“মৃত্যুহীন প্রাণ”
১।
তাবড় তাবড় সমাজপতিদের সঙ্গে ঘোর তর্ক বিতর্ক সেড়ে বাড়ি ফিরছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি জানেননা আড়ালে আড়ালে নিবিড় হয়ে উঠছে কি নিবিড় চক্রান্তের জাল। স্ত্রী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ কোনো কিছুকেই মেনে নিতে নারাজ সমাজপতিরা এবার স্থির করেছে তাঁকে বধ করেই পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে এসবের।
সদ্য নগর হওয়া কলকাতায় প্রায় মধ্য রাত। গ্যাসের আলোতে আরো রহস্যময় হয়ে উঠেছে রাত্রি। বিদ্যাসাগর চলেছেন একা। কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই তাঁর। এমন সময় গলীর অন্ধকার ফুঁড়ে বেড়িয়ে এলো কালান্তক যমের মতো চেহারার কয়েকটি লাঠিয়াল। এরা সমাজপতিদের কাছে টাকা খেয়েছে বিদ্যাসাগরকে খুন করার জন্য।
দাঁড়িয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর। হাঁক দিলেন ‘শ্রীমন্ত...’ সেই ডাক নিঝুম রাত্রি ভেদ করে ছুটে গেলো শ্রীমন্ত’র কাছে। লাঠি হাতে মুহুর্তে উদয় হলো শ্রীমন্ত। ‘কি বাবামশায়, কি হয়েছে?’ ভাড়াটে লাঠিয়ালদের ঘায়েল করে বিদ্যাসাগর’কে নিয়ে ঘরে ফিরে চল্লো শ্রীমন্ত। - এই ঘটনার থেকে, ক্রমে,ঞ্ছবিতে আর অক্ষরে যিনি আমাদের নিয়ে চললেন বিদ্যাসাগরের জীবনের গহনে তাঁরি লেখায়, রেখায় আমরা প্রথম চিনেছি শেরউড্ বনকে। চিনেছি রবিনহুড্’কে। জেনেছি ইতিহাসে ব্যবহৃত নানান অদ্ভুত অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার। তিনিই আমাদের নিয়ে হানা দিয়েছেন ব্রাজিলের বনে যেখানে কর্ণেল সুরেশ বিশ্বাস, তখনো কর্নেল নন, সার্কাসের পলাতক বাধ রঙ্গলালকে এসেছেন খুঁজতে। তাঁরি কল্পনায় আমরা দেখেছি আলেকজেন্ডারের ছাইনি, দেখেছি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে বনে বনে একা একা ঘুড়ে বেড়ানো চন্দ্রগুপ্ত’কে। কে তিনি? তাঁরি নাম ময়ূখ চৌধুরি।
শুকতারার পাতায় মাসে একবার শেরউড্ বনের সেই রবিনহুড্’কে দেখার অপেক্ষা নিয়ে কেটেছে আমাদের দিন। যেহেতু মফস্বল তাই শুকতারা এসে পৌঁছতেও হতো দেরী। মাসের যে দিনটিতে শুকতারা আসার কথা সেদিন থেকেই বাড়িতে যিনি দিতেন খবরের কাগজ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ যেতো শুরু হয়ে।
শুকতারার মলাটে তখন ‘লৌহ মুষ্টি কৌশিক’এর কান্ড কাহিনী আঁকছেন নারায়ণ দেবনাথ। ‘সর্প রাজের দ্বীপে’ নামটি মনেপড়ে আজো। প্রতি সংখ্যায় ‘হাঁদা ভোঁদা’ আর বাঁটুল ঘটিয়ে চলেছে নিত্য নতুন কান্ড। তারি পাশাপাশি তুষার চ্যাটার্জী’র ‘কালো বাঘের থাবা’, ব্যাক প্যান্থার। মনেপড়ে। মনেপড়ে ময়ূখ চৌধুরি’র ‘শের উড্ বনের রবিনহুড্’, ‘ইতিহাসে অস্ত্র’। আরেকটি ছবিতে গল্প, আজ মনেনেই, হায়, কার সৃষ্টি ছিল সেটা, ‘যুগে যুগে’, শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন নিইয়ে লেখা ঐ ছবিতে গল্প আমাদের বাল্যের ‘কথামৃত’... ঐ রকম সময়েই কে যেন লিখতেন ‘অদৃশ্য জলদস্যু’। জয়ন্ত নামের এক ইস্কুল মাষ্টারের হাতে এসে গিয়েছিল এক তরবারি যার মালিক জলদস্যু গঞ্জালো (?)। তলোয়ারটি হাতে আসার সুবাদে সেই গঞ্জালো’র ভূত হয়ে উঠলো তার বন্ধু ... ঐ সময়, বা সম্ভবতঃ আরেকটু আগে প্রকাশিত হয়েছিল, শুকতারা’তেই, জগদীশ চন্দ্র বসু’কে নিয়ে লেখা ‘পত্রে পত্রে চঞ্চলিয়া’...
