন্টা খানেকের
জন্য কারেন্ট এসেই আবার নেই ...
বৃষ্টির যমজ যে আলস্যে সেই আলস্যে সারাদিন যাইনি
কোথাও । তখন ইস্কুলের শেষ দিক । যাওয়া মানে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাওয়া
মফস্বল শহরের কেন্দ্রে, মফস্বলি পার্কে ...
সন্ধ্যা ক্রমে রাত্রি হয়ে গেলো। আবার বাতাস
বইল। আবার বৃষ্টি নামলো। তবু আমার বিছানার মাথার দিকের জানালাটা বন্ধ করলাম না । জানালার
বাইরের গোঁসাই দের বাগানের বড় বড় আশ্ শ্যাওড়ার গাছ । তার অন্ধকার পাতার আড়ালে
অন্ধকার আকাশ । দূরের বাতাসে সেই আশ্ শ্যাওড়ার
ডালপালা সড়ে যাচ্ছে, বেড়িয়ে পরছে আরেকটুকরো আকাশের অন্ধকার । আমাদের বাড়ির পেছনের খালও জলে ভরে গিয়ে ছুঁয়ে
দিয়েছে উঠোন, পেছনের বারান্দার সিঁড়ি । সিঁড়িতে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিচ্ছে ঢেউ
... হায়, আমার সন্ততিরা বঞ্চিত মর্মের ঐ সব অলৌকিক অভিযান থেকে । এরা ‘ফলাট্’এ বেড়ে
উঠছে । হায়, ফলাটে বেড়ে উঠে মানুষ হওয়া যায় কি প্রকৃত? যেমন মানুষ অপু, দুর্গা,
জাঁ ক্রিস্তফ্, প্রিন্স্ মিশ্কিন বা নিতান্ত ‘পুতুল নাচের ইতিকথার শশী ডাক্তার?
জানিনা। জানতে চাইনা। আমি ভুলে যেতে চাই, ভুলে থাকতে চাই আমার এই ফলাট্ জীবন, এই আইটি
বাস্তবতা । আমি টের পাই আমি হেরে গেছি, টের পাই আমি চাই বা না চাই আমার যাপন হয়ে গেছে
নাগরিক । আমার দুঃখুগুলো, সত্যজিত রায়ের ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’র সৌমিত্র চাটুজ্জের
দুঃখু ... সাঁওতাল পরগণার পরিবর্তে অফিসের পাট্টিতে নাহয় উইক্-এন্ড টিরিপে গোয়ায়
গিয়ে নয়তো কোনো রিসর্টএ গিয়ে মাল খেয়ে উথ্লে ওঠে আর তখন ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকি
‘
হইতে ছিলাম গারিবলডি ... হইয়া গেলাম আইটি প্রো ...’ ... আর ঐ সময় আমার মুখটা যে ঠিক,
টলষ্টয়ের ‘ইম্প এন্ড্ দ্য পীসেন্ট্স্’
ব্র্যাডের সেই হঠাৎ টাকা হওয়া মাতাল চাষীটির মতোই হয়ে ওঠে সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ
আর নেই ।
আমি মরে গেছি। সন্দেহ নেই। আমার সন্তানদের আমি
ছিন্নমূল করেছি। তাদের কোনো জন্মভূমি, জন্মস্থান নেই । জানি । তথাপি মাঝে মাঝে মনেপড়ে
সেই কারেন্ট না থাকা রাত্রি, সেই আষাঢ়ের, শ্রাবণের ... আমাদের বাড়ির পেছনের খাল জলে
ভরে গিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছে উঠোন, পেছনের বারান্দার সিঁড়ি ... সিঁড়িতে আস্তে আস্তে
ধাক্কা দিচ্ছে ঢেউ ... আর ঐ বিষ্টি-বাদ্লার রাত্রে ছোট্ট খেয়া নৌকা দিয়ে কারা যেন
চলেছে কোথায় ... তারা গান গাইছে ‘ নাইয়ারে নাওএর বাদাম তুইল্লা কুন্ দেশে যাও চইল্লা
...’ মনেপড়ে সেই তারাপদকে যে এমনি নৌকার থেকে ভেসে আসা গানের টানে পেছনে ফেলে সমস্ত
সুখের হাতছানি,ঝাঁপিয়ে পরেছিল জলে, সাঁতরে গিয়ে উঠেছিল ঐ নৌকায় ...
আমি
মরে গেছি। সন্দেহ নেই। আমার সন্তানদের আমি ছিন্নমূল করেছি। তাদের কোনো জন্মভূমি, জন্মস্থান
নেই । জানি। ... তথাপি হে আমার নিজস্ব দেবতা, তোমার কাছে কি নেই তেমন সঙ্গীত যার স্পর্শে
মৃতও প্রাণ পেতে পারে? সাঁতরে পার হয়ে যেতে পারে এই ফলাট-জীবন, এই আইটি যাপন? হে আমার
নিজস্ব দেবতা, সেই বাদলের রাত্রে আমার ঝাঁপানো হয়নি জলে, আমাকে ক্ষমা করো। ... আমাকে
ক্ষমা করো আর ... আর যেহেতু তুমি দেবতা তাই সব ভুলে আরেক বার, আর শুধু একবার গেয়ে
ওঠো সেই গানটি ‘ নাইয়ারে নাওএর বাদাম তুইল্লা
কুন্ দেশে যাও চইল্লা ...’ ... এবারো যদি সাড়া না দিতে পারি তোমার ডাকে তাহলে সত্যই
আমাকে মৃত বলে ঘোষনা করে তুমিও না হয় ফেলে চলে যেও ... কিন্তু তার আগে নয় ...
দেবতা
হে, হে আমার নিজস্ব দেবতা, আমাকে আর একবার সুযোগ দাও ...
১২/১২/২০১১
– ২৮/০৭/২০১৪