প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Wednesday, October 16, 2024

বুনো-লতা । ২।

বুনো-লতা

২।

“জগৎ পারাবারের তীরে” যারা’ই, যে কর্মেই রত, আদতে সে সকলই “খেলা”। ওই খেলার মত্ত সক্কলেই “শিশু”। – এই সহজ কথাটি কি টের পান নি রবীন্দ্রনাথ? তাহলে কেন লিখলেনঃ “ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে,/ বণিক ধায় তরণী বেয়ে, / ছেলেরা নুড়ি কুড়ায়ে পেয়ে/   সাজায় বসি ঢেলা।” – অর্থাৎ, কেন তিনি বণিক কে, বাণিজ্যকে আলাদা করে দিলেন আর সবার থেকে? শিশুর থেকে? করলেন, বা করতে বাধ্য হলেন ওই হেতুই, যে হেতু যিশুকে বলতে হয়েছিল, যে, সূঁচের ফুটো গ’লে উট যদিবা চলে যেতে পারে, ধনী কদাপি পারবেনা স্বর্গ-দোর, তা দসে যতো বিরাট-বিশালই হোক, তা দিয়ে ঢুকতে। ওই যে লোকটি বসে গলা সাধছে আর ভাবছে সংগীত গেয়ে সে অমর হয়ে থাকবে, এই যে ধেড়ে ইন্দ্রটি পদ্যের দ্বি-পদ, ত্রিপদ, চতুস্পদ লিখে লিখে, লোককে পড়িয়ে পড়িয়ে উন্মাদ হয়ে গেলো এতাবৎ তাকে রবি ঠাকুরের চেয়ে উচ্চতর আসন বাঙালী দিলোনা বলে – ইত্যাদি, এরা শিশু। শিশু হরিহর রায়, সর্বজয়া, দুর্গা, অপু, ফাদার সিয়ের্গি, প্রিন্স মিশকিন, আনা কারেনিনা, মাদাম বোভারি’রা। এরা নিজ দৈনন্দিনে এমনই নিমজ্জিত, যে, তারা ভুলে যায়, যে, তাদের এই সকল দৈনন্দিন, এই সকল অমরতা-লোভের উর্ধেঃ “ ঝঞ্ঝা ফিরে গগনতলে,/ তরণী ডুবে সুদূর জলে,/মরণ-দূত উড়িয়া চলে” – তবু খেলে চলে তারা। খেলেই চলে। – এদের সঙ্গে যদি সাম্রাজ্যবাদী লোভ, পুঁজি তান্ত্রিক পণ্যায়ণের মূল্যে মুনাফা – ইত্যাদির খেলায় যারা মত্ত, তাদেরকে মিলিয়ে ফেলি, গুলিয়ে ফেলি “শিশু” বলে, তাহলে যে মস্ত ভুলটি হবে, তারই প্রতিপক্ষে “ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে,/বণিক ধায় তরণী বেয়ে” র অন্তর্গত লোভের কথাটি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন রবিকবি।

এই মুহুর্তে আমি যে চার-পাঁচটি লেংটা শিশুর কথা বলছি তাদের আবহে পারাবার নেই। আছে একটি মড়া খাল, যার মুখ, নদীর দিকে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বাঁধ দিয়ে। ফলে সে আর বহতা নয়। তার সারা গা’য়ে কচুরিপানার সাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পোকামাকড়,সাপ-সাপালি। মড়া-খালের পাড়ে এক সাড় শেওড়াবৃক্ষ। কয়েকটি সুপারী গাছ। টিন-চাল, টিন-দেওয়ালের খোপ। আরেক ধারে পিচ-সড়ক। তারা লেংটা খেলে বেড়ায়, দৌড়ে বেড়ায়। কান্দে, হাসে। বড় হয়। কিন্তু বেড়ে ওঠেনা। মাঝখানে সিমেন্ট-দেওয়াল। এই পাড়ে আমাদের বা। বাসা। বাড়ি। দেওয়ালের কিনারে দাঁড়িয়ে আমি যখন ওই শিশুদের নাম, তাদের কার ক’টা দাঁত উঠলো-পড়লো – এই সকল নিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করছি, যখন এক্কেবারে ছোটোটি, বড়দের মতোই এই দেওয়াল-ভাঙা আসরে যোগ দিতে এসে হোঁচট খেয়েও, না কেঁদে হাসছে, তখন, বেলা এগারোটা নাগাদ, ওই মেয়েটি, ওই বুনোলতা, আবার এসেছে “ফুনে চাজ” দিতে। আগে অবশ্য আমার অনুমতি সে নিয়েছে। অনুমতি ছাড়া আমাদের মতো বিরাট ভদ্রলোকের বাড়ির গেট ওরা পার হয়না। কিন্তু ওরাও আমাদের ঠিক ততোটাই প্রতিবেশী, যতোটা, আর পাশের “কয়লাবাবু”। যিনি সবংশে বকলম, যিনি কয়লার কারবারে হাত কালো না করেই কালো টাকার পর্বত গড়েছেন। তিনি বা তাঁর গুষ্টি অবশ্য অবলীলায় ঢুকেপড়ে। হাঁকডাক দিলে আলাপ সালাপও চালায়। 

