“সে আসিবে, আমার মন বলে ...”
টেবিলে রাখা ফোনটা আবার বেজে উঠতেই রিনার মনেহল এবারেও নির্ঘাৎ রং নাম্বার। তবু , হয়তো অভ্যাসের বশেই কিংবা হয়তো দুপুরের প্রায় অপ্রাকৃত নিঝুমতার হাত এড়াতেই উঠে গিয়ে রিসিভার টা হাতে নিলো সে।
"হ্যালো... "
"কে, রিনা?... "
"বলছি "
"আমি মিতা...।মিতা... মিতালী.. "
একটু কি ধাক্কা লাগলো রিনার কোথাও? বল্লোঃ "ওহ, বল কেমন আছ"
ও প্রান্তেও যেন জড়তা। ভোরের হালকা কুয়াশার মতো না'কি মাঘ নিশীথের কুয়াশা,সুচীভেদ্য? "রিনা, একটা খবর দিতে তোমাকে ফোন করলাম... "
"বল"
"রিনা, ও.. ও আসছে.. "বলতে গিয়ে স্বর কি কেঁপে উঠল ওই প্রান্তের? মিতার?
মুহুর্তের দম নিল রিনাও।
"শুনেছি... "
"ওহ" কয়েক মুহুর্তের নীরবতা, ওপ্রান্তে। এ প্রান্তে আধা মধ্যবিত্ত পাড়ায় আধা অলস দুপুর। কয়েক পুরুষের তেতলা বাড়ির দোতলার কোঠা। ও প্রান্তে পশ্ রোদ্দুর ছুঁয়ে আছে পুলের হাল্কা নীল। জানলা দিয়ে দেখা যায় যত্ন করে কামানো যুবতী 'অঙ্গের' মতো পার্ক। যুবকের উত্তেজিত পৌরুষের মতো ফ্ল্যাট। দুয়ের মাঝখানে এই মুহুর্তের যোগাযোগ এই ইথার বাহিত বার্তালাপে।
“ কে জানালো? … ও নিজে...”?
“না। … কাল দিবাকরদা এসেছিল”।
“ ও দিবাকরও জানে তাহলে ...। দিবাকর কোথায় শুনেছে কিছু জানো? “
“না”
“আমাকে একটা হেল্প করবে রিনা...”
“বলো...”
“ সোমাবৌদি'কে একটু দেবে খবরটা...। ওরা তো তোমার কাছাকাছিই থাকে ... ”
“ হ্যাঁ। … তুমিওতো ফোন করে বলে দিতে পারো...”
“ তাই তো করব ভেবেছিলাম। কিন্তু সোমাবৌদিদের ফোনটা বোধহয় বিগড়ে আছে ...। দুদিন থেকে কিছুতেই লাইন যাচ্ছেনা ...”
“রতনদা'র অফিসের ফোনে”? - রিনার কন্ঠে, দৃষ্টিতে কি কিছু ছায়া ফেল্লো? জিঘাংসার মতো? কিংবা আরেকটু কঠিন কিছু?
“... হ্যাঁ, সে'ত করাই যায় … মানে... তোমার যদি অসুবিধা থাকে ...”
“না না, অসুবিধা কি? ওদের বাড়ি তো আমাদের দু গলী পরেই। গিয়েই জানিয়ে আসব এক সময় ...”
“ বাঁচালে ভাই ...”
ফরিদের দোকানের সামনে এসে রিক্সা নিলো রিনা। ফরিদ এখন দোকানে নেই। ফরিদের সেই 'গিলে খাওয়া' চোখ শালাটি রয়েছে। তার তেরছা তাকানোতেও শাড়ির আঁচল কিংবা ব্লাউজে টান দিলোনা রিনা। গোপনে দেখেও নিলোনা বুকের দিকে। রিক্সাওয়ালাকে বল্লোঃ “রতনদা'র অফিসে চলো ...”
রিক্সাওয়ালা প্রশ্ন করলো “ সেটা কোথায় দিদি “ ?
ভুল শুধরে নিয়ে রিনা বল্লোঃ “ পিডব্লুডি অফিস, ছোটটা ...”
প্রায় বিকালের মুখে দেখাগেলো “ছোটো” পিডব্লুডি অফিসের মাঝারি সাইজের ক্যান্টিনে রতন চৌধুরি আর রিনা বসে আছে কাঠের বেঞ্চিতে, মুখোমুখি। মধ্যবর্তী কাঠের লম্বা ডেস্কে চা আর সিঙ্গারা ঠান্ডা হচ্ছে। রতন চৌধুরি প্রথমটি শেষ করে দ্বিতীয় সিগারেটে এসে বল্লোঃ “ সোমা জানে খবরটা “ ?
