প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Wednesday, November 4, 2020

রহস্য-কাহনের রহস্যান্বেষণ

রহস্য-কাহনের রহস্যান্বেষণ

সপ্তর্ষি বিশ্বাস


প্রথম প্রকাশঃ সাহিত্য, হাইলাকান্দি, ২০২১

১।

এক বা একাধিক লোক মিলে, এক বা একাধিকের স্বার্থে, অনেক ক্ষেত্রে নিতান্ত নিঃস্বার্থেই একটা কিছু ‘ঘটনা’ ঘটালো – যে ঘটনা অন্য এক বা একাধিকের ধারণায় ‘অনুচিত’ – সহজ কথায় তাকেই বলাহয় ‘অপরাধ’। অক্সফোর্ড-অভিধান মতে ‘ক্রাইম’ হচ্ছেঃ “An action or omission which constitutes an offence and is punishable by law”  আর “offence” এর মানেঃ “A breach of a law or rule; an illegal act”  এবং “the whole system of rules that everyone in a country or society must obey”, হয়, সংজ্ঞা,’ law’ শব্দের। এই সকল ‘সংজ্ঞা’ মেনে সংঘটিত হলো  একটি “অপরাধ” । অতঃপর এক বা একাধিক লোক বুদ্ধি অথবা সযৌক্তিক চেষ্টা অথবা দুয়েরই রসায়নে শনাক্ত করে ফেল্লো সেই ‘ঘটনা’র অন্তরালস্থিত এক বা একাধিক কে, অন্তিমে হয়তো সেই ‘অপরাধী’ গণ হল ধৃতও। - এই সংজ্ঞা, গোয়েন্দা কাহিনীর, আদিম শুধু নয় আদপে তা মৃতই আর ওই মৃত সংজ্ঞাটির ভূত এতাবৎ বিশ্বময় তথাকথিত ‘পাঠক’, ‘বোদ্ধা’ ,’ আলোচক’ দের কাঁধে চেপে আছে। সেই কারনেই ‘গোয়েন্দা কাহিনী’, অন্তিমে, অদ্যাপি বিবেচিত ‘হাল্কা’ পাঠবস্তু বলেই। মৃত ওই সংজ্ঞাটির প্রেতটি এতোটাই ক্ষমতাশালী, যে, স্বয়ং আঁদ্রে জিদ এবং এলিয়টহেন ব্যক্তিদের ওকালতি সত্ত্বেও জর্জ সিমোনোর কপালে জোটেনি নোবেল পুরস্কার। বলা হয়ে থাকে সিমোনোর এই নোবেল না পাওয়ার প্রতিক্রিয়া, ওই বছর, ত্বরাণ্বিত করেছিল আঁদ্রে জিদের মৃত্যু। এই ‘রটনা’টিকে ‘ঘটনা’ বলেই মনে হয় কেননা সিমোনো’র “দ্য উইডো” আর কামু’র “দ্য আউটসাইডার”, যা সিমোনোর গ্রন্থটির তুলনায় নিতান্তই জোলো, দুটি গ্রন্থ একই সময়ে (১৯৪৫)প্রকাশিত হলেও সিমোনোর “বিধবা কোডার্ক” (La Veuve Couderc) কে ‘সাধারন” এবং “অ-সাধারন” পাঠক ও আলোচকই এড়িয়ে যান “হাল্কা” এবং “ক্রাইম নভেল” বলে। বাংলা ভাষায় সিমোনো স্তরের কাহন লিখিত না হলেও শরদিন্দুর “ব্যোমকেশ” এবং অন্যান্য ‘অপরাধ ভিত্তিক’ কাহিনী( যেমন “সাক্ষী”,”পতিতার পত্র”,”স্মর গরল” বা উপন্যাস “বিষের ধোঁয়া”), সাহিত্য হিসেবে অত্যন্ত উন্নত মানের হলেও, অদ্যাপি ‘সাহিত্য’ হিসেবে অনাদৃতই বস্তুতঃ। চলচ্চিত্রে যেমন কুরোসাওয়ার সিনেমার মধ্যে তাঁর “স্ট্রে ডগ্‌” কিংবা “হাই এন্ড লো” নিয়ে ততো হেউঢেউ এখনো নেই যতোটা রয়েছে “রেড বিয়ার্ড” বা “ইকিরু” নিয়ে। অথচ “স্ট্রে ডগ্‌” যতোবারই দেখি, টের পাই কোনো ভাবেই এই ছবি নয় অধমর্ন তাঁর নন্দিত ছবিগুলির তুলনায়। - এই সমস্তেরই মূলটি নিহিত “গোয়েন্দা কাহিনী” বা “অপরাধ কাহিনী”র সেই সংজ্ঞায় যার মৃয়ু হয়েছে বহুযুগ পূর্বেই।