বুনোলতা যখন তার “স্মাট-ফুন” চাজে লাগাচ্ছে তখন তাকে নিয়ে জেরা করছে যে, সে, আমার মা’কে দেখে রাখার, দিনরাত্রি থাকা, মাঝ বয়সী মহিলা। শিশুগুলির সঙ্গে সামান্য আড্ডা দিয়ে আমি বাইর-কোঠায় ফেরার নিমিত্ত ঘুরে দাঁড়াতেই, সেই শিশু দলের যেটি সবচে’ বড়, যার বয়স বড়জোর আট, সে ডাকলো, তার ডাকে “চুপি চুপি” মেশানো। আমিও নুয়ে কান দিলাম বাড়িয়ে। সে ফিসফিসিয়ে বল্লঃ “ক্কাকু, যে বেটি তুমরার ঘর-অ গেসে ফুন চাজ দেওয়াত, ইগু কিন্তু চুর”। হায়, চোর, হায় চুরি। হায় “না বলিয়া পরের দ্রব্য …”। বুনোলতা এই বালকের কাকি অথবা জেঠি। দুইটি ছোকরা ভাই, তাদের দুইটি বৌ – পাশাপাশি টিনিখোপে বাস করে। বালক কে নিশ্চিত তার মা’ই বলেছে, যে, বুনোলতা চোর। এবার বুনোলতাও, কালে, তার বাচ্চাকে শেখাবে, তার জা’টি, যে’ও, হয় আরো একটি বুনোলতাই, সে “চোর”। “চোর” শব্দের সংজ্ঞা এখানে, হরিহর-পত্নী সর্বজয়ার, হরিহরের দিদি, বুড়ি ইন্দির ঠাকরুন কে “চোর” বলার একই নিয়মের অধীন। অর্থাৎ দুই-পলা শর্ষের তেল, দেড়টি কাঁচা লংকা থেকে বড়জোর ইমিটেশনের শস্তা মালা’র এদিক-ওদিক। আমি বালককে বললাম, ফিস্ফিস করেই “আচ্ছা, আমি পুলিশো জানাইয়া রাখমু”। 

বাইর-কোঠায় ঢুকে আবার বসেছি লিখতে, এইবার আগমন মা’র সেই আধবুড়ি আয়া-জনের। “দাদা, আপনি বোধয় জানেন না, তাই বলছি, ওই ওকে যে বাড়ি ঢুকতে দিয়েছেন, ওর চরিত্র-স্বভাব খুব খারাপ”।

স্থির দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম “ পেটে খাওয়া না থাকলে তো স্বভাব-চরিত্র ধুয়ে বাঁচা যায়না। ওদের দেড়বেলা খাওয়া মেলেনা। তাই স্বভাব-চরিত্র বা যা খুশি’র মূল্যে ওরা খেতে পেলেই আমি খুশি। ওর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই”।

একটু দমে গেলেও মহিলা থাবলো না। “আরে জানইন নি, ও মুসলিমের সঙ্গে যায়” …।

আবার স্থির চোখে তাকাতে হলো। “শোনো, ও হিন্দুর সাথে গেলে যা, মুসলমানের সঙ্গে গেলেও তা’ই। হিন্দু-মুসলমানে আমার কিচ্ছু আসে যায়না। পেটের আর ক্ষুধার ও কিছু আসে যায়না”। 

