জলিল স্যার
১।
জলিল স্যারের প্রসংগে কিছু বলিবার অর্থ এমন একটি প্রজাতি সম্বন্ধে বলা যাহা প্রায় বিলুপ্ত বহুদিন...এমনকি আমাদের মফস্বল শহরগুলি হইতেও...
জলিল স্যার যখন মাষ্টারিতে ঢুকিয়াছিলেন তখনো মুড়ি-মুড়কির দড়ে মাষ্টারি বিক্রির যুগ আরম্ভ হয়নাই। তখনো ভোরবেলা গ্রামদেশের ভিটা হইতে ইষ্টিশান পর্যন্ত হাঁটিয়া আসিয়া ভিড়েভরা বাসে চাপিয়া অথবা দুলকি চালে চলা কয়লায় টানা ট্রেনে চাপিয়া মফস্বল শহরে আসিয়া পরিচিত পান-বিড়ির দোকানে পূর্বরাত্রে রাখিয়া যাওয়া সাইকেলখানি লইয়া ইস্কুলে পড়াইতে আসা শিক্ষক দেখা যাইত...
এইসব অবশ্যই জলিল স্যারের যৌবনের কথা যাহা আমি দেখিনাই, যাহা আমরা দেখিনাই।আমরা যখন জলিল স্যারকে দেখিতে আরম্ভ করি তখন আমারা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র এবং তাঁহার গ্রামের বাড়িতে তাঁহার দ্বিতীয় পুত্রও ছাত্র পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ শ্রেণির। আমাদের মফস্বল শহরে তখন ইহাই একমাত্র হাইয়ার সেকেন্ডারী ইস্কুল যেইখানে ছেলে-মেয়ে,মাধ্যমিকের পর,একত্রে পড়িতে পারে এবং একমাত্র হাইয়ার সেকেন্ডারী ইস্কুল যেইখানে ‘সাইন্স’ পড়ানো হইয়া থাকে। ফলে যাঁহারা ছিলেন এগারো-বারো কেলাসে পাঠদানের অধিকারী তাঁহারা চালে চলনে বার্তায় ভংগীতে ‘সেকেন্ডারি’ শিক্ষকগন হইতে আপনাদিগের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ফিকিরে থাকিতেন।‘সেকেন্ডারি’ শিক্ষকগনের একদল ঐসব ‘হায়ার সেকেন্ডারি অধ্যাপক’দিগের তালে তাল দিয়া নিজ ‘প্রাজ্ঞতা’র পরিচয় দিতেন,আরেকদল সু্যোগ খুঁজিতেন ‘হায়ার সেকেন্ডারি অধ্যাপক’দিগকে ‘বাঁশ’ দিবার। আবার শহরের আমলাদিককে অনর্থক ‘তৈল’ প্রদানের কর্মটি উভয়পক্ষই করিতেন একত্রে। সৌরীন নামে একটি অতি ডেঁপো ছোকড়া ছিল আমাদের সহপাঠী। ঐ দুই দলের শিক্ষক-শিক্ষিকাগনই সর্বতোমুখী চেষ্টা লইতেন তাহার প্রিয় হওয়ার কেননা জাতিতে তাহার পিতা ছিলেন ‘ডিভিসনেল ফরেস্ট অফিসার’।
একজন ‘সেকেন্ডারি’ শিক্ষকের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ছিলেন রাজ্যের রাজধানীর বড় এক আমলা। ঐ শিক্ষকজন ক্লাস নিতে আসিয়া বা পথে দেখা হইলে,ছাত্র,ছাত্রর মাতাপিতা,রিক্সাচালক,মুদীর দোকানী সকলকেই সেই ‘দাদা’র কীর্তি-কাহিনী উদারভাবে শুনাইয়া দিতে কার্পণ্য করিতেন না।ছিলেন দুই ‘মহাকবি’।একজন উচ্চমাধ্যমিক ক্লাশে জুলজি পড়াইতেন অন্যজন নিম্ন-মাধ্যমিকে...কিন্তু ঠিক কি বিষয় যে তিনি পড়াইতেন তাহা বুঝিনাই কদাপি...কেননা ‘বাংলা সাহিত্য’, ‘ইতিহাস’, ‘সমাজ অধ্যয়ন’ সমস্ত বিষয়ের ক্লাসেই তিনি আসিতেন এবং পড়াশুনায় নিতান্ত দূর্বল তথা নিরীহ ছেলেগুলিকে লইয়া রগড় করিয়াই তিনি কেলাস কাবার করিয়া দিতেন। প্রধান শিক্ষক,যে তিনজনের আমল আমি দেখিয়াছি তন্মধ্যে,অনিন্দ্য ভট্টাচার্য’ই একমাত্র সেই ‘সেকেন্ডারি কবি’কে কিছুদূর বাগে আনিতে পারিয়াছিলেন বলিয়াই আমার অনুমান।
