প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Saturday, August 8, 2015

পান্থ সঙ্গীত: ইন্দ্রনীল দে'র নাটক

পান্থ সঙ্গীত: ইন্দ্রনীল দে'র নাটক


১।









... প্রায় কুড়ি মিনিট মতন “নাটক”টি দেখে পস্‌ (pause) করে রাখলাম। পস্‌ করলাম কেননা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এটি একটি মৌলিক বাংলা নাটক বলে। যদিও কুড়ি মিনিটের মধ্যেও তাল কাটছিল অভিনয়ে, সংলাপে তথাপি নাটকটির অন্তর্গত ভাবনাবৃত্তের পরিধির একটা  আঁচ ততোক্ষনে পাওয়া গেছে আর তা পাওয়া গেছে বলেই, টাইটেল কার্ডে কোনো কৃতজ্ঞতা স্বীকার ইতাদি না থাকলেও, কেবলি মনে হচ্ছিল – না, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামক “নাট্যব্যক্তিত্ব”র পক্ষে এতো গহন ভাবনা অসম্ভব। সন্দেহ বিমোচনার্থে ইন্টারনেটের শরণ নিলাম এবং মিনিট দশ খোঁজাখুঁজির পরেই দেখলাম যে মূল রচনাটি Anthony Joshua Shaffer (১৯২৬ – ২০০১) নামের নাট্যকারের এবং মূল নাটকটির নাম Sleuth । এটিকে ভিত্তি করে ১৯৭২ সালে এবং ২০০৭ সালে ইংরেজিতে দুটি সিনেমাও হয়েগেছে। আশ্বস্ত হলাম এটা টের পেয়ে যে বাবু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের “টিকটিকি” নামক নাটক বা সিনেমাটি ঐ Sleuth’এরই একটি ব্যর্থ অনুকরণ প্রচেষ্টা তা’ও আবার টাইটেল কার্ডে মূল লেখা বা লেখকের নাম উল্লেখ না করেই। পরে বাবু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের “নাটক” সমগ্রতে দেখলাম আদত নাট্যকারের নামটির উল্লেখ তিনি করেছেন।
আশ্বস্ত হলাম, কেননা, বাংলা নাটক বলতে যখন “কইলকাত্তাইয়া” “নাটক”কেই লোকে বুঝতে আরম্ভ করেছে তখন থেকেই ঐ “কইলকাত্তাইয়া” নাটক হয়ে পড়েছে বিদেশী নাটকের অনুবাদ ও অনুকরণ নির্ভর। তক্কের খাতিরে কিছু কিছু মৌলিক নাটকের নাম, ভালোয় মন্দয়, করা গেলেও মূল ধারাটি “থ্রী পেনী” অপেরা থেকে “ফেরিওলার মৃত্যু” হয়ে “বাসনা বৃক্ষমূলে” হয়ে চলেছে ঐ পথেই। এমতাবস্থায় ঐ “কইল্লকাত্তাইয়া” বাবু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যদি একটি রীতিমতো চিন্তনযোগ্য, মৌলিক নাটক ফেঁদে বসেন তখন একটু আশ্চর্য হতে হয় বৈকি আর তাই যখন জানলাম এটি নকল তখনই নিশ্চিন্ত হলাম কেননা অন্ততঃ নিজের কাছে তো এইটুকু আবারো প্রমাণিত হলো, যে, আমার এদ্দিনের গড়ে ওঠা ধারণাটি ভুল নয় ...
