যাব,পিছু পিছু যাবঃ প্রসঙ্গ দেবদাস আচার্যের ‘তিলক মাটি ’
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
প্রথম প্রকাশ "আদম" , কলকাতা, নভেম্বর ২০১১ সংখ্যা
১। আবহসঙ্গীত
এ রকম প্রশ্নকরা যদি আজো সমীচীন হয়, যে,রবীন্দ্রনাথের রচনার মূল সুরটি ঠিক কি, তাহলে উত্তর হিসাবে এ’ও হয়তো সমীচীন যে, রবীন্দ্রনাথের মূল সুরের সমান্তরালে বেজে যায় "... কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই ।’
কিন্তু এ’ও কি ঠিক, যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিটি রচনাতেই ঠিক একইভাবে বলে
গিয়েছেন সেই অনন্ত যাত্রার গুহ্য ইঙ্গিতকথা? তা’যে অবশ্যই নয় সে কথা প্রমাণে প্রয়োজন হয়না কোনো তর্কের।
তথাপি ঐ মূল সুরের প্রসঙ্গটিও টিঁকেযায় তার আপন মহিমায় কেননা ‘শাস্তি’, ‘মহামায়া’, ‘মণিহারা’ এমনকি
‘রবিবার’, ‘ল্যাবরেটরী’ হেন
গল্পে বা ‘হঠাৎ দেখা’, ‘ক্যামেলিয়া’ বা
‘ কিনু গোয়ালার গলি’ হেন কবিতাতেও রবীন্দ্রনাথের শব্দ, বাক্য আবর্তিত হয় সেই আলোকেই
কেন্দ্র করে যে আলোকের স্পর্শে একদা স্বপ্ন ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল নির্ঝর । একই ভাবে সুধীন্দ্রনাথ
বিষয়ে বলেছিলেন জীবনানন্দ ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা’ । যদিও আগাগোড়া সুধীন্দ্রনাথও
কখনোই নয় নিরাশাকরোজ্জ্বল ।
প্রকৃত প্রস্তাবে আমি যা বলতে চাই তা এই, যে, রবীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ বা
অমিয় চক্রবর্তী এঁদের প্রত্যেকের রচনাতেই যদি
তলিয়ে যান পাঠক তাহলে, অবশেষে যা নিয়ে উঠে আসেন সে একেকটি ‘ধ্রুবপদ’ ।
সেই ধ্রুবপদ,কারোর, ‘তোমারো অসীমে প্রাণমন লয়ে।’, কারোর বা ‘নিরাশাকরোজ্জ্বলতা’ । আরেকটু পিছিয়ে গেলে, মধুসূদন
বা হেমচন্দ্রে তা আরো ষ্পষ্ট । অন্যথায় ভিক্টর হুগো, বোদলেয়ার বা গ্যেটে,হোমারে । কিন্তু
যে কোনো ভাষার, যে কোনো দেশের শিল্প রচনায়, ক্রমে দেখাযায় এমন একটি কালের প্রাদুর্ভাব
যেখানে অনেক ভালো কবিতা হয়তো লেখা হচ্ছে, অনেক মনীষাহেন চিন্তার বিচ্ছুরনও দেখা যাচ্ছে
তথাপি কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সেই ধ্রুবপদ যার নিরিখে একজন কবিকে আলাদা করে
নেওয়া যাচ্ছে অন্য জনের থেকে ।
সুধীন্দ্রনাথ বা অমিয় চক্রবর্তী বাংলা কবিতার যে পর্বের মনীষা সেই পর্বে জীবনানন্দই
একমাত্র ব্যতিক্রম। সহজ প্রত্যক্ষতায় জীবনানন্দ ক্রমে তাঁর লাশ কাটা ঘরের বাস্তবতার
ঠিক বিপরীত মেরুর দিকে, ক্রমে, চলে এসেছেন তাঁর সংশয়াকূল চৈতন্যের হাত ধরেই ।‘মাঘ সংক্রান্তির রাতে’, ‘আমাকে একটি কথা দাও’ হেন কবিতায়, মূলতঃ তাঁর জীবিতাবস্থায়
অপ্রকাশিত আরো অসংখ্য কবিতায় – যদিও জীবনানন্দের শব্দ,বাক্য
সেখানেও চিন্তাকূল তথাপি – সেখানে তিনি যাত্রী ‘বোধ’ বা
‘আট বছর আগের একদিন’ কেন ‘বনলতা সেন’ হেন কবিতারো স্পর্শ পথের
পক্ষান্তরে । তথাপি জীবনানন্দের এই যাত্রা একটি পরিক্রমারি রূপরেখা যে পরিক্রমাও, অতঃপর,
শুধু বাংলা কবিতা কেন, বিশ্ব কবিতাও হারিয়ে ফেলেছিল অনেকদিন ।
এই ধ্রুবপদ বা ধ্রুবপদের ইঙ্গিতপথের
