প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Friday, May 24, 2019

শাদামুখ-কালোমুখ


শাদামুখ-কালোমুখ
সপ্তর্ষি বিশ্বাস

" And indeed there will be time
For the yellow smoke that slides along the street,
Rubbing its back upon the window-panes;
There will be time, there will be time
To prepare a face to meet the faces that you meet;"
"The Love Song of J. Alfred Prufrock" - T. S. ELIOT




দিনটি ২৩ অক্টোবর। সন  ১৯৯০। আমার প্রথম দিন শিলচর আরইসি'তে। কিভাবে যে এড্‌মিনিস্ট্রটিভ বিল্ডিং থেকে জাইজেক্‌ড্‌ হয়ে এসে পড়লাম থার্ড হোস্টেলের কোনো ফ্লোরে, কোনো একটি সিংগল-রুমে তা আর মনেনেই। যা মনে আছে তা প্রহৃত হতে থাকা "সিনিয়র" দের দ্বারা। নতুন ছাত্র ঢুকলে এই পেটানোর নামই "র‍্যাগিং" যা ভোটবাক্স পিটিয়ে নয় কে ছয়, ছয় কে নয় করলে হয়েযায় "রিগিং"। "নবীন বরণের" এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমার কপালে জুটছিল আরো বেশী প্রহার কেননা আমার দেশগেরামের দুই "দাদা" - অনুপ দেব আর দুলাল দেব - জানে, যে আমি "লেফ্‌টিস্ট"। ছাত্র রাজনীতিতে "এক্‌টিভ্‌"। ওদের সঙ্গে আরেকটি ছোকরা ছিল - হোস্টেলে ওকে বলা হত "হেটেশ", পরে জেনেছি। আরেকটিকে বলা হত "কাকা" মানে কা-কা, মানে, কাউয়া, মানে কাকহেন কন্ঠস্বর-হেতু। দিনটি ২৩ অক্টোবর। সন  ১৯৯০। সেদিনই লালকৃষ্ণ আদবানীর দেশব্যাপী দাঙ্গা বাধানোর উদ্দেশে ভ্রাম্যমান "রামরথ" কে আটকালো, খুব সম্ভবতঃ মোলায়েম সিং যাদব। আর আদবানী ( এবং সঙ্গে হয়তো আরো কিছু নেতা) চালান হল জেলে। - এই সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় আমার "নবীন বরণ" ও হতে লাগলো আরোও মশলাদার ...। আসরে ছিল আশিসতরু, যে একদা পশ্চিমবাংলার ১ম হয়েছিল মাধ্যমিকে। "আনন্দমেলা"ইয় ছাপা ফোটোর সংগে মিলিয়ে চিনেছিলাম। তবে সে, হাত, আমার ওপরে চালায়নি। দলে ছিল।
"তুই কমিনিস্ট?"
"না"
"না মানে? কলেজে পলিটিক্স করতি না? কমিনিস্ট পার্টি?"
"কমিউনিস্ট পার্টি করার মানেই কমিউনিস্ট হওয়া নয়"
"আরে, ব্যাটা এখুনি জ্ঞান দিতে লেগেছে দেখি" - ব্যাস্‌, আরম্ভ আরেক দফা চড়চাপড়।
"অযোধ্যায় যে রাম মন্দির ভেঙ্গে বাবরি মশজিদ হলো, তখন তোর কমিনিস্টরা কোথায় ছিল?"
" ওটা মন্দির না মশজিদ তা কিচ্ছুই প্রমাণ হয়নি এখনো, আর মন্দির থেকে মশজিদ হওয়া যা, মশজিদ থেকে মন্দির হওয়াও..." -
"শাল্লা, বাঙ্গালরার সাপোর্টে মাতে" - অর্থাৎ 'মুসলমানদের সমর্থনে কথা বলে' -সঙ্গে সঙ্গে আরেক রাউন্ড চড়চাপড় ...
যাইহোক, সেসব ১৯৯০ সালের কথা। আমি নিজে তখন ১৮-১৯, সেই মারকুটে "দাদা"রাও আর কত হবেন? অনুপ, দুলালেরা আগেই "নানা কেলাসে, খোপে খোপে থরো নলেজ" নিয়ে আরইসিতে এসেও সেমিস্টারে সেমিস্টারে জিরিয়ে জিরিয়ে তখন ফাইন্যাল ইয়ার। কত হবে তাদের বয়স? ২৪? বড়জোর ২৬? - তাহলে আজ, ২০১৯ সালে তাদের বয়স ... সহজ অংক ... কিন্তু আশ্চর্য এই, যে, তাদের তখনকার ভাবনাচিন্তার সঙ্গে আজকের তাদের ভাবনাচিন্তা, যা এই মহৎ বদনবহি মারফৎ পেয়েছি, দেখিনি সামান্যতম কোনো পরবর্তন, কোনো পরিণতি। আজো তারা তেমনি মূর্খের মতন কথাবার্তা বলে, ছড়ায়। না, দাঙ্গা করতে যায়না কারন দাঙ্গা করাটা হোস্টেলে নতুন আসা ছাত্রদের পেটানোর মতো একতরফা যে নয়, তা এরা জানে।