প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Sunday, February 10, 2019

"প্রথম দিনের সূর্য" (আলাপ পর্ব)


"প্রথম দিনের সূর্য"
আলাপ পর্ব



প্রশ্ন,মূলতঃ,একটিই। সেই প্রশ্নটিকেই খুঁজে যাওয়া,খুঁজে পাওয়া আপন শোণিতে। -এ’ই শুধু দায়, এ’ই শুধু নিরভিসন্ধি। এই খুঁজে পাওয়ার পথে পথেই বেলা যায়। দুপুর ঢলে পরে বিকালে। বিকাল নুয়ে আসে সন্ধ্যায় । তুলসী তলে প্রদীপ জ্বলে। ভেসে আসে আজান গান। আরেকটি রাত্রির প্রস্তুতিতে রত হয় ঝোপঝাড়, নদী ও জোনাকি। এদেরো কি সেই একই দায় - প্রশ্নটিকেই খুঁজে যাওয়া,খুঁজে পাওয়া আপন শোণিতে?
                              অথচ প্রশ্নগুলি বহু উচ্চারিত,বহুল আলোচিত,অনেক মুদ্রিত,অসংখ্য খোদিত। তাই অপরের লিপিগুলি পাঠ করতে করতে কখনোবা প্রশ্নগুলি আপনার শোণিতসঞ্জাত বলে ভ্রম হয়। ভ্রমের ঘোরে জমিয়ে তুলি বিভ্রমের নুড়ি ও প্রস্তর -উত্তরের ইঙ্গিত ভেবে ,ইঙ্গিতের নির্দেশ ভেবে। কিন্তু যেহেতু প্রশ্নগুলি নিজ শোণিতসঞ্জাত নয় তখনো ,তখনো তারা পাখিপড়াবুলি, পুঁথিপড়াধূলি সুতরাং অন্য তরঙ্গে সহজেই তারা ভেসে যায়,ধুয়ে যায়,মুছে যায়এমনকি বেমালুম বেহদিশ হয়ে যায় উত্তরের ইঙ্গিত চেয়ে জমিয়ে তোলা নুড়ি ও প্রস্তর। কখনও বা একটি গোটা জীবনই কেটে যায় ওই পাখিপড়া পুঁথিপড়া প্রশ্নমারীচের ছলনায়। আবার কখনো যদি মস্তিষ্কের ও স্নায়ুর অন্তর্গত কোষগুলির ,পরমানুগুলির পার্‌মুটেশন-কম্বিনেশনের সঙ্গে মিলেযায় মহাবিশ্বের অনু পরমাণুর পার্‌মুটেশন-কম্বিনেশন তখনি কোনো কোনো মানুষের মর্মে ঘটে যায় রে্সোনেন্স্‌, অনুনাদ -পাখিপড়া  পুঁথিপড়া প্রশ্ন ,তার অক্ষরের,বিদ্যার,জ্ঞানের সমস্ত খোলস ভেঙ্গে বেজে ওঠে অন্তরের তন্ত্রীতেটের পাওয়া যায় প্রশ্ন আসলে একটিই। 

প্রশ্নটির মতো এর উত্তরও সংখ্যাতীত গুহাগাত্রে,পাষাণে খোদিত। ঊনপঞ্চাশ হাওয়ায় উড্ডীন।
অতএব অপরের লিপিগুলি থেকে তাদের নিজস্ব উত্তরের অক্ষরও উড়ে এসে ঝরেপড়ে মর্মপ্রাকারে নিজ মর্মের, নিজস্ব উত্তরের ছদ্মবেশে। পাখিপড়া-পুঁথিপড়া সেই সকল বাক্য, অক্ষর, যতি বহন করতে করতে
মরুদ্রাঘিমার উটের মতো অনেকেই পার হতে পারে না মরুসীমা। ভ্রমাত্মক অক্ষরের ইঙ্গিত রেখে হারিয়ে যায় বিপথে। যায় নিঃশেষ হয়ে।
                              তবু প্রশ্ন টিকে আপন আপন শোণিতে চিহ্নিত করণই বিজয়। রাজধানীকে ঘিরেফেলা পদাতিকে,অশ্বারোহীতে।অতঃপর দ্বিতীয় স্তরের যুদ্ধ । রাজধানী দখলের।
এই যুদ্ধে শাদা পতাকা নেই । শুভ্র পারাবত নেই। দূতহস্তে সন্ধিপত্রের প্রেরণ নেই। আক্রান্ত রাজাও যুঝে যাবে প্রাণপণ। তুমিও যুঝবে । অন্তিমে রাজধানী চিহ্নিত করা সত্ত্বেও ,সর্বস্ব দিয়ে যুদ্ধ করা সত্ত্বেও, তুমি না’ও পেতে পারো প্রশ্নের ইঙ্গিত,উত্তরের গতিপথ