এই অন্বেষা নয় শিল্প শ্রষ্টার বা শিল্পের নিরিখে কোনো বহির্বস্তু। এ শিল্প শ্রষ্টার
মননেরি এক অন্তর্বস্তু যা তাঁর দিনগত, মুহুর্তগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর শিল্প মনীষার
ঐক্যে ও বিবাদে অবয়ব প্রাপ্ত এক মহানির্বাণপথ। আধুনিকতার প্রবাদপুরুষ বোদলেয়ারেও সেই
ধ্রুবপদটিকে অতি সহজেই যায় চিনে নেওয়া । চিনে নেওয়া যায় রিলকেতেও । এমনকি, যদিও তা
নিছকই মেধা নির্ভর তথাপি এলিয়টেও আমরা টের পাই তাঁর যাত্রা ছিল সেই ধ্রুবপদের ইঙ্গিতপথের
দিকেই । বহুপরে সেই ধ্রবপদটিই নাম বদলে হয়ে উঠেছে grand narrative আর ঘোষিত হয়েছে যে এই post modern বিশ্ব ব্যবস্থায়
grand narratives অচল ।
কিন্তু এলিয়ট-পাউন্ড’এর সময়কাল
আর grand narrative এর মৃত্যুর ঘোষিত সময় কালের মাঝামাঝি কোনো এক সময়েই আমরা আসলে লক্ষ্য
করি শিল্পের সেই যুগ যা ধ্রুবপদ বিচ্যুতির যুগ । অতএব আধুনিকতা, খুবই ক্ষুদ্র অর্থে
যা এলিয়ট-পাউন্ড বা বুদ্ধদেব বসু’র আধুনিকতা তাকেও সরাসরি হেতু বলা যায়না এই ধ্রুবপদ
বিচ্যুতির। বরং আধুনিকতার প্রবক্তা এলিয়টের মুখেই শোনাযায়, যে, ‘
Literary criticism should be completed by criticism from a definite ethical and
theological standpoint. ।
The ‘greatness’ of literature cannot be determined solely by literary standards;
though we must remember that whether it is
literature or not can be determined only by literary standards.’ (
Religion and Literature, T.S.Eliot)
অর্থাৎ এলিয়টও এখানে, প্রকারান্তরে মেনে নিচ্ছেন এমন কি ঘোষনা করছেন যে শিল্পের
মহত্ত্ব নির্ণীত হতেপারে একমাত্র কোনো একটি সুপষ্ট অবস্থান থেকেই আর তাকেই তিনি বলছেন ‘definite
ethical and theological standpoint’ ।
বাংলা কবিতা ঠিক কবে এবং কিভাবে এই
‘definite ethical and theological
standpoint’ থেকে বিচ্যুত হয়েছিল বা হতে আরম্ভ
করেছিল তার বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র করবো কোনোদিন আজ শুধু এটুকুই বলে রাখি, যে, পাঠক
হিসাবে আমি বাংলা কবিতার ঐ ধ্রুবপদহীন সময়টিতে স্বস্তি পাইনা বিন্দুমাত্র সুতরাং যখন
৭১ বৎসর বয়ষ্ক কোনো কবির রচনায় ইঙ্গিত পাই সেই ধ্রুবপদের যা তাঁরি কিঞ্চিৎ বয়োজ্যেষ্ঠ
এবং সমসাময়িকদের হাতে হয়েছিল বিনষ্ট, ধর্ষিত তখন তাঁর রচনার নিবিড়তর পাঠে আগ্রহী হতে
বাধ্য হই ।বাধ্য হই পাঠক হিসাবে। বাধ্য হই কবি হিসাবে।
২।কবি প্রসঙ্গ
কবি দেবদাস আচার্যের জন্ম ১৯৪০ সালে। আজ সাল ২০১১। আমার দুর্ভাগ্য এই ( শুধু
আমার কেন সমগ্র বাংলা কবিতারি দুর্ভাগ্য কি এ নয়?) যে এই প্রথম আমি হাতে পেলাম তাঁর
কবিতা, গ্রন্থবদ্ধ ভাবে।ইতিপূর্বে তাঁর লেখার সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় ঘটে থাকলেও
আর সেই পরিচয় থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও আগ্রহ জন্মে থাকলেও দুই মলাটের সৌজন্যের পরিসরে
কেবলি তাঁর কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গ্রন্থটি ( তিলক মাটি, প্রকাশকঃ আদম)
হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখামাত্রই মনে এলো একটি পুরোনো গানঃ How many roads must a man walk down
before you call him a man? মনে এলো একটি কবিতা কয়টি
পংক্তিঃ মাঝে মাঝে দু একটা প্লেন উড়ে যায়। এক ভিড় হরিয়াল পাখি উড়ে চলে গেলে পরে ভাবি
। শুধু দুই পায়ে হেঁটে কতোদুর যেতেপারে মানুষ একাকী? । ৭১ বৎসর । হায়, আমাদের দেশে
আর আমাদের ভাষায়ই শুধু কেন, কতোগুলি দেশে, কতোগুলি ভাষায় একজন কবি, যিনি প্রকৃতই কবি
ছিলেন হয়তো উত্তর চল্লিশেও, কবি রয়েযেতে পেরেছেন ৭১ এ? আর যিনি পেরেছেন, যাঁরা পেরেছেন,
তাঁরাই যুধিষ্ঠির অথবা তাঁর অনুসরনকারী সেই ধর্ম-সারমেয় যাঁদের কাছে আমাদের প্রশ্নের
শেষ নেই, শেষ নেই কৌতুহল জ্ঞাপনের ।
জীবনের প্রায় ঐ রুপ পর্বে এসেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেনঃ
পশ্চাতের নিত্যসহচর , অকৃতার্থ হে অতীত
,
অতৃপ্ত তৃষ্ণার যত ছায়ামূর্তি প্রেতভূমি
হতে
নিয়েছ আমার সঙ্গ , পিছু-ডাকা অক্লান্ত
আগ্রহে
আবেশ-আবিল সুরে বাজাইছ অস্ফুট সেতার
,
বাসাছাড়া মৌমাছির গুন গুন গুঞ্জরণ যেন
পুষ্পরিক্ত মৌনী বনে । পিছু হতে সম্মুখের
পথে
দিতেছ বিস্তীর্ণ করি অস্তশিখরের দীর্ঘ
ছায়া
নিরন্ত ধূসরপাণ্ডু বিদায়ের গোধূলি রচিয়া
।
পশ্চাতের সহচর , ছিন্ন করো স্বপ্নের বন্ধন
;
রেখেছ হরণ করি মরণের অধিকার হতে
বেদনার ধন যত , কামনার রঙিন ব্যর্থতা
—
মৃত্যুরে ফিরায়ে দাও । আজি মেঘমুক্ত শরতের
দূরে-চাওয়া আকাশেতে ভারমুক্ত চিরপথিকের
বাঁশিতে বেজেছে ধ্বনি , আমি তারি হব অনুগামী
।
আর কবি দেবদাস লিখলেনঃ
সূর্যাস্তটাই এখন আমার পথ, আমার ভরসা।
দিনটা দ্রুত গড়িয়ে গেল সূর্যাস্তের পথ
ধরে
নিজেকেও সূর্যাস্তের মতোই অবর্ণনীয় লাগছে,
সম্মোহিত হয়ে থেমে থেমে উপভোগ করার সময়
নেই আমার,
নিজেকে ওই মোহময় পথে স্থাপন করলাম,
একটানা ধাওয়া করবো ওকে,
এবং করতেই থাকব
যতদূর সূর্যাস্তটা চলবে, যতদিন ধরে চলবে,
এবং চলতেই থাকবে
ততোদূরই। ( যাব, পিছু পিছু যাব)
উদ্ধৃত কবিতাটি দেবদাস আচার্যের ‘তিলক মাটি’ গ্রন্থের অন্তিম
কবিতাগুলির একটি। এর পরের দুটি পৃষ্ঠায়, দুটি কবিতায় সমাপ্ত হয় গ্রন্থটি।
অন্তিম পর্বের শেষ ন’টি রচনা যেন এই গ্রন্থের অন্তরা। এই শেষ ন’টি কবিতায় মৃত্যু
আর মৃত্যু বিষয়ে তাঁর ধারনা ও সিদ্ধান্ত যেন আপনাকে অক্ষরবদ্ধ করে ছায়াপথহেন। জানাযায়
যে অন্তর্গত বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁর এতোদিনের পথচলা তার সংবাদ। জানাযায়ঃ
‘ কত মানুষের কত মহৎ কর্তব্য রয়েছে
যা পূরণ হবে একদিন, এরকম সম্ভাবনার কথাই
ঘুরে ফিরে ভাবি
সেই সব সম্ভাবনার মধ্যেই এই বিকেলে
আমার পাঠানো বুদ্বুদগুলি ভেসে বেড়াক’। (পুণ্য এ বিকেলে)
এখানে এসে মনে না পড়ে উপায় নেই জীবনানন্দের সেই পংক্তিগুলিঃ ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায় ।’ এই মনেপড়া ভাবের, এই মনেপড়া
ভংগীর। এইখানে এসে দেবদাস আচার্যের ‘ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’ এসে
মিলেমিশে একাকার হয়েযায় বাংলা কবিতার প্রায় আবহমান ‘ট্র্যাডিশান’ এর সঙ্গে । যে
