নিজের সঙ্গে বন্দরে
১।
এই বেঙ্গালোর শহরে এসে বাসা বাঁধবার প্রায় দেড় দশক হতে চল্লো।
এই দেড় দশকের প্রথম পাঁচ বছরে আমার যা লেখালেখি তাদের শরীরে,
শোণিতে,মর্মে যন্ত্রণার দাগ শিল্পীত হলেও স্পষ্ট। ওই যন্ত্রণা এই দুরন্ত গতিশীলতার
সঙ্গে, দেশবাড়ি, ভিটেবাড়ির মূল্যে এই শহরে স্বেচ্ছায় উদ্বাস্তু হতে আসা দ্বিপদ
প্রাণীগুলির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে না পারার যন্ত্রণা। বগলের তলায় আঁকড়ে ধরে থাকা
থলীতে ক্রমশঃ মুদ্রা জমে উঠতে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে বদলে যেতে দেখার যন্ত্রণা।
“ডোনেশন” দিয়ে সন্ততিকে “ইন্টারন্যাশন্যাল” ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার যন্ত্রণা।
ফ্ল্যাট বাড়ির জ্যামিতিতে আপনাকে আটকে ফেলার যন্ত্রণা। যদিও সকল বাসা, সকল বাড়িই “পরের
জেগা, পরের জমি – ঘর বানাইয়া আমি রই। আমি’ত সেই ঘরের মালিক নই” তথাপি সেই শীর্ণ
খালের ধারে, বাঁশঝাড়ের ছায়াতে – কলেজ কোপারেটিভ থেকে “লোন” নিয়ে বাবার করা –
আমাদের ওই ছোট্ট বাড়িটা – তাকে মনেহতো, মনেহয় – যদিও সে মনে হওয়াও “মায়া” – তবু –
সে যেন “নিজের জেগা, নিজের জমি”। যেন আমার দাফনের মাটি, জন্মের মৃত্তিকাঘ্রাণ। আজো
আমার রচনার মর্মে কখনো কখনো শিল্পীত অবয়বেই খরশান হয়ে ওঠে তথাপি, অন্যে টের না
পেলেও আমি নিজে টের পাই যে সেই যন্ত্রণার সূচিমুখ স্থূল হয়ে আসছে। ক্রমশঃ।
কিন্তু কেন? এমন হওয়ার কথাতো ছিলনা। অন্ততঃ এই প্রতিজ্ঞায়
ছিল সচেতন প্রস্তুতি, যে, শিকড় থেকে ঝরে যেতে দেবোনা ক্ষুদ্রতম অনুমৃত্তিকাটিকেও।
তথাপি নিজমর্মে টের পাচ্ছি সেই ঝরে যাওয়া। যেন এলেন পো’র সেই “ঊশার” সাহেবের
দুর্গহেন বাড়ির সেই ফাটল যা বাড়তে থাকে, কেবলি বাড়তে থাকে...
কিন্তু কেন? এমন হওয়ার কথাতো ছিলনা ... পেটে দু পাত্র স্কচ্
থাকলে অবলীলায় বলে দিতে পারতাম এই চালচিত্রের সঙ্গে নিজেকে “মানিয়ে” নিতে গিয়ে
আমিও পাথর হয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু আজ, এই মুহুর্তে, স্কচ্হীন মগজে নিশ্চিত
জানি যে এটা মিছেকথা। কথাটা “মানিয়ে” নেওয়া নয়। “মেনে” নেওয়া। আমি আসলে মেনে
নিচ্ছি মানুষের, সভ্যতার এই নিয়তিকে। বহিরঙ্গে যাইবা ভাবছি, যাইবা বলছি, যাইবা
লিখছি, মর্মে ঠিক তার বিপরীতে নিজেকেও করে তুলছি এখানকার মতো, এখনকার মতো “চলনসই”।
আর এই “চলনসই” হয়ে উঠবার আবডালে যা হারাচ্ছি তা আমার স্বধর্ম।
না, কোনো শ্রীকৃষ্ণের বাত্লে দেওয়া “পথ” আমার “স্বধর্ম” নয়
কেননা আমাকে আমার প্রতিটি শোণিতকণিকার মূল্যে জানতে হয়েছে যে “আমরা দন্ডিত হয়ে
জীবনের শোভা দেখে যাই...মহাপুরুষের বানী চারিদিকে কিলবিল করে”। অতএব কোনো একটি
