‘অন্ধ পিতা, অন্ধ পুত্র তার...’
যখন এগারো বা বারো কেলাসে পড়ি তখন মা
একদিন বল্লো ‘কি সব সিগারেট খাস্, বাসাময় দুর্গন্ধ করে ...’ একটু থেমেঃ ‘তোর বাবা বলেছে এমন গন্ধ সস্তা সিগারেটে হয়।
খুব কড়া। ক্ষতি বেশী করে। সিগারেট খাবি ত একটু কম খা, কিন্তু দামী জিনিস খা’ – না ধূমপানে
উৎসাহ দেওয়া নয়, মূলতঃ পরাজিত স্নেহের এই আর্তনাদ। অনেকদিন পরে কথাটা মনে পড়লো আজ
অনেকদিন আগে পড়া একটি বই ফিরে পড়তে গিয়ে। সে’ও এক সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া ছেলের
গপ্পো। কিন্তু সেই ছেলে তখনো সিগারেট ধরেনি। তার বাবা তাকে বলছেন তাঁর নিজের কথা।
প্রথমবার সিগারেট খেয়ে ধরাপড়ার গল্প।
“I treat you as
your grandfather treated me when I was a young chap. We were more like brothers than father and son. I’ll never forget
the first day he caught me smoking. I was standing at the end of the South Terrace one day with some maneens like myself
and sure we thought we were grand fellows because we had pipes stuck in the corners of our mouths. Suddenly the
governor passed. He didn’t say a word, or stop even. But the next day, Sunday, we were out for a walk together and when we
were coming home he took out his
cigar case and said: ‘By the by, Simon, I didn’t know you smoked, or something like that. Of course I tried to carry it off as best I could.
If you want a good smoke, he said, try one of these cigars. An American captain made me a present of them last night in
Queenstown.
Stephen
heard his father’s voice break into a laugh which was almost a sob.”
হ্যাঁ। জয়েস্। জেম্স্ জয়েস্। সেই “A Portrait of the Artist as a Young Man”। সেই তাঁর Ulysses এর মুখ্য চরিত্র Shephen Dedalus এর বেড়ে ওঠার গল্প, সেই ডাব্লীন শহর। গ্রন্থটি লিখিত ১৯০৭ থেকে ১৯১৫’র
মধ্যে। যদি ধরে নেওয়া যায় যে এ জয়েসেরি আত্মজৈবনিক কাহন তবে যখন স্টিফেন্’কে তার
পিতা এই কাহিনী শোনাচ্ছেন তখন তার বয়স ১৭-১৮ অর্থাৎ ১৯০০ সালের দিকে আর তার বাবার
জীবনেও এই ঘটনা যেহেতু ধটেছে তাঁর ঐ ১৭-১৮ বছর বয়সেই তাই সেই ঘটনার সময়কাল
১৮৬৮-৭০। স্থান আয়ার্লেন্ড।
বাবার কথার খেই ধরে মা যেদিন
আমাকে বল্লোঃ ‘সিগারেট খাবি ত একটু কম খা, কিন্তু দামী জিনিস খা’ সেটা ১৯৮৯-৯০
সাল। স্থান আসামের প্রত্যন্ত শহর করিমগঞ্জ। ভাবতে গিয়ে মনে এলো সদ্য পঠিত
রাজনারায়ণ বসু’র ‘আত্মচরিত’এর কথাও। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতি প্রিয়, বহুগুনান্বিত,
বাংলার এই দুঃসাহসী রেনেশাঁ চরিত্রের আত্মজীবনিতে পাইঃ ‘ একদা আমি গোলদীঘিতে মদ
খাইয়া টুপভুজঙ্গ হইয়া রাত্রিতে বাটীতে আসাতে মাতাঠাকুরানি অতশিয় বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “আমি আর
কলিকাতার বাসায় থাকিবনা, বোড়ালে গিয়া থাকিব”। পিতাঠাকুর আমার আচরণের বিষয় অবগত