ট্র্যাডিশান, আমি বলেছি, ধ্রুবপদের, ধ্রুবপদের দিকে যাত্রার । যে ট্র্যাডিশানের প্রসাদভিন্ন বহু প্রায় কবিজনের বহুল টেক্নিক্
ধন্য রচনাও অকবিতা অন্তিম বিচারে ।
‘তিলক মাটি’র এই অন্তরা পর্বের কাছে আবার ফিরে আসতে হবে আমাদের। আসবো। তার
আগে বলেনিই গ্রন্থটির অন্যান্য পর্বগুলির কথা । যে পর্ব্বগুলি, অবশ্যই, গ্রন্থটি পাঠ
করতে করতে, পাঠক হিসাবে আমারি মনোজ নির্মান ।
আলাপ পর্ব্বঃ ‘বাড়তে দিই’ থেকে ‘কিছুতে নেই’
বিস্তার পর্ব্বঃ ‘আয়ুরেখা’ থেকে ‘মন নাচেরে’
অন্তরা পর্বঃ ‘যাও ভালোথেকো’ থেকে ‘আয়ুধ’
৩। আলাপ পর্ব্ব
‘এই বারান্দায়
ওই সুবিশাল গাছের ছায়া
মৃদু জ্যোৎস্না, অচঞ্চল রাত
উচ্চকিত সব শব্দ থেমে গেছে
আঙ্গুলের মাথায় একটা জোনাকি এসে বসল
হাত লম্বা করে দিই, প্রলুব্ধ হই
আঙ্গুলটাকে বাড়তে দিই
এবার অনেক কটা
তারপর ঝাঁক ঝাঁক
অসংখ্য তারার মতো
আমার আঙ্গুল ওরা টেনে নিয়ে চলল
বহু দূরে বহু বহু দূরে
এখন
সবচেয়ে কাছের একটা ছায়াপথ
আমার আঙ্গুল’ (বাড়িতে দিই)
এই কবিতায় আরম্ভ হয় গ্রন্থ ‘তিলক মাটি’। এই কবিতায় ঘোষিত
হয় কবির এক থেকে বহু হওয়ার ইচ্ছা । প্রায় ঈশ্বরের মতোই । এই কবিতায় কবি পার হয়ে যান
নৈমিত্তিকতাকে । এই কবিতাতেই নিকটতম ছায়াপথটিকে তাঁর নিজের একটি আঙ্গুল হিসাবে ঘোষনা
করবার মাধ্যমে কবি নির্মাণ করেন ইঙ্গিত জীবনের সঙ্গে মহাজীবনের মিলন সেতুর । আর ঐ সেতুটিরি
কোথাও যেন ছায়াপাত ঘটায় । মৃত্যু না হোক মৃত্যুচেতনা । যে চেতনার পরের শুদ্ধস্বরটি
বেজে ওঠে ঠিক পরের কবিতাটিতেই যার নাম ‘কুপ্রস্তাব’ যেখানে কবির সমস্ত
পারিপার্শ্ব নিজেদের মধ্যে মন্ত্রণা করেনিয়ে তারপর কবির কাছে এসে বলেঃ ‘ পুনর্যৌবন দিতে পারি, নেবে?’ ।
‘পুনর্যৌবন’দানের এই প্ররোচনা ‘কু প্রস্তাব’ কেননা আমরা জানি
যযাতির ইতিহাস, জানি বহু কসরত করে প্রথমা স্ত্রী’কে ডিভোর্স দিয়ে প্রায় বৃদ্ধ বয়সে
এলিয়ট সাহেবের যুবতী ভার্য্যা গ্রহন ও তার পরের ইতিহাস । আর তার চেয়েও বেশী জানি, যে,
বার্ধক্যই জীবনের সেই স্তর যেখানে , মর্মের সেই তৃতীয় নয়ন হয় পরিস্ফুট, যা, অতীতের
সেই চৈনিক কবিদের মতো সমস্ত বর্ণের গহনে যে বর্ণ শুভ্রতা , তাকে অবলোকনে হয় সক্ষম ।
আর এই বার্ধক্য যে কেবল বয়সের বার্ধক্য নয়, এ’যে আত্মার বিকাশেরি একটি স্তর এ’ও এক
তর্কাতীত সত্যই বটে। প্রসংগক্রমে মনে আসছেন অমিয় চক্রবর্তী, তাঁর এই বৃষ্টি, পালা বদল
কবিতাঃ
চিন্তার সমস্ত রং ধুয়ে গেছে শাদা হয়ে,
। । । । । । । ।
বাসনার আলোগুলি ঝিমিয়ে ঝাপসা হয়ে জ্বলে পাশে।
এ হল সেই নিরাসক্তির সংজ্ঞা যা কে অর্জন করে নিতে গেলে যৌবনের মায়ার ঊর্ণাজাল
কে বিদায় দিতেই হয় ।
যার আখ্যান চীনদেশের কবিতায় (খৃঃ ৬০০ – ৭০০’র কাছাকাছি সময়ের) মেলে বার বারঃ
Heaven’s
fragrance everywhere pure
emptiness,
heaven’s music endless.
……….. ………………..
All bottomless
clarity, in which vast
kalpas begin and
end out of nowhere.
…. …. …. …. …. …
I hoard sky a setting sun leaves
And love this
cold stream’s clarity
………. ………………. ……… ……….
