“যা পেয়েছি প্রথম দিনে”
'যা
পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে,
দু হাত
দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মতো হেসে॥
যাবার
বেলা সহজেরে
যাই
যেন মোর প্রণাম সেরে,
সকল
পন্থা যেথায় মেলে সেথা দাঁড়াই এসে॥
খুঁজতে
যারে হয় না কোথাও চোখ যেন তায় দেখে,
সদাই
যে রয় কাছে তারি পরশ যেন ঠেকে।
নিত্য
যাহার থাকি কোলে
তারেই
যেন যাই গো ব’লে–
এই
জীবনে ধন্য হলেম তোমায় ভালোবেসে॥'
যাদের কথা অজান্তেই বাদ পড়লো এই গপ্পে, তাদের প্রত্যেককে……………।।
১। “আমাকে জাগাবে বলে” ...
ফিরে যেতে হয় সেই বৃদ্ধ, অতিবৃদ্ধ,মহাবৃদ্ধ,চির যুবক,নব যুবক সেই রবি বাবুর কাছেইঃ “যা আমার সবার হেলাফেলা যাচ্ছে
ছড়াছড়ি / পুরোনো ভাঙা দিনের ঢেলা, তাই দিয়ে ঘর গড়ি” … ১৯৮৮/৮৯
সাল। এগারো কেলাস। করিমগঞ্জ কলেজ। শতকরা ৩০০ ভাগ মফস্বলি “ইন্টেলেক্চুয়াল” হয়ে
উঠছি। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, পায়ে হাওয়াই চটি, মুখে চারমিনার আর মগজে “বিপ্লব”। কলেজের
দেওয়াল পত্রিকায় কবিত্বের বিজ্ঞাপন। “দিদি”দের আস্কারা। সহিপাঠিনীদের চোরা চাউনি। মদটা,
গাঁজাটা হয় ধরে ফেলেছি নয়ত ধরব ধরব করছি। মর্মে সতত সঙ্গীতঃ “বালকবীরের বেশে তুমি করলে
বিশ্বজয়, একি গো বিস্ময়…” – কলেজে এনুয়েল ফেস্টিভেল। নিজেই নাট্যকার, ডিরেক্টার, এক্টার।
চলছে এক্সিবিশান। সাইন্স বিল্ডিঙের এগারো-বারো কেলাসের মাঝখানের পার্টিশান খুলে বিরাট
হল্। এক সন্ধ্যাবেলা এক্সিবিশান দেখছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে – যেন জাঁ পল্ সার্ত্রে বা
ওয়াল্টার বেঞ্জামিন। অসংখ্য নকলনবিশী আর আনাড়ি “এব্স্ট্রাক্ট” আর নেংটো মেয়েছেলে এঁকে
বাহাদুরি নেওয়ার চালবাজির পরে হঠাৎই চম্কে ওঠা। ফাঁসিকাঠ। ঝুলন্ত এক শিখ আর … একজন
মুসলমান …? গরুর গাড়িতে খড়ের বোঝা। “হাইলি ইন্ফ্লেমেবল্”। আরো বেশ কয়েকটি ছবি। জলরঙ্গে।
হ্যাঁ, দোষে গুনে ঐগুলি ছবি। রেখায় রঙে মন টানে। চোখ কাড়ে। মনে আছে এই ছবিগুলো ছিল
দরজা থেকে যে দেওয়াল বাঁদিকে, তাতে। ঠিক মুখোমুখি দেওয়ালে গিয়ে আবার চম্কে ওঠা। পেন্সিলের
কাজ। শায়িত গাছের গুঁড়ি। নারীশরীর। আরো অনেক…তাদের পাশেই একটি জলরঙ্গের ছবি। কিন্তু
শিল্পীর নাম পেন্সিলে আঁকা ছবিগুলির আঁকিয়ের নয়। ঝোপ জংলায় ঘেরা একটি ছোটো পুকুর না’কি
ডোবা? তাতে ছিপ ফেলে বসে আছে একজন রোগাসোগা, লম্বা মানুষ। ছবির নাম “শ্-শ্-শ্”
…
প্রথম দফা দেখা সেড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারমিনার ধরিয়ে
ঠিক কি ভাবা যায় তা’ই ভাবছি। অডিটোরিয়ামে নাচ গান কিসব চলছে তাই ঐ টানা বারান্দায় লোকজন
নেই বিশেষ। ভাবতে ভাবতে ভাবতে ভাবতে প্রায় ভবসাগর পাড়ি দিতে চলেছি এমন সময় –
“তুমি’ত কবিতা লেখো” –
রোগা, লম্বা একটি ছেলে। গালে সামান্য দাড়ি। অদ্ভুত চাউনি।
“হুম্, কেন?” – কন্ঠকে যথাসম্ভব “অমিতাবচ্চন” করে নিয়ে
জবাব।
“না, মানে, আমি ছবি আঁকি। দেখলাম তুমি আমার ছবিগুলো খুব
মন দিয়ে দেখছো …”
“তোমার ছবি? কোন্ গুলো?”
যুবকের সঙ্গে এক্সিবিশন্ হল্ এ আমার পুনঃপ্রবেশ এবং
আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার, যে, যে ছবিগুলি দেখে চম্কে উঠেছিলাম সেই ফাঁসিকাঠ। ঝুলন্ত এক
শিখ আর … একজন মুসলমান …? গরুর গাড়িতে খড়ের বোঝা। “হাইলি ইন্ফ্লেমেবল্”। এ’ই সবেরি
আঁকিয়ে এই যুবক…
সেই প্রথম সাক্ষাৎ সন্দীপনদা’র সঙ্গে তারপরে … হ্যাঁ একটু
দুঃসাহস আর একটু ইয়ার্কি মিলিয়ে বলছি “তারপরের কথা’ত ইতিহাস” …
ইতিহাস? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ – ইতিহাসে কোথায় ঐ নাম পঙ্কজ
সূত্রধর? ঐ অপূর্ব পেন্সিলে আঁকা ছবিগুলির শিল্পী? কোথায় পাঞ্জুদা’র নাম? যে এঁকেছে
ঐ “শ্-শ্-শ্” – ঠিক যেন একটু শব্দ হলেই ভেঙ্গেযাবে নিস্তব্ধতা … শালা, যে “ইয়ে”র
ইতিহাসে তাদের নাম নেই – উল্লেখ নেই আমাদের সহপাঠী পিঙ্কুর আঁকা “অমিতাবচ্চন”এর পোর্ট্রেট্
এর – যা পরের বছর এনুয়েল ফেস্টিভেলের ছিল বিশেষ আকর্ষণ, যে ইতিহাসে নেই বাবুদা’র, যে
বহুকাল “রফিবাবু” নামে ছিল পরিচিত তার মঞ্চানুষ্ঠান, নেই চেং-কং-কাবই,সুজিত বেগী, হাইপাওয়ার
চশমার কুমারেশদা –“কুমারেশ নাথ চন্দন”, তার গাঁজারু সাগরেদ বাবু পবিত্র, নেই সেই অনন্য
ছড়াগুলি “কেটে শাকশব্জি করলা শেখে বায়োলজি” আর “কুমারেশ বন্ধুরে ডাকি কহিল দীপক/
ব্ল্যাক্বোর্ডে লিখে এসো / নিয়ে যাও চক্/ আমি যারে ভালবাসি মিত্রা তার নাম…” – হ্যাঁ,
আমার প্রসিদ্ধ স্মৃতিও তারপরের পংক্তিগুলি মনের আনতে পারছেনা কিছুতে … ইতিহাস? হাঃ
হাঃ হাঃ হাঃ – যে ইতিহাসে নেই ঐ শিলালিপিগুলি, নেই মোটরবাইক ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের অঢেল
ক্যাসেট আর বিজ্ঞহেন্ হাস্যসহ রজৎদা“সাবান রজত”, লিপ্টুদার মাথায় গুন্ডাদের ঢুকিয়ে
দেওয়া জ্যামিতির কম্পাস ও রক্তপাতের দাগ- সেই “ইতিহাস”এর মুখে আমি ‘ইয়ে’ করি
…
মহাপন্ডিত রোলা বার্থ বলেছেন মীথ আসলে এক বিশেষ ভাষাপ্রক্রিয়া।
হ্যাঁ, আমারো তাতেত বিশ্বাস। -ঐ শিলালিপিগুলির অনেক কিছুই আমার দেখা নয়। শোনা। অন্তুদা-করলাদি,
দীপকদা-মিত্রা –এদের যুগ আমাদের যুগের ঠিক আগে। তবু নিজেকেও চরিত্র মনেহয় ঐ যুগের।
কেন? কেননা ঐ সবই মীথ্ যেমন মীথ্ নেতাজী মেলার “বিদ্যুৎকন্যা”, যেমন মীথ প্রেমাঙ্কুরবাবুর
শালির দুধ, যেমন মীথ “ভাঙ্গা বাইচ্চু” …
পাঞ্জুদার সঙ্গে একবারই আমার দেখা হয়েছিল। সৌগতদার বাড়ির
গেইটে। তারপরে ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এসেছিলাম ওর বাড়ি অব্দি। ওদের বাড়ি পার হয়ে
– রাজা-জয়-রাতুল-রাম-রঘু এই পঞ্চপান্ডবের ইন্দ্রপ্রস্থ পেরিয়ে, “খুকনের দুকান”, কস্মোপলিটান্
ক্লাবের মাঠ, সুভাষের দোকান আর “মরিন্ড মাজন”এর দোকানের পরে আমার বাড়ি। এর পরেই বাড়িই
রাজাদা’র। -অন্তুদা,রাজাদা,সন্দীপনদা,সৌগতদা,পাঞ্জুদা – সহপাঠীই ছিল সম্ভবতঃ। করিমগঞ্জ