মনেপড়ে সেই রাত্রি গুলি। তখন ঘুমাতাম দিদিভাই’এর সঙ্গে। আলাদা কোঠায়। তথাপি রাত্রি এগারোটার পরে আলো জ্বল্লে বাবা’র ধমক খেতে হতো। ফলে আল জ্বালানোর উপায় ছিলোনা। দিদিভাই’কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দলে টানা গিয়েছিল। ফলে হ্যারিকেন জ্বেলে মেঝেতে শুয়ে গিলতাম ছবি গুলি। অক্ষর গুলি। সেই লন্ঠনের কারসাজিও যখন ধরা পরে গেলো বাবার কাছে তখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে, তার আড়ালে টর্চ্চ জ্বেলে চললো পড়া ...
আঁশ্ শেওড়ার পাতা থেকে টিনের চালে ঝরে পরছে শিশির। কোন্ অচেনা রাতপাখি উড়ে এসে একটু বিশ্রাম নিতে বসেছে টিনের চালে। শব্দ পাচ্ছি তার। আর ছবিতে, অক্ষরে ভেসে মনে মনে তখন ঘুড়ে বেড়াচ্ছি শেরউড্ বনের আনাচে কানাচে। এযেন সেই দুঃসাহসী শংকরের সঙ্গে ‘চাঁদের পাহাড়’ এর সন্ধানে আফ্রিকার অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া। কে বলবে বিভূতিভূষণ দেখেননি আফ্রিকা? কে বলবে ময়ূখ চৌধুরি’ ছিলেননা ব্রাজিলের বনে, আলেকজান্ডারের ছাইনিতে বা প্রস্তর যুগে, মানুষের আদিমতম অস্ত্র উদ্ভাবনের দিনটিতে? ময়ূখ চৌধুরির রেখা গুলির দিকে আজো চেয়ে থাকি অপার বিস্ময়ে। সাদা-কালো’র আশ্চর্য ব্যবহারে আলো অন্ধকারের যে ইঙ্গিত তাঁর ছবিতে তেমন আর খুব দেখেছি বলে মনে পড়েনা। ‘টিনটিন’ এর শ্রষ্টা হার্জের ‘ডিটেল্’ নেই ময়ূখ চৌধুরিতে ঠিক যেমন নন্দলাল বসু’র ছবিতে নেই পাশ্চাত্য শিল্পীদের মতো ডিটেল্, অথবা বিভূতিভূষণ কদাপি থমাস্ মানের মতো চরিত্রদের জুতো জামার বর্ণনা দেননি কোথাও। তথাপি, সামান্য একটি রেখার সামান্য সরল ও বক্র গতিতে ময়ূখ চৌধুরি, প্রায় নন্দলালেরি মতো আমাদের কল্পনাকে দিতে সক্ষম হয়েছেন এমন এক ডানা,যে, আমরা অবলীলায় পার হয়ে গেছি ‘টাইম্ এন্ড্ স্পেস্’এর সমূহ বাধাকে।
‘কিশোর ভারতী’র নিয়মিত গ্রাহক ছিলাম না আমি। ‘কিশোর ভারতী’র আসা ‘শুকতারা’ থেকে আরেকটু অনিয়মিত ছিল। আসতো মনিময়’দের বাড়ি। কোনো এক শারদীয়া ‘কিশোর ভারতী’তেই প্রকাশিত হয়েছিল ময়ূখ চৌধুরি’র ‘হুল’ । সাঁওতাল বিদ্রোহের পটভূমিতে ঐ’যে ছবিতে গল্প তাতেই আমার প্রথম ‘বড়দের কবিতা’ পড়া – “ এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/ এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না / এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না / আমার দেশ কে আমি ফিরে কেড়ে নেবো / বুকের মধ্যে টেনে নেবো কুয়াশায় ভরা বিকাল’ ... এই পংক্তি গুলি আজো ভুলিনি। ভুলিনি ঐ ছবিতে গল্পেরি অন্যত্র থাকা এই পংক্তি গুলিওঃ ‘নীল আমি ছুঁয়ে আছি শতচ্ছিন্ন কবন্ধ স্বদেশ/ ধান, মৃত্যু, জন্মঋণ / নীল আমি ছুঁয়ে আছি আদিবাসী ধনুকের ছিলা / নীল, তোর স্পর্শে আমি রক্তমুখী নীলা ...’