এখানে emptiness, clarity সকলই ব্যবহৃত হয়েছে ‘অরঙ্গীন’ বা ‘বাহ্য বর্ণের উপস্থিতি হীনতা’ অর্থে। এই ‘বর্ণহীনতা’ দৃশ্যবস্তুর সাপেক্ষে নয়। এই ‘বর্ণহীনতা’ মূলত অন্তরের এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীর। লি পো এখানে এইভাবে ব্যাখ্যা করেন একে :
Blossoms pure,
no dye of illusions,
mind and water
both are pure idleness.
অর্থাৎ যখনই হয় বিধৌত তখনই সে প্রকৃত বর্ণে ভাস্বর। তখনি সে ‘শূন্য’, ‘বর্ণহীন’। তখনি নিরাসক্ত চোখে দেখা সম্ভব
হয় শুধু পৃথিবীকে নয়, স্বর্গকেও :
I sit once and
plumb whole kalpas,
see through heaven and earth empty.
অথচ বহিঃ প্রকৃতির সত্য তার বিপরীতে নিজেকে করতে চায় প্রতিষ্ঠিত। রঙের, বর্ণের,
বাসনার আবর্ত রচনায় সে হয় এমন সিদ্ধ যে স্বয়ং অর্জুণকেও হতেহয় দ্বিধাগ্রস্থ । সাময়িক
হলেও নামিয়ে রাখতে হয় গান্ডীব । আর বহিঃ প্রকৃতির ঐ বর্ণিল ষড়যন্ত্র কেই ‘কুপ্রস্তাব’ বলে ঘোষনা করে দিয়ে দেবদাস আচার্য প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁর ধ্রুবপদের
প্রাথমিক স্বরটিকে যে স্বরটি গেয়ে শোনায় সকালের জবা গাছের ডালে নেচে বেড়ানো টুনটুনির
গল্প, বলে শুকনো কঞ্চির ডগায় এসে বসা ফড়িঙ্গের কাহন । আর সেই কাহন, তাঁর ঐ নিরাসক্ত
দৃষ্টির প্রসাদে হয়ে ওঠে একেকটি চিরন্তন ভাষ্কর্য্য ।
‘ আজ দুপুরে একটা টুনটুনিকে
আমাদের জবা গাছের ডালে ডালে
নেচে বেড়াতে দেখলাম
সারাদিন আর কিছুই দেখিনি
কোনো কিছু দেখতে পাওয়া বেশ বিস্ময়কর ।’ ( দৃষ্টিসুখ)
অথবা
‘ শুকনো কঞ্চির ডগায় যখন
একটা ফড়িং এসে বসে
তখন
ওই শুকনো কঞ্চিটা
জীবন্ত হয়ে ওঠে
...
এই সহজ স্পর্শে আমি হতবাক হয়ে পড়ি, হতবাক হয়ে পড়ি ‘ (মহাস্পর্শ)
এই দেখা’র প্রসংগে মনে আসে আরেকজন কবিকে যিনি বলেছিলেনঃ
‘From my village
I see as much as from earth one can see of the Universe ।
Therefore my
village is as big as any other earth
Because I am the
size of what I see
And not the size
of my own height ।
...
The essential is
to be good at seeing,
Good at seeing
without always thinking’
সেই কবি Fernando Pessoa। তিনি ১৮৮৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়
জাত । আর আমাদেরি বাংলাদেশে ১৯৩৪ এ জাত আরেক কবি, মনেপড়ে তাঁকেওঃ
‘ সকল সেতুর মতো এখানেও এই প্রান্তে কুসুম
ফুটেছে;
সুন্দর, সুঘ্রাণ ফুল, ও প্রান্তেও কুসুমের
ঘ্রাণ ভেসেযায়।
...
