প্রবেশিকা

ভিড়েই রয়েছি মিশে, নিজবেশে, তাই চিনতে পারছেনা কেউ। এ'ই স্বাভাবিক। ম্যাজিক-মাহাত্ম্য ছাড়া, ম্যাজিক-মাহাত্ম্যের মূলে অন্ধকার টুপি আর ঝোলা কোট ছাড়া, কে হে আমি? কে’বা আমি? কিভাবে ভিড়কে বলি ইন্দুরে কেটেছে টুপি, লাল-নীল রুমালের ঝাঁক উড়ে গেছে পায়রা, কাক হয়ে...

Wednesday, November 26, 2025

ইন্দ্রনীলের “চন্দ্রাহত”: অশ্রুনদীতে ভাসে ভেলা

ইন্দ্রনীলের “চন্দ্রাহত”: অশ্রুনদীতে ভাসে ভেলা

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

 


 “ যে নামেই ডাকো তুমি / গোলাপ তো গোলাপেরই সুগন্ধ ছড়ায়!” – ক্লিশে। একটি ফিনিক্স-ক্লিশে যা নিজের ছাই থেকে, ভষ্ম থেকে আবার জন্মায়, বার বার জন্ম নেয়। জন্ম নেয় প্রত্যেক কালে, কালের নিজস্ব প্রয়োজনে। এখানেই বলে নিই যে, আমার চিন্তায় ‘কাল’ এর সূচক, আপাত ভাবে, দশক, শতক ইত্যাদি হলেও, কালের আদত নির্ণায়ক সেই কালের উৎপাদন আর বন্টন ব্যবস্থা ও দ্বন্দ্ব। উৎপাদনে যারা লগ্নী করেছে বৃহত্তম পুঁজি তাদের জিতিয়ে দিতেই সতত ক্রিয়াশীল ‘রাষ্ট্র’ নামের যন্ত্র। তাই এখানে ‘অর্থ’ই ঈশ্বর। স্বর্ণই ঈশ্বর। অর্থ বা স্বর্ণকে “What’s in a name? - স্রষ্টা, ওই একই নাটকে বর্নণা করেছেন এভাবেঃ “There is thy gold, worse poison to men’s souls” – এই “বিষ” যখন, যে মুহুর্ত থেকে প্রভু, ঈশ্বর – সেই মুহুর্ত থেকে আরম্ভ প্রেমের, ভালবাসার, সবুজের, কারুণ্যের হত হওয়ার যুগ। পক্ষান্তরে এ’ও সত্য, যে প্রতিটি পোকামাকড়েরও প্রতিটি মুহুর্ত আদতে একাধিক পরস্পর বিরোধী শক্তির দ্বন্দ্ব। যে কালে অর্থ, মুনাফা, রাষ্ট্র যতো বলীয়ান, সেই কালেই বিপরীত ধারাটিও সমস্পর্ধী। এই বিপরীত ধারা ভালবাসার, প্রেমের, কারুণ্যের, সবুজের। এরই প্রকাশ-প্রয়োজনে বার বার জন্ম নেয় যে নামেই ডাকো তুমি / গোলাপ তো গোলাপেরই সুগন্ধ ছড়ায়!” – জন্ম নেয় রোমিও-জুলিয়েট। কখনো “ওয়েস্ট সাইড স্টোরি” হয়ে, কখনো ‘চন্দ্রাহত’ হয়ে।

