"ওগো রুদ্র,দুঃখে সুখে..."
"ওগো রুদ্র,দুঃখে সুখে এই কথাটি বাজল বুকে--
তোমার প্রেমে
আঘাত আছে,নাইকো অবহেলা ॥"
কোট করিলাম। বন্ধু প্রশ্ন করিল "কিভাবে? কিভাবে অবহেলা নাই কিন্তু আঘাত আছে?"
কি দিব উত্তর? কিভাবে দিব? হায়, আমিও কি জানি? বুঝি কি আমিও?
জানিনা। তবুতো পংক্তিগুলি আমিই কোট করিয়াছি। কেন করিয়াছি? ভাবি। হয়তো এই
ভাবনাযাত্রাতেই মিলিবে, অন্ততঃ মিলিতে পারে উতুরের কোনো সূত্র, কোনো ইশারা ...
যে পংক্তিগুলি কোট করিয়াছি তাহাতে "রুদ্র" একটি প্রধান
শব্দ। আমার ভাবনার নিরিখে এই শব্দের অর্থই বা কি? প্রয়োগই বা কিরূপ কেননা বাজারি
অর্থে "এথিস্ট" আমি নহি তবে কালী,দুর্গা,শিব, আল্লা, জেসাস, আত্মা,
অমরতা - ইত্যাদিতে আমি বিশ্বাসী তো নহি বটেই বরং এসব আমার ঘেন্না করে। তবে পিওর
লিটারেচার হিসাবে উপনিষদ হইতে বাইবেল আমি পড়িয়াছি। এন্জয় করিয়াছি। আজো পড়ি। আজো
করি। তবে না'ত বাবু দেবেন্দ্রনাথকে আমার "মহা-ঋষি" বলিয়া মনেহয়, সাহেবসুবোদিগের
মডেলে প্রাচ্চ্যকে হাজির করিবার ধান্দাজাত "ব্রাহ্ম" ধম্মো'কে মনেহয় নিতান্তই
ফাজিলামি। তথাপিও "রুদ্র" শব্দটি আমার মর্মে, হয়, ধ্বনিত, অনুরণিত।
যে ব্রহ্মান্ড, অথবা যে সকল ব্রহ্মান্ড মহাবিস্ফোটজাত অথবা
প্রতিমুহুর্তের মহাবিস্ফোটহেতু যে সকল বাব্ল ব্রহ্মান্ডের জন্ম মুহুর্মুহু,তাহাদের
সকলেরই বিলয়, অন্তিমে কৃষ্ণগহবরে। যেহেতু বাব্ল ইউনিভার্স, মাল্টিভার্স ইত্যাদির হইল
উল্লিখিত সুতরাং ইহা প্রমাণিত, যে, আমার মর্ম ব্রহ্মান্ডের অন্তর্গত ব্রহ্মান্ড কোনো
ঈশ্বরের ইচ্ছাজাত নহে এবং সেইহেতু এই ব্রহ্মান্ড বা ব্রহ্মান্ডসকল এবং তাহাদের
অন্তর্গত প্রানী ও নিষ্প্রাণ জগতের জন্ম-মৃত্যু কিছুই নহে কোনো ঈশ্বরের ইচ্ছাধীন।
তথাপি মহাবিস্ফোট হইতে কৃষ্ণগহ্বরাবধি যে বৃত্ত বা পুনঃপৌনিকতা তাহার স্তরে স্তরে
সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের আখ্যান চিরন্তন। এই মহা আখ্যানের অঙ্গ যেমন জ্বলন্ত
সূর্য্য, মহাসূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, উল্কা, ধূমকেতু তেমনি এমিবা, ভাইরাস,
বেক্টেরিয়াও, আমিও তুমিও, ধূলিকণাগুলিও, ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, পজিট্রনও।মহাবিস্ফোট