মহিলা এবার ক্ষান্ত হলো তবে বল্লো “ওই দাদা ঘরে থাকলে এরা আসবার সাহস পায় না”।

অর্থাৎ, আমার ছোটোভাই, যে এই মুহুর্তে, মাদ্রাজে অবস্থান করছে, থাকবে কয়েকদিন সপরিবারে, সে। অর্থাৎ রূপক থাকলে এরা এতোটা সাহস পেতোনা। কিজানি। হয়তো আমিও যদি এখানেই থাকতাম, হয়তো আমাকেও ওরা ভয় পেতো। হয়তো আমার মধ্যেও ওই ভয় দেখানো ভদ্রলোকি ডালপালা মেলতো। এবং মেলাটাই স্বাভাবিক যদিনা আমরা সক্রিয় ভাবে ওই ভদ্রলোকি’র বিষ-চারাটিকে মুড়িয়ে না ফেলি, প্রতি মুহুর্তে। কিজানি। হয়তো ডাবলিনে বাস করলে জয়েস না লিখতেন ডাবলিনার্স, না ইউলিসিস। গতকাল সকালেই, লঙ্গাই বাজার গিয়ে মা’র জন্য মাছ কিনেছিলাম। হেঁটেই গেছি। ফেরাও যেতো হেঁটেই। তা’ও ফাঁকা অটোরিক্সা দেখে, উঠে পড়লাম। বসলাম অটোচালকের কিনার-সিটে। বসতে না বসতেই  অটো চালক গল্প আরম্ভ করে দিল। বল্লো, চৈত্র থেকে আশ্বিন গেলো মেঘে আর জলে। এখন কয়দিন রউদের মুখ না দেখলে সব যাবে। জানালো এই চৈত্র থেকে আশ্বিনের মেঘের নিমিত্ত 

কি কি রকমের ধান ভাল হবে, কিকি রকমের ধান হবেনা বা পরিমাণে কম হবে। সব জানালো। হায়, আমি, একদা এই শহরে জন্মে, বড় হয়ে, পরে সিলিকন-সিটি’র বাসিন্দা, আমি, “ চৈত্র”, “আশ্বিন”, “মেঘ”, “পানি”  শব্দগুলিতে  আকুল হলাম। কিন্তু  ধানের নাম ১টাও বুঝতেই পারিনি। পারিনি, যারা এই শহরে বাস করে, তারাও কি পারে? পারতো? – না। ধান, চালের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছেদ বহু আগেই পূর্ণ হয়েছে। “অন্ধ বিক্রেতার থেকে ধূপ কেনার সুযোগ নষ্ট হয়েছে”। 

               দিনে রান্না করতে যিনি আসেন দীপালীদি, তাকে মাছ ইত্যাদি দিয়ে বাইর-উঠানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানলাম। এরপরে ভিতরমুখো হ’তেই দেখি দীপালিদি আমার মা’র সঙ্গে কি এক শলাপরামর্শে নিমগ্ন। কান পাতলে বোঝা গেলো, মাছ ঠিক যতো টুকরো মা খাবে, ঠিক ততো টুকরোই সে রাঁধবে নাহলে। “বুঝরা অইত …”। বুঝলাম। – বুঝলাম মাছ-টুকরো বেঁচে গেলে তা পেটে যাবে মা’র এই আয়া-জনের এবং তা দীপালিদির ইচ্ছা নয়। বুঝলাম এবং আবার এসে দাঁড়াতে হলো শূন্যে। একদিকে “আদর্শ হিন্দু হোটেল”, অন্যদিকে “হুনান রিপোর্ট”। 

