ফেরা
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
… … তারপর
বিমান চালকের কন্ঠে ঘোষিত হলো – আর আধঘন্টার মধ্যেই এই বিমান স্পর্শ করবে বেঙ্গালোরের
মাটি।
… মাটি না’কি রাণওয়ের পিচ? নাকি এই হঠাৎই ‘শহর’ থেকে
‘নগর’ হয়েওঠা মানচিত্রের কোথাও রয়েছে মাটি? যে ‘মাটি’ – ‘মা’, ‘মা-টি’? আমার মাটি?
মাটি ঢেকেছে সিমেন্টে। তার উপরে, শূন্যে, দুলছে, ঝুলছে আমার, আমার মতো অনেক পলাতকের
‘ফ্ল্যাট বাড়ি’। এই ঝুলে থাকবার দাম মেটাতে প্রতিটি সকাল বিবর্ণ অফিসযাত্রী, প্রতিটি
বিকাল অফিস-ক্যান্টিন, থুড়ি, ‘কাফেটেরিয়া’, প্রতিটি সন্ধ্যা হর্ণ’এ, শিং’এ , যানজটে
এসি গাড়ি, প্রতিটি রাত্রি সোডিয়াম বাতিতে জ্বলেওঠা, প্রতিটি রাত্রি তারাহীন …
প্রতিটি
দিনে-রাত্রে একই ভাবনা কবে? কবে যাবো স্বদেশে? মাটিতে? … যেন সেই বাঁশুরিয়া … সুমন চাটুজ্জে’রঃ “ঠেলা
ভ্যান চালাও তুমি কিংবা ভাড়া গাড়ির ক্লিনার
ক বছরে একবার
যাও তোমার দেশে নদীর কিনার
ফাঁক পেলে
বাঁশি বাজাও ফেলে আসা ঘরের ডাকে” …
তফাৎ এই,
যে, আমার বাঁশি নেই। ‘ফেলে আসা ঘরের ডাকে’ আমার অশ্রুই আমার অক্ষর অথবা আমার অক্ষরই
আমার অশ্রু। … তারা, তারার ভিড় রাত্রির আকাশে, কালপুরুষ, সপ্তর্ষি মন্ডল … আমাদের বাড়ির,
দেশবাড়ির ছোটো উঠোনের থেকে দেখেছি, এবারো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। অনেক অনেক অনেক তারা দেখেছি
জোনাকের বাড়ির পেছনের মাঠে দাঁড়িয়ে। যদিও জোনাকের বাড়ি ঘিরে, বাড়িত পেছনের মাঠ ঘিরে
উঠে আসছে অতিকায় সমস্ত বিল্ডিং-দানব তথাপি দেখাযায় তারা, অনেক অনেক তারা, অদ্যাপি …
আঠারোটি
দিন ফুরিয়ে গেলো, হারিয়ে গেলো, ভেসে গেলো লঙ্গাই, কুশিয়ারা, বরাক, জিরি, চিরি’র জলে।
যেন সেই এক’টা বেজে দশ মিনিটে, দুপুরে, গান শিলচর রেডিওতেঃ “আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে
কখন অন্য মনে …” … এই ফুরিয়ে যাওয়া এক হাহাকার। তথাপি, সেই হাহাকারের আবডালে কোথাও
কি, কখনো কি বাজেনি ভিন্ন সুর? এই ‘ব্যাঙ্গালোর-দেশে’, এই ‘মাটিহীন গ্রহে’, এই মাটিহীন
গ্রহের এই দোল্যমান খোপ-বাসায়? পার হয়ে আসা আট চল্লিশটি বছরের কুড়িটি বছর কেটেছে যেখানে,
সেখানের অভ্যাসে, অভ্যস্ততায়? আবার মনে আসে সুমনের ওই গানটিই, তারই আরেক পংক্তিঃ “
দেশে গিয়ে এমন সুরে হয়ত ডাকো কলকাতাকে” …
হ্যাঁ, এই বাস্তব। এই বাস্তুহীনের বাস্তবতা।
অচিন্ত সেনগুপ্ত
লিখেছিলেন ‘উদ্বাস্তু’ শব্দের ছায়ায় দাঁড়ানো মানুষদের “কেউ উৎখাত ভিটেবাড়ি থেকে, কেউ
উৎখাত আদর্শ থেকে”। আদতে “আদর্শ” বলে কিছু নেই। থাকতে পারেনা। প্রতিটি শ্রেণী তার নিজের
স্বার্থটিকে স্তাপন করবার নিমিত্ত নির্মাণ করে এক মহাকাহন যার নাম “আদর্শ”। তথাপি তারাই