বিস্তারে যাওয়ার আগে এখানেই বলে নিই, যে, আমার বিচারে সমস্ত “গোয়েন্দা কাহিনী”ই, হয়, “অপরাধ কাহিনী” তবে সমস্ত “অপরাধ কাহিনী”ই নয় “গোয়েন্দা কাহিনী”। বরং পাঠক হিসাবে আমাকে এ’ও অনুভব করতে হয়েছে, যে, রামায়ন,মহাভারত,ইলিয়াদ থেকে  “ব্রাদার্স কার্মাজভ”, “আনা কারেনিনা”, “মাদাম বোভারি”, “উইদারিং হাইট্‌স্‌” এমন কি “ঘরে বাইরে”ও মূলতঃ এক বা একাধিক “অপরাধ কাহিনী”র সমন্বয়। এক বা একাধিক “অপরাধ”ই এদের কেন্দ্র, এদের ভ্রূণ। তথাপি “পাঠক, আলোচক” নির্বিশেষে “অপরাধ কাহিনী” বলতে একবাক্যে মেনে নেবেন সিমোনোর “স্টেইন অন্‌ দা স্নো” বা গ্রাহাম গ্রীনের “এ গান্‌ ফর্‌ সেল্‌”কে কিন্তু “আনা কারেনিনা” কিংবা “ঘরে বাইরে”কে এতাবৎ মেনে নিতে পারেননি তাঁরা “অপরাধ কাহিনী” হিসাবে। কিন্তু আনা কারেনিনার জীবনের প্রতিটি মুহুর্তই একটি অপরাধের, “ক্রাইমের” উদ্‌যাপন যার “পানিশ্‌মেন্ট” অন্তিমে আনার আত্মহত্যায়। সন্দীপের “ক্রাইমের” সঙ্গে আপনাকে যদি না জড়িয়ে ফেলতো বিমলা তাহলে কি নিখিলেশকে পেতে হতো তার অন্তিম “পানিশমেন্ট”? অথবা বিমলা-সন্দীপের “ক্রাইম” কে দেখেও “অহং” কিংবা “অভিমানে” এড়িয়ে থাকবার যে প্রবণতা নিখিলেশের তা’ই কি নয় তার নিজের “ক্রাইম”? …… বাংলা ভাষায় লিখিত দুটি শ্রেষ্ঠ “অপরাধ কাহিনী” অবশ্যই “কৃষ্ণকান্তের উইল” আর “বিষবৃক্ষ”। পরের সময়ে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের “রত্ন দ্বীপ”। কিন্তু বঙ্কিম যেহেতু “ঋষি” সুতরাং তাঁর রচনা কি “পাঠক, আলোচক”রা “অপরাধ কাহিনী” বলবেন কিকরে? সুতরাং বাংলা “অপরাধ কাহিনী”র আরম্ভ, সততই “দারোগার দপ্তর” দিয়ে!

   বাংলা “অপরাধ কাহিনী”র আরম্ভ, সততই “দারোগার দপ্তর” দিয়ে। অথচ সাহিত্যগুনে “দারোগার দপ্তর” – রবীন্দ্র-বঙ্কিম ইত্যাদির নাম করবার তো ওঠেনা প্রশ্নই – “কাঞ্চনজঙ্ঘা” সিরিজের সঙ্গেও নয় তুলনীয়। পক্ষান্তরে “ব্রাদার্স কার্মাজভ”, “আনা কারেনিনা”, “বিষবৃক্ষ”, “কৃষ্ণকান্তের উইল” বা “ঘরে বাইরে”র বহিরঙ্গে কোনো “সত্যান্বেষী” নেই সত্য আর যেহেতু “সত্যান্বেষী” নেই বহিরঙ্গে, সুতরাং “অপরাধ”কে, যে অপরাধ, যে সকল অপরাধ মানবের যমজ কিংবা পূর্বজ, তাদের সূত্র-সন্ধান করতে হয়েছে স্বয়ং লেখককেই। ঠিক যেমন বকলমে নিজের অপরাধের সন্ধানকল্পে ইদিপাসকে হতে হয়েছিল স্বয়ং “গোয়েন্দা”, “সত্যান্বেষী” বা ‘স্যমন্তক মনি” চুরির অপবাদ থেকে রক্ষা পেতে কৃষ্ণকে যেমন হতে হয়েছিল “গোয়েন্দা”। এই ‘সন্ধান’ গুলি আদতে “অপরাধ”কে নিমিত্ত মাত্র রেখে লেখকের সন্ধান সেই পথরেখার যা ধরে তিনি ডুব দিতে পারেন মানবমনের গহনতর অন্ধকারের অন্দরে নিহিত, নিদ্রিত সত্যগুলির দিকে আর সেই সত্যগুলিকে উন্মোচন করে তার নিরিখে স্থানের, কালের, পাত্রের মর্মগত যন্ত্রণাকে উন্মোচিত করে প্রকৃত শ্রষ্টাজন ক্রমে পার হয়ে যান, যেতে চান, স্থান-কাল-পাত্রের চক্রবালকে।