তবু এই না পাওয়া পরাজয় নয়।
তুমি চলে যাবে।
ঠিক।
‘মানুষের মৃত্যু হবে’
ঠিক।
তবুও ‘মানব থেকে যাবে’
তোমার রণনীতি খুঁজে পাবে,পাবেই একজন না একজন। একদিন না একদিন।
তবে প্রশ্নটি ,অন্তিমে ,যেমন এক, একটিই, উত্তরটি হয়ত নয় ... 
      যখনি মেধা ,আলোচনা ,শ্রবণ,পাঠ – সচেতন ভাবে ব্রতী হয় কোনও জিজ্ঞাসার সন্ধানে, যে জিজ্ঞাসা তাকে দিতে পারে , সে আশা করে, তার জীবনের,যাপনের কোনও সার্থকতা - তখনি তার স্নায়ু ,মগজকোষ ,কোষাভ্যন্তরে চলমান পরমাণুগুলির অন্তর্গত দান-প্রতিদান,আঘাত –সংঘাতের  বেনিয়মের,“কেওসের” মধ্যে  অবয়ব নিতে চেষ্টা করে নানান ‘প্যাটার্নস’ আর আন্তিমে,যার ‘মর্ম-প্যাটার্ন’ এর সঙ্গে মহাজীবনের,মহাজগতের তরঙ্গের প্যাটার্ন ,ক্ষণমাত্র কালের জন্য, যায় মিলে- যদি যায় মিলে - তখনই কি টের পাওয়া যায় প্রশ্নটি?

হয়তো হৃদয়ে “প্রেম ,প্রীতি ,করুণার আলোড়ন” বশতই একদা মনে হয়েছিল প্রশ্নটি এই, যে, “পৃথিবীতে এত দুঃখকষ্ট কেন,অবিচার,অন্যায় কেন”মনে হয়েছিল এর একটা হেস্তনেস্ত করে যাওয়াই প্রতিটি জীবিত মানুষের কর্তব্য।জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। মহাজীবনের অন্তিম সার্থকতা। মনে হয়েছিল -আমার, তোমার ,রাম,শ্যাম,রহিমের - সকলের ওই একই দায়। তবু তারা তাদের দায় ভুলে আছে। যারা সেই দায়ের সতত সচেতন চর্চায় রত তাদের প্রাথমিক দায় যারা ওই দায় বিস্মৃত তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
- এই প্রশ্ন এবং এই উত্তর যারা প্রকৃতই নিজ শোণিতে পেয়েছে, যেমন তনুদা, পরলোকগত গোস্বামী বাবু, তারা সেই দায়ের মুল্যে অদ্যাপি সভা সমিতি করে বেড়ায়, গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ায়, ইস্তেহার বিলি করে,পার্টির পত্রিকা বিক্রি করে যে সামান্য আসে তাতেই দিন গুজরান  করেদেয়, দিচ্ছে – “একদিন সমস্ত রামশ্যামরহিমেরা নিজ নিজ অধিকার চেয়ে গর্জে উঠবে ,ফেটে পড়বে” - এই আশায় ।
-এই প্রশ্ন এবং এই উত্তরকে একদা নির্ভর করেছিলাম। অদ্যাপি, মর্ম্র তার ছায়াটুকু কেঁপেওঠে। সঙ্গে কেঁপেউঠি সংশয়েও। এক বিশেষ সময়ের পৃথিবীকে একটি বিশেষ উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার প্রয়োগে শোষণ মুক্ত করবার দায়টিকে কেন পারলাম না যাপনের কেন্দ্রে স্থাপন করতে? ভাবি, ওই প্রশ্ন , ওই উত্তর আমার শোণিতসঞ্জাত ছিল না'কি ছিল  কেবলই পুঁথিপড়া,পাখি পড়া? না'কি দুই'ই ছিল মিলেমিশে - ঠিক যেমন আকর্ষনের মর্মেও থেকে যায় বিকর্ষনের বীজ, বিকর্ষনের মর্মে আকর্ষন ...