এইতো সেদিন, আমার দশ বছরে পা দেওয়া ছেলে, ময়ূখ চৌধুরি’র ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ পড়ে আমাকে এসে বলবো ‘বাবা, আমাকে এই কবিতাটা শিখিয়ে দাও ...’ কোন কবিতা? ‘এখনি অন্ধ বন্ধ করোনা পাখা’ ... বিদ্যাসাগরকে নিয়ে ছবিতে গল্প ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’এ, নানা স্থানে ময়ূখ চৌধুরি উদ্ধৃত করেছেন এই কবিতাটি ।
আমার মনে আসছে হালের দার্শনিক (?) তথা ঔপন্যাসিক Umberto Eco’র The Mysterious Flame of Queen Loana উপন্যাসটির কথা যেখানে তিনি কাহিনীর প্রোটাগোনিষ্টের অবচেতনের গহনে আমাদের নিয়ে গিয়ে জানিয়েছেন এই সত্য, যে, মূলতঃ পাঠ্য পুস্তক নয়, আমাদের সৎ-অসৎ ভালো-মন্দের প্রথম বোধটি মূলতঃ জন্ম নেয় তার পারিপার্শ্বের ‘pop culture’ এর অবচেতন-বিশ্লেষণের মাধ্যমেই। ... ঠিক যেমন ইন্দ্রজাল কমিক্সের অরণ্যদেবের কাছে আমরা প্রথম শিখেছিলাম দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের সত্য, দেখেছিলাম ‘শিষ্ট’ আর ‘দুষ্ট’র সংজ্ঞার ইঙ্গিতও। তা’ই আবার ফিরে জানা গিয়েছিল ‘শেরউড্ বনের রবিনহুড্’ এর ছবিতে, অক্ষরে। হাজার পাতা ইতিহাস বই পড়িয়েও আমার দশ বছরের ছেলের মর্মে বিদ্যাসাগর ও তাঁর অবদানকে ততোটা জীবন্ত করা যেতোনা যতোটা করে দিলেন ময়ূখ চৌধুরি তাঁর ঐ ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ নামের ছবিতে গল্পে।
ঐ সময় ‘আনন্দমেলা’ ক্রমে নিজের জায়গা করে নিচ্ছিল ‘শুকতারা’, ‘কিশোর ভারতী’র পাশাপাশি। ‘পক্ষীরাজ’ তখনো প্রকাশিত হচ্ছে মনেহয়। তবে খুব কম আসতো। ‘সন্দেশ’ও না আসার মতোই। ‘আনন্দমেলা’য় গল্প, ছবিতে গল্প সবই থাকতো তবে ছবিতে গল্পের ক্ষেত্রে বিমল দাস (?) এর আঁকায় শরদিন্দু’র ‘সদাশিব’ ছাড়া বহুদিন কোনো মৌলিক ছবিতে গল্প প্রকাশিত হয়নি। টিন্টিন, রোভার্সের রয়, গাবলু ( Henry) , বাঘা ( Tiger) সবই ছিল বিদেশী ছবিতে গল্প বা কমিক্সের অনুবাদ। টিন্টিনের অনুবাদ করতেন তৎকালীন সম্পাদক নীরেন চক্রবর্তী নিজে ফলে সেগুলো ‘অনুবাদ’ না হয়ে হয়ে উঠতো নতুন সৃষ্টি। ‘কালো সোনার দেশে’তে ‘Boom! One day, your car goes "Boom"! Don't just give up in gloom, call Autocart To the rescue’ র বাংলা করতে নীরেন চক্রবর্তী লিখেছিলেনঃ গাড়ি হলে দুম্ ফট্, ডেকে পাঠাও চট্পট্ অটোকার্টো’কে ...’