                              চলতি কিংবা আদিম সংজ্ঞাতেও যাদেরকে বলা যায় “অপরাধ কাহিনী” তাকেও “সাহিত্য” হয়ে উঠতে গেলে পালন করতে হয়, ধ্বজাধারী “সত্যান্বেষী”র নয়, সত্যান্বেষী শ্রষ্টার ভূমিকা, জীবন ও জগতের মুহুর্মুহু দ্বন্দ্ব সঞ্জাত সমস্ত বিকিরনের অন্তত কিছু অংশকে ছুঁইয়ে দিতেই হয় তার। নতুবা সেইসব কাহন হয়েপড়ে খবর-কাগজের, টেলিভিশন চ্যানেলের “ক্রাইম রিপোর্টিং”। বড়জোর “ক্রিমিনোলজি” টেক্সট্‌ বই। এখানে ‘ভাষা’ অবশ্যই পালন করে এক বৃহৎ ভূমিকা। বার বার পাঠ করে, মনোযোগ সহকারে পাঠ করে এবং করতে করতে  আমার বার বারই মনে হয়েছে, মনে হয়, যে, হাতে গোনা কয়েকটি হোম্‌স্‌ কাহিনীতেই মাত্র কোনান ডয়েল সক্ষম হয়েছিলেন স্থানের, কালের, পাত্রের মর্মগত যন্ত্রণাকে উন্মোচিত করে প্রকৃত পার হয়ে যেতে স্থান-কাল-পাত্রের চক্রবালকে। এলিয়টের বিচারে শেক্ষপীরের “হ্যামলেট” চরিত্রের যে “প্রব্লেম” ( আমি ব্যক্তিগত ভাবে এলিয়টের সঙ্গে একমত নই এখানে) তেমনি অসংখ্য আজীব-গরীব দাস্তানের একটি পিন্ড এই শার্লক হোম্‌স্‌ চরিত্র। কখনো চরিত্রটি উদ্রেক ঘটায় বিরক্তিরও। এই সমস্ত “আজীব-গরীব দাস্তান”, আস্তিনে লুকানো “অবজার্ভেশন” সমস্তকে পার হয়েও, আমার ভাবনায়, যে কটি হোম্‌স-গাথা মানব মনের অন্তর্গত সত্যের দিকে ধাবিত হতে পেরেছে সেই কয়েকটি রচনা হলঃ A Study in Scarlet, The Man with the Twisted Lip, The Yellow Face, The Crooked Man , The Hound of the Baskervilles, The Resident Patient এবং The Adventure of the Solitary Cyclist - এই কাহিনীগুলি নিয়ে পরে ভিন্ন আলোচনার ইচ্ছা রইলো । আপাততঃ এটুকুই বলি, যে, হলদে মুখ বা হলচে মুখোশে নরনারীর প্রেম আর মাতৃস্নেহের করুন দ্বন্দ্বটি উন্মোচিত হয় রহস্য কাহিনীকে আদল হিসেবে ব্যবহার করে। নিঃসংগ সাইকেলারোহীও একটি এক তরফা প্রেমের অপূর্ব কাহিনী। ঠিক যেমন বাস্কারভিল-হাউন্ডে হোমস্‌ সাহেবের কেরামতির চেয়েও আমার কাছে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, উজ্জ্বল হয়ে থাকে বাস্কারভিল-সদনের সেই পরিচারিকাটি যে তার জেল পালানো ভ্রাতার কাছে, তার স্বামীর সহায়তায়, প্রতিরাত্রে আহার্য পৌঁছে দেয় চোরাবালি-থাকা গহন অরণ্যে এখানে এসে মনেপড়ে ডিকেন্সের “গ্রেট এক্সপেক্টেসন্‌স্‌” এর বালক ‘পিপ্‌’ কে। মনেপড়ে আমার বাল্য কালে দেখা পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা একটি ছিঁচকে চোরকে – যে আমার কাছে জল চেয়েছিল   - তথাপি শার্লক হোম্‌সের প্রতিটি কাহন বা কোনান ডয়েলের অন্যান্য কাহিনীও কালের চক্রবাল পার হয়ে উড়ে আসে তাঁর “ভাষা শিল্প” আর “বুনন দক্ষতা”র গুনে। - অথচ এই গুনটির প্রয়োজনের কোনো ইঙ্গিতও “অপরাধ” বা “ গোয়েন্দা” কাহিনীর তথাকথিত, মৃত সংজ্ঞায় নেই। সুতরাং “সরকারী” যে “পাঠক, আলোচক” তাদের চোখে পড়েনা কোনান ডয়েলের বা শরদিন্দুর ভাষা ব্যবহারের মুন্সীয়ানা, গল্প বলিয়ের দক্ষতা। ঠিক যেমন তাদের চোখে পড়েনা হলদে-মুখোশের “মা”টিকে বা বাস্কারভিল সদনের “ভগিনী”টিকে আর পত্নীপ্রেমে নিবেদিত প্রাণ তার বরটিকে, যে ওই বাস্কারভিল-কুকুরের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও বনে যায়, নিশুত রাত্রে, নিজ পত্নীর ভ্রাতাটিকে আহার্য্য দিয়ে আসতে

           অপরাধ কাহিনী কিংবা গোয়েন্দা কাহন, যে ঢঙ্গেই লিখিত হোক্‌ না কেন, একটি কাহিনী যখন ছুঁয়ে দিতে পারে মানবমনের গহনের এই সকল অনুভুতিকে – তন্মুহুর্তেই সে, “অপরাধ” বা “ গোয়েন্দা” কাহিনীর তথাকথিত, মৃত সংজ্ঞার থেকে বার হয়ে এসে, হয়ে যায় ‘সাহিত্য’। যে পাঠক, আলোচক তা দেখতে অক্ষম সে আদতে অন্ধ।

“অপরাধ” এবং “গোয়েন্দা” দুই রকমের কাহিনীরই আরেক “ডিফাইন্ড্‌” কিং বলা ভালো কুইন, আগাথা ক্রিস্টি। কিন্তু আগাথা ক্রিস্টি কে কি আটকে রেখে দেওয়া যায় “গোয়েন্দা-অপরাধ” কাহিনীর কূপে? যারা তা করতে সক্ষম তারা অন্ধ।

