জাফর পানাহি ও তাঁর ‘বৃত্ত’
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
প্রথম প্রকাশঃ 'মিরুজিন, সংখ্যা ২, ১৪ই আষাঢ়, ১৪১৯
১।
কামুর ‘আউটসাইডার’এর প্রোটাগোনিষ্ট যখন হঠাৎই গুলি করে খুন করে ফেল্লো একজন মানুষকে এবং কোনো চেষ্টাই করলো না আত্মরক্ষার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের , চরিত্রটির শ্রষ্টা কামু যখন এই হত্যার কোনো হেতুই উল্লেখ করতে অস্বীকার করলেন গোটা উপন্যাস-শরীরে, সেই ১৯৪২ সালে, ইউরোপীয় আধুনিকতা যে বিন্দুতে গিয়ে দাঁড়ালো তার মুখোমুখি, ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া গোদারের ‘ব্রেথ্লেস্’ ছবির গাড়ি চোর প্রোটাগোনিষ্ট – শেষ দৃশ্যে যে ইচ্ছে করলেই পালাতে পারতো পুলিশের হাত থেকে, অথচ পালালো না, কারন হিসেবে জানান দিলো সে পালাতে পালাতে এখন ক্লান্ত এবং ঐ ক্লান্তির মূল্যে সে পুলিশের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পরলো রাজপথে –
তাকে দাঁড় করিয়ে দিলে ইউরোপীয় আধুনিকতার একটি গতিপথ হয়তো লক্ষ্য করা যেতে পারে।
কামু’র আউটসাইডারের মর্মের যে শূন্যতার বোধ, যে ‘স্ট্রেঞ্জনেস্’ তা যতোদূর অনুধাবনীয় তার চেয়ে ঢের অনুধাবনীয় গোদারের প্রোটাগোনিষ্টের ক্লান্তি কেননা সে ‘আউট্সাইডার’
নয়, মানুষ হিসাবে তার কামনা-বাসনা, তার জিজীবিষা সবই বহুদূর অনুধাবনীয়। সে কামু’র Meursault এর মতো ‘পেটি বুর্জোয়া’
নয়। বরং সে, Michel, সেই শ্রেণীরই খুব কাছাকাছি যাদের ‘শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার আর কিছু নেই’ ... কাছাকাছি, তবু সে তা নয় কেননা সে ঐ ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন না ঘটাতে না চেয়ে বরং ঐ ব্যবস্থাতেই আশ্রয় চায়, চায় প্রেম ... কিন্তু এই ব্যবস্থা তা’কে সে সব কিছু না দিয়ে বরং বেড়ায় তাড়া করে ... ফলতঃ এক সময় ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ই হয়ে ওঠে তার নিয়তি ... পক্ষান্তরে কামু’র প্রোটাগোনিষ্টের যে ক্লান্তি তা’ও যদিও ‘আত্মঘাতী’
কিন্তু সমান্তরালে সে ঘাতকও বটে।
প্রায় ভুলে যাওয়া ঐ দু’টি চরিত্রের কথা মনে এলো জাফর পানাহি’র ‘ক্রিমসন্ গোল্ড্’ (Talaye sorkh, ২০০৩) ছবিটি ফিরে দেখতে বসে কেননা এখানেও, একটি হত্যা এবং আত্মহত্যা প্রথম দৃশ্য থেকেই তাড়া করে ফেরে দর্শককে ... কিন্তু এখানে হত্যাকারী ‘হুসেন’
না’ত কামু’র আউট সাইডার, না’ত সে গোদারের মিচেল ... তার যে সংকট তা দিনগত প্রাণ ধারনের সংকট। সে বেঁচে থাকতে চায়। সে আনন্দ পায় মোটর সাইকেলে চেপে ঘুড়ে বেড়াতে। সে বাঁচিয়ে রাখতে চায় অন্যকে। পেটের দায়ে বয়স বাড়িয়ে সৈন্যদলে ঢুকে পড়া বালকের ক্ষুধার্ত মুখ তাকে বাধ্য করে বিলিয়ে দিতে সেই পিজা যা তাকে দেওয়া হয়েছিল খদ্দেড়কে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। মোটর বাইকে ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিজা পৌঁছে দিয়ে আসার চাকরীটি ছাড়াও সে, তার হবু শ্যালকের সঙ্গে মিলে করে পকেট-মারা’র ব্যবসা। আশ্চর্য এই, যে, ঐ পকেট মারার ব্যবসাতেও ছায়া ফেলে তার জীবন তৃষ্ণা ... এই যার চরিত্র সে কেন খুন করে ফেলে, প্রায় অকারনেই একজন মানুষকে? কেন খুন করার পরেও, তার বন্ধু যখন জীবনপণ আশ্বাস দেয় ‘আমি আছি তোমার সঙ্গে...’ সে কেন পরবর্তী গুলিটি চালিয়ে দেয় তার নিজের খুলিতে? এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজবার আমার যে ব্যক্তিগত প্রয়াস, পাঠক, তা’ই আমি আপনার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিচ্ছি এই রচনায় এতদ্ভিন্ন এই ইন্টারনেট্-সময়’এ তথ্য নিয়ে আলোচনা করার কোনো অর্থ হয়না কেননা উৎসাহি পাঠক চাইলেই পানাহি আর তাঁর সিনেমা বিষয়ে অসংখ্য তথ্য সংগ্রহ করে নিতে পারেন ইন্টারনেটে। অতএব এই ইন্টারনেট সময়ে আলাপ আলোচনায়, তথ্য নয়, অনুভবের ভাগাভাগিই বোধকরি একমাত্র অর্থবহ বিনিময় ...