হে কেশর, হে পরাগ, আমাদের চারিপাশে পরিকীর্ণ এই
বাস্তবের মতো হয়ে, বাস্তব বিশ্বের মতো
হয়ে আমাদের
মানস নেত্রের এক বিশ্ব আছে, মানসের বিশ্বও
বাস্তব’।
অপর আঙ্গিকে হলেও যে দেখার কথা এখানে বলেছেন বিনয়, অব্যবহিত পূর্বে বলেছেন পাসোয়া, সেই ‘দেখা’ রই ফলিত রূপ দেবদাসের বর্ণনে, কাহনে, আবহ নির্মাণে । ঐ দেখার গহনে মিশে আছে সেই ইচ্ছা – এক থেকে বহু হবার । মিশে আছে সেই অনুভব যা ‘একের অনলে বহু’ কে ‘আহুতি’ দিতে সক্ষম । আর ঐ সক্ষমতার অতলে রয়েছে সেই তপস্যা যার বলে, বর্তমান লেখক নির্ণীত, এই গ্রন্থের ‘আলাপ’ পর্বের অন্তিমে এসে দেবদাস বলে উঠতে সক্ষম হনঃ
‘ যা কিছু বানাই
সম্ভবত তাতে
অন্য অনেকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েযায়
বস্তুত
আমার অবিসংবাদিত একক অধিকার বলতে
কিছুই নেই
কিছুই নেই আমার একার, নেই, কিছুই নেই
।’ ( কিছুই নেই)
এখানে এসে মনেপড়ে কতো কথা ।কতো গান । মনে পড়ে ‘অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা
যায় তাহা যায়’ , মনেপড়ে ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে যাহা
কিছু সব আছে আছে আছে ।’ । মনেপড়ে ট্র্যাডিসানের সঙ্গে
ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্টের মিলনের কথা । মনেপড়ে হুইট্ম্যানের প্রতি পাউন্ডের বন্ধুত্বের
প্রস্তাব ।আর এ’ই সব মনেপড়াকে নিয়েই এগিয়ে যাই, হে পাঠক, গ্রন্থটির পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলির
দিকে ।
৪। বিস্তার পর্ব্ব
এই পর্বে মৃত্যু অথবা তার উপস্থিতির চেতনা নির্মাণ করে স্পষ্টতর আবহঃ
‘এসো গোল হয়ে বসি
মোমবাতির আলো নিভু নিভু
যে যার গল্পগুলো এবার শেষ করি
সময় আর দিবালোক চঞ্চল
দ্রুত সরে সরে যায়, পালা বদল করে
ততোধিক দ্রুততায় আমাদের স্বপ্নে রঙ লাগাতে
হবে
এসো আলো থাকতে থাকতে
আমাদের কল্পনার গায়ে
লতা পাতা জড়িয়ে দিই
নদীর ঢেউ জড়িয়ে দিই’ ( দেরী কোরো না)
এইবার, সেই দেরী না করে গল্প গুলি বলে নেওয়ার ভিতর দিয়ে সূচিত কবি ও পাঠকের
সমান্তরাল যাত্রা । সেই যাত্রায় কোথাও শুনি ‘আমাদের বৌমা-টি’র গল্প যাঁর
দোকানের বাইরের বেঞ্চিটিতে বসে আমিও চা খেয়েছি বহুদিন । গড়িয়া মোড়ে কখনো, কখনো গাঙ্গুলী
বাগানে, কখনোবা কক্স বাজারে, ঢাকায়, আসামে, শিলচরে, করিমগঞ্জে এমনকি, হায়, দক্ষিণের
এই পোড়া শহর বাঙ্গালুরুতেও । যাঁর ‘ক্ষয়ে যাওয়া পাথুরে মুখে
/ প্রত্ন-ছাপ / আগুনে ঝলসানো ।’ যাকে আমাদের সকলেরি, শেষ
পর্যন্ত, মনেহয় ‘টেরাকোটা মেয়ে’ । আলাপের এই পর্বে আমরা
শুনি কবি কন্ঠে ‘ভূত বন্দনা’ । যে পঞ্চভূতের কৃপায় তাঁর
উৎপত্তি । ক্রমে তাঁর বিনাশও ( এইখানে এসে মনেপড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘আজ আমার প্রণাম গ্রহন করো পৃথিবী ।) । এই পর্বে পাঠকের অদৃশ্য সাহচর্য্যে তিনি
পথ হাঁটেন ছোটো ছোটো কথাদের সঙ্গে সঙ্গেঃ
‘ ছোটো ছোটো কথা
মনেপড়ে
তাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটি
কোনো কথাই
স্বয়ং সম্পূর্ণ অর্থবহ নয়
খন্ড খন্ড কথাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ মাত্র’
( সম্ভব হতেও পারে)
এই পংক্তি গুলি আমাকে ভাবিত করে অন্যভাবে। কেননা ৭০ বৎসর বয়সে দাঁড়িয়ে তাঁর
এই উক্তির অর্থ হয়, জীবনের অভিজ্ঞতার নির্য্যাসে
পোষ্ট মডার্ণ জীবন ধারনার মর্মে এক অকুন্ঠ আঘাত । যারা বলেছিল বিশ্বযুদ্ধের
সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে ‘গ্র্যান্ড নেরেটিভ’ তাদের
ভেবে দেখতে বলি ‘গ্র্যান্ড নেরেটিভ’ এর সংজ্ঞা নিয়ে ।
আসলে আমাদের সব কথাই যে মূলতঃ একটি কথার প্রকাশের দিকে যাত্রা করে আছে এই ধারনার এমন
অনাবিল প্রকাশ, পাঠক, আমার আর মনে পড়েনা খুব বেশী ।
দেবদাস অনুভব করেন কথাগুলি, অনুভব করেন মূলতঃ তাঁর দেখার ভিতর দিয়েই। কোনো
তত্ত্বে তাড়িত নয় এই অনুভব, এই উচ্চারন আর তাই
এরই পাসাপাশি আমরা দেখি যে কবি দেখছেন ‘করিম রাজমিস্ত্রি’র অবৈধ প্রণয়,
দেখছেন এবং তাকেও নিচ্ছেন তাঁর দীর্ঘ যাত্রা পথের পাথেয় করে ।
মনোরম এই বিস্তার পর্ব বিস্তারের নিয়মেই উপল-বন্ধুর। কখনো তারানা তাড়িত। কখনো ধীরলয়ে বয়ে যাওয়া গ্রামের নদীটি ।তথাপি সর্বিত্রই নিরাসক্ত চাহনির মর্মগত আশাবাদে ভাস্বর। যে আশাবাদ বা আস্তিক্য ( অস্তি-অর্থে) তাঁর রচনার ধ্রুবপদটির আরেকটি মৌল স্বর । যে স্বর বেজেওঠে এই বিস্তার পর্বের শেষে এসে এইভাবেঃ
‘ উঠোনে
বাতাস ঘুরে ঘুরে নাচ করছে, পাখিরাও
দু’একটা খড় কুটোও তার সঙ্গ নিয়েছে
...