হইতে কৃষ্ণগহ্বরাবধি যে বৃত্ত বা পুনঃপৌনিকতা তাহাতে আমি, তুমি সকলেই উপস্থিত
তথাপি এই মহা অনিয়মের নিরিখে আমার বা তোমার সহিত ভেদনাই ভাইরাস,বেক্টেরিয়া,
ধূলিকণারও। তথাপি, দেখো, এই বিশ্ববেনিয়মের অনিশ্বরের হাতে ঝড় উঠে, সেই ঝড়ে
ঝরাপাতার,ধূলির আনন্দযাত্রার সঙ্গে মিলিয়া যায় নীড়ভাঙ্গা পক্ষীমাতার, পক্ষীশিশুর
হাহাকার, এই মুহুর্তে যে ব্রহ্মান্ড বিলীন হইল কৃষ্ণগহ্বরে তাহার হাহাকারের
বিপরীতে সদ্যোজাত বাব্ল ইউনিভার্সের আনন্দরোল, এই মুহুর্তে নানান শ্মশানে,
কবরখানায় নানান ক্রন্দন-বিলাপের পক্ষান্তরে এইমাত্র জন্ম নেওয়া শিশুর আত্মঘোষনার
আহ্লাদ - এই সমস্ত কিছুকে মিলাইয়া যে বিপুল নিরীশ্বর বেনিয়ম, সে'ই
"রুদ্র"। তাহারই আঘাত নামে, আমার তোমার মর্মে, দুঃখে,মৃত্যুতে, বিরহে।
যে আঘাতে ওই নিরীশ্বর রুদ্র জাগ্রত করে আমাকে, তোমাকে সমান আঘাতেই সে জন্মদেয় বাব্ল-ইউনিভার্সের,
জীবন্ত নক্ষত্রকে পরিণত করে কৃষ্ণগহ্বরে। ক্ষুদ্রতম ধূলিকণা হইতে আমি, তুমি হইয়া
বিরাট নক্ষত্র - প্রত্যেকে, প্রতি মুহুর্তে ঐ নিরীশ্বর বেনিয়মের মনোযোগ লাভে ধন্য
হইতেছে। ঐ মহা বেনিয়মের না-ঈশ্বর অবহেলা করিতে জানেন না। - অবহেলা আমাদিগের
উদ্ভাবন, আমাদিগের সম্বল। আমাদিগের - আমরা যাহারা নিতান্ত ক্ষুদ্র আমরাই নিজ নিজ
অহং কে নিজ মর্মে বিস্তার করতঃ ভাবিয়া লই আমি অমুক হইতে শ্রেষ্ঠ, ঘোষনা করি
ব্রহ্মান্ডে "মানুষ"ই শ্রেষ্ঠ, মনুষ্যজন্মই শ্রেষ্ঠতম। - ইত্যাদি।
কিন্তু যে বেনিয়মের না-ঈশ্বর মহাবিস্ফোট হইতে কৃষ্ণগহ্বরের নিয়ন্তা তাহার তূলাদন্ড
নাই। তাই তাহার চলেনা কাহাকেও অবহেলা করিয়া। প্রতি মুহুর্তের আঘাতে সে আমাদের রাখে
জাগ্রত। নির্মাণ করে আমাদের গমনপথ, পরিণতিপথ,মরণপথ। আমরা ভুলি, ভুলিয়া থাকি,
ভুলিয়া বাঁচি বেনিয়মের ওই না-ঈশ্বর কে। কিন্তু সে ভোলেনা। সুতরাং যাপনপথের যে
মুহুর্তে জীবন জাগ্রত করে আমাকে, মুহুর্তের জন্যও, আমি ঐ মুহুর্তটিতে অন্ততঃ,
টেরপাই "তোমার প্রেমে আঘাত আছে নাইক অবহেলা"। কিন্তু বিস্মৃতও হই,
যেহেতু ক্ষুদ্র, পর মুহুর্তেই। তখনই আসে অহং, অহংকার। তখনি অপরের প্রতি অবহেলায়
পুষ্ট হয় এই অহং। হায়, তথাপিও মহাবেনিয়মের মহা না-ঈশ্বর আমাকে করেনা অবহেলা।
ভোলেনা আমাকে...
