‘যবন না আমি কাফের ভাবিয়া’কবি নজরুল
ইসলাম’কে আবর্তনের একটি প্রচেষ্টা
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
১।
না
রবীন্দ্রনাথ থেকে হেঁটে গিয়ে নজরুলকে ছোঁয়া অসম্ভব। অসম্ভব কেননা ‘শ্রষ্টা’ এই প্রাথমিক
প্রস্থানবিন্দুটির থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের উড্ডয়ন পথ সম্পূর্ন
বিপরীত না হলেও বিভিন্ন । রবীন্দ্রনাথ যেখানে আমরন
‘ দেবতারে
প্রিয় করি / প্রিয়রে দেবতা’র সাধনায় নিরত সেখানে নজরুলের যাত্রা যেন, মূলতঃ, সেই
রক্তমাংসের প্রতিমাটির দিকে যার অন্বেষন তাঁর অক্ষরে মূর্ত্ত হয় এইভাবেঃ ‘আমি যার
নূপুরের ছন্দ বেণুকার সুর, কে সেই সুন্দর কে ...’ ... তবে সেই
সুন্দরের সন্ধান কখনোই নয় একমাত্রিক –
তবে সেইসব
কথায় যাওয়ার আগে আমার একটি অতি ব্যক্তিগত অনুভব এখানে বলেনিই... আমি ব্যক্তিগত ভাবে
রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলকে পাশাপাশি রেখে বা একের আলোতে অন্যকে বিচার করার সম্পূর্ণ
বিরোধী কেননা মোটামোটি একই সময়ের আবর্তে জন্মানো ছাড়া এর অন্য কোনো যুক্তিগ্রাহ্য
কারনই নেই। জীবনযাত্রা, সামাজিক অবস্থান এবং তারি কারনে ভাব, ভাবনা, ভাষা উভয়ের
ক্ষেত্রে সম্পূর্ন বিভিন্ন। অতএব এঁদের একের নিরিখে অন্যকে বিচার বা আলোচনা
করার যতো প্রচেষ্টা, এতাবৎ, সবই আমার কাছে অনর্থক। আমার
কাছে নজরুল ‘এ ক্লাস্ বাই হিম্সেলফ্’।
এখন ফিরে
যাই ঠিক যেখান থেকে আরম্ভ করেছিলাম সেখানে। যেখানে বলেছি নজরুলের যাত্রা যেন, মূলতঃ, সেই
রক্তমাংসের প্রতিমাটির দিকে যার অন্বেষন তাঁর অক্ষরে মূর্ত্ত হয় এইভাবেঃ ‘আমি যার
নূপুরের ছন্দ বেণুকার সুর, কে সেই সুন্দর কে ...’ ... তবে সেই
সুন্দরের সন্ধান কখনোই নয় একমাত্রিক ... এবার দেখি, দেখার
চেষ্টা নিই নজরুলের সেই বহুমাত্রিক গমনপথের ইশারা রেখাটি ...
২।
নজরুল
ইসলামের সঙ্গে আমারো প্রথম পরিচয়, আরো অনেকের মতোই, তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির
মাধ্যমে, অন্য অনেকের মতোই কাজী সব্যসাচীর সেই যাত্রা ঢঙ্গের
আবৃত্তির মাধ্যমেও বটে। আজ টের পাই সব্যসাচীর ঐ
বিকৃত ‘আবৃত্তি’ তে প্রথমবার
না শুনলে কবিতাটিকে হয়তো এতো সহজে ভুল বুঝতামনা। ইস্কুল জীবনের শেষে যখন বু.ব অর্থাৎ
‘বুদ্ধদেব বসু’ পড়ে ক্রমে ‘আধুনিক’ ও ‘শিক্ষিত’ হতে আরম্ভ করলাম তখন তাঁর পরানো
ঠুলির দৌলতে বাল্যকালের ভালোলাগা যেসব প্রকৃত কবিদের নাম বাদ গেলো সিলেবাস থেকে
তাঁদের মধ্য অন্যতম নজরুল আর সত্যেন দত্ত। বুদ্ধদেবের কু শিক্ষা পার হয়ে এঁদের
দুজনকেই আমার পুনরাবিষ্কার করতে লেগেছে অনেকটা সময়। তবে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আগেই
যে নজরুলকে পুনরাবিষ্কার করেছিলাম বা বলা উচিত করার পথে পা বাড়িয়ে ছিলাম তার মূল
কারন নজরুলের গান যা বুদ্ধদেবের চোখ রাঙ্গানি সত্ত্বেও কোনোদিনই পারিনি একেবারে