কলেজে। তারপরে … যথারীতি …“নিখিলেশ প্যারীসে, মউদুল ঢাকাতে …”
পাঞ্জুদা’র ছবি, আমার মর্মে, একহারা, খোঁচাদাড়ি, না গোঁজা
শার্ট ( সম্ভবতঃ হালকা সবুজ)। এখনের ছবি দেখে মেলাতে পারিনি। মেলাতে পারেছি ঐ “শ্-শ্-শ্”
ছবি আর একটি গল্পের মূল্যে…
এগ।রো কেলাসে উঠেই “হক্কলে প্রেমময় পুরুষ হই যাইন” – বলতেন
আমাদের অঙ্কের স্যার রঞ্জিত দাশ – হ্যাঁ, বিনা পয়সায় ছাত্র পড়ানো, প্রেমের টানে সেই
আমলে আই আই টি ছেড়ে করিমগঞ্জে ফিরে আসা, একটু আধটু জুয়া খেলা আর মদ্যপান সহ অঙ্কে অনন্য
সাধারন মেধা ও তৎসহ এইরূপ বানীর মূল্যে তিনিও একটি মীথ্… এগারো কেলাসে উঠেই আমরা,
আমাদের দাদারা – এই মফস্বলে প্রথম “কোএড্” হতো। তখন। “কোএড্” হওয়া গেছে তথাপি “কো”নারীদের
সঙ্গে কোয়ালিশন হচ্ছেনা – এই বিরাট দুর্যোগে অন্তুদা,রাজাদা,সন্দীপনদা,সৌগতদা’দের ব্যাচ্
যখন রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ তখনই একদিন কান্ডটা করলো পাঞ্জুদা। কলেজের সামনে বসা
সপ্ড়িওয়ালার কাছ থেকে কিন্লো “এক টাল্” সপ্ড়ি। রাখবে কোথায়” ঝোলা শার্টের নীচের
দিকটাকেই ঝুলি বানিয়ে সোজা গার্লস্ কমন্রুমের সামনে। ভূমিকাহীন আমন্ত্রণ “কোএড্”
এর “কো”নারীদের প্রতিঃ “নেও নেও সপ্ড়ি খাও। ফাটাফাটি সপ্ড়ি…”
অতঃপর? অতঃপর যা হওয়ার তাই হলো। স্থাপিত হলো “কো-এড” এর
“কোয়ালিশান”। অতঃপর রঞ্জিত স্যারের ভাষায় এলো সেই প্রেমময় যুগ। তবে আমার যদ্দুর ধারণা
তাতে মনে হয় ঐ “কোয়ালিশান” এর “এক্সিকিউটিভ্” পাঞ্জুদা হয়ে যেতে হয়েছিল সক্কল মহিলাদের
“ভাই”। ভুল থাকলে শুধ্রে দিও পাঞ্জুদা –
এই উপকথা শুনেছি সৌগতদার মুখে। সৌগতদা’ই আমাকে দেখিয়েছিল
আরেক অনবদ্য নিদর্শন, কাব্যের। সে একটা যুগ গেছে যখন “এস এফ্ আই” নামটি ততো ঘৃণ্য
ছিলনা। তখনো, অন্ততঃ মফস্বলে “ভালো” ছেলেরা “এস এফ আই” করতো এমন কি এস ইউ সি’ও করতো।
প্রজাপতির অফিস হিসেবে এস ইউ সি’র মতো নাম ডাক না থাকলেও অন্ততঃ শিলচরে, তৎকালে, “এস
এফ আই” ও কম যেতোনা। সেই যুগে, করিমগঞ্জ কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনে প্রায় সব সীট্ই
জিতেনিলো এস এফ আই। অন্তুদা, সৌগতদা এমন কি “জুনিয়র কেঁচো” কিশলয় চক্কোত্তি অব্দি
–লাল সেলাম! – আমার জীবনে কলেজঋতু তখনো আসেনি যদিও – আসি’ আসি করছে …
সৌগতদা সম্ভবতঃ হয়েছিল ম্যাগাজিন সেক্রেটারি আর সেই সুবাদে
পাঠ্য, অপাঠ্য, মৌলিক, টৌকিক – অসংখ্য কলেজি সাহিত্যকর্ম – নানা পাড়া থেকে, গ্রাম থেকে
এসে জমা হয়েছিল তার ভান্ডারে। অনেক বছর পরে “এ বোঝা আমার নাও বন্ধু নামাও” গাইতে গাইতে
সোগতদা যখন ভান্ডার সাফ্ করছিল তখনই পাওয়া যায় এই অমূল্য রত্নটি। রচনাকার ভাঙ্গার
কোনো এক প্রেমিক মিয়া সাহেব। পদ্যটি এইরূপঃ “কতকথা হয়েছিল বসে করিমগঞ্জে/ দাও নাই সাড়া
যেন মূকগুঞ্জে/ যেন তন্ন পেয়েও আছো নিকুঞ্জে…”
এই সমস্তই হয়তো বহুর কাছে “হেলাফেলা” আর এরাই আমার। “যা আমার সবার হেলাফেলা
যাচ্ছে ছড়াছড়ি / পুরোনো ভাঙা দিনের ঢেলা, তাই দিয়ে ঘর গড়ি”
…তাই ভুলিনা। তাই মনে আসে কথাগুলি। ছবিগুলি। তাই স্মৃতি। তাই লিখে রাখা …
২। স্যার, অমিতাভ চৌধুরি
ছিলেন স্যার, অমিতাভ চৌধুরি। তাঁর মোটা কাঁচের চশমা। বিরাট,
বিষণ্ণ এক উঠানের আরধারে তাঁর জনশূন্য বাড়িটি। শহরের যে প্রান্তে কুশিয়ারা নদী, সেই প্রান্তের এক মনখারাপ গলীতে স্যারের
বাড়ি। বাড়িতে স্যার একা’ই থাকতেন তখন। বারান্দা থেকে পাওয়া যেতো তাঁর ফিল্টার উইল্সের
ঘ্রাণ। সামনের বারান্দা থেকে একটা অন্ধকার করিডর ধরে এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে স্যারের
পড়ানোর ঘর। দেওয়ালে কাঠের তাক। বই। স্টেট্স্ম্যান্ পত্রিকা। মস্ত একটা কাঠের
টেবিল ঘিরে কাঠের বেঞ্চি। কয়েকটা চেয়ার। স্যারের খাটিয়া। ঠিক উল্টোদিকে ডাঁই করা
ফিল্টার উইল্সের প্যাকেট। খালি আর অখালিতে মেশানো। ঐ ডাঁই থেকে, পরের বছর, বাজি ধরে সিগারেট চুরি করেছিল আমার
ছোটোভাই।
ছিলেন স্যার, অমিতাভ চৌধুরি। তাঁর মোটা কাঁচের চশমা। বিরাট,
বিষণ্ণ এক উঠানের আরধারে তাঁর জনশূন্য বাড়িটি। ছিল ফিল্টার উইল্স্ সিগারেট।
ছিল নিত্য সন্ধ্যায় লোডশেডিং আর সিগারেট দু আঙ্গুলের ফাঁকে নিয়ে তাঁর হাত বাড়িয়ে দেওয়া
মোমের শিখার দিকে। না’ত মুখ নেবেন মোমের কাছে,না’ত মোমবাতিকে হাতে করে আনবেন মুখের
কাছে। প্রায় শিক্ কাবাব বানানোর কায়দায় মিনিট দুই সিগারেটের মাথাটা মোমের শিখায় চেপে
রেখে তারপর তিনি চারটে ব্রহ্ম টান। সিগারেটের জ্বলে ওঠা। সিগারেট দু আঙ্গুলের ফাঁকে
নিয়ে মোমের শিখার দিকে ঐ হাত বাড়িয়ে দেওয়া থেকে সিগারেটের প্রকৃত জ্বলেওঠার মুহুর্তটি
ছিল আমার কাছে থ্রীলারপ্রায়। চোখের পলক ফেলতে পারতাম না, অঙ্ক করার হলে হাত থেমে যেতো।
স্যারের চোখে পড়ে গেলাম একদিন। বেশী কথা স্যারকে বলতে শুনিনি কখনো। স্থির চোখে, চশমার
কাঁচের ভিতর দিয়ে একটি চাউনি। ঐ যথেষ্ট। কলেজ ইলেকশনের সময়েও দেখেছি কুমারেশ,সজল দত্ত’হেন
“মাস্তান”ও স্যারকে আসতে দেখেই সর্দারি ছেড়ে ভোঁকাট্টা দিয়েছে।
অথচ তেমন লম্বা চওড়া ত ননই – রীতিমতো বেঁটে’ই ছিলেন স্যার।
ছিল এক আরোগ্য-অসম্ভব চর্মরোগ যার প্রকোপে স্যার বহুযুগ ইন্দ্রলুপ্ত। একদা আমাদের বাড়িতে,
প্রতি রবিবারে এক আসর বসতো। বলাযায় “স্টাডি সার্কল”। পালা করে পাঠ হতো “দাস ক্যাপিটেল্”।
পরে “ওরিজিন অফ্ স্পেসিস্”। আসতেন নানা বিষয়ের অধ্যাপকেরা। ফিজিক্সের তুষারকাকু
আর স্যার, অমিতাভ চৌধুরি। বোটানি-জুলজির প্রদীপ বিকাশ বাবু।
আরো আসতেন কেউ কেউ। স্মৃতি এখন প্রতারণা করছে। কয়েকদিন জেঠু, মানে সুজিৎ চৌধুরিকেও দেখেছি আসতে। তখন আমি পাঁচ-কিংবা ছয় কেলাসের ছাত্র।
স্যারকে তখন থেকেই দেখছি ঐ ইন্দ্রলুপ্ত মস্তকে। আরোগ্য-অসম্ভব
ওই চর্মরোগই তাঁর আজীবন অকৃতদারত্ব পালনের হেতু। নতুবা বেঁটে খাটো হলেও ওই রকম সুপুরুষ,
