অরণ্যদেবতা ও অন্যান্য উপকথা
অরণ্যদেবতা ও অন্যান্য উপকথা
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
[ রচনাকাল ২০১৪ -২০১৯]
যাত্রা
মনেপড়ে প্রথম সাঁকোটি?
মর্মে খোদিত থাকে।তাকে
পার হয়ে যাওয়া কিংবা
তার
ভেঙ্গে যাওয়া
জলরং ছবিহেন
মনে আসে
পেরোতে
পেরোতে
শেষ সাঁকো
অনতিদীর্ঘ এই অতীর্থযাত্রার।
শুধু তুমি জানোনা যে
এই হল শেষ সাঁকো
অনতিদীর্ঘ এই অতীর্থযাত্রার।
আলোকদার বাড়ি
আমরাও একদিন আলোকদা’র বাড়ি গিয়েছিলাম। ইস্টিশান থেকে ট্যাক্সি, নেমে শেয়ার-অটো তারপরে রিক্সা। রিক্সায় চেপে দোকানপাট, ঘরগেরস্থি, লোকজন, পুকুরঘাট – এসব দেখতে দেখতে শীত আর বসন্তের মাঝামাঝি, সকালের পরে, দুপুরের খানিকটা আগে,পৌঁছে গিয়েছিলাম আলোকদার বাড়ি। “কতো দূরের থেকে আসছো, সঙ্গে আবার দুটি কচিকাঁচা” –বৌদি বল্লেনঃ “ওদের খাইয়ে নাও। সঙ্গে তোমরাও একটু একটু। তুমি চলো রান্নাঘরে, আমার সঙ্গে। ও আর ওর ‘আলোকদা’ গল্প করুক বসে বসে।
অগুনতি বছরের শিশু বটগাছটির ঝিলিমিলি পাতাদের মতো কথা বল্লেন আলোকদা। সুখের কথা, দুঃখের কথা, রঙের কথা, সাদাকালো আর ইস্টম্যান কালারের কথা। কবিতার কথা। বল্লেন গদ্যের কথাও। জানালেন জবা গাছ, জুঁই গাছ আর পেয়ারা গাছেদের অন্তর্গত উতল নির্জনের অসংখ্য সংবাদ। আমার সাত বছর বয়সী ছেলেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য বল্লেন ভূতের গল্পও। এই সব কথা আর গল্পদের আড়াল-আবডালে আলোকদার জানলাগুলি দিয়ে এসে পড়ল একটি দুপুর তার সমস্ত আশ্চর্য নিয়ে, নক্সাদার মেঝে আর আলপনা নিয়ে। শীতের পাখিরা বসন্তের আকাশের দিকে লিখে দিলো তাদের নিরন্তর ওড়া। রান্নাঘর থেকেও উড়ে এলো নিমন্ত্রণ।
নিমন্ত্রণের ভিতরে সার সার পিঁড়ি পাতা। খেতে খেতে আরো কথা হলো। খাওয়া শেষ হলে আরো আরো কথা। শেষ না হওয়া আর না বলতে পারা কথাদের ঘিরে এক সময় নেমে এলো সেই স্বাভাবিক নীরব যাকে চালচিত্রে রেখে বেরিয়ে পড়তে হয় আবার।
আমরাও বেরিয়ে পড়লাম আলোকদার বাড়ি থেকে। বৌদি বল্লেন “আবার আসবে”। একটি বই দিলেন আলোকদা। “আশ্রয়ের বহির্গৃহ। লিখে দিলেনঃ “শ্রীমতী মধুশ্রী বিশ্বাস শ্রী সপ্তর্ষি বিশ্বাস শ্রী অর্ঘ্য বিশ্বাস শ্রী অর্চিতা বিশ্বাস সবাইকে আলোক সরকার ১১ই এপ্রিল ২০০৯”।
ইদানীং ২০১৯ সাল। অর্থাৎ দশ বছর হতে চল্লো আলোকদার সঙ্গে প্রথম দেখার, শেষ সাক্ষাৎকারের।
কোথাও কি লেখা রইলো আলোকদার বাড়ি গিয়েছিলাম আমরাও একদিন?
"রঙ দে চুনারিয়া"
“শ্যাম পিয়া মোরি রঙ্ দে চুনারিয়া”
প্রিয়,
এ হৃদি রাঙ্গিয়ে দিয়ে যেয়ো
নীরবের সুরে আর গানে।
মোছেনা এ রঙ আর যেন
লক্ষবার যমুনা-সিনানে।
প্রিয়,
এমনি গহিন রঙ দিয়ো
যেন ডুবে ভেসে যেতে পারি
মর্মগত রঙের কাননে।
#
যদি না রাঙ্গিয়ে যাও, তবে
স্থানুবৎ প্রতীক্ষায় রব
আমরন, পথের কিনারে …
মীরা আমি নই সখা,রাধা নই।
আমার নাগর নয় কালিয়া কি শ্যাম–
হে সুদূর, তুমি প্রিয় মোর,
এ আখরগুলি আমি
তোমাকে দিলাম।।
পরাজিত, পরিচিত স্বর...