হালের বাংলা নাটকের “মূল ধারা”র চিত্রটি যখন এই, তখন, হে পাঠক, ভারতবর্ষের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসে কেউ যদি রচনা করে শতকরা দুইশত ভাগ মৌলিক নাটক এবং হিন্দি সিনেমাভিন্ন অন্য কোনোরূপ “অভিনয়” বিষয়ে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা না থাকা কিছু “গ্রাম্য” যুবককে নিয়ে সফলভাবে মঞ্চস্থ করতে সক্ষম হয় সেই নাটক, সেই নাটকগুলি তাহলে, তাকে, আমি অন্ততঃ বলতে বাধ্য হই “প্রমিথিউস্‌”। বলতে বাধ্য হই, কেননা, যে সমস্ত নাটক ও যে নাট্যকার ও নাট্যদলটির কথা আমি বলতে যাচ্ছি তার, তাদের ঠিকানা বরাক উপত্যকা, জিলা কাছাড়। সেই অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাভাষী জনতাকে অসমীয়ারা এতাবৎ “বিদেশী” বলে চালিয়ে দিতে চায় ( যেহেতু বরাক উপত্যকা বা কাছাড় জেলা “আসাম” নামক রাজ্যের অন্তর্গত)। এই অঞ্চলে বাংলা ভাষায় কথা বলবার, লেখবার অধিকার অর্জন করতে হয় রক্ত দিয়ে। এদিকে “কইলকাত্তাইয়া”রাও ঐ অঞ্চলের বঙ্গভাষী জনতাকে বাঙ্গালী বলতে নারাজ। বরং ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলতে পারা বা না পারা দিল্লীবাসী ‘চ্যাটার্জী” বা বোম্বেবাসী “বন্দ্যোপাধ্যায়” তাদের বিচারে অনেক বেশী বাঙ্গালী। আরও আশ্চর্য এই, যে, এই বরাক উপত্যকার সিংহভাগ “শিক্ষিত” জনতাও নিজেদেরকে শোধন করে নিতে হয়ে উঠতে চান “কইলকাত্তাইয়া”। বলনে, চলনে। সুতরাং সেই বরাক উপত্যকার পয়লাপুল নামের চা বাগানভিত্তিক গ্রামটির থেকে যখন উঠে আসে “বাজে মাদল বাজে”, “তিন পুতুলের গল্প”, “নোয়াহ্‌’র নৌকা” বা “পান্থসঙ্গীত” হেন মৌলিক নাটক  তখন নাট্যকার, পরিচালক ইন্দ্রনীল দে ও তাঁর প্রয়াসকে নিয়ে ভাবতে, বলতে বাধ্য হতেহয় বৈকি।
আলোচনা দীর্ঘতর হওয়ার আগেইবলে নিই যে ইন্দ্রনীল ও তাঁর নাটকদল “RACE” ( Human Race) যে বরাকের এই তথ্য বা এই সত্য আমার কাছে নিতান্তই কাকতালীয় ঠিক যে অর্থে কবি রুচিরা শ্যাম বা করুণা সিন্দু দে যে শিলচরে ছিলেন এই তথ্য আমার কাছে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক ঠিক যেমন অনর্থক “বরাকের কবি, “লুইতের কবি, “গাঙ্গেয় কবি ইত্যাদি বাক্যবন্ধ গুলি।  কবি যে অঞ্চলেই জন্মান, যে অঞ্চলেরি জল হাওয়ায় তাঁর বিকাশ ঘটুক সেই অঞ্চলের বর্ণ,ঘ্রাণ,কথা,ব্যথা,উপকথা,রূপকথা তাঁর অক্ষরে ছায়াপাত করতে বাধ্য তথাপি সেই ছায়ায়, আলোয় তিনি যদি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হন এমন কিছু অক্ষরবাহিনী যা সেই বাল্মীকি,বেদব্যাস,শেক্ষপীর, গ্যেটে,রবীন্দ্রনাথ,জীবনানন্দ,রিল্‌কে বা বিনয় মজুমদারের অক্ষরের অবিনশ্বরতা সত্ত্বেও – অনুবাদের অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও – চিরতরে বিদ্ধ হয়ে যেতে পারে একজন প্রকৃত পাঠকের মর্মে, শরের মতন তাহলে “ভাট পাড়া বা “কাঁসারি পাড়া তাঁকে নিয়ে যতোই উদ্বাহু