প্রথমেই আমাকে টেনে নেয়, অদ্যাপি, তাঁর ভাষা-দক্ষতা যার বাই প্রোডাক্ট তাঁর চরিত্র নির্মাণে, চালচিত্র অঙ্কনে। এই দুটি মিলে যা করে, প্রথমতঃ, তা, চরিত্রগুলিকে করে ত্রিমাত্রিক। এখানেই কোনান ডয়েলের “ওয়াট্‌সন” হোমস কাহিনীর ‘বলিয়ে’ হয়েও হেরে যায় আগাথা’র মিস্‌ লেমন আর হেস্টিংসের কাছে। হোমস্‌ স্বয়ং হেরে যায় মিস্‌ মার্পলের কাছে। আমি অবলীলায় হেঁটে বেড়াই ইংল্যান্ডের না দেখা গ্রামের পথে পথে, মাঠে মাঠে, বাগানে বাগানে মিস্‌ মার্পলের সঙ্গে গল্প করতে করতে। তাঁ বানানো কেকের টুকরো মুখে দিয়ে প্রুস্তের মার্সেলের মতো আমারো কি জানি কি একটা । কিছু একটা মনে পড়ে যায় । পোয়রোর সঙ্গে যখনই হাঁটি লন্ডন শহরে আমার মনে আসে “মিসেস ডালওয়ে”র বন্ড স্ট্রীট, টের পাই ৩৬০ ডিগ্রীর এক পূর্ণতা। মাঝে মাঝে, তবুও, হয়তো অবচেতনগত ‘ইনারশিয়া’হেতুই , ভাবি, আগাথা ক্রিস্টি' কি খুব মহান লেখিকা?

কেজানে। তবে এ আমি জানি যে আমি গত কুড়ি বছরেরো বেশী সময় ধরে তাঁর মুগ্ধ পাঠক। গোয়েন্দা-বুদ্ধির ঝিলিক থেকেও তাঁর চরিত্রচিত্রণ, চালচিত্র অঙ্কন আর মানব ও তার যাপন বিষয়ে তাঁর  অন্তর্দৃষ্টি আমাকে মুগ্ধ করে। বার বার মুগ্ধ করে। ফলে আর সব পড়ার কিনারে কিনারে মাসে না হলেও অন্ততঃ দুমাসে একটি আগাথা-কাহন, আগে পড়া বা না পড়া, আমার পড়া হয়েই যায়। যেমন এই  আগাথা ক্রিস্টিরই ‘মারি ওয়াস্টমাকট’  (MARY WESTMACOTT) ছদ্মনামে লেখা  Absent in the Spring আমার ‘সাইড্ ডিশ্’।

মারি ওয়াস্টমাকটের সঙ্গে প্রথম পরিচয় Giant's Bread এ, ৯২-৯৩ সালে। একটু ছড়ানো আর মেলোড্রামাটিক হলেও অত্যন্ত লিরিক্যাল রচনা। অনবদ্য মানবমনের অন্ধকারের উদ্ঘাটন

আগাথা ক্রিস্টির আত্মজীবনী পাঠ করে আনন্দ পেয়েছি।  উপকৃত হয়েছে আমার পাঠক/লেখক দুই সত্তাই। তবে তাতেও, তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের অব্যবহিত আগে, তাঁর দু-হপ্তার অন্তর্ধান রহস্য, যা এখনো কিংবদন্তী, তার কোনো ক্লু পেলাম না তখনই হাতে এলো ওয়াস্টমাকটের  Unfinished Portrait, হ্যাঁ এখানে তাঁর জীবনের ঐ কটি দিনের কথা আছে।

 ...  Absent in the Spring  ভালো লাগছে। আগাথা ক্রিস্টি’র গহনে আছেন এক নাট্যকার তা প্রায়ই টের পাই। এই গ্রন্থেও তা’ই। আজন্ম তূলোর পুতুল হয়ে কাটানো এক মহিলা, যাঁর যাপনে, মহিলার নিজেই মতেই, এতাবৎ আগাগোড়াই সুখ – স্বামী পদস্থ, পুত্র-কন্যারা থিতু, বিবাহিত, পেছনে তাকালেও সমস্ত মসৃণ, ছায়া নেই কোনো অনিয়মের, বে নিয়মের, সেই মহিলাই ৪৮ বৎসর বয়সে নিজের এমন এক বাল্যসখীর মুখোমুখি হয় যার যাপন নেই, সমস্তটাই জীবন আর তাই সমস্তটাই নিয়ম ভাঙ্গা তবু সে সুখি! এবারে সেই মসৃণ-মহিলার মর্মে নিজের যাপিত সময়কে নিয়ে ভাববার, বিশ্লেষণ করবার পালা

ওই "Absent in the Spring " থেকেই আবার ফিরে যাওয়া শেক্ষপীরের সনেটে। এমনটাও নতুন কিছু নয়। আগাথা’র অনেক রচনারই নাম শেক্ষপীরের নাটকস্থ সংলাপ বা কবিতা বা তাঁর সনেট থেকে নেওয়া। বর্তমান নামটি সেক্ষপীরের ৯৮ সংখ্যক সনেটঃ

 

From you have I been absent in the spring,

When proud-pied April, dressed in all his trim,

Hath put a spirit of youth in everything,

That heavy Saturn laughed and leaped with him.

 

                                        এই আরেক মজা। আগাথা ক্রিস্টি খুলে বসলে মন যেন উড়তে থাকে। শেক্ষপীরের সনেটটি থেকে মনে এলো শেক্ষপীরের সনেট নিয়ে অস্কার ওয়াল্ডের The Portrait of Mr. W. H. নামের বড় গল্পটি । সে’ও এক অর্থে আরেকটি রহস্যগল্পই। ঠিক যেমন ওয়াইল্ডের “পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে” যে সকল “ছায়াপিন্ড”কে লক্ষ্য করে জীবনানন্দ বলেছিলেন “বরং নিজেই তুমি লেখোনাক একটি কবিতা” সেই “ছায়াপিন্ড”দেরকে বলতে ইচ্ছা করে, যে, “গোয়েন্দা কাহিনী, অপরাধ কাহিনী” নয় কোনো মঙ্গল বা শনিগ্রহজাত বস্তু। এ শুধু একটি ‘ফর্ম’, একটি “ঢং”, একটি “ছক”, কম্পিইটার বিজ্ঞানের পরিভাষায় “ডিজাইন প্যাটার্ন”। অক্ষম যার লেখনী সে ওই ‘ফর্ম”টিতেই যায় আটকে। ফলে সাহিত্য হয়না রচিত। আর প্রকৃত শ্রষ্টা, প্রকৃত শিল্পী তাকে ব্যবহার করে নির্মাণ করেন ইন্সপেক্টার ম্যাগ্রে না ইন্সপেকটার চ্যান্‌ কাও’হেন চরিত্র