সমস্ত ভাঙ্গার আগে ভেঙ্গেপড়ে 'অটুট' বিশ্বাস।
তবুও অভ্যাসবশে পরিক্রমা,স্তুতি, প্রদক্ষিণ -
করণিক, জলদস্যু, গৃহবাসী অথবা সন্ন্যাসী
প্রতিভোরে জেগে দেখে আরো একটি দিন
এরকমই অবিশ্বাসী, প্রতারক, দাহ্য, নিরীশ্বর।
সমস্ত ভাঙ্গার আগে তাই ভাঙ্গে অন্তরালে
'অটুট' বিশ্বাসে গড়া পূজাবিধি, পুজিত ঈশ্বর।।
সকল ভাঙ্গার শেষে বিশ্বাসের ভেলাটি পুড়িয়ে
যে একা দাঁড়াতে পারে মশানের পার্শ্ববর্তী মাঠে
তারি মর্মে শুধু বাজে নিজের শোণিতে গড়া
প্রাণবন্ত ঈশ্বরের পরাজিত, পরিচিত স্বর।।
অরণ্যদেবতা
“আমাদের অরণ্যদেবতা ভালুক চরান। সূর্য, বিরাট সূর্য, তালদিঘিটির চেয়েও বিরাট আর গোল,
সোনা দিয়ে গড়া আগাগোড়া, আমাদের অরণ্যদেবতা
ভালুকদলের কাঁধে তাকে তুলে
রেখে যান রোজ, ভোরবেলা,
আমাদের এ বনের শিয়রে।
এইভাবে ভালুকেরা অরণ্যদেবতার
সহযোগী বহুকাল ধরে। এভাবেই
মৌমাছিও সহযোগী মানুষের, অরণ্যদেবতার বরে
বহুযুগ ধরে, আমাদের বনের মানুষ
ভালুক শিকার করে তবুও, কেননা
আমাদের অরণ্যদেবতা অনেক অনেক যুগ আগে
অনুমতি দিয়েছেন আর বলেছেন প্রত্যেক শিকারীজনই
শিকার করতে পারে
ঠিক ঊনচল্লিশটা ভালুক। তারপরে
প্রতিজন শিকারীর কাছে একজন ভালুক আসবে
দুঃসাহসী,উগ্র আর দীর্ঘ, বলশালী। তাকে যদি
শিকারীটি আক্রমণ করে তাহলে শিকারীটির
মরণ নিশ্চিত। অন্যথায় অরণ্যদেবতার
ভালুক আর থাকবেনা তালদিঘিটির চেয়েও বড়,গোল,
সোনা দিয়ে গড়া সূর্যটিকে বনের শিয়রে রেখেযেতে”। - ধীরে ধীরে, থেমে থেমে
এতোদূর বলে নিয়ে বৃদ্ধাজন থামে। দম নেয়। যদিও সে মহিলা তবুও ঊনচিল্লিশজন
ভালুক শিকার করেছে সে নিজের যৌবনে। তার কুটিরের জানলা দিয়ে উড়ে আসে আরণ্যক হেমন্তের হাওয়া। কূপীর আগুনশিখা কাঁপে।
যুবক ম্যাক্সিম গোর্কি একদৃষ্টে দেখেন
বৃদ্ধাকে। বৃদ্ধা ফের, বলে, বলে যেন
নিজমনে, বলে নিজেকেইঃ “ প্রতিজন পুরুষের জীবনেও আসে চল্লিশতম সেই ভালুকের মতো
অকস্মাৎ একজন নারী, প্রথম, তৃতীয় কিংবা নবম, দশম – যাই হোক, প্রতিজন পুরুষের জীবনেও আসে চল্লিশতম সেই ভালুকের মতো
অকস্মাৎ একজন নারী, আসে সেও অরণ্যদেবতারই
অমোঘ আদেশে। সেই হয় ওই পুরুষের
শেষতম নারী। সে নারীর মাদক যাদুতে
পুরুষটি অন্ধ হয়ে গিয়ে দৃষ্টি ফিরে পায় সেই
নারীটিরই চোখের আলোতে। তারপর সে পুরুষ আর
পালাতে পারেনা। সে এই নারীকে নিয়ে
নির্মাণ করে গৃহ, সাজায় সংসার – অরণ্যদেবতার
নির্দেশে অথবা আদেশে। কেননা প্রতিটি গৃহে, প্রতিটি
উঠানে ক্রীড়ারত শিশু দেখলে তৃপ্ত হন
অরণ্যদেবতা। বলি হে ছোকরা, শোনো,
তোমাদের বইপুঁথি, গীর্জা, মসজিদে কিংবা মন্দিরে
এরকম দেবতা আছেন?” – বুড়ি থামে। শনের মতন
চুলগুলি তার পাখিদের মতো ওড়ে হেমন্তবাতাসে।
যুবক ম্যাক্সিম গোর্কী দেখেযান কুটীর আর বৃদ্ধাকে ঘিরে নেমে আসে যুগান্তের দাহ্য অন্ধকার।
কবিকথা
১।
একটি মানুষ চলে গেলে
নদীতীরে পড়ে থাকে তার
ব্যবহৃত মুখগুলি আর
স্মৃতি, তৃপ্তি, বাসনার হাড় ।
ধীরে ধীরে মুছে দেয় সবই
বহমান নদীর অঙ্গুলি।
একজন কবি চলে গেলে
দৃশ্যাতীত ঘাসের উষ্ণীষে
থাকে তাঁর অনুধাবনীয়
লিপিগুলি। প্রলয়েরও শেষে –
২।
‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি’।
কবি নয়। যশোলোভী।
সন্ন্যাসীর ভেক্ধারী গুপ্ত মর্ষকামী।
‘সকলেই কবি নয়’। সকলেই
নানাবিধ বাহবা প্রত্যাশী।
...এবং কবিকে দেখো
কি সহজে মিশে গিয়ে চিতার আগুনে
বিভূতিভূষণবেশে ফিরে এসে
কোনোরূপ আতিশয্যহীন
দাওয়ার রোদ্দুরে বসে ঝালমুড়ি ভাগ করে খান
সুকুমার, আমি আর কৌশিকের সাথে ...
