প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Tuesday, May 14, 2019

এক অস্বচ্ছ ভারতীয়ের অস্বচ্ছ চিন্তা


এক অস্বচ্ছ ভারতীয়ের অস্বচ্ছ চিন্তা

১। টুক্‌টুক্‌-টুক্‌টুকি
প্রত্যন্ত কোনো মফস্বলের কোনো নিদাঘ দ্বিপ্রহরে যদি শুনতে পান ডাকহয়তো বা সুললিত কিশোরী কন্ঠেরইযেমন শুনেছিলেন রবীন্দ্রনাথতাঁর "চৈতালী' "পুঁটু" কবিতায়তাহলে ...
রবীন্দ্রনাথ শুনেছিলেন  "কে ডাকিল দূর হতে,“পুঁটুরানী,আয়"
অতঃপরঃ
দুয়ার করিয়া ফাঁক দেখিনু বাহিরে।
মহিষ বৃহৎকায় কাদামাখা গায়ে
স্নিগ্ধনেত্রে নদীতীরে রয়েছে দাঁড়ায়ে।
কিন্তু ২০১৯ সালের কাছাড় জেলার নিদাঘ দ্বিপ্রহরে "পুঁটুরানী" নয়, যে ডাক প্রায়শই শোনাযায়, যাচ্ছে, যাবে আরো কিছুদিন, তা, "টুক্‌টুক্‌, ও টুকটুক্‌" বা "টুকটুকি, ও টুকটুকি" এবং "দুয়ার করিয়া ফাঁক"  যা দেখাযাবে তা একটি আজীব শকট সেই শকট ক্ল্যাসিকেল অটোরিক্সার মামাতো বা মাসতুতো ভাই। মুখোমুখি সিটে বসে ছজন চাপতে পারে। 'পাইলট' মহাশয়ের গা ঘেঁষে আরো দুজন। অর্থাৎ ক্যাসিক্যাল অটোরিক্সার তুলনায় তিনজন মতো বেশী যাত্রী আর সামান্য কিছু বেশী সামানপত্র টানতে সক্ষম এই "টুকিটুক" বা "টুকিটুকি"। অথচ এই 'টুকটুকি' যখন প্রথম আমদানী হলো এই প্রত্যন্ত মফস্বলে তখন সাবেক ওটো চালকেরা রীতিমতো আন্দোলনে নেমেছিল এই শকটটির বিরুদ্ধে। তাদের যুক্তি, স্বাভাবিক ভাবেই, ছিল, এই শকটটি প্রবেশ করলে তাদের অটোরিক্সার ব্যবসা মার খাবে আর স্বভাবিক ভাবেই এই প্রতিবাদ ক্রমে ঝিমিয়ে পড়েছিল আর "টুকটুক" তাদের স্থান করে নিয়েছিল মফস্বলের রাস্তায় রাস্তায়। - এই বছর, ২০১৯ এ, দেশবাড়িতে গিয়ে দেখলাম "টুকিটুকের" ছড়াছড়ি। ঠিক যেমন কোনো এক বছর দেশবাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম ওটোরিক্সার ছড়াছড়ি। জানিনা ওটোরিক্সার আগমন কালে সাইকেল রিক্সার মালিকেরা কোনো প্রতিরোধ চেষ্টা নিয়েছিলেন কি'না। সম্ভবতঃ নেননি কেননা রিক্সা চালক আর ওটো চালকদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণী দূরত্ব ওটো চালক আর টুকিটুকি চালকদের মধ্যেকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণী দূরত্বের চেয়ে ঢের ঢের বেশী। রিক্সা চালক থেকে ওটো চালক হয়ে ওঠার মধ্যে ঘটেযায় নিম্ন বিত্ত থেকে "মধ্যবিত্ত" - বিত্তের হিসেবে নয় - সামাজিক গ্রহনযোগ্যতার হেসেবে - উত্তরণ। কিন্তু ওটো রিক্সা আর টুকটুকের লড়াই অন্যত্র। ওটো চালকের টুকটুক চালক হতে কোনো বাধা নেই, সামাজিক গ্রহনযোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তরণ না ঘটুক অবতরনো ঘটেনা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একবার - সকরারী লোন, জমি-গয়না বিক্রি বন্ধক, ধার কর্জ করে যে একটি ওটো রিক্সা কিনে ফেলেছে তার পক্ষে এই মুহুর্তে টুকটুক কিনে, তার চালক হয়ে, উপার্জন বাড়ানোর কথা চিন্তা করা নিতান্ত অসম্ভব। সুতরাং এই সংঘাত।
