প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Tuesday, September 2, 2025

যে আখ্যানটি গুম্‌ হয়ে গেছে

 যে আখ্যানটি গুম্‌ হয়ে গেছে

সপ্তর্ষি বিশ্বাস


১।

নিজস্ব প্রতিমা, প্রতীক বদলে যায়। বদলে বদলে যায়।

অর্থ হয় মনের “কোয়ালিটি” বদলে যায়। বদলে বদলে যায়। আর তা যায় তখনই যখন সময় নিতান্ত মৃত “কোয়ান্টিটি” নয়, জীবিত অনুঘটক। 

সে অনেক কাল আগের কথা। প্রায় আরেক জন্মের – যখন লিখিত হয়েছিল এই  পংক্তিগুলিঃ

“বেহুলা তোমার বিপন্ন মান্দাসে ভেসে যায় কোন লখিন্দরের শব।

এপাড়ে আকাশ তমসামগ্ন আর ওই পাড়ে শত শিয়ালের কলরব।

বেহুলা তোমার দুই চোখ ভরা জল, বুক জুড়ে পোড়ে জীবনের প্রত্যাশা” …

… তারপর? মনে আসছে না “পুড়ে যায় ভালবাসা” দিয়ে মিল দেওয়া ছাড়া আর কিছুই। আর মনে আসছে শেষ দুটি পংক্তি, খন্ড খন্ড …

“… আহত শয়নে (?)  জরৎকারুর বুকে মনসা লুকায় মুখ।

… … … চাঁদ সদাগর বুঝি আজ বীতশোক।”

সে অনেক কাল, প্রায় পূর্বজন্মের কথা। এটি আমার দ্বিতীয় মুদ্রিত ‘কবিতা’। প্রকাশ করেছিলেন বিজিৎ কুমার ভট্টাচার্য। আজ টের পাই, লেখাটিতে ছন্দ ভিন্ন আর কোনো মৌলিকত্ব না-থাকা সত্ত্বেও সম্পাদক প্রকাশ করেছিলেন, উঠতি “কবিযশোলোভী” কে নিরুৎসাহ না করতেই। … সে অনেক কাল, প্রায় পূর্বজন্মের কথা। লেখাটি মনে করিয়ে দিলো পত্নী। লেখাটি যখন হয়, প্রকাশ হয়, তখন তার ও আরেক জন্ম, আরেক যুগ, আমাদের। “হৃদয়ে প্রেমের দিন”। … সে মনে করিয়ে দিতে আমিও মনে করলাম আর মনে করে দেখলাম লেখাটায় ছন্দ ছাড়া কিছুই ছিলনা মৌলিক, ঠিক, তবে লেখাটিতে সমবেদনা ছিল, প্রতিটি চরিত্রের প্রতি, চাঁদের প্রতিও। হয়তো ঠিক জ্ঞাতসারে নোয়। তবু ছিল। ঠিক যে রকম ওই “থাকা”র নিমিত্ত, অজ্ঞাতসারেই, লেখা হয়ে গিয়েছিল আমার অবস্থান – সেই ১৯৯২-৯৩ সালের।

সেই ১৯৯২-৯৩ সালেও আমি নিরীশ্বর, কোশাম্বি কিছু কিছু ঘেঁটেছি, ফ্রেজারের “গোল্ডেন বাউ”, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো,  আরো অল্পবিস্তর মার্ক্স-এঙ্গেলস্‌। অর্থাৎ নেহাৎ-ই অরাজনৈতিক ছিলাম না তখনো। তথাপি … সেখানে যাওয়ার আগে বলে নিই ২০২৫ এর কথা। কয়েকটি মুহুর্তের কথা।

কবিতা, আমার নিজের লেখাকে বলবোনা, বলবো চেষ্টা। – মনে এই ‘চেষ্টা’র সংকল্প টি আসে কিভাবে? কোথা থেকে? – এখানে এসে, সততই, জীবনানন্দ, আমার ধ্রুবতারা, যিনি বলেনঃ “ 

…”।


অর্থাৎ, শিল্প আমাদের অন্দরে, মগজকোষেই জন্মায়। জন্মানোর একমাত্র গর্ভগৃহ। আর যেহেতু অন্দরের বাস্তবিক “হৃদয়” যন্ত্রটি, হয়, রক্ত,শ্বাস-প্রশ্বাস ইত্যাদির নিমিত্ত, অতএব, মগজ-উপত্যকায় তার সরাসরি কোনো জমি নেই। তাই, “হৃদয়” দিয়ে রচিত, নির্মীত শিল্প ও আদতে মগজেরই। হ’তে পারে মগজের যে অঞ্চল, যে কোষ গুলি এলিয়টের মগজে বেশীমাত্রায় ক্রিয়াশীল, রবার্ট ফ্রস্টের ক্ষেতে তা ভিন্ন অঞ্চল, ভিন্ন কোষ। এতভদিন্ন দুটি মানুষ যেমন যেমন দুটি সময়ের, অঞ্চলের, সমাজের সন্ততি, সুতরাং তাদের মগজ ও মগজকোষের কারিগরি অবশ্যই ভিন্ন। – অর্থ হয়, আমার কাছে কবিতা-চেষ্টা, আমার বা কবিতা – হোমার থেকে বিনয় মজুমদারের – জাগতিক প্রক্রিয়া। বস্তু-সংলগ্ন প্রক্রিয়া। যে অর্থে “ভাব” ও বস্তুরই সন্ততি। – এইহেতু জীবনানন্দের কথাগুলি, প্রথমবার পাঠমাত্র, সম্ভবত ততোটা না-বুঝেই, লেখা হয়ে গিয়েছিল মগজ-গুহার দেওয়ালে।

গতকাল, ২০২৫ সালের ১২ এপ্রিল, দুপুর দেড়টা নাগাদ হঠাৎ-ই টের পেলাম চেষ্টায় স্থিত হওয়ার উদ্যম, টের পেলাম কয়েকটি পংক্তি অথবা পংক্তির ভ্রূণঃ

“হে চাঁদ সদাগর, তোমার পালা-গান  এখনো এই গ্রহে শ্রাবণ মাস

রটায় ধারাজলে। উঠান-কালিদহে  ডোবায় সাত-ডিঙ্গা,ভাসায় লাশ।

ওষধি ঘাস তবু মাঠের নাভি ঢেকে  আবার লেখে কথা সে বেহুলার।”

কেন? 