নৃত্য করুক বা মহারাজ স্বয়ং তাঁকে তাঁর শ্রেষ্ঠ ভাঁড়াসনটি দানই করুন – তাতে প্রকৃত শিল্পের,কবিতার কিছু আসে যায় না। সুতরাং ইন্দ্রনীল দে যে কাছাড়ের পয়লাপুলের মানুষ বা তাঁর কলেজজীবন শিলচর, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পাঠ এই সমস্ত কিছুই আমার কাছে, নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা ইন্দ্রনীল দে’র প্রসঙ্গে আলোচনায়, নিতান্ত অর্থহীন। - যা অর্থবহ, যার প্রয়োজনে, প্রেরণায় এই লেখনী ধারণ, তা হলো এই সত্য, যে,ইন্দ্রনীল দে  একজন প্রকৃত নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা।  
নিতান্ত কাকতালীয় হলেও আরেকটি তথ্য এখানে, গর্বিত ভাবেই, জ্ঞাপন করে রাখি, যে, ইন্দ্রনীল দে, হয় অঙ্গুলে গোনা আমার অতিশয় ঘনিষ্ট বান্ধবজনেদের অন্যতম।
২।
ইন্দ্রনীল ও তাঁর নাটককে বলেছি প্রমিথিউস। কেন বল্লাম? বল্লাম এই হেতু, যে, ইন্দ্রনীল যে সময়ে এসে হাজির হলেন তাঁর নাটক নিয়ে, সেই ২০০১ সালে, তখন আমার মতো আরো অনেকেই বাংলা নাটক – তা সে “কলকাত্তাইয়া” একাডেমী হলের নস্টামিই হোক্‌ আর ভড়ং সর্বস্ব বাংলা “থার্ড থিয়েটার”ই হোক্‌ বা আঞ্চলিক ভাষায় করা নাটকের নামে ভাঁড়ামিই হোক্‌- দেখা ছেড়েই দিচ্ছে। অন্ধকারে হঠাৎ জ্বলা জোনাকির মতো - “দুই গালো চড়” ( পাথারকান্দির একটি দলের পরিবেশনা, নাট্যকার সম্ভবতঃ শেখর দাস) , পশ্চিমবঙ্গের কোন্‌ এক মফস্বলি দল “আয়না”র মুক্তাঙ্গন প্রয়াস – ইত্যাদি – চক্‌মকি পাথরের মতো। আগুন জ্বলছেনা মর্মে। আগুন জ্বলছেনা বাদল সরকার বা উৎপল দত্তের চর্বিত চর্বনে। মঞ্চে জ্যান্ত হাঁস আমদানিা বা ক্রেইনে করে পরী নাবানোর পরিবেশন-চালাকিতে একবার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে তারপর বরাকের “কাঠের তলোয়ার” থেকে গঙ্গার “মাধবী মালঞ্চী কন্যা” – সকলেই ধার ক্ষয়ে যাওয়া, ধর্ষিতা । ঠিক তখনি ইন্দ্রনীল এসে হাজির হলো করিমগঞ্জে। তার সদ্য লেখা নাটকের পান্ডুলিপি পড়ে শোনাতে।
প্রান্তিক সমস্ত মফস্বলের মতোই করিমগঞ্জও এক ছন্নছাড়া মফস্বল তবু এই শহরের দুই দিকে দুই নদীর গতায়াত। কুশিয়ারা আর লঙ্গাই। লঙ্গাই পাহাড়ি নদি। দুর্বার তার স্রোত। তারই কিনারের তিনটি বড় বড় পাথরে বসে দুপুরে নাটক পড়ে শোনালো ইন্দ্রনীল আর শুনলাম আমি আর সিদ্ধার্থ। সেই শোনার উত্তেজনা, মুগ্ধতা, কিকরে যায় মঞ্চস্থ করা এই সমস্ত ভাবনা ও আলাপচারিতার কাহন এখানে বলতে গেলে উপন্যাস ফেঁদে বসতে হয় তাই   আপাততঃ সেদিকে না গিয়ে শুধু বলছি যদি ঐ একটি নাটকের রচনা ও তার প্রযোজনাতেই থেমে যেতো ইন্দ্রনীল, থেমে যেতো “রেস্‌” তাহলে সে’ও হতো আলো তবু ঐ জোনাকির আলো যাতে অন্ধকার না কেটে আরো গাঢ়তর ঠেকে বরং। কিন্তু সে স্বর্গ থেকে নিয়ে এলো আগুনই কেননা তারপর একাদিক্রমে, অদ্যাবধি, তার নাটক তার প্রযোজনা চলেছে, ঐ লঙ্গাই নদীর মতোই দুর্বার স্রোতে...