বাদ দিতে। নিজেদের রচনাকে গান আর সুরের আঙ্গিকে প্রকাশ করে গিয়েছিলেন বলেই আরো দুই
মহাপ্রতিভা অতুলপ্রসাদ আর রজনীকান্ত সেন, যদিও বু.ব’র
সাট্টিফিকেটহীন, তথাপি মর্মে ছিলেন সেই প্রথম থেকেই।
যদিও আমার মর্মে নজরুলের পুনরাবিষ্কারের প্রাথমিক সূত্র ছিল তাঁর গান, তথাপি
তাঁর কবিতা, এই ‘বিদ্রোহী’ নামক মহাকবিতা, যা কবি গৌতম চৌধুরির মতে ‘বু.ব’র পরানো ঠুলিতে না দেখতে পাওয়া আরেক ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ ...’ আমাকে
সাহায্য করলো নজরুলের সৃষ্টি আঙ্গিককে আরো নিবিড় করে অনুভব করতে।
এবারে যাত্রা করা যাক সেই মহাকবিতাটির ছায়া লক্ষ্য করে ...
৩।
কথিত আছে যে মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ আমক একটি ‘গদ্য কবিতা’ মোহিতলাল
শুনিয়েছিলেন নজরুলকে আর সেই রাত্রেই নজরুল এসে সারারাত্রি জেগে লিখেছিলেন কবিতাটি।
সম্ভবতঃ পরদিন সকালে মোজাফফ্র আহমেদ’কে প্রথমে পড়ে শুনিয়েছিলেন রচনাটি। মোহিতলাল মজুমদার আমার
একজন শ্রদ্ধেয় কবি ও ভাবুক। তবে তাঁর ‘আমি’ নামক রচনাটি আমার পড়া নেই বা তাঁর এমন
কোনো গদ্য বা কবিতাও আমার পরা নেই যাকে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উৎস বলে ধরে
নিতে পারি। তবে একথা বারবারই মনেহয় যে ‘আমি’ নামক রচনাটি যদি প্রকৃতই এমন
ক্ষমতাবান রচনা হয়ে থাকে তবে তা হারিয়ে গেলো কেন? নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র পাশাপাশি ঐ
রচনা কেন স্থান পেলোনা আপামর নাহোক অন্ততঃ মুষ্টিমেয় পাঠক মানসেও? আর যদি এ’ও ধরে
নেওয়া যায় যে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র আঁতুড় ঘর মোহিতলালের কোনো একটি রচনা তাহলেও
কবিতাটির স্বাতন্ত্র ঠিক সে কারনেই লাঘব হয়না যে কারনে থমাস্ কীডের ‘স্পেনিস্
ট্রেজেডি’ ও তৎকালীন আরো নানান কিছুকে উৎস হিসেবে নিয়েও “হ্যামলেট” বা সেক্সপীয়ার
আরো বহু রচনাই স্বতন্ত্র সেক্সপীয়ারের প্রতিভার স্বাক্ষরহেতু।
কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’ হলেও কবিতার রচনাশৈলীতে কোনো ছদ্ম বিদ্রোহ ছিলোনা
নজরুলের। কুষ্মান্ডেরা তাঁর আরবী-ফারসী-হিন্দি শব্দ প্রয়োগের কুতর্কের অবতারনা
করলে আপাততঃ এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কেননা ঐ সব কথা বু.ব’রা তুলেছিলেন, ‘কবিতা’ পত্রিকার নজরুল সংখ্যা, যা নজরুলের মৃত্যুর পরে
প্রকাশ করেছিলেন বু.ব, তাতেই এবং আরো অনেকেই খন্ডনও করেছিলেন সেইসব। সহজ কথায়,
আমার কাছে, কবিতায়-গদ্যে, আরবী-ফারসী-হিন্দি-পুস্তু যেকোনো ভাষার শব্দ যে কোনো
ভাষার শব্দের পাশাপাশি ব্যবহৃত হতে পারে যদি সেই ব্যবহার বাক্যটিকে ধর্ষন না করে।
শুধু ‘বিদ্রোহী’ কেন নজরুলের অন্য কবিতা বা গানেও আরবী-ফারসী-হিন্দি শব্দের
ব্যবহারকে, অন্ততঃ আমার কাছে, মনে হয়নি শ্রুতি বিদারক। অতএব আমার ধারনায় কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’ হলেও কবিতার