তবে আগাথা’কে নিয়ে আমার সমস্যা অন্যত্র। পাঠে, পুনর্পাঠে আমার মনে হয়েছে, যে, আগাথা বিশ্বাস করতেন না যে, ‘অপরাধ’ এবং ‘অপরাধী’ দুয়েরই শ্রষ্টা আদতে তার স্থান, তার কাল। একজন হত্যাকারী কে যে ‘ভিলেন’ হতেই হবে তেমন কোনো গুহালিপি নেই, ছিলোওনা কোনোদিন। যদি থাকতো তাহলে

মহাকবি WILLIAM BLAKE এর ১৭৯৪ সালে লিখিত London  কবিতাটি পাঠ করতে করতে এই ২০২০ সালেও আমার মনে আসতো না ১৮৬২ সালের লন্ডন-ছবি যার আঁকিয়ে দস্তভস্কি (Winter Notes on Summer Impressions) আর এই দুটি পাঠ মনে এনে দিতোনা ১৮৪২ থেকে ১৮৪৪ সালের মধ্যে লিখিত Friedrich Engels  এর The Condition of the Working Class in England গ্রন্থের The Great Towns অংশ ।

এই রচনাত্রয়ীকে একত্রে স্মরণ করবার মূলে  দারিদ্রের অপরূপ-নির্মম বর্ণনা’ই শুধু  নয়। কিন্তু আমার চিন্তার সূত্রটি এই, যে, ব্লেইক – স্বপ্নাদেশ পাওয়া সাধক-কবি, এঞ্জেল্‌স্‌, এক বস্তুবাদী তথা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী এক বিপ্লবীজন আর দস্তয়ভস্কি, এনার্কিজমের ধ্যান ধারণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত না হতেপারা এবং সেন্ট্‌ সাইমনি ‘সমাজতন্ত্র’ আর রাশিয়ান ‘অর্থডক্স’ চার্চের ‘ঈশ্বর’এর মাঝামাঝি পিষ্ট হতে থাকা একজন দার্শনিক অথচ তিনজনেই –দেখছেন একই সত্য, প্রকাশও করছেন একই রকমের মর্মন্তুদ চীৎকারে, অভিশাপে। গর্জে উঠছেন  “এ আমার, এ তোমার পাপ”বলে শুধু একটি ক্ষেত্রেই এঞ্জেলস্‌ অপর দুই মহাপ্রাণ থেকে আলাদা যেখানে এঞ্জেলস্‌ চিনে নিতে পারছেন, যে, এই বাইবেলী ‘Baal’ টি মূলতঃ আর কিছু নয় – পুঁজিবাদের নগ্নতম স্বরূপ। - আগাথার চরিত্রদের ৯৯ ভাগ “ওয়েল-টু-ডু” হলেও তারা সকলেই পুঁজিবাদের সন্ততি এবং সেই ইংল্যান্ড তথা লন্ডনের সন্ততি যার আক্রান্ত স্বরূপটি দেখে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন ওই তিন শ্রস্টাজন।

কিন্তু আগাথার বা আমার আরেক প্রিয় লেখিকা, তিনিও বৃটিশ, পিডি জেম্‌সের রচনায় ছায়া ফেলেনা সেই পুঁজিবাদী আবহ বা আবহ – যা’ই আদতে অপরাধ ও অপরাধীর জন্মদাতা। আগাথা আর পিডি জেম্‌সের অপরাধ কাহিনী যেন, মনে হয়, এই পৃথিবীর কিছু নয়, যেন কোনো ইডেন-উদ্যানে ঢুকেপড়ে কিছু “খারাপ মানুষ” করছে অপরাধগুলি। হ্যাঁ, কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি’রা গোয়েন্দা তথা অপরাধ কাহিনীকে তাদের মৃত সংজ্ঞার থেকে বার করে বৃহত্তর দিগন্তে নিয়ে এলেন। তার শরীর থেকে মুছে দিলেন ‘হাল্কা’ শব্দটির উল্কিদাগ। আগাথা ক্রিস্টি তাঁর বেশীরভাগ কাহিনীতেই উন্মোচন করবার চেষ্টা নিয়েছেন ( অনেকটাই ভিক্টোরিয়ান ‘ফর্ম’ এ হলেও) মানন-মানবীর মধ্যেকার জটিল জৈব সম্পর্কটিকে খুঁড়ে দেখতে। তার রহস্য গুলিকে বুঝেনিতে। - এখানে তাঁকে আমার প্রায়শই মনে হয় এনিস্‌ নিন্‌ এর পরিপূরক।

 

 

 

 

 

 

 