ইন্দ্রনীল ও তাঁর নাটককে বলেছি প্রমিথিউস। কেন বল্লাম? – একটা হেতু ব্যাখ্যা করে বলেছি। আরেকতা হেতু হয় এই, যে, যে প্রমিথিউস এনেছিল আগুনের সন্ধান কি হয়েছিল তার পরিণতি? সেই ককেশাস পর্বতে তাঁকে বন্দী করে বেঁধে রাখা হয়েছিল বিশাল প্রস্তরে আর স্বয়ং জিউস্‌ চিল পাখির বেশে দিনভর ঠুক্‌রে খায় তায় যকৃৎ! – কি হলো ইন্দ্রনীলেরো? কি হলো তার “রেস্‌” নাটকদলেরো? – না, তার, তাদের ইতিহাস রচনার সময় এখনো আসেনি আর আমার এই প্রয়াস নয় প্রচেষ্টা ইতিহাস রচনারো। আমি নিশ্চিত যে “রেস্‌” কে নিয়ে ইন্দ্রনীল ধেয়ে যাবে আরো বহুদূর তথাপি কালের আয়নায়, এই মুহুর্তে, যখন সুমন চট্টোপাধ্যায়’ও “তিস্তাপারের বৃত্তান্ত” খ্যাত, যখন বাবু রুদ্রপ্রসাদ “কিংবদন্তী” কিংবা যখন শম্ভু মিত্র ধর্ষিত মনসার পালা ভাঁড়িয়ে বহু আঞ্চলিক গোমূর্খও আপ্যায়িত – তখন – ইন্দ্রনীল দে – এই নামটির সঙ্গে কতজন দর্শক, পাঠক পরিচিত?
৩।
মন্টুদার ভূঁষিমালের  দোকান। লাগোয়া বাঁশের বেড়ার ছোট্ট কোঠা। তাতে কেরোসিন কাঠের ছোট্ট টেবিল। দুপাশে দুটি বেঞ্চ। যেহেতু পয়লাপুলে তখনো “বার্‌” গজায়নি ফলে মদ কেনা গেলেও স্বস্তিতে বসে খাওয়ার জো নেই। তা বোতল পকেটে পুরে মন্টুদার আস্তানায় এসে পড়লে আর ঝন্টুদার সঙ্গে মুখচেনা থাকলে দোকানের লাগোয়া ঐ কোঠায় বসে ধন্টা তিনেক নিরাপদে মাল খাওয়া যায়। মন্টুদা জল সাপ্লাই দেয়। গেলাস সাপ্লাই দেয়। বদলে গোটা নেয় কুড়ি-পঁচিশ টাকা। ঘরভাড়া বাবদ। তবে “বন্ধু”রা এলে অন্য খদ্দেরদের তাড়ায় মন্টুদা। তখন আমি আর ইন্দ্রনীল বসে মাল টানি। দু এক পাত্তর চড়ায় মন্টুদাও। কখনো সখনো। সিদ্ধার্থ মাল খায়না। আঙ্গুল চোষে।
দীপকুমার আদতে বিহারি। সামান্য জমিজমা। ধান ফলায়। নিজেই। আসে মন্টুদার আসরে। “বন্ধু”রা এলে। মন্টুদার মতো তার মাথাতেও নাটকের ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছে ইন্দ্রনীল। “রেস্‌” এর প্রতিজন কুশীলবই তা’ই। বিমলদা, বিষ্ণু, ধীরয, রামেশ্বর – হয় মন্টুদা’র মতো দোকান বা “রেস্টুরেন্ট”। তাদের কেউ নয় – এমন কি – মফস্বলি বা গাঁইয়া সংজ্ঞাতেও – “শির্‌খিত” ( “তিতাস...” এর ভাষায় ‘শিক্ষিৎ”) আর “ইন্টেলেক্‌চুয়াল” তো দূরস্থান। মন্টুদা আর বিমলদা বাদে বাকীদের মাতৃভাষাও নয় বাংলা। তবু এরাই যখন “আজ বসন্ত” নাটকে গেয়ে ওঠে “গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে মৃদুল মধুর বংশী বাজে...” – তখন প্রেক্ষাগৃহ ভরেওঠে হাততালিতে। চোখের কোনে জমে ওঠে কিসের যেন অশ্রু ...
পড়েছি রতন থীয়ামের দলের মানুষদের খামারের কথা। অনেকেই পড়েছেন নিশ্চয়। দেখেওছেন হয়তো অনেকে। কিন্তু ইন্দ্রনীলের এই মন্টুদা’র দোকানের খবর কজন রাখে? কজন জানে, রাতের পরে রাত চলে এদের মহড়া – এক কালে পয়লাপুল হাই ইস্কুলের কোঠায়, এখন ইন্দ্রনীলের নিজের ইস্কুলে? কজন জানে যে শুধু ঐ মাটির টানে, ঐ নাটক আর নাটকদলের টানে ইন্দ্রনীল ফিরে গেলো – বেঙ্গালোরে এসে চাকরী পাওয়া সত্ত্বেও?