-” জানিনা, আমিতো জানাইনি। মিতালীদির ফোন পেয়েই তোমার এখানে চলে এলাম ...”
“মিতা বল্লো আমাকে জানাতে”?
হয়তো হ্যাঁ বা না এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই রিনা আঁচল সামান্য আলগা হল। ঝুঁকেপড়ে কি যেন কুড়িয়েও নিলো রিনা। “আমাকে এখন উঠতে হবে রতনদা। দাদা কলেজ সেড়ে ফিরবে। আমারো ছাত্র আসবে ...”
“ছোটো” পিডব্লুডি অফিসের টিনে ছাওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে চতুর্থ সিগারেটটি টানতে টানতে রিনার চলে যাওয়া দেখলো রতন চৌধুরি। 'সে আসবে'। সোমা এখনো জানেনা। তবে জানবে নিশ্চয়। আজ না হোক কাল। তারচেয়ে রতন নিজেই যদি … কিন্তু তাতে কি সুবিধে হবে আদৌ কিছু?
“যতীন সোমেশদাকে … ইয়ে বড়বাবুকে বলে দিস আমি আজ চল্লাম ...” রিনার ঢলতে বসা যৌবনের গহন আগুনের সেঁকের আবডালে “ও আসছে “ এই খবরের ককটেলের ভিতর দিয়ে হেঁটে চল্লো রতন। একবার নিজের মনেই বল্লো “ আসুক না। তাতে আমার কি “? অফিস ফেরত জনতার এক দুইজন ফিরেও তাকালো তার দিকে। রতন টের পেলো কি? আরো কিছুদূর গিয়ে আবার বল্লোঃ “ ওর আসাটা সোমার পক্ষে ...” … সিদ্ধান্তে আসার পথে রাশি রাশি জলছবি, কিছু কিছু তেল রং'ও আছে। এখন কিছু কিছু ছবি সবাক হয়ে হয়ে উঠতে চাইছে ভাষ্কর্য। সুতরাং সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনা রতন চৌধুরি। আবার বলেঃ “ আসুক না। তাতে আমার কি “? বলে, তবু মন যেন চলতে চায় একটা সিদ্ধান্তের পথে। অথচ এক সময় রতন দেখে তার পথে সন্ধ্যা নেমেগেছে। লাইটপোস্টের ষাট-আশি পাওয়ারের বাল্বগুলি জলে উঠেছে। কোনো কোনো জানলা থেকে উড়ে আসছে বালিকা কন্ঠের “পিয়া কি নজরিয়া, জাদু ভরি ...” - প্রায় সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার মতোই রতন পথ পেলো। টের পেলো তার অজান্তেই তার চলা এসে থেমেছে অজিত ঘোষের মনোহারী দোকানের সামনে। অজিত ঘোষের মনোহারী দোকানের পাশ দিয়ে ছোটো গলী। একটু গিয়েই অন্ধকার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উঠেগেলে ছোটো কোঠা। আশি পাওয়ার বাল্বে 'নিরাশাকরোজ্জ্বল'। গলীর সামনে দাঁড়িয়ে, অজিত ঘোষের চোখ এড়িয়ে আরো দুটি সিগারেট টেনে নিয়ে গলীতে ঢুকে পড়লো রতন।
“আরে, 'কিং অফ ব্রাইব' যে, তা দাঁড়িয়ে কেন? অন্দরে আসতে আজ্ঞা হোক ...” - অমল। যথারীতি।
“আরেকটা গেলাস বার কর রে বিমল, প্রায় তিন যুগ পরে মহারাজের পা পড়লো এই অন্ধকূপে। তাঁর সম্মানে দুটো পেগ না হলে চলে “ ? - বক্তা বিমল। বয়োজ্যেষ্ঠ কমলদা বল্লেঃ “আরে ভায়া বসো, বসো, বসে পড়ো। হয়ে যানে নাকি এক হাত? “ ইঙ্গিত কেরোসিন কাঠের টেবিএ ছড়ানো তাসের দিকে। সবসময় যুবক ইন্দ্রজিৎ নিজের চেয়ার ছেড়ে বসতে দিলো রতন কে। “বসুন রতনদা...” পকেটের সিগারেটের প্যাকেটটা টেবিলের মাঝখানে, লাইটারসহ ছুঁড়ে দিলো রতন চৌধুরি। কিন্তু বসলো না । নিজে একটা সিগারেট টানতে টানতে প্রদক্ষিণ করতে লাগলো ছোটো কোঠাটিকে। কেরোসিন কাঠের নিচু আলমারি থেকে ততোক্ষণে কাঁচের গেলাস বার করে ফেলেছে চিরযুবক ইন্দ্রজিৎ। পেগ বানাতে লেগে গেছে কমলদা। কড়া হুইস্কি। অনেকদিন ছেড়েছে রতন। স্কচেই সে অনেকদিন থিতু। তবু গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে গেলাস টেবিলে নামিয়ে রেখে বলে উঠলোঃ
“ সত্যি তোমরা কেউ কিছু শোনোনি”?