ইন্দ্রনীল দে’র “চন্দ্রাহত” কি “রোমিও-জুলিয়েট”? – অনুবাদ? অনুসরণ? ছায়া? সম্ভবত আবহের আবহ। Arden সংস্করনের যে সিরিজটি সম্পাদক René Weis, তার ভূমিকাতে, আরম্ভ পর্বের নাম “WRITING LOVE”। কথাটি উল্লেখের হেতু -- যে অর্থে , যতোটুকু “রোমিও-জুলিয়েট” — “WRITING LOVE”, ইন্দ্রনীলের “চন্দ্রাহত”র আবহে ততোটুকুই শেক্ষপীর। বাকিটা ইন্দ্রনীল। নাট্যকার-পরিচালক-অভিনেতা ইন্দ্রনীলের নিজের কথায় “আমি চেয়েছি একটি প্রেমের কাহন শোনাতে”। কিন্তু কেন? আমার ধারণা, সে চেয়েছিল, কারণ তাকে অনুভব করতে হয়েছে, এই পুঁজি বিধ্বস্ত যুগ যখন পচনে পচনে ফ্যাসিবাদ আর ফ্যাসিবাদ নয় নেহাৎ নাজি বাহিনী কিংবা বুলডোজার, ফ্যাসিবাদ এক সর্বাত্মক ধ্বংস-যন্ত্র যা তুচ্ছাতিতুচ্ছ দৈনন্দিনতার অন্দরেও ঢুকে যায়, গিয়েছে। ফলে এমনকি ‘প্রেম’ও গিয়েছে নিশ্চিহ্ন হয়ে। এখানে উৎপল দত্ত’র এই কথাটি হয়তো নয় নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকঃ “যে সমাজে টাকাই একমাত্র নৈতিকতা, সেখানে দরকার হয় বার বার প্রাথমিক নীতিগুলোর প্রচার। যে সমাজে নারীর কোনো মর্যাদাই নেই, সেখানে দরকার মা-কে দেবীজ্ঞানে পূজা করা”। যে কালাবর্তে আমাদের বসবাস, সেখানে প্রেম নেই। তাই প্রেম ছিল আর কেমন ছিল সেই প্রেম তারই সন্ধানে বার হয়ে পড়তে হয়েছে ইন্দ্রনীলকে। এই সন্ধানটুকুই ‘চন্দ্রাহত’ আর “রোমিও-জুলিয়েট” যোগসূত্র। এরই হাত ধরে চলে এসেছে কবিতা। মূল  “রোমিও এন্ড জুলিয়েট” ছায়া এখানেও ইচ্ছাকৃত। যেমন ইচ্ছাকৃত, নাটক-নাম ‘চন্দ্রাহত’ শতভাগ বঙ্গ হলেও চরিত্রেরা জার্মান, কাহিনীর আশু চালচিত্র বিদেশ, মঞ্চসজ্জা বিদেশের। বিশেষ কালের। 

এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার, যে, “চন্দ্রাহত”, তার মঞ্চ, তার চরিত্র ও স্থান নাম, চরিত্রদিগের পোষাক ‘পিরিয়ড’ সাপেক্ষে দ্বিশত ভাগ নিখুঁত হলেও নয় ‘পিরিয়ড ড্রামা’। ‘period drama’ শব্দবন্ধ  কেম্ব্রিজ অভিধানেঃ “a television or film production set in a period in the past, or productions of this type.” অর্থাৎ এর জন্ম পুঁজিবাদের গর্ভে, পুঁজিবাদের নিজস্ব প্রয়োজনে লেফাফা দিয়ে সব কিছুকে সব কিছুর থেকে আলগা করবার মূল্যে পুঁজিবাদের প্রতিরোধ শক্তিগুলিকে হত্যা করবার প্রয়োজনে। এই নিমিত্তই “লেখক” থেকে “লেখা” কে, যাপন থেকে জীবনকে, সৃষ্ট বস্তুর থেকে তার স্রষ্টা মানুষকে আলগা করবার তত্ত্ব ও দর্শনের আমদানী। কিন্তু “চন্দ্রাহত” ততোটুকুও পিরিয়ড ড্রামা নয়, সিনেমা “ওয়েস্টসাইড স্টোরি”র দুটি ভিন্ন কালের প্রোডাকশন যতোটা। নতুবা সুকুমার রায়ের  “হাতে রইল পেন্সিল”  উচ্চারিত হতোনা গেস্টাপো’র সংলাপে। নাটকটি দেখতে দেখতে আমার প্রত্যয় হয়েছে, যে, স্থান ও কালের এই দূরত্ব সৃষ্টি ইচ্ছাকৃত এবং এই ইচ্ছায় মূলে, সচেতন বা অবচেতন ছায়া ব্রেখটের এপিক থিয়েটার ধারণার। এপিক থিয়েটার, স্তানিসলাভস্কির বিপরীতে, সতত জানান দিতে চায় দর্শক আর নাটকের মধ্যবর্তী দূরত্বের। সেই ‘দূরত্ব’ কে ব্যবহার করে নাট্যকার হয়ে ওঠেন এপিকের কবিবর যাঁর গমন অবাধ। এই অবাধ নির্মীত হয় দূরত্বের নির্মাণের দ্বারা। ২য় বিশ্বযুদ্ধ “চন্দ্রাহত” নাটকে, সেই দূরত্বের নির্মাতা। চরিত্র কিংবা ঘটনা কি হতে পারতো না দেশজ? যেমন হয়েছে বিশাল ভরদ্বাজের মকবুল-ওমকারা-হাইদারে? অবশ্যই পারতো। কিন্তু তেমনটি যে হলোনা, তার হেতুও, নাট্যকারের দূরত্ব সৃজনের ইচ্ছা। ইচ্ছা, কাহিনীকে এমন একটি plane এ স্থাপন করবার যে সমতলে বিশ্ব, ব্রহ্মান্ডে ‘প্রেম’ সম্ভব ছিল। ‘প্রেম’ এবং রোমিও-জুলিয়েট হেন এক অসম্ভব প্রেম। ইন্দ্রনীলের নিজের কথায় “যা এক ঘন্টার সাক্ষাৎ থেকে মাত্র আট চল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে পরস্পরের নিমিত্ত আত্মাহুতি-ইচ্ছায় প্রজ্জ্বলিত হয়”। – এখানেই ‘চন্দ্রাহত’র ঘরানা শেক্সপীয়ারের। এখানেই শেক্সপীয়ারের সঙ্গে ব্রেখট এসে মিশে গেছে অবলীলায়। 