৪।
এ’তো গেলো স্কেচ্‌ - সংগঠক ইন্দ্রনীলের। অভিনেতা আর পরিচালক ইন্দ্রনীলের স্কেচ্‌ আঁকা যাবেনা কেননা নাটক মাধ্যমটি এমনই, যে, তাকে ক্যামেরায় ধরে দেখালেও তার প্রকৃত চরিত্রটি টের পাওয়া যায়না। তাই অভিনেতা ইন্দ্রনীল বা তার দলের ঝন্টু দাস, কৃষ্ণ পান্ডে, সূরয্‌ ঠাকুর, শ্যামল রায়, শচীন কয়রী, শিবকুমার কয়্‌রী বা তারকেশ্বর সাহানী – এদের অভিনয়ের সপ্রতিভতা, মাদল বাজানো রপ্ত করে নেওয়ার সার্থকতা, কোরাসগানে গলা মেলানোর চরিতার্থতা – সমস্ত কিছুই দর্শককে টের পেতে হবে মঞ্চের সামনে বসে থেকে। মঞ্চের সামনে বসে থেকেই টের পেতে হবে ইন্দ্রনীলের মঞ্চসজ্জা’র ইঙ্গিতময়তা যা এক কথায় না’ত সিম্বলিক না ইম্প্রেশনিস্ট। প্রায় সাদামাটা আলোতেই সজ্জিত হয় ইন্দ্রনীলের নাটকের মঞ্চ। তবে “টোন্‌” এর সামান্য অদল বদলে আলো হয়েওঠে নাটকের প্রকৃত আবহই। তাই হয়তো আলোর চমকদারি চোখেপড়েনা আলগা করে।
নাট্যকার ইন্দ্রনীল মারাত্মক এবং ততোটাই মৌলিক যতোটা মৌলিক হওয়া যায় আদ্যন্ত শেক্ষপীর পাঠের পরেও, শেক্ষপীরের নানান নাটকের নানান প্রযোজনার ‘ভিডিও’ দেখেও। নাট্যকার ইন্দ্রনীল ততোটাই মৌলিক যতোটা মৌলিক থাকা যায় টেনেসি উইলিয়ম্‌স্‌ থেকে গিরিশ কারনাড্‌ অব্দি নিবিড় ভাবে অনুধাবন ও অনুভাবনের পরেও। নাট্যকার ইন্দ্রনীল ততোটাই মৌলিক যতোটা মৌলিক থাকা সম্ভব হয় রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীতে, ডাকঘরে মুগ্ধ হওয়ার পরেও।
ইন্দ্রনীলের নাটকশরীর আত্মপ্রকাশ করে সাবেক “এপিক থিয়েটার”এর আদলেই। সূত্রধার বা কোরাসের গানে। রচিত হয় একটি বাস্তব পরিবেশ। কখনো তা কোনো সরকারি আপিসের, কখনো ছোট্ট চা দোকানের কখনোবা পাহাড়ে উঠবার পথের ধারের সস্তা পান্থ নিবাসের। অতঃপর চরিত্রদের মুখের নিতান্ত সাধারন সংলাপ দর্শক কে ক্রমে এনে হাজির করে – কখনো ৩০১০ সালে, কখনো এমন এক শহরে, এমন সময়ে যখন সোজা সরল কেরানী হরিপদ প্লাস্টিকের ফুল ভিন্ন জীবন্ত ফুল আর পাচ্ছেনা তার শহরে... অথবা বিষ্টি বাদ্‌লার রাত্রে এক ধর্মশালায় যেখানে এসে জমা হয়েছে নানা উদ্দেশ্যে পাহাড়ে উঠতে চাওয়া নানা রকমের মানুষ...