[ রচনাটি "বদন বহি" তে দিয়াছিলাম। পাঠান্তে দেবলদা, ডঃ দেবল দেব ( https://debaldebspeaks.blogspot.com/), যিনি
একাধারে বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী ও কবি, তাঁহার এই মন্তব্যটি, যাহা একটি স্বয়ংসম্পুর্ণ
রচনাও বটে, উপহার পাওয়া গেলো। এই স্বয়ংসম্পুর্ণ রচনাটিকেও তাই রাখিলাম সংগ্রহে।
সপ্তর্ষি, আহা, কী অপূর্ব
রচনা উপহার দিলেন এই সকালে! মানুষ-মানুষীর প্রেম পুরাতন হলে একদিন অবহেলা আসে -
"সেই পুরাতন প্রেম য়দি এককালে হয়ে পড়ে দুরস্মৃত কাহিনী কেবলি"। কিন্তু হে
রুদ্র, তোমার চিরকালীন প্রেমে কখনো অবহেলা নেই, যদিও আঘাত দিয়ে যাও বার বার। সেই আঘাত
পেলেই আমি বুঝি, আমার প্রতি তোমার নিরন্তর মনোযোগ। সারাজীবন, সকাল-সন্ধ্যা, তোমায় আমায়
এই খেলা চলছে। এ খেলা তো মধুর নয়।.... এই রকম কবিতা রবি ঠাকুর ছাড়া আর কে সৃজন করবেন?
কবিতাটির অত্যন্ত বিশ্বস্ত
ব্যাখ্যা আপনি উপহার দিয়েছেন, কিন্তু তাতে যখন আপনার "বেনিয়মের না-ঈশ্বর রুদ্র"-র
মহাকল্পনা যোগ হয়, তখন সেটা আরেকটা নতুন কাব্য সৃষ্টি করে। রবি ঠাকুরের হাত ধরে পাঠক
বিজ্ঞান আর মানুষী প্রেমের মিলনভূমিতে দাঁড়াতে পারে, রবি ঠাকুরের কবিতাকে 'সম্ভ্রান্ত
শিক্ষিত বাঙালীর বিয়ে-বাড়িতে বাজানোর গান'-এর পরিচয় ছাড়িয়ে অন্য কিছু বুঝতে পারে, তাকে
সম্ভ্রম করবার যোগ্যতা অর্জন করে।
আর ভাবতে ইচ্ছে করে,
আপনার এই নিরীশ্বর রুদ্রর বর্ণনার পশ্চাতে আমার নিজের কোনও রচনার কোনও পংক্তি হয়ত দাঁড়িয়ে
আছে। "এই মহা আখ্যানের অঙ্গ যেমন জ্বলন্ত সূর্য্য, মহাসূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, উল্কা,
ধূমকেতু তেমনি এমিবা, ভাইরাস, বেক্টেরিয়াও, আমিও তুমিও, ধূলিকণাগুলিও, ইলেকট্রন, প্রোটন,
নিউট্রন, পজিট্রনও। মহাবিস্ফোট হইতে কৃষ্ণগহ্বরাবধি যে বৃত্ত বা পুনঃপৌনিকতা তাহাতে
আমি, তুমি সকলেই উপস্থিত তথাপি এই মহা অনিয়মের নিরিখে আমার বা তোমার সহিত ভেদ নাই ভাইরাস,বেক্টেরিয়া,
ধূলিকণারও।" এটা পড়েই বলতে ইচ্ছে করল - "তোমার তুমিও আমি।" ]
নয় এ মধুর খেলা--
তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল-সন্ধ্যাবেলা নয় এ মধুর খেলা ॥
কতবার যে নিবল বাতি, গর্জে এল ঝড়ের রাতি--
সংসারের এই দোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা ॥
বারে বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে।
দারুণ দিনে দিকে দিকে কান্না উঠেছে।
ওগো রুদ্র, দুঃখে সুখে এই কথাটি বাজল বুকে--
তোমার প্রেমে আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা ॥
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৩ আশ্বিন, ১৯২০
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯১৩
রচনাস্থান: লোহিত সাগর
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
সূত্রঃ http://tagoreweb.in