প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Wednesday, July 7, 2021

দৈত্যের বাগান আর লালকমল-নীলকমলের গল্প

দৈত্যের বাগান আর লালকমল-নীলকমলের গল্প

...তারপর থেকেই সেই দৈত্যের বাগানে বন্ধ হলো বসন্তের আসা যাওয়া। তারপর থেকে দৈত্যের বাগানে শীত,শুধু শীত। শুধু বরফ। শুধু মরা পাতা। গল্পটা সবারই জানা।

হিংসুটে দৈত্য তার বাগানের দোর বন্ধ করে দিয়েছিল। তাড়িয়ে দিয়েছিল সেখানে খেলতে আসা শিশুদের। তাতেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বসন্তের, পাখিদের, তূলো তূলো শাদা মেঘেদের আসা, দৈত্যের বাগানে। ... গল্পের খাতিরে লেখক অস্কার ওয়াইল্ড ভেঙ্গে দিয়েছিলেন দৈত্যের বন্ধ দরজা। তাকে নিয়ে গিয়ে ছিলেন আরেক অন্তহীন উদ্যানে। কিন্তু বাস্তবের দৈত্যেরা নয় অস্কার ওয়াইল্ড এর প্রতীকী দৈত্য আর সত্য এ'ও যে বাগান, উদ্যান, পার্ক সমস্তই সেইসব দৈত্যদের দখলে যারা রক্তমাংসের, যারা সমস্ত নিঙ্গড়ে -- সৌন্দর্য, কদর্য, মৃত্যু, জন্ম -- সমস্তই নিঙ্গড়ে পরিণত করতে ব্যস্ত - মুদ্রায়, রূপায়, সোনায়। হায়, এরা জেনেও জানেনা, যে, তাদের হাতের বিষাক্ত ছোঁওয়ায়, একদিন, সেই রাজা মিডাসের মতোই, তাদের সন্ততিরা, তাদের উত্তরপুরুষেরা হয়ে যাবে সোনা। নিষ্প্রাণ সোনা। ... হোক্‌, ক্ষতি নেই। এমন সব দৈত্যেরা যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় নিজেদের লোভের হাতেই তাহলে মঙ্গলই হবে পৃথিবীর। কিন্তু তা'তো নয় হওয়ার। তাদের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও, আমরা - যারা সোনা নিয়ে নয়, রক্তে মাংসে চেয়েছিলাম বাঁচতে তারাও যে মুছে যাবো সেইসব লোভী দৈত্যদের লোভে, পাপে ...

এক একরত্তি মফস্বল শহরে ছিল এক বাগান। এক পার্ক। একটি বিরাট দিঘিকে ঘিরে। একদল গাছ আর কিছু সিমেন্টের বেঞ্চি ছাড়া আর কিছুই না থাকলেও সে'ই ছিল মফস্বলের এক মহাসম্পদ। বেশ কয়েক প্রজন্মের। সেখানে হাঁটাহাটি, আড্ডাবাজি সে সমস্ত ছাড়াও জমায়েত -- রবীন্দ্রজয়ন্তী, পথনাটক -- মাঝে মাঝে। দুটি চারটি কলেজডানা ছেলেমেয়ে বিশ্বজোড়া পাহারাচোখ এড়িয়ে ... মাঝে মাঝে ... আমিও, কলেজপালানো দুপুরে, মাঝে মাঝে, সিমেন্টবেঞ্চিতে বসে চেয়ে দেখতাম সূর্যের স্থানাঙ্ক বদলের সঙ্গে সঙ্গে, সেই দিঘি, সেই 'শম্ভূ সাগরের' রং-বদল। সমুদ্রের নেশায় মাতাল সেই যুবকের মতো আমি বলতে পারবোনা 'Call me Ishmael' কিন্তু সাগর নয়, শম্ভূ সাগর পাড়ের সেই দুপুরগুলির দিকে ফিরে তাকিয়ে আমার মনে আসছে 'মবিডিক' শিকার-যাত্রা'র লিপিকারজনের কথাইঃ