২০০৩ সালে তোলা এই ছবিটির আগে, ২০০০ সালে জাফর পানাহি নির্মাণ করে ফেলেছেন ‘The Circle’, যা আমার মতে শুধু নয়, বিশ্ব সিনেমার প্রায় সমস্ত দর্শক-সমালোচকদের মতেই তাঁর প্রথম পরিণত ছবি। সেই ছবি ঝড় তুলেছে সিনেমা-ইতিহাসে, পানাহি পেয়েছেন ভেনিসের গোল্ডেন-লায়ন ... সে সমস্ত আজ সর্বজনজ্ঞাত । ঐ চবিটি বিষয়ে পানাহি’র যে কথাটি আমাকে ভাবিত করে তা হলো এই, যে, ‘The Circle’ এ পানাহি মূলতঃ দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিয়তিকেঃ Panahi
sees the new work as an artistically more mature piece. It is his examination,
as he indicated to us, of the fate of his child characters, so to speak, when
they grow up. The difficulties of childhood now assume quite different
proportions. ( সূত্র WSWS) বিশদ আলোচনায় যাওয়ার আগে এখানে শুধু এ টুকু বলে নিই, যে, ‘The Circle’ অন্তিমে, তার বহুমাত্রিক গমনের শেষে, বলে একটি কথা’ই – স্বর্গ নেই। স্বপ্নের স্বর্গ নেই। নিজ নিজ স্বপ্নকে অবয়ব দিতে চেয়ে যে যে পথেই ছুটে যাক অবশেষে তাদের ক্ষমতা নেই সেই বৃত্তকে ভেঙ্গে বার হয়ে আসার যে বৃত্তের প্রতীক শেষ দৃশ্যের জেলখানা ... যে জেলখানাকে পানাহি হাজির করেছেন প্রথম দৃশ্যের হাসপাতালের সমান্তরালে .... এখানে এসে মনেপড়ে ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’র সেই দৃশ্য যখন ঈশ্বর চক্রবর্তী নিজেকে পরাজিত ভেবে চলেছে আত্মহত্যা করতে আর তখনি এসে হাজির হচ্ছে হরপ্রসাদ , বলছে যে পথেই যাও না কেন অবশেষে ঐ পরাজয়ই ধ্রুব । পাঠক জ্ঞাত আছেন যে, একটি চাকরি পেয়ে নিজের ছোট্ট বোনটিকে একটি ‘ঘর’
দেওয়ার বাসনা নিয়ে উদ্বাস্তু কলোনীর থেকে চলে এসেছিল ঈশ্বর চক্রবর্তী আর হরপ্রসাদ, পক্ষান্তরে ঐ উদ্বাস্তু কলোনী আঁকড়ে পরেছিল সমস্ত উদ্বাস্তুদের স্বপ্নকে অবয়ব দেওয়ার আকাঙ্খায় ... এ’ও বৃত্ত। এতোদূর একটি বৃত্ত নির্মাণ করেছিলেন ঋত্বিকও। কিন্তু তারপর, ঐ ছবিতেই, ঐ বৃত্তকে ভেঙ্গে ঋত্বিক এগিয়ে নিয়ে চললেন ঈশ্বর চক্রবর্তী’কেই ... এবার তার হাত ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, মৃত বোন সীতার নাবালক ছেলে ... তারও চোখে স্বপ্ন, তার মার মতোই, ঘরের, নীড়ের ।
পানাহির ‘The Circle’ বলেনা বৃত্ত ভাঙ্গার কথা। বলে বৃত্ত ভাঙ্গার স্বপ্নগুলির ভেঙ্গে যাওয়ার কাহন। ঐ বলাও এক অভূতপূর্ব ভঙ্গীতে। যেন একটি রীলে রেস। একটি চরিত্রকে ধরে কাহিনী এগিয়ে চলে কিছুদূর। জানা যায় ঐ চরিত্রটির আশা, সাধ, স্বপ্ন এবং তার অব্যবহিত পরেই সে মিলিয়ে যায় ... কোথায়? আপাতঃ ভাবে জানা যায়না। পরিবর্তে চরিত্রটি, যেতে যেতে, তার কাহিনী-মশাল দিয়ে যায় অপর চরিত্রকে ... এবং অবশেষে সেই সমস্ত হারিয়ে যাওয়া চরিত্র একত্রিত হয় জেলখানার অন্ধকার কুঠুরীতে ... ইঙ্গিত বলতে রয়েযায় ঐ শিশুটি যাকে আলোকিত জীবন দেওয়ার স্বপ্নে তার মা তাকে ফেলে পালিয়ে আসে ... তারপর অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে, যেন কুন্তী, যেন Moses’এর মাতা Yoshebel ... সেই শিশু কন্যাটিকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, তাকে এবার ভরন-পোষন করবে ‘সরকার’
সে বড়ো হবে ... ভালো হবে ... মা’টি চেয়েছিল ঐ কন্যাটিকে নিয়ে যাক কোনো সূত অধীরথ কিন্তু পরবর্তে সরকারী অনাথ আশ্রমের হানাদারিকে সে মেনে নেয় ... আশায় আপনাকে সংহত করতে চায় মা’টি ... কিন্তু মা’টির মনেও যেমন, আমাদের মনেও তেমনি রয়েযায় প্রশ্ন, যে সরকার, যে ‘ব্যবস্থা’র অত্যাচারে ঐ মা এবং আরো অসংখ্য মা, ভগিনী আজ জীবন্মৃত তার হাতে কি করে সঠিক ভাবে বেড়ে উঠবে ঐ শিশু?...
২।
স্বর্গ নেই। স্বপ্নের স্বর্গ নেই। আছে শুধু এক বৃত্ত। এক Vicious
circle। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ, মনেপড়েঃ সেখানে মানুষগুলো সব ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো / ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে /মশালের আলোয় ছায়ায় তাদের মুখে /বিভীষিকার উল্কি পরানো ...
পানাহি’র ‘সার্কলএ’ও তাই। শুধু মানুষের পরবর্তে এক বিশেষ লিঙ্গের মানুষ। তারা মহিলা। মহিলাদের মধ্যেও তাদের শ্রেণী আলাদা। ‘পুরুষের প্রতিরক্ষাহীন মহিলা’। প্রতিটি পুরুষ এদের অশালীন ইঙ্গিত করে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা চায় পরিচয় পত্র। পথচলতি তথাকথিত দম্পতী এদের দেখে সন্দিগ্ধ চোখে। আবার ঐ দলেরি কেউ কেউ নিজের পূর্ব পরিচয় গোপন করে আশ্রয় চায় ‘পুরুষ’এর কাছে। সেজে ওঠে ‘দম্পতী’। পক্ষান্তরে কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে ‘দম্পতী’
শব্দের সন্ধি ভেঙ্গে ‘পত্নী’টিকে ভিড়ে যেতে হয়, অকস্মাৎ ঐ ‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার’
মিছিলে ... তাদের ঠাঁই হয় জেলখানায়, লোক চক্ষুর আড়ালে ... এখানে এসে মনে পড়ে Michel Foucault, তাঁর Madness
and Civilization: Leprosy disappeared, the leper vanished, or almost, from
memory; these structures (কুষ্ট রোগীদের নিমিত্ত নির্মীত জেলখানা স্বরূপ হাসপাতাল গুলি )remained.
Often, in these same places, the formulas of exclusion would be repeated,
strangely similar two or three centuries later. Poor vaga-bonds, criminals, and
"deranged minds" would take the part played by the leper, ... আজ যখন পথে পথে ঘুরে বেড়ানো উন্মাদের সংখ্যা কিছুটা কমে গেছে তখন ঐ শূন্য স্থান পূর্ণ করতেই যেন ঐ সব মহিলাদের ধরে আনা যারা প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া, অর্থাভাবে গয়না বন্ধক দিতে যাওয়া বা (স্বামী দ্বারা পরিত্যক্তা হয়ে) ‘পুরুষহীন’
হয়ে চলাফেরা করা ‘হেন মারাত্মক অপরাধে অপরাধী ... প্রকৃত অর্থে, যেমন বলেছেন ফুকো, ঐ একই গ্রন্থে, যে, যেহেতু তথাকথিত reason তার সীমবদ্ধতা হেতু ব্যাখ্যা করতে অক্ষম হয় উন্মাদের unreason কে তাই ঐ না বোঝাটিকে সে চোখের আড়াল করে দিতে চায়। এখানে reason হয় তার power game এর মূল ঘুঁটি, ঠিক একই ভাবে ঐ মহিলাদের (আসলে ঐ সমাজের সমস্ত মহিলাদেরই) সাধ-স্বপ্নকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ ‘ব্যবস্থা’
তাকে সড়িয়ে দেয় চোখের আড়ালে। জেল খানায়। পরবর্তে কায়েম রাখে তার আধিপত্য ...
যদি ‘ইরান’
বা বিশেষ কোনো সময় ও সমাজকে বাদও দিই তাহলেও পানাহির সার্কল এই কথা বলে, যে, যখনি এক দল মানুষের সাধ-স্বপ্নকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় তথাকথিত ‘সমাজ’
বা ‘ব্যবস্থা’তখন তাকে সে সড়িয়ে দিতে চায় চোখের আড়ালে ... সেই ‘একদল’
কখনো ইরানের মহিলা, কখনো সত্তরের দশককে ‘মুক্তির দশক’
করে তোলার স্বপ্নে বিভোর যুবক-যুবতী, কখনো তিয়ানম্যান স্কোয়ারে জমায়েত হওয়া ছাত্র-ছাত্রী, কখনো জালিয়ানোয়ালা বাগের অহিংস জনতা ...
