রক্ষিতা
ওয়াইওমিং এর বিগ্হর্ন নেশনেল পার্কের
চাকরীটার জন্য যে দরখাস্তটা লিখেছিলাম তার সঙ্গে লিখেছিলাম একটি আত্মপরিচয়পত্রও। ঐ স্বলিখিত আত্মপরিচয়পত্রে উল্লেখ
ছিল আমার প্রায় সমূহ গুণাবলীর – আমি অশ্বারোহনে ও অশ্বপালনে পটু, এটাওটা জুড়ে
অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণে দক্ষ, ভারী যন্ত্র ও বড় গাড়ি চালনায় অভ্যস্ত,
উদ্ভিদবিদ্যাতেও আমার নৈপুণ্য রয়েছে, বনাঞ্চলে পথানুসন্ধান এবং উচ্চকন্ঠে চীৎকারেও
আমার দক্ষতা অপরূপ। অর্থাৎ সঙ্গীহীন বনবাসোপযোগী সমস্ত প্রতিভা আমাতে বর্তমান। সে
আজ অনেক বছরের কথা। ঐ আত্মপরিচয়পত্রটি পাঠান্তে আমার তৎকালীন মাস্টারমশাই ভ্রূকুটি-কূটিল দৃষ্টি হেনে
বলেছিলেনঃ “ লোরা, ওরা আসলে জানতে চায় তুমি অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে ঠিক কতোটা কি
করতে সক্ষম। তুমি একা পৃথিবীটাকে উল্টে দিতে পারো কি’না তা জানতে কর্মকর্তারা
উৎসাহী নয়। বরং ওরা তোমার মধ্যে কতোটা “টিম্ প্লেয়ার” হওয়ার সদিচ্ছা ও ক্ষমতা আছে
তা’ই জানতে চায়”।
আমি ওইভাবে ভাবতে শিখিনি কখনো। আমার ধারনা ছিল - যে যতো বেশী কিছু একা করতে
পারে সে ততোটাই বেশী সফল।
প্রায় সমস্ত জীবনভর আমি তা’ই করার চেষ্টায় নিরত থেকেছি। ওয়াইওমিং এ আমি গিয়েছিলাম ২৩ বছর বয়সে। তারপর তিনটি বছর হাজার ভেড়ার একটি পালকে উত্তরের মরু অঞ্চলে
চড়িয়ে বেড়িয়েছি একা। শেষ ছয়মাস প্রায় একটানা করেছি ঐ কাজ। যে সময়ের কথা বলছি তখন না
ছিল সেল্ ফোন, না ছিল ইন্টারনেট আর যে অঞ্চলের কথা সেখানে শ্রান্ত দিনান্তে নিজেকে
চাঙ্গা করে নেওয়ার জন্য গরমজলের টবে ডুবেথাকার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায়না। মাইলের পরে মেইল ধূসর হরিৎ ঝোপ আর নিয়তি বলতে
দিনগত দুর্যোগ – এই দুয়ের ছায়ায় আমার চলা। বন্দুকে গুলি ভরা। বই পড়া। শিকারী কুকুর
আর ঘোড়াগুলো- তখন আমার আপনজন বলতে এরাই -এদেরকে খাওয়ানো পড়ানো - ঐ তখন আমার যাপন। পুরুষের উন্মাদ পৃথিবীতে আমি
তখন একা এক যুবতী। আমাকে ঘিরে আছে মাতাল, লম্পট,সন্ন্যাসী। আমি একা। অভিযোগহীন।
অভিযোগহীন – কেননা – ঐ যাপন আমিই নির্বাচন করেছিলাম।
সেই ভেড়ার পালের রক্ষণাবেক্ষণের
কাজের থেকে শেল্ উপত্যকায় গোচারণ, বিগ্হর্ন অরণ্যে পশুপালন, মালিশশিক্ষা থেকে কি’যে
আমি করেছি তার ইয়াত্তা নেই। এতে আমার কর্মাভিজ্ঞতার তালিকাটি যে কিঞ্চিৎ জটিল