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সেই শিলচর আরইসি'রই আরেকজন, আমাদের থেকে দুই বছরের উঁচু ক্লাসের ছাত্র (আমি তার স্নেহ পেয়েছিলাম তখন, এখনো পাই), নিজের রুমে, দু-নম্বর হোস্টেলে, ঘুম দিচ্ছিল। ধরাযাক তার নাম "এক্স", তাকে ডেকে তুল্লো তার সমপাঠীরা। "চল্‌ চা খেয়ে আসি"। এই দলটির সঙ্গে সে মিশতো। ফলতঃ স্বাভাবিক নিয়মেই সে'ও চল্লো ওদের সঙ্গে চা খেতে। অবশ্যই বাবরী নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা চলছিল। হঠাৎই দলের একজন, যে'ও আমাকে খুবই স্নেহ করতো, ( ধরাযাক তার নাম ওয়াই) হঠাৎই বল্লো, "এই যে শালা জাকিরের রুম" , জাকিরদা তখন আমাদের কলেজের স্পোর্টস্‌ সেক্রেটারি, বলেই দরজায় ধাক্কা দিল জাকিরদার। দরজা খোলামাত্র সে বসিয়ে দিল চড়, জাকিরদার গালে।- এক্স্‌দা সেই মুহুর্তে ওয়াই'দা চরিত্রের এমন একটা দিক এ জানলো, যা সে অদ্যাপি বিস্মৃত হতে পারেনি। "আমার তো এমন লজ্জা  লাগলো, যদি আমাকেও দেখে জাকির, তবে ভাববে আমিও ওই রকম... প্রায় দৌড়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে মুখ বাঁচালাম" - আজই ফোনে সে বলছিল আমাকে। - অর্থাৎ ১৯৯২ সালে তার যে মৌলিক অবস্থান ছিল তা রয়ে গিয়েছে এখনো। একইভাবে ওয়াই'দা ও অন্যদের অবস্থান, তাদের বদনবহি মারফৎ, হোয়াট্‌সেপ মারফৎ, বিন্দুমাত্র বদলায়নি।
প্রসঙ্গ গুলি মনে আসবার অনুষঙ্গ এই, যে, একই মানুষের মর্মে নানা মানুষ, নানা মুখ থাকে, সত্য। তার সবগুলি সে নিজেও হয়তো দেখতে পায়না একটি জীবনে। অন্যরাতো দূরস্থান। প্রশ্ন এই, যে, তার সেই অনেকমুখের মধ্যে কোন্‌ বা কোন্‌ কোন্‌ মুখগুলি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে? - এই প্রশ্নের জবাব, যদিও খুবই আদিম ভাবে, খুঁজবার চেষ্টা করেছেন স্টিভেনসন তাঁর "ডঃ জ্যাইল এন্ড মিস্টার হাইড" এ এবং গ্রন্থটি শেষ হচ্ছে এইভাবে I bring the life of that unhappy Henry Jekyll to an end - অর্থাৎ অন্তর্গত দানবটিকে বিনাশের নিমিত্ত তার মর্মের অর্ধেকমানুষটি আপনাকেই নিঃশেষ করে দিলো। মর্মের নানামুখ নিয়ে ভাবনার ক্ষেত্রে আমার মনে আসেন জেমস্‌ জয়েস্‌, বিশেষ করে তাঁর "ইউলিসিস" আর সেই মহা-উপন্যাসের নায়িকা মলি ব্লুম্‌। মলি'র সংখ্যাতীর মুখ ছড়িয়ে রয়েছে গ্রন্থটিতে, সন্তানহীনা জননীমুখ, নানাপুরুষের আসঙ্গকামনায় ও সঙ্গমে তপ্ত মুখ, লিওপোল্ডের পত্নী হিসাবে গৃহিণীমুখ - যা সরাসরি মলি'র কামুকামুখের প্রতিপক্ষে। কিন্তু অন্তিমে তার সেই "ইয়েস্‌ মোনোলগ" এ তার গৃহিনীমুখটিই ভাস্বর হয়েথাকে। অন্তর্গত মুখের মিছিল, সবচেয়ে বেশী ও জটিল দস্তয়ভস্কিতে। তাঁর সৃষ্ট জটিলতম চরিত্র ফাইদোর কার্মাজভের কোন মুখটির নিমিত্ত সে কাঙ্ক্ষিত? সে'কি তার "সেন্সুয়েল" মুখগুলি না'কি তার "সেইন্ট" মুখটি? একই প্রশ্ন ওঠে ফাদার জসীমা'কে ঘিরে। শরচ্চন্দ্রের "একাদশী বৈরাগী"র কোন মুখটি, অন্তিমে শরৎচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন? - কথাটি এই, যে, অন্তিমে অনেক মুখের মধ্যে একটি বা কয়েকটি বিশেষ মুখের সমাহারই নির্ণয় করে একটি চরিত্রকে। ঠিক যেমন একটি লৌহপিন্ড তখনই চুম্বক যখন তার অন্তর্গত অনু-পরমাণু চরিত্রের বেশীরভাগই চুম্বকহেন আচরন করছে। অতএব কম্পাসবহনকারী সততই চাইবে চুম্বককে দূরে রাখতে নতুবা চুম্বক তার কম্পাসকে করবে বিপথগামী, অচল।
আন্‌ফ্রেন্ড্‌ বা ব্লক করার ক্ষেত্রে আমিও মেনেচলি সেই নিয়মই। যে বদনটিকে আমি বদনবহিতে "ব্লক" করছি, আমার সীমিত দেখার মধ্যে তার কোন্‌ মুখটি বেশী ভাস্বর? ভাবুকমুখ? বজরং-মুখ? গায়কমুখ? দাঙ্গাবাজমুখ? ...

ঘুম ঘর