এইরূপ মাদারির খেলের সমান্তরালে জলিল স্যার,বাসস্টপ হইতে সাইকেলে চাপিয়া,আসিতেন প্রত্যহ সকাল সাড়ে নয়টায়।শ্মশ্রুগুম্ফবিহিন পরিষ্কার কামানো মুখমন্ডল,বাম পার্শ্বে সিঁথি কাটিয়া আঁচড়ানো চুল। ধব্ধবে শাদা শার্ট,কালো পেন্টুলুন। মুখে ঈষদ হাসির রেখা। পূর্বে বর্ণিত কোনো দলেরি সদস্য ছিলেননা তিনি। ছাত্র-শিক্ষক কাহারো সন্মুখেই আপনাকে ‘কবি’, ‘সাহিত্যিক’ কিংবা ‘মহাজ্ঞানী’ হিসাবে প্রতিপন্ন করিবার প্রয়াস বা প্রচেষ্টার কোনো বালাই ছিলোনা তাঁহার। অথচ কাহারো সহিত বিবাদ বচসায় দেখিনায় তাঁহাকে যেমন দেখাযাইত অন্য অনেককেই...ষ্পষ্ট মনেপড়ে দুই ‘হায়ার সেকেন্ডারি অধ্যাপক’ স.বাবু আর র.বাবুর প্রায় হাতাহাতি ইস্কুল কেন্টিনের সন্মুখে... স.বাবু মূলতঃ ছিলেন গুন্ডা প্রকৃতির আর র.বাবু ছিলেন তাঁহার অঞ্চলের কুচক্রীদিগের মাথা তদুপরি উভয়েই বাস করিতেন প্রায় এক পাড়ায় অতএব সংঘর্ষ নানা কারনেই বাধিতে পারে...
ফাইভ হইতে টেন্ সব শ্রেণীতেই ক্লাশ লইতেন জলিল স্যার। ক্লাস নাইন-টেনে তাঁহার নিকট পাঠ নিয়াছি সমাজ অধ্যয়নের। ক্লাস সিক্সে সম্ভবতঃ ভূগোল।‘চট্পটে ছাত্র’ বলিয়া তাঁহার বিশেষ স্নেহ যেমন পাইয়াছি তেমনি অতি দুরন্ত স্বভাবের কারনে সেভেন-এইট্ পর্যন্ত কিল-চড়ও খাইয়াছি বিস্তর। অন্ততঃ ক্লাস সেভেন অবধি জলিল স্যার আমাদের ভয়ের পাত্রই ছিলেন। অথচ তেমন যে মারধর করিতেন তাহাও নহে,তেমন মারাত্মক কোনো শাস্তিও দিতেননা। যাহা দিতেন তাহার নাম ‘চিমটি’। বাহুতে কিংবা পেটে। সেই ‘চিমটি’ হইতেও বেশী ছিল ‘চিমটি’র ভয়।পড়া করিয়া না আনিলে বা খাতা-বই মনেকরিয়া না আনিলে জুটিত সেই ‘চিমটি’।তবে তখন টের না পাইলেও আজ বুঝি সেই ‘চিমটি’তেও মিশ্রিত থাকিত স্নেহ ...
ইস্কুলবাড়িটির আকৃতি অনেকটা ইংরেজী ‘ইউ’ অক্ষরের ন্যায়।‘ইউ’টির ঠিক মধ্যবিন্দুতে আধো-অন্ধকার কোঠাটি প্রিন্সিপালের কোঠা। লাগোয়া কোঠা ভাইস্ প্রিন্সিপালের। ঐ কোঠাগুলিকে ঘিরিয়া অফিসরুম।‘ইউ’র কেন্দ্রটির দিকে মুখ করিয়া দাঁড়াইলে ডানপার্শ্বে যে কোঠাগুলি দেখাযায় সেইগুলি বড় বড় মোটা মোটা ইঁটের তৈয়ারি। থামগুলিও তেমনি দশাসই।‘ইউ’আকৃতির।ইস্কুলবাড়ির ঐ অংশ সম্ভবতঃ বৃটিশ আমলের অবদান।এই সম্পূর্ণ অংশটিতে লাল রঙের চূনকাম। টানা বারান্দার একপার্শ্বে ক্লাসরুমের সাড়ি।ক্লাশঘরগুলির ঐ পারে দন্ডায়মান গোটা পাঁচ বয়স্ক আমগাছ। তাহাদের গায়ে শ্যাওলা।তাহাদের ছায়ায় ঐ দিকটি সর্বদাই স্যাঁতস্যাঁতে।ঐদিকে উঁচু দেওয়াল।পারাইয়া বড় খেলার মাঠ।বৃটিশ আমলের কোঠাগুলিতেই বসিত ফাইভ- সিক্সের ক্লাস। অদ্যাপি চোখে ভাসে সেই আধো-অন্ধকার কোঠাটিতে জলিল স্যার চেয়ারে উপবিষ্ট। ভূগোল পড়াইতে গিয়া নানাদেশের গল্প বলিতেছেন ... কখনোবা আমাদিগকে লিখিতে দিয়া তাকাইয়া আছেন জানালা দিয়া...আমগাছগুলির পাতার ভিতর দিয়া আলোছায়ার কাটাকুটি আসিয়া পড়িয়াছে স্যারের টেবিলে,ক্লাসঘরের মেঝেতে...