                           কিন্তু যাঁরা পারলেন,পারবেন ওই  প্রশ্নে, উত্তরে নিবিষ্ট হতে প্রকৃতই , তাঁদের প্রতি আমার মর্মে এখন কোন অশ্রদ্ধা নেই, ক্ষোভ নেই, অভিযোগ নেই। তবে একদা ছিল...
এখন তাঁদের শ্রদ্ধা করি আমি।সম্ভব হলে সহায়তাও। তবে এই প্রশ্নে মগজ,মর্ম যখন তোলপাড় তখনও জানিনা যে এটি আসলে একটি ‘শাখাপ্রশ্ন’ মাত্র
মূল প্রশ্নটি নয়। 


“আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রানের কাছে চলে আসি
বলি আমি এই হৃদয়েরে
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়”-
জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা বলার ইমেজ-সম্মোহন পার হয়ে “প্রানের কাছে” চলে আসবার, অন্য সব “দেবতারে ছেড়ে” ,নিহিত ইঙ্গিত মর্মে স্পষ্ট হতে হতে বেলা গড়িয়ে গেল অনেক। "সব দেবতারে ছেড়ে" নিজস্ব "প্রানের কাছে" চলে আসবার প্রয়াসকেন্দ্রে যে নির্ভয়,জলদস্যু দলপতিহেন যে দুঃসাহস - মর্মের পাললিক শিলা, জীবনানন্দ দাশের ইঙ্গিতটি শোণিতে শিকড়িত হওয়া সত্ত্বেও ,তা’কি অবয়ব নিলো মর্মে ? নিয়েছে মর্মে? অদ্যাপি? ভাবি।
ভাবি,আপন প্রাণের কাছে চলে আসবার পথটি কি রকম?
ঝরাপাতা মর্মর বনপথ ? আষাঢ়ের ,শ্রাবণের, জলেডোবা ধানক্ষেতের আলপথ ?
কোলাহল মুখর কোনও বাজারবন্দর পথ ?
গেরস্থ বাড়ীর খিড়কিদোর নাকি গণিকাভগিনীর ধূলির কেল্লায় প্রবেশের জর্জরিত গলিপথ ?
“সব দেবতারে ছেড়ে” ... অথচ পথে পথে মোড়ে মোড়ে,ফুটপাথে,গঞ্জে গ্রামে, গ্রন্থে,লিপিতে কত যে “দেবতা”
“মানুষ মানুষী”র “জৈব” প্রেম এক দেবতা।
গার্হস্থ তেমনি একজন।
বানপ্রস্থ একজন।
সন্ন্যাস আরেকজন।
এদের যেকোনো একজনের নিভৃত ছায়াতে অথবা একাধিকজনের বারোয়ারি ছত্রতলে যে বা যারা দাঁড়িয়ে পরতে পারে একটি জীবনের জন্য, তাদের মতন করেই দাঁড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। একদা। অবচেতনে।
গার্হস্থ মধুর ।
বানপ্রস্থ ধূসর উজ্জ্বল।
সন্ন্যাস গৈরিক।
রাষ্ট্রবিপ্লব রক্তাভ।
শিল্প গভীর নীলাভ।
যৌনতা উটের জন্য কাঁটা ঝোপ ।
অবৈধতা স্বাদু।
তবু তাদেরএকজনকে বা একাধিকজনকে  কেন বয়ে নিতে হবে আমাকে?