একদা প্রেসিডেন্সির নামজাদা এই ছাত্রটির অবিবাহের অন্য কোনো হেতু পারেনা থাকতে।
ফিরে যাই সেই সিগারেটের জ্বলে ওঠার দৃশ্যে। সিগারেট দু আঙ্গুলের ফাঁকে নিয়ে মোমের শিখার
দিকে ঐ হাত বাড়িয়ে দেওয়া থেকে সিগারেটের প্রকৃত জ্বলেওঠার মুহুর্তটি ছিল আমার কাছে
থ্রীলারপ্রায়। চোখের পলক ফেলতে পারতাম না, অঙ্ক করার হলে হাত থেমে যেতো। স্যারের চোখে
পড়ে গেলাম একদিন। বেশী কথা স্যারকে বলতে শুনিনি কখনো। স্থির চোখে, চশমার কাঁচের ভিতর
দিয়ে একটি চাউনি। অতঃপর একটি মাত্র বাক্য বা খন্ড বাক্যঃ “তিন লেটার ফাইয়া মেট্রিক্
ফাশ্ করলায় আর সিকেরেট ধরানি দেখ্স্না’নি?” – বাক্যটি উচ্চারিত হওয়ামাত্র -আমি,
রাহুল, দেবর্ষি, অরূপ দাশ, পঙ্কজ দাশ, অয়ন, জয়দীপ বণিক, আর … ঠিক মনে পড়ছেনা … প্রত্যেকের
মুখে এবং পেটে হাসির হুলুস্থুল গুড় গুড় করেই আবার তলপেটে চালান। হাসলে উপায় নেই। অতএব
হজম করো।
যদিও কলেজে উঠেই, রঞ্জিত দাশ স্যারের ভাষায়,
“প্রেমময়” পুরুষ হয়ে গেছি, যদিও সিগারেট টান্তে
শিখেছি সেই সাতের কেলাস থেকে, যদিও কলেজ ইলেক্শানে দাঁড়ানোর
তোড়জোড় গিয়েছে আরম্ভ হয়ে –তথাপি স্যারের হোম্টাস্ক মিস্ করবার সাহস ছিলনা।
কিন্তু আমাদের ভাগ্য মন্দ। ছ’মাস না যেতেই স্যারের ঐ চর্মরোগের প্রকোপ এমনই বেড়ে
গেলো যে স্যারকে কলকাতা চলে যেতে হলো চিকিৎসাহেতু। কবে ফিরবেন ঠিক নেই। আমাদের বলে
গেলেন যদ্দিন স্যার আসছেন না তদ্দিন উমেশ দাশের কাছে অঙ্ক আর ফিজিক্স্ পড়তে।
সহপাঠীরা প্রায় সক্কলেই গিয়ে
ফিড়ে নাড়া বাঁধলো উমেশ দাশের কাছে। একমাত্র আমি বাদে। আমি বাদে –কেননা উমেশ দাশ’কে
“শিক্ষক” তায় পদার্থ বিদ্যা আর অঙ্কের মতো দুটি গুরুতর বিষয়ের অধ্যাপক বলে আমি
ভাবতেই পারতাম না তাঁর ধর্মেন্দ্রকাট্ চুল, জিতেন্দ্রকাট্ বিট্ল্স্ জুতো আর মিঠুনের কায়দায় শাদাশার্ট-শাদা
প্যান্টের বহর দেখে। কলেজে, তাঁর পিরিয়ডেও সাকুল্যে হাজির
ছিলাম দুদিন কি তিনদিন। এরমধ্যে দুদিনই তাঁর সাধের সাদাশার্ট-শাদাপ্যান্টের
উইনিফর্মে কলম দিয়ে দিয়েছিলাম কালি ছিঁটিয়ে। কয়েকদিন তাঁর ক্লাশ ও প্রাক্টিক্যাল্
পিরিয়ডে ফেরার থেকে অবশ্য আত্মসমর্পণ করেছিলাম এবং প্রায় রাজা পুরুর মতোই বলেছিলাম
...
না,
অমিতাভ চৌধুরি স্যারের পরিবর্তে উমেশবাবুর কাছে যাওয়ার কথা আমি
ভাবতেও পারলাম না। বাবাকে বীরদর্পে জানান দিলামঃ ‘নিজে পড়বো। নিজে নিজে পড়বো’।
৩। “গন্ধে উদাস হাওয়ার
মতো”
ঘোষনা তো করলাম “নিজে পড়বো।
নিজে নিজে পড়বো” কিন্তু তখন চলছে জীবনের সেই ‘সবুজ-করুণ’ অধ্যায়
যখন বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার মতন গান, মূলতঃ রবীন্দ্রসঙ্গীত ঢুকে পরছে অস্তিত্বের আনাচে
কানাচে। প্রথমবারের মতো নিজের গহনে জেগে উঠছে আরেক ‘আমি’ ... সেই ‘আমি’র অতলে
মুহুর্মুহু ভাংছে,গড়ছে আরেক পৃথিবী। সেই আরেক পৃথিবীর আরেক আলোয়, আরেক অন্ধকারে নতুন
অবয়ব নিয়ে জেগে উঠছে মফস্বলের প্রতিটি নদী-নালা-খাল-বিল-ইস্কুলঘর-বাঁশঝাড়-প্রতিটি চেনামুখ-অচেনা
মেঘমালা ... ক্লাশের টানে, পাঠের টানে নয় – কলেজে যাওয়া তখন কলেজেরি
টানে। সন্তর বাজার পার হয়ে খানিক এগিয়ে গিয়ে গঙ্গা ভান্ডার নামের দোকান। সামনে
একফালি জায়গা তবু সব “বিরাট” জনসভা ঐ গঙ্গা ভান্ডারের সম্মুখস্থ প্রাঙ্গনেই।
আরেকটু এগিয়ে গিয়েই দুই বোন। রাধা-দুর্গা। রাধায় যদি নুন্ শো’তে “জংলী জওয়ানী” তো
দুর্গায়, ম্যাটিনীতে “কম্সীন্ কলি”। এদের মুখোমুখি উঁচু
দেওয়াল। ফটকের দুদিকে দুই বিরাট উঁচু নারকোল গাছ। ডানদিকে হেঁটে গেলে এক তলায়
পরীরা। গার্লস্ কমন্রুম। বাঁদিকে, সোজা এগোলে, অডিটোরিয়াম। আর প্রহরীস্বরূপ দুই নারকোল গাছের নীচ বরাবর সোজা এগিয়ে গেলে
মাথাত উপরে খোদাই করা “শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানম্”। কমার্স বিল্ডিং। পেরিয়ে,
সোজা হাঁটলে বারো কেলাসের সাইন্সের কোঠা। টানা বারান্দা সামনে। এক
প্রান্তে প্রিন্সিপ্যাল্ রুম, আরেক প্রান্তে নির্ধনদার
ল্যাবরেটরী। অর্থাৎ কেমিষ্ট্রির ল্যাবরেটরী। তবে যতো বড়ো কেমিষ্টই তুমি হও না কেন
ঐ পিওন নির্ধনদা ছাড়া গতি নেই। ফাইন্যালে কার ভাগ্যে কোন্ সল্ট্ রোল নাম্বার
জেনে, কড়কড়ে দশটাকা নিয়ে জানিয়ে যাবে নির্ধনদা’ই।
প্রিন্সিপ্যাল-কোঠা পার হয়ে বাঁ দিকে গেলে আর্টস্ বিল্ডিং। দোতলা।
চারটি কিশোরী তার অধীশ্বরী। তনুশ্রী দত্ত, দুই মৌসুমী আর
কামালুদ্দিন স্যারের মেয়ে...
প্রিন্সিপ্যাল-কোঠা পার হয়ে ডান
দিকে গেলে বোটানি ডিপার্টমেন্ট। ফিজিক্স ল্যাব্। পেছনে ধু ধু পুকুর। ঐ পাড়ে
ছাত্রাবাস। কুমারেশদা, পবিত্রদা
–গাঁজার আসর। ওই পুকুরপাড়ে, গাছতলায় বসে বেসুরো কন্ঠে
রবীন্দ্রগান গাইতে গাইতে অবলীলায় ক্লাসের পর ক্লাস পার করে দেওয়া – সকালের নীল
রঙের আকাশ দুপুরে রং পাল্টে গন্,গনে, পোড়া
পোড়া। এক সময় সামান্য ধূসর। তারপরে বিকালের নেমে আসা... আহ্ দিনগুলি,
সেই দিনগুলি ... সেই যেখানে জীবনের সমস্ত শরৎকাল শিউলী হয়ে আজো ছড়িয়ে রয়েছে ঘাসে ঘাসে
...
আর ছিল এক ফিলিপ্স রেডিও আর ছিল এক গীতবিতান।
রেডিও শুনে আর গীতবিতান। পরে এসেছিল একটা টেপ্ রেকর্ডার। “গীতবিতান” খুলে দিয়েছিল
এক অন্য পৃথিবী। নিয়ে গিয়েছিল এমনই এক ঘোরের মধ্যে যে,সহপাঠীরা যখন খাতার প্রথম পাতায়
লিখে রাখতো ‘সরস্বতৈঃ নমহ্’ আমি তখন লিখে রাখছি ‘পথ হতে আমি গাঁথিয়া এনেছি সিক্ত যূঁথীর
মালা, সকরুণ নিবেদনের গন্ধ ঢালা’... ‘এই দুয়ার দেওয়া ঘরে কভু আঁধার নাহি সড়ে, তবু আছো
তারই প’রে, ও মোর দরদীয়া’... লিখে রাখতাম ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে যাহা কিছু সব আছে
আছে আছে’... কে পূর্ণ, কি পূর্ণ, কোন্ অন্তবিহীন পথ পাড়ি দিয়ে কে চলেছে কোথায় সেই
সব প্রশ্নে যে আলোড়ন তখন উঠেছিল মনে সে অবশ্যই নয় ‘দার্শনিক অন্বেষা’ তবুও কোথায়
যেন নিজের মধ্যে জাগতো এক অপূর্ণতার বোধ যা আশ্রয় খুঁজতো ঐ গানে, ঐ সুরে ...