একই কথা খাটে মঞ্চসজ্জা-ক্ষেত্রেও। আপাত ভাবে চরিত্রদের পোষাক, ডুপ্লেক্স-ছাঁদের কোঠা – তৎকালের বাস্তব। কিন্তু মঞ্চকে অক্ষে ভাগ করে, তার একেক তলে আলো জ্বালিয়ে কিংবা নিভিয়ে দিয়ে যে কম্পোজিশন তা ক্লাসিক রয়াল সেক্ষপীর নয়। বরং ‘থ্রি-পেনী অপেরা”। তাতেহ্‌ শুনে ফেলেছে রোমিও আর জুলিয়েটের নিভৃত আলাপন। জানা গেলো মঞ্চের কোণে …। 



এখানে মঞ্চটিকে একটি দ্বি-মাত্রিক কাগজে আঁকা, X-Y অক্ষে ভাগ করা খাতার পাতা হিসাবে ধরে নিলে দেখা যাবেঃ বর্গ ৩। এই অংশটুকু আলোকিত। রোমিও–জুলিয়েট নিভৃত আলাপনে রত। একটি সরলরেখা। বর্গ ২। এই অংশেও আলো জ্বলবে। অর্থাৎ দুটি কোয়াড্রেন্ট’ই আলোকিত। তাতেহ শুনেছে তাদের নিভৃত আলাপন। – এইবার সরলরেখা ত্রিভুজে পরিণত। বর্গ ১। তাতেহ, রোমিও, জুলিয়েট। তিনটি বিন্দু। একই সরল রেখাতে। মধ্যে জুলিয়ানা। ডান পাশে তাহেহ। তখনো তার উত্তরণ হয়নি। অর্থাৎ প্রতিরোধের মূলও যে ভালবাসায়, প্রেমে, আর সেখানে ইহুদী-জার্মান, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-কৃশ্চান – একাকার, তা’ সে টের পায়নি। সে এখনো জানেনা রোমিও’র আসল পরিচয়ও। রেখার আর প্রান্তে রোমিও। রোমিও, যে নিশ্চিত জানে – প্রেমই অন্তিম। মানব-মানবী প্রেম, মানবতার প্রতি প্রেম। মধ্যবিন্দুতে জুলিয়ানা/জুলিয়েট। বর্গ ৪।এই বার আলো জ্বলেছে  এই অংশেও। মৃত রোমিও–জুলিয়েট,  হাহাকার রত তাতেহ। রোমিও-জুলিয়েট একটিই বিন্দু। আরেকটি বিন্দু তাতেহ। একটিই রেখা। তবে আর সরল নয়। - আলো আর কম্পোজিশনের গতিশীল এই প্রকাশ সমসাময়িক। শুধুমাত্র কম্পোজিশনের জ্যামিতিক বদল – সিনেমা। আলোর ব্যবহার একে সিনেমার থেকে ভিন্ন করেছে। দিয়েছে নাটকীয়তা। শেক্ষপীয়ারিয় নাটকীয়তা। 