কেন ২০২৫ সাল? 

কেন ১২ এপ্রিল? কেন দুপুর দেড়টা? 

কেন এই পংক্তিগুলি, কেন এই পংক্তি গুলি-ই?

অথচ আবহ বলতে ‘কৃতান্ত নগরে’র সেমি-পশ্‌ গলীর তেতলার খোপ-কোঠা। মুখামুখি, রাস্তার ওইপাড়ে, নির্নীয়মান আরেক খোপ-কোঠা-বস্তি। সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলা হয় “ফ্ল্যাট”। আবহাওয়াঃ গুমোট গরম। আকাশে হাল্কা না-বৃষ্টির মেঘ। অর্থাৎ বাইরে কোথাও শ্রাবণ, বর্ষা, বৃষ্টি – কেউ নেই। মনের কোথাও, অন্তত মনের যতোটুকু, মগজের যতোটুকু টের পাওয়া যায়, তাতেও মেঘ, বৃষ্টি, সাপ, মনসা – নেই। কিন্তু “নেই” থেকে “নেই” ছাড়া আর কিচ্ছু জন্মায় না। জন্মানো অসম্ভব। ঈশ্বর বললে আলো হয়না। বিদ্যুৎ চমকালে আলো হয়। পাথরে পাথর ঠুকলে আলো হয়। আগুন হয়। গতার মানে এই, যে, পংক্তিগুলি না হোক, তার বীজ ছিল। মনে। আমি জানতাম না। তবু ছিল। ঠিক যেমন থাকে স্বপ্নে — জেগেথাকায় না-দেখা অনেক কিছুই, তেমনি। ভাবি, ভাবতে চেষ্টা করি, কি ছিল, কি কি ছিল, মনে, মনের অজান্তে। ভাবি, তবে এ’ও ঠিক যে, ঠিক কি, কি কি, ছিল তা ভেবে উন্মোচিত হবেনা কদাপি। ছিল, অবশ্যই, “সপ্তডিঙ্গা মধুকর, চারিদিকে জল/ শ্রাবণের অবিশ্রাম মনসা মঙ্গল”। আবডালে ছিল শক্তিকাকু। ছিল “অনন্ত ভাসানে” গ্রন্থের বেশ ক’টি কপি। বাবার কাছে রাখা ছিল। “বিক্রি”র নিমিত্ত। বিক্রির বদলে বিলি হয়েছিল। কাদের দিয়েছি? মনে নেই। কেননা যখন ওই গ্রন্থের প্রকাশ, আমার ওই কবিতাটি পাঠ, তখন ভেবেচিন্তে বই বিলানোর, বই আনার, পড়ার – বয়স নয়। তখন সদ্য সদ্য “কবিতা”র রক্তমাংস-স্বাদ পেয়েছি। পড়ছি। যা পাচ্ছি, তা’ই। যাকে পাচ্ছি, তাকেই পড়াচ্ছি। এই “পড়ানোর” খাতে, মা’র এম-এ পাঠকালে কেনা বুদ্ধদেব বসু সংকলিত “আধুনিক বাংলা কবিতা”, বিষ্ণু দে’র “স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ” থেকে বাবার কাছে রাখা শক্তিপদ ব্রহ্মচারী’র “অনন্ত ভাসানে”, বাবার সংগ্রহের বিজিৎ কুমার ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় “এই আলো হাওয়া রৌদ্রে” – কাকে যে দিয়ে ফেলেছি মনে নেই। ঠিক যেমন মনে নেই আমার সংগ্রহে সমর সেনের কবিতা, শক্ত চট্টো’র দে’জ বই – ইত্যাদি কার কাছ থেকে এসেছিল। 

কবিতাটি নিয়ে একটি গদ্যও লিখেছিলেন শক্তিপদ ব্রহ্মচারী। লেটার প্রেস যুগে। যখন “লোকাল পেপার” বলতে ছিল শুধুমাত্র “গতি” আর “সোনার কাছাড়”। অন্তত আমার স্মৃতিতে। স্মৃতি আর ইতিহাসে দূরত্ব অনেক। সম্ভবত “সোনার কাছাড়” পত্রিকাতেই বেরোয় লেখাটি। সংখ্যাটি ছিল বাবার সংগ্রহে। যতোদূর মনে আছে, লেখাটি শক্তিকাকুর এক রাত্রির, শ্রাবণরাত্রির অভিজ্ঞতা। কি বলা যায় এ’কে? নাহ, প্রবন্ধ অবশ্যই না। এই টুকরো গদ্য আদতে তাঁর ওই কবিতারই ছিটকে যাওয়া “আগ-কথা”, কবিত্বেরই ছটা। হয়তো পন্ডিতেরা বলবে “ব্যক্তিগত গদ্য” – যা ইংরেজি “Personal Prose” শব্দবন্ধের ব্যর্থ অনুকরন। সে যাইহোক। ওই গদ্যে শক্তিকাকু বাড়ি ফিরছে। মফস্বলের রাত। বর্ষার। “মহিমালয়” থেকে আড্ডা সেড়ে একা ফেরার পথে বাঁধের কিনারে অস্থায়ী বস্তির অন্দর থেকে ভেসে আসা পদ্মপুরাণ টান দিলো। “কুপীলম্পে রাতকানা নিরক্ষরা বুড়ি / লখার মরণে কান্দে আছুড়িপিছুড়ি”। দেখাগেলো বাঁশবেড়ার ফাঁক দিয়ে। “কান্দে” লখার মরণে। তবে অন্দরে আছে আরেক শংকাও “জাল-  টানা ছেলে কাল রাতে গেছে জলে/ রেখো মা মনসা তার সর্বাঙ্গ কুশলে”। …