নয় উদ্বাস্তু যারা ‘উৎখাত ভিটেমাটি থেকে”। আমি, আমরা – আমাদের ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছি।
হয়তো সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় নয়, যাপনের তাগিদে, দরকারে তবু আমরা ‘উদ্বাস্তু’, তবু আমি
‘উদ্বাস্তু’ কেননা আমার, আমাদের উৎখাত হয়েছে “জিজীবিষা” নামক শব্দের থেকে। পরিবর্তে
আমরা বেছে নিয়েছি “টিঁকে থাকা”কে। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ছায়া হয়ে গিয়েছে এই দ্বন্দ্বঃ
“ ফাঁক পেলে বাঁশি বাজাও ফেলে আসা ঘরের ডাকে
দেশে গিয়ে
এমন সুরে হয়ত ডাকো কলকাতাকে”
এই ‘বাঁশুরিয়া’,
গ্রাম গ্রামান্তর থেকে এই সমস্ত নগরে, বন্দরে ‘টিঁকে থাকতে আসা’ সংখ্যাতীত দেহাতি মজুর
– ‘ঘরের ডাকে’ নদীর ডাকে ফিরে ফিরে ঘরের দিকে, নিজ মৃত্তিকার দিকে গেলেও কি তার সংস্থান
বাঁচার? সংস্থান সেই অর্থে আমারো নেই। আমাদেরো নেই। আবার আছেও। আছে কেননা আমরা নিম্নবিত্ত
নই। উচ্চ বা নিম্ন ‘মধ্যবিত্ত’। আমার যে সকল সমপাঠীরা, বন্ধুরা, দাদারা এই দেশগ্রামেই
রয়েগেছে তারা সকলেই উচ্চ বা নিম্ন ‘মধ্যবিত্ত’। তারা সকলেই কি মৃত নাকি প্রেত? না।
তাদের অনেকেই আমার চেয়ে, আমাহেন সংখ্যাতীত পলাতকের চেয়ে বেশী জীবিত। …। হ্যাঁ, তাদের,
তাঁদের অনেকেরই মনে আছে এই ধারণা, যে, “এখানে? এই বা এই রকমের প্রত্যন্ত মফস্বলে? নো,
নেভার! কোনো ‘লাইফ্’ নেই! কিস্যু নেই!” – তাদের ধারণায় আমি বা আমাহেন পলাতকেরা বিরাট
‘সফল’! হাঃ! ‘সফল’! হায় ‘সাফল্য’! – তবে দোষ তাদেরো নেই। কয়েক প্রজন্ম ধরে এই বাণিয়া
বিশ্বব্যবস্থা মধ্যবিত্ত জনমানসে খোদাই করে দিয়েছে, মুহুর্মুহু দিচ্ছে - এক বিকৃত জীবন-স্বপ্ন
যা শেখায় পালিয়ে যেতে, যা আদতে বলে ‘গরম কড়া’ থেকে ‘আগুনে ঝাঁপাতে’ যে আগুন কে তারা
শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের মোড়কে রেখেছে বিজ্ঞাপনের দ্বারা, সংবাদের দ্বারা, প্রচারের দ্বারা।
আদতে তারা চায় আমাদের আমূল, আমর্ম উৎখাত আর সেই সুযোগে তোমার, আমার ‘গরম কড়াই’, আমেজের
মাটির উনুন, উনুনের নিচের ভিটে সমস্ত উপড়ে নিয়ে সে ফেঁদে বসেছে, বসছে, বসবে আরো বড় ‘ধান্দা’,
আরো বড় মুনাফা। আর আমরা, পলাতকেরা, শরণার্থীরা আমরণ দগ্ধে মরব ‘ঘর’ আর ‘কলকাতা’, দেশগ্রাম
আর বেঙ্গালোর-বোম্বে-আমেরিকা-ইংলন্ডের দ্বন্দ্বে…
তবু ‘বাঁশুরিয়া’
তুমি ‘ফাঁক পেলে’ই বাজিয়ো তোমার ‘গেঁয়ো সুরের বাঁশি’ – কেজানে হয়তো ওই বাঁশির সুরেই
আমরা একদিন প্রত্যাখ্যান করব ‘পলায়ন’কে, ঘুরে দাঁড়াবো … আর ততোদূর যদি নাইবা পৌঁছানো
যায় এক জীবনে তথাপি তোমার ঐ বাঁশির সুরে আমার মতন অনেক অনেক অনেক পলাতক, তোমার মতন
অনেক অনেক অনেক অনেক শরণার্থী বেঁচে নেবে অন্ততঃ কয়েক মিনিট, কয়েক মুহুর্ত্ত …