‘সার্কল’
ছবিটি দেখতে দেখতে মিশেল ফুকো’কে মনে পড়ে আবারো ।
তাঁর History of Sexuality তে আমরা দেখেছি শুধু Sex নয়, sex বিষয়ে আলোচনাও কিকরে হয়ে ওঠে ক্ষমতার প্রতীক। ‘সার্কল’
এ আমরা দেখি সিগারেট খাওয়ার মতো তুচ্ছ বাস্তবতা কি ভাবে নেয় ঐ স্থান। পক্ষান্তরে ‘ক্রিম্সন্-গোল্ড’এ দেখি হুসেনের হবু শ্যালক হুসেনকে বলে যে সে তার বাবাকে সম্মান করে বলে বাবার সামনে সে সিগারেট খায়না, খায়না হুসেনের সামনেও। অথচ হুসেনকে সে সিগারেট জ্বালিয়ে দেয়। মোটর বাইকে হুসেনের পেছনে বসে সে সিগারেট খায়। এখানে এসে ‘সম্মান জানানো’
প্রক্রিয়াটির অন্তর্গত ক্ষমতা-সমীকরনের অন্য একটি সংজ্ঞা নির্মাণ করতে চান না’কি জাফর পানাহি? – হয়তো চান, নাহলে পানাহি ছাড়া অন্যদের ছবিতে কেন এভাবে উঠে আসেনা ‘স্বর্গ নেই, স্বপ্নের স্বর্গ নেই’
এর ঐ বদ্ধ বাস্তবতা? এই মুহুর্তে মনে পড়ছে অন্য যে সব প্রিয় ইরানি ছবি গুলির কথা সে গুলিতে মানুষকে সিঁড়ির মতো ব্যবহার করে পরিচালক বলেছেন বহু বহু গভীরতর নীলাকাশের কথা ।
এলোমেলো ভাবে আমার মনে আসছে কিছু
নামঃ
Children of Heaven (1997) মজিদ মজিদি
The Cyclist (1987) মহসীন ম্যাক্বালেফ্
আব্বাস কির্মাস্তমি’র Koker Trilogy (1987–94),
Taste of Cherry (1997), and The Wind Will Carry Us (1999).Where Is the Friend's
Home?, And Life Goes On (1992) (অন্য নামঃ Life and Nothing More),
Through the Olive Trees (1994),Pedar/ Father
(1996), The Song of Sparrows
(2008) মজিদ মিজিদি ...
কিন্তু আকাশের ঐ বদ্ধতার, খন্ডতার কথা শুনেছি কি এই ছবি গুলিতে? মনেহয় শুনিনি, মনেহয় জাফর পানাহি’
ঐ বদ্ধতাকে পর্দায় হাজির করার অপরাধেই হারালেন স্বাধীনতা। তাঁকে গিলে খেতে চাইলো ঐ ‘বৃত্ত’।
কিন্তু সক্ষম হলো কি? এতাবৎ? যদি হতো তাহলে কি জন্ম হতো This Is Not a Film নামের ছবির? Genre এর? ...
৩।
The Circle এর ‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো’
চরিত্র গুলি বৃত্ত ভাঙতে চায়না। এরা বৃত্তের পরিধিতে ঘুরে ঘুরে খোঁজ করে ফাটলের, ছিদ্রের যা দিয়ে নিজে গ’লে যাওয়া যায়, গলিয়ে দেওয়া যায় সন্ততিকে। পক্ষান্তরে Crimson Gold’ এর হুসেন ঐ ভাবেই, বৃত্তীয় দেওয়ালের শরীরে ফাটলের খোঁজ করতে করতে এক সময় যেন ভেঙ্গে ফেলতে চায় ঐ দেওয়ালকে, ঐ বৃত্তকে। এই হঠাৎ ভেঙ্গে ফেলতে চাওয়ার মর্মেও থাকে একটি প্রায় অবাস্তব অভিজ্ঞতা। অর্ডার করা পিজা পৌঁছে দিতে সে হাজির হয় এক প্রাসাদোপম ফ্ল্যাটে যাতে রয়েছে সদ্য আমেরিকা ফেরৎ এক যুবক। আমেরিকায় তার মা বাপ থাকে। সে’ও ছিল কিছু কাল কিন্তু ফিরে এসেছে হোম্ সিক্নেসের তাড়নায়। ঐ যুবক পিজা অর্ডার করেছিল তার বান্ধবীদের জন্য যাদেরকে সে এখন ‘whore’ শব্দেই চিহ্নিত করছে। সেই ‘whore’ দুজন পিজার অর্ডার দিতে বলেছিল ঠিক, কিন্তু পিজা এসে পৌঁছানোর আগেই তারা চলে যায়। এবার, শূন্য প্রাসাদে তিন তিনটে পিজা নিয়ে কি করবে সে? তাই সে পিজা গুলি হুসেনিকেই বলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে নিতে। কিন্তু হুসেনও ত’
একা। তিনিটে পিজা দিয়ে কি করবে সে? এবার সেই যুবক বলে যে তবে ত বেশ ভালোই হলো, আমিও একা, তুমিও একা ...এসো দুজনে মিলে এখানে পিজা খাই... ইত্যবসরে আমি আমার ‘কথা’
গুলি বলি তোমাকে ... (এখানে ঐ যুবকের একাকীত্ব মনে পড়ায় Kar Wai Wong বা Wong Kar Wai’র ‘My Blueberry Nights’ এর সেই কোটিপতির কন্যাটিকে যে কেবল মাত্র ঐ ‘কথা’টুকু বলবার প্রয়োজনে মিথ্যা অছিলায় আটকে রেখেছিল ভাগ্যান্বেষী এলিজাবেথকে ...) ... ঐ রাত্রে, ঐ প্রাসাদোপম গৃহটি, ক্রমে, হুসেনের মর্মে হয়ে ওঠে এক objective correlative ... ঐ বিত্তের আনাচে কানাচে ঘুরতে ঘুরতে যেন সে টের পায় ঐ যুবকের প্রয়োজন নেই ঐ বিত্তে , কেননা ঐ যুবক জানেনা ঐ বিত্তের প্রকৃত ব্যবহার ।
পক্ষান্তরে তার প্রয়োজন আছে ঐ বিত্তে ।
হয়তো ঐ অনুভবই তার মর্মে ফিরিয়ে আনে সেই জুয়েলারী-শপ্ আর তার ম্যানেজারকে যে ম্যানেজার বার বারই তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে ঐ দোকানে ঢুকবার ‘যোগ্য’
সে নয় । সে প্রথমে ভাড়া করা পোশাকে বড়লোক সেজে ঢুকেছিল, ঠিক, কিন্তু এইবার সে আর ঐ ভাবে ঢুকতে নারাজ ... এইবার সে চায় ঐ ‘নিয়ম’
কে ভেঙ্গে ফেলতে যে নিয়মে ঐ দোকানে ঢোকার সে অযোগ্য, যে নিয়মে The Circle এ মহিলারা ধূমপান করতে পারেনা প্রকাশ্যে, পুরুষের সঙ্গ ছাড়া অধিকার পায়না বাসে ট্রেনে ভ্রমনের, যে নিয়মে কন্যা সন্তান ও তাকে জন্ম দেওয়ার কারনে তার মাতা হয় ‘অপয়া’ ... তাকে এসে আশ্রয় নিতে হয়, অবশেষে, জেলের কুঠুরীতে ...
ঐ সমস্ত নিয়মের প্রতীক হয়ে হুসেনের সামনে মূর্ত্তি নেয় জুয়েলারী-শপ্ এর ম্যানেজারটি। ঐ দোকানের ‘মিলিয়ন ডলার’
দামের ‘জুয়েলারী’
হয়ে ওঠে হুসেনের মুক্তি পরোয়ানার প্রতীক। ফলতঃ সে সকাল সকাল হানা দেয় ঐ জুয়েলারী-শপ্’এ। হেলমেটে আজ তার মুখ ঢাকা অথচ সে কখনো হেলমেট, পরেনা বলে তার অফিস কর্তৃপক্ষ তাকে শাসিয়েছে বহুবার ... আজ সে হেল্মেটে মুখ ঢাকে কেননা আজ সে অন্য দিনের ‘হুসেন’
নয়। এক অন্য হুসেন। সে ছিনিয়ে আনতে যাচ্ছে তার ‘অধিকার’, তার অস্তিতের বৈধতা ... হবু শ্যালককে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে সে ঢুকেযায় জুয়েলারী-শপ্’এ ... পাঠক, তারপর ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলির বৃত্তান্ত আপনাদের জানা ... যাঁদের জানা নয় অনুরোধ করবো ছবিটি দেখে জেনে নিতে ... ঐ পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে, পাঠক, আপনি প্রকৃতই অনুভব করবেন যেন একটি যুগের অবসান ...