এই পর্যন্ত ইন্দ্রনীলের নাটক যেন রানওয়ে ধরে ধাবমান এরোপ্লেন। নিজেকে এবং বাহিত যাত্রীদিগকে সে প্রস্তুত করে নিচ্ছে উড়ানের জন্যে। এবার ঘটবে টেক্‌ অফ্‌। এবার আরম্ভ হবে প্রকৃত যাত্রা। কাহিনীর বহিরং বাস্তবে লাগবে অন্তর্গত রূপকের স্পর্শ। পরীর পাখা। পাখির ডানা। জানা যায় বিগত মুহুর্ত অবধি যে লোকটিকে আমরা জানতাম কেবলি একটি “লোক” বলে, জীবনানন্দের ভাষায় “ক্লান্ত জনগন” বলে, প্রকৃত প্রস্তাবে তারই কাছে এসেছে একটি চিঠি... চিঠিটি সেই নোয়াহ্‌’র যে জেনেছে আবার আসবে সেই মহাপ্লাবন তাই সে তার জাহাজে তুলে নিতে চায় কয়েকজন ‘প্রকৃত’ মানুষকে। - এই টেক্‌ অফ্‌টি ঘটে একাধিক মাত্রায়। কাহিনী যেমন উন্মোনার্থ সন্ধান করে চক্রবাল বহির্ভূত আরো এক বা একাধিক চক্রবালের তেমনি নিতান্ত সাধারণ সংলাপগুলিও উন্মোচন করতে চায় দৈনন্দিনতার চক্রবালাতীত আরো আরো আরো চক্রবাল ...
যদিও সম্পূর্ণ দেহটাকে বাদ দিয়ে মাঝখান থেকে কিছু সংলাপ তুলে দেওয়াটা, রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন সুর ছাড়া গানের কথা প্রসঙ্গে, সেই গণেশহীন তাঁর বাহনের মতো, তেমনি, তবু অন্ততঃ একটা অংশ এখানে উদ্ধার না করে পারছিনা –
নাটকের নাম “পান্থসঙ্গীত”। পাহাড়ের উপরে মেলা বসবে পরদিন থেকে। শিব ঠাকুরের মেলা। ( শিবরাত্রিকে ঘিরে, বরাক উপত্যকার ভুবন পাহাড়ে প্রকৃতই এমন একটি মেলা হয়ে থাকে)। রাত্রে নেমেছে প্রবল বিষ্টি বাদল। পাহাড়ের নীচে এক ধর্মশালা। তাতে পাকাপাকি বাস করে যারা সেই সন্ধাতেও বসেছে তাদের নিয়মমাফিক আসর। নিয়ম মাফিক মস্তি, নিয়ম মাফিক বচসা। ঐ সংলাপের সূত্র ধরে জানা যাচ্ছে যে তাদের একজন মাতাল, একজন চোর, একজন জুয়াড়ী। এমন সময় কে যেন দরজার কড়া নাড়ে। পুলিশ আলো কি’না – ইত্যাদি দ্বিধা দ্বন্দ্ব পার হয়ে দরজা খুল্লে দেখাযায় একজন বেহুঁশ মানুষ। সামান্য পরিচর্যার পরে সেই মানুষের হুঁশ ফিরলে তারপরে এই সংলাপঃ

আগন্তুকঃ আমি কোথায়? ... ও, মনে পড়েছে। ইস্‌, বাইরে কি বরখা। আরে ফাগুন মাসে এত বরখা আমি কোনোদিন দেখিনাই রে ভাই। আপনারা যদি দরওয়াজাটা না খুলে দিতেন, আমি ত মনেহয় আজকে মরেই যাইতাম।
চোরঃ তে তুমি ... মানে আপনে ফিট্‌ অইগেলা কেম্‌নে?
আগন্তুকঃ আমার তো, বুঝলেন কি’না, এই একটাই মুশকিল। ফিট্‌ হয়ে যাই। মানে, এই ভালো আছি, ভালো আছি ... আবার হঠাৎ করিয়ে ফিট হয়ে গেলাম।
জুয়াড়ীঃ তে আপনে কই থেকিয়া আইছইন? পাহাড়ো শিবর মেলাত যাইতা বুধহয়, না’নি?
আগন্তুকঃ হাঁ হাঁ। ঠিক ধরিয়েছেন। আমি অনেক দূর থেকে আসলাম রে বাবু। আমি ঐ শিবের মেলায় যাব, ওখানে খেলা দেখাব –
মাতালঃ মেলাত্‌ আবার কিতা খেলা?
আগন্তুকঃ জাদু কা খেলা। মানে বুঝলেন কি না, আমি হলাম বাজিগর।
জুয়ারীঃ বাজিগর?