আমার শৈশবের কিনারে খাল। খালের ওইপাড়ে, তখনো এবং আরো অনেকদিন, ছিল…

তার আগে বলেনিই যা ছিলনা। ছিলনা “চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,/ একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।/ কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,”। ছিল “রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক”। … কাশবনের জায়গায় বাঁশঝাড়। আদিমতা মাখানো। তখনো। হতে পারে এ’ও, যে, যতোটা আদিমতা আদতেই ছিল তার সঙ্গে আরো কয়েক পোঁচ আদিম যোগ করেছিল আমার শৈশব-চোখ। ছিল কচুরীপানা। কচুরিপানার নিজস্ব-নীল ফুল। ছিল ছন-বাঁশের বাড়িঘর। একটি দু’টি টিন-চালে রোদ ঠিকরে উঠতো আনাচে কানাচে। বৃষ্টি নামলে, সেই তুমুল আদিম বৃষ্টি, আমাদের এপাড়ের টিন-চালে বৃষ্টি-পড়া-গানের সঙ্গে নিশ্চয় মিলে যেতো ওই পাড়ের ছন-বাঁশ আর টিন-চালের তালও। বৃষ্টি-ঋতুতে খাল থেকে উঠে আসতো সাপ। খালের শরীরে মিশে যেতো সাপ। নানা সাপ। নানান জাতের সাপ। জাত সাপ। বেজাতি সাপ। ঢোঁরা … নাহ্‌ , “ধুরা সাপ”। খালের কিনার-জলে ঢেউ উঠতো। ‘জার্মানী ফেনা”, ইংরেজিতে যা “কচুরীপানা”, দুলে উঠতো, দুলে দুলে উঠতো। আর একদিন হঠাৎই বৃষ্টি-শব্দের সঙ্গে মিশে উড়ে আসতে আরম্ভ হতো সুর। শুধু সুর। সুর-ই। শুদ্ধ সুর। একটি বাক্যও বুঝিনি কোনোদিন। আরম্ভ হতো দিনরাত্রির ‘পদ্মপুরাণ’ পাঠ। এ আমারই পাপ, আমারই অক্ষমতা, যে আজো জানিনা সেই পদ্মপুরাণ কোনটি – বাইশ কবির পদ্মপুরাণ যার একজন দ্বিজ বংশীদাস? …  “বাংলাদেশের অন্তর্গত কিশোরগঞ্জ মহকুমার পাটোয়ারী বা পাটুরী গ্রামে৷ তার পিতা যাদবানন্দ ছিলেন একজন সংস্কৃত পণ্ডিত৷ দ্বিজ বংশীর স্ত্রীর নাম সুলোচনা৷ দ্বিজ বংশীদাস ও সুলোচনার একমাত্র সন্তান চন্দ্রাবতী মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি।” – নাকি আরো কোনো আঞ্চলিক সংস্করন। কিন্তু ঠিক যেন বুঝতে পারতাম কাহনটি, চোখে ভাসতো নাকি চোখই যেতো ভেসে সেখেনে, যেখানে “ সপ্তডিঙা মধুকর চারিদিকে জল/ শ্রাবণের অবিশ্রাম মনসা-মঙ্গল/ পচা পাটে এঁদো ডোবা বিষধর ফণা/ ছেঁড়া কাঁথাকানি আর বেহুলা-যন্ত্রণা” …। সেখানেই শক্তিকাকু চিনে নিয়েছিল দ্বিজ বংশীদাসকে। লিখেছিল, এইভাবেঃ “এখনো বুকের দ্বিজ বংশীদাস কহে /হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কালীদহে”। — গো পাঠিকা, হে পাঠক “হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কালীদহে” এই উচ্চারণ শাহী রাবীন্দ্রিক “ ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে--/ "হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্‌খানে।" – মনে করিয়ে, মনে পড়িয়ে দিয়েও যে থেকে যায় স্বতন্ত্র, এই কথাটি আপনারা টের পেলেও দাগ দিয়ে রাখলাম। 

গো পাঠিকা, হে পাঠক, ক্রমে নেহাত খোলা বাজারের অর্থনীতি’র স্বাভাবিক সংকটের দিন এলো। তার ভশ্ম থেকে উঠে এলো নিও লিবারেলি পাটোয়ারী। যে মাঠ, যে খল, যে নদী, যে মফস্বল, যে গ্রামের পতন ঘটতো, অন্যথায়, আরো এক-দেড় দশক পরে, তা’ই ঘটে গেলো আমার শৈশব থেকে কৈশোর পেরোনোর আগে-আগেই। ফলে “ডহরের ঘোর-লাগা গহনের টানে” তলিয়ে গেলো খালের এপাড়, ওই পাড়ের সকলই। মাথা তুলল্লো ইঁট-পূজা, করসেবা। কোথায় পদ্মা? কে মনসা? ক্রমে এগিয়ে এলো “ধন-তরাস”, “ডান্ডি নেত্য”, এগিয়ে এলো যারা তাদের পুঁজি লগ্নী করেছে, তাদেরই ইচ্ছায়, চেষ্টায়। কিন্তু ততোদিনে, বাসা বেঁধে ফেলেছে “বুকের দ্বিজ বংশীদাস। এসব কথা উনিশ শো পঁচাশি থেকে নব্বই’এর আর আজ লিখতে বসেছি নিজেরই একটি রচনা-চেষ্টার কথা, ২০২৫ সালের এপ্রিলে।

২০২৫ সালের এপ্রিলে আবহ বলতে ‘কৃতান্ত নগরে’র সেমি-পশ্‌ গলীর তেতলার খোপ-কোঠা। মুখামুখি, রাস্তার ওইপাড়ে, নির্নীয়মান আরেক খোপ-কোঠা-বস্তি। সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলা হয় “ফ্ল্যাট”। আবহাওয়াঃ গুমোট গরম। আকাশে হাল্কা না-বৃষ্টির মেঘ। অর্থাৎ বাইরে কোথাও শ্রাবণ, বর্ষা, বৃষ্টি – কেউ নেই। আপাত ভাবে। কিন্তু “বুকের দ্বিজ বংশীদাস”, তাকে কোথায় রাখা? 