হইয়া আমাকে পরিমিত মদ্যপায়ী করিবার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করিলেন। ... একদিন
সন্ধ্যার পর আমাকে পিতাঠাকুর তাঁহার লিখিবার ঘরে ডাকিলেন। ডাকিয়া ঘরের দরজা বন্ধ
করিয়া দিলেন। আমি বুঝিতে পারিলাম না যে
ব্যাপারটা কি? তাহার পর দেখিলাম, তিনি একটি দেরাজ খুলিয়া একটি কর্কস্ক্রু ও একটি
সেরির বোতল ও একটি ওয়াইন গ্লাস বাহির করিলেন। তৎপরে প্রকান্ড টিনের বাস্কটি খুলিলেন।
টিনের বাক্সো খোলা হইলে আমি দেখিলাম যে তাহাতে ... পোলাও, কালিয়া, কোফ্তা
রহিয়াছে। পিতা ঠাকুর আমাকে বলিলেন, “তুমি প্রত্যহ সন্ধ্যার পর আমার সঙ্গে এই এই সকল উত্তম দ্রব্য আহার করিবে,
কিন্তু মদ ( সেরি) দুই গ্রাসের অধিক পাইবে না; যখনি শুনিব অন্যত্র মদ খাও, সেই দিন
অবধি এই খাওয়া বন্ধ করিয়া দিব”। কিন্তু আমি সেইরূপ পরিমিত পানে সন্তুষ্ট হইতাম না।
অন্যত্র পান করিতাম। এইরূপ অপরিমিত মদ্যপানে আমার একটি পীড়া জন্মিল’। - রাজনারায়ণ
বসু’র সময়কাল ১৮২৬ থেকে ১৮৯৯। অর্থাৎ ঘটনার আন্মানিক কাল ১৮৪৫-৪৮ হওয়া সম্ভব।
-এইবার এই পিতাদের পাশাপাশি, এই দৃশ্যগুলির পাশাপাশি যদি হাজির করাযায় স্থানকালের
অতীত আরেক পিতাকে যিনি বলছেনঃ ‘হে পুত্র! বলবান ব্যক্তিগণের সহিত যুদ্ধ করা
কোনরূপেই আমার অভিপ্রেত নহে,কারণ, বৈরভাব হইতে বিকার জন্মে; সেই বিকার
অলৌহ-নির্ম্মিত শস্ত্রস্বরূপ। বৎস! তুমি যে এই অনর্থকর সংগ্রামঘটনাকে উপযুক্ত
বলিয়া মনে করিতেছ, এই অনবধানতা হইতেই শাণিত সায়ক ও অসি নিষ্কাশিত হইবে’। দুর্যোধন
কহিলেন, “পূর্বতন ব্যক্তিরা দ্যূতব্যবহার করিতেন, তাহাতে কোন বিকৃতি বা
সংগ্রামঘটনার সম্ভাবনা ছিলনা; অতএব মাতুল বচনে অনুমোদন করিয়া অদ্য সভানির্ম্মাণের
অনুমতি করুন। দুরোদরক্রীড়া ক্রীড়মান ও তদনুবর্ত্তীদিগের স্বর্গের দ্বার স্বরূপ;
অতএব পান্ডবগণের সহিত অক্ষক্রীড়া করা অবৈধ নহে।
দৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “নরেন্দ্র! তুমি যাহা কহিতেছ, তাহা আমার শ্রেয়োবোধ হইতেছে
না। তোমার অভিরুচি হয়, কর, কিন্তু যেন ভবিষ্যতে অনুতাপ করিতে না হয়। মেধাবী বিদুর
বিদ্যাবুদ্ধিপ্রভাবে এই সকল বিষয় প্রত্যক্ষ করিয়াছেন যে, যে সকল ব্যক্তি বশংবদ
নহে, ক্ষত্রিয়ান্তক মহৎ ভয় তাহাদের সমীপবর্ত্তী”। [ মহাভারত, সভাপর্ব,
পঞ্চপঞ্চাশত্তম অধ্যায়, শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ]
অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত জয় হলো
পুত্রস্নেহেরি। পিতাপুত্রের আলোচনার এ’ই শেষাংশ। ‘সভাপর্ব’তে আরো বেশ কিছু অধ্যায়ে
রয়েছে এই আলোচনা যা একত্র হয়ে, নতুনতর ব্যঞ্জনা নিয়ে এসেছে রবীন্দ্রনাথের ‘গান্ধারীর
আবেদন’এ। সমস্ত তর্ক, যুক্তি-দর্শানো ইত্যাদির শেষে ধৃতরাষ্ট্র বলছেনঃ
হায় বৎস অভিমানী! পিতৃস্নেহ মোর
কিছু যদি হ্রাস হত শুনি সুকঠোর
সুহৃদের নিন্দাবাক্য , হইত কল্যাণ ।
অধর্মে দিয়েছি যোগ , হারায়েছি জ্ঞান ,
এত স্নেহ । করিতেছি সর্বনাশ তোর ,
এত স্নেহ । জ্বালাতেছি কালানল ঘোর
পুরাতন কুরুবংশ-মহারণ্যতলে —
তবু পুত্র , দোষ দিস স্নেহ নাই ব'লে ?