ম্যানেজারটি ‘এলার্ম’
বেল্ টিপে দিলে লোক জড়ো হয়। হুসেনের পালানোর পথ যায় বন্ধ হয়ে। এবার? এবার সে জেলে যাবে। সে জেলে যাবে? আবার ফিরে যাবে ঐ বৃত্তে? না। তা হয়না। সে বৃত্ত ভাংবে। ঐ মুহুর্ত্তে তার কাছে ঐ বৃত্তের প্রতীক একটিই মানুষ, সে ঐ জুয়েলারী-শপ্ এর ম্যানেজার। ফলতঃ হুসেনের গুলি স্বাভাবিক ভাবেই তার খুলি দেয় উড়িয়ে।
মুহুর্তের মধ্যে বদলে যায় বাস্তবতা। এবার? এবার কি ভাঙ্গলো বৃত্ত? দোকান ঘিরে ফেলছে লোকজন। আসছে পুলিশ। এবার? এবার তাকে ধরা দিতে হবে। যেতে হবে জেলে ঐ বৃত্তীয় নিয়মেই। না। এ’ও হয়না। অতএব এইবার বৃত্তের প্রতীক সে নিজে। তার অস্তিত্ত্ব। সে গুলি চালায় নিজের কপালে ...
অর্থাৎ, কামু’র ‘আউটসাইডার’
যে খুনটি করেছিল এবং নিজেকে দিয়েছিল ধরিয়ে তার মূল্যে সেই চরত্রটি কিনে নিয়েছিল নিজের ‘আউটসাইডার’
পদবী। জানিয়েছিল তার অস্তিত্ত্বের মর্মে রয়েছে কেবলি শূন্যতা । জানিয়েছিল ঐ শূন্যতার কাছে অন্যকে বধ করা বা নিজে বধ হওয়ার কোনো তফাৎ নেই। গোদারের মিচেলও চায়নি বৃত্ত ভাঙ্গতে। সে’ও খুঁজছিল গ’লে যাওয়ার মতন একটি ফাটল। এক সময় তার ক্লান্তি তাকে নিরস্ত করলো ঐ সন্ধান থেকে। সে আথঘাতী হলো পুলিশের গুলিতে। কিন্তু এই হুসেন, এই হত্যা আর আত্মহত্যার মূল্যে যাকে প্রতিষ্ঠা করলো তার নাম জীবন। The Circle’এ, ২০০০ সালে যে বৃত্ত নির্মাণ করেছিলেন পানাহি, ২০০৩ সালে তা’ই ভাঙ্গতে তিনি হলেন প্রস্তুত ...
কিন্তু ভাঙ্গলো কি বৃত্ত? হুসেনের আত্মহত্যা প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠলেও হলোনা সঠিক প্রতিবাদ যে প্রতিবাদ ফলপ্রসূ। তার জন্য আমাদের প্রতীক্ষা করতে হলো আরো আট বছর। ২০১০ সাল পর্যন্ত। ২০১০ সালে পানাহি নির্মাণ করলেন The Accordion যা ব্যাকরনগত ভাবে একটি শর্টফিল্ম এবং আমার অতি প্রিয় ছবি ঐ The Accordion ।
The Accordion এর কাহিনীধারা সরল ( তবে সহজ নয় কদাপি), The Accordion এর কাহিনী তার প্রায় অনুপস্থিত অবয়বে যে অ-নে-ক কথা বলে তার একটি কথা এই, যে, বৃত্তের শরীরের ফাটল ধরে গ’লিয়ে আনা যায়না অস্তিত্বকে, নিজের কিংবা অন্যের খুলিতে গুলি চালিয়ে বা পাথর ছুঁড়ে মেরে ভেঙ্গে ফেলা যায়না বৃত্ত ।
The Accordion বলে, যে, স্বর্গ হয়তো নেই তথাপি মানুষ তার সরলতম আবেগে, সহজতম ইচ্ছায় গড়ে নিতে পারে স্বর্গের সিঁড়ি ... আর ঐ সিঁড়ি বেয়েই সে পার হতে পারে এই বৃত্ত, ভেঙ্গে ফেলতে পারে এই বৃত্ত ।
ঠিক যেমন নিজের ধ্বজা টিকে ভেঙ্গে ফেলে অন্যকে শুধু নয়, নিজেকেও মুক্ত করতে নেমেছিলেন ‘রক্তকরবীর রাজা, শেষ দৃশ্যে ।
এই তিনটি ছবি, পানাহি’র, আমার মর্মে তাই নির্মাণ করে এক নির্বিকল্প ট্রিলজি’র।
৪।
অন্তিমে আমার মনে পড়ছে আরো দুইটি সিনেমার কথা। ১৯৩৯’এ রেনোয়ার ‘রুল্স্ অফ্ দ্য গেইম’ আর ১৯৪৮’এ দেসিকা’র ‘বাইসাইকেল থীফ্স্’। প্রথমটি ফরাসী নিউ ওয়েভ্ এর জন্মদাতা বা ঐ ঘরানার একটি মুখ্য ছবি। দ্বিতীয়টি দ্বারা ইটালীয়ান নিও রিয়েলিস্ট ধারার সূত্রপাত। কিন্তু ইরানী ছবিতে আমি যেন ছায়া দেখতে পাই দেসিকার যেন টের পাই ইরানী পরিচালকেরা এই সত্য টিকে মর্মে জেনেই আসেন সিনেমা করতে, যে, অভিজাত সম্প্রদায়, সব দেশের, সব জাতির, সব সময়ের – মৃত। ফলে তাদের জীবনের অন্তঃশ্বাসশূন্যতাকে খুঁড়ে আজ আর অন্ধকারকেও সঠিক ভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। তাই রেনোয়ার মতো তাঁরা অভিজাত সমাজের কেচ্ছাকে সচরাচর করেন না উপজীব্য। ফলে তাঁদের সিনেমা ভাষাও বদলে যায়। তথাপি উপস্থাপনার প্রশ্নে পানাহি, অন্ততঃ এখানে আলোচিত তিনটি ছবির দুটিতেই একটু অ-ইরানী। অন্যেরা যখন ধীরে ধীরে, দর্শককে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় ঢুকিয়ে দেন কাহিনীর কেন্দ্রে সেখানে ‘সার্কল’ আর ‘ক্রিম্সন্ গোল্ড’
এর পানাহি প্রথমেই দর্শকের সামনে এনে হাজির করেন এমন এক খন্ড ঘটনা যা দর্শককে এক টানে উপড়ে নিয়ে আসে তার নিজস্ব বাস্তবতা থেকে। তারপর আর ছবিটি আগাগোড়া না দেখে উপায় থাকেনা দর্শকের ।
সপ্তর্ষি বিশ্বাস, এপ্রিল ৫-১০, ২০১২
জাফর পানাহি ও তাঁর
‘বৃত্ত’
সৌজন্য 'মিরুজিন, সংখ্যা ২, ১৪ই আষাঢ়, উল্টোরথ, ১৪১৯
১।
কামু’র ‘আউটসাইডার’এর
প্রোটাগোনিষ্ট যখন হঠাৎই গুলি করে খুন করে ফেল্লো একজন মানুষকে এবং কোনো চেষ্টাই
করলো না আত্মরক্ষার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের , চরিত্রটির শ্রষ্টা কামু যখন এই হত্যার
কোনো হেতুই উল্লেখ করতে অস্বীকার করলেন গোটা উপন্যাস-শরীরে, সেই ১৯৪২ সালে,
ইউরোপীয় আধুনিকতা যে বিন্দুতে গিয়ে দাঁড়ালো তার মুখোমুখি, ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া
গোদারের ‘ব্রেথ্লেস্’ ছবির গাড়ি চোর প্রোটাগোনিষ্ট – শেষ দৃশ্যে যে ইচ্ছে করলেই
পালাতে পারতো পুলিশের হাত থেকে, অথচ পালালো না, কারন হিসেবে জানান দিলো সে পালাতে
পালাতে এখন ক্লান্ত এবং ঐ ক্লান্তির মূল্যে সে পুলিশের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পরলো
রাজপথে –
তাকে দাঁড় করিয়ে
দিলে ইউরোপীয় আধুনিকতার একটি গতিপথ হয়তো লক্ষ্য করা যেতে পারে।