অমল কিছু বলতে যাচ্ছিল আগবাড়িয়ে।যথারীতি। তাকে থামিয়ে দিয়ে, কমল, বয়োজ্যেষ্ঠ কমলদা বলে উঠলোঃ “ কত কিছুই তো শুনি রোজ রোজ। আগে শুনি তুমি কি শুনেছো...” ছোটো চারপেয়ে টেবিল ঘিরে এখন সকলেই বসেছে বাবু হয়ে যে যার চেয়ারে। মাথার উপরে ঝুলছে আশি পাওয়ার বাল্ব। হঠাৎ দেখলে গঞ্জের থানার ইন্টারোগেশন রুমের ছবি চোখে ভাসতেই পারে। বয়োজ্যেষ্ঠ কমলের বাক্যটি শেষ হতে হতেই চারজনের চোখে চোখে কি খেলে গেলো কোনো বিদ্যুৎ? যেন এরা, অমল, বিমল, কমল এমন কি ইন্দ্রজিৎও এক দলে। যেন হাতে সিগারেট নিয়ে কোঠাময় পায়চারী করতে থাকা রতন, রতন চৌধুরি, আর দলের। যদিও এই কোঠা, এই মুখগুলি, রতনের মস্তিস্কের কোথাও টেনে আনছে জলছবি, কিছু কিছু তেল রং'ও আছে। এখন কিছু কিছু ছবি সবাক হয়ে হয়ে উঠতে চাইছে ভাষ্কর্য। তবু রতন যে এদের কেউ নয়, অন্ততঃ এই মুহুর্তে তা টের পেতে সক্ষম কোঠার এক কোনে ঘটং ঘটং করে ঘুরতে থাকা ঊষা কোম্পানীর টেবিল ফ্যানটিও। 'ও আসছে' এই সংবাদ এরা সত্যই পেয়েগেছে কি'না তা টের পাওয়ার চেষ্টা নিলো রতন। কিন্তু সেই চেষ্টা পরাজিত হল... পরাজিত হল তার নিজের অন্তর্গত উত্তেজনার কাছেই কি? রতন চৌধুরি বল্লোঃ “ ও আসছে...”
“আরে বাহ্, বড়িয়া বড়িয়া ...” প্রায় লাফ দিয়ে উঠে বল্লো অমল। খবরটা শুনে সত্যি কি মস্তি জেগেছে অমলের নাকি এলকোহলহেতু তার অভিনয়ে যোগ হয়েছে আরো কোনো মাত্রা? টেবিলে রাখা শস্তা হুইস্কিতে আরেক চুমুক দিয়ে রতন চৌধুরি টের পেতে চেষ্টা নিতে যাওয়ার মুখেই বিমল বল্লোঃ “ ও আসছে তো তোর এত ফুর্তির কি তাতে”? “
“ তা বাপু তুমিই বা এমন ব্যাজার হলে কেন? ও আসলে তোমার কোণ পাকা ধানে মই পড়বে বাওয়া “ ? - বক্তা ইন্দ্রজিৎ।
বিমল। আমার কোন পাকা ধানে কে মই দেবে? এটা কোনো কথা হলো? ও এলেই বা কি আর না এলেই বা কি ? আমরা ছিলাম, যেমন ছিলাম, তেমনি আছি , তেমনি থাকব …
বয়োজ্যেষ্ঠ কমলদা। যেমন ছিলাম তেমনই আছি। ঠিক। কিন্তু ও এলে তেমনই যে থাকবো বা থাকা যাবে সে ব্যাপারে এতো শিওর হওয়া …
বিমল। আমরা ছিলাম, যেমন ছিলাম, তেমনি আছি , তেমনি থাকব। আলবাৎ থাকবো। কে এলো , কে গেলো তাতে আমার কোনো বালও ছেঁড়া যায়না …
অমল। না ছেঁড়া যাক, গজাতে তো পারে …
চিরযুবা ইন্দ্রজিৎ। না বাওয়া, সেটি হচ্ছেনা, এখন বাল পেকে ঝরার সময়। এখন আর কেউ এলেই বাল গজাবেনা এ আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি …"
গেলাসের মদ টুকু শেষ করে রতন চৌধুরি বল্লোঃ “ আমি যা শুনেছি, তা জানিয়ে গেলাম। এখন তোমাদের কার কি ...”