প্রতিজন ছাত্রেরি খাতা খুঁটাইয়া পড়িতেন জলিল স্যার। ভুল হইলে বুঝাইয়া দিতেন। দিতেন ‘চিমটি’ও। কোনো না কোনোভাবে শিখাইয়া লইতেন যাহা শিখাইবার। ক্লাস সেভেন-এইটে আমাদের ‘বি’ সেক্সনে ক্লাস করাননাই তিনি। কিন্তু সেভেনের হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষার ইতিহাস-খাতা দেখিয়াছিলেন তিনিই। আমার লেখা কয়েকটি উত্তর ভালোলাগায় টীচার্স-কমন্-রুমে ডাকাইয়া লইয়া পিঠ চাপডাইয়া দিয়াছিলেন...
‘ইউ’র কেন্দ্রটির দিকে মুখ করিয়া দাঁড়াইলে বামপার্শ্বে যে কোঠাগুলি সেইগুলি অপেক্ষাকৃত নূতন।সেইগুলির গায়ে সাদারঙ। সেই কোঠাগুলিতে ক্লাস বসে সেভেন হইতে টেনের ছেলেদের। ক্রমে আমরাও একদিন লালবাড়ি হইতে উত্তীর্ণ হইলাম শাদাবাড়িতে। সেভেন-এইট্ ডিঙ্গাইয়া উঠিলাম ক্লাস নাইনে।আবারো আসিলেন জলিল স্যার। সমাজবিদ্যা পাঠ দিতে।
এইসব কথা ১৯৮৭-৮৮ সালের।
২।
ইস্কুলের গন্ডি পারাইলাম। এগারো-বারো কেলাস কলেজে পড়িয়া অতঃপর কারিগরি শিখিতে চলিয়া গেলাম হোস্টেলে।খুব বেশী দূরে নহে,৫৬ কিলোমিটার দূরের প্রতিবেশী শহরে। ইতিমধ্যে আমাদের বন্ধু তপু আমাদের শহরে বেশ নেতা হইয়া উঠিয়াছে। তপু আমার বন্ধু সেই ক্লাস সিক্স হইতেই। রীতিমতো ভালোছাত্র ছিল সে। পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও নানা রকমের পড়াশুনা ছিল তপুর। মনে আছে সত্যজিৎ রায়ের সম্পাদনা করা ‘মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প’ আমি পড়িয়াছিলাম তপুর দৌলতেই...ইস্কুলে সে’ও ছিল জলিল স্যারের পছন্দের ছাত্রদের একজন।
ক্রমে রাজনীতিতে জড়াইল তপু। রেকর্ড ভোট পাইয়া কলেজের জেনারেল সেক্রেটারি হইল। তপুর এবম্বিধ উন্নতিতে আমরাও আমোদ এবং বন্ধু হিসাবে সুবিধা দুই’ই পাইতেছিলাম। কিন্তু এবম্বিধ উন্নতির সহিত গুন্ডা এবং গুন্ডামির সম্পর্ক কালক্রমে নিবিড় হয় স্বাভাবিক ভাবেই। সেইভাবেই তপুর একদিন হাঙ্গামা বাধিল শহরের কুখ্যাত মাস্তানভ্রাতাদ্বয়ের সঙ্গে। উহারা আমাদের শহরে ‘হীরা-পান্না’ নামে সুবিখ্যাত। এই ‘হীরা-পান্না’ নাম তাহাদের পিতৃপ্রদত্ত না’কি তাহাদের প্রতিভায় মুগ্ধ হইয়া শহরের জনগনপ্রদত্ত তাহা বলা মুশকিল। ঠিক কি লইয়া কিভাবে তাহাদের সহিত তপুর ঝামেলা বাঁধিয়াছিল জানিনা তবে গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি আসামাত্র অন্য বন্ধুদের মুখে শুনিলাম কিয়দ্দিবস পূর্বেই ‘হীরা-পান্না’র সহিত তপুর প্রকাশ্য বচসা হইয়া গিয়াছে,সন্ধ্যাবেলা,শহরের একমাত্র আলোকিত রাস্তা ষ্টেশনরোডে। পরদিন আড্ডাস্থলে গিয়াও শুনিলাম আরো কাহিনী। তপু সেই সন্ধ্যায় আড্ডায় আসেনাই।
আরো এক দুইদিন কাটিয়াগেলো। সেইদিন সকালে উঠিয়া চা-জলখাবার খাইয়া সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ নিজের কোঠায় দরজা ভেজাইয়া সবে সিগারেট টানিতে আরম্ভ করিয়াছি তখুনি হন্তদন্ত হইয়া আসিয়া দরজায় ধাক্কাদিল কূটন –