       নাটক, যেহেতু এই লেখাটির কেন্দ্রে একটি মঞ্চস্থ হওয়া নাটক রয়েছে, সুতরাং অভিনয় – অভিনেতা, অভিনেত্রীর কথাও এসে পড়ে চিন্তায়। – এই কম্পোজিশনটিতে কিংবা পূর্বে দ্বৈত নৃত্যের দৃশ্যেও – জুলিয়ানা/জুলিয়েট চরিত্রের অভিনেত্রীর দেহাভিনয়ে ওঠেনি সেই ছন্দ – যে ছন্দ এই নাটকের একটি মাত্রা। যে ছন্দ এই নাটকের কবিতা এবং কবিতা-সদৃশ সংলাপ, যা’ও, ইচ্ছাকৃত ভাবেই, দৈনন্দিনের চেয়ে ভিন্ন করা হয়েছে নাট্যকার-দ্বারা – তার প্রতিফলন বারবারই ব্যাহত হয়েছে জুলিয়েট-অভিনেত্রীতে। দ্বৈতনৃত্যে, স্পটলাইট-বৃত্তের বাইরে নৃত্যরতা যুগল ঢের বেশী ছন্দোময়।  নাটক, যেহেতু এই লেখাটির কেন্দ্রে একটি মঞ্চস্থ হওয়া নাটক রয়েছে, সুতরাং এ’ও আশা করা যায় যে, পরবর্তী উপস্থাপনায় এই ছন্দ-ভাঙ্গা, এই অভিনেত্রীই শুধরে নেবেন অথবা অন্য কোনো অভিনেত্রী আসবেন ছন্দ নিয়ে। ছন্দের প্রসঙ্গ যখন এসে পড়লোই, তখন, বলি সেই দৃশ্যের কথা, যা ছন্দে এবং অন্তর্বস্তুতে আমার অন্দরে ঢেউ তোলে। 

দ্বিতীয় দৃশ্যটি উন্মোচিত হয় শুধুমাত্র সেকেন্ড কোয়াড্রেন্টে আলো জ্বালিয়ে। সেখানে রুডলফ, আদতে রোমিও, রেডিওর ঘোষক। তার ঘোষনা আরম্ভ হয় গদ্যে। এরপরেই সে উড়ে যায় কবিতায়ঃ “ প্রিয় আমার, নামে কি এসে যায়?...গোলাপ তো গোলাপেরই সুগন্ধ ছড়ায়!” – এবং এখানে এসেই তার বলন, চলন – শরীর-নাটক – ঝলসে ওঠে ছন্দে। বাক্য গদ্যে ফিরলেও ফেরে গদ্য-ছন্দে, রুডলফ/রোমিও তার সঙ্গে তাল রেখে থেকে যায় ছন্দিত। সে যখন বলে, বলতে থাকে এই অংশঃ “বন্ধুরা ফুলের সৌরভ, সঙ্গীতের মূর্ছনা আর ভালোবাসার পাখি- এদের কোনো দেশ নেই, ধর্ম নেই, সীমানা নেই” – তা হয়েওঠে, আবহ সঙ্গীতের সঙ্গে মিলেমিশে, এক সম্পূর্ণ গীতি-নৃত্য-নাট্য। এই সম্প্রচার শুনছে, রেডিও চালিয়ে জুলিয়ানা। আদতে জুলিয়েট। সে’ও বলে যাচ্ছে রুডলফের কবিতাইঃ “প্রিয় আমার, নামে কি এসে যায়? …”– এ’ও কবিতাই। এ’ও গীতি-নৃত্য-নাট্য। নাট্যকারের। তথাপি জুলিয়ানা/জুলিয়েট অভিনেত্রীর দেহে, স্বরে সেই ছন্দ, বাজলো না এই প্রোডাকশনে।

Anthony Doerr এর ২০১৪ সালে লিখিত উপন্যাস “All the Light We Cannot See” টিরও আবহ ২য় বিশ্বযুদ্ধ, রেডিও, রেডিওতে সম্প্রচারিত একটি অনুষ্ঠান । কিন্তু সুখপাঠ্য এবং ২০২৩ সালে Netflix এর Miniseries টিও যথেষ্ট ভালো হলেও, ওই রেডিও এবং সম্প্রচারকে বারবার ব্যবহারের মূল্যে, ঐ উপন্যাস ও ওই সিরিজ, অন্তিমে হয়ে ওঠে ক্লান্তিকর। পক্ষান্তরে এই একই এলিমেন্টের সীমিত তথা ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যবহার “চন্দ্রাহত” কে ভিন্ন মাত্রা দেয় আর তার দ্বারা এলিমিন্টটিও দাবী করে বসে নতুন মাত্রা। এর সাপেক্ষেই নাটকে প্রবেশ করে আরো একটি দ্বন্দ্ব, এই নাটকের, এই সময়ের। সব সময়ের। সব শ্রেণী বিভক্ত সমাজের।