মণিলোভে কালসর্প করিলি কামনা ,
দিনু তোরে নিজহস্তে ধরি তার ফণা
অন্ধ আমি । — অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে
চিরদিন — তোরে লয়ে প্রলয়তিমিরে
চলিয়াছি — বন্ধুগণ হাহাকাররবে
করিছে নিষেধ , নিশাচর গৃধ্র-সবে
করিতেছে অশুভ চীৎকার , পদে পদে
সংকীর্ণ হতেছে পথ , আসন্ন বিপদে
কণ্টকিত কলেবর , তবু দৃঢ়করে
ভয়ংকর স্নেহে বক্ষে বাঁধি লয়ে তোরে
বায়ুবলে অন্ধবেগে বিনাশের গ্রাসে
ছুটিয়া চলেছি মূঢ় মত্ত অট্টহাসে
উল্কার আলোকে — শুধু তুমি আর আমি ,
আর সঙ্গী বজ্রহস্ত দীপ্ত অন্তর্যামী —
নাই সম্মুখের দৃষ্টি , নাই নিবারণ
পশ্চাতের , শুধু নিম্নে ঘোর আকর্ষণ
নিদারুণ নিপাতের । সহসা একদা
চকিতে চেতনা হবে , বিধাতার গদা
মুহূর্তে পড়িবে শিরে , আসিবে সময় —
ততক্ষণ পিতৃস্নেহে কোরো না সংশয় ,
আলিঙ্গন করো না শিথিল , ততক্ষণ
দ্রুত হস্তে লুটি লও সর্ব স্বার্থধন —
কুরুবংশরাজলক্ষ্মী নাহি রবে আর —
শুধু রবে অন্ধ পিতা , অন্ধ পুত্র তার ,
আর কালান্তক যম — শুধু পিতৃস্নেহ
আর বিধাতার শাপ , আর নহে কেহ ।
তারপরে মঞ্চে আসছেন গান্ধারী। সাধ্বীমাতার ভয়ে দুর্যোধন চলে যাচ্ছেন মঞ্চ
ত্যাগ করে। কথোপকথন মোড় নিচ্ছে অন্য দিকে কিন্তু অন্তিমে ধৃতরাষ্ট্র পরাজিত
হচ্ছেন, আবারো, আপনার অপত্য স্নেহের কাছে। “শাণিত সায়ক ও অসি নিষ্কাশিত” হচ্ছে। ধ্বংস
হচ্ছে কুরু বংশ। মহাকাব্যের মহাপিতার হচ্ছে মহাপতন।
আমি মহাকাব্যের চরিত্র নয়। আমার
পিতাও নন। ততোদূর ব্যাপ্তি, যাকে বলে ‘লার্জার দ্যান্ লাইফ’, নেই আমাদের। নেই সেই
স্টিফান ডেডালুসের বা তার পিতারো। যদিও রাজনারায়ণ বসু বা তাঁর পিতার ব্যাপ্তি ঢের
বেশী তবু মহাকাব্যের মহাজীবনের তুলনায় তাঁরাও ক্ষুদ্র। তথাপি সেই অপত্য স্নেহ, তার
হেউ ঢেউ, তাতে ডুবে গিয়ে পুত্রের হাতে ‘বিষফল’ তুলে দেওয়ার দ্বন্দ্ব, যন্ত্রনা’র
নিরিখে সকলেই মহাকাব্যের সেই মহাপিতার সমগোত্রীয় ঠিক যেমন হোমারের ইউলিসিসের একচক্ষু
সাইক্লপ্ রাক্ষসের সমান গোত্র নিয়ে জয়েসের ইউলিসিসে মদের বারে হানাদেয় সেই একচোখা
ইহুদী বিদ্বেষী যে মিস্টার ব্লুম্’এর ইহুদীপ্রীতি তে বিরক্ত হয়ে তাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে
মারে বীয়ারের কার্টন্, কুকুর লেলিয়ে দেয়ঃ O, Jesus, he did. And he let a volley of
oaths after him.
-- Did I kill him,
says he, or what?
And he shouting
to the bloody dog:
-- After him,
Garry! After him, boy!
And the last we saw was the bloody car rounding
the corner and old sheepface on it gesticulating and the bloody mongrel after
it with his lugs back for all he was bloody well worth to tear him limb from
limb. Hundred to five! Jesus, he took the value of it out of him, I promise
you.
আমরা মহাকাব্যের ঐ মানুষদের
মতো বড়ো হয়তো আর হতে পারবোনা কোনো দিন ... হয়তো তার হেতু ‘ঈশ্বর বহুযুগ মৃত’ বলে
নীৎসের সেই ঘোষনা, হয়তো তার হেতু কখনো ঘটে যাওয়া শিল্প বিপ্লব, ইতালীর নবজাগরন,
ডারুইন, ফ্রয়েড, মার্কস্, রবীন্দ্রনাথ বা ফুকো ... তথাপিও ঐ মহানুভুতি গুলি
আমাদের মর্মেও রয়ে যাবে, রয়ে গেছে – উদ্ধৃত উপন্যাসের অংশ, আত্মকথার অংশ, আমার
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা তা’ই বলে... তাই আমি ভীতও বোধ করি। হায়, আমিও এক পিতা।
আমারো অপত্য স্নেহ মর্মে হেউ ঢেউ। হায়, তুমিও, তোমরাও পিতা – আমিও সন্তান, সন্তান
তোমরাও – তাই, কখনো অসহায় বোধ করি নিজ পিতার মর্মের ধৃতরাষ্ট্র’টিকে টের পেয়ে,
কখনো ঐ ধৃতরাষ্ট্র’কে টের পেয়ে আপনার মর্মেও ... আর সেই সঙ্গে টেরপাই ঐ মহাকাব্যিক
পিতার অসহায়তাও...
তবুও, জীবন, হে জীবন, মুগ্ধ হই, অন্তিমে, তোমার এই মায়ায়, বন্ধনে, অসহায়তায়
... হে পিতা, আমাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মূল্যে তোমার অসহায়তার কাহন কি কাউকেউ কোনোদিন
বলবেনা তুমি? ...