অতএব
অমিতাভ চৌধুরি স্যারের অনুপস্থিতির সুযোগে সেই আকাশ, বাতাস, ঘোষ ডায়রী, যশোদা, অশোকা
রেস্টোরেন্ট, বাজারের বাইরে পলানের বীয়ারের দোকান, বাজারে নেমেই হাতের ডান দিকে বাঁশের
বেড়া দেওয়া, ঝাঁপ টানা স্বদেশী, বিদেশী মদের দোকান, কলেজের ফিজিক্স্ লেবরেটরীর পেছনের
পুকুরধার, সহপাঠিনীদের স্তনের ভাঁজ, চোখের সঙ্গীতে নিজেকে দিলাম পুরোপুরি বিলীন করে।
সাইকেলে চেপে ঘুড়ে বেড়াই শহরের এই মাথা থেকে ঐ মাথা। এইতো আরশোলা-পাখির মতন এক শহর
তারি অলী-গলী-রেল লাইন, ছোটো দোকান, বড়ো দোকান, মাঝারি পার্ক, দুই শ্মশান, দুই নদী,
নালা নর্দমা, থানার টিলা, টিলার উপরে সরকারি গেস্ট হাউস, ওল্ড মিশন রোডের শেষ প্রান্তে
পুরোনো মিশনের ভাঙ্গা দেওয়াল – এই সব দেখে দেখে, দেখে দেখে আশ মেটেনা – তখনো, হায়,
এখনো…
এমনি করে ভোলানাথের ষাঁড়ের মতো সাইকেলে
শহর চষে বেড়ানোর এক বিকেলে হঠাৎই শুনলাম এক কন্ঠঃ “অরেবা, সাইকেলখান্ এট্টু থামাও
চাইন…” পরিচিত কন্ঠ। প্রিয় কন্ঠ।
৪। স্যার, রঞ্জিত দাস
পর্ব -১।
ব্রেক্ কষলাম। সাইকেল থামলো।
রাস্তার বাঁদিকে। ফুটপাথ। কৃষ্ণা স্টোর্স। রিক্সায় স্যার। রঞ্জিত দাস। তিনিও
অমিতাভ চৌধুরি স্যারের মতনই। বেঁটে খাটো। তবে ইন্দ্রলুপ্ত নন। চোখে তাঁরও চশমা।
ইনিও এক কালের নামী ছাত্র। অত্যন্ত নামী ও সফল শিক্ষক। মূলতঃ অঙ্কের। শো দেড়শোর
বেশী ছেলেমেয়ে তাঁর ছাত্র। এই শো দেড়শো’র অন্ততঃ আশি জনকে তিনি পড়ান বিনা বেতনে।
অন্ততঃ তিরিশজন বাড়ি থেকে “স্যারের বেতন দেবো” বলে পয়সা এনে এক মাসে দেয় দুমাস
দেয়না। অশোকা,যশোদা,রাধা,দুর্গা বা পলানের সম্মানে ব্যয় করে সেই পয়সা।
“অমিতাভবাবু তো অসুস্থ। তুমার
অইন্য বন্ধুরাত উমেশের কাসে যায়। তুমি কিতা কর? চব্বিশ ঘন্টা ত পুকুর পাড়ো আর নাইলে সাইকেলোই দেখি ...”
“ না, মানে, স্যার, আমি...”
“তুমি কিতা? মহানায়ক উত্তম কুমার নি?”
“না স্যার, মানে, আমিও পড়ি...”
“ও। ভালা। শুনো, সামনের সোমবার থেকিয়া সোম,বুধ,শুক্র আমার কাসে আইয়া পড়বায়। তুমার
বন্ধু-বান্ধবীরা আমার ইনোও আসইন। আমি সুকেশবাবুরে কইয়া দিমু...”
-তারপরেও জীবনে নানান
শিক্ষকজনের ছায়াতলে এসেছি। কিন্তু এমনটি কি দেখেছি আর? দেখবো আর? –একটা ছেলে
বাউন্ডুলের মতো ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। তাকে ডেকে নিয়ে পড়ানো! হায়! দ্রোণ কতো বিরাট আচার্য?
অন্তিমে কুরু বংশের কেনা গোলাম। এই আচার্য্য, এই
রঞ্জিত দাস, এই অমিতাভ চৌধুরি, এই
রাধিকা রঞ্জন চক্রবর্তী আমাকে পড়াননি প্রণামীর বিনিময়ে কিংবা দ্রোণের মতো
গুরুদক্ষিণা চাওয়ার ছলে শোধ তুলে নিতে চাননি কোনো গান্ধাররাজের উপরে ...
মনেপড়ে শিবানী ম্যাডামের কথা।
এডিশনের ম্যাথ্স্’এ এব্স্ট্রাক্ট এল্জাব্রা পড়াতেন। টেস্ট পরীক্ষার আগে
দেখলাম সেট্ থিয়োরিএ এক চতুর্থাংশ বড়জোর পড়েছি অথচ ম্যাডাম ক্লাশে সবই পড়িয়েছেন। শরণাপন্ন
হলাম ম্যাডামের। অবশ্যই বাবারও ভূমিকা ছিল এখানে। কিন্তু যে স্নেহে, যে যত্নে তিনি আমাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে
পড়িয়েছিলেন হপ্তা তিন... হায়! এই ঋণ শোধ করা যায়না কোনো গান্ধাররাজকে যুদ্ধে
হারিয়ে, বন্দী করে এনে ...
পরদিন বিকেলে, কলেজ থেকে ফিরে বাবাও জানান দিলঃ “সোমবার
থেইক্যা রঞ্জিতবাবুর বাসাত পড়াত্ যাইবায়”। বাবার জানান দেওয়ার প্রয়োজন অবশ্য
ছিলোনা। স্যারের আদেশই যথেষ্ট ছিল পরের সোমবার থেকে তাঁর বাড়িতে হাজিরা দেওয়ার
জন্যে।
৫। নটীকথা
কোনো বড়লোক, মানে পয়সাওলা লোক দূর দেশ থেকে আনাচ্ছিলেন
এক নর্তকীকে তাঁর নতুন নাচঘর নেচে উদ্বোধন করবার জন্য।
বর্ষার সময়। নৌকা আসছিল বড় নদী
কুশিয়ারা হয়ে। মাস খানেকে নোকা যখন ভিড়লো ঘাটে তখন নর্তকী নারাজ মাটিতে পা রাখতে।
জনে ভাসতে ভাসতে তখন তার জলের নেশা গিয়েছে ধরে। “হয় নাচঘর অব্দি নৌকায় যাবো নয়তো
ফিরে যাবো”। বায়না সুন্দরীর। এদিকে পাঁজি দেখে, পুঁথি দেখে দিনক্ষণ ঠিক হয়ে আছে নাচঘর উদ্বোধনের। বাবু পড়েছেন ফাঁপরে। কি
যায় করা? নৌকায় উঠে হাতে ধরছেন সুন্দরীর, পায়ে পড়ছেন সুন্দরীর। তোফা দিচ্ছেন। মোহর দিচ্ছেন। লিখে দিতে যাচ্ছেন ঘর
গেরস্থির কাগজ। কিন্তু সুন্দরী নারাজ। তার এক কথাঃ “হয় নাচঘর অব্দি নৌকায় যাবো
নয়তো ফিরে যাবো” –
বাবু যখন একান্ত নিরুপায় হয়ে
প্রায় ঝাঁপ দেন কুশিয়ারার জলে তখন এক জোয়ান মদ্দ এসে হাজির। সে বল্লো “উপায় করে
দিতে পারি। কিন্তু শর্ত আছে”।
“বাবা, মাথা খাও, যা ইচ্ছে
তা’ই নাও। বলো কি উপায়?”
“রাতারাতি খাল কেটে নৌকা নিয়ে
যাবো আপনার নাচঘরে”
“পারবে?”
“নিচ্চয় পারবো। না পারলে কান
কাটবেন। তবে –“
“তবে আপনাত নটীর সঙ্গে এখন
একবার দেখা করবো আর পরে এক রাত ...”
বাবুর বুক ফাটলো। তবু বল্লেন
“দেখা’ত নাহয় এখন করিয়ে দিলাম। কিন্তু পরে...ও রাজি না হলে... মানে, খুব জিদ্দি মেয়েলোক কি’না।।দেখতেই ত
পাচ্ছ...”
“হক্ কথা। আমিও জোর কিছু করবো
না। এখন তো দেখাটা দিন করিয়ে...”
দেখা হলো। কি যে কথা হলো, কি যে ঘটলো জানলোনা কেউ। ঘন্টার মধ্যে
হাজার লোক লেগে পড়লো খাল কাটার কাজে। পরদিন ভোরের মধ্যে খাল একে, নাচতে নাচতে হাজির হলো বাবুর নাচঘরে। সারারাত জেগে জেগে পরশ্রান্ত বাবু
যেন নতুন জওয়ানী পেয়ে উঠে এলেন। “কি গো সুন্দরী, কই গো
সুন্দরী...”
সাড়া নেই। কোথায় সুন্দরী।
দেখাগেলো দাসীগুলি ঘুমে অচেতন। সুন্দরীর খাঁচা খানি। পক্ষী নেই। নেই ঐ খাল কাটার
দায় মাথায় নেওয়া জোয়ান ছোকড়াও...