কৌতুহল নিয়ে এসব দেখি’ (মন নাচে রে)
কেন কেজানে এখানে এসে মনেপড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ফাল্গুনী’, মনেহয় এই সব ‘দেখা’ যেন ‘ফাল্গুনী’র বাউলের সেই ‘দেখা’ যা অসম্ভব হয় বাহিরের চোখদুটি অন্ধ নাহলে, ‘ফাল্গুনী’র বাউল বলেঃ ‘একদিন আমার দৃষ্টি ছিল । যখন অন্ধ হলুম ভয় হল দৃষ্টি বুঝি হারালুম । কিন্তু চোখওয়ালার দৃষ্টি অস্ত যেতেই অন্ধের দৃষ্টির উদয় হল । সূর্য যখন গেল তখন দেখি অন্ধকারের বুকের মধ্যে আলো ।’ সেই আলোয় দেবদাস লিখে রাখেন তাঁর দিনের প্রাপ্তির’ কথাঃ
‘খাঁ খাঁ শূন্য মাঠ
সন্তদের হেঁটে যাওয়া দেখি
দুপুরে শংকর গ্যাস দিয়ে গেল,
এল ক্যুরিয়ারে চিঠি, বিল
গৃহিনী হাই তুলল মুখ তুলে
টিকটিকি ডাকল, গৃহিনী বলল ঠিক ঠিক
সবই এরকম দিনরাত
এরকমই দিনরাত
এর বেশি ওই
সন্তদের হেঁটে যাওয়া’ ( দিনের প্রাপ্তি)
আমাকে আচ্ছন্ন করে তাঁর প্রাপ্তি সংবাদের তালিকা। গ্যাস দিয়ে যাওয়া, ক্যুরিয়ারে
আসা চিঠি, গৃহিনীর হাই ।।এই সমস্তের নৈমিত্তিকতার পাশাপাশি সন্তদের হেঁটে যাওয়া । এ
যেন এক নাটকই । অথচ যে নাটক নিগূঢ়, নিবিড় । যে নাটকে সেক্সপীয়ারীয় দ্বন্দ্ব নেই । নেই
চেকভীয় বা ইবসেনীয় দমচাপা উত্তেজনা । বরং এই নাটকের কোথাও রয়েযায় ‘ডাকঘর’হেন subtlety । যেখানে রাজার চিঠির সমান্তরালে সন্তদের হেঁটে যাওয়া
হয়ে ওঠে এক objective
correlative ।
৫। অন্তরা
একদিকে সমস্ত নৈমিত্তিক প্রাপ্তি আর সমান্তরালে সন্তদের ঐ হেঁটে যাওয়া । ঐ
হেঁটে যাওয়ার দিকে চেয়ে থেকে থেকে কবি নিজেও কি পার হয়ে যাননা, যাননি তাঁর নৈমিত্তিকতার
ক্ষুদ্র গন্ডীটিকে? নাহলে অন্তরায় এসে কিকরে গেয়ে ওঠেন তিনিঃ
‘ অতীতকে দশ পংক্তির পদ্যে ফুরিয়ে ফেলব,
সেই সারাংশের ব্যাঞ্জনাটুকুই
ফুঁ দিয়ে বুদ্বুদ বানিয়ে
ক্রমাগত উড়িয়ে চলব বাকি বিকেল ।’ (পুণ্য-এ বিকেলে)
অতীতকে অর্থাৎ অতীতের সমস্ত তুচ্ছতাকে মাত্র দশ পংক্তির বেশী জায়গা না দেওয়ার
স্পর্ধা দেখাতে পারেন কারা? কতোজন? আমার মনে আসে টলষ্টয়ের ‘ফাদার সিয়ের্গী’, দস্তয়ভস্কি’র ‘ফাদার জসিমা’ । যদিও দেবদাসের
যাত্রায় ঐ সন্তদের মতো পাপের সঙ্গে নিত্য সংগ্রামের
ইতিহাসের কোনো চিহ্ন নেই তথাপি অতীতকে মাত্র দশ পংক্তির মূল্যে শেষ করে দিয়ে অনন্তের
দিকে অন্তহীন হেঁটে যাওয়ার বাসনার ইঙ্গিতে দেবদাসের রচনা আমার মর্মে ফিরিয়ে আনে ঐ সন্তদের
।ঐ অন্তহীন গমনও যে এক রকমের আস্তিক্যই তা’ই দেবদাস জানান দেন একই রচনার পরের পংক্তি
মালায়ঃ‘ কত মানুষের কত মহৎ কর্তব্য রয়েছে
যা পূরণ হবে একদিন, এরকম সম্ভাবনার কথাই
ঘুরে ফিরে ভাবি
সেই সব সম্ভাবনার মধ্যেই এই বিকেলে
আমার পাঠানো বুদ্বুদগুলি ভেসে বেড়াক’। (পুণ্য এ বিকেলে)