রচনাশৈলীতে কোনো ছদ্ম বিদ্রোহ ছিলোনা নজরুলের। কবিতাটি চলে বিশুদ্ধ ছন্দে এবং
শৈলীগত ভাবে বিশুদ্ধ শেলী-কীট্স্ এমনকি বায়রনীয় রোমান্টিকতার সূত্র ধরেই। ‘বিদ্রোহী’
কবিতার গমনগতি ও গমনভঙ্গী আমাকে মনে করায় শেলীর ‘ওড্’ গুলি, ‘ওড্ টু দ্য ওয়েষ্ট
উইন্ড্’ বিশেষতঃ। যদিও বহুদূর শ্লথ ও সঞ্চারী তথাপি এই গমনগতি ও গমনভঙ্গীর ছায়া
যেন পাই রবীব্দ্রনাথের ‘বলাকা’ কবিতাগ্রন্থে, খুব বেশী করে ‘বলাকা’ ( ৩৬ সংখ্যক
কবিতা) নামের কবিতাটিতে ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘আমি’ ( ‘আমারি চেতনার রঙ্গে
...’)র কোথাও টের পাই নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ ...
তাহলেও ঐ টের পাওয়া টুকু যতোনা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাদৃশ্যকে সূচিত
করে তার চেয়ে ঢের বেশী সূচিত করে তাদের বৈপরীত্য কে। ‘চেতনার রঙ্গে’ই যে পান্না
সবুজ তা’যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতারো মূল উপজীব্য সে কথা আজ, বু.ব’র ঠুলি চোখ থেকে খুলিয়ে পাঠককে দেখানোর প্রয়াস দুরয়হ হলেও অসাধ্য নয় মোটেই।
‘বিদ্রোহী’তে যে ঘোষনা তা ঐ ‘আমি’রই ঘোষনা তা কোনো বন্দুকবাজ, বহিরঙ্গের
‘বিদ্রোহী’র ঘোষনা নয় ( ঐ কথাটি ধরতে না পারার জন্যই কবিতাটি ‘আবৃত্তি’ করতে গিয়ে
সব্যসাচী’কে এরকম গর্ধভহেন চীৎকার করতে হয়)। এ মূলতঃ আবহমানের মানবসত্তাকে অকস্মাৎ
আপনার মধ্যে আবিষ্কারের সে’ই ঘোষনা যা বহু মার্জিত ভাবে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘আমি’
তে, যা আরো প্রবলতর আবেগে ঘোষিত হয়েছিল তাঁর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ পর্বেঃ
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমন পশিল প্রাণের ‘পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ!
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।
কেমন পশিল প্রাণের ‘পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ!
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।
যে সময়ের কথাপ্রসঙ্গে, পরে, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ এটা হচ্ছে সেদিনকার কথা যেদিন অন্ধকার থেকে আলো এল বাইরের,
অসীমের। সেদিন চেতনা নিজেকে ছাড়িয়ে ভূমার মধ্যে প্রবেশ করল। সেদিন কারার দ্বার খুলে বেরিয়ে পড়বার জন্যে,
জীবনে সকল বিচিত্র লীলার সঙ্গে যোগযুক্ত হয়ে প্রবাহিত হবার জন্যে অন্তরের মধ্যে তীব্র ব্যাকুলতা। সেই প্রবাহের গতি মহান বিরাট সমুদ্রের দিকে।
এই ‘ভূমা’টি আরো স্পষ্ট তাঁর ‘আমি’ তে। পক্ষান্তরে নজরুলের
ঐ ‘ভূমা’টি যেহেতু ছিলোনা ‘বৈদিক’ ফলে ‘বিদ্রোহী’ তে নেই সেই বৈদিক বর্ণনাঃ
ও দিকে
, অসীম যিনি তিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা
মানুষের
সীমানায় ,
তাকেই