নটী গেলো। বাবুও গেলেন। কিন্তু
রয়ে গেলো এই খাল। নটী খাল-
শহরের দুই প্রান্তে দুই নদী আর
শহরের কিনার দিয়ে, রেল লাইনের
কিনারে কিনারে ধাবিত টেলিগ্রাফের তারের মতো, খাল। নটী খাল।
এর নামের ইতিহাস পন্ডিতদের হয়তো অজানা নয়, হয়তো একটু পড়েটড়ে
নিলেও আমিও জানতে পারবো। কিন্তু আমি সে ধার ধারিনা। আমি ঐ নামকে ঘিরে নিজেই বানাই
ইতিহাস। আঁকি ঐ রঙ্গিনী ছবি, ওই বাবুর কায়দা কেতা, ঐ অচেনা যুবকের পরিচয়লিপি ...
ঐ নটী
খালের ধারেই বাড়ি। ভোর ভোর উঠে মা’র করে দেওয়া হর্লিক্স না’কি বর্নভিটা খেয়ে
সাইকেল নিয়ে নামি রাস্তায়। বড় রাস্তা ধরে যাই ঐ “কাল্ভার্ট” অব্দি যেখানে নটী
খালেরো বুক থেকে একটি নালা কেটে নিয়ে ফেলা হয়েছে ভুক্কুরের কচু ক্ষেতে, উমেশ শ্যামের, কালা মিয়ার ধান ক্ষেতে। ঐ খানেই
মুখোমুখি দোকান – মণীন্দ্রমাজন আর সুভাষের। সুভাষের দোকানের কিনার বরাবর ঐ নালা।
নালার কিনারে রাস্তা। কাঁচা। বেঁকে গিয়ে ভুক্কুরের কচুক্ষেত, ধান ক্ষেত। পারাপারহীন জলা। লোকে বলে সরল খাঁ’র দিঘি। কিনারেই সরল খাঁ’র
কবর। বাঁশ ঝাড়। টিলা। হাট্মেন্ট রোড। আবার বড় রাস্তা। বাজার। বাজারের উল্টোদিকের
পাকা রাস্তা ধরে যেতে থাকলে শহর ফুরিয়ে ফিয়ে আসে টিল্লা বাজার। ‘বডার’। আর ঐ অতোদূর
না গিয়ে ডাইনে ঘুড়লেই স্যারের, রঞ্জিত দাসের বাড়ি। - অর্থাৎ
মফস্বলেরো শহরতলী আরম্ভ হয়ে যায় খানিক পরেই।
স্যারের বাড়িতে ঢোকার আগে চলে
যাই কাছের শ্মশানে। আমি, সুমন, দেবর্ষি। সৌমিত্র যদিও কমার্সে, যদিও তখন তার বিনয়
সেন স্যারের বাড়ি গিয়ে বুক্ কিপিং পাঠ নেওয়ার কথা, তথাপি
সাইকেল নিয়ে সে’ও এসে জোটে শ্মশানে। আসে ভবতোষও। সে’ও কমার্সে। তারও যাওয়ার কথা
বিনয় সেন স্যারের বাড়িতে। সংগ্রহে থাকলে একটু গাঁজাও টেনে নিই সিগারেটের সঙ্গে।
ভবতোষ নেশা করেনা। আড্ডা মারে। তারপরে রমনী রোডের এক দোকানে চা খেয়ে অঙ্ক শিখতে
আমরা যাই স্যারের বাড়িতে। সৌমিত্র আর ভব যায় বিনয় সেনের বাড়ি।
৬। স্যার, রঞ্জিত দাস
পর্ব ২।
“রেইট্ অফ্ চেইঞ্জ অফ
মোমেন্টাম ইজ্...” – ক্যাল্কুলাস থেকে ডিনামিক্স, ডিনামিক্স থেকে মোশন্ অফ্ পেন্ডুলাম...ডেফিনিট্ ইন্টিগ্র্যাল ... আসলে
অঙ্ক জিনিসটা স্যার ভালবাসতেন গানের মতন, সেতার, সরোদ, ভায়োলিনের মতন। কবিতার মতন। প্রতিদিনই বোর্ডে
অঙ্ক করতে করতে হারিয়ে যেতেন নিজেই। নিজের সঙ্গে কথা বলতেন। নিজে নিজে কথা বলতেন।
আশ্চর্য হয়ে দেখতাম সেই অঙ্ক করা। এ’ও যেন অমিতাভ চৌধুরি স্যারের সিগারেট
জ্বেয়ালানোর মতো এক থ্রীলার। দেখতাম। মুগ্ধ হতাম কিন্তু হাতের কলম চলতোনা। সময় বয়ে
যেতো। মাথায় এসে ভিড় করতো নানা রাজ্যের চিন্তা, কল্পনা,
কবিতা ...
মস্ত কোঠায় বড় বড় তিনটে আর ছোট
দুটো টেবিল। একটা কাঠের কালোবোর্ড। অমিতাভ চৌধুরি স্যারের বাড়িতে আমাদের সঙ্গে
কোনো মেয়ে পড়তোনা। কিন্তু রঞ্জিত দাস স্যারের বাড়িতে – কারা ছিল? “কি? ভালো?” -
অন্তরা সেন, রাখী – যা’কে আমরা পিসী বলে
ডাকতাম আমাদের সহপাঠী সুশান্তর সে সম্পর্কে পিসী হওয়ার দরুন, ছিল রানী –রোশেনারা, বিশ্ববরা – বিশাল চশমা। বনানীও
ছিল কি? উৎপলা? রাজশ্রী ছিল বোধহয়।
পূরবী দত্ত? আর পূরবীর সঙ্গে থাকা ঐ সীনা নামের মেয়েটা?
ছেলেদের মধ্যে দেবর্ষি, পরিতোষ, সুমন, দেবদত্ত...বদরপুর থেকে এসে হোস্টেলে থে পড়া
আরো কয়েকজন। সামসুদ্দিন আর তাজুদ্দিনও ছিল মনেহয়।
যদিও একমাত্র রানীর প্রতি
দেবর্ষির নিয়ম মাফিক দূর্বলতা ও নিয়মিত প্রেম নিবেদন ও রানীর সেসব ঠাট্টা
ইয়ার্কীতে উড়িয়ে দেওয়া ভিন্ন তেমন কোনো “এডাল্ট কন্টেন্ট” ছিলনা তথাপি মেয়েদের
সাধারন উপস্থিতির উত্তেজনা দানা বাঁধতো অবশ্যই।
রঞ্জিত দাস স্যার সিগারেট খেতেন
না। জনতা হোটেলে তাঁদের একটা আসর ছিল। তাতে মদ্যপান ও জুয়া খেলা হতো। অমিতাভ
চৌধুরি স্যারেরও যাওয়া আসা ছিল জনতা হোটেলে। রঞ্জিত দাস স্যার নিতেন নস্যি।
স্যারের দেখাদেখি একদিন আমি আর সুমন চেষ্টা নিয়েছিলাম। তবে সফল হইনি। অঙ্কে নিমগ্ন
স্যার আমাদের হাঁচি-কাশি মিশ্রিত আওয়াজে পিছন ফিরে তাকিয়েই বুঝে নিলেন ব্যাপার।
ডাকলেন “হ্যালো, ও হ্যালো,
হ্যালো ...”
পর্দা সড়িয়ে এলেন স্যারের
স্ত্রী। তিনিও অঙ্কের শিক্ষিকা। মদন মোহন মাধব চরণ উচ্চতর বালিকা বিদ্যালয়ের। ইনি
ছিলেন স্যারেরি সহপাঠিনী। সেই থেকেই প্রেম দুজনের। স্যার চান্স পেয়েছিলেন খড়্গপুর(?) আই আই টি’তে। গিয়েওছিলেন শুনেছি। কিন্তু
ছয় মাসের মধ্যে করিমগঞ্জ ফিরে এসেছিলেন এই “হ্যালো”র টানে...
“ইতা দুগুরে ভিত্রর বাথরুম টা
দেকাই দেও। ইতা মনোকরসইন নইস্য লইলেউ অরঞ্জিত দাস হই যাইবা...”
স্যার অঙ্কের পরে অঙ্ক করে
যাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে এটা সেটা বোঝাচ্ছেন। প্রশ্ন করছেন। সময় বয়ে যাচ্ছে। আমার খায়
আঁচড়ও পড়ছেনা। যদিবা পড়ছে তবে তা কোনো সহপাঠিনীকে অংকনের চেষ্টারেখা নতুবা কাব্য
প্রচেষ্টা। হ্যাঁ, আমার প্রথম
লেখা দীর্ঘ কবিতা “তমাল, তোমার মতো”র জন্ম রঞ্জিত স্যারের
বাড়িতে বসেই –
স্যারের অঙ্কপ্রেম, জটিল সব অঙ্ককে সমাধান করবার কায়দা –আমাকে
মুগ্ধ করতো ঠিকই কিন্তু না’ত সে অঙ্ক আমি খাতায় তুলে আনতাম, না’ত
পরে নিজে করে দেখবার চেষ্টা নিতাম। সুতরাং যা দাঁড়াচ্ছিল তা এই, যে, স্যার টেরও পাচ্ছিলেন না আমি যে আসলে শিখছিনা
কিছুই। স্যার যখন টের পেলেন তখন আর ফেরার উপায় থাকতোনা যদিনা –
যদিনা প্রবেশ করতো আরেকটি
চরিত্র...
সেই চরিত্রটির কাহনে যাওয়ার আগে
শুধু বলে নিই,যে, পরবর্তীতে
আমার সঙ্গে আমার যতো শিক্ষকজনেরি দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে প্রায় প্রত্যেকেরি, প্রতিবারই মূল কৌতুহল এবং প্রশ্ন ছিল – চাকরী, বেতন,
উন্নতি –ইত্যাদিকে ঘিরেই। একমাত্র এই স্যার, রঞ্জিত
দাস, দেখা হলেই বলতেনঃ “নতুন কিতা লেখলায় বা? হদিন তুমার কবিতা পড়লাম অমুক পত্রিকাত। নূতন কিচ্ছু লেখলে ফড়াইয়া যাইয়...”
