প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Monday, May 16, 2022

১৯৯১,২০২২, বিনয় ঘোষ, সুকেশ বিশ্বাস ও কিছু টুকরো কথা

   ১৯৯১,২০২২, বিনয় ঘোষ, সুকেশ বিশ্বাস ও কিছু টুকরো কথা 

ফোন এলো।

"তোর কাছে বিনয় ঘোষের পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতি, মনে হয় ২ খন্ডের বই, আছে?"

না। বইটা নেই। আমার কাছেও নেই। ছাপাও হয় বা ইদানীং হয়েছে বলেও জানিনা।

বল্লাম। বাবাকে। একটু হতাশই হল। বল্লোঃ "আমি ওদের বলেছি কারো কাছে না থাকলে তোর কাছে থাকবে..."

জানালাম আছে। তবে 'সফট কপি'। বাবার, বা বাবার প্রজন্মের অনের কাছেই এটি একটি রহস্য। আমার পুত্র যখন তার পিতামহ কে "কিন্ডল" বস্তুটি দেখিয়ে ব্যাখ্যা করেছিল তখন, বাবার চোখ মুখের গর্বিত বিস্ময় দেখে মনে হচ্ছিল, যে, এই নাতিটিই যেন "কিন্ডল" নামক যন্ত্রের আবিষ্কর্তা। অতএব বিনয় ঘোষের 'সফট্‌ কপি' থাকার সংবাদে বাবা, স্বাভাবিক ভাবেই, সন্তুষ্ট হয়নি তেমন। তখন বল্লাম "আচ্ছা, দাঁড়াও, আমি প্রিন্ট আউট মানে ছেপে নিয়ে আসবো বাড়ি আসার সময় বা পাঠিয়ে দেব কুরিয়ারে"। 

"নাহ্‌ কুরিয়ারে পাঠানোর দরকার নেই। নিয়ে আসিস তুই আসার সময়েই"।

... তারপর বাবার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হলো আইসিইউ তে।

...সেই নবম ক্লাসে পড়ার সময় বিনয় ঘোষ, প্রথম ...

ছিল বিষয় 'সমাজবিদ্যা', ইতিহাসে, ভূগোলে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বকচ্ছপ। ছিল অধ্যায় 'বাংলার নবজাগরণ'। ছিল নাম রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও ... ইত্যাদি ইত্যাদি। নামগুলি এবং তাদের কিছু কিছু গল্প আর এই শব্দ, 'নবজাগরণ' নয়ের ক্লাসে একেবারে অজানা ছিলনা। দিদিভাই, যিনি আইনতঃ বাবার পিসী হলেও ভূমিকা নিয়েছিলেন বাবার মায়েরই, তাঁর মুখে বিদ্যাসাগরের গল্প, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, তার বাধা বিপত্তি, রামকৃষ্ণের উদারতা -- এই সমস্ত শুনেছি বাল্যেই। ঘুম-গল্পে। শুনেছি তাঁর আবৃত্তিতে "মেঘনাদ বধ", আলো নেভা কোঠায়, আবহে শেয়াল ডাক চলে এসেছে উঠানে। তাঁর কাছেই অই নাম 'নবজাগরণ'ও শুনেছি তখনই।  পরে রাজেন্দ্র লাইব্রেরীর 'জীবনী গ্রন্থমালা" আর ময়ূখ চৌধুরীর "খাপে ঢাকা তলোয়ার", শুকতারায় প্রকাশিত চিত্রগল্প 'যুগে যুগে' জানিয়েছে আরো সম্বাদ। এ ছাড়াও বাবা আর শক্তিকাকু বা বাবা আর জেঠু ( সুজিৎ চৌধুরি)র আলাপ, আড্ডা থেকে ছিটকে আসা টুকরোকথার দৌলতে।  ... তবে গোটা ব্যাপারটা, অবশ্যই, ছিলোনা মর্মে স্পষ্ট। এদিকে ২-৩ দিনের কি এক ছুটিতে ওই 'নবজাগরণ' নিয়েই লিখে আনতে বলেছেন জলিল স্যার। 

বাবাকে বল্লাম। বাবা বল্লো 'হুম'। চলেগেলো কলেজে। দুপুরের দিকে ফিরলো একটা বই নিয়ে। কলেজ লাইব্রেরীর থেকে। বল্লো 'এটা পড়ো। তারপরে কথা হবে। সব হয়তো বুঝবে না। তবু পড়ো ..." 