কি দায় আমার ?
কি দায় আরেকজনের? কি দায় আরও অনেকজনের?
“এসেছিস যখন তখন একটা দাগ রেখে যা”হেন বুলি ধর্মপ্রচারকের, ধর্মব্যবসায়ীর। কর্মবীরের।
ব্রহ্মচর্য ,বানপ্রস্থ,সন্ন্যাস,জনহিত, রাষ্ট্রবিপ্লব সকলকেই অন্য অনেক দেবতার মতনই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছি তাদের। কিন্তু শোণিতে ডালপালা তো দূরস্থান,শ্যাওলা হয়েও,অবশেষে,চিহ্ন রেখে যায়নি কেউ।
 
কেন ব্রহ্মচর্য,বানপ্রস্থ,সন্ন্যাস,জনহিত, রাষ্ট্রবিপ্লব বা অন্য অনেক দেবতার  রেখে যায়নি কোনো দাগ, শ্যাওলা কিংবা পলি আমার মর্মে? বরং শিল্প, “কারুবসনা”, ক্রমে,শোণিতে হয়ে উঠেছে বনস্পতি।
তবে কি এ’ই আমার “কাজ”? এই জীবনে?  
“দাগ রেখে যাওয়ার ছেনি ,হাতুরি?
ভাবতে গিয়ে মনে এল পরশপাথরের সন্ধানে উন্মাদ হয়ে যাওয়া মানুষটির কথা,যে,পথের প্রতিটি নুড়ি কুড়িয়ে,তার লোহার শিকলে ঠেকিয়ে পরীক্ষা করতে করতে অবশেষে পরশ পাথরটিকে হাতে পেয়েও পারল না চিনতে। চেয়েও দেখল না কোন্‌ নুড়ির স্পর্শে সত্যি সোনা হয়ে গিয়েছে তার লোহার শিকল ... এতে তার লাভ হল এই, যে , সে নিজে, নিজমর্মে ওই উথাল পাথাল সন্ধানের মুল্যে, উপার্জন করল সোনা । ক্ষতিটি হল এই, যে ,পরশপাথর সে পেল না। ফলে অন্য আরেক লোহার শিকলকে ,অন্য আরেকজনের মর্মগত লোহাকে স্পর্শমাত্র সোনা করে দেওয়ার প্রতিভার থেকে, পন্থার থেকে বঞ্চিত হল সে।
                                                  “আমি জন্মেছি একটি বিশেষ কাজ করে যেতেএকটি দাগ রেখে যেতে” - এই বিশ্বাসে ভরকরে চলতে থাকলে,একজন মানুষ ,জীবনের একটি পর্বে পৌঁছে, হয় দেখবে,যে, যে ছেনি হাতুড়ি সম্বল করে সে গিয়েছিল দাগ কাটতে তাতে দাগ পরেনি বরং তার হাতেই হয়েছে যক্ষ্মা কেননা প্রকৃতপ্রস্তাবে  ছেনি হাতুড়ি নয়,রঙ তুলিই হয়তো ছিল তার পরশ পাথর কিন্তু তখন চিনতে পারেনি বলে ,ওই খ্যাপাজনের মতো সেও,অজান্তেই প্রত্যাখ্যান করেছে,রঙ তুলিকে, প্রকৃত সময়ে। অথবা সে দেখবে ছেনী হাতুরি,রং তুলি,কাগজকলম,যোগধ্যান,বলশেভিক বুর্জোয়া ,নারীদেহ,বটতলা- প্রতিটি ‘দেবতা’কে হাতে নিয়েই সে চেষ্টা করেছে দাগ কাটবার। কিন্তু দাগ বসেনি।শুধু অনর্থক চেষ্টার মুল্যে সে খুইয়েছে তার নিজের আঙ্গুলগুলিই। ...
