রবিকবির "আমি" ও আমরা
"আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হতো যে মিছে " অথবা " ফাগুনের কুসুম ফোটা হবে ফাঁকি, আমার এই একটি কুঁড়ি রইলে বাকি".... আরো অনেক, অনেক "আমি", রবীন্দ্রগীতিতে, ঘুরেফিরে।
এই " আমি" কোন আমি? এ কি নিতান্ত এক ব্যক্তি যাকে ব্যক্তিত্ব'র নামে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, নিভৃতির নামে বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি দিয়ে গড়েছে এই বিশ্ব ব্যবস্থা? মনে রাখতে হবে শিল্প বিপ্লব ও তৎপরবর্তী কালই রবিকবির আবহ। বিচ্ছিন্নতার, ব্যক্তির অন্তর্গত বিচ্ছেদেরো আলাপ তথা বিস্তার-কাল এটিই। গুটিকয় বাবু মিলে, তার সামান্য আগেই, মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার জন্মভূমি যে পশ্চিম, তারই, দেড় দুইজন বাদে, পল্লবগ্রাহী বিদ্যা বলে, নিজেদের মধ্যেই কিছু রৈরৈ কান্ড বাধিয়েছেন, পরে বলা হয়েছে "বাংলার নব জাগরণ "। যা সত্য হলে বুঝতে হবে বাংলা মানে বাবু আর তাঁদের চাটুকাররাই বাংলার দুইশত ভাগ। এমত সময়ের অব্যবহিত পরেই রবিকবির আসা। ওই সময়টি খুবই সন্দেহজনক কেননা ওই সময়ের এক মহাসন্ততি মহা হুংকারে ঘোষনা করছেন ঈশ্বর পাওয়ার নিমিত্ত মানুষ খুন করতেও তিনি প্রস্তুত, হায়, ওই যে ঈশ্বর আর ওই যে মুক্তি, যা মানুষ মারার মূল্যে পাওয়া যাবে, তা যে বিচ্ছিন্নতার কি বিরাট প্রমাণ, তা ওই সময়ে নিশ্চিত টের পাননি অনেকেই। আশ্চর্য এই, যে, রবিকবি না'ত ঠিক "নবজাগৃতি-মহাজন", না তিনি "মানুষ মেরে মুক্তি" পার্টির মেম্বার। পক্ষান্তরে তিনি বলছেন "বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়। অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়, লভিব মুক্তির স্বাদ"। ফলতঃ তাঁর কাব্যের " আমি" হতে পারেনা মানুষ মেরে একা একা "মুক্তি" ঘটি পানান্তে ঈশ্বরের কিরিপায় উর্বশী, মেনকা, রম্ভার রম্ভোরুতে গড়াগড়ি। আবার শোপেনহাওয়ার, কিয়েরকেগার্ড ইত্যাদি হেন জর্জরিত আমি বা পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের বানিয়ে দেওয়া বিজ্ঞাপনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক 'আমি'।
রবীন্দ্রনাথের 'আমি' বিদ্রোহী ' আমি', গণতন্ত্রের এমন কি বলা যায় সমাজতন্ত্রের 'আমি'ও। তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশে মন্ত্রীমশাই, প্রধানমন্ত্রী মশাই, যার উপর গণ-খুনের অভিযোগ ঝুলন্ত, সে, যে জনতার করের অর্থে করে বেড়াচ্ছে যথেচ্ছাচার আর দেশবাসী ও বলছে " সাবাস, রাজা করেছেন তো বেশ করেছেন" —- এই যখন চালচিত্র, যখন এই লোকগুলি একদিকে তার করদাতা-অস্তিত্ব, তার গণতান্ত্রিক অস্তিত্ব –--- সমস্ত বাদ দিচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে, আবার একই সঙ্গে বলছে তার চাই "প্রাইভেসি", তখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, যে, এই প্রাইভেসি নেহাৎই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। বিজ্ঞাপন- হিট মাল মশলা কিনে " ব্যক্তি " সাজার চেষ্টা, "আমি" দেখানোর ধান্দা। এই চালচিত্র আমাকে বাধ্য করে রবীন্দ্রনাথের "আমি" নিয়ে নতুন করে ভাবতে।
রবীন্দ্রনাথের 'আমি' বিদ্রোহী ' আমি', গণতন্ত্রের এমন কি বলা যায় সমাজতন্ত্রের 'আমি'ও কেননা ওই "আমি" টিকে বাদ দিয়ে, তার অধিকারকে এড়িয়ে গিয়ে, তার ন্যায্য পাওনাকে অস্বীকার করে, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র শুধু নয়, রবিকবি বলছেন, গোটা ব্রহ্মাণ্ডেরই কোনো অর্থ হয়না। ওই "আমি" টি ছাড়া ব্রহ্মাণ্ডই হয়না। অতএব " আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে"। সমবেত জনতার প্রত্যেকটি " আমি"র একজন কে বাদ দিয়েও হয় না, হতে পারেনা কোনো "ব্যবস্থা", ফাল্গুনে শত ফুল বিকশিত হওয়ার পরেও, একশত-এক সংখ্যক নামগোত্রহীন যে ছোট্ট চারাটি, প্রাচীরের ছিদ্রে, তাতেও যদি কুঁড়ি না আসে, তাহলে তোমার বসন্ত, সে যতো বজ্র নির্ঘোষেই না জাহির করুক নিজেকে, আদতে সে ফাঁকি। ফাঁকিই। আর ওই ফাঁকির বিপরীতে একমাত্র সত্য " আমরা সবাই রাজা"। এই "আমরা" র প্রতিটি "আমি" রাজা, প্রতিটি আমাতে ফুল ফোটে। যদি ফোটে তাহলেই সে ব্যবস্থা ফাঁকি নয়। আর তা না হলে, আমরা তো দেখলাম, শুধুমাত্র ধনতন্ত্রের দেখানো " আমেরিকান ড্রিম" এর ডিম না ফুটে ফেটে গেলো কিভাবে, দেখলান বার্লিন-দেওয়াল, দেখলান তিয়ানম্যান স্কোয়ার।
"মানুষের মৃত্যু হ'লে তবুও মানব থেকে যায়" পংক্তিতে জীবনানন্দ যে অর্থ প্রয়োগ করেন "মানব" শব্দটিতে, রবীন্দ্রনাথ উচ্চারিত প্রতিটি "আমি" তে, আমি পাই তারই ঝংকার।
=== x ===