বলে ‘আমি' ।
সেই
আমির গহনে আলো
- আঁধারের ঘটল সংগম
,
দেখা
দিল রূপ , জেগে উঠল রস ।
‘ না'
কখন ফুটে উঠে হল ‘হাঁ'
মায়ার মন্ত্রে ,
রেখায় রঙে সুখে দুঃখে ।
‘বিদ্রোহী’তে
বা সমগ্র নজরুলেই এ’ই যে বৈদিক ধ্যান ধারণার অনুপস্থিতি এতে বহু পাঠক অখুশী, আবার
খুশিও বহু পাঠক। অখুশীর দলের ভাবটা এ’ই যে নজরুলের কবিতায় ‘ফিলস্ফি’ নেই। কাজেই
‘বাদ্ দাও, ওসব কেবল আবেগের অমার্জিত লাফালাফি’। আর যাঁরা এই বৈদিক ধ্যান ধারণার
অনুপস্থিতিতে খুশি তাঁরা নজরুলকে ঠেলে ঠুলে ‘মাওবাদী’ প্রমাণ করেই ছাড়তে প্রস্তুত।
কিন্তু না’ত নজরুল ‘বৈদিক’ , না’ত তিনি মাওবাদী। ‘আমি’ বা ‘আত্মা’র যে স্বরূপ
‘বিদ্রোহী’তে প্রকাশিত তার কূল দ্বান্দিক বস্তুবাদ পায়না। বরং বেদ-উপনিষদ ঐ
স্বরূপের কথা জানে। তবে জানার পরে যেখানে ‘ভূমা’র অবতারনা করে বেদ-উপনিষদ,
রবীন্দ্রনাথ যার ছায়ার বলেন ‘আলো আঁধারের সঙ্গম’এর কথা সেখানে গিয়ে নজরুল বলেনঃ
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
এই ‘কুর্নিশ’ না করা কিন্তু আবার বোদ্লেয়ারীয় ‘নিহিলিজম’
নয়। এখানে আপনার গহনের যে ভান্ডার তাকে আবিষ্কার করেই কবি ‘বিদ্রোহী’। জীবনের
যাপনের যে ‘আইন’ তাকে তিনি অস্বীকার করেন মহাজীবনের আশীর্বাদে। ফলে আপনার গহনে
তিনি দেখেননা বোদ্লেয়ারীয় অন্ধকারঃ
I'm
like the King of some damp, rainy clime,
Grown impotent and old before my time,
Who scorns the bows and scrapings of his teachers
And bores himself with hounds and all such creatures.
* * * * * * *
Can't warm this skeleton to deeds of slaughter,
Whose only blood is Lethe's cold, green water.
Grown impotent and old before my time,
Who scorns the bows and scrapings of his teachers
And bores himself with hounds and all such creatures.
* * * * * * *
Can't warm this skeleton to deeds of slaughter,
Whose only blood is Lethe's cold, green water.
( Spleen,
Charles Baudelaire, Tr.Roy Campbell, Poems of Baudelaire (New York: Pantheon
Books, 1952)
৪।
যেহেতু বৈদিকতার ছায়া নেই, নেই বোদলেয়ারীয় ‘নিহিলিজম্’ এর ছায়াও, যেহেতু
আপনার গহনে তাকিয়ে নজরুল বলেননা ‘ বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুদিত যৌবন ...
রক্তের আরক্ত লাজে লক্ষবর্ষ-উপবাসী শৃঙ্গার কামনা / রমনী-রমণ-রণে পরাজয়-ভিক্ষা
মাগে নিতি’ ( বন্দীর বন্দনা বু.ব) – অতএব বু.ব’র শুধু নয় তৎকালীন এবং এইকালীন বহু পাঠকের কাছেই নজরুল অদ্যাপি ব্রাত্য। তবে
নিজের অবস্থানের ব্যাপারে নজরুলের ধারনা ছিল খুবই স্পষ্ট নাহলে এমন অবলীলায় এই কথা
বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো কিঃ
বর্তমানের কবি আমি ভাই,
ভবিষ্যতের নই
‘নবী’,কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!
কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারে চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
এ’ই যে ‘যবন না আমি কাফের ভাবিয়া’ ... এ’ই নজরুলের প্রকৃত অবস্থান। তাই তাঁর গহনে ‘ভোর হলো ওঠ্ জাগ্ মুসাফির আল্লা রসুল বল্’ থেকে ‘ আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ এমন জাগ্রত রূপ পারে পরিগ্রহ করতে। এখানে এসে এ’ও টের পাওয়া যায়, যে, রূপের যে ‘নিরাকার রূপ’টি ‘ব্রহ্ম’, সেখানে এসে রক্ত-মাংস-পাঁপড়ি-পরাগের ‘রূপ’এ মুগ্ধ নজরুল কেন ততোটা আশ্রয় পান না, কেন তাঁকে বার বার, গানে অন্ততঃ, ফিরে যেতে হয় ‘সাকার’ কালী, কৃষ্ণ ইত্যাদির দিকে। জন্মসূত্রে ‘নিরাকার’এর সাধক হয়েও ‘সাকার’ এর দিকে মর্মের এই আহ্বানটি টের পেয়েইকি তাঁকে বলতে হয় যে ‘যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি নাড়ি কাছা’ ?
৫।
কথা বাড়ানো যায় অনেক। আরো অনেক যুক্তি, উদাহরন টেনে আনা যায়। নজরুল সম্বন্ধে
বু.ব’র আরো অনেক অমূলক, চালাক বক্রোক্তির ফিরিস্তি দিয়ে খন্ডন করা যায় সেগুলো। কিন্তু
সেই সবই অবান্তর যদি এই সত্য টুকু বুঝে নেওয়া যায়, যে, নজরুল প্রকৃতার্থেই একটি
স্বরচিত শ্রেণীর কবি ও মানুষ যাঁর কাছে ‘রূপ’ই ছিল শেষ কথা। তাই ‘প্রিয়’কে দেবতা
করার পরিবর্তে ‘দেবতা’কেই ‘প্রিয়’ করে তোলেন নজরুল। বলেনঃ
সংসারে মোর
মন ছিলোনা তবু মানের দায়ে
আমি ঘর
করেছি সংসারেরি শিকল বেঁধে পায়ে,
শিক্লী
কাটা পাখি কি আর পিঞ্জরে সই ফিরে?
বলিস্
ননদীরে, সই বলিস্
ননদীরে।।
বলিস গিয়ে
কৃষ্ণ নামের কলসী বেঁধে গলে
ডুবেছে রাই
কলংকিনী কালীদহের জলে,
কলংকেরি পাল
তুলে সই চল্লেম অকূল পানে –
নদী কি আর
থাকতে পারে সাগর যখন টানে,
রেখে গেলাম
এই গোকুলে কূলের বউ-ঝি রে ...
না, এই গানে দেহ’ থেকে
দেহোত্তর কোনো সত্যের দিকে গমনের কোনো ইঙ্গিত নেই, নেই তেমন কোনো প্রয়োজনও।
এই প্রেম পাগলিনী পদাবলীর ‘রাই’ কি’না এ নিয়ে আলোচনা বা
তর্কে যাওয়াও অবান্তর। এই ‘রাই’ সে শরীরিনী ‘রাই’ যে দেহে, মনে কাউকে
ভালবেসেছে, যাকে ভালবেসেছে সে যে ‘শ্রীকৃষ্ণ’, সে’যে ‘বিশ্বরূপ’ এমনও ভাবার
কোনো হেতু নেই। সে একজন পুরুষ। তাকেই ভালবেসে এই ‘রাই’ জেনেছে যেঃ
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! -আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে
সব বাঁধ!
আর তা’ই সে চলেছে
ঐ ‘কৃষ্ণ’ নামের কলসী
নিয়ে কালীদহে ডুবে মরতে। হ্যাঁ, ঐ ‘ডুবে মরা’র মতো’ আকূল
প্রেমের মর্মে আছে যে টুকু স্পর্শ, অরূপের, ঐ অরূপের
কাছেই নজরুলের আত্মনিবেদন। ঐ খানে তিনি নন কোনো বহিরঙ্গের ‘বিদ্রোহী’, ঐখানে তিনিও
সাধক, তিনিও
রামপ্রসাদ ।
যে অর্থে
রামপ্রসাদ ব্রাহ্ম নন, যে অর্থে রামপ্রসাদের সাধন পথের সঙ্গে ভিন্ন রবীব্দ্রনাথের
সাধনপথ সেই অর্থেই ভিন্নতা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের। সেখানে অতুলপ্রসাদ বরং
নজরুলের ঢের কাছের মানুষ।