২।
কথা বলার ঝোঁকে আর স্মৃতির টানে চলে এসেছি অনেকদূর। বলতে বসেছিলাম ময়ূখ চৌধুরি’র কথা, চলে এলাম ‘গাড়ি হলে দুম্ ফট্’ এ ... আসলে এটাই স্বাভাবিক। ময়ূখ চৌধুরি, নারায়ণ দেবনাথ, হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে যেহেতু আমাদের শৈশবেরি নামান্তর সুতরাং এর একটা কিছু নিয়ে ভাবতে বসলে, লিখতে বসলে অন্যটা, অন্যরা চলে আসে অবলীলায়...
এই কথাগুলো মনে জমে ছিল অনেকদিন। তবু লেখা হয়ে উঠছিল না। এবার বলি কি’করে লেখা হয়ে উঠলো, এখন, সেই গল্প।
ই-কমার্স্ এর দৌলতে, বলা ভালো, ‘ফ্লিপ্কার্ট’ নামক অন্লাইন্ শপিং সাইটটির দৌলতে সেদিন হাতে পেলাম একটি অনন্য বই। যদিও ফ্লিপ্ কার্টের সাইটে বইটি আছে দেখে এবং মলাটের ছবিটি দেখেই ঐ গুম্ গুম্ শব্দটা বেজে উঠেছিল বুকের ভেতর তবে তখনো জানিনা যে বইটি হাতে পাওয়া মাত্র আমার যে ঘটেযাবে এমন জন্মান্তর।
বইটা হাতে পেয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে যে অনুভবটা প্রথমেই হলো তা হচ্ছে একটি প্রণাম। একটি কৃতজ্ঞতা। কার কাছে? তাঁর কাছে, তাঁদের কাছে যাঁরা এমন যত্ন করে দায়িত্ব নিয়েছেন আমাদের হারানো শৈশব’কে ফিরিয়ে দেওয়ার, তাঁর কাছে, তাঁদের কাছে। হাতড়াতে হাতড়াতে দেখি এক জায়গায় প্রকাশকের ফোন নাম্বারটিও দেওয়া আছে। প্রায় ভূতগ্রস্থের মতো ডায়াল করলাম ঐ নাম্বার।
‘হ্যালো’
‘হ্যালো, আচ্ছা এটাকি লালমাটি’ প্রকাশনা’র নিমাই গরাই’এর নাম্বার?’
‘হ্যাঁ, বলছি’
‘ও, নমস্কার। আমি বেঙ্গালোর থেকে বলছিলাম। আমার নাম ... । মানে, ইয়ে, আপনাদের প্রকাশিত ‘ময়ূখ চৌধুরি’র কমিক্স্-সমগ্র’র প্রথম খন্ডটা হাতে পেয়ে ... মানে দেখুন আমি সদ্য চল্লিশ ছুঁয়েছি ... আমাদের শৈশব তো ঐ ছবি, ঐ গল্প গুলোর কাছে বাঁধা দেওয়া ... তাই ... মানে ... ভাবলাম আপনাকে একটা অভিনন্দন জানাই ... মানে... এরকম কাজ ...মানে ... এতো যত্ন নিয়ে ... তাছাড়া এতো খরচ সাপেক্ষ...’