       এই সমূহ উদ্যোগ হয়তো তার মরমে রেখে যাবে স্বর্ণধূলি ।কিন্তু তারদ্বারা অপরকে স্বর্ণসন্ধান সে দিতে পারবে না। দেবযানীর অভিশাপ গ্রস্থ কচহেন সে থেকে যাবে তার বিদ্যার ,অন্বেষার ভারবাহী।
সক্ষম হবে না তার প্রয়োগে।
হয়তো অন্তিমে ,পত্রে , বান্ধবজনকে সে লিখবে “ আমি খুব মাঝপথে নেমেগেছি অমিতাভ , ভুলকরে নেমে গেছি ..."
কার পংক্তি? অভিরূপ সরকারের?
 
মাঝে মাঝেই ভাবি "কোন এক রকমের পরশপাথরের সন্ধানই জীবন" - এমন একটি ধারণা,সচেতনে বা অবচেতনে বহন করবার কোনও হেতু আছে কি? এমন কি হতে পারে পারে না ,যে জীবন শুধুমাত্র জীবনেরই জন্যই? যাপনের নিমিত্তই? 'সময়' শুধুমাত্র উড়িয়ে, পুড়িয়ে দেওয়ারই?
জীবনের কোনও মহাজাগতিক লক্ষ্য থাকবার দরকার রয়েছে কি আদৌ?
বানিয়ে তুলবার দরকার আছে কি কোনো "মহাজীবন" নামক মহার্ঘ্য মিথ্যার?
অর্থাৎ, মাঝে মাঝেই "জীবন কেন" -এই প্রশ্নটি ঘাই দেয় যাপনের বহিরঙ্গে ।এই 'ঘাই দেওয়া'কে  ব্যক্তিগত করে পবিত্র করে নিতে হলে বলতে হয় “আমি কেন”?
এই প্রশ্নে নিমগ্ন হতে চাওয়ার চেষ্টার আবহে অন্তিমে ,সৃজিত হতে পারে কি অর্থবহ কোনও সংলাপ, স্বগত কিংবা দ্বৈত?
জানিনা।
এই অক্ষরপ্রচেষ্টা তারই সন্ধান।
ঝড়ে জলে বাতাসে,ভুকম্পনে,নদি সমুদ্রের গতি পথের হঠাৎ পরিবর্তনে এমন তো কতই হয়,যে একটি প্রস্তর অথবা একটি দ্বীপের অবয়ব হয়ে ওঠে অপরূপ আবার রক্ত মাংসের ভাস্কর তাঁর সচেতন ছেনী হাতুড়িতেও নির্মাণ করেন এরূপ অপরূপ নির্মীত ভাস্কর্যটির উদ্দেশ্য-বিধেয় বিষয়ে যদি প্রশ্ন করাযায়দ ভাষ্করজনকে, তাহলে ভাস্করজনের সৃজনোদ্দিপনার গহন থেকে পাওয়া যাবে এক বা একাধিক উওর।কিন্তু  ঝড়ে জলে বাতাসে,ভুকম্পনে,নদি সমুদ্রের গতি পথের হঠাৎ পরিবর্তনে সৃষ্ট অপরূপের উদ্দেশ্য-বিধেয়, যেহেতু না-প্রশ্ন-সম্ভব, সুতরাং প্রতি মুনীর নিজ নিজ মতামত, প্রতিজন না-মুনীরও।
"আমি কেন" এই প্রশ্নেরো একটি উত্তর নিহিত 'আমি'র অন্তর্গত মগজ-ভাস্করজনের সৃজনোদ্দিপনার গহনে কেননা অন্তিমে 'আমি'ও নই কি ঝড়,জল,বাতাস,ভুকম্পনের হাতেই গড়া এক অপরূপ ?
এই পর্বে এসে কে যেন বলেওঠে "আমি কোন জন?" আমার মগজ-ভাস্করজনই কি 'আমি'? নেহাতই ঝড় জল ,বাতাসের দ্বন্দ্বে,পরিণয়ে- হয়েওঠা এক আকস্মিক যে বলে “আমি কে ?” আমি তাকে যদি বলি “তুমি কে?” - তাহলে?