এই আয়া-জনকে দেখেছি, দুপুরের পরে দুপুর একটি পুরনো শাড়ি, যা কখনো “দামী” ছিল, তার আঁচল কিংবা পাড় – সেলাই করছে। তার নিজের অন্নবস্ত্রের সংস্থান অপরের ঘরকাজ করে। ওই বুনোলতা’র মতো তার নিজের মেয়ে বা বোন রয়েছে নিশ্চয়। তথাপি, যেহেতু সে “ব্রাহ্মণ” এবং যেহেতু সে “অনেক আগের থেকেই ভদ্রলোক”, ফলে, সে নিজেকে, নিজ মনেই, বুনোলতা’র চেয়ে উপরে একটি অবস্থান দিয়ে ফেলেছে। বামনি বলে সে “উচ্চ” দীপালিদইর চেয়েও। এবং দীপালিদি, আমার ভাই’র বিয়ের পরপর, আমার ভাতৃবধূকে বলেছিল “এরা বুধয় ভালা বাবন না”। একে ঝুমা তখন নতুন বৌ, তা’য় শ্বশুরবাড়ির “ব্রাহ্মনত্ব” নিয়ে প্রশ্ন। অতএব, ঝুমা দীপালিদিকে প্রশ্ন করল, কেন এমন মনেহয় তার, প্রকৃত প্রস্তাবে, তার শ্বশুরবাড়ি মস্ত বড় ব্রাহ্মণ। দীপালিদির উত্তর “তারা আমার হাতের রান্না খান, তাই বললাম”। – অর্থাৎ বঞ্চিত হ’তে হ’তে, হ’তে হ’তে এরা নিজেদেরকে নিজেরাই পারছেনা আর সম্মান করতে। মূল্য দিতে। শুধু বুনোলতা নয়, দীপালিদি বা ওই আয়া-জন এরা প্রত্যেকেই সেই কুন্তা। এরা পরস্পরকে ঘিরে দাঁড়ালেই দানা বাঁধবে, বাঁধতে পারে, আদত প্রতিরোধ। আদত মহিষাসুর সেটি টের পেয়েই, বহু আগেই এনে দিয়েছিল জাতপাত। উপনিবেশ-ওয়ালারা একে করেছিল অস্ত্র। অতঃপর সরাসরি উপনিবেশ থেকে যখন দেশগুলি “স্বাধীনতা”র পাজামা-পাঞ্জাবী-পতাকা’তে হলো পরোক্ষ উপনিবেশ, তখন, এই জাতপাতকেই ব্যবকার করলো “স্বদেশ” এর “স্বাধীন” নেতা ও তাদের দলগুলি।

এক টুকরো মাছের লোভ, ওই আয়া-জনের, আমার মর্মে এনেদেয় ইন্দির ঠাকরুনের নোনা ফলের লোভের বৃত্তান্ত, তার নাজেহাল হওয়া ভ্রাতৃবধূ সর্বজয়ার কাছে। আবার পরবর্তীতে এই সর্বজয়াকেই দেখি, বড়লোক বাড়িতে কাজ কত্রবার আমলে, ক্ষণে ক্ষণে লোভী হ’তে, নিজের জন্য নাহোক, অপুর জন্য। বুনোলতা’র এই মোবাইল-লোভ, চার্জ-দেওয়া লোভ, এ কি নয়, দুর্গার পুঁতিমালা লোভ? ফোনে কে তাকে দেবে কোন মহার্ঘ্য সম্বাদ? বাস্তবে মোবাইলটি ঘেঁটে, গান, রিল্‌ চালিয়ে, সে নিজেকে ভেবে নেবে “সুখী” বলে, তার আশেপাশের ভদ্রলোক মেয়ে-বৌ’দের মতো বলে। এর মূল্যে সে ভুলে থাকবে তার সমূহ না পাওয়া। এতাবৎ। তার সমূহ না পাওয়া – আমরণ।


 – এই সকল “লোভ” আদতে লোভ নয়। এই সকলই প্রকাশ, জিজীবিষার। অথবা এরাই জিজীবিষা। এটি শনাক্ত করতে না পারলে, অন্তিমে, সব প্রতিরোধ, সব আন্দোলনই ভেঙ্গে যাবে। “আমার মাথা নত করে দাও” – কার কাছে? ঈশ্বর? অনন্ত? শালা, কে ঈশ্বর আর কি অনন্ত? মাথা নত করে দাও ওই সকল জিজীবিষার কাছে। জীবনের কাছে। যাপনের অন্তর্গত দুঃখের কাছে। অন্যথায়, হায়, ফিরে যেতে হয় সেই রবিকবির কাছেইঃ

“যখন তোমায় প্রণাম করি আমি,    প্রণাম আমার কোন্‌খানে যায় থামি,

      তোমার চরণ যেথায় নামে অপমানের তলে

          সেথায় আমার প্রণাম নামে না যে

      সবার পিছে, সবার নীচে, সব-হারাদের মাঝে॥”












বুনো-লতা (১)