২।

নরকের পথ ধরে হেঁটে চলেছেন দান্তে। অথচ সেই যাত্রা-বর্ণনের নামটি “স্বর্গীয় মিলন গাথা”। ‘নরক’ তবু ‘ডিভাইন’। পদে পদে হাহাকার আর আর্তনাদ আর যাতনার ক্রন্দনে ছিন্ন ভিন্ন হাওয়া, বাতাস, আবহ। তবুও ‘কমেডি’। ‘কমেডি’ কেননা এই যাত্রায় তাঁর সঙ্গে চলেছেন মহাকবি ভার্জিল আর যাত্রার অন্তমে রয়েছে আশ্বাস বিয়াত্রিচের। সুতরাং নরক যাতনা দেখেও দান্তের মর্ম হচ্ছেনা অন্ধকার। বরং এই সকল ‘পাপী’দের প্রতি করুণার ভরে উঠভছে তাঁর মন। তিনি তাদের দোষ-গুন-পাপ-পুণ্যের মাপ নিচ্ছেন না, এমন কি নিজের মনেও।   মর্মগত করুণায় জারিত অক্ষরে কেবলই লিখে রাখছেন সেই সকল কাহিনী আর তাই অন্তিমে পাঠককে অনুভব করতে হচ্ছে, যে, যাকে ‘পাপী’ বলা হচ্ছে, যাদেরকে ‘পাপী’ বলা হচ্ছে তারা আদতে ‘মানুষ’ শব্দের অন্তর্গত রিপু আর তার ‘মানুষ’ নামক জীবেদের দ্বারা নির্মীত ‘সমাজ’ ও ‘ব্যবস্থা’র কাছে অসহায় । ওই অসহায়তার অশ্রুতেই দান্তের নরক যাত্রা এমন স্বর্গীয়, এই অশ্রুতে সিক্ত বলেই দস্তয়েভস্কির ‘পাপী’ রা ‘পাপী’ নয় – তারা, তাঁর নিজের কথাতেই “গ্রেট্‌ সিনার”। এই অনুকম্পাতেই ফ্লবেয়ারের চরিত্রেরা সজল করে পাঠককে।

নরকের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলেছেন জর্জ সিমোনো’ও। চালচিত্রে সার সার অসহায় মুখ। কারোর মুখে উল্কি লোভের, কারোর কামনার, কেউ শিকার নিতান্তই মুহুর্তের উন্মাদনার। এদের কেউ হত, কেউ হত্যাকারী। তাদের কাউকেই তথাকথিত দোষ-গুন-পাপ-পুণ্যের মাপে ‘বিচার’ করছেন না – জর্জ সিমোনো নিজে, না’ত তাঁর  রচিত চরিত্র ইন্সপেকটর জুলস্‌ ম্যাগ্রে। “আমি লিখি, যে সকল অপরাধের কথা, সেই গুলি হয়তো আমি নিজেই সংঘটিত করতাম। কেননা আমরা যে সময়ের সন্ততি তা’তে ওই সকল অপরাধ করাই স্বাভাবিক। আমি, সৌভাগ্য বশে, জীবিকা নির্বাহের ভিন্ন পন্থা পেয়ে যাওয়ায় আমাকে হাতে কলমে করতে হয়নি অপরাধগুলি। তবে আমি এদের চিনি। এদের জানি। আমার লেখায় অভিজাতদের মর্মকথা নেই কেননা আমার কোনো ব্যাঙ্কার-হেন অভিজাত ব্যক্তির সঙ্গে বসে ওমলেট খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই।“ বলেন সিমোনো। মনে আসে জীবনানন্দ দাশের পংক্তিঃ “আমরা দন্ডিত হয়ে জীবনের শোভা দেখে যাই / মহাপুরুষের বাণী চারিদিকে কিলবিল করে””মানুষের তাই হল যা হবার নয়”

                                            ‘প্যারিস রিভিউ’ পত্রিকার ১৯৫৫ সালের গ্রীষ্ম সংখ্যায় প্রকাশিত সিমোনো’র সাক্ষাৎকারটি নানা কারনেই যে কোনো আত্ম-সন্ধানীর, প্রকৃত শিল্পভোক্তার অবশ্যপাঠ্য। যৎসামান্য উদ্ধার করবার, এখানে, লোভ সামলানো গেলোনাঃ

I think that if a man has the urge to be an artist, it is because he needs to find himself. Every writer tries to find himself through his characters, through all his writing.

  

“The Brothers Rico”. The story might be the same if instead of a gangster you had the cashier of one of our banks or a teacher we might know.

… …

Because society today is without a very strong religion, without a firm hierarchy of social classes, and people are afraid of the big organization in which they are just a little part, for them reading certain novels is a little like looking through the key-hole to know what the neighbor  is doing and thinking — does he have the same inferiority complex, the same vices, the same temptations? This is what they are looking for in the work of art.

I think many more people today are insecure and are in a search for themselves. … what people today want are the most complex books, trying to go into every corner of human nature. “

এখানে এসে পাঠকের, পুনরায়, মনে পড়তে বাধ্য দস্তয়ভস্কির সেই প্রবাদ প্রতিম পত্রাংশঃ

(There are) moments (when), one does, " like dry grass," thirst after faith, and that one finds it in the end, solely and simply because one sees the truth more clearly when one is unhappy. I want to say to you, about myself, that I am a child of this age, a child of unfaith and scepticism, and probably (indeed I know it) shall remain so to the end of my life. How dreadfully has it tormented me (and torments me even now)—this longing for faith, which is all the stronger for the proofs I have against it. And yet God gives me sometimes moments of perfect peace; in such moments I love and believe that I am loved;”