"...look! here come more crowds, pacing straight for the water... Strange! Nothing will content them but the extremest limit of the land ...Say, you are in the country; in some high land of lakes. Take almost any path you please, and ten to one it carries you down in a dale, and leaves you there by a pool in the stream. There is magic in it. "

এই যাদু জলের জাদু। জলের দিকে চেয়ে বসে থাকবার যাদু। যে যাদুর টানে অনেক অনেক বৈকাল কেটেছে কুশিয়ারা-লঙ্গাই'এর জলশরীরে দৃষ্টি ভাসিয়ে দিয়ে ...

    জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখনো নিজেই সেই মবিডিক-শিকারী দলের ইসমাইল, কখনো আলেকজেন্দার সেলকার্ক, কখনো রবিনসন ক্রুশো ...। হ্যাঁ, সেই নটীখাল,লঙ্গাই,কুশিয়ারা,শম্ভূ সাগর -

আমার, আমাদের অনেকেরই মর্মে, তখনো ছিল 'সাগর', এখনো তা'ই। তার কারণ হয়তো, যেমন বলেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি'তেঃ উপকরণ প্রচুর থাকিলে মনটা কুঁড়ে হইয়া পড়ে; সে কেবলই বাহিরের

উপরেই সম্পূর্ণ বরাত দিয়া বসিয়া থাকে, ভুলিয়া যায়, আনন্দের ভোজে বাহিরের চেয়ে অন্তরের অনুষ্ঠানটাই গুরুতর। শিশুকালে মানুষের সর্বপ্রথম শিক্ষাটাই এই। তখন তাহার সম্বল অল্প এবং তুচ্ছ,

কিন্তু আনন্দলাভের পক্ষে ইহার চেয়ে বেশি তাহার কিছুই প্রয়োজন নাই। সংসারে যে হতভাগ্য শিশু খেলার জিনিস অপর্যাপ্ত পাইয়া থাকে তাহার খেলা মাটি হইয়া যায়"। ... এই ন্যালাখ্যাপা মফস্বলের ওই

এক টুকরো 'সাগর' আর এক খাবলা 'পার্ক' ঘিরে রেখেছিল আমাদের কৈশোর থেকে যৌবনকেও। যে সকল বয়স্কদের দেখেছি, হেঁটে বেড়াতে, বিকালে, এই পার্কে, আজ মনেহয় যদি জেনে নিতে পারতাম

তাঁদের জীবনে এই এক টুকরো 'সাগর' আর 'উদ্যানের' ভূমিকাটি ...

ছোটো মফস্বল। আরো ছোটো টুকরো পার্ক। ঠিক। তবু আমরা ছিলাম ভাগ্যবান কেননা আমাদের পার্কে ছিলনা, সুমনের 'পাড়ার ছোট্ট পার্কের' বিষাদী-হাহাকারঃ

"রেলিং এ শুকোয় শাড়ী পাঁচিলে শুকোয় ঘুঁটে / ঘাস গুলো সব শুকিয়ে শুকিয়ে শেষ-মেশ গেছে উঠে / পাড়ার ছোট্ট পার্ক ঘাস নেই আছে ধুলো / ঘাসের অভাব পরোয়া করে না সবুজ বাচ্চা গুলো "

আমাদের পার্কে সবুজ ছিল। হেমন্তে হলুদ। শরতে নীল মেঘ দাঁড়িয়ে, ছায়া লিখে দিতো শম্ভূ 'সাগরের' জলে।