“অনন্ত ভাসানে” পাঠ-যুগের কিছু পরে পড়েছিলাম শম্ভু মিত্র’র “চাঁদ বণিকের পালা”। সেই বয়সে মন্দ লাগেনি। ক্যাসেট জোগাড় করে শুনেওছিলাম, শম্ভুবাবুর ভূতুড়ে গলায় সেই আজীব-গরীব … নাটক? … কিজানি। আজ আর একে নাটক বলে ভাবতে পারিনা। তবে সে আমলে শক্তিকাকুর “অনন্ত ভাসানে”, খালপাড়ের বসতি ও তার সঙ্গে পদ্মপুরানের বিলুপ্তি, শম্ভুবাবু – সব মিলিয়ে লিখিত হয়েছিল একটি নিতান্ত বালখিল্য পদ্য – যা’র কথা আগে বলেছি। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি,যে, কালী সিংগীর মহাভারতও ঘাঁটাঘাঁটি আরম্ভ হয়ে গিয়েছে ততোদিনে। আরম্ভ হয়ে গিয়েছে কোশাম্বী নিয়েও নাড়াচাড়া – মূলত সুজিৎ চৌধুরী, ‘আত্মিয়তার’ বাঁধা নিয়মে না হলেও যিনি আমার আত্মার নিকটতম জনের একজন, তাঁরই উৎসাহে, কিছুটা তত্ত্বাবধানেও। — ঠিক কি কারণে এই প্রসঙ্গটি বলা দরকার, তা, গো পাঠিকা, হে পাঠক, ক্রমে আপনারাই সক্ষম হবেন উন্মোচনে।

গো পাঠিকা, হে পাঠক, আরম্ভেই বলেছি, যে, নিজস্ব প্রতিমা, প্রতীক বদলে যায়। বদলে বদলে যায়।

অর্থ হয় মনের “কোয়ালিটি” বদলে যায়। বদলে বদলে যায়। আর তা যায় তখনই যখন সময় নিতান্ত মৃত “কোয়ান্টিটি” নোয়, জীবিত অনুঘটক। এই অনুঘটকটি ঠিক কিভাবে ক্রিয়াশীল হয়, হ’তে পারে – তার বিস্তার প্রুস্ত। প্রুস্তের “হৃত সময়ের অন্বেষণ” মহা -উপন্যাসে আমরা দেখেছি নিজস্ব প্রতিমা, প্রতীক বদলে যাওয়ার প্রত্যক্ষ, অপ্রত্যক্ষ হেতু সমূহ। দেখেছি, প্রবন্ধ-সুলভ বিশ্লেষণে নয়। বিশ্লেষণ, প্রুস্তে, হয়ে গিয়েছে গল্প, কখনো তা উন্নীত হয়েছে কবিতায়। উপন্যাদের প্রথম খন্ডে যাকে দেখেছিলাম, হয়তো নিতান্ত প্রেম নামক জ্বরে আক্রান্ত নিতান্ত কিশোরী, তাকেই হয়তো তৃতীয় খন্ডে দেখা গেলো পাটোয়ারী বুদ্ধির বেসাত করা এক জাঁহাবাজ মেয়েমানুষ চেহারায়। প্রথমে ধাক্কা লাগে। ক্রমে প্রুস্ত আমাদের নিয়ে হাঁটেন সেই স্থান ও কালের অক্ষ ধরে যার অন্তর্গত অভিজ্ঞতাই এই “কোয়ালিটেটিভ চেঞ্জ” ঘটিয়েছে। 

আমিও একদিন দেখলাম, শম্ভুবাবুর “পালা”টি মগজে, দাঁতে কৈ-মাছের কাঁটা বিঁধে থাকলে যেমন, তেমনই এক অস্বস্তি দিচ্ছে সেই অতীত থেকে উঠে এসে। আরো একটু তলিয়ে দেখলাম  “কুপিলম্পে রাত-কানা নিরক্ষরা বুড়ি/ লখার মরণে কান্দে আছুড়ি-পিছুড়ি” – এ সত্য ছবিটির পাশাপাশি শম্ভুবাবুর পালাটিকে মনে হচ্ছে রাংতার তলোয়ার, শোলার ফুল। একই সঙ্গে মনে হলো, লখা, তার মরনের কাহনে এসে নিরক্ষরা বুড়ি কাঁদে, আজো কা*দবে, কিন্তু কেন? তার তো “জালটানা ছেলে”, সে তো “কৈবর্ত”, সে’তো জাল টানতে জলে যায়, গেছে। আর “লখা” সে’তো জমিদারের নন্দন। সে যায় বাণিজ্য করতে। 

তাহলে? 