অমল। আচ্ছা, ঠিক কবে আসছে, কোথায় উঠছে - কিছু জানিস?
“না” বলে দৃশ্যটি থেকে বার হয়ে এলো রতন। কানাগলী পার হয়ে আরো খানিকটা হেঁটে একটা ট্যাক্সি নিলো।
“ কোথায় যাবেন স্যার” ?
পিছনের সিটে বাবু হয়ে বসে একটা সিগারেট জ্বেলে নিয়ে রতন চৌধুরি বল্লোঃ নিয়ে চলুন আপনার যেখানে ইচ্ছা, যেদিকে ইচ্ছা …
অমল,বিমল আর ইন্দ্রজিৎ কে যেতে দিলো কমল। বয়োজ্যেষ্ঠ কমলদা। তারপরে খালি কোঠায় বসে বসে বিড়ি টানলো বেশ কয়েকটা। “ও আসছে “। হ্যাঁ, এমন খবর আগেও রটেছে দু একবার। কিন্তু কোনো বারই শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি ঘটেনি। তার মনে পড়লো বাপ মা মড়া নিজের ভাইঝি'র মুখটি। ওহ্, এই এক মায়া, এই একমাত্র মায়া কমলের। বয়োজ্যেষ্ঠ কমলদার। এ ছাড়া আর কাউকে, কিচ্ছুকে তোয়াক্কা করেনা কমল পাল। সেই ভাইঝিও ক্রমে এখন আইবুড়ি। “ ও আসছে” - ও আসবে তো আসুক। তাতে কমল পালের কি? শুধু ভাইঝিটার কথা ভেবে …
কোঠায় তালা দিয়ে সড়কে নামলো কমল পাল। অজিত ঘোষকে চাবি দিলোনা। এই মুহুর্তে অজিত ঘোষের ভ্যাজর ভ্যাজর শুনবার কোনো ইচ্ছা নেই কমল পালের। বিড়ি মুখে হাঁটতে লাগলো কমল পাল। এটা এই মাঝারি শহরের শহরতলী অঞ্চল। বিল্ডিং, ফ্ল্যাটবাড়ি সবই আছে। আছে বস্তি। আছে এঁদো গলী, কানা গলী। এই অঞ্চল অনেক রাত অব্দি জেগে থাকে। কিন্তু জেগে থাকে নিজের খোলসের আড়ালে। পথঘাট প্রায় নির্জন। স্ট্যান্ডে গাড়ি নেই। অটো আর সাইকেল রিক্সা কিছু আছে। রাত্রি মাত্র ন'টার কাঁটা পেরিয়েছে। আসর আজ একটু আগে আগেই ভেঙ্গে গেছে। ভেঙ্গে গেছে “ও আসছে “ এই খবরেই। কিছুদূর হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালো কমল পাল। ইতিউতি দেখে নিলো একবার। কেন যে দেখলো কেজানে। তারপর খুচরো-চালিত ফোনে'র যোনিতে খুচরো ঠেসে দিয়ে ডায়াল করল নাম্বার। একবার। রিং হলো। ওপ্রান্তে তুল্লোনা কেউ। ফোনের ফুটো গ'লে ফিরে এলো খুচরো। দুইবার। তিনবার। এইবার দাঁতে দাঁত চেপে কমল পাল বল্লোঃ শালি!! চতুর্থবারে ফোন উঠলো। … “হ্যালো ...” মহিলা কন্ঠ, নেশা জড়ানো না হলেও নেশায় মেশা।
“তিন বার চার বার কল করলাম … এতোক্ষণ লাগলো তুলতে...”
“ওহ্, তুমি … সরি ডিয়ার সরি ...”
“আর ডিয়ারি দেখাতে হবেনা... কি করছিলে ...”