মধ্যে শম্ভূ সাগরকে রেখে দু দিকে পার্ক। আর দুই দিকে রাস্তা। একদিকে বড় রাস্তা। আরেক দিকে গলী। গলীর প্রান্তে বাড়ি সেই একমাত্র ডাক্তারবাবু'র যাঁকে প্রয়োজনে অনুরোধ জানালে, দিনে, দুপুরে, মধ্যরাতেও মূর্তিমান সহায় হয়ে হাজির হতেন রোগীর বাড়ি -- তাঁর মস্ত 'ভট্‌ভটি' হাঁকিয়ে। পার্কের আরধারে আবক্ষ রবীন্দ্রমূর্তি। শ্বেতশুভ্র। আমি আর তিষ্টুদা একবার তাঁর কাছেই আবেদন জানিয়েছিলাম রাত্রে লেখা দেওয়াল লিপিতেঃ "এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না ... আমার দেশ কে আমি ফিরে কেড়ে নেবো" ... মনের কোনোখানে, তখনো জানতাম, আজো জানি, যে 'দেশ' 'মৃত্যু উপত্যকা' -- সে নয় কারোরই দেশ, রবি ঠাকুরের তো না'ই।

...... তারপর ... তারপর ... পেটের ধান্দায় ...পালিয়ে গেলাম। পালিয়ে গেলাম সেই মফস্বল থেকে যে মফস্বল 'শহর জানে আমার প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন, প্রথমবার ফেল ..." , জানে "আমার প্রথম সব কিছু"। তবু যখনই এসেছি দেশগ্রামে, অন্ততঃ একবার গেছি সেই 'পার্ক'কে দেখতে, জিগিয়ে নিতে 'কেমন আছো, হে আমার মর্মের পদ্মা নদী, হে আমার ময়নাদ্বীপ ..." ... হানা দিতাম ছোট্ট সেই পান-বিড়ি-আচারের দোকানে -- যাকে বলতাম 'দাদুর দোকান'...।

তারপর?

তারপর একদিন এসে দেখি সেই টুকরো ময়নাদ্বীপটি বন্দী। শেকল ঘেরা। শুনলাম দৈত্যেরা দখল নিয়েছিল। বলেছিল 'টিকিট লাগবে', আয়োজন করেছিল কিছু খেলনাপাঁতির আর সেগুলির লোভ দেখিয়ে করে নিতে চেয়েছিল 'টু পাইস্‌' আর তারপর শেকলে পড়েছিল তালা। আর কেউ পারবেনা ঢুকতে। দানবের আদেশ। ঢুকতে পারনেনা শিশুরা, কিশোরেরা,যুবকেরা,'উদ্বাস্তু' প্রেমিক-প্রেমিকারা, তিন কূল হারিয়ে ফেলা নিঃসঙ্গ বৃদ্ধেরা! হায়! ঢুকতে পারবেনা কোনো রঙ, কোনো পাখি, আসতে পারবেনা বসন্ত! আর সেই সমস্ত না আসার মূল্যে এই ধূসর মফস্বলের সবার মন থেকে ক্রমে ক্রমে মুছে যাবে 'ময়নাদ্বীপ', হারিয়ে যাবে স্বপ্ন দেখানো "হোসেন মিয়া' ঠিক যেমন হারিয়ে গেলেন সেই বৃদ্ধ বেলুনওয়ালা যাঁর বেলুন মানেই 'ভুবন পাহাড়ের ময়না' ... তবে তাঁকে তো ডেকে নিয়েগেছে কাল, মহাকাল, কিন্তু এই 'ময়নাদ্বীপ'? এ'র দখল নিয়েছে দৈত্যেরা! ...

কিন্তু এ'ও ঠিক, যে, সব দানবের, সব দৈত্যের গল্পের শেষেই তাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে হয় লালকমল-নীলকমলের তলোয়ারে, বর্শায়।

আমি নিশ্চিত, এই ছোট্ট মফস্বলের ছোট্ট পার্কটিকেও দানবের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনবে এই শহরেরই লালকমল-নীলকমলের দল!

আমি তো পলাতক। অক্ষরের শুভেচ্ছা ছাড়া,তাদের কে, এই লড়াই এ, কি আর জানাতে পারি...

 

৭/৭/২০২১

বেঙ্গালোর

-------

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ঘুম ঘর