তাহলে, সেই কবে জীবনানন্দ লিখেছিলেনঃ “ দূরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙ্গে / গ্রাম পতনের শব্দ হয়;”। – এই “পতন” সার্বিক পতন। শুধু “বন কেটে বসত” নোয়, সেই সঙ্গে বসতের নিজস্ব রসায়নে, রসে জারিত সংস্কৃতি, পারস্পারিক সম্পর্ক সবই কেটে ফেলে “সেটলার” দের হাতে, পুঁজি প্রভুদের হাতে তুলে দেওয়া। এই “বন কেটে বসত” যতো বেড়েছে, বাড়ছে, ততোই নগর সংস্কৃতিতে “ফক-কালচার” করছে বংশবৃদ্ধি। সনাতন মীথ, কথকতা, গল্পগাথা – সকল কিছুকেই বুদ্ধির মারপ্যাঁচে “নতুন” করে, “চমকদার” করে হাজির করবার প্রবণতা। নতুবা শম্ভুবাবু কিভাবে সোজাসাপ্টা ভাগাভাগি করে ফেলেন, মনসা আর শিব কে, আলো আর অন্ধকার, জ্ঞান আর অজ্ঞান ব’লে? চাঁদ বণিক শিবের উপাসক। অতএব সে “আলোর পথযাত্রী”। তাকে বিড়ম্বনায় ফেলে অন্ধকার “মনসা”। অতএব চাঁদ সদাগর একজন “ট্র্যাজিক হিরো”। আশ্চর্য! চাঁদ একজন সদাগর এবং ভূসম্পত্তির অধিকারি আর মনসা - চতুর্বর্গের বাইরের, প্রায় “দলিত” এক শ্রেণীর প্রতিনিধি। অতএব তাদের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব আর যাইহোক, জ্ঞান-অজ্ঞানের দ্বন্দ্ব হতে পারেনা আর বিশ্লেষণের চাতুরীতে এই শ্রেনীদ্বন্দ্ব কে ভিন্নভাবে প্রচার করতে তা হয় মিথ্যাচার। গো পাঠিকা, হে পাঠক, যে সময়ে শম্ভুবাবু এই পালাটি “নামাচ্ছেন” তখন ডি.ডি. কোসাম্বি কোনো কাল্ট নয়, আন্ডারগ্রাউন্ড ইন্টেলেকচুয়াল নন। তিনি যে একজন একজন অগ্রণী মার্কসবাদী তা শুচিবায়ুগ্রস্থদিগের সুবিধার্থে বাদ দিলেও তিনি – ইতিহাসবিদ এবং ভারততত্ত্ববিদ। সুবিদিত। ডি.ডি. কোসাম্বি পৌরাণিক কাহিনীগুলিকে আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, যে, এসকল মিথ আদতেই কালজয়ী (ধর্মীয়) কোনো তর্কাতীত সত্য তো নয়ই, এগুলি আদতে ইতিহাসের আনুষঙ্গিক আখ্যান। এই সকল আখ্যান বস্তুগত বাস্তবতা ভিন্ন জন্ম নিতেই পারেনা। এই সকল আখ্যানের জন্মসূত্র – সমকালীন উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা ও তজ্জনিত শ্রেণী সংঘাত। ফলে এই কাহিনীগুলি  সমকালীন সমাজের শ্রেণী কাঠামোর প্রতিফলন। তাঁর Myth and Reality গ্রন্থটিকে অনুধাবনের, অতিসরলীকরনের ঝুঁকি সত্ত্বেও, মনেহয় একটি ইঙ্গিত এইভাবে দেওয়া যায় যেঃ অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মিথগুলির জন্ম ও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। আর যেহেতু সমকালীন শাসকশ্রেণীর সুবিধার্থেই এই সকল ঘটানো হয়, ফলে, দেবতারা প্রায়শই শাসক শ্রেণীর প্রতিভু হয়ে দেখা দেয়, দিয়েছে। শাসকের শ্রেণী স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করাই তার কাজ। একই ভাবে “ধর্ম”, কোনো ধর্মই, বাস্তবে স্থান-কাল নিরপেক্ষ নোয়। সকল “ধর্ম”ই উৎপাদন-বন্টনের দ্বন্দ্ব এবং সমকালীন যে শক্তি এই উৎপাদনের নিয়ন্তা, সেই শক্তির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়। খাপ খাইয়ে নেয়। কথাগুলি মনে রেখে মনসা বা বিষহরি ( আমাদের বিসরি)’র দিকে তাকালে সহজেই দেখা যায়, যে, কাহনটি প্রকৃত প্রস্তাবে অভিজাত, বর্ণহিন্দু দিগের সঙ্গে চতুর্বর্গের বাইরে থাকা স্থানীয় উপজাতির, আত্মনিয়ন্ত্রণ-অধিকার, ভূমি-অধিকার – ইত্যাকার মৌলিক প্রশ্নে যে দ্বন্দ্ব তারই কাহন। গ্রামীণ এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলির, বিশেষত বাংলা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের, মধ্যে মনসার পূজা প্রচলিত, যা এই সম্প্রদায়ের তৃণমূল উৎপত্তির ইঙ্গিত দেয়। মনসার পূজার প্রতি চাঁদ সদাগরের প্রতিরোধ সমাজের নিম্ন স্তর থেকে আগত দেবতাদের গ্রহণে প্রভাবশালী শ্রেণীর অনীহার প্রতীক। গো পাঠিকা, হে পাঠক,আশাকরি এক্ষণে, পূর্বে সুজিত চৌধুরী ও তাঁর উৎসাহে কোশাম্বী হাতে তুলে দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখের হেতুটি এখন স্পষ্ট।

গো পাঠিকা, হে পাঠক, যেভাবে লিখিত হলো, যেভাবে সাজানো হলো যুক্তিগুলি, পরপর, বাস্তবে এমন টা যে ঘটেনি তদ্বিষয়ে আপনারা নিজ অনুমানে অবগত। তথাপি, আমি আরেকটি বিস্তারে যাব। এই সকল ভাবনা গুলি, একদিনে, এক মুহুর্তে বা কোশাম্বি পড়তে প্ড়তে বা পাঠমাত্রই আসেনি। “বুকের দ্বিজ বংশীদাস” আমাকে যুগপৎ  “হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কালীদহে আর "হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্‌খানে” – পংক্তিগুলি বলেযায়। বলে যেতে থাকে। আমার নিজের স্থান-কাল আর আমার চালচিত্রের সাপেক্ষে বিস্তারিত-তর যে স্থান-কাল দুয়ের নিরিখে ওই জেদী মেয়েটি, মনসাটি, বিসরিটি, আমার মধ্যে শিকড় ছড়িয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে, যে মনসা স্পষ্ট এক নিপীড়িত শ্রেণীর প্রতিনিধি সে কি করে হয়ে যায় "আস্তীকস্য মুনর্মাতা ভগিনী বাসুকেস্তথা। জরৎকারু-মুনি-পত্নী মনসা দেবী”? আর তারপরে জুড়ে দেওয়া হয় – “নমোহস্তুতে”? কিভাবে বর্নহিন্দুর ঘরে, ঘরে ঘরে সে উঠে আসে?

এখানেও কোশাম্বি’র সূত্র ধরে এগোলে দেখা যায়, যে, যখনই ব্রাহ্মণ্যবাদ দেখেছে, টের পেয়েছে, যে, কোনো একটি বিশেষ চিন্তা, ধর্মীয়, তার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠতে পারে, তখুনি, ব্রাহ্মণ্যবাদ তাকে দখল করেছে। সহজতম উদাহরন গৌতম বুদ্ধ কে হিন্দু অবতারে পরিণিত করা। খুবই চতুরতার সঙ্গে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তাঁর Oriental Philosophy তে বৌদ্ধ ধর্ম কে ব্রাহ্মণ্যবাদী দিন্দুরই শাখা বলে চালিয়ে দিয়েছেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রমুখদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও। অতএব আদত মনসাকে খুন করে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। বণিকের মানদন্ড এখানেও হয়েছে সফল।

          বণিকের মানদন্ড এখানেও হয়েছে সফল। নতুবা এই সত্য ছবিটি কেন দেখেন শক্তিপদ “ কুপিলম্পে রাত-কানা নিরক্ষরা বুড়ি/ লখার মরণে কান্দে আছুড়ি-পিছুড়ি”? যে বণিক তথা জমিদার তার ঔদ্ধত্যে, যে ঔদ্ধত্যও তার শ্রেণী চরিত্র, জমির “পাট্টা” না দেওয়ার বা ডিক্রি-উৎখাত-বুলডোজারের মতো, এন আর সি’র মতো – কানুনের, আইনের যে বা যারা প্রতিনিধি, তাদের পুত্রের মৃত্যুতে, আন আর সি পীড়িতা, গ্রাম-শহর সীমার বাইরে, সতত ডিক্রি-বুলডোজার ভীতিতে পীড়িতা, নিরক্ষরা বুড়ি কেন কাঁদবে? কিন্তু কাঁদে, শক্তিপদ’র এই দেখা সত্য। দেখামাত্র অভিভূত হওয়া, মর্মে কবিতার জন্ম হওয়া সত্য। ঠিক যেমন সত্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে, যে শ্রেণী, শ্রমিক তথা হারাবার কিছু নেই শ্রেনীর – নাৎসী পক্ষ সমর্থন ও যোগদান।