“কি আর করবো বলো একা মেয়ে মানুষ … রাতের বেলা...” … ওপ্রান্তে মস্ত বেডরুম। কুইন বেডে উদোম হয়ে শুয়ে আছে একটি পুরুষ। কুইন বেডের দুপাশে দুটি নাইট ল্যাম্প। পুরুষের দিকের টা নেভানো। মহিলার দিকেরটা জ্বলেছে এইমাত্র। পুরুষটির দিকে পেছন করে উদোম মহিলাটি ফোনের রিসিভার হাতে।
“আজ তো আর কারোর আসার কথা ছিলনা ...” পুরুষটি বলে। ফিসফিসিয়ে। আদতে হিসহিসিয়ে। মহিলার চোখ ইশারায় তাকে জানায় 'কাস্টমার' নয়, জানায় চুপ থাকতে।
“ তোমার তো রাতেরই দোকান...”
“সে আর বলতে। আর জন্মে যে বাদুড় ছিলাম জানোই তো ...কি ব্যাপার বলোতো, এত রাত্রে ...”
“তোমার জন্যে এটা এতো রাত হতে পারে অন্যদের জন্য এখনো রাত্রি সাড়ে ন'টা হয়নি...”
“কিছু চাই বুঝি? টাকা পয়সা? বাপ্পাকে দিয়ে পাঠাবো”? - মহিলার কন্ঠে কি স্নেহ? প্রীতি? প্রেম? প্রশ্রয়?
“না সেসব কিচ্ছু না...”
“তাহলে”? “
“ তাহলে তুমি জানোনা? খবর পাওনি? আর পাবেই কি করে - যাদের সঙ্গে তোমার শোয়াওঠা...”
“ কি হয়েছে বলোতো? আমার কিন্তু এখন সত্যি ভয় করছে...”
“ শোনো, আজই রতন এসে জানিয়ে গেলো ও নাকি আসছে ...”
মুহুর্তের নীরবতা।
“ খবর পাকা? না'কি আগের বারের মতো ...”
“ কাঁচা, পাকা জানিনা । যদি পাকা হয়, তাহলে “?
“ ...তাহলে ...তাহলে ...। কিছু একটা করা যাবে ভেবে। আমি কার সকালে তোমার কাছে ...”
“ না, পাপড়ি তোমাকে দেখলে উপায় থাকবেনা আর...”
“তাহলে?”
“দিনের বেলা বাড়ি থেকো আর ফোনের কাছে থেকো। এখন আমি ছাড়ছি। পাপড়ি'র চশমাটা সাড়াতে দিয়েছিলাম, দেখি দোকানটা যদি...”
ফোন কেটে গেলো।
“বাবুদা, যদি কিছু মনে না করেন ...”
'বাবুদা'র চোখে সন্দেহ, বিরক্তি।
“আপনি রাতে এখানেই থেকে যান। আমি মীরাকে বলছি...”
“আমি কি এখানে মীরার জন্য আসি”?
“ না, না - সে কি কথা। আমি ঘন্টা দুয়ের মধ্যেই ফিরছি। ততোক্ষণ মীরা … আর কাল দিনেও... রাতেও … আজ আমাকে একটু … বেরোতে হবে … এখুনি ...”
“হুঁ, সে আমি ফোন আসতেই টের পেয়েছি। আচ্ছা, শ্যামা, তোমাকে কি দিতে আমি কম দিই, আর দিয়েছি ...”
“বিশ্বাস করুন বাবুদা অন্য কোনো কাস্টমার না। আমিও কি আপনাকে কোনোদিন কোনো কিচ্ছুতে না বলেছি? রাগ করবেন না প্লিজ। আপনি থাকুন। আমি ঘন্টা দুয়ের মধ্যেই ফিরব। আপনি কালও থাকুন না কেন ...”
“তোমার কাজ বুঝি ফোনে হয়না?.”
“না বাবুদা, এ কাজ ফোনে হয়না” বলেই মহিলা, শ্যামা, ডাক দিলো “মীরা, মীরা...” উত্তর ভেসে এলো “দিদি ...”
“এ ঘরে আয়...”
“বাবুদা, আপনাকে আরেকটা হেল্প করতে হবে...”
“কি””
“আপনার গাড়িটা নেবো। বাপ্পা চালাবে। আমি আমার ড্রাইভারটাকে এই ব্যাপারটাতে জড়াতে চাই না...”
“কি ব্যাপার বলোতো শ্যামা, এতো আর্জেন্ট, এতো সিক্রেসি ...”