বলতেন “লেখা লেখিটা ছাড়িও না। ইটায় তুমারে যে শক্তি দিবো আর কিচ্ছুয়ে দিতোনায়...”
– একই কথা বলতেন স্যার দেবব্রত সোমও। রমাপদ ভট্টাচার্য্যও। - হ্যাঁ, এই যে আমার অক্ষর প্রচেষ্টা, এতাবৎ, এই প্রাণান্তকর চাকরি, এই গেরস্থালী, এই প্রবাস সত্ত্বেও – স্যার, এই আমার সামান্য
গুরুদক্ষিণা – আপনাদের স্নেহের, ভালবাসার, আশীর্বাদের...
৭। রাজাদার পুনঃপ্রবেশ
১ম পর্ব।
রাজাদার প্রবেশ ঘটেছিল অনেক
আগেই। আমার সেই ক্লাস এইট্ নাইনে পড়ার আমল থেকেই।
আমাদের বাড়ির পরেই বাড়িই
রাজাদার। রাজাদার বাবাকে আমরা ডাকতাম জেঠু। বাবার সহকর্মী। করিমগঞ্জ কলেজে বোটানির
হেড্। আরো ছোটো বয়সে রাজাদাদের বাড়ির সামনের পাকা উঠানে রাজাদা’র সঙ্গে ক্রিকেট
টিকেট খেল্লেও রাজাদার সঙ্গে একটা দূরত্ব ছিল। সেই দূরত্ব ভেঙে গেলো রাজাদার
ছোটোবোন মিঠুয়াদির বিয়ের সময়। আমি ক্লাস নাইনে বা টেনে পড়ি তখন। রাজাদা শিলচর আর ই
সি’তে। ফার্স্ট ইয়ার? সেকেন্ড ইয়ার?
মনে করতে পারছিনা। মিঠুয়াদির বিয়ের সময় ওর সঙ্গে বাজারে যাওয়ার
ছবিগুলি মনে আছে। ওর হাতে লিস্টি আর আমি একধারসে বক বক করে চলেছি। প্রফেসর শঙ্কু,
ফেলুদা, কিরীটী রায় থেকে শার্লক হোম্স্,
দিলীপ পাল স্যারের বাড়ির কথা থেকে দেবব্রত সোমের বাড়ির গল্প,
আমার তৎকালীন – তৎকাল থেকে প্রায় বারো কেলাসের শেষ
অব্দি-“স্বপনচারিণী”র কথা ... বাজার করার ব্যস্ততা ও হুঁশিয়ারির মধ্যেও আমার কথায়
সাড়া দিয়েগেছে রাজাদা অক্লান্ত...
এর পরে যে ছবিগুলি ভাসছে চোখে
তা দুপুরের। হোস্টেল থেকে ছুটিতে এসেছে রাজাদা। আমারও গ্রীষ্মের ছুটি বা মেট্রিকের
টেস্টের পরের সময়টা। দুপুর বই খাতা বগলে নিয়ে রাজাদার বাড়ি। কখনো সংস্কৃত ট্রেন্শ্লেশান
দিচ্ছে। কখনো অঙ্ক বুঝিয়ে করিয়ে দিচ্ছে। দিচ্ছে সদ্য পড়া গল্পের বইও। মনের আছে সেই
সময় থেকে অনেকটা সময় জুড়ে কালকূট আর সমরেশ বসু ভর করেছিলেন আমাদের দুজনকেই। ওই
ভাবেই আমার হয়েপড়া সুবিনয় রায়ের মুগ্ধ শ্রোতা ...
ছুটি শেষে রাজাদার হোস্টেলে
ফেরার দিন যতো এগিয়ে আসতো ততোই মন খারাপ। কিন্তু সেই মন খারাপ প্রকাশ করা যেহেতু
পৌরুষের কথা নয় তা’ই চাপাই থাকতো সেসব আমার মনে। যাওয়ার দিন “চলো রিক্সা পাওয়া পর্যন্ত
তোমার সঙ্গে যাই” বলে হাঁটতাম যতোটা পারা যায়। একবার বাস স্টান্ড অব্দি আর রিক্সা
পাওয়াই গেলোনা। বাসের টিকিট কেটে এসে রাজাদা বল্লো “কি করে ফিরবি? এ’টা রাখ। রিক্সা করে চলে যা-“ একটা পাঁচ
টাকার নোট। তখন বাস স্টেন্ড থেকে আমাদের বাড়ি অব্দি তিন টাকা ছিল ভাড়া। দুটাকা
ফাউ। রাজাদার বাস ছেড়ে দিলে আমি দুটাকায় এক প্যাকেট চারমিনার কিনে কাতি তিনটাকা
পরের চারমনার-প্যাকেটের নিমিত্ত গাঁটে রেখে পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে। তবে গোটা গোটা
চারমিনার টানার আহ্লাদও রাজাদা’র হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার মন খারাপের কাছে হেরে
গিয়েছিল...
কাজেই বারো কেলাসে রাজাদা যখন
বল্লো “আমিই তোকে পড়াবো” তখন তা “রাজাদার প্রবেশ” না বলে পুনঃ প্রবেশই বলা উচিৎ।
৮। রাজাদা,দ্রোণ,একলব্য এবং ...
হপ্তায়, দু হপ্তায় শনিবার-রবিবারে হোস্টেল থেকে
বাড়ি আসতো রাজাদা। কখনো সঙ্গে আসতো নতুন ক্যাসেট। পন্ডিত ভীমসেন যোশি, পন্ডিত রবিশংকর আর সুবিনয় রায়, সুচিত্রা মিত্র –
মূলতঃ। কখনো আসতো বই। সমরেশ বসু’র ‘গঙ্গা’, ‘টানাপোড়েন’ ...
‘টানাপোড়েন’ রাজাদার কাছ থেকে নিয়ে পড়া হলেও এই বই সংগ্রহ করেছিল অভিজিৎদা। অভিজিৎ
চক্রবর্তী। “আসে নি ফুরান্ বই খাতা কাগজ” ডাকা মানুষদের কাছ থেকে অভিজিৎদা কিনে
নিতো পাতা হলদে হয়ে যাওয়া পূজো সংখ্যা, মোটামোটি আস্ত আছে –
এরকম বই। এই ‘টানাপোড়েন’ সেভাবেই সংগৃহিত। অভিজিৎদার সঙ্গে পরিচয়ের আগেই তার
সংগ্রহের বহু “পুরোনো” বই রাজাদার হাত হয়ে এসেছে আমার কাছে। তারপরে সবই যে
স্বস্থানে ফেরৎ গেছে তেমন নয়। -ওই সময়ে পড়া সমরেশ বসু’র লেখাগুলির মধ্যে, এখন, “পুনর্যাত্রা” ছাড়া, অন্য
কোনোটিই আর তেমন মনে পড়েনা ...
রাজাদার সঙ্গে আসতো আমন্ত্রণ
–আরেক জীবনের, আরেক চক্রবালের। সেই চক্রবাল
‘হোস্টেল জীবনের”। মশ্চক্ষে দেখতে পেতাম হোস্টেলে রাজাদার রুম্। আজব সব বন্ধুরা
তার – জিতেশ- জ্যাঠাভট্, রবিদ্যুতি বিশ্বাস, ধনু –কালাইন, পন্ডিত, শিতেনের
দোকান ... কয়েক বছর পরে, জয়েন্ট্ এন্ট্রান্সের ফলাফলে যখন
দেখা গেলো প্রাপ্ত নম্বরের খাতে অনেকেরই শিলচর আর ই সি ভিন্ন গতি নেই – তখন
মনিময়হেন উচ্চাভিলাষীরা মর্মাহত হয়েছিল আর আমি বেজায় খুশি হয়েছিলাম এই জন্যে,
যে, রাজাদা-জিতেশদা’র কলেজে – “পড়া” নয়,
থাকা যাবে। তার আগেই অবশ্য আমি শিলচর আর ই সি’তে কাটিয়ে এসেছিলাম
তেরাত্র। সে কাহিনী আসবে যথাস্থানে।
মনেপড়ে দাশ-মুখার্জীর ক্যাল্কুলাস
বইদুটি। অলোক চক্রবর্তীর ফিজিক্স্। দুই খন্ড। লাল কালোতে জেনারেল ফিজিক্স।
কমলা-কালোতে ইলেক্ট্রিসিটি ইত্যাদি। এল এম মিত্র’র কেমেস্ট্রি। হলুদ মলাটের
“ইন্টারমেডিয়েট ফিজিক্স্”। ...রাজাদা এলে
মদ-গাঁজায় ভাঁটা পরতো। সকাল
সকাল উঠেই “স্যারের বাড়ি যাচ্ছি” বলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যেতোনা। প্রাতঃরাশ
সেড়ে বসে থাকতাম “রাজা”- বলে ডাকটির জন্য।
সেই আমলে, জয়েন্ট্ এন্ট্রান্স্ এর ফিজিক্স
প্রশ্নপত্রের প্রথমেই থাকতো কিছু “রিজোনিং” – যেমন ঝুলন্ত পুলের উপর দিয়ে
মিলিটারিরা মার্চ্চ করে গেলে ব্রীজটি কখনো খুব জোরে দুলে ওঠে। কেন? – অত্যুৎসাহী কয়েকজন সহপাঠী এগারোতে পা রেখেই জোগাড় করে ফেলেছিল সেসব
প্রশ্নপত্র। আমার ব্যাটার কোর্স’ই শেষ করাতে গিয়ে হাবুডুবু খেতে হচ্ছিল রাজাদা’কে।
সুতরাং জয়েন্টের প্রশ্ন ফশ্ন দেখার ফুরসৎ ছিলনা।
পরে, যখন নিতান্তই দিতে হলো জয়েন্ট, তখন এদিক ওদিক থেকে কিছু প্রশ্নপত্রটত্র এনে দেখি – আর যা পারি না পারি ঐ
রিজোনিং স-ব আমার জানা। জানা –কেননা যখন পড়িয়েছে রাজাদা – গল্পচ্ছলে বলেগেছে ওই সব
– সাউন্ড পড়াতে ফিয়ে রেসোনেন্স্ প্রসঙ্গে ঐ পুলের দুলে ওঠা ... আরো কতো কি ...ঐ
বেসিক্ ফিজিক্সটা শিখিয়ে দেওয়ায়, পরে, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে নানা সাব্জেক্টে “কম্পার্ট” পেয়ে “খোপে খোপে থোরো
নলেজ” নিতে হলেও ফিজিক্সে কম্পার্ট লাগেনি। - মাত্র কয়েক বছর আগেই আবার বসেছিলাম
ফিজিক্স পড়তে – ফাইন্ম্যানের “সিক্স ইসি পীসেস্” আর “নট্ সো ইসি পীসেস্”।
-তখনো আবার আবিষ্কার করলাম রাজাদাকে। তার সেই পড়ানোকে ...