সিমোনো’ও সন্তান এই  “অদ্ভুত আঁধার” ঘেরা সময়েরই। তেমনি তাঁর গোয়েন্দা ম্যাগ্রেও।ম্যাগ্রে কাহিনীতে “অপরাধ” আদতে আবহমাত্র। সেই আবহের জট ছাড়াতে ছাড়াতে সিমোনো আমাদের কখনো নিয়ে দাঁড় করান সেই “বিপন্ন বিস্ময়” এর মুখোমুখি যেখানে বাল্য বান্ধবকে প্রায় কুড়ি বছরের ব্যবধানে ভবঘুরে, দিন মজুর তথাপি প্রশান্তিময় যাপনে সহসা আবিষ্কার করে অধুনা ‘স্টিংকিং রিচ’ অপর বান্ধবের ঈর্ষা হয়ে ওঠে এমনই প্রবল যে, বন্ধুটিকে সে অনুসরন করে এবং খুন করে অবশেষে। এরা একদা একই মেয়েকে ভালবেসেছিল এবং তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় তাদের হাতে হত হয়েছিল মেয়েটি। তার পরে তাদের “জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার”। কিন্তু এক বন্ধু, এক প্রেমিক অদ্যাপি সেই অন্ধকারের আবর্ত ছেড়ে বার হয়ে আসতে পারেনি বলে ব্যর্থ হয় তার দাম্পত্য, বিফল হয় তার উপার্জন। পক্ষান্তরে অন্য বন্ধুজন, যেন বা টলস্টয়ের সেই ফাদার সিয়ের্গি, সেই সমস্ত কে পার হয়ে অবলীলায় ভবঘুরে, দিনমজুর। মনেপড়ে কি সেই জেন্‌ গল্প যেখানে দুই সাধুর সামনে পড়ে গিয়েছিল এক সুন্দরী আর এক সাধু তাকে কোলে নিয়ে পার করে দিয়েছিল কাদাজলের রাস্তা? পরে, রাতে দ্বিতীয় ‘সাধু’জন যখন প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে পুনরায় তখন প্রথম ‘সাধু’ বলে, যে, “তুমি দেখছি এখনো সেই মেয়ে কে কোলে নিয়েই আছো! আমি তো তাকে সেই দুপুরেই কোল থেকে নামিয়ে দিয়েছি ” – হ্যাঁ, সিমোনো একাধারে শোনান জেন্‌ গল্পের মতো উপাখ্যান আর সমান্তরালে, অনুচ্চারে বলে যান “ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি / মাথা কর নত / এ আমার, এ তোমার পাপ” আর পরম মমতায় শোনান ‘পাপ’ শব্দের অন্তর্গত অসহায়তার কথা। - এইভাবেই সিমোনো হয়ে ওঠেন দস্তয়ভস্কির প্রকৃত উত্তরসূরী আর এই ভাবেই ‘অপরাধ/গোয়েন্দা কাহিনী” ফিরে পায় তার প্রকৃত সংজ্ঞা। যে সংজ্ঞা ক্রিস্টিয় ২য় শতকে Apuleius (এপুলিয়াস্‌ ? ) খাড়া করে গিয়েছেন তাঁর ল্যাটিন ভাষায় লেখা ( রোমান) কাহন “The Golden Ass” এ, যার প্রসঙ্গ, দস্তয়েভস্কি-সাহিত্যের স্বরূপ উন্মোচনের কালে বারংবার উল্লেখ করেছেন বাখতিন। বর্তমান রচনার প্রাসঙ্গিক সারকথা, বাখতিনের The Dialogic Imagination থেকে, এই, যেঃ

“the criminal material itself is not essentiak for Apuleius;what matters are the everyday secrets of private life that lay bare human nature – that is, everything that can only be spied and eavesdropped”

 

সিমোনো যখনই পড়ি, যখনই ভাবি, তখনই মনেহয়, প্রশ্ন করা হলে, নাস্তিক সিমোনোও নিশ্চিত , রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চে বিশ্বাসী দস্তয়ভস্কির মতোই বলতেনঃ যদি ‘সত্য’ বা ‘ন্যায়’, হয় ‘মানবতা’র বহির্ভূত কোনো বস্তু তাহলে ‘সত্য’ বা ‘ন্যায়’ নয়, আমি বেছে নেবো ‘মানবতা’কেই। দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেনঃ If anyone could prove to me that Christ is outside the truth, and if the truth really did exclude Christ, I should prefer to stay with Christ and not with truth.

যদি এই ভাবনাসূত্র কে অনুস্রন করি, তাহলে বলতে হয়, যে, ‘অপরাধ/গোয়েন্দা কাহন’ এর জীবিত ও চলিষ্ণু ( এবং বর্ধিষ্ণুও) সংজ্ঞায় ‘অপরাধের বহিরঙ্গের সত্য’ কে আবিষ্কার করে দেখানোর দায়িত্বটি গৌণ। মুখ্য দায়িত্ব এই ‘গৌণ’ বাস্তবতাকে ঘাটের সিঁড়ি করে নেমে যাওয়া মানুষের, মানবের গভীরতর সত্যের সন্ধানে। সিমোনোর দেখানো পথে হেঁটে চলা পথিকদের মধ্যে অন্যতম Friedrich Dürrenmatt । তাঁর কাহিনীতেও অপরাধ আবহমাত্র। তাঁর The Pledge গ্রন্থে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন সিমোনোর বা তাঁর নিজের রচনা প্রক্রিয়া ও আধার সম্বন্ধেও। এই উপন্যাসে এক রহস্য কাহিনীর সফল লেখককে মুখোমুখি হতে হয় এক অসফল পুলিশ অফিসারের এবং পুলিশ অফিসারটি রহস্য কাহিনী লেখককে আক্রমণ করে এইভাবেঃ

since the politicians have shown themselves to be so criminally inept  . . . People hope the police at least will know how to put the world in order,.. every reader and every taxpayer has a right to his heroes and his happy ending, and it’s our job to deliver that—I mean ours as policemen, just as much as it’s your job as writers. No, what really bothers me about your novels is the story line, the plot. There the lying just takes over, it’s shameless. You set up your stories logically, like a chess game…

This fantasy drives me crazy. You can’t come to grips with reality by logic alone. Granted, we of the police are forced to proceed logically, scientifically; but there is so much interference, so many factors mess up our clear schemes, that success in our business very often amounts to no more than professional luck and pure chance working in our favor. Or against us. But in your novels, chance plays no part, and if something looks like chance, it’s made out to be some kind of fate or providence; the truth gets thrown to the wolves, which in your case are the dramatic rules. Get rid of them, for God’s sake”.