 বুনো-লতা

১।

ভাসান। কখনো আনন্দের ছিল, ছিল দুঃখের। ছিল দেবী প্রতিমার চোখে অশ্রুকে চিহ্নিত করবার। তারপর, ভাসানও ভেসে গেলো নিও-লিবারেলি বানে। ভাসানের আনন্দ-বেদনা, দেবীর আগমন-গমনের যাদু-কাহনের মতোই, মুছে গিয়ে, অবয়ব নিয়েছে এক “মস্তি”। এই “মস্তি” এক চীজ বটে। “মস্ত্‌ মস্ত্‌”। শরৎ, শিশির, ঘাস – সমস্তের উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া এক বুলডোজার। সব ভেঙ্গে, নিঙড়ে বানিয়ে তোলা একেকটি বাজার। একেকটি মোচ্ছব।

ঘড়ি-কাঁটা রাত দশটার ফলক পার হয়ে ক্রমে পৌঁছে যাচ্ছে সাড়ে দশে। এই শহর, এর শরিলে-গা’য়েও খোলা-বাজারের দাঁত-নখ দাগ। ক্ষতও হচ্ছে। তবু, কোথাও গিয়ে আর এগোচ্ছেনা। ফলে, এ এখনো অনেকটাই মফস্বল। আর আমাদের পাড়া, যেহেতু এই গঞ্জেরও প্রান্তে, ফলে, এক ঝলক অতীত-আলো, এক-পশলা পরাহত অন্ধকার, এখনো মিশে আছে এ পাড়ায়। সাড়ে দশ মানে, এ পাড়ায় অনেক রাত। রাত ছিঁড়ে, ছোটো ছোটো টুকরো করে, চলে ফিরে আসছে একটি দু’টি ভাসান-দল। মস্তি-ভাসানের মস্ত্‌ খোঁয়াড়ি কিছু ছড়িয়ে, কিছু সঙ্গে করে যাচ্ছে তারা। বাইর-কোঠায় আড্ডা দিচ্ছি আমি আর সিদ্ধার্থ। বাইর-কোঠা বলতে বাইর-বারিন্দা থেকে আলগা একটা কোঠা। আদতে রূপক এই কোঠায় বসে ছাত্রী-ছাত্র পড়ায়। ইস্কুল-কাজ করে। রাস্তার ঠিক কিনারে বলে, রাস্তা ধরে বড় গাড়ি গেলেও আওয়াজ হয় গেটে। মনেহয় কেই এলো। এমনি একটা আওয়াজ উঠলো গেটে। আমাদের আড্ডারত মন সেদিকে গেলোনা। কারন, আমরা জানি এই আওয়াজ ফাঁকি আওয়াজ, ফাঁকা আওয়াজ। এতো রাতে কে আসবে? আড্ডা চল্লো। কিন্তু এবার ঘষটানো পা-আওয়াজ। অতএব ধ্বনি এখন আর অশরীরী নয়। এবং সত্যই, তখনই, শরীর, আবির্ভূত, বাইর-কোঠার খোলা দরজার সামনে, যুবতীর। শিউরে উঠলাম। কে এই মেয়ে? একবার মনে হলো বিসর্জিতা কোনো প্রতিমা না’তো? উঠে এসেছে, সদ্য, কোনো নদী থেকে, খাল থেকে, বিরাট পুকুইর-পুষ্করিনী থেকে? জানাতে এসেছে, কিভাবে ভাসান তার বর্ন-ঘ্রান-অশ্রু-আকুতি হারিয়ে নিতান্ত মস্তি হয়ে গিয়ে, দেবীকে, দেবী দিগকে আবডালে করছে প্রহারই? – পর মুহুর্তে মনে হলো, সদ্য ভাসানের দেবী’র আশাক-পোষাক এমন অনুজ্জ্বল হয় কি করে?  গা’য়ের নাইটি – কখনো উজ্জ্বল হলুদ ছিল। এই মুহুর্তে পিচরাস্তা-কিনারের ধূলির মতন। “ চোখ দুটো চুন-চুন ,- মুখ খড়ি-খড়ি!” – তাহলে এ কী গতবছরের কুশিয়ারা-জল লেগে থাকা, বিগত বছরের কোনো প্রতিমা? “সমসাময়িক হতে শেখে নাই”? তা’ই এসেছে জানাতে?