“ সে অনেক কথা। বলবো আপনাকে ...।”
“চাবি আমার প্যান্টের পকেটে। নিয়ে যাও। কিন্তু ...”
“না না, কিচ্ছু ভাববেন না , শ্যামা আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়ে খুন জখমে জড়াবে না...”
“খুন জখম...”
রহস্যময় হাসে শ্যামা। “এই তো মীরা রেডি, আজ শেভ করেছিলি” “ ?
“ হ্যাঁ দিদি” “ ...
“ এই তো গুড্ গার্ল … আমি তাহলে চট করে একটু রেডি হয়ে নি, তুই থাক বাবুদা'র কাছে ...”
রাত্রির নগ্নতার উপরে কুয়াশা টানিয়ে দিয়েছে হাল্কা মশারি ততোক্ষ্ণে। এই মশারিকে কুমারীর যোনিপর্দার মতো মুহুর্মুহু ছিন্নভিন্ন করতে করতে এগিয়ে চলেছে শ্যামার গাড়ি। চালক আসনে বাপ্পা। সে'ও নিশ্চিত নয় গন্তব্য বিষয়ে ফলতঃ প্রতি মোড়েই তাকে প্রশ্ন করতে হচ্ছে “দিদি, এবার কোন দিক নেবো “ ? শ্যামা বলে দিচ্ছে। কিন্তু একবারে বলছেনা গন্তব্যটি ঠিক কি বা কোথায়। গাড়ির এসি বন্ধ করে জানালার কাঁচ নামিয়েদিয়েছে শ্যামা। থুতনি জানালায় রেখে বসেছে শ্যামা। হাওয়ায় উড়ছে তার অন্ধকার চুল। ' ও আসছে' … সে'কি আনন্দের খবর তার কাছে? না'কি প্রতিশোধ স্পৃহাই তাকে টেনে নিয়ে চলেছে এখন? এখনো ? না'কি মনের কোথাও ঝরেযেতে চাইছে কয়েক বিন্দু জল – ক্ষমার? ভালবাসার? 'ও আসবে, কোনো দিন আসবে' এ যেমন নিশ্চিত তেমনি 'ও আসছে' এই সংবাদের ভ্রূন হয়ে বেড়ে উঠেও ঝরে গেছে আগেও অনেক বার। প্রতিবারই শ্যামা এমনি অস্থির হয়েই ছুটে গেছে কারো না কারো কাছে। ঘটিয়েফেলতেচেয়েছে কোনো না কোনো ঘটনা …
“শালা, খানকীর ছেলে, চোখেদেখোনা তো এতো রাতে পথে বেরোও কেন...” প্রবল ব্রেকের আবহে বাপ্পার কন্ঠ। “ আর একটু হলেই বারাটা গাড়ির নিচে পরছিলো আর কি ...” এই খন্ড বাক্য দুটিতে ভর করে শ্যামা যেন ফিরে আসে গ্রহান্তর থেকে - এই গ্রহে, এই শহরে, এই রাস্তায়, এই সময়ে। সে দেখে হেড লাইটের আলো পার হয়ে অস্থির পায়ে রাস্তা পার হচ্ছে এক যুবক। “ নেশা ফেশা করেছে হয়তো, ছেড়েদে - তুই চল” - বলে শ্যামা। যুবক ততোক্ষণে রাস্তার অন্য পাড়ে। তাকে আলোয় ভাসিয়ে তারপর অন্ধকারে ডুবিয়ে গাড়িটি চলেযায়। মোড় নেয় হাইওয়ের দিকে।