কামু’র আউটসাইডারের মর্মের
যে শূন্যতার বোধ, যে ‘স্ট্রেঞ্জ্নেস্’ তা যতোদূর অনুধাবনীয় তার চেয়ে ঢের
অনুধাবনীয় গোদারের প্রোটাগোনিষ্টের ক্লান্তি কেননা সে ‘আউট্সাইডার’ নয়, মানুষ
হিসাবে তার কামনা-বাসনা, তার জিজীবিষা সবই বহুদূর অনুধাবনীয়। সে কামু’র Meursault এর মতো ‘পেটি বুর্জোয়া’ নয়। বরং সে, Michel, সেই
শ্রেণীরই খুব কাছাকাছি যাদের ‘শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার আর কিছু নেই’ ... কাছাকাছি, তবু
সে তা নয় কেননা সে ঐ ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন না ঘটাতে না চেয়ে বরং ঐ ব্যবস্থাতেই
আশ্রয় চায়, চায় প্রেম ... কিন্তু এই ব্যবস্থা তা’কে সে সব কিছু না দিয়ে বরং বেড়ায়
তাড়া করে ... ফলতঃ এক সময় ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ই হয়ে ওঠে তার নিয়তি ... পক্ষান্তরে
কামু’র প্রোটাগোনিষ্টের যে ক্লান্তি তা’ও যদিও ‘আত্মঘাতী’ কিন্তু সমান্তরালে সে
ঘাতকও বটে।
প্রায় ভুলে
যাওয়া ঐ দু’টি চরিত্রের কথা মনে এলো জাফর পানাহি’র ‘ক্রিমসন্ গোল্ড্’ (Talaye sorkh, ২০০৩) ছবিটি ফিরে দেখতে বসে
কেননা এখানেও, একটি হত্যা এবং আত্মহত্যা প্রথম দৃশ্য থেকেই তাড়া করে ফেরে দর্শককে
... কিন্তু এখানে হত্যাকারী ‘হুসেন’ না’ত কামু’র আউট সাইডার, না’ত সে গোদারের
মিচেল ... তার যে সংকট তা দিনগত প্রাণ ধারনের সংকট। সে বেঁচে থাকতে চায়। সে আনন্দ
পায় মোটর সাইকেলে চেপে ঘুড়ে বেড়াতে। সে বাঁচিয়ে রাখতে চায় অন্যকে। পেটের দায়ে বয়স
বাড়িয়ে সৈন্যদলে ঢুকে পড়া বালকের ক্ষুধার্ত মুখ তাকে বাধ্য করে বিলিয়ে দিতে সেই
পিজা যা তাকে দেওয়া হয়েছিল খদ্দেড়কে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। মোটর বাইকে ঘুরে ঘুরে বাড়ি
বাড়ি গিয়ে পিজা পৌঁছে দিয়ে আসার চাকরীটি ছাড়াও সে, তার হবু শ্যালকের সঙ্গে মিলে
করে পকেট-মারা’র ব্যবসা। আশ্চর্য এই, যে, ঐ পকেট মারার ব্যবসাতেও ছায়া ফেলে তার
জীবন তৃষ্ণা ... এই যার চরিত্র সে কেন খুন করে ফেলে, প্রায় অকারনেই একজন মানুষকে?
কেন খুন করার পরেও, তার বন্ধু যখন জীবনপণ আশ্বাস দেয় ‘আমি আছি তোমার সঙ্গে...’ সে
কেন পরবর্তী গুলিটি চালিয়ে দেয় তার নিজের খুলিতে? এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজবার আমার
যে ব্যক্তিগত প্রয়াস, পাঠক, তা’ই আমি আপনার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিচ্ছি এই রচনায়
এতদ্ভিন্ন এই ইন্টারনেট্-সময়’এ তথ্য নিয়ে আলোচনা
করার কোনো অর্থ হয়না কেননা উৎসাহি পাঠক চাইলেই পানাহি আর তাঁর সিনেমা বিষয়ে অসংখ্য
তথ্য সংগ্রহ করে নিতে পারেন ইন্টারনেটে। অতএব এই ইন্টারনেট সময়ে আলাপ আলোচনায়,
তথ্য নয়, অনুভবের ভাগাভাগিই বোধকরি একমাত্র অর্থবহ বিনিময় ...
২০০৩ সালে তোলা এই ছবিটির আগে, ২০০০ সালে জাফর পানাহি
নির্মাণ করে ফেলেছেন ‘The Circle’, যা আমার মতে শুধু নয়, বিশ্ব সিনেমার প্রায় সমস্ত
দর্শক-সমালোচকদের মতেই তাঁর প্রথম পরিণত ছবি। সেই ছবি ঝড় তুলেছে সিনেমা-ইতিহাসে,
পানাহি পেয়েছেন ভেনিসের গোল্ডেন-লায়ন ... সে সমস্ত আজ সর্বজনজ্ঞাত । ঐ চবিটি বিষয়ে
পানাহি’র যে কথাটি আমাকে ভাবিত করে তা হলো এই, যে, ‘The Circle’ এ পানাহি
মূলতঃ দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিয়তিকেঃ Panahi
sees the new work as an artistically more mature piece. It is his examination,
as he indicated to us, of the fate of his child characters, so to speak, when
they grow up. The difficulties of childhood now assume quite different
proportions. ( সূত্র WSWS) বিশদ আলোচনায় যাওয়ার আগে এখানে শুধু এ
টুকু বলে নিই, যে, ‘The Circle’ অন্তিমে, তার বহুমাত্রিক
গমনের শেষে, বলে একটি কথা’ই – স্বর্গ নেই। স্বপ্নের স্বর্গ নেই। নিজ নিজ স্বপ্নকে
অবয়ব দিতে চেয়ে যে যে পথেই ছুটে যাক অবশেষে তাদের ক্ষমতা নেই সেই বৃত্তকে ভেঙ্গে
বার হয়ে আসার যে বৃত্তের প্রতীক শেষ দৃশ্যের জেলখানা ... যে জেলখানাকে পানাহি
হাজির করেছেন প্রথম দৃশ্যের হাসপাতালের সমান্তরালে .... এখানে এসে মনেপড়ে ঋত্বিকের
‘সুবর্ণরেখা’র সেই দৃশ্য যখন ঈশ্বর চক্রবর্তী নিজেকে পরাজিত ভেবে চলেছে আত্মহত্যা
করতে আর তখনি এসে হাজির হচ্ছে হরপ্রসাদ ... বলছে যে পথেই যাও না কেন অবশেষে ঐ
পরাজয়ই ধ্রুব ... পাঠক জ্ঞাত আছেন যে, একটি চাকরি পেয়ে নিজের ছোট্ট বোনটিকে একটি
‘ঘর’ দেওয়ার বাসনা নিয়ে উদ্বাস্তু কলোনীর থেকে চলে এসেছিল ঈশ্বর চক্রবর্তী আর
হরপ্রসাদ, পক্ষান্তরে ঐ উদ্বাস্তু কলোনী আঁকড়ে পরেছিল সমস্ত উদ্বাস্তুদের স্বপ্নকে
অবয়ব দেওয়ার আকাঙ্খায় ... এ’ও বৃত্ত। এতোদূর একটি বৃত্ত নির্মাণ করেছিলেন ঋত্বিকও।
কিন্তু তারপর, ঐ ছবিতেই, ঐ বৃত্তকে ভেঙ্গে ঋত্বিক এগিয়ে নিয়ে চললেন ঈশ্বর
চক্রবর্তী’কেই ... এবার তার হাত ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, মৃত বোন সীতার নাবালক ছেলে
... তারও চোখে স্বপ্ন, তার মা’র মতোই, ঘরের, নীড়ের ...
