নারকীয়
স্বর্গপথগাথা
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
‘ Through me you go into the city of weeping’
Dante, Inferno, Canto III
পাতালে প্রবেশ পর্ব
১।
কোথাও বলেনি কেউ “পথিক
তুমি কি
হারিয়েছ পথ”? তবু
গমনের মধ্যপর্বে এসে
টেরপাই নিজমনে – পথ
হারিয়েছে –
সূচীভেদ্য অন্ধকারে দ্রাঘিমা ও অক্ষ ঢেকেছে।
এ অরণ্য মৃত্যু থেকে ভয়ঙ্কর। তাকে
অসম্ভব এঁকে রাখা – জানি – কোনো লিপি বা অক্ষরে -
-কেননা যক্ষহেন অক্ষরের অ-মৃত
শরীরে
আজো ততো দ্যুতি নাই। টেরপাই বৈতরণী তীরে
অন্ধ এক উপত্যকা পৌরাণিক সর্পিণীর মতো
এঁকেবেঁকে দিগন্তের নাভি ছুঁয়ে দিয়ে
নক্ষত্ররচিত কোনো প্রাকারের মতো
পর্বতের দুর্গহেন নিবিড়ে মিশেছে।
হয়তো বিপথ তবু পথান্তর অসম্ভব জেনে
চলি আমি অন্ধ অই পর্বতের টানে।।
২।
তখন সূর্য্য ক্রমে নক্ষত্ররক্ষিতাদল নিয়ে
অপর দিনকে তার বরাভয় দিতে
ধাবমান। সূর্যের এ যাত্রা যেন
সূচিত আদিমতম প্রেমের প্রসাদে –
সহসা শার্দূল এক সূচীভেদ্য অন্ধকার ভেঙ্গে
আট্কে দাঁড়ালো পথ।
অসম্ভব মুগ্ধতায়,
ভয়ে,
চিত্রে অর্পিত আমি যেতে থাকি ক্রমেই পিছিয়ে –
শার্দূল,অগ্রসর,বিচিত্রিত রোমরাজি নিয়ে।
পলায়নতৎপর আমি ভীত চোখে আকাশে তাকিয়ে
দেখি সূর্য এতাবৎ তেমনি নিঝুম থেমে আছে ।
তখনই বাতাসকেও কম্পিত করে ঘোর ত্রাসে
একটি পেশল সিংহ আর একজন নেকড়েনি আসে –
হয়তো বিপথ তবু পথান্তর অসম্ভব জেনে
পুনরায় চলি আমি অন্ধ অই পর্বতের টানে।।
৩।
‘দাঁড়াও পথিকবর! জন্ম তব বঙ্গে, জানি!
তিষ্ঠ ক্ষণকাল!” নিশিডাকহেন এই
কন্ঠস্বর শুনে
স্থাণুবৎ স্তব্ধ আমি। স্বর ফিরে বলে
“ অদ্য আমি নামানুষ, তবে, মনুষ্যের অধিগম্য দেশে
‘কবি’ এই ছদ্মবেশে ছিলাম অনতিদূরে, কালে”
-কবিকে চিনতে পারি।
অলৌকিক ভূগোলে ও কালে
এভাবে কবিকে পেয়ে আমার কাহন আমি
বলি তাঁকে। সবুজ জোনাকি জ্বলে কুয়াশার জালে –
‘যদিও শ্বাপদগুলি ভয় দেখিয়েছে, তবু সাধ’ বলি আমি,
‘চক্রবালে লগ্ন অই পর্বতের শীর্ষদেশে যেতে’।
‘তুমিতো জানোনা অই পর্বতের অসম্ভব দেশে’
‘কে
তোমার অপেক্ষাতে আছে’ কবির
গভীর স্বর বলেঃ
‘তোমাকে বিঘ্নহীন তার কাছে নিয়ে যাব বলে
আমার যাত্রা এই পর্বতের নিম্ন সমতলে”।
৪।
কবির গভীর স্বর বলেঃ “ শার্দূল, প্রহরী সে,
অন্ধ অরণ্যের। সুকৃতি, সুনিশ্চিত,
তোমাদের
যুগল ভাগ্যের। অন্যথায় আর সব পথিকের মতো
তুমিও শিকার হত্ সুনিশ্চিত, অই
শার্দূলের।
অই যে নেকড়েনি,
তার জননাঙ্গে এবং জঠরে
দাহ্য ক্ষুধা। রতিসঙ্গিনীর
বেশে পশুপুরুষের
শোণিত আস্বদ করে এতাবৎ তৃপ্তি নাই তার –
সিংহটির চক্ষে তাই জ্বলমান ধাতব ধিক্কার।
সিংহ, সে’ও গর্বে অন্ধ,
তাই নেকড়েনিকে
বন্দী করে । নেকড়েনিটি আবার পালালে
সিংহ তাকে ফিরে ধরে আনে এ অরণ্যে,
পাতালে, নরকে। - এরকম বিপত্তি অনেক
এই পথে। সুতরাং
হিংস্র তবু ভিন্ন পথ দিয়ে
আমাদের যেতে হবে সমুদয় বিঘ্ন পেরিয়ে।।
নরকপথ পর্ব
১।
দিন ক্রমে নিভে আসে।
নেমে আসা বাদামী সন্ধ্যার
ডানা ছুঁয়ে থেমে গেলে পার্থিবের দাহ্য পারাপার
গমন প্রস্তুতি চলে আবডালে কবির ও আমার।