‘আরে ভাই, খরচ টরচের কথা বাদ দিন। ও সব তো আছেই। কিন্তু এ’ই যে আপনি ফোন করলেন, এগুলোই তো পাওয়া, এগুলোই তো চলার পথের পাথেয় বললে পাথের, প্রেরণা বললে প্রেরণা, উৎসাহ বললে উৎসাহ।।‘
‘ঠিক। ঠিক’ ... তারপর? তারপর কি বলবো ঐ মানুষটিকে যিনি আমাদের শৈশবকে তো এনেই দিয়েছেন আশ্চর্য দুই মোড়কে এতদ্ভিন্ন ময়ূখ চৌধুরি, এই বিস্মৃত মহা-শিল্পী’কে এনে হাজির করেছেন সর্ব সমক্ষে? তবু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আরো কিছু সময় শুনতে ইচ্ছে করছে ঐ কন্ঠস্বর। কেন? কেননা তিনি দুঃসাহসী। কেননা তিনি পথিকৃৎ। তাঁর আগে কেই এই কথাগুলি ভাবেনি তেমন করে। নন্টে-ফন্টে ইত্যাদি চটি বই হয়ে বাজারে বেড়িয়েছিল, ঠিক, কিন্তু সে গুলিতে ভালবাসা থেকে ব্যবসার গন্ধটাই যেন বেশী ছিল।
“ “আমরা, জানেনতো, লীলা মজুমদারেরো সমগ্র করেছি?””
“ “ হ্যাঁ হ্যাঁ ইন্টারনেটে দেখলাম ...””
“ “ দেখুন, আমরা তো আর তেমন বড় প্রতিষ্ঠান নই, যা করি, যতোটুকু করি, ভালবেসে করি আর তা যখন আপনাদের মতো মানুষের কাছে পৌঁছায় আনন্দ পাই ...””
“ “ আমার ছেলেওতো ময়ূখ চৌধুরির খুব ভক্ত। নারায়ণ দেবনাথেরো। নারায়ণ দেবনাথ’কে কখনো মুখোমুখি দেখা ওর একটা অব্সেশান্””
“ “ আরে সে কি কথা! আমাকে বল্লেননা কেন? আমি দিতাম দেখা করিয়ে...””
““ দাদা, আপনার নাম্বারটা তো আজই পেলাম ...এখনি পেলাম””
““ও হ্যাঁ, ঠিক ঠিক, তবে কলকাতায় এলে এবার সোজা বৌ বাচ্চা নিয়ে আমার এখানে চলে আসুন। ওকে আমি নারায়ণ দেবনাথের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো ...’”
আরো কিছু কথা হলো। এলোমেলো। মনে পড়ছেনা এখন। আসলে ততোক্ষণে আমি ভেসে গেছি। হ্যাঁ, সঠিক মানুষই করছেন সঠিক কাজটা। মারাত্মক ভালবাসা না থাকলে যেমন সৃষ্টি করা যায়না ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ বা ‘খাপে ঢাকা তলোয়ার’ হেন ছবি, গল্প বিশেষতঃ ঐ গুলি থেকে যখন তেমনটা উপার্জনও হতোনা শ্রষ্টার তেমনি মারাত্মক ভালবাসা না থাকলে এমন বইগুলি প্রকাশের সাহসও যায়না করা।
এই সংকলনটি ‘লালমাটি’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে। কলকাতা বই মেলায়। রয়েছে মোট তেত্রিশটি ছোটো বড়ো ছবিতে গল্প। রয়েছে নারায়ণ দেবনাথের আঁকা ময়ূখ চৌধুরি’র একটি ছবি। এই স্বপ্ন-কথকটির চেহারা কেমন ছিল এ নিইয়ে কতো জল্পনা কল্পনা করেছি একটা সময়। ‘খাপে ঢাকা তলোয়ার’, ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ আর ‘শেরউড্ বনের রবিনহুড’ পড়ে আমার ছেলে আমাকে বলেছে ইন্টারনেটে খুঁজে দেখতে তাঁর চেহারা। না। নেই। কোথাও নেই। না, তাঁকে মনে রাখেনি কেউ। তাঁদেরকে মনে রাখেনি কেউ। আশ্চর্য, কয়েকটা গোটা প্রজন্ম যাঁদের রেখা আর লেখার ছায়ায় বেড়ে উঠলো তাঁরাই হারিয়ে গেলেন এমন ভাবে? মনে এলো আরেকটি নাম রবিদাস সাহা রায়। তা’ও শেষ পর্যন্ত তাঁকে কি একটা পুরষ্কার না’কি দিয়েছে পচ্ছিমবঙ্গ ছোক্কার, কিন্তু ময়ূখ চৌধুরি’র সেসব কিছুই জোটেনি। নারায়ণ দেবনাথ এখনো জীবিত। দেখাযাক তাঁকে কিছু দেয় কি’না এই পচ্ছিমবঙ্গ ছোক্কার ...