পানাহি’র ‘The Circle’ বলেনা বৃত্ত ভাঙ্গার কথা। বলে
বৃত্ত ভাঙ্গার স্বপ্নগুলির ভেঙ্গে যাওয়ার কাহন। ঐ বলাও এক অভূতপূর্ব ভঙ্গীতে। যেন
একটি রীলে রেস। একটি চরিত্রকে ধরে কাহিনী এগিয়ে চলে কিছুদূর। জানা যায় ঐ চরিত্রটির
আশা, সাধ, স্বপ্ন এবং তার অব্যবহিত পরেই সে মিলিয়ে যায় ... কোথায়? আপাতঃ ভাবে জানা
যায়না। পরিবর্তে চরিত্রটি, যেতে যেতে, তার কাহিনী-মশাল দিয়ে যায় অপর চরিত্রকে ...
এবং অবশেষে সেই সমস্ত হারিয়ে যাওয়া চরিত্র একত্রিত হয় জেলখানার অন্ধকার কুঠুরীতে
... ইঙ্গিত বলতে রয়েযায় ঐ শিশুটি যাকে আলোকিত জীবন দেওয়ার স্বপ্নে তার মা তাকে
ফেলে পালিয়ে আসে ... তারপর অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে, যেন কুন্তী, যেন Moses’এর মাতা Yoshebel ... সেই শিশু কন্যাটিকে
নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, তাকে এবার ভরন-পোষন করবে ‘সরকার’ সে বড়ো হবে ... ভালো হবে ... মা’টি
চেয়েছিল ঐ কন্যাটিকে নিয়ে যাক কোনো সূত অধীরথ কিন্তু পরবর্তে সরকারী অনাথ আশ্রমের
হানাদারিকে সে মেনে নেয় ... আশায় আপনাকে সংহত করতে চায় মা’টি ... কিন্তু মা’টির
মনেও যেমন, আমাদের মনেও তেমনি রয়েযায় প্রশ্ন, যে সরকার, যে ‘ব্যবস্থা’র অত্যাচারে
ঐ মা এবং আরো অসংখ্য মা, ভগিনী আজ জীবন্মৃত তার হাতে কি করে সঠিক ভাবে বেড়ে উঠবে ঐ
শিশু?...
২।
স্বর্গ নেই।
স্বপ্নের স্বর্গ নেই। আছে শুধু এক বৃত্ত। এক Vicious circle। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ,
মনেপড়েঃ সেখানে মানুষগুলো সব ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো / ইতস্তত
ঘুরে বেড়াচ্ছে /মশালের
আলোয় ছায়ায় তাদের মুখে /বিভীষিকার উল্কি পরানো ...
পানাহি’র ‘সার্কল’এ’ও তাই। শুধু মানুষের পরবর্তে এক বিশেষ
লিঙ্গের মানুষ। তারা মহিলা। মহিলাদের মধ্যেও তাদের শ্রেণী আলাদা। ‘পুরুষের
প্রতিরক্ষাহীন মহিলা’। প্রতিটি পুরুষ এদের অশালীন ইঙ্গিত করে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা
চায় পরিচয় পত্র। পথচলতি তথাকথিত দম্পতী এদের দেখে সন্দিগ্ধ চোখে। আবার ঐ দলেরি কেউ
কেউ নিজের পূর্ব পরিচয় গোপন করে আশ্রয় চায় ‘পুরুষ’এর কাছে। সেজে ওঠে ‘দম্পতী’।
পক্ষান্তরে কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে ‘দম্পতী’ শব্দের সন্ধি ভেঙ্গে ‘পত্নী’টিকে
ভিড়ে যেতে হয়, অকস্মাৎ ঐ ‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার’ মিছিলে ... তাদের ঠাঁই হয়
জেলখানায়, লোক চক্ষুর আড়ালে ... এখানে এসে মনে পড়ে Michel Foucault, তাঁর Madness and
Civilization: Leprosy disappeared, the
leper vanished, or almost, from memory; these structures (কুষ্ট রোগীদের নিমিত্ত নির্মীত জেলখানা স্বরূপ হাসপাতাল
গুলি )remained. Often, in these
same places, the formulas of exclusion would be repeated, strangely similar two or three centuries later.
Poor vaga-bonds, criminals, and "deranged minds" would take the part played by the
leper, ... আজ যখন পথে পথে ঘুরে
বেড়ানো উন্মাদের সংখ্যা কিছুটা কমে গেছে তখন ঐ শূন্য স্থান পূর্ণ করতেই যেন ঐ সব
মহিলাদের ধরে আনা যারা প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া, অর্থাভাবে গয়না বন্ধক দিতে যাওয়া
বা (স্বামী দ্বারা পরিত্যক্তা হয়ে) ‘পুরুষহীন’ হয়ে চলাফেরা করা ‘হেন মারাত্মক অপরাধে অপরাধী ... প্রকৃত অর্থে, যেমন
বলেছেন ফুকো, ঐ একই গ্রন্থে, যে, যেহেতু তথাকথিত reason তার সীমবদ্ধতা হেতু ব্যাখ্যা করতে
অক্ষম হয় উন্মাদের unreason কে তাই ঐ না বোঝাটিকে সে চোখের
আড়াল করে দিতে চায়। এখানে reason হয় তার power game এর মূল ঘুঁটি, ঠিক একই ভাবে ঐ মহিলাদের (আসলে ঐ সমাজের সমস্ত মহিলাদেরই)
সাধ-স্বপ্নকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ ‘ব্যবস্থা’ তাকে সড়িয়ে দেয় চোখের আড়ালে। জেল
খানায়। পরবর্তে কায়েম রাখে তার আধিপত্য ...
যদি ‘ইরান’ বা
বিশেষ কোনো সময় ও সমাজকে বাদও দিই তাহলেও পানাহি’র সার্কল এই কথা বলে, যে, যখনি এক
দল মানুষের সাধ-স্বপ্নকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় তথাকথিত ‘সমাজ’ বা
‘ব্যবস্থা’তখন তাকে সে সড়িয়ে দিতে চায় চোখের আড়ালে ... সেই ‘একদল’ কখনো ইরানের মহিলা,
কখনো সত্তরের দশককে ‘মুক্তির দশক’ করে তোলার স্বপ্নে বিভোর যুবক-যুবতী, কখনো
তিয়ানম্যান স্কোয়ারে জমায়েত হওয়া ছাত্র-ছাত্রী, কখনো জালিয়ানোয়ালা বাগের অহিংস
জনতা ...