বিশেষ মত বা বেশ কিছু মত ও বাণীর মিশ্রণে অপরের দ্বারা প্রস্তুত কোনো অবয়ব আপন
কঙ্কালের উপরে চাপিয়ে তাকেই “স্বধর্ম” বলা আমার হলোনা। এতাবৎ। আমার,
তোমার,তার,প্রত্যেকের স্বধর্ম তা’ই শুধু যা সে পারে অবলীলায় বয়ে নিতে। মর্মে,স্কন্ধে।
তার চেয়েও বেশী সত্য এই, যে, যা সে অবলীলায় পারেনা বয়ে নিতে তারই বিপক্ষে সে
দাঁড়ায়। দাঁড়াতে সাহস করে। তবে এ’ও আমাকে আপন শোণিতের মূল্যেই জানতে হয়েছে, যে, যা
আমি অবলীয়ায় বহন করতে সক্ষম বা কোনো মহাপুরুষ বা কাপুরুষ বহন করতে সক্ষম তা’ই “সত্য”
নয় আর যা আমি বহন করতে ঘৃণা করি তা’ই যে “মিথ্যা” বা “ভুল” এমনও নয়। - যতো দিন
যাচ্ছে ততোই এই ধারণায় আমি স্থিততর হচ্ছি, যে, সত্য এবং মিথ্যা, ভুল এবং শুদ্ধ –
দুটি বিপরীতার্থক শব্দমাত্র। আদতে দুয়ের মধ্যে কোনো তফাৎই নেই।
এর অর্থ হয় এই,যে, যে ভার বহন করতে আমি মর্মে নারাজ আমি
দাঁড়াচ্ছি না তার বিপক্ষে। বরং তাকে মেনে নিচ্ছি ঠিক যেমন ধর্ষিতা মেয়ের নাচার
মাবাপ মেনে নেয় মন্ত্রীবাবার-সাধুবাবার অফার করা ক্ষতিপূরণ। মেনে নেয় শরগোল উঠিয়ে
লাভ নেই। ঐ মন্ত্রবাবার চামচা অনেক, ওই সাধুবাবার শীষ্য অনেক। - তবু এমনও কি
দেখিনা যে, মেনে নিচ্ছেনা।? আর না মেনে নেওয়ার মূল্যে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলছে? –
ভাবের ঘোরে ভাবি “ঐ আমারো স্বধর্ম”। শিল্পীত বাক্যে, নিয়ন্ত্রিত মিছিলে
হাঁটাহাঁটির মূল্যে নিজেকেই চোখ ঠারি।
বিমান বন্দরে
বসে আছি। “কফি ডে” দোকানে। একমাত্র এখানেই ধূমপান সম্ভব। সামনেটা অন্ধকার নির্মীত।
আমার টেবিলে আমি অন্ধকার। একা। আশেপাশের টেবিলেও একা কিংবা দোকা অন্ধকার।
অনতিদূরের আলোকিত “এরাইভেল্”। “ডিপার্চার”। ঐ পথ দিয়ে যাদের আনাগোনা তারা আলোকিত।
তাদের বর্নালী পেন্টি কেটে বসেগেছে তাদের গীতগোবিন্দ নিতম্বে। তাদের গালের মাংসের
ভিতরে পোঁতা আছে দশ ফলার রেজার। তারা ব্যস্ত। তারা সমস্ত। তাদের আভডালে দেখাযায় দু
চারটে অন্ধকার যাত্রীকেও। দেখামাত্র টের পাওয়া যায় “এই স্থানে সকল রোগেরই সু-চিকিৎসা
হয়” এই রকম কোনো পঞ্জিকামথিত বিজ্ঞাপনের তাড়ায় অসুস্থ স্বামী বা পুত্রকে নিয়ে
এসেছেন এখানে। বাঁচার আশায়। হায়! হায় রে বাঁচা! আমি বসে আছি। আমি কোথাও উড়ান
দেবোনা। আমি অপেক্ষা করছি।
অপেক্ষা করতে আমার ভালো লাগে। ইস্টিশানে, খেয়াঘাটে,
বাসস্টপে। এমন কী এই গীতগোবিন্দনিতম্বসংকুল বিমান বন্দরেও। একজন কবি ছিলেন। বছর
পনেরো কুড়ি আগে। তিনি লিখেছিলেন কথাগুলি। আমার মনেপড়ে। মাঝে মাঝেই মনেপড়েঃ
“বাঁচিবার অর্থ এইঃ শান্ত বাসস্টপে চুপচাপ
দাঁড়ায়ে প্রতীক্ষা করা, বাস নয়, বাসে চ’ড়ে যিনি
আসিবেন, তাঁর জন্য। আসিবে, তাহার জন্য। এই
অর্থ কভু শিখেছ বাঁচার? তবে বাঁচিয়াছ তুমি!