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে, যে শ্রেণী, শ্রমিক তথা হারাবার কিছু নেই শ্রেনীর – নাৎসী পক্ষ সমর্থন ও যোগদান যে তাদের আত্মহননের নামান্তর তা তারা টের পায়নি। টের পেতে দেয়নি নাৎসী ব্যবস্থা। শুধুমাত্র দমননীতি দ্বারা নয়। ‘প্রচারে’র দ্বারা। গো পাঠিকা, হে পাঠক, আমরা জ্ঞাত, যে, এই ‘প্রচারে’র স্বরূপটি দীর্ঘ বিচার বিশ্লেষণের পরে কিছুটা যিনি অনুধাবন করেছিলেন, তিনি আন্তোনিও গ্রামসী। আমরা জানি, যে, তিনি দেখেছিলেন এবং বিশ্লেষমণ করে দেখিয়েছেন, যে, শাসক শ্রেণী কেবল বল প্রয়োগের মাধ্যমে শুধু নয়,শিক্ষা, ধর্ম এবং মিডিয়ার মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গুলির মাধ্যমে তার নিজের “নীতি” , যা তার ক্ষমতা কায়েম রাখবার রুলবুক, তাকেই জনমনে  "স্বাভাবিক" বা "সাধারণ জ্ঞান" বলে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে শাসক তার সুবিধার্থে শাসিত ও শোষিতদের পরম সর্বনাশ করিয়ে নেয়, তাদের নিজেদের দ্বারাই। আমরা কি দেখিনি, সম্প্রতি, অযোধ্যায়, রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার মূল্যে নিজ ভিটাবাড়ি,দূকান-মকান হারিয়েও একদল “ভক্ত” রাম আর রামের পূজক দিগের কিনারে দাঁড়িয়েছে?

এখানে এসেই, সন্দেহ হয় দ্বিজ বংশীদাসকেও।


সন্দেহ হয় দ্বিজ বংশীদাসকেও কেননা তিনিও তো “দ্বিজ”। অতএব বৈশ্যদিগের পক্ষ তাকে নিতেই হবে। চতুর্বর্গের ছক তাঁকে রাখতেই হবে টিঁকিয়ে। এই দ্বিজ বংশীদাস (১৬শ-১৭শ শতক)   সংস্কৃত,  পুরাণ, আগম ও তন্ত্রাদি শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। ছিলেন সুগায়ক।  তিনি মনসামঙ্গল ছাড়াও সংস্কৃতে কৃষ্ণগুণার্ণব ও বাংলায় রামগীতা, চন্ডী – ইত্যাদি গ্রন্থও রচনা করছেন। কাজেই, বণিক-পুত্রের মৃত্যুকে যথাসাধ্য করুণ রসে জারিত করে পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি পালন করছেন শাসকদিগের স্বার্থ রক্ষার্থ hegemony বুননের কাজটি এবং কাজটিতে যে তিনি সফল তার প্রমাণ ওই নিরক্ষরা বুড়ির ক্রন্দন বেনের ছেলে লখার মৃত্যুতে। আর তার দ্বারা চাঁদবেনের সাত খুন নোয়, চাঁদবেনেদের, জনিদার তথা দেশীয় বণিক শ্রেণীর, সাত হাজার খুন মাফ করিয়ে নিয়ে, অবশেষে মনসা’কে বাঁ হাতে অঞ্জলী প্রদানের মহানুভবতায় চাঁদের প্রতিষ্ঠা। 

২।

গো পাঠিকা, হে পাঠক আবার ফিরি সেই প্রশ্নে, সেই অনুষঙ্গে – গতকাল, ২০২৫ সালের ১২ এপ্রিল, দুপুর দেড়টা নাগাদ হঠাৎ-ই টের পেলাম চেষ্টায় স্থিত হওয়ার উদ্যম, টের পেলাম কয়েকটি পংক্তি অথবা পংক্তির ভ্রূণঃ

“হে চাঁদ সদাগর, তোমার পালা-গান  এখনো এই গ্রহে শ্রাবণ মাস

রটায় ধারাজলে। উঠান-কালিদহে  ডোবায় সাত-ডিঙ্গা,ভাসায় লাশ।

ওষধি ঘাস তবু মাঠের নাভি ঢেকে  আবার লেখে কথা সে বেহুলার।”

কেন? 

কেন ২০২৫ সাল? 

কেন ১২ এপ্রিল? কেন দুপুর দেড়টা? 

কেন এই পংক্তিগুলি, কেন এই পংক্তি গুলি-ই?

অথচ আবহ বলতে ‘কৃতান্ত নগরে’র সেমি-পশ্‌ গলীর তেতলার খোপ-কোঠা। মুখামুখি, রাস্তার ওইপাড়ে, নির্নীয়মান আরেক খোপ-কোঠা-বস্তি। সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলা হয় “ফ্ল্যাট”। আবহাওয়াঃ গুমোট গরম। আকাশে হাল্কা না-বৃষ্টির মেঘ। অর্থাৎ বাইরে কোথাও শ্রাবণ, বর্ষা, বৃষ্টি – কেউ নেই। মনের কোথাও, অন্তত মনের যতোটুকু, মগজের যতোটুকু টের পাওয়া যায়, তাতেও মেঘ, বৃষ্টি, সাপ, মনসা – নেই। 