রেডিওতে ভেসে আসা শুবার্টের “দ্য সেরেনেড্‌” হঠাৎই বন্ধ হয়ে যেতে চমকে ওঠে জুলিয়ানা/জুলিয়েট। ফিরে দেখে, যে, তার পালক পিতা তাহেহ, যিনি নাজি প্রতিরোধের একজন মাননীয় নেতা, তিনি দিয়েছেন রেডিও বন্ধ করে। বন্ধ করবার কারণ হিসাবে তিনি জুলিয়ানাকে বলেনঃ “এটা সঙ্গীতে গা ভাসানোর সময় নয়। … সঙ্গীতে তোমার এই কালক্ষয় আমাকে বিস্মিত করেছে। বিশেষ করে জার্মান সঙ্গীত!” উত্তরে জুলিয়ানা “সঙ্গীতের তো কোনো জাতি ধর্ম ভাষা নেই তাতেহ্‌ । … ..সঙ্গীত কবিতা এসব আমার প্রেরনার উৎস। দেশের জন্যে লড়াইয়ে এ আমাকে সাহস জোগায়!” যাপনের দুইটি অক্ষ। ইনফ্রাস্ট্রাকচার আর সুপার-স্ট্রাকচার। শিল্প ইত্যাদি সুপার-স্ট্রাকচারের অংশ যে সুপার-স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে আছে ইনফ্রা-স্ট্রাকচারকে ভর করে। ইনফ্রাস্ট্রাকচারের দ্বন্দ্ব প্রভাবিত করে সুপার স্ট্রাকচারকে। ইহুদি-জার্মা্ন, হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি, আদতে, ইনফ্রা-স্ট্রকচারে শোষক আর শোষিতের দ্বন্দ্ব। আদতে অর্থনৈতিক কারণে ইস্রায়েল চায় গাজা’র বিনাশ। ২য় বিশ্বযুদ্ধ কালীন জার্মানী চায় ইহুদী নিধন – বিশ্বের উপরে অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠাই তার হেতু। বহিরঙ্গে থাকে ইহুদী-ঘৃণা। আর তারই ফলে ইহুদী দিগের একাংশের মর্মেও – জার্মান ঘৃণার, ক্ষুদ্রতর অর্থে জাতীয়তাবাদের জন্ম, স্বভাবিকভাবেই হয়ে যায়। এই ঘৃণা ছায়া ফেলে সুপার স্ট্রাকচারে। ইহুদীর জার্মান সঙ্গীতকে ঘৃণাতে, শব্দকে “মিঞা শব্দ” বলা্তে, গান কে “বাংলাদেশী” বলাতে। এই সত্যটিকে প্রতিষ্ঠা করে দৃশ্যটি।

কোনো তত্ত্বজ্ঞান ছাড়াই, স্রেফ ভালবাসার,সঙ্গীতের,কাব্যের টানে ইন্দ্রনীলের জুলিয়েট, টের পায় ওই ঘৃণার অহেতুকতা যা জাতীয়তাবাদী তাতেহ্‌ কে টের পেতে হলো, অন্তিমে, জুলিয়ানাকে খুইয়ে। মনেপড়ে প্রুস্তের “টাইম রিগেইন্ড” । ১ম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেওয়া ফরাসী Saint-Loup এসেছে প্যারিসে, সাক্ষাৎ হচ্ছে পুরনো বন্ধু, কাহিনীর লেখকের সঙ্গে। এই সাক্ষাতে আলোচনার বিষয় কিন্তু জার্মান সঙ্গীত, জার্মানীর উচ্চাঙ্গ সংগীত। -- ঠিক যেমন “চন্দ্রাহত” তে শুবার্ট শুনছে, মুগ্ধতায়, ইন্দ্রনীলের জুলিয়েট। এখানে, জুলিয়ানা অথবা জুলিয়েট, আমার মনে আনে সেই জার্মান মহিলাকে, ১ম বিশ্বযুদ্ধ কালে যাঁর “যুদ্ধ নয়” অবস্থানকে সমর্থন করেনি তৎকালের জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিও, যাঁকে হত্যা,করা হয়েছিল ১৯১৯ সালে । তিনি রোজা’। Rosa Luxemburg । ইন্দ্রনীলের জুলিয়ানা/জুলিয়েট চরিত্রের গঠনে, নাটকের বাক্য শরীরে গোলাপের ব্যবহারে। গোলাপ, রোজ, রোজা। 

প্রকৃত শিল্প এইভাবেইক্লিশে’কে, অতীতকে পুনর্জন্ম দেয় ছাই থেকে, ভষ্ম থেকে – প্রত্যেক কালে, কালের নিজস্ব প্রয়োজনে। নাটকের ‘নাজি’ আর ‘গেস্টাপো’ যে ভিন মুখোশে অদ্য আরো বেশী সক্রিয়, হন্তারক – তা’কি আর টের পাননি প্রকৃত দর্শক?


ঘুম ঘর