এই কূটন,আমি,তপু আর মনিদীপ ছিলাম ইস্কুলে ঘনিষ্ঠতম। আমরা ক্লাস সেভেনে উঠিলে মনিদীপের বাবা গেলেন বদলী হইয়া। ইতিপূর্বে জুবিনের বাবার বদলী হইয়াছিল ... জুবিন ... জুবিন বট্ঠাকুর ... যে বর্তমানে জুবিন গর্গ নামে খ্যাত ... এইবার মণিদীপ গেলো ...রহিয়া গেলাম কূটন,আমি আর তপু। পরে, ক্রমে, রাজনীতি,রাজনৈতিক ধ্যান-ধারনা লইয়া তপুর সঙ্গেও একসময় এক রকমের দূরত্ব আমাদের গড়িয়া উঠিয়াছিল ঠিক কিন্তু ঐ সমস্তই ‘রাজনীতি,রাজনৈতিক ধ্যান-ধারনা’র মতো বাহ্যিক। গহনে আমরা ছিলাম বন্ধুই।
বারো কেলাসের পর আমিও ছাড়িলাম শহর। কূটন একা হইল। হোস্টেলে নূতন বন্ধু-বান্ধব হইল আমার। কূটনেরো জুটিল নতুন বন্ধু। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের হ্রাস হইলনা কিছুমাত্র। শনি-রবিবারের ছুটি বা অন্যান্য ছুটিতে বাড়ি আসিতাম ঐ বন্ধুত্বের টানেই। তপুকে সর্বদা পাওয়া না গেলেও মাঝে মধ্যেই অন্য দলবলকে এড়াইয়া সে আসিত আমাদের সঙ্গে আড্ডা মারিতে...
ফিরিয়া যাই গ্রীষ্মের ছুটির সেই সকালে যখন সকালে উঠিয়া চা-জলখাবার খাইয়া সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ নিজের কোঠায় দরজা ভেজাইয়া সবে সিগারেট টানিতে আরম্ভ করিয়াছি তখুনি হন্তদন্ত হইয়া আসিয়া দরজায় ধাক্কাদিল কূটন – কূটন আসিয়া এক শ্বাসে যাহা বলিল তাহার মর্ম এই,যে,আজ সকালেই ‘হীরা-পান্না’র সহিত তপুর বিরাট মারামারি হইয়া গিয়াছে, ষ্টেশনরোডে - ‘হীরা-পান্না’ না’কি তলোয়ারের কোপ মারিয়াছে তপুকে। তপু নাকি হাসপাতালে। কেহ ফোন করিয়া খবর দিয়াছে কূটনকে। সে রিক্সা লইয়াই আসিয়াছে আমাকে লইয়া হাসপাতালে যাইবার জন্য।
রিক্সায় হাসপাতালে পৌঁছিতে লাগিল মিনিট কুড়ি। তেমন কিছু বড় না হইলেও হাসপাতালটিতে পাঁচ ছয়টি ওয়ার্ড। পুরুষ ওয়ার্ডের প্রথমটি দেখিলাম। তপু নাই। দ্বিতীয়টিতে ঢুকিয়া ইতিউতি দেখিতেছি তখনি কানে আসিল একটি পরিচিত কন্ঠঃ ‘বিশ্বাস...সৌমিত্র...এদিকে আয়...’...ঐ কন্ঠ জলিল স্যারের। ওয়ার্ডের প্রান্তে, জানালার ধারের শেষ বেডে তপু শায়িত। নাকে অক্সিজেন,হাতে সেলাইনের নল,সমস্ত শরীরে বেন্ডেজ। বেন্ডেজ ছাড়াও ক্ষত রিহিয়াছে শরীরে। দেখিয়া জীবিত কি মৃত বুঝিবার উপায় নাই...রুগীর বিছানার কিনারে চেয়ারে বসিয়াআছেন জলিল স্যার। হাতে একটি তালপাতার পাখা। তাহাদ্বারা তাড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছেন রক্তের ঘ্রানে আকূল হইয়া উঠা মাছিগুলিকে।
তপুর ‘জেনারেল সেক্রেটারি’ আমল আমরা দেখিয়াছি। দেখিয়াছি ‘তপুদা’র সামান্য কৃপাদৃষ্টির আশায় তপুকে ঘিড়িয়া থাকা ছেলে ছোকড়ার দঙ্গল। সেই তপু,হয়তো এ তাহার মৃত্যু শয্যাই,এইখানে সে একা,নির্বান্ধব। বাপ-মা-ভাই’ও নাই কিনারে...