চোরঃ মেজিক। মেজিক। মেলাত্‌ মেজিক দেখায়।
মাতালঃ আরে তুমি ত বড় কামের মানুষ রেভাই! তুমি জাদু জান?
আগন্তুকঃ হাঁ। আমি জানে।
মাতালঃ তুমি হাওয়া থাকিয়া জিনিস আন্‌তে পারো?
আগন্তুকঃ হাঁ, আমি ও’ভি পারে।
মাতালঃ তে আমারে হাওয়া থাকিয়া একটা আনিয়া দেও।
আগন্তুকঃ কি?
মাতালঃ মাল।
আগন্তুকঃ কি মাল?
মাতালঃ আরে মাল!
আগন্তুকঃ বাবুজী ও কি বলছে?
জুয়াড়ী (মাতালকে) ঐ চুপ্‌!
(আগন্তুককে) ঔষধ, ঔষধ। ঔষধ’র কথা ক’র। তার খুব অসুখ ত...
আগন্তুকঃ অসুখ? কি অসুখ?
মাতালঃ তুমার আর আমার এক অসুখ রে ভাই। তুমি খালি ফিট্‌ হই যাও আর আমি খালি ফিটিং হই যাই।
চোরঃ না, অসুখ একটা আছে আমরার। চাইরোজনের একটাই অসুখ। আমরার ঘুম ঘরেনা। শেষ কবে ঘুমাইস্‌লাম আমরার মনউ নাই।
আপাতঃ নিরীহ এই সংলাপ অংশটুকু আমাকে জানায় যে বার্তাগুলি তাদের কিছু কিছু হয় ঈদৃশঃ
১। জাদু। প্রতিটি মানুষই মনে মনে অপেক্ষা করে থাকে এক জাদুকরের যে তাকে “হাওয়া থেকে মাল” এনে দেবে...যে তার মাথায় ছুঁইয়ে দেবে জাদুদন্ড আর তখুনি তার শরীর থেকে আলগা হয়ে খসে পড়বে এই  “ব্যাঙ”এর খোলস। জানা যাবে সে’ও এক রাজপুত্র। গহনে।
২। প্রতিটি মানুষই মর্মে নিদ্রাহীন। নিদ্রাহীন তার পাপ নিয়ে, প্রেম নিয়ে, অপরাধ নিয়ে, অপরাধবোধ নিয়ে। পাঠক ! মনেপড়ে কি “ইন্‌সম্‌নিয়া” ছবির সেই বিনিদ্র পুলিশকর্মীটিকে যে অনিদ্রার গহনে মুখোমুখি বসে থাকতো তার পাপের সঙ্গে? মনেপড়ে সেই অনিদ্রাপীড়িত “ট্যাক্সি ড্রাইভার”? মার্টিক স্কর্‌সিসি’র? যাপনের একটি আপাতঃ লক্ষ্যের অভাবে যে ছিল নিদ্রাবিরহিত?
৩। লক্ষ্য করুন “ফিট” আর “ফিটিং” এর অনুপ্রাস। লক্ষ্য করুন তাদের ইঙ্গিত...
এই বার্তালাপের পরে ওই জাদুকরের খেলা দেখতে চায় তারা। জাদুকর বলেঃ তো নিন্‌ বাবুরা, শুরু করছি আমার সবচেয়ে খতরনাক্‌ খেলা। গল্প সচ্‌ করে দেওয়ার জাদু –
এই মুহুর্তেই ঘোরে নাটকটির প্রকৃত টেক্‌অফ্‌। প্রতিদিনকার চেনা – হাত সাফাই দেখানো জাদুকর থেকে জাদুর মতন জাদুকর – হুডিনি – সমস্তকে মুছে দিয়ে বার হয়ে আসে এক জাদুকর ... সে কী ঈশ্বর? সে কী শয়তান? ...
এরপরে এই কাহিনী বা ইন্দ্রনীলের অন্য সব নাটকের সব কাহিনীই নিরত হয় যে ভিন্ন ভিন্ন উড্ডয়নপথে সেই সব পথগুলি এখানে বলে দেওয়ার অর্থ, আরম্ভেই কোনো রহস্য কাহিনীর শেষ বলে দেওয়ার মতোই, গর্হিত। সুতরাং হে পাঠক, হে দর্শক আশা রইল আপনারা প্রত্যেকে নিজ নিজ পন্থায় আবিষ্কার করে নেবেন ইন্দ্রনীলের নাটকের মর্মপথ, উপস্থিত হবেন সশরীরে “রেস্‌” এর নাটকের আঙ্গিনায় ...