গাড়িটি হাইওয়েতে মিলিয়ে গেলে লাইটপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ে দিবাকর। আস্তে আস্তে সিগারেট বার করে পকেট থেকে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর ছায়া থেকে বেঁচে যাওয়ার উল্লাসে না'কি ভয়ে না'কি বিস্ময়ে তার আঙ্গুল কাঁপে ? কাঁপা আঙ্গুলেই সিগারেট জ্বেলে নিয়ে ক্রমে যেন নিজের মধ্যেই থিতু হতে পারে সে। ঠিক কোণ মুহুর্ত থেকে সে এমন হয়েয়াছে? বিশ্বচরাচর বিস্মৃত? তার একাকীত্বকে, তার একলা কোঠাটিকে অসম্ভব ভালবাসা সত্ত্বেও কেন তার আজ মন টিঁকলো না ? কেন সে বার হয়ে এলো রাস্তায়? এই প্রায় মধ্যরাত্রে? কেন রাস্তা পার হতে গিয়ে সে টেরও পেলোনা সশরীর মৃত্যুর দ্রুততায় ছুটে আসা গাড়িটিকে? - এই সকল প্রশ্নের ভিড় হাত্ড়ে নিজেকে খুঁজতে চাইল সে, সে দিবাকর, এলিজিবল ব্যাচেলার দিবাকর, ডিভোর্সি দিবাকর, 'মুডি' কলেক টিচার দিবাকর … প্রশ্নগুলির ভিড়ে হাতড়াতে হাতড়াতে অকস্মাৎ অনুভব করলো প্রায় অপার্থিক এক শৈত্য। অনুভব করলো মনে। শরীরে।
এই শীত ভয়ের। এই শীত ভীতির। কলেজ সেড়ে নিজের একা আস্তানায় আসামাত্র এই ভীতি তাকে ঘিরতে আরম্ভ করেছে। ক্রমে ক্রমে ভীতি তাকে জড়িয়ে নিলো আষ্টেপৃষ্ঠে। তখুনি নিজের একা আস্তানা ছেড়ে সে বার হয়ে এসেছিল রাস্তায়। একা তার খুব ভয় করছে। খুব ভয়। তার এখন ভিড়ের বড়ই প্রয়োজন। সঙ্গীর নয়, সঙ্গের প্রয়োজন। তাকে ঘিরে সে শুনতে চায় মনুষ্য স্বর, দেখতেচায় মানুষজন। না , তারা তার সঙ্গে কথা বলবেনা। তাকে ঘিরে কথাবার্তা বলবে …
আবার হাঁটতে লাগলো দিবাকর। আদতে প্রায় দৌড়াতেই লাগলো সে। ' ও আসছে' … সে'কি কোনো আহ্লাদ-সংবাদ? না'কি এক পরাজয় কাহিনীর পুনরাভিনয়? না'কি প্রতিশোধ? 'ও আসবে, কোনো দিন আসবে' এ যেমন নিশ্চিত তেমনি 'ও আসছে' এই সংবাদ আকাশের কোণে ঝড়ের মেঘের মতো দানা বেঁধেও উড়ে গেছে বাতাসে অনেক বার। এবারো কি তা'ই ঘটবে না'কি … “ইয়েলো মুন্” বারের আলো ঝলমলিয়েওঠে অন্ধকারে। কেমন যেন উত্তাপ পায় দিবাকর। দ্রুততর হয় তার গতি।
“এ'তো সেই কলগার্ল শ্যামা'র বডি “ - লাশের মুখে জোরালো টর্চের আলো ফেলে বলে পানু ঘোষ। হাইওয়ের পেট্রোলিং টিমের সর্দার পানু ঘোষ। কয়েকটি ছবি মর্মে ঝলসে উঠলেও তার স্বর কাঁপেনা। “সঙ্গের টা ওর ড্রাইভার হবে। গাড়িটা … গাড়িটা চেনা... তবে শ্যামার নয় ...” পুলিশ ওয়াকি-টকিতে ভেসে আসে নানা কথা, নানা স্বর ও শব্দ। “ না স্যার, এক্সিডেন্ট না। মার্ডার। আরেকটা গাড়ির টায়ারের ছাপও ...” “এম্বুলেন্স পাঠাতে বলেছি স্যার”
“আর এম্বুলেন্স, শালি আর মরবার টাইম পেলো না, এই রাত্রে, এখানে ...”
“আজ রাতে আর ফেরা হবে বলে তো … “
“ আর ফেরা … জলদি একটা পেগ বানা, কড়া করে বানা ...”