এ যেন সমরযাত্রা,
অন্তরালে, আপনারই সাথে
দ্বন্দ্বযুদ্ধ । নিঃসময়ে, অপার্থিব নিরালোক রাতে
চিত্রাঙ্কন – গুহাগাত্রে, তালপত্রে, গুপ্ত প্যাপীরাসে।
‘যে রজনী যায়, আজি’, ধীরে, অতি ধীরে
ব্যাপ্ত হোক্ চরাচরে, বৈতরণী তীরে।
আমি তাকে লিখে যাবো মর্মজলাক্ষরে।
কালপুরুষ-সহোদর নিজে এ যাত্রায় আমার সহায়
প্রতিটি গমনক্ষণ সুতরাং মূর্ত্ত মাধুকরী –
লিখে রাখি গুহাগাত্রে,প্যাপীরাসে, তালের পাতায়।
দিন ক্রমে নিভে আসে। ঘুমদেশে নদীগুলি ধায়।
২।
“ আমি সে তোরণ যার পরপারে রোদননগরী।
আমার অপর পারে না-প্রাণের নীরন্ধ্রতা শুধু।
আমি সে তোরণ যার পরপারে না-সময় ধূধূ।
আমার জন্মের কেচ্ছা বৈতরণীঅতলে নিহিত।
ঈশ্বরের উদ্ভাবন আমি, নিজহাতে গড়া ঈশ্বরীর।
অন্তিম প্রমাণ আমি আদিতম প্রীতি ও রতির।
শূন্যেরও আদি আমি, আমি প্রাক্ কৃষ্ণ-গহ্বরের।
না-বস্তুর সত্তা আমি, আমি হই না-সময়জাত।
আমার অপর পারে বৈতরণী ক্রমেই নিহত”।।
-এসকল বাক্যগুলি তোরণের ললাটে খোদিত।
পাঠমাত্র টেরপাই মর্মমূলে আমি দ্বিখন্ডিত।
বলি “কবি, বল আমি জীবিত না মৃত?”
“মমতা, কামনা, ভীতি, স্মৃতি ও যাতনা
সমূলে পুড়িয়ে তবে এ তোরণ পার হতে হয়।
কবির গভীর স্বরে প্রকম্পিত ব্যাপ্ত না-সময়।
“না-আশার এই বৃত্তে ছায়াদের বসতি, বিস্তার,
আলো থেকে, অন্ধকার থেকে এরা সব পূর্ণ বিতাড়িত –
তবুও এ বৃত্তে তুমি বহু ছায়া পাবে পরিচিত”।।
৩।
কেবলই ক্রন্দনশব্দ, শীৎকার আর হাহাকার এখানে হাওয়ায় উড়েগিয়ে
ফিরে আসে নিরাকাশদোরে ধাক্কা খেয়ে। এখানে দিগন্ত নেই। কোথাও তারার
চিহ্ন নেই। ভীতি ও বিস্ময়ে মিশে নেমে আসে গাঢ় অশ্রু দুচোখে আমার।
ক্রিয়া, বাক্য, বিশেষণ, বিভক্তি ,কারক এইখানে ব্যাকরণসূত্র হারিয়ে
আর্তনাদে মিলে গিয়ে অবয়ব পায় কোনো হিংস্র না-ভাষার –
ছায়াগুলি পরস্পর ছুঁয়ে থাকে তবু কেবলই ক্রন্দনশব্দ, শীৎকার আর হাহাকার।
এখানে মাত্রা, যতি, আকার, আকৃতি বিকৃতির চাবুকে শাসিত।
এইখানে বর্ণ নিজে মৃত,বর্ণহীন। ধূসরতা এইখানে হয়েছে ধূসর –
সকল সংকেত মুছে এইখানে বয়েযায় মুহুর্মুহু না-ধূলির ঝড়।
এখানে ‘জীবন’ কবে মরেগেছে, অজানিতে, নিছক ‘যাপনে’ –
এখানে শব্দের শব ভেসেযায় ভুলে গিয়ে ব্যবহার, মানে।
এখানে ‘যাপন’গুলি স্বপ্নাতুর হয়না কোনো সমুদ্রের দূরাগত গানে।
৪।
সহসা সম্মুখে ওরা কারা? পাতালের গর্ভগত কোন্ পুরী থেকে
ছায়ামিছিলের মতো মুখগুলি, শৃংখলিত, বার হয়ে আসে একে একে?
‘অই তো পাগল বিশু, অই তো নন্দিনী’ – বলি আমি আমার কবিকে –
“গো নন্দিনী! ফাগুলাল! বিশু! এদিকে তাকিয়ে দেখো!
চেনোনা আমাকে? এই সব কি চেহারা? না-মানুষ
না-হাড্ডির এই কাঠামোতে প্রাণ, মন কখনো ছিল কি”?
“রাজার উচ্ছিষ্ট বলে এই স্থানে এরা পরিচিত।
লোহা ক্ষয় হয়েগেছে। মর্চেতেই অদ্য সমাহিত
এরা সব। এরা শব। প্রাণ নেই। তবু নয় মৃত” –
কবিরও স্বরের মধ্যে বিষাদের ধারা প্রবাহিত।
“এরা সব নিজহাতে জন্মমাত্র নিজেই নিহত।
বিশ্বরূপ কিংবা কোনো অন্যতর কালাজাদু নয়
এদের ঘাতক। হায়, স্বয়ং মৃত্যুরও কাছে এরাই বিস্ময়”!!
২২/১০/১৭ – ১৩/০১/১৮