তবে বাঁচিয়াছ তুমি, তবে মনে রেখেছে তোমাকে
সেই রুবি রায়-যারে হয়ত বা দেখনি কখনো
বনলতা সেন হ’য়ে তবু যে তোমার সঙ্গে কথা
বলিয়াছে...”
হায়! কে’যে কবে কিভাবে মরে যায়! কি আশ্চর্য ভাবে অপরের
বিজ্ঞাপিত “এই স্থানে সকল রোগেরই সু-চিকিৎসা হয়” এই রকম কোনো পঞ্জিকামথিত
বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করে নিয়ে “স্বধর্ম” আংরাখা এঁটে তারপর মরে যায় ঐ আংরাখার
আড়ালে!! তবু যেহেতু জীবিত দিনে সে ছিল প্রক্ক্রিতই কবি তা’ই সমস্ত অপেক্ষার আবহে
আমার মনেপড়ে ঐ পংক্তিগুলি।ন আজো পড়লো। গীতগোবিন্দনিতম্বসংকুল বিমান বন্দরে বসে
আমার মা আর বাবার জন্য অপেক্ষা করার আবহে।
রাত ক্রমে ক্রমে সাড়ে আটটার নাভিতে স্পর্শ করে। তারপর গড়িয়ে
নেমেযায় আটটা বেজে চল্লিশ মিনিটে। “কফি ডে”র শোভন অন্ধকার থেকে উঠে গিয়ে দাঁড়াই “এরাইভেল”
লাউঞ্জে। উজ্জ্বল আলোকে চিত্রিত “নৃমুন্ডের হেঁয়ালী”। আছে ভিরু চোখ। ভিতু চোখ।
লোভী চোখ। জ্বলা চোখ। নেভা চোখ। প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছে কিন্তু ক’জনের অপেক্ষা যে
“যিনি আসিবেন, তাঁর জন্য। আসিবে, তাহার জন্য” আর কজনের অপেক্ষা যে তিনি বা তাহার
বস্তুমূল্যে তার কিছুটা স্বরলিপি ঐ দৃষ্টিগুলিতে অঙ্কিত। লোক আসছে। বার হয়ে। অপেক্ষারতরা হাত নাড়ছে। গিয়ে জড়িয়ে ধরছে।
চুমু খাচ্ছে। কেউ বার হয়ে আসছে হেঁটে। কেউ কেউ হুইল চেয়ারে। আমি চিলচোখে দেখে নিতে
চাইছি আমার মা আর বাবার আসার চিহ্ন। মনে পড়ছে “এই আসা যাওয়ার খেয়ার কূলে আমার বাড়ি।
কেই বা আসে এ পারে কেউ পারের ঘাটে দেয়রে পাড়ি…” – চম্কে উঠি! ঐতো বাবা। ঐতো! লম্বা।
মাথায় টাক। চোখা নাক। ঐতো সেই চিরপরিচিত ভঙ্গি হেঁটে আসার! মা
কোথায়? মা নিশ্চয় হুইল চেয়ারে। গত কয়েক বছর ধরেই মা’র হুইল চেয়ারের প্রয়োজন হয় এই
সব পাড়িতে। প্রথমবার, এই বিমান বন্দরেই , মা’কে হুইল চেয়ারে, পোর্টারবাহিত,
দেখামাত্র ... না, শঙ্খ ঘোষ’কে আমার কবি বলে মনে হয়না, মনেহয় কুশলী ... তবু আমার
মনে এসেছিলঃ “মাগো আমার মা, তুমি আমার এ ঘর ছেড়ে কোথাও যেওনা ... এই যে ভালো ধূলোয়
ধূলোয় ছড়িয়ে আছে দুয়ারহারা পথ ...”
আশ্চর্য এই জীবন! আশ্চর্য এই বেঁচেথাকা! আশ্চর্য এই মরে
যাওয়া! – কোথায় বাবা? এ’তো অন্য এক প্রৌঢ় – বাবার দশ বৎসর আগেকার চলার ভঙ্গিটিকে
নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন... হায়! কিন্তু যাচ্ছেন কোন্ দিকে? – ঐ যে বাবা আসছে। বাবাও
হুইল চেয়ারে। গায়ে মাথায় চাদড় মুড়ি দেওয়া। তীক্ষ্ণ নাসা এখন পাখির বাঁকা ঠোঁটের
মতন বার হয়ে আছে চাদড়ের ঘোমটা থেকে। দুই পোর্টার দুই হুইল চেয়ারে করে নিয়ে আসছে মা’কে
আর বাবাকে। তৃতীয় পোর্টার বয়ে আনছে সামানপত্র। এরই সামনে দিয়ে পার হয়ে চলে যাচ্ছেন
সেই প্রৌঢ় যাঁর উচ্চতা, নাক, টাক, চলার ভঙ্গি সবই বাবার মতো তবু মাঝখানে দেড় দুই
দশকের ফাঁক ...