অনিতাভ চৌধুরি স্যার ফিরে এলেন, কিছুটা সুস্থ হয়ে, প্রায়
এক বৎসর পরে। তখন বারো কেলাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে
টেষ্ট পরীক্ষা। আমি যেহেতু তাঁর কথামতো উমেশ দাসের কাছে যাইনি পড়তে – সেই রাগে
কিংবা অভিমানে অন্য অনেককে ডেকে নিয়ে পড়াতে আরম্ভ করলেও আমাকে ডাকালেন না স্যার।
আমিও গেলাম না। কিন্তু ভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যক্রমে, টেস্টে,
আমার ফিজিক্স পেপার গিয়ে পড়ল স্যারের হাতেই। বাবা একদিন কলেজ ন্থেকে
ফিরে বল্লোঃ “রঞ্জুবাবুয়ে ত’রে তান্ বাসাত যাইতে কইসইন” ... একটু থেমে “ত’ত
ফিজিক্স পেপার তাইন দেখ্ সইন, খুব খুশি হইসইন। কইসইন কার
কাসে পড়ে? আমি কইসি বড় রাজার কাসে...” – বড় রাজা, রাজাদাও স্যারেরি ছাত্র এবং অতি প্রিয় ছাত্র। অতএব এই সাফল্য এক অর্থে
তাঁরই। -এখানেও মনে আসে আচার্য্য দ্রোণের কথা। এই স্থানে স্যার অমিতাভ চৌধুরি না
হয়ে দ্রোণ হলে সে যে কি গুরুদক্ষিণা চেয়ে বসতো এই একলব্যের কাছে – কেজানে। কিন্তু
যেহেতু স্যার অমিতাভ চৌধুরি দ্রোণ নন তাই দুদিন বাড়িতে ডেকে পড়ানেন আলাদা করে –
পড়ানেন ডায়োড্,ট্রায়োড্ - সি আর দাশগুপ্ত’র ফিজিক্স বই
থেকে ...
৯। বাড়িগুলি, সেই বাড়িগুলি এখন কোথায়? ...
জীবনানন্দ দাশের পংক্তি গুলি
মনে পড়ছেঃ
কার্তিকের ভোরবেলা কবে
চোখে মুখে চুলের ওপরে
যে শিশির ঝরল তা
শালিক ঝরাল বলে ঝরে
আমলকী গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিক
কার্তিকের রোদে আর জলে
আমারই হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর
মতন;
সূর্য? না কি সূর্যের চপ্পলে
পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে
পৃথিবীর থেকে উড়ে যায়
এ জীবনে ঢের শালিক দেখেছি
তবু সেই তিনজন শালিক কোথায়।
... এ জীবনে ঢের শালিক দেখেছি, তবু সেই তিনজন শালিক কোথায়?
আমি বলি, নিজ মনে প্রায়শই বলিঃ এ জীবনে ঢের বাড়ি,
লোকজন সবই ত’ দেখেছি, তবু সেই বাড়িগুলি
এখন কোথায়?
তবু সেই বাড়িগুলি এখন
কোথায়?... বাড়িগুলি, সেই
বাড়ি গুলি ... যে বাড়িগুলিতে অবলীলায় গেট্ খুলে ঢুকে গিয়ে, যখন
তখন, বলা যেতোঃ “নন্দাদি, খিদে
পেয়েছে...”, বসেপড়া যেতো আড্ডায়, থেকে
যাওয়া যেতো দিনের পরে দিন। হয়ে ওঠা যেতো ঐ বাড়ির মানুষ ...
এমন আশ্চর্য বাড়িগুলি সেই সময়েও
যে খুব বেশী সংখ্যায় ছিল তেমন নয়। কিন্তু আজ, এই সময়ে দাঁড়িয়ে মনেহয় ঐ রকম বাড়ি, ঐণ রকম মানুষ আর
নেই। থাকবেওনা আর ...
হে পথিক, তবু যদি কোনোদিন তুমি সন্ধান চাও, ঠিকানা চাও তাই বলছিঃ লঙ্গাই ব্রীজের থেকে নেমে সোজা, হাসপাতাল রোডের দিকে হাঁটতে থাকলে এক সময় তোমার হাতের বাঁদিকে আসবে
শ্রীভূমি পাঠশালা। তারপর হিমাংশু ধরের বাড়ি। সীমানা ঘিরে উঁচু উঁচু নারকোলের
পাহারা। আরেকটু এগিয়ে গেলে সেই নালা, নটীখাল থেকে জল বয়ে যাচ্ছে
ভুক্কুরের কচু ক্ষেতে। মুখোমুখি দোকান – ‘মরিন্ড মাজন’ আর বাবু সুভাষদা’র। আরো
কয়েক পা এগোলে ছোট মশজিদ। লাগোয়া গোরস্থান। উল্টোদিকে কস্মোপলিটান ক্লাবের মাঠ।
পূজো হতো। পূজোর পরে স্টেজ বেঁধে জলসা নাটক ...
না, আমাদের পাড়ার তৎকালীন ডাকসাইটে সুন্দরী
দিদিদের দেখে ঐ জলসাতেও তুমি দাঁড়িয়ে পড়োনা, হে পথিক,
সামনে ঐ “খুকনের দুকান”। এখানে এসে বাঁ দিকের বড় রাস্তাটি ধরো।
এগিয়ে যাও। হ্যাঁ, এগিয়ে যাও। কোনো ল্যান্ড্মার্ক লাগবে,
কোনো পিন্কোডও না। তুমি ঠিক চিনে নিতে পারবে বাড়িটা। চিনে নিতে
পারবে কেননা ঐ রকম বাড়ি আর নেই। কোথাও নেই। কোনোখানে নেই। নিচু তরজার বেড়ায় ঘেরা
উঠানে আলগা একটা কোঠা। একলা। একচালা। যাকে ঠাকুমা-দিদিমা’রা বলতেন “বাইর্বাড়ি”।
সেই “বাইরবাড়ি”র বাঁ দিক দিয়ে “ভিতরবাড়ি”তে যাওয়ার পথ।
ভিতর বাড়িতে ‘এল’ আকৃতির
বারান্দা। আলাদা ঠাকুরঘর। হাতের ডান দিকে। ভেতর বাড়ির পেছনে পুকুর। শ্যাওলা ঢাকা।
সুপারী গাছের অরণ্যহেন সমাবেশ। ছায়া। মাটি ভিজে। জংলী ঘাসে লতায় আমাজন। সুপুরী
গাছের শরীরেও শ্যাওলা। যেন শিলালিপি। ...বাসিন্দা কারা এ বাড়ির? নন্দাদি-ধর্মদা-তোপ্সে? মন্দাকিনীদি? টুসি-লুস্ত? ‘ধনমামা’? অভিজিৎদা? আমি?
রাজাদা? অন্তুদা? তনুদা?
নাকি সকলে, প্রত্যেকে?
সেই রাজাদারই সঙ্গে আমার এই
বাড়িটিতে প্রথম প্রবেশ। রাজাদা-অন্তুদা বন্ধু। অন্তুদা তখন চলেগেছে। পড়ছে
দুর্গাপুর আর ই সি’তে। নন্দাদি অন্তুদার দিদি। সব থেকে বড় দিদি। নন্দাদি-ধর্মদা’র
ছেলে তোপ্সে। তখন নিতান্ত শিশু। তখনো বেঁচে আছেন মেসো। মাসি’ও। অন্তুদা-নন্দাদির
বাবা-মা। অন্তুদা সবার ছোটো। বড় নন্তুদা, পান্তুদা, মান্তুদা। কেউই থাকেনা তখন করিমগঞ্জে।
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায়না। ওদের বন্ধুরা আসে। অদের সঙ্গে আসে বন্ধুর-বন্ধুরা।
আসে বন্ধুর-বন্ধুর-বন্ধুর... বন্ধুরা। আসে। এসে মিশে যায়, মিলে
যায় এই আজব বাড়ির আজব হট্টমেলায়। “নন্দাদি চা খাবো” , “নন্দাদি
খিদে পেয়েছে”, “নন্দাদি কাল আমার দিদিরা আসবে। বাড়িতে জায়গা
নেই আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই তোমাদের এখানে ঘুমাব” ... জায়গা, জ্যামিতির, ভূগোলের মাপে খুব ছিল কি ওই বাড়িটিতেও?