  

এক হাওয়া বলেঃ "যদি কোনও বিশ্বকর্মা, কোনও তুখোড় বিপুল ভাস্কর, অতিযত্নে এই বিশ্বের প্রতিটি ধূলিকণাকে,প্রতিজন তৃণকিশোরীকে,প্রতি সমুদ্রের প্রত্যেক ঢেউযুবককে ,প্রতিটি খালবিলের প্রতি শিশু -মৎস্যকে ,গর্ভ,যোনি ,জরায়ুকে নির্মাণ না'ই করে থাকেন,তাহলে কিভাবে এই সমস্ত প্রাণীগুলি ,এমিবা থেকে মানুষ,জরায়ু থেকে পুং জননেন্দ্রিয়,মেঘরাশি থেকে তৃণরাজি সকলে সকলের সঙ্গে এইভাবে ,নিভৃত আত্মীয়তায় ,নিহিত নিয়মে মিশে গিয়ে, বেঁচে রইল অদ্যাপি? এক ভাস্কর আর তাঁর বহু হওয়ার বাসনার ফসলই কি এই বিশ্ব? এই এক বিশ্ব? এই কি একমাত্র বিশ্ব? একমাত্র ব্রহ্মান্ড? যদি তা'ই হয় তাহলে ভাস্করজনের প্রতিটি সৃষ্টির ,এমন কি তুচ্ছাতিতুচ্ছ ধুলিকণাটির দ্বারাও তিনি প্রমাণে, প্রকাশে নিরত কোনো বিশেষ 'ইচ্ছা'র? উদ্দেশ্যের?
তাহলে কি হে গৃহত্যাগী ,গেরুয়াধারণকারী সন্ন্যাসী তুমিও যেমন "তাঁর"ই ইচ্ছায় এই গৈরিক অঙ্গে ধরেছ তেমনি,হে জন্ম জন্মান্তরের বিট্‌লে পুরোহিত‌ তুমিও ধরেছ নামাবলী, কসাই ধরেছে ছুরি, গণিকাভগিনী ধরেছে কাস্টমার, সতী-সাবিত্তী ধরেছেন 'ফাইডালিটি'...
  তবে কি,হে বলশেভিক ,হে নাস্তিক তুমিও নও "তাঁর" ইচ্ছার বহির্গত? "তাঁর" মহিমার প্রকাশে ,বিস্তারে তোমারও রয়েছে ভুমিকা? এই যে কাফেতে ,”মোড়ে তে বসে থাকা” যুবক যুবতী তোমাদের ভূমিকাও নির্দিষ্ট "তাঁর" পাণ্ডুলিপিতে?
যদি প্রশ্ন ওঠে "কি সেই ভুমিকা?"
তাহলে উত্তর কি শুধুমাত্র এইঃ  "তা যদি জানতে চাও ,প্রকৃতই,তাহলে "তাঁকে" জান।জানবার জন্য ব্যাকুল হও ।"তাঁকে" জানাই তোমার আপনাকে জানা।সুতরাং "আমি কে" র পরিবর্তে "তুমি কে" র উত্তরের  সন্ধানে মর্মে বলশালী হও।ধ্যানে নিবিড় হও ..." তুমি কদাপি নও নেহাতই কোলাহল জাত এক আকস্মিক।তুমি সেই ভাস্করজনের সৃষ্টি লীলাকে অনুভব করো আপন শোণিতে।বিস্মিত হও।গাও “আকাশ ভরা সূর্য তারা,বিশ্ব ভরা প্রান,তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান /বিস্ময়ে তাই জাগে জাগে আমার প্রান...”
[এই যে 'বিস্ময়' আর সেই যে, যে বিস্ময়, যা 'বিপন্ন', 'বিপন্ন বিস্ময়' - তাদের মধ্যেকার দূরত্ব কতোটা? কতো আলোকবর্ষ, কতো সত্য, ত্রেতা, কলি? ...
এক ভাস্কর আর তাঁর বহু হওয়ার বাসনার ফসলই কি এই বিশ্ব? এই এক বিশ্ব? এই কি একমাত্র বিশ্ব?]