এইবার দেবীর আঙ্গুল … “দুটো হাত, ক’খানা আঙুল”… একটি হাত উঠে এলো ডাক দেওয়ার ভঙ্গিতে। আবার শিউওরে ওঠা। কে এ? কি চায় এ? এ’কি নিশিডাক? না’কি বিশ্ব চক্র সিরিজের বিকেল ছ’টার শো থেকে উঠে আসা কোনো দুরাত্মার ছল? যেই এগিয়ে যাব, বার হয়ে আসবো বাইর-কোঠা থেকে, অমনি নিজের জামা নিজে ছিঁড়ে চিল্লিয়ে উঠবে “বাঁচাও … বাচাও” আর তার সাঁটের ছোকরাগুলি ঘিরে ফেলে বলবে “ এমনে ত ভদ্রলুক আর পথে দিয়া মাইয়া গেলে টানিয়া ঘরো লইযাইন, দে হারামজাদা লাখ টাকা দে, নাহলে …” … পা তবু, মন্থরে হলেও, এগোলো। আমি, সিদ্ধার্থ – চার পায়ে এগোলে মেয়েটি টের পেলো কিছু। এটা অন্তত টের পেলো, যে, এই যে “আমি” আমার মতো দেখতে হলেও, আমার ভাই’এর মতোও দেখতে। অর্থাৎ আমি যে মেয়েটিকে চিনতে পারছিনা, তা’ই, হয় স্বাভাবিক। এইবার সামান্য হাসি উঠে এলো মুখে। “আমি আফনারার কিনারের বাসাত থাকি”। হাত দিয়ে দেখালো পার্শ্ববর্তী জমাট অন্ধকার। এখানে একটি দু’টি টিন-চাল আর বাঁশ-বেড়ার ঘর। আগেছিল ছন-চাল আর বাঁশ-বেড়া। গোঁসাইদের জমি। আমরা বলতাম জমিদারি। বুড়া গোঁসাই’এর কয়েক লক্ষ ছানাপোনা ছিল। এই টুকরো জমিতে, বুড়া টপকালে, সব্বাই জানালো দাবী। অতএব জমি হলোনা কারোরই। কয়েক লক্ষ ছানাপোনার যেটি এখানে বাস করে, এই আমাদের বাড়িরই উল্টো গলীতে, সে’ও এখন সত্তর। এর বাপ-আমল থেকেই এখানে ছোটো ঘর বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হতো। রিক্সা চালক, ঠেলাগাড়ি চালক বা ওই কিসিমেরই শ্রম যাদের জীবিকা, তাদেরকে। এতে যেটা হতো, তা এই, যে, এদের বৌ গুলি বেগার খেটে দিতো গৌঁসাইজীর গিরস্থিতে। “সেই ট্রেডিশান” এখন টিন-চাল আর বাঁশ-বেড়া আর একদা “হুক” মারা কারেন্টের বদলে, বাধ্য হয়ে, “আসলি” কারেন্ট। ব্যস। – এই যে দেবী, অধুনা দন্ডায়মানা, আমাদের মুখামুখি, যার আবহে অন্ধকার, সে ওই গোঁসাই-প্রজাদের কারো বৌ-মেয়ে । বোঝা গেলো।  “এট্টু, দুই মিনিট চাজ দিতে পারমু নি”? তার হাতে একটি ভগ্নদশা “স্মাটফুন”। “আমরার কারেন্ট নাই”। হায়, দেবী, হায় মানুষ, হায় সভ্যতা! দু’টি আলোকিত, কারেন্টিত বাড়ির মাঝখানে এই একফালি অন্ধকার, গাড়, কঠিন, জটিল। হায়, যেখানে দেবীর, দেবীদের ঘরে ঘরে অন্ধকার, সেখানে মন্ডপ আলো করে কাকে আনো তোমরা? মেয়েটির চোখে ভিতুভিতু জিজ্ঞাসা। মুহুর্তে টের পেলাম “

খুব জ্যোৎস্না, তেমনি হাড়কাঁপানো শীত। পৌষ মাসের শেষ। সদর কাছারি হইতে লবটুলিয়ার ডিহি কাছারিতে তদারক করিতে গিয়াছি। লবটুলিয়ার কাছারিতে রাত্রে রান্না শেষ হইয়া সকলের আহারাদি হইতে রাত এগারটা বাজিয়া যাইত। একদিন খাওয়া শেষ করিয়া রান্নাঘর হইতে বাহিরে আসিয়া দেখি, তত রাত্রে আর সেই কন্‌কনে হিমবর্ষী আকাশের তলায় কে একটি মেয়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় কাছারির কম্পাউন্ডের সীমানায় দাঁড়াইয়া আছে। পাটোয়ারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম-ওখানে কে দাঁড়িয়ে?

পাটোয়ারী বলিল-ও কুন্তা। আপনার আসবার কথা শুনে আমায় কাল বলছিল-ম্যানেজারবাবু আসবেন, তাঁর পাতের ভাত আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। আমার ছেলেপুলের বড় কষ্ট। তাই বলেছিলাম-যাস্।

কথা বলিতেছি, এমন সময় কাছারির টহলদার বলোয়া আমার পাতের ডালমাখা ভাত, ভাঙ্গা মাছের টুকরা, পাতের গোড়ায় ফেলা তরকারি ও ভাত, দুধের বাটির ভুক্তাবশিষ্ট দুধভাত-সব লইয়া গিয়া মেয়েটির আনীত একটা পেতলের কানাউঁচু থালায় ঢালিয়া দিল। মেয়েটি চলিয়া গেল।

আট-দশ দিন সেবার লবটুলিয়ার কাছারিতে ছিলাম, প্রতিরাত্রে দেখিতাম ইঁদারার পাড়ে সেই মেয়েটি আমার পাতের ভাতের জন্য সেই গভীর রাত্রে আর সেই ভয়ানক শীতের মধ্যে বাহিরে শুধু আঁচল গায়ে দিয়া দাঁড়াইয়া আছে। প্রতিদিন দেখিতে দেখিতে একদিন কৌতূহলবশে পাটোয়ারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম-কুন্তা-যে রোজ ভাত নিয়ে যায়, ও কে, আর এই জঙ্গলে থাকেই বা কোথায়? দিনে তো কখনো দেখি নে ওকে?

পাটোয়ারী বলিল-বলছি হুজুর।

ঘরের মধ্যে সন্ধ্যা হইতে কাঠের গুঁড়ি জ্বালাইয়া গন্‌গনে আগুন করা হইয়াছে-তারই ধারে চেয়ার পাতিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া বসিয়া কিস্তির আদায়ী হিসাব মিলাইতেছিলাম। আহারাদি শেষ করিয়া আসিয়া মনে হইল একদিনের পক্ষে কাজ যথেষ্টই করিয়াছি। কাগজপত্র গুটাইয়া পাটোয়ারীর গল্প শুনিতে প্রস্তুত হইলাম।

-শুনুন হুজুর। বছর দশেক আগে এ অঞ্চলে দেবী সিং রাজপুতের বড় রবরবা ছিল। তার ভয়ে যত গাঙ্গোতা আর চাষী ও চরির প্রজা জুজু হয়ে থাকত। দেবী সিং-এর ব্যবসা ছিল খুব চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়া এইসব লোককে-আর তারপর লাঠিবাজি করে সুদ আসল টাকা আদায় করা। তার তাঁবে আট-ন’জন লাঠিয়াল পাইকই ছিল। এখন যেমন রাসবিহারী সিং রাজপুত এ-অঞ্চলের মহাজন, তখন ছিল দেবী সিং।

দেবী সিং জৌনপুর জেলা থেকে এসে পূর্ণিয়ায় বাস করে। তারপর টাকা ধার দিয়ে জোর-জবরদস্তি করে এ দেশের যত ভীতু গাঙ্গোতা প্রজাদের হাতের মুঠোয় পুরে ফেললে। এখানে আসবার বছর কয়েক পরে সে কাশী যায় এবং সেখানে এক বাইজীর বাড়ি গান শুনতে গিয়ে তার চৌদ্দ-পনের বছরের মেয়ের সঙ্গে দেবী সিং-এর খুব ভাব হয়। তারপর তাকে নিয়ে দেবী সিং পালিয়ে এখানে আসে। দেবী সিং-এর বয়স সাতাশ-আটাশ হবে। এখানে এসে দেবী সিং তাকে বিয়ে করে। কিন্তু বাইজীর মেয়ে বলে সবাই যখন জেনে ফেললে, তখন দেবী সিং-এর নিজের জাতভাই রাজপুতরা ওর সঙ্গে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে ওকে একঘরে করলে। পয়সার জোরে দেবী সিং সে সব গ্রাহ্য করত না। তারপর বাবুগিরি আর অযথা ব্যয় করে এবং এই রাসবিহারী সিং-এর সঙ্গে মকদ্দমা করতে গিয়ে দেবী সিং সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। আজ বছর চারেক হোলো সে মারা গিয়েছে।

ঐ কুন্তাই দেবী সিং রাজপুতের সেই বিধবা স্ত্রী। এক সময়ে ও লবটুলিয়া থেকে কিংখাবের ঝালর-দেওয়া পালকি চেপে কুশী ও কলবলিয়ার সঙ্গমে স্নান করতে যেত, বিকানীর মিছরি খেয়ে জল খেত-আজ ওর ওই দুর্দশা! আরো মুশকিল এই যে বাইজীর মেয়ে সবাই জানে বলে ওর এখানে জাত নেই, তা কি ওর স্বামীর আত্মীয়-বন্ধু রাজপুতদের মধ্যে, কি দেশওয়ালী গাঙ্গোতাদের মধ্যে। ক্ষেত থেকে গম কাটা হয়ে গেলে যে গমের গুঁড়ো শীষ পড়ে থাকে, তাই টুকরি করে ক্ষেতে ক্ষেতে বেড়িয়ে কুড়িয়ে এনে বছরে দু-এক মাস ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আধপেটা খাইয়ে রাখে। কিন্তু কখনো হাত পেতে ভিক্ষে করতে ওকে দেখি নি হুজুর। আপনি এসেছেন জমিদারের ম্যানেজার, রাজার সমান, আপনার এখানে প্রসাদ পেলে ওর তাতে অপমান নেই।”

হায়, বিভূতিভূষণ, এই “আরণ্যক”, শুধু “আরণ্যক” ই কেন, আপনার সমস্ত কাহন-কাহিনী আর মাও সে তুঙ্গের “হুনান রিপোর্ট” – এদের মাঝখানে আজো আমি দিশাহারা। আমি মার্ক্সের কাছে গেছি অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক ভাবে। হে কার্ল মার্ক্স, বিদূতিভূষণ আমাকে ঠেলে দিয়েছেন আপনার দিকে। আপনার সেই কম বয়সের নোটবই গুলির দিকে। আমার বিদ্রোহ-বিপ্লব অন্তিমে ভালবাসা। ভালবাসাই। হে বিভূতি, হে কার্ল মার্ক্স, আমি বুঝিনা, আমি বুঝিনি – এতো বচ্ছর ধরে যারা বিভূতি পড়ে আসছে, পড়িয়ে আসছে, বই লিখে বাজার দোকান ছেয়ে ফেলেছে, তারা কেন চিনতে পারেনি, আজো পারেনা এই সকল কুন্তা’দের? দুর্গা দের? আর যারা চিনতে পায়, যেমন আমি, আমিই বা ঠিক কোন ভাবে কাজে লাগছি সেই প্রক্রিয়াতে, যার দ্বারা সকল কুন্তা’ই একদিন হ’তে পারে, পারবে, সিংহবাহিনী?

শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। তাই তিনদিন ধরে কারেন্ট নেই ওদের। সাড়ে সাত গন্ডা’র ওই জমিদার, ওই গু-সাই, করেনি কোনো ব্যবস্থা। অতএব, শেষ পর্যন্ত এই কুন্তা, হরিহর রায়ের মেয়ে, এই দুর্গা, সাহস করে পার হয়েছে আমাদের বাড়ির গেট। কাঁপা হাতে ফোনটি বাড়িয়ে ধরে, আরো কাঁপা স্বরে বলছে  “এট্টু, দুই মিনিট চাজ দিতে পারমু নি”? 

আমি বললাম “যা, চার্জে দে। দু মিনিট কেন? দুই ঘন্টা হলেও বা কি?”

এর নাম, আমি নিশ্চিত, বুনো-লতা। 

বন্য লতা’ই সে। বন্য লতা’ই এরা।

এ’ই দেবী। এরাই দেবী।


ঘুম ঘর