প্রকৃত অর্থে এ’ই তাঁর অন্তরা। এ’ই তাঁর শেষ কথা। অন্ততঃ এই গ্রন্থের । যে গ্রন্থের নাম ‘তিলকমাটি’ । এই গ্রন্থের নাম ‘তিলকমাটি’ কেননা অন্তহীন তাঁর এই যাত্রায় মাটী’র তাঁর প্রথম ও শেষ তিলক । এই গ্রন্থের নাম ‘তিলকমাটি’ কেননা তিলকমাটি’র শুভ্রতায় আলোকিত এই গ্রন্থের দৃশ্যাবলী, এই গ্রন্থের বাক্য বিন্যাস । এতে মিশে আছে জীবণের প্রতি তাঁর আজানু প্রণাম, মিশে আছে মহাজীবনের পথটির সন্ধানের ইঙ্গিতরেখা । এই নামটির মর্মে মিশে আছে তথাকথিত আধুনিকতাকে সর্বৈব নাকচ করে দেওয়ার অভিপ্রায় ।
অন্তিমে আবারো বলি রবীন্দ্রনাথের ‘প্রান্তিকে’র সঙ্গে দেবদাসের
এই ‘তিলকমাটি’র সংশ্রব আমি টের পাই প্রকৃতই। সেই সংশ্রব প্রথমতঃ
সূচিত গ্রন্থদুটির অন্তর্গত মৃত্যু চেতনার সাযুজ্যে। উভয় গ্রন্থেই মৃত্য এবং তার চেতনা
অন্তঃসলিলা। বরং জীবনের দীর্ঘ যাত্রার সমস্ত সম্বল নিয়ে আপনাকে মহাজীবনের স্রোতে ন্যস্ত
করবার উন্মুখতা না হোক, অন্ততঃ প্রস্তুতি দুটি গ্রন্থেরি প্রকৃত আবহ। আঙ্গিকের দিক
থেকেও এদের নৈকট্য এইখানে, যে, উভয়েরি লিখন ভঙ্গিমা টান্ টান্, মেদহীন, পাহাড়ি নদীর
মতো ।গতিশীল ।তথাপি গভীর । এমনকি ‘প্রান্তিক’ গ্রন্থের শেষে
রবীন্দ্রনাথ যেমন স্পষ্ট করে বলে গেছেনঃ
‘নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস ,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস
—
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে’
তেমন ভাবে না বল্লেও ‘তলকমাটি’র অন্তিম কবিতায় দেবদাসও
বলেন এক যুদ্ধের কথা। যে যুদ্ধ তাঁর অন্তর্গত যুদ্ধ । যে যুদ্ধ প্রটিটি সংবেদনশীল মানুষের
অন্তর্গতঃ
‘ পথে
ছোটো ছোটো ব্যর্থতা
ধূলো মাটির মতো
পায়ে জড়িয়ে যায়
ছোটো ছোটো সুখ শান্তিও
পালক বুলিয়ে যাওয়ার মতো
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়
কিন্তু আমি এভাবে
সুখ দুঃখের মধ্যে
জড়িয়ে থাকব না
ধনাত্মক ও ঋণাত্মক
অভিঘাতগুলিকে
নিয়ন্ত্রণ করে
পরস্পর মুখোমুখি সংঘাত ঘটিয়ে
শক্তি তৈরি করব
সেই শক্তিই হবে
আমার পরিত্রাণের অস্ত্র (আয়ুধ)
শেষ করার আগে শুধু এ’ই বলি যে, যেমন লিখেছেন দেবদাস, সূর্য্যাস্তটাই এখন তাঁর
ভরসা, তাঁর সেই সূর্যের পিছু পিছু তিনি হেঁটে যাবেন যতোদূর যাওয়া যায়, যতোদিন যাওয়া
যায় । তেমনি আমিও বলি, সমস্ত মুগ্ধ পাঠকের পক্ষ থেকে বলি । দেবদাস এগিয়ে যাবেন হেমলিনের
বাঁশি ওয়ালার মতো তাঁর সুরগুলি বাজাতে বাজাতে আর আমরাও, সেই বাঁশির সুরে মুগ্ধ সেই
বালক বালিকার মতোই, ‘যাব, পিছু পিছু যাব’ । যতোদূর যাওয়া যায়
। যতোদিন যাওয়া যায় ।
সপ্তর্ষি বিশ্বাস, ২৪/৪/২০১১ – ৮/৫/০১১ বেঙ্গালোর