‘সার্কল’ ছবিটি
দেখতে দেখতে মিশেল ফুকো’কে মনে পড়ে আবারো ... তাঁর History of Sexuality তে আমরা দেখেছি শুধু Sex
নয়, sex বিষয়ে আলোচনাও কিকরে হয়ে ওঠে ক্ষমতার
প্রতীক। ‘সার্কল’ এ আমরা দেখি সিগারেট খাওয়ার মতো তুচ্ছ বাস্তবতা কি ভাবে নেয় ঐ
স্থান। পক্ষান্তরে ‘ক্রিম্সন্-গোল্ড’এ দেখি হুসেনের হবু শ্যালক হুসেনকে বলে যে
সে তার বাবাকে সম্মান করে বলে বাবার সামনে সে সিগারেট খায়না, খায়না হুসেনের
সামনেও। অথচ হুসেনকে সে সিগারেট জ্বালিয়ে দেয়। মোটর বাইকে হুসেনের পেছনে বসে সে
সিগারেট খায়। এখানে এসে ‘সম্মান জানানো’ প্রক্রিয়াটির অন্তর্গত ক্ষমতা-সমীকরনের
অন্য একটি সংজ্ঞা নির্মাণ করতে চান না’কি জাফর পানাহি? – হয়তো চান, নাহলে পানাহি
ছাড়া অন্যদের ছবিতে কেন এভাবে উঠে আসেনা ‘স্বর্গ নেই, স্বপ্নের স্বর্গ নেই’ এর ঐ
বদ্ধ বাস্তবতা? এই মুহুর্তে মনে পড়ছে অন্য যে সব প্রিয় ইরানি ছবি গুলির কথা সে
গুলিতে মানুষকে সিঁড়ির মতো ব্যবহার করে পরিচালক বলেছেন বহু বহু গভীরতর নীলাকাশের
কথা ... এলোমেলো ভাবে আমার মনে আসছে যে ছবি গুলির কথা তারা এরকমঃ
Children of Heaven (1997) মজিদ মজিদি
The Cyclist (1987) মহসীন ম্যাক্বালেফ্
আব্বাস কির্মাস্তমি’র Koker Trilogy (1987–94), Taste of Cherry (1997), and The Wind
Will Carry Us (1999).Where Is the Friend's Home?, And Life
Goes On (1992) (অন্য নামঃ Life and Nothing More), Through the Olive
Trees (1994),Pedar/ Father (1996), The Song of Sparrows (2008) মজিদ
মিজিদি ...
কিন্তু আকাশের ঐ বদ্ধতার, খন্ডতার কথা শুনেছি কি এই ছবি
গুলিতে? মনেহয় শুনিনি, মনেহয় জাফর পানাহি’
ঐ বদ্ধতাকে পর্দায় হাজির করার অপরাধেই হারালেন স্বাধীনতা। তাঁকে গিলে খেতে চাইলো ঐ
‘বৃত্ত’ ... কিন্তু সক্ষম হলো কি? এতাবৎ? যদি হতো তাহলে কি জন্ম হতো This Is Not a Film নামের ছবির? Genre
এর? ...
৩।
The Circle এর ‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো’ চরিত্র গুলি বৃত্ত ভাঙতে চায়না। এরা
বৃত্তের পরিধিতে ঘুরে ঘুরে খোঁজ করে ফাটলের, ছিদ্রের যা দিয়ে নিজে গ’লে যাওয়া যায়,
গলিয়ে দেওয়া যায় সন্ততিকে। পক্ষান্তরে Crimson Gold’ এর
হুসেন ঐ ভাবেই, বৃত্তীয় দেওয়ালের শরীরে ফাটলের খোঁজ করতে করতে এক সময় যেন ভেঙ্গে
ফেলতে চায় ঐ দেওয়ালকে, ঐ বৃত্তকে। এই হঠাৎ ভেঙ্গে ফেলতে চাওয়ার মর্মেও থাকে একটি
প্রায় অবাস্তব অভিজ্ঞতা। অর্ডার করা পিজা পৌঁছে দিতে সে হাজির হয় এক প্রাসাদোপম
ফ্ল্যাটে যাতে রয়েছে সদ্য আমেরিকা ফেরৎ এক যুবক। আমেরিকায় তার মা বাপ থাকে। সে’ও
ছিল কিছু কাল কিন্তু ফিরে এসেছে হোম্ সিক্নেসের তাড়নায়। ঐ যুবক পিজা অর্ডার
করেছিল তার বান্ধবীদের জন্য যাদেরকে সে এখন ‘whore’ শব্দেই
চিহ্নিত করছে। সেই ‘whore’ দুজন পিজার অর্ডার দিতে বলেছিল ঠিক, কিন্তু পিজা
এসে পৌঁছানোর আগেই তারা চলে যায়। এবার, শূন্য প্রাসাদে তিন তিনটে পিজা নিয়ে কি
করবে সে? তাই সে পিজা গুলি হুসেনিকেই বলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে নিতে। কিন্তু হুসেনও ত’
একা। তিনিটে পিজা দিয়ে কি করবে সে? এবার সেই যুবক বলে যে তবে ত বেশ ভালোই হলো, আমিও
একা, তুমিও একা ...এসো দুজনে মিলে এখানে পিজা খাই... ইত্যবসরে আমি আমার ‘কথা’ গুলি বলি তোমাকে ... (এখানে
ঐ যুবকের একাকীত্ব মনে পড়ায় Kar Wai Wong বা Wong Kar Wai’র ‘My Blueberry Nights’ এর সেই কোটিপতির কন্যাটিকে যে কেবল মাত্র ঐ ‘কথা’টুকু বলবার প্রয়োজনে
মিথ্যা অছিলায় আটকে রেখেছিল ভাগ্যান্বেষী এলিজাবেথ’কে ...) ... ঐ রাত্রে, ঐ
প্রাসাদোপম গৃহটি, ক্রমে, হুসেনের মর্মে হয়ে ওঠে এক objective correlative
... ঐ বিত্তের আনাচে কানাচে ঘুরতে ঘুরতে যেন সে টের পায় ঐ যুবকের
প্রয়োজন নেই ঐ বিত্তে ... কেননা ঐ যুবক জানেনা ঐ বিত্তের প্রকৃত ব্যবহার ...
পক্ষান্তরে তার প্রয়োজন আছে ঐ বিত্তে ... হয়তো ঐ অনুভবই তার মর্মে ফিরিয়ে আনে সেই
জুয়েলারী-শপ্ আর তার ম্যানেজারকে যে ম্যানেজার বার বারই তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে ঐ
দোকানে ঢুকবার ‘যোগ্য’ সে নয় ... সে প্রথমে ভাড়া করা পোশাকে বড়লোক সেজে ঢুকেছিল,
ঠিক, কিন্তু এইবার সে আর ঐ ভাবে ঢুকতে নারাজ ... এইবার সে চায় ঐ ‘নিয়ম’ কে ভেঙ্গে
ফেলতে যে নিয়মে ঐ দোকানে ঢোকার সে অযোগ্য, যে নিয়মে The Circle এ মহিলারা ধূমপান করতে পারেনা
প্রকাশ্যে, পুরুষের সঙ্গ ছাড়া অধিকার পায়না বাসে ট্রেনে ভ্রমনের, যে নিয়মে কন্যা
সন্তান ও তাকে জন্ম দেওয়ার কারনে তার মাতা হয় ‘অপয়া’ ... তাকে এসে আশ্রয় নিতে হয়,
অবশেষে, জেলের কুঠুরীতে ...
ঐ সমস্ত নিয়মের প্রতীক হয়ে হুসেনের সামনে
মূর্ত্তি নেয় জুয়েলারী-শপ্ এর ম্যানেজারটি। ঐ দোকানের ‘মিলিয়ন ডলার’ দামের
‘জুয়েলারী’ হয়ে ওঠে হুসেনের মুক্তি পরোয়ানার প্রতীক। ফলতঃ সে সকাল সকাল হানা দেয় ঐ
জুয়েলারী-শপ্’এ। হেলমেটে আজ তার মুখ ঢাকা অথচ সে কখনো হেলমেট, পরেনা বলে তার অফিস
কর্তৃপক্ষ তাকে শাসিয়েছে বহুবার ... আজ সে হেল্মেটে মুখ ঢাকে কেননা আজ সে অন্য
দিনের ‘হুসেন’ নয়। এক অন্য হুসেন। সে ছিনিয়ে আনতে যাচ্ছে তার ‘অধিকার’, তার
অস্তিতের বৈধতা ... হবু শ্যালককে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে সে ঢুকেযায় জুয়েলারী-শপ্’এ
... পাঠক, তারপর ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলির বৃত্তান্ত আপনাদের জানা ... যাঁদের জানা নয়
অনুরোধ করবো ছবিটি দেখে জেনে নিতে ... ঐ পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে, পাঠক, আপনি
প্রকৃতই অনুভব করবেন যেন একটি যুগের অবসান ...