‘ময়ূখ চৌধুরি’র কমিক্স্ সমগ্র প্রথম খন্ড’তে তিনটি ভূমিকা। তিনটিই অনবদ্য। সম্পাদক বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায় ছবিতে-গল্প এই জেনারটি এবং তাতে ময়ূখ চৌধুরি’র ভূমিকার কথা লিখেছেন। দেবাশিস সেন লিখেছেন মানুষ ও শ্রষ্টা ময়ূখ চৌধুরি ও তাঁর সৃষি নিয়ে। এই লেখাটিতে জানা যায় ময়ূখ চৌধুরি’র প্রকৃত নাম শক্তিপ্রসাদ রায় চৌধুরি, জানাযায় প্রসাদ রায়, সূত্রধর গুপ্ত, আত্মনাম গুপ্ত ও রাজা রায় ছদ্মনাম গুলি তিনি নিয়েছিলেন ‘ময়ূখ চৌধুরি’ নামটি নেওয়ার আগে। তবে আমাকে সবচেয়ে আকূল করেছে আমার আরেক প্রিয় শিল্পী চন্ডী লাহিড়ি লিখিত ভূমিকাটি। তাঁর ভূমিকা’র শেষে চন্ডী লাহিড়ি লিখেছেনঃ ‘এই হতভাগ্য দেশে কার্টুন শিল্পীরা জীবদ্দশায় স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখেননি। ‘হা অন্ন’ করেই তাঁদের দিন কেটেছে। আজ সেই দুর্ভাগারা আর কিছু পান না পান একটু মর্যাদা কি পেতে পারেন না! দেশের শিশুদের মনে তাঁরা আনন্দ জুগিয়েছেন। সার্কাসের ক্লাউন তবি খেতে পান, দু-বেলা বেতন পান। একজন কার্টুনিস্ট সেই সামান্য বেতন বা মজুরি জীবদ্দশায় পাননি। এখন গ্রন্থাকারে বই ছাপা হওয়ায়, আমার ধারণা, নিমাইবাবু তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদার কিছুটা দিলেন। এজন্য এই পরিণত বয়সে, আমি ব্যক্তিগত ভাবে আনন্দিত’।
হ্যাঁ, আমিও আনন্দিত আমার হারানো শৈশবকে ফিরে পাওয়ার জন্য, আনন্দিত একজন দুঃসাহসী বন্ধুকে পাওয়ার জন্য যাঁর মশালের আলোর উজ্জ্বল হয়ে উঠছে অতীরের অন্ধকার। আমার মনে আসছে ময়ূখ চৌধুরি’র উদ্ধৃত সেই পংক্তিগুলিঃ ‘এখনি অন্ধ বন্ধ করোনা পাখা’ আর মনে আসছে সেই কাহিনীর নাম যাতে উদ্ধৃত হয়েছিল পংক্তিগুলি ... পাঠক, ঐ ছবিতে গল্পটির নাম ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ ... পাঠক, ময়ূখ চৌধুরি নিজেও কি নন অমনি আরেকটি মৃত্যুহীন প্রাণ? ...
২৭/০৬/২০১২