“ইয়েলো মুন্,” এর কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দিবাকর টের পায় এক রকমের স্বস্তি। তার খেয়াল হয় আজ শুক্রবার। কার সেকেন্ড সেটার ডে। অনেক অফিস কাছারিই ছুটি। অতএব “ ইয়েলো মুন্ “ ভিড় এই সময়েও যথেষ্ট। অন্তত টেবিল প্রায় সবই ভরা। ভরা টেবিল সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপের মতো খালি ছোট টেবিলটাতে বসেপড়ে দিবাকর। সে স্বস্তি বোধ করে। তাকে ঘিরে সে শুনতে পায় মনুষ্য স্বর, দেখতে পায় মানুষজন। তারা তার সঙ্গে কথা বলছেনা। তাকে ঘিরে কথাবার্তা বলছে। আহ্ । একটু আলোকিত ভিড়ের মধ্যে এই আশ্রয়কে সে নির্ভর করে। অর্ডার দেয় 'ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট “ লার্জের।
পর পর কয়েকটি লার্জে আর হিন্দি ঝিনচাক গানে ক্রমে যেন চাঙা হয়ে ওঠে দিবাকর। ভাবে রাত্রিটা এখানেই দেবে নাকি কাটিয়ে? সিগারেট জ্বেলে নিয়ে অর্ডার করে... এবারে ভদকার। ভদকা আসে কিন্তু এবারে আসে অন্য একজন ওয়েটার। গেলাসে মদ টুকু ঢেলে দিয়ে চলে যেতে যেতে মুচকি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে যায় দিবাকরকে। এই হাসির সূত্র ধরেই দিবাকর টের পায় যে ওয়েটারটিও জানে... জানে যে "ও আসছে... "... জানে যে "ও " এলে ঠিক কি হবে দিবাকরের, জানে কি হবে রিনার.... জানে? কিন্তু কিভাবে জানে? কতটুকু জানে?... যায় কি ডেকে প্রশ্ন করা? হয়তো যায়। তবে তার নিমিত্ত আরো একটু সাহসের প্রয়োজন বোধ করে দিবাকর। সাহস টুকু তাকে নিঙড়ে নিতে হবে তার পারিপার্শ্ব থেকেই। সুতরাং সূর্যালোক সন্ধানী ক্লোরোফিল হেন দিবাকরের দৃষ্টি আছড়ে পরে তাকে ঘিরে বসেথাকা জনতার দিকে আর তখুনি দিবাকর টের পায় - জানে, এরা সকলে, প্রত্যকে জানে। জানে যে "ও আসছে... "... জানে যে "ও " এলে ঠিক কি হবে দিবাকরের, জানে কি হবে... টের পাওয়া মাত্র দিবাকর অনুভব করে সেই শীত, সেই শৈত্য, সেই ভীতি.... একটি তীরের মতন " মুনলাইট বার" থেকে ছিটকে যায় দিবাকর। ছিটকে বেরিয়ে আসে রাস্তায়, অন্ধকারে। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া বুলেটের মতন দৌড়ে যেতে গিয়ে দিবাকর টের পায়, যে, তার কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো গন্তব্য নেই। তার কিনার দিয়ে হুহু করে ছুটে চলে যায় লাল নীল আলো আর অপার্থিব হস্তিনীর শীৎকারের মতো ধ্বনি তুলে দুটি পুলিশ জিপ আর একটি এম্বুলেন্স। কোথায় যায় তারা? কেন যায়? তবে কি... ধাবমান গাড়িগুলির হেডলাইট-আলোতে দিবাকর দেখতে পায় যে দেওয়ালে দেওয়ালে, প্রতি ল্যাম্পপোস্টে, গাছেদের গায়ে গায়ে হাতে লেখা পোস্টার। কিছু কিছু পোস্টার ছিঁড়ে গিয়ে ডানা ঝাপ্টাচ্ছে - যেন মহাজাগতিক কিছু রাত্রিচর উড়ে যেতে চাইছে এই গ্রহের কেন্দ্রটান ছিঁড়ে। সহসা সেই টান এসে লাগে দিবাকরের কেন্দ্রেও যেনবা। ভীত দিবাকর আঁকড়ে ধরতে চায় কাউকে, কিছুকে। ছুটতে ছুটতে সে গিয়ে আছড়ে পরে এক বন্ধ দরজায়। দরজায় ধাক্কা দেয় দিবাকর। বলেঃ রিনা, রিনা, রিনা - দরজা খোলো, আমাকে ভেতরে আসতে দাও। রিনা, আমিই তো তোমাকে বলেছিলাম ও আসছে ... '
#
হালকা আকাশি রঙ কাগজের রাইটিং প্যাডের থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিলাম। বেগুনি কালিতে কলম চুবিয়ে লিখলাম, লিখলাম বড় বড় গোটা গোটা অক্ষরেঃ 'আসতে পারব না, এবারে অন্ততঃ '... কাগজটিকে ভাঁজ করে পুরলাম কাঁচ বোতলে। বোতলের মুখ বন্ধ করে বোতল ছুঁড়ে দিলাম নীল জলে। যার দরকার তার কাছে ঠিক পৌঁছে যাবে এই কাগজ - ভাসতে ভাসতে। অর্থও করে নেবে যে যার মতো, যে যার দরকার মতো।
১৪/০৮/২০২০
বেঙ্গালোর