রচিত অক্ষরগুলি চিতার বাতাস লেগে ওড়ে ঘরময়...
মহাকাল সে অক্ষরে দেখি
গাঁথেন নিজের মালা – একা – নিজহাতে।।
[প্রণাম কবি বিকাশ দাশ]
যাপনে ছুটির দিন
পরপর তিনদিন ছুটি। শনিরবি যথারীতি। শুক্রবার কালীপূজো
অথবা দেওয়ালি। সব মিলে শরৎ-হেমন্তের মাঝামাঝি
বাহাত্তর ঘন্টা জুড়ে ছুটি। ভেবেছো বাগান করবে, হেমন্তের ফুল
ফোটাবে ব্যালকনি-টবে, রংতুলি নিয়ে
এঁকে রাখবে স্বপ্নেদেখা সান্ধ্য পথটিকে, গাঁয়ের মেলাতে যাবে
কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে, ফুচকা-জিলিপি খাবে, গ্যাস বেলুন কিনে
আনন্দিত ভাসাবে আকাশে। জানালার পাশে বসে বসে
পড়ে শেষ করে ফেলবে চার খন্ড “জন ক্রিস্টোফার”। নানা রঙ
উল দিয়ে বুনে তুলবে কারো জন্য রামধনু। রামধনুরঙ্গা
সোয়েটার। দেখো আজ গীর্জাঘড়ি গড়িয়ে গড়িয়ে
শুক্রশনি পার হয়ে ক্রমে ঝরে যাচ্ছে রবিবার
বিকালের নাভি পারহয়ে অথচ ব্যালকনি-টবে
হেমন্তের ফুল ফুটলোনা। এক্রাইলিক
শুকালো ইজেলে। বাহাত্তর ঘন্টা দেখো বাহাত্তর শতাব্দীর মতো
ডুবে গেলো যাপনের বহুতল টিলার আড়ালে।
যাপনের ছুটিদিনগুলি এভাবেই নিভে গেছে, নিভে যায়, আর
গীর্জাঘড়িটি তবু বলে চলে “ছুটি হোক,
ছুটি হোক – আবার – আবার” –
স্টেশনবাবুর মেয়ে
দূরপাল্লার ট্রেন থেমেছে ছোট্ট ইস্টিশনে।
বিকাল হারায় লাগিয়ে দিয়ে
"হলুদ বনে বনে"।
দু'এক মিনিট থেমে থাকার ফাঁকে
দু'একটি লোক নামে। আমার জান্লা থেকে
একটি বাড়ি,টালির,দেখি
হাঁটাপথের দিকে।
কোত্থেকে এক সত্যি ময়ূর এসে
পেখম ছড়ায় টালির বাড়ির
চিলতে বারান্দাতে।
ট্রেন ছেড়েযায়, তক্ষুনি,হায়,
এই ছবিটি ছিঁড়ে।
সন্ধ্যা ঘনায়, শিরীষশাখায়
চাঁদ ওঠে লাফ দিয়ে।
কে পোষে ওই ময়ূর, ভাবি,
স্টেশনবাবুর মেয়ে?
প্রতীক্ষা
প্রতিটি শব্দের গায়ে ছায়া পড়ে তোমার যাওয়ার।
প্রতি শব্দ ঘড়ি দেখে, পথ চায়
তোমার আসা'র।
প্রতি শব্দ, প্রতিশব্দ
ধ্বনি হয়ে, প্রতিধ্বনি হয়ে
তোমার যাওয়ার পাশে বেজেওঠে
গীর্জাঘড়িতে।
আগের বসন্তে তুমি
শব্দদের এ দেশে এসেছিলে,
এ বছর শীতে, ভাবি,
আসিবে আবার?