      এইবারের দেশবাড়ি যাওয়ার আরেকটি পর্যবেক্ষন এই,যে,করিমগঞ্জের মতো ক্ষুদ্র, প্রত্যন্ত মফস্বল থেকেও সাইকেল রিক্সা এক্কেবারে ওধাও। কোথায় গেলেন এঁরা? এঁরা সক্কলেই কি ওটো চালক হয়ে গেলেন? তত্ত্বগত ভাবে এমনটা হওয়া অসম্ভব আর বাস্তবে তা'যে হয়নি তার সাক্ষী আমি নিজে। অটো চালকদের মধ্যে আমার অনেক সহপাঠী রয়েছে, তাদের দাদা, জামাইবাবুরা রয়েছেন। রয়েছেন ওই শ্রেণীরই মানুষেরা যাঁরা লেখাপড়া ঠিক মতন করেননি নানা কারণে। কিন্তু ওই অটোচালকদের মধ্যে এমন একটিও মুখ নেই যাঁদের আমি আমার বেড়ে ওঠার নানা সময়ে দেখেছি রিক্সা চালাতে।
তাহলে কোথায় গেলেন তাঁরা? তাঁরা কি তাঁদের রিক্সা চালিয়ে উপার্জন করা "পুঁজি"তে পুঁজিপতি হয়ে দোকান পসরা খুলে বসলেন? না'কি তলিয়ে গেলেন যাপনের শেষতম ধাপটিরো তলায়? যাঁরা এখনো তলিয়ে যাননি যাপনের শেষতম ধাপটিরো তলায় তাঁরা এখন কেউ মুদীর দোকানের খুচরো হ্যান্ডেল, কিংবা চাঅলার হেল্পার, কেউ বা চেষ্টা করছেন দিন মজুরীর। - অর্থাৎ সাইকেল রিক্সার চালক হিসেবে তাঁদের যে উপার্জন ছিল তার দশ থেকে পঁচিশ গুন কম উপার্জনে তাঁরা এই মুহুর্তে যাপনের চেষ্টা নিচ্ছেন বা সেই চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মুছে গেছেন।
ওটো-টুকটুকের লড়াইও থেমেছে। এখন ওটো-টুকটুকি ভাইবোন না হলেও সতীন অন্ততঃ নয়। কিন্তু কতোদিন? যখন একচেঁটে পুঁজি এসে হানা দেবে এখানেও, তখন? তখন কি ঘটবে? - অর্থাৎ ওলা-ইউবারহেন 'দাদা'রা, যাঁরা গু-হাটি অব্দি হেঁটে চলে এসেছেন, তাঁরা 'শিলচর', যা এখন চামচিকে-পাখি, তাতে হানা দেবেন অচিরেই, অতঃপর করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি সর্বত্র হবে তাঁদের রাজত্ব। তখন? তখন কি ঘটবে? - তখন ঘটবে এই, যে, কোনো একবার দেশবাড়িতে এসে দেখবো ওটো-টুকটুকি ভাইবোনেরা সব্বাই নিরুদ্দেশ। হাতেগোনা এক দুইজন ঘর গামছা বেচে মোটরগাড়ি কিনে নেমেছে ওলা-ইউবারের ড্রাইভারি করতে, বেশ একটি অংশ বড় অংশ দুলুবাবু-দিলীপবাবুদের স্বনামে-বেনামে নেওয়া ওলা-ইউবারের চালক হয়ে পেট চালাচ্ছে। সবারই উপার্জন, গড়ে, আগের তুলনায় দশ থেকে পঁচিশ গুন কম। আর বাকিরা স্রেফ "নেই" হয়ে গেছে। ঠিক যেমন "নেই" হয়ে গেছেন লেটার প্রেস যুগের কম্পোজিটার ও অন্যান্য কর্মীরা ডিজিটেল প্রিন্টিং এর যুগে। ... হ্যাঁ, অনেকে বলবেন "প্রগতি", মোদী হুজুরের বান্দা'রা বলবেন 'উন্নতি', "আচ্ছে দিন" কিন্তু তাঁদের ধাপ্পাবাজির পাশ কাটিয়ে আমরা কি সন্ধান করে দেখবোনা, এখনো, এই "নেই" হয়ে যাওয়ার ম্যাজিক-মঞ্চের পেছনের কারসাজি গুলি? - যদি না দেখি তাহলে আমরাও যে কবে "নেই" হয়ে যাবো, তা আমরা জানিনা - তবে 'তিনি' বা 'তাঁরা' তা জানেন। গণৎকারের চেয়ে ঢের বেশী "একিউরেসি'তে জানেন।
         স্বচ্ছ ভারতের গোমাতাসন্ততিরা অবশ্যই প্রশ্ন তুলবেন "কে এই 'তিনি' বা 'তাঁরা'? আমরা তো গোরুমা আর তারামা আর শ্যামাপ্রসাদ আর সাভারকার বাবা ভিন্ন অন্য জানিনা" ... না, এই সকল স্বচ্ছ গোশাবক দিগকে নিয়ে আমি ভাবিত নই। আমি ভাবিত সেই সকল আম-মগজগুলিকে নিয়ে যারা এতাবৎ তেমন স্বচ্ছ ভারতীয় নয়, যাদের মর্মে এখনো প্রশ্ন আছে, প্রশ্ন ওঠে, তাঁদের নিমিত্ত আমি চেষ্টা করবো 'তিনি', 'তাঁরা' ও এই 'ডিজিট্যাল' যুগে তাঁদের কলা কৌশল, আমি যতোটা টের পেতে পেরেছি, তা'ই বুঝিয়ে বলতে। কয়েক কিস্তিতে।


ঘুম ঘর