কিন্তু সেইদিনই খেপে খেপে রচিত হলো কবিতা-চেষ্টাটি। পূর্ণও হলো। এবং অতঃপর এ’ও দেখা গেলো, যে, ১৯৯২-৯৩ সালেও আমি, বলা উচিত ১৯৯২-৯৩ সালের ‘আমি’টির আরো একটি রচনা-চেষ্টার বিষয় এই কাহন, এই চরিত্র, এই আবহ। কিন্তু লেখা দু’টি প্রায় দুই মেরুর। ২০২৫ এর লেখাটি একটি মোটামোটি অবয়ব পেলে পড়তে দিলাম কবি, অগ্রজ দেবাশিস তরফদারকে। দেবাশিসদা নানা কথার সঙ্গে এই প্রশ্নও করলো, যে, হঠাৎ এই বিষয়, এই লেখা? – করলো, কারণ আমি ঠিক কি পড়ি, পড়ছি, ভাবছি – ইত্যাদি নিয়ে দেবাশিসদার সঙ্গে আমার নিত্যদিনই বিনিময় হয়। বিগত অন্তত তিন বছরের বিনিময়ে এই বিষয়টি নেই। তাহলে? তাহলে, আমিও জানিনা সঠিক। তবে এ যে কোনো আচমকা “প্রেরণা” নয় আর “আচমকা প্রেরণা”র গোটা ধারণাটিই যে হয় অনর্থক তা আমি জানি। 

নিজের লেখাটি নিয়ে বসলাম আবার। পড়লাম আবার। 

না, কেন’র সহজ উত্তর না’তো দেবাশিসদা চেয়েছে না আমি পেয়েছি বা পাবো। তবে এই লেখাটি আর আপমার পত্নীর দ্বারা মনে করানো, ১৯৯২-৯৩ এর লেখাটি’র মধ্যবর্তী স্থান-কালে উড়ে গেলো মন। ক্রমে উঠে এলো, যেন সেই কালীদহ থেকেই অথবা কালীদহ’ই নটীখাল কিংবা নটীখালই কালীদহ, ছবিগুলি। সেই ভেসে আসা বেহুলা-গান, টিনচালে ঝমঝম বৃষ্টির ধ্বনি, জার্মানি-ফেনা’র গা থেকে উঠে আসা ঘ্রাণ, নুয়েপড়া বাঁশঝাড়, তার আদিম অন্ধকার, সাপেদের আনাগোনা…। আমি টের পেলাম এরা ছিল। এরা মগজকোষে ছিল। ছিল বস্তুত। ছিল বস্তু হয়ে। বস্তু হিসাবেই। তারা নানা মোড়েই জেগে উঠতো। নতুনা ১৯৯২-৯৩ এর প্রায় এক দশক পরে, আবার কেন ডায়রীতে লিখেছিলাম শম্ভুবাবু’র “পালা”টি নিয়ে আমার বিরক্তির কথা? কেন, আরো পরে, আবার কোশাম্বী পড়তে পড়তেও মর্মে এসেছে সেই মনসা-মেয়ে? কেন বার বার, বার বার শক্তিকাকুর কবিতাটির প্রতিটি পংক্তি, ফিরে এসেছে হাজার বার? কেন গ্রামসীর hegemony নিয়ে, পরবর্তীতে যখন চেষ্টা নিয়েছি অধ্যয়নের, তখনো এসে হাজির হয়েছে দ্বিজ বংশীদাস? 

কেন?

কারণ এই লেখাটি কখনো লিখিত হবে বলে। লিখিত, কোন দৈব যোগাযোগে নয়। বাস্তবিক, বস্তুগত সংযোগে। মগজ, স্নায়ু – এই সকল প্রত্যঙ্গের বস্তুগত সত্যই শিল্পের, শিল্পচেষ্টারও সত্য। 

কিন্তু কেন ২০২৫ সাল? 

কেন ১২ এপ্রিল? কেন দুপুর দেড়টা? 

এখানে এসে মনে আসছেন দস্তয়ভস্কি, তাঁর Dream Of a ridiculous man গল্পের নামহীন কথক-প্রোটাগোনিস্টের কথা। সে চায় আত্মধাতী হ’তে। চায় সে অনেকদিন ধরেই। সে জোগাড় করে রেখেছে, তন্নিমিত্ত, একটি পিস্তলও। তবু করেনা আত্মনিধন। তখনো। কেননা সে সঠিক মুহুর্তটিকে পারেনা, তার মনেহয়, চিহ্নিত করতে। অতঃপর, একরাত্রে, যথারীতি সে আত্মহন-ভাবনা নিয়ে পথ হাঁটছে, তখনঃ “ As I was thinking about the gas lamps in the street I looked up at the sky. The sky was horribly dark, but one could distinctly see tattered clouds, and between them fathomless black patches. Suddenly I noticed in one of these patches a star, and began watching it intently. That was because that star had given me an idea: I decided to kill myself that night. … I made up my mind that it should certainly be that night. And why the star gave me the thought I don't know.”

এই মনসা-মেয়ে, এই পাটোয়ারী বণিক – চাঁদ, এই গর্বিতা সনকা, এই সিক্ত-মার্জারহেন লখিন্দর – এরাও ছিল মর্মে। বহুদিন। বহু দিনরাত্রির ভিতর দিয়ে এরা পরিগ্রহ করেছে এই রূপগুলি – গর্বিনী, সিক্ত-মার্জার … ইত্যাদি। কিন্তু তারা আজই কেন? 

 কেন ২০২৫ সাল? 

কেন ১২ এপ্রিল? কেন দুপুর দেড়টা?  

“ I don't know.”

৩।

গো পাঠিকা, হে পাঠক, এইবারে নিবেদন সেই কবিতা-চেষ্টাটি যা নিয়ে এতো এতো অক্ষর এনে জমা করলাম এতোদিন, এতো সময় …