হয়েগেছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে ৩৫ বছরের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে একদিনের জন্যও আমি
আর্থিক দিক থেকে পরনির্ভর ছিলাম না।
আমার প্রথম প্রকাশিত বইটি একটি স্মৃতিচারন মূলিক আখ্যান। সেটা প্রকাশিত হওয়ার
প্রায় পরপরই আমার সঙ্গীজনের, অবশ্যই সে পুরুষ, কাছেও এলো এক মতা বেতনের চাকরীর প্রস্তাব। তবে
সেই চাকরীস্থল আমাদের প্রদেশের থেকে দূরে। প্রস্তাবটি পাওয়ার পরে সে আমাকে বল্লো ‘এসো
“আমরা” এতে সম্মত হই’। “আমরা” অর্থাৎ আমি ও সে। “এরা যে বেতন দিচ্ছে তাতে আমাদের
দুজনের দিন হেসেখেলে কেটেযাবে। তোমাকে চাকরী করতে হবেনা। তুমি লেখার জন্য সময় পাবে
ঢের বেশী। আর এখানের এই বাড়িটা আমরা রেখে দেবো। তাতে আমাদের জন্মস্থানেও আমাদের
একটা আশ্রয় থেকেযাবে। তুমি কি আসবে আমার সঙ্গে?”
ছ’মাসের মধ্যে আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম – যে আমি এতাবৎ কাউকে অনুসরন করিনি
কোনোভাবেই, কোনো কারনেই – সে’ই আমি – সমস্ত ছেড়েছুড়ে চলেছি “রক্ষিতা” হতে! হ্যাঁ,
আমার গহনে তখন পরের লেখাটির ভাবনা ও তজ্জনিত গবেষণা নিয়ে এক রকমের উদ্দীপনা ছিল
বৈকি। তবে এহোগৌণ। তখন এ’ও আমি টের পাইনি যে আমার মর্মে ছিল এক শান্তির নীড় রচনার
গোপন বাসনাও। গৃহকর্ম থেকে বাজারহাটে যাওয়া – এ সমস্তই ক্রমে এসেগেলো আমার ভালোলাগার
পরিধিতে। সকালে উঠে চা-কফি থেকে ওর দুপুরের টিফিনবাক্স সাজিয়ে দেওয়া আর রাতে
ওয়াইন-চীজ’এ তাকে আপ্যায়ন। - ঐ আমার যাপন। হ্যাঁ, দিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বই
নিয়ে, ল্যাপ্টপ্ নিয়ে আর কুকুরগুলোকে নিয়ে পেছনের ছোট্ট বাগানে লেখাপড়া – সে’ও ছিল। সে’ও
আছে।
অদ্যাপি, যখন অক্ষর আমার কাছ থেকে সহসা পলাতক, যখন আমার মর্মের অশ্রু বাস্তবের
বর্ষা হয়ে আমাকে ডাকদেয় আমার সেই ফেলে আসা আরণ্যক দিবারাত্রির দিকে – আমি বাক্রুদ্ধ
বোধকরি। নিজেকেই বলি – “ কেন? এ’তো তুমিই চেয়েছিলে। এইতো তুমি চেয়েছিলে”। হ্যাঁ,
চেয়েছিলাম। ঠিক। তবে এ’ও আরো বেসী ঠিক যে যা পেলাম তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
আমি ভাবতে পারিনি যে আমি এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েযাবো – বিচ্ছিন্ন হয়েযাবো সেই
পার্বত্য জীবনের থেকে, যাপনের থেকে, তার প্রকৃতির থেকে, তার সমাজের থেকে, সংস্কৃতির
থেকে – যারা আমাকে লালন করেছে আমার ৩০ বছর বয়স অবধি।
“তুমি কি আসবে আমার সঙ্গে?” – এই প্রশ্নটি যে আমাকে করেছিল সে আমার ভালবাসার