জলিল স্যার বলিলেনঃ ‘আমি এসে দেখেছি বেডে নিয়ে এসেছে ওরা তপুকে,তারপরই সবাই চলেগেলো...’আমি বলিলামঃ ‘বাড়ির লোক...” জলিল স্যার মাথা নাড়িলেন। আসেনাই। জানি উহারা তপুকে লইয়া নাজেহাল...তবু এমন অবস্থায়...হাতপাখা নাড়িতে নাড়িতে জলিল স্যার বলিলেনঃ ‘বিশ্রীভাবে মেরেছে...কেজানে আর সেড়ে উঠবে কি’না...’ শেষের দিকে তাঁহার গলা স্পষ্ট ধরিয়া আসিল...আমার মনে পড়িল আবছা আবছা শোনা একটি ঘটনা, জলিল স্যার সম্বন্ধে...আমাদের বয়স্ক তাঁহার যে ছেলেটি ছিল সে না’কি মারা গিয়াছে...বর্ষার রাত্রে জলভরা মাঠের পথদিয়া ফিরিতেছিল সে।ঝড়-ঝঞ্ছায় ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়িয়া জলে পড়িয়া যায়। তাহাতেই বিদ্যুৎস্পৃস্ট হইয়া মারাযায় সে... অদ্যাপি সেই কাহিনীর সত্যাসত্য জানিনা তথাপি পিছন ফিরিয়া তাকাইলে জলিল স্যারের যে মুখ ভাসিয়া উঠে চক্ষে তাহা এক প্রকৃত পিতারি মুখ ... যিনি একটি বা দুইটি সন্তানের জৈব পিতা হওয়ার মূল্যে সকল বালক-বালিকাকেই করিয়া লইয়াছেন নিজ সন্ততি ...
সেইযাত্রা প্রানে বাঁচিয়া গিয়াছিল তপু...হয়তোবা জলিল স্যারের প্রার্থনাবশেই। কিন্তু অবশেষে তাহার অকালমৃত্যুই হইয়াছিল সেই ঘটনার তিন-চারি বৎসরের মধ্যে।
তথ্য হিসাবে এইখানে আরেকটি কথাও বলিয়া রাখাযায়,যে,তপু বিজেপি করিত,ছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদেরো সক্রিয় সদস্য আর জলিল স্যার ছিলেন মুসলমান...
৩।
জলিল স্যারের কথা মনেপড়ে।
নানাসময়ে নানাকারণেই মনেপড়ে। বাড়িতে গেলে যে ইস্কুলে যাই একবার তাহার একটি প্রধান কারন জলিল স্যার এখনো আছেন। গেলে দেখাহয়,কথাহয়। টের পাই সেই টান, যাহা নাড়ির ... টের পাই যে সময় আসিতেছে, ক্রমে, তাহার ছায়ায় না শিক্ষকের মর্মে থাকিবে ঐ টান, ছাত্রের প্রতি ... না’ত ছাত্রের মর্মে থাকিবে ঐ শ্রদ্ধা শিক্ষকের প্রতি ...
যখন জলিল স্যার অবসর লইবেন তখনো বাড়িতে গেলে ইস্কুল দেখিতে যাইব ঠিকই তবে তখন ইস্কুলের চত্বরটি দেখাভিন্ন অন্য খুব বেশী কিছু টান আর থাকিবেনা।
--------
১৬/৫/২০১০ – ৩/০৩/২০১২
বেঙ্গালোর
------
প্রথম মুদ্রণঃ সাময়িক প্রসঙ্গ, শিলচর