আর হাওয়া জবাব দেয়ঃ "এই বিশ্ব,সত্যই অতি সুরচিত ।সুগঠিতকীটানুকীট থেকে মানুষ-সকলেরি জন্য সুষম।পুষ্টিকর।এই বিশ্ব অতি অতিথিবৎসল ও বটে।আর যেহেতু এই বিশ্বেরঅতিথিবৎসল তার প্রমান তৃণ থেকে তার মহানীলাকাশের সর্বত্র বিরাজিত,সুতরাংসম্ভব এই, যে,এই বিশ্ব এই প্রাণ বৎসল বিশ্ব,বস্তুত, "একটি" মাত্র নয়, একটিই মাত্র নয়,কেননা যেহেতু স্থান কালের গতিপথ সমতল(flat) সুতরাং মুহুর্মুহু সৃষ্টি হচ্ছে নব নব ব্রহ্মান্ড স্থান কালের গতিপথেএই সংখ্যাতী্ত ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের পৃথিবী হেনপ্রাণবৎসল গ্রহ অবশ্যই বিদ্যমান।সুতরাং এই মহাকাহনে ভাস্কর "big bang" I স্রষ্টা আমার, স্রষ্টা তোমারওই নিকানো উঠোনহেন নাভিটির ,এই জননাঙ্গের, এমিবার,ব্যাক্টেরিয়ার,ভ্রূণের,স্বপ্নের এবং বাস্তবের।
হ্যা,এই "multiverse" ও এতাবত,স্বাভাবিক কারণেই সম্পূর্ণ প্রমানে প্রতিষ্ঠিত নয়।Gravitational waveহেন আরো বহু ঘটনায় multiverse ধারনার মানচিত্রেও ঘটে যাচ্ছে মুহুর্মুহু যোগবিয়োগকিন্তু সেই যোগ বিয়োগেmultiverse এর অবয়ব বিষয়ে ধারনা বদলাতে থাকলেও তার অস্তিত্ব বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।
সুতরাং "আমি কেন"? এর উত্তর নিহিত আমাতেই।
"আমি" কে? "আমি" মহাজাগতিক মহাবিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট অনেকগুলি ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্গত একটি বিশেষ ব্রহ্মান্ডের প্রানবৎসল একটি গ্রহের একটি প্রাণী।ঠিক যেমন ঝড়, বাতাস,জল,বৃষ্টির হাতে নির্মিত হস্তীহেন অবয়বের পাহাড়,দেবদেবীর আদলের প্রস্তর।তফাত এই, যে,তাদের প্রাণ নেই।
আমার শোণিতে শিকড় ছড়িয়েছে বহুল মহাবিশ্ব। multiverseতাই আমার প্রাণের কোনও আরোপিত দায় নেই।আরোপ করার মতন মহাজাগতিক সূত্র নেই।প্রভু নেই।আমার দায় নেই আমার প্রাণটিকে রক্ষনাবেক্ষনেরো।
সমাজ যে দায় দেয় তা চাপিয়ে দেওয়া দায়।প্রাণ কে যারা আঁকড়ে রাখতে চায় তাদের ভীতি দূরীভূত করতে, দৈনন্দিনতার দায়কে সহনীয় ,বহনীয় করতেই তাদের রীতি নীতি,আচার বিচার, সমাজ-কল্যান। কেননা তাদের মর্মে নেই বহু-ব্রহ্মান্ডের ছায়া। সুতরাং তাদের প্রয়োজন ব্রহ্মের"
আমার প্রাণ আছে।কিন্তু সেই প্রাণের কোনই দায় নেই কোনও রকমের দাগ রাখবার।সমাজ প্রগতি আনবার।পুঁথি আঁকবার।ছবি লেখবার ।ওই দায়হীনতার স্বাধীনতার স্রষ্টাহীন এই বিরাট বিশ্বের দিকে চেয়ে যখন গেয়েওঠা “  বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান", তখন এই বিস্ময় আর ওই "বিপন্ন বিস্ময়" এর মধ্যে থাকেকি খুব একটা তফাৎ?
 
 

 

ঘুম ঘর