পুরুষ, শ্রদ্ধার পুরুষ আর তা’ই জীবনে প্রথমবার আমি কাউকে বলেছিলাম “হ্যাঁ”। আমি
চলে এসেছিলাম এই অজানা দেশে, অচেনা মানচিত্রে। চলে আসতে আসতে ঘাড় ফিরিয়ে কেবল দেখে
নিয়েছিলাম, দেখে নিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিলাম যে ঐ পর্বত প্রদেশের অন্তর্গত তোরন
আমার জন্য চিরতরে রুদ্ধ হয়নি। হবেনা।
আজ আমি দ্বিধাবিভক্ত। আমার এক পাশে প্রেম অন্যপাশে ভীতি। আপন গহনে চলতে চলতে
যখন আমি আমার অন্তর্গত গূঢ়তম ভীতিটিকে দেখতে পাই তখন আমি টেরপাই আমার সেই “একা কিছু
করতে পারা”র ইচ্ছার, উদ্দমের আমি দাসী হয়েগেছি। আমার ইচ্ছাশক্তিই আজ আমাকে শক্তিহীন করেছে। আমি
আসলে সেই “ইচ্ছা শক্তি”রই রক্ষিতা। আমি আমার নিজেরি এক পরিহাস।
আজ আমার নিজের অন্তর্শক্তির একটি স্পষ্ট
পরিমাপ রয়েছে আমার গহনে। কুড়ি বা তিরিশ বছর বয়সে এ আমার ছিলনা। আমি আর আমাকে
নির্ণয় করিনা আমার উপার্জিত অর্থের মূল্যে। তথাপি স্বেচ্ছাবিশ্রামের প্রাথমিক আরাম
ও উত্তেজনার শেষে দিনের কাজের ফাঁকে যখন বই নিয়ে, ল্যাপ্টপ্ নিয়ে আর কুকুরগুলোকে
নিয়ে পেছনের ছোট্ট বাগানে বসি তখন আমাকে
ঘিরে নেয় এক অন্তহীন অভাববোধ। ঐ অন্তহীন অভাববোধ ছিল আমার কল্পনাতীত। আমি টেরপাই
আমার আপনঘর, আপনার মানুষ, আপন পারিপার্শ্ব, প্রকৃতি, জলবায়ু – সমস্ত আমি এসেছি পেছনে
ফেলে। তারাই ছিল আমার অন্তর্শক্তি। আমার লেখিকাসত্তা। তাদের হারিয়ে এসে জানিনা আজ
ঠিক কি অক্ষর, কি বাক্য রচনা করব আমি। এই মানিচিত্রে আমার স্বামীজনটি ভিন্ন আর
কেউ, কিচ্ছু আমাকে চেনেনা। জানেনা। কখনো এই নৈঃশব্দের আবর্তে বসে অনুভব হয় আমার “আমি”টিকে
আমি বিস্মৃত হয়েছি পূর্বাপর।
আমি ভাবি – ইদানীং – আমি আবার সিদ্ধান্ত নেবো বা নির্বাচন করব আমার যাপনপন্থা –
অসহায়তার, অক্ষমতার যাপনপন্থা – অন্যথায় আরো ধারালো করেনেবো আমার তলোয়ার। মনোযোগ
আমার কর্ম। আমার স্বধর্ম। আমার আছে এক নিকট সঙ্গীজন, আছে পরিবার, আছে কাছে-দূরে।
আছে। আর আছে বলেই তারা আমাকে “রক্ষা” করে। রক্ষা করবে। তাই আমি “রক্ষিতা”ই। “রক্ষিতা”
শব্দের প্রকৃত অর্থেই।
[ এটি একটি অনুবাদ। বাংলাভাষায় রচনাটিকে সাবলীল করেনিতে শব্দের, শব্দার্থের,
ক্রিয়াপদের যেটুকু নির্মান, বিনির্মান নিতান্ত দরকার তার চেয়ে বেশী স্বাধীনতা আমি
নিইনি। মূল রচনাটির নাম A
Kept Woman লেখিকা Laura Bell ( জন্ম ১৯৫৪),
রচনাটি Granta সাহিত্যপত্রে ( Issue 115,
Spring 2011) প্রকাশিত। ]