কোথায় এক্সাচ্ছেন তিনি? কোথায়ইবা যেতে পারেন? যেতে পারেন
কতো দূরইবা? “ মাঝে মাঝে দু একটা প্লেন উড়ে যায়। একভিড় হরিয়াল পাখি উড়ে চলেগেলে
পরে ভাবি।শুধু দুই পায়ে হেঁটে কতোদূর যেতে পারে মানুষ একাকী?” ... না, খুব বেশী
দূর নয়। অদূরেই অপেক্ষায় থাকে হুইল চেয়ার। অদূরেই অপেক্ষায় থাকে “পোর্টার” ... “যিনি
আসিবেন, তাঁর জন্য। আসিবে, তাহার জন্য” ...
দিশাহারা বোধকরি। টেরপাই ভার্জিনিয়া উল্ফ্। টের পাই তাঁর
চেষ্টা – “স্ট্রীম্ অফ্ কন্শাস্নেস্” নাম দিয়ে যাকে “বুঝে ফেলতে” চেয়েছে দিগ্গজেরা।
টেরপাই ভার্জিনিয়া উল্ফ্। টের পাই তাঁর চেষ্টা একটি মুহুর্তকে সামগ্রিক ভাবে
নির্মাণ করবার। স্ট্রিম। প্রকৃতই। মুহুর্তে মনে আসে এই বেঙ্গালোর শহরে এসে বাসা বাঁধবার প্রায় দেড় দশক হতে চল্লো।
এই দেড় দশকের প্রথম পাঁচ বছরে আমার যা লেখালেখি তাদের শরীরে,
শোণিতে,মর্মে যন্ত্রণার দাগ শিল্পীত হলেও স্পষ্ট। ওই যন্ত্রণা এই দুরন্ত গতিশীলতার
সঙ্গে, দেশবাড়ি, ভিটেবাড়ির মূল্যে এই শহরে স্বেচ্ছায় উদ্বাস্তু হতে আসা দ্বিপদ
প্রাণীগুলির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে না পারার যন্ত্রণা। বগলের তলায় আঁকড়ে ধরে থাকা
থলীতে ক্রমশঃ মুদ্রা জমে উঠতে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে বদলে যেতে দেখার যন্ত্রণা।
“ডোনেশন” দিয়ে সন্ততিকে “ইন্টারন্যাশন্যাল” ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার যন্ত্রণা।
ফ্ল্যাট বাড়ির জ্যামিতিতে আপনাকে আটকে ফেলার যন্ত্রণা। যদিও সকল বাসা, সকল বাড়িই “পরের
জেগা, পরের জমি – ঘর বানাইয়া আমি রই। আমি’ত সেই ঘরের মালিক নই” তথাপি সেই শীর্ণ
খালের ধারে, বাঁশঝাড়ের ছায়াতে – কলেজ কোপারেটিভ থেকে “লোন” নিয়ে বাবার করা –
আমাদের ওই ছোট্ট বাড়িটা – তাকে মনেহতো, মনেহয় – যদিও সে মনে হওয়াও “মায়া” – তবু –
সে যেন “নিজের জেগা, নিজের জমি”। যেন আমার দাফনের মাটি, জন্মের মৃত্তিকাঘ্রাণ। আজো
আমার রচনার মর্মে কখনো কখনো শিল্পীত অবয়বেই খরশান হয়ে ওঠে তথাপি, অন্যে টের না
পেলেও আমি নিজে টের পাই যে সেই যন্ত্রণার সূচিমুখ স্থূল হয়ে আসছে। ক্রমশঃ।
কিন্তু কেন? এমন হওয়ার কথাতো ছিলনা ...
মনে আসে একটি খেয়া ঘাট। একটি নিঝ্ঝুম সন্ধ্যা। বৃদ্ধ একটি বট বৃক্ষের তলায় বসে আছে একটি বালক।
প্রতীক্ষায়। “যিনি আসিবেন, তাঁর জন্য।
আসিবে, তাহার জন্য” ...