আসলে ছিলনা। যা ছিল তা মনের জায়গা। অনেক জায়গা। তাই যতো মানুষই আসুক
–জায়গার অভাব হয়নি কোনোদিন। লোকে বলতো ‘আচানি বাড়ি’। দিনে, রাত্রে
যে কোনো সময়েই না’কি দেখা যেতো ওই বাড়িতে কেউনা কেউ আচাচ্ছে। খাওয়া সেরে মুখ আচমন
করছে। আমিও কতোদিন, সারা শহর ঘুড়ে এক পেট ক্ষুধা নিয়ে হাজির
হয়েছি রাত্রি এগারোটায়। বাড়ি গেলে বকা খাবো। তাই এখানে খেয়ে দেয়ে গিয়ে বলবো
‘নন্দাদি’র বাড়িতে ছিলাম। সাত খুন মাফ হয়ে যাবে। অন্ততঃ নেশা করিনি –এটুকু বিশ্বাস
করবে মা,বাবা।
ছুটি ছাটায় এসে জড়ো হতো নন্তুদা
– সপরিবারে। ছোট্ট ছোট্ট দুটি পুতুল – পুঁচকি আর টুস্কি। পান্তুদা-মান্তুদা’র পরিবার
জোটেনি তখনো। সে এক মার্ মার্ কাট্ কাট্ ব্যাপার। আড্ডা,গান ... আহা, মান্তুদা’কে
কে এক বন্ধু একদিন সিগারেট অফার করলো। মান্তুদা গম্ভীর সুরে জানান দিলোঃ “ছেড়ে
দিয়েছি। ক্লাস ফোরে উঠে ছেড়ে দিয়েছি ...”
“মানে? যখন সবাই মা’র দুধ ছেড়ে বিড়ি সিগারেট ধরে
তখনই তুই ছেড়ে দিয়েছিস বিড়ি সিগারেট? তাহলে ধরলিটা কবে?”
“ওক্কে। তবে বলি শোন্...”
সেই বাইরবাড়ির চৌকিতে মৌজ করে
বসে বলতে আরম্ভ করে মান্তুদা-
১০। ‘এতক্ষণে অরিন্দম’
...
হয়,ইহা,শিয়ালের গু যাহা
দ্বারা গুড্ডির সূতার মাঞ্জা হয় দিগ্বিজয়ী। নিশ্চিত। সমস্যা এই যে কালা মিয়ার
হেমন্তক্ষেতে –কুকুরের গু, বন্টলার গু, ভট্টাচার্যের গু, নমশূদ্রের গু, তর্কালঙ্কারের গু, সাম্রাজ্যবাদীর গু, সামন্তবাদীর গু, সর্বহারা শ্রেণীর গু –ইত্যাদি
নানাবিধ গু হইতে, কিভাবে, দুগ্ধমিশ্রিত
অম্বু হইতে ক্ষীরের ন্যায়, তাহা আল্গাইয়া লওয়া? – হুঁ হুঁ বাবা, ধনমামা -মুখে মুখে ব্যাঘ্রের অন্ডাশয়
যতোই খন্ডিত করনা কেন , ঐ শিয়ালের গু আল্গাইয়া বাহির করিবার
পরম হংস ছিল এই শর্মাই কেবল।
(…সেই বাইরবাড়ির একচালা। দুই
প্রান্তে দুটি ঝুলন্ত বাল্ব। চল্লিশ ওয়াটের। সদর দরজাহাটখোলা। চৌকির উপরে বসে আছে
মান্তুদা। ধিরে আছি আমরা। আছেন ‘ধনমামা’। এ সম্বোধন নয়, এ নামও নয়,এ এক
উপাধি। উপাধি হাবলুদা’র, তার গালি গালাজের অপূর্ব ভান্ডারের সম্মানহেতু তাকে এই উপাধিটি দেওয়া হয়েছিল।
আসরে আমাদের কারো কোলে বা কাঁধে ঝুলে আছে পাঁচ বছরের তোপসেও…)
মাঠে যাইয়া প্রতিটি গু তেরো
সেকেন্ড শুঁকিয়াই – মা,
মাগো – অধমের দোষ নিয়োনা মা – বলিতে পারিতাম কোন্ গু শিয়ালের। হে
অর্বাচীনেরা, এইরূপ যাহার দক্ষতা, এইরূপ
হয় যে জহুরি, তাহাকেও, হায়, রাস্তা হইতে আধখাওয়া বিড়ি তুকাইয়া টানিতে হইত এবং ততোধিক অন্যায় ছিল এই,
যে, এই বুর্জোয়া সমাজবাসী, ফিউডাল ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী, কাঙাল ভারতবাসী – সর্ব প্রকার শ্রেণী বৈষম্য ভুলিয়া – এই সকল সমাচার বাড়ি
বহিয়া গিয়া দিয়া আসিত। কাহাকে? না, শ্রীল
শ্রীযুত শক্তিপদ চৌধুরিকে,যিনি, এই
মর্কটেরা জ্ঞাত আছে, যে, সপমর্কে আমার
পিতা।
সুতরাং তৃতীয় শ্রেণীতে পাঠরত এই
শিয়ালগু বিশেষজ্ঞকে নাকাল হইতে হইত-যদিবা শক্তিপদ চৌধুরির দ্বারা সরাসরি নহে – তবে
তাহার লাঠিয়াল নন্তুর দ্বারা। এই নন্তুও, হায়, হয় সেই শক্তিপদ চৌধুরিরই পুত্র এবং জ্যেষ্ঠ
পুত্র!
( গেইটের আওয়াজ হলো। কেউ ঢুকলো।
কে? দেখার দরকার নেই। যদি সে এই আসরের মেম্বার
হয় তো এখানে এসে জুটবে আর ‘সিনিয়র মেম্বার’ হলে ভিতরবাড়িতে যাবে –নন্দাদি,ধর্মদা,তনুদা’দের আসরে।
কিন্তু চরিত্রটি প্রবেশ করলো এই
আসরেই।)
“এ একটি অতি ডেঁপো ছোকরা। যে
যাইবেন, ইহার কান মলিয়া যাইবেন”। হায়,
এবম্বিধ সাম্রাজ্যবাদী ইস্তাহার ঝুলাইয়া আমাকে, পথিপার্শ্বে, লাইটপোষ্টে বাঁধিয়া রাখা হয়। তথাপি
মুক্তি পাইবামাত্র বিড়ি তুকাই হাগার কালো বিস্রা তুকানির মতো। তথাপি নিষ্কৃতি
দেয়না নাৎসী বাহিনীর চরেরা। কান ভাঙ্গায় – শক্তিপদ চৌধুরির, তাহার
লাঠিয়ালের। “হায় ধর্ম! একি সুকঠোর দন্ড তব...”
( শঙ্করদা’র ভাই মান্নাদা।
ইংলিশ মান্না। ‘নাইস্ টু লুক্ক্ ইউ অল্ ইন জয়্ মুড্।
কেউ জবাব না দেওয়ায় স্বগতোক্তিতে পরিণত হলো তার স্টার্টিং ডায়লগ।
সে’ও বসে পড়লো। চৌকিতে উঠে।
মান্তুদার পা ঠকে লেপটা টান্ দিয়ে বল্লোঃ একটু দেও, সো কোল্ড্ থিস্ ইয়ার’ ।।)
দিবারাত্রি গত হয়। কিশোরকুমার
গাহিয়া যান “আসেনা সূর্য হয়না সকাল জীবন আঁধারে মোর”... ধনমামা কন্ঠ মিলায় “কি
আশায় বাঁধি খেলাঘর...”
অবশেষে আসিল “সে এক দিন”। দশদিন
নহে। “দুনিয়া কাঁপানো একদিন”। অতি প্রত্যুষে আমার ডাক পড়িল পাক্ঘরে। তথায় দাদা
ছিল, দিদিও ছিল দন্ডায়মতী। কাঁচা মেঝেতে
ছিল বান্ডিল। এক, দুই, তিন – বান্ডিল।
নাসিরুদ্দিন। বিড়ি। ছিল এক বান্ডিল দিয়াশলাই ও। নিদ্রালু চক্ষে বুঝিবার চেষ্টা
নিলাম এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং আমার পিতা শক্তিপক চৌধুরি ও তাঁহার লাঠিয়ালবর্গ
কি চাহে। সম্মুখ সমর চাহে বীরচূড়ামনি? তবে কোথা রণ আহ্বান?
কোথা শস্ত্র? সকলেই ভেট্কামুখ, নিশ্চুপ কেন? –অতঃপর লাঠিয়াল কহিলা বিষাদেঃ “ভাই রে,
বিড়ি যখন তর্ খাইতেউ লাগব খা। কিন্তু বাইরে, ফথেঘাটে,
বিড়ি তুলিয়া, তুকাইয়া খাইস্ না। মাইনষে
বাবারে খারাফ কয়। তুই ইখানো খা। ঘরো বইয়া খা। কেউ কিচ্ছু কইত না। ওউ নে তর্ বিড়ির
বান্ডিল। দেশলাই। শেষ হইলে আবার কইস্। আমি নিজে আনিয়া দিমু মরিন্ড মাজনের ঘর
থেকিয়া...”
জনগন! হে সচেতন জনতা! হে
নাগরিকবৃন্দ! হে ভট্টাচার্য ভারতবাসী! হে নমশূদ্র ভারতবাসী! হে তর্কালঙ্কার
ভারতবাসী! হে দরিদ্র ভারতবাসী! হে কাঙাল ভারতবাসী! আমার ভাই –
আমার ভাই, আমার বড় দাদা, সর্বজ্যেষ্ঠ
দাদা তিনশত ভাব বুর্জোয়া যে চাল টি চালিল, যখন আমি নিতান্ত
তৃতীয় শ্রেনী, তাহার ইমোশনেল অতিয়াচার কিভাবে সহিব আমি?
কিয়ৎক্ষণ নিরুত্তর থাকিয়া উঠিয়াছিলাম গর্জিয়া “তবে ধিক্, ধিক্ মোরে...”
সেই যে বিড়ি সিগ্রেট ছাড়লাম আর
খাইনি কোনোদিন।