ম্যানেজারটি ‘এলার্ম’ বেল্ টিপে দিলে লোক জড়ো
হয়। হুসেনের পালানোর পথ যায় বন্ধ হয়ে। এবার? এবার সে জেলে যাবে। সে জেলে যাবে?
আবার ফিরে যাবে ঐ বৃত্তে? না। তা হয়না। সে বৃত্ত ভাংবে। ঐ মুহুর্ত্তে তার কাছে ঐ
বৃত্তের প্রতীক একটিই মানুষ, সে ঐ জুয়েলারী-শপ্ এর ম্যানেজার। ফলতঃ হুসেনের গুলি
স্বাভাবিক ভাবেই তার খুলি দেয় উড়িয়ে।
মুহুর্তের মধ্যে বদলে যায় বাস্তবতা। এবার?
এবার কি ভাঙ্গলো বৃত্ত? দোকান ঘিরে ফেলছে লোকজন। আসছে পুলিশ। এবার? এবার তাকে ধরা
দিতে হবে। যেতে হবে জেলে ঐ বৃত্তীয় নিয়মেই। না। এ’ও হয়না। অতএব এইবার বৃত্তের
প্রতীক সে নিজে। তার অস্তিত্ত্ব। সে গুলি চালায় নিজের কপালে ...
অর্থাৎ,
কামু’র ‘আউটসাইডার’ যে খুনটি করেছিল এবং নিজেকে দিয়েছিল ধরিয়ে তার মূল্যে সেই
চরত্রটি কিনে নিয়েছিল নিজের ‘আউটসাইডার’ পদবী। জানিয়েছিল তার অস্তিত্ত্বের মর্মে
রয়েছে কেবলি শূন্যতা । জানিয়েছিল ঐ শূন্যতার কাছে অন্যকে বধ করা বা নিজে বধ হওয়ার
কোনো তফাৎ নেই। গোদারের মিচেলও চায়নি বৃত্ত ভাঙ্গতে। সে’ও খুঁজছিল গ’লে যাওয়ার মতন
একটি ফাটল। এক সময় তার ক্লান্তি তাকে নিরস্ত করলো ঐ সন্ধান থেকে। সে আথঘাতী হলো
পুলিশের গুলিতে। কিন্তু এই হুসেন, এই হত্যা আর আত্মহত্যার মূল্যে যাকে প্রতিষ্ঠা
করলো তার নাম জীবন। The Circle’এ, ২০০০ সালে যে বৃত্ত নির্মাণ করেছিলেন পানাহি,
২০০৩ সালে তা’ই ভাঙ্গতে তিনি হলেন প্রস্তুত ...
কিন্তু ভাঙ্গলো কি বৃত্ত? হুসেনের আত্মহত্যা
প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠলেও হলোনা সঠিক প্রতিবাদ যে প্রতিবাদ ফলপ্রসূ। তার জন্য
আমাদের প্রতীক্ষা করতে হলো আরো আট বছর। ২০১০ সাল পর্যন্ত। ২০১০ সালে পানাহি
নির্মাণ করলেন The
Accordion ... যা ব্যাকরনগত
ভাবে একটি শর্টফিল্ম এবং আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি ঐ The Accordion ...
The Accordion এর কাহিনীধারা সরল ( তবে সহজ নয় কদাপি), The
Accordion এর কাহিনী তার
প্রায় অনুপস্থিত অবয়বে যে অ-নে-ক কথা বলে তার একটি কথা এ’ই, যে, বৃত্তের শরীরের
ফাটল ধরে গ’লিয়ে আনা যায়না অস্তিত্বকে, নিজের কিংবা অন্যের খুলিতে গুলি চালিয়ে বা
পাথর ছুঁড়ে মেরে ভেঙ্গে ফেলা যায়না বৃত্ত ... The Accordion বলে, যে, স্বর্গ হয়তো নেই তথাপি মানুষ তার
সরলতম আবেগে, সহজতম ইচ্ছায় গড়ে নিতে পারে স্বর্গের সিঁড়ি ... আর ঐ সিঁড়ি বেয়েই সে
পার হতে পারে এই বৃত্ত, ভেঙ্গে ফেলতে পারে এই বৃত্ত ...ঠিক যেমন নিজের ধ্বজা টিকে
ভেঙ্গে ফেলে অন্যকে শুধু নয়, নিজেকেও মুক্ত করতে নেমেছিলেন ‘রক্তকরবী’র রাজা, শেষ
দৃশ্যে ...
এই তিনটি ছবি,
পানাহি’র, আমার মর্মে তাই নির্মাণ করে এক নির্বিকল্প ট্রিলজি’র।
৪।
অন্তিমে আমার মনে
পড়ছে আরো দুইটি সিনেমার কথা। ১৯৩৯’এ রেনোয়ার ‘রুল্স্ অফ্ দ্য গেইম’ আর ১৯৪৮’এ দেসিকা’র ‘বাইসাইকেল থীফ্স্’।
প্রথমটি ফারাসী নিউ ওয়েভ্ এর জন্মদাতা বা ঐ ঘরানার একটি মুখ্য ছবি। দ্বিতীয়টি দ্বারা
ইটালীয়ান নিও রিয়েলিস্ট ধারার সূত্রপাত। কিন্তু ইরানী ছবিতে আমি যেন ছায়া দেখতে
পাই দেসিকা’র যেন টের পাই ইরানী পরিচালকেরা এই সত্য টিকে মর্মে জেনেই আসেন সিনেমা
করতে, যে, অভিজাত সম্প্রদায়, সব দেশের, সব জাতির, সব সময়ের – মৃত। ফলে তাদের
জীবনের অন্তঃশ্বাসশুন্যতাকে খুঁড়ে আজ আর অন্ধকারকেও সঠিক ভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব
নয়। তাই রেনোয়ার মতো তাঁরা অভিজাত সমাজের কেচ্ছাকে কদাপি করেন না উপজীব্য। ফলে
তাঁদের সিনেমা ভাষাও বদলে যায়। ‘ডিপ্ ফোকাস’ বা নানা রকম কাটের প্রয়োজন পড়েনা
তাঁদের। বরং দেসিকা’র মতো, কিছু কিছু অংশে কুরোসাওয়ার মতো তাঁদের ক্যামেরা চলে
অবলীল ছন্দে। তথাপি উপস্থাপনার প্রশ্নে পানাহি, অন্ততঃ এখানে আলোচিত তিনটি ছবির
দুটিতেই একটু অ-ইরানী। অন্যেরা যখন ধীরে ধীরে, দর্শককে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময়
ঢুকিয়ে দেন কাহিনীর কেন্দ্রে সেখানে ‘সার্কল’ আর ‘ক্রিম্সন্ গোল্ড্’ এর পানাহি
প্রথমেই দর্শকের সামনে এনে হাজির করেন এমন এক খন্ড ঘটনা যা দর্শককে এক টানে উপড়ে
নিয়ে আসে তার নিজস্ব বাস্তবতা থেকে। তারপর আর ছবিটি আগাগোড়া না দেখে উপায় থাকেনা
দর্শকের ...
সপ্তর্ষি বিশ্বাস, এপ্রিল ৫-১০, ২০১২