                         এখানে, পুলিশ অফিসাররের জবানীতে যে রহস্য-কাহিনী তা এই সময়ের জীবিত, চলিষ্ণু ও বর্ধিষ্ণু সংজ্ঞার রহস্য কাহিনীই তথাপি এখানে এড়ানো যায়না ইচ্ছাপূরণের দিকটি। এই ওপন্যাসিক নিজেকে নিয়েও আইরনি করেন , অন্তিমে, উপন্যাসের শেষে, “এপেনডিক্সহেন” একটি ‘সমাধান’ ও ‘অপরাধী’র গ্রেপ্তার ঢুকিয়ে দিয়ে। তবে যে দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত লেখক করেছেন এখানে তা শুধুমাত্র রহস্য-কাহিনীর দ্বন্দ্ব নয়। শিল্প আর বাস্তবের আদি ও অন্তিম দ্বন্দ্ব। ‘গদ্য’ সাহিত্যের বেশী প্রাসঙ্গিক দ্বন্দ্ব। - কতোটা ‘বাস্তব’ আর কল্পণা প্রতিভার কতোটা মিশ্রণে নির্মীত হয়, হতে পারে, হয়েছে, মহৎ শিল্প? প্রকৃত শিল্প? ‘ডন কিহোতে’ যা বলছে তা’ই সত্য না’কি ডন কিহোতেকে পাঠক যেভাবে দেখছে সত্য সেটাই? নাকি দুটিই? নাকি কোনোটিই নয়?

      

এই সকল প্রশ্ন, দ্বন্দ্ব, যাপন অন্বেষা, জীবন ভাবনা যেখানে অবয়ব নেয়, নিতে পারে “অপরাধ” বা “অপরাধীর সন্ধান” কে আবহ কিংবা আবহের চেয়ে আরো বেশী কিছু করে নিয়েও, সেখানেই অপরাধ/গোয়েন্দা/রহস্য কাহিনী হয়ে ওঠে প্রকৃত কাহিনী এবং সেখানেই এই ঘরানাটির সার্থকতা। অথচ এই সহজ সত্যটুকু যে অদ্যাবধি পাঠক, এমন কি বিদগ্ধ পাঠকেরও কাছে স্পষ্ট নয় তা টের পাই অপরাধ/গোয়েন্দা/রহস্য কাহিনী নিয়ে বদন-বহি’তে, এক আলোচনায়, একজন পড়ুয়া, প্রাজ্ঞ, তথাকথিত সাহিত্যবোধ থাকা মানুষ যখন বলেন, যে, রাতে ঘুম না পেলে অনেকেই ‘সিরিয়াস’ কিছু না পড়ে অপরাধ/গোয়েন্দা/রহস্য কাহিনী হেন ‘হাল্কা’ পাঠবস্তুই পড়তে পছন্দ করেন। - এ হালের কথা। আরো আগে সুনীল গাঙ্গুলীর কোনো লেখায় ছিল, যে, ট্রেনে-প্লেনে যেতে সময় কাটানোর জন্য ( অর্থাৎ টাইম কিল্‌ করার জন্য) সিমোনো-উপন্যাস লাজবাব। - এটি বোধহয় সিমোনোর ‘প্রসংশা’ করতে গিয়েই বলা। অর্থাৎ আমার বয়স যখন ১৬-১৭ ছিল তখনো অপরাধ/গোয়েন্দা/রহস্য কাহিনী কে যেভাবে দেখা হতো, অদ্য, ৪৮ বছরে পা রেখেও দেখছি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি পাঠক সমাজের অথচ রহস্য-কাহিনীকে ‘ফর্ম’ হিসেবে ব্যবহার করে জীবন ও জগতের গহনতর সংকট, দ্বন্দ্ব, উত্তরন-পথের সন্ধান করবার কাজটিতে Stieg Larsson, Qiu Xiaolong  হেন লেখকজনেরা এসেছেন। অনেক পাঠকই তাঁদের রচনাও পাঠ করছেন “ঘুম না পেলে হাল্কা কিছু” পড়বার আমেজে! প্রাজ্ঞ পাঠকেরা কি ভুলে গিয়েছেন যে দস্তয়ভস্কির “ব্রাদার্স কার্মাজভ” বা আন্দ্রে জিদের “কাউন্টারফেটার্স” , উমবের্ত একোর “নেম অফ দ্য রোজ”, “ফুকোজ্‌ পেন্ডুলাম” বা হালের Roberto Bolaño র The Savage Detectives – এ সমস্তই অপরাধ/ রহস্য/গোয়েন্দা কাহিনীর ‘ফর্ম’টিকে ব্যবহার করে জীবনের, যাপনের নানামাত্রিক উন্মোচনের চেষ্টা?

 

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

০৭/১১/২০২০

বেঙ্গালোর

ঘুম ঘর