সেই বই 'বাঙ্গলার নবজাগৃতি', বিনয় ঘোষ প্রণীত।

'পড়া' বলতে বাবাও সম্ভবতঃ উল্টে পাল্টে দেখাই বুঝিয়েছিল কেননা ওই মহাগ্রন্থ, বাংলার তথাকথিত 'নবজাগরণের', মার্ক্সীয় বিশ্লেষণের প্রথম পূর্ণ প্রচেষ্টা যে, আমাহেন মধ্যমেধা কিশোরের বোধগম্য হবেনা তা বাবা, এত বছর কলেজে পড়িয়ে জানতো নিশ্চিত। মনে আছে বইটি থেকে পরিচিত নাম গুলিঃ বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, রামমোহন, কেশব সেন ... খুঁজে খুঁজে বার করে খাবলা খাবলা পড়েছিলাম। ভয় ছিল বাবা প্রশ্ন করতে পারে।

সেই প্রথম পাঠের কথা মনে পড়ছে, আজ, বিনয় ঘোষের "মেট্রোপলিটান মন, মধ্যবিত্ত, বিদ্রোহ", ১৯৯১ সালের পরে, আবার পড়তে বসে। সে সময়ে বইটি শক্তিকাকু ( শক্তিপদ ব্রহ্মচারী)র সংগ্রহ থেকে পড়েছি বলেই মনেহয়। পাঠস্মৃতির আবহে যেন শক্তিকাকুর কোঠার দুপুর মিশে আছে। 

ষাটের দশকের শেষ আর সত্তরের প্রথম পর্ব মিলিয়ে লিখিত গ্রন্থটি ১৯৯১ সালে যে স্পন্দন জাগিয়েছিল তা রয়েগেছে তখনকার ডায়রীতে। 

১৯৭০ থেকে ১৯৯১, ১৯৯১ থেকে ২০২২, সংখ্যার হিসাবে যত বছরই হোক না কেন, আদতে সহস্র বছরের দূরত্ব। ৭০'এর চালচিত্রে বিশৃংলা থাকলেরো ছিল আশার উদ্দীপনাও। 'ভকত' দের চক্রান্ত চল্লেও তা শুধুমাত্র বয়ে যাচ্ছিল চোরাস্রোতেই। প্রকাশ্য হওয়ার ভূমি পায়নি। ৯০-৯১ সাল এলো ফ্যাসিবাদের পূর্নগ্রাস-সম্ভাবনাকে ঘোষনা করে। 'করসেবা', 'বাবরি', 'আরএসএস' এ সজ্জিত হয়ে, রক্তে ভাসিয়ে দিয়ে সমস্ত রাজপথ, সমস্ত অলীগলী, রথ ছুটলো দাঙ্গার দায়িত্ব নিয়ে। প্রথম দেখলাম চেনামুখ, পরিচিত মানুষদের মুহুর্তে মানুষ থেকে 'হিন্দু' হয়ে যাওয়া। ২০২২ এ দেখছি ফ্যাসিবাদীরা তাদের ছল, বল, কৌশল -- মূলতঃ রাষ্ট্রযন্ত্রটাকেই -- নিয়ে নেমেছে প্রকাশ্য রাস্তায়। ভোটবাজির 'কমিউনিস্ট' রা ঢেকে ফেলতে চাইছে ভারতের প্রকৃত কমিউনিস্ট আন্দোলনের নামগন্ধ। প্রকাশ্য ফ্যাসিবাদীরা আমদানী করছে 'আর্বান নক্সাল', 'মাওবাদী' ইত্যাদি 'আজীব-গরীব' শব্দ, সংজ্ঞা আর 'ভোটবাজ' 'বাম' 'তেভাগা-তেলেঙ্গানা'র উত্তরসূরী 'নকশাল বাড়ি'র বদলে জোটাচ্ছে বানানো স্থান, বানানো 'সংগ্রাম'।

৭০ এ লিখিত বিনয় ঘোষের রচনাগুলি, তবু, হারায়নি প্রাসঙ্গিকতা। হ্যাঁ, বিনয় ঘোষ যাকে বলেছিলেন ' কাগজ সভ্যতা' , তা আজ হয়ে গিয়েছে 'ডিজিট্যাল মিডিয়া' আর তৎকালীন মেকী, ক্রুশ্চেভি রাশিয়ার পাশাপাশি একালের চীনও জুটেছে 'সমাজবাদের' মোড়কে পুঁজিকে চাউর করার কুকর্মে।তবু, ৭০ এ লিখিত বিনয় ঘোষের রচনাগুলি,  হারায়নি প্রাসঙ্গিকতা।

কিভাবে?

এ'ও লিখে রাখবো। কখনো। আজ শুধু এটুকুই লিখে রাখি, যে ' যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই'। লিখে রাখি, যে, জীবনকে দেখবার যে দৃষ্টি আমি পেয়েছি, হয়তো তার অন্যথা হতো অন্য রকম আবহে, অন্য রকম 'বাবা'র খপ্পরে। যদি ওই নাইন,টেন বয়সেই বাবা হাতে তুলে না দিতো বিনয় ঘষ, পড়ে না শোনাতো 'কালান্তর' থেকে অংশ বিশেষ, না জানাতো রবীন্দ্রনাথের 'ভারতবর্ষের ইতিহাস', তাহলে, হয়তো, আমার অন্বেষা আমাকে, অন্তিমে নিয়ে যেতো ওই পথেই তবু দেরী হয়ে যেতো, দেরী হয়ে যেতো অনেকটা আর এই "ছোটো কেনে" জীবনে এই সকল দেরীর মাশুল বড়ই মর্মান্তিক।


১৬/০৫/২০২২

বেঙ্গালোর


 

ঘুম ঘর