ইন্দ্রনীল এখনো আছে, ইন্দ্রনীলেরা এখনো আছে, “রেস্‌” আছে, “রেস”এর সহোদরেরাও আছে – এই সত্যটুকু, এই আশার কথাটুকু আপনাদের কাছে জানিয়ে দিতেই আমার এই ‘পান্থ সঙ্গীত’। এই অক্ষরপ্রচেষ্টা।
পরিশিষ্ট
২০০১ থেকে ২০১৫। পনেরোয় পা দিচ্ছে ইন্দ্রনীলের নাট্যদল। অর্থাৎ এ যে শুধু যৌবনের হর্মোনাক্রান্ত “শিল্পজ্বর” নয় তা হয় প্রমাণিত। পুরস্কার ইত্যাদিতে যদিও বর্তমান লেখকের বিশ্বাস নেই কানাকড়া তথাপি বিশ্বাসীজনেদের নিমিত্ত “রেস্‌” নাটকদলের ২০১২ অবধি পাওয়া পুরস্কারের তালিকাটি অন্তিমে দিচ্ছি উদ্ধার করে। - এই পুরস্কারগুলি ইন্দ্রনীলের এককার্জিত। অপর কুশীলবেরাও অর্জন করেছেন পুরস্কার – ঐ একই সঙ্গেই। কিন্তু আপাততঃ তার তালিকা আমার হাতে নেই। ভবিষ্যতে তাও সংগ্রহ এবং প্রকাশের ইচ্ছা রইল।

Year
Festival/Competition
Award
Play
Category
2001
Northeastern Theatre fest,
Badarpur, Assam
Best script
Dhitang Dhitang
Script
2001
Northeastern Theatre fest,
Khoai, Tripura
Best script
Dhitang Dhitang
Script
2002
Northeastern Theatre fest,
Karimganj, Assam
Best Script
Baje Madal baje
Script
2002
Northeastern Theatre fest,
Karimganj, Assam
2nd Best
Production
Baje Madal baje
Production
2002
Northeastern Theatre fest,
Karimganj, Assam
2nd Best Direction
Baje Madal baje
Direction
2002
Northeastern Theatre fest,
Karimganj, Assam
2nd Best Actor
Baje Madal baje
acting
2002
Rupam National Theatre fest,
Silchar, Assam
Best Music
Director
Baje Madal baje
Music
2003
Northeastern Theatre fest,
Badarpur, Assam
Best script
Chal kabadi
Script
2003
Rupam National Theatre fest,
Silchar, Assam
Best Script
Chal kabadi
Script
2005
Northeastern Theatre fest,
Karimganj, Assam
3nd Best director
Aaj Basanta
Direction
2005
Rupam National Theatre fest,
Silchar, Assam
2nd Best Actor
Tin Putuler Golpo
Acting
2007
Northeastern Theatre fest,
Dharmanagar, Tripura
2nd Best Script
Baje Madal baje
Script
2008
Northeastern Theatre fest,
Bilonia, Tripura
2nd Best
Production
Chal Kabadi
Production
2008
Northeastern Theatre fest,
Bilonia, Tripura
2nd Best Direction
Chal Kabadi
Direction
2008
Rupam National Theatre fest,
Silchar, Assam
Best Script
Teen Hazar Dosh
Script
2009
Northeastern Theatre fest,
Nogaon, Assam
2nd Best Script
Chal Kabadi
Script
2011
Northeastern Theatre fest,
Nogaon, Assam
2nd Best Direction
Panthosangeet
Direction
2012
Rupam National Theatre fest,
Silchar, Assam
Best Script
Panthosangeet
Script
2012
Rupam National Theatre fest,
Silchar, Assam
Best Light
Designing
Panthosangeet
Light Design

তালিকাটি সম্পূর্ণ নয় কেননা ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে করিমগঞ্জে “বহুরূপী” আয়োজিত নাট্যোৎসবে “রেস্‌” পরিবেশন করেছে “পান্থসঙ্গীত” কিন্তু বরাকের নাটক বিষয়ে গবেষণারতা জনৈকার কাছে প্রাপ্ত এই তালিকায় তার উল্লেখ নেই।

















ঘুম ঘর