হে চাঁদ সদাগর, তোমার পালা-গান  এখনো এই গ্রহে শ্রাবণ মাস

রটায় ধারাজলে। উঠান-কালিদহে  ডোবায় সাত-ডিঙ্গা,ভাসায় লাশ।

ওষধি ঘাস তবু মাঠের নাভি ঢেকে  আবার লেখে কথা সে বেহুলার।

হে চাঁদ সদাগর, দেবতা আজো করে স্বর্গে বেহুলার বলাৎকার।


যদিও পালা’টি হে তোমাকে ঘিরে ঘোরে 

নায়ক নও তবু তুমি এ কাহিনীতে, নায়ক নয় 

ঢোঁরা লখিন্দর। বেচারি বেহুলাও পার্শ্ব ভূমিকায় ।

একলা বাইদ্যানি  মনসা, ছোটোজাত, নায়ক এখানে, হে 

নিরীশ্বর। মনসা দেবী নয়, নিছক বাইদ্যানি। চতুর্বর্গের 

বাইরে ঘর – খোলা ও খাপরার। মাঠের ওই ধার

যেখানে গ্রামসীমা,কবরিস্তান, যেখানে শিয়াল আর

শকুনে মিলে খায় – হাড্ডি, মড়া-খুলি – অন্ধকার

চিতাটি থেকে তুলে, চিতাটি নিভে গেলে

শরিক তারা স্থায়ী ব্যবস্থার।


মনসা বাইদ্যানি সাপের যাদুকরী

হে চাঁদ সদাগর, মনে কি নাই

মনসা বেদেনীর  দাবাই এ জান ফিরে

       তুমি ও তোমার ওই সাহা-বেহাই

পেয়েছো কতোবার?                   বণিক ও জমিদার

          ভুলেছো পলকেই সে উপকার।


তবুও মনসা সে উড়নচন্ডী মেয়ে

করেনি মনে কিছু, পোষেনি রাগ। তাই যখন তার

নেহাতই দরকার হাঁড়িটি চাপাবার গেঁড়ি ও গুগলী বা

শাপলা ফল,  সে এসে ঢুকেছিল                    

ক্ষুধা ও দ্বিধা নিয়ে তোমার দিঘিটিতে, হে সদাগর, 

যদিও রোজ তার অন্ন জোটেনা তবুও যৌবন, যেন শ্রাবণ –

সে ঢল চোখে দেখে তুমি হে দেশলাই, তোমার কাম

পোড়াতো ঠিক তাকে, তোমার দিঘিপাড়ে

যদি না সনকার সন্দেহ

না নিয়ে যেতো তাকে দিঘির আঘাটাতে

হয়তো ঘুড়ে যেতো গল্প-মোড়। সনকা মনসাকে

শিয়াল-থাবা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজে দিল ছোঁবল –

“চেঙমুড়িকানি’, হে সদাগর, তুমি তো ঠিকই জানো 

মনসা বেদেনীকে করেছে কানা ওই সনকাই।

কেনই করবেনা?  তুমি তো সদাগর  এবং জমিদারও                  

“তুমি তো বাপু ওহে  রাজার ছেলে হও

তোমার হয় আবার কিসের পাপ? 

ওরা তো ওরকমই, বাইদ্যা বেটিগুলি,  

সাপের মতো ওরা 

  নিজেও সাপ।”

হে চাঁদ সদাগর, তোমার পালা-গানে

               কই এ গীত গুলি? সব লোপাট 

হয়েছে, শুধু হে                      কালের হাতে নয় 

                  চতুর্বর্ণের চতুরতায়।

গাঙ্গুড়ে মনসার                            ভাসিয়ে দিয়ে লাশ

             তুলেছো ধুয়েমুছে স্পার্ম,প্রমাণ।

 “দেবী”র ছেঁড়া শায়া                   পড়িয়ে তাকে পাড়ে

                 তুলেছো, দিয়েছো দেবতা নাম।

 


এবং কড়ি পেয়ে                           তোমার চারণেরা

                হে চাঁদ সদাগর, বেঁধেছে গান।

যে গানে চাঁদ তুমি                    সেজেছো নিজে হিরো

              পড়েছো শব্দের ট্র্যাজিক তাজ।

ব্যবসা-প্রয়োজনে                       বেচেছো বেহুলাকে

               প্রবলতরদের রাত-সভায়।

বেচারী বেহুলা সে                         ক্যাবারে নেচে নেচে

               দিয়েছে জলে ঝাঁপ কি ঘেন্নায়

সে কথা শুধু জানে                 ধোপানী ‘নেতা’ যে

               কাপড়-কাচা ঘাটে লাশটি পায়।

হে চাঁদ সদাগর, ভেবেছো পালা-গান 

এবং প্রত্যেক শ্রাবণ মাস

রটাবে ধারাজলে তোমার কাহিনী হে

ভাসাবে সাত-ডিঙ্গা,ডোবাবে লাশ।

হয়তো সদাগর                                 সফল তুমি আজ

            চন্দ্র-বণিকের পালা ও গান

সগৌরবে, হায়      রূপালী পর্দায়  

            পঁচিশ সপ্তাহ হাউস ফুল।

তথাপি সদাগর                            শ্রাবণ ও ধারাজল

            সকলই জানে, জানে ওষধি ঘাস।




—------------------------------------

মুদ্রনঃ সাহিত্য, সেপ্টেম্বর ২০২৫

Saturday, August 16, 2025

অল্পদূর সঙ্গে হেঁটে যাওয়া

 অল্পদূর সঙ্গে হেঁটে যাওয়া

[ আরবি কবি নিজার কাব্বানি’র ছায়ায় ]



১।

সে চায় 

নতুন ভাষা, ব্যাকরণ। নতুন অক্ষর

যা তার বন্ধুর মাপমতো, যা তার প্রীতিতে 

খাপ খাবে, মিলে যাবে 

তাদের প্রেমের 

মাপে মাপে।

#

সব

শব্দকোষ, সব

অভিধান থেকে ছুটি নিয়ে

সে চায় এমন ওষ্ঠ, এমন অধর

যা পারে দেশলাই কাঠি, যা পারে

ফুলের গাছ হ'তে। সে চায়

অধর ওষ্ঠ 

ঝরাবে, উড়াবে শব্দ 

সমুদ্র যেভাবে

জলপরী 

ভাসায় অথবা জাদুকর

তার টুপি থেকে

যেভাবে খরগোস।

২।

সবগুলি জমানো অক্ষর

শ্লেটপাথর

খাতা-বই, ব্ল্যাকবোর্ড, চকখড়ি সহ

স্বত্ব ছেড়ে 

এক কথায় দিয়ে দিতে রাজি

যদি কেউ দিতে পারো তাকে

একটি অক্ষর, যে অক্ষর জানে

বন্ধুর সৌন্দর্যে এক

নাকছাবি হতে।

#

সে চায় পাঁচটি মাত্র

নতুন আঙ্গুল। উঁচায় লম্বায় যারা  

মাস্তুলের মতো। নতুন আঙ্গুলে

কবিতা-গয়না গড়ে দিতে চায়

